বিশ্বায়নের যুগে কবিতা

কৈশোরের (ষাটের দশকের শেষার্ধে) বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রিয় শিক্ষক জীবনজুড়ে শেখার মন্ত্র দিয়েছিলেন। পাঠক্রমের অতিরিক্ত পড়াশোনার যে-আগ্রহ জন্মেছিল, তার নেপথ্যে শ্রদ্ধেয় সেই শিক্ষক অমলবাবুর অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। পরবর্তীকালেও এরকম কিছু শিক্ষকের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, যাঁদের কাছে আমি কখনো বিদ্যায়তনিক পাঠ নিইনি। এরকম এক বিদ্বজ্জনের একটি কথা আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে  কার্যকারিতা দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে পেছন ফিরে হাঁটলে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। সাহিত্যজগতের চারদিকে অতীতচারণার আধিক্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ-কথা বলেছিলেন। অবশ্য আরো একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য – প্রমথ চৌধুরী একবার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে প্রাচীন ও সমসাময়িক বিষয়ে সমান আগ্রহী।

আজ যে-বিষয় আলোচনা করতে চলেছি তার শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের কথাও বেশিরভাগ জুড়ে থাকবে, থাকবে তত্ত্ব-ধারণা-তথ্য-অনুমান-বিশেস্নষণ-মতামত। এই বাংলা যেহেতু প্রথমত কবিতার মুক্তাঞ্চল, তাই বিশ্বায়নের আবর্তে কবিতার কী হাল হচ্ছে ও হতে পারে আর কবিদের কী মহান ভূমিকা প্রত্যাশিত, তা নিয়ে এক চাপানউতোর কসরত!

বিশ্বায়নের স্বরূপ

শুরুতে আমরা বিশ্বায়ন ব্যাপারটা কী তাকে একবার প্রয়োজন-সাপেক্ষেক অর্থে বোঝার চেষ্টা করি। আমরা বলতে পারি যে, বিশ্বায়ন হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়া যা জাতি-রাষ্ট্রের সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং সামগ্রিকভাবে জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। কিন্তু কোন কোন সম্পর্ক? শুধুই কি বাণিজ্য?

এ-প্রসঙ্গক্রমে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বহুমাত্রিকতা সামনে চলে আসে – বিশ্বব্যবস্থায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক ও যোগাযোগের উপর্যুপরি ক্রিয়াকলাপ চলতে থাকে। এই সূত্রে, দর্শনগতভাবে বিশ্বায়নকে চিহ্নিত করা যায় : ক. বিশ্বজুড়ে উন্মুক্ত বাজার – অর্থনৈতিক ঐক্যবন্ধন – একনিয়মানুসারী উৎপাদন ও উপভোগ; খ. বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক সমাকলন যা মানবজাতির সাধারণ স্বার্থনির্ভর – যেমন, সমতা, মানব অধিকার রক্ষা, আইনের শাসন, বহুত্ববাদ, শামিত্ম ও সুরক্ষা; গ. বিশ্বজুড়ে নৈতিক সংহতি, যা মানবিক মূল্যবোধসংশিস্নষ্ট; যা মানবতার নিরবচ্ছিন্ন বিকাশের জন্য অপরিহার্য।

এই বিশ্বায়নকে আমরা মূলত সন্দেহ ও ভয়ের চোখেই দেখে থাকি; কিন্তু যারা এই প্রক্রিয়াকে পরিকল্পনা ও কার্যকর করেছেন, তাদের ভিত্তি ছিল মতাদর্শগতভাবে ছয়টি মূল দাবি : ১. বিশ্বায়ন হলো বাজারের উদারনীতিকরণ এবং বিশ্বব্যাপী সংহতিকরণ; ২. বিশ্বায়ন অপরিহার্য ও অনিবর্তনীয়; ৩. বিশ্বায়নের তত্ত্বাবধায়ক কেউ নয়; ৪. বিশ্বায়নের ফলে, দীর্ঘকালীন ক্ষেত্রে, প্রত্যেকে উপকৃত হবেন; ৫. বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রসারণ ও অগ্রসরণ হবে; ৬. বিশ্বায়ন ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রগুলোকে একযোগে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

বিশেষজ্ঞরা বিশ্বায়নকে ক্রিটিক্যালি বহুরূপে দেখে থাকেন : বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকা–র এক উপায় হিসেবে; একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে; আর্থিক বাজারিকরণ ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রীকারক প্রক্রিয়া হিসেবে; একটি সমালোচনামূলক ধারণা হিসেবে; একটি আখ্যানমূলক বিভাগ হিসেবে; একটি সাংস্কৃতিক নির্মাণ হিসেবে এবং অবশ্যই একটি তাত্ত্বিক সন্দর্ভ হিসেবে।

বিশ্বায়নের তিন সেনাপতিকে আমরা চিনেছি এই ক্রমে : বাজার অর্থনীতি     প্রযুক্তি (তথ্যপ্রযুক্তিসহ)   যোগাযোগ (গণমাধ্যমসহ)।

অতঃপর আমরা, এই বিশ্বায়নপর্বে উপস্থিত মানুষেরা বিশ্বায়নের নমুনা কীভাবে দেখতে পাচ্ছি তার একটি পর্যালোচনা করে দেখি – অন্তর্দেশীয় ও আন্তর্দেশীয় উভয় ক্ষেত্রেই উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা; বিনিয়োগের মাধ্যমে পুঁজির এক দেশ থেকে অন্য দেশে গতায়াত; জাতিগুলোর মধ্যে সীমা পেরিয়ে ব্যবসায়িক কার্যকলাপ; বিদেশে মানুষের সহজ পরিযান, যাতায়াত বা স্থায়ীভাবে বসবাস; দেশে দেশে দক্ষ শ্রমিকের পারস্পরিক যাওয়া-আসা; বিদেশে কাঁচামাল, অর্ধ-সম্পূর্ণ ও সম্পূর্ণ উৎপাদিত সামগ্রীর রফতানি-আমদানি  যেমন, গাড়ির সরঞ্জাম যায় জাপান, জার্মানি, কোরিয়া থেকে আর অ্যাসেমবিস্ন হয় যুক্তরাষ্ট্রে; এক দেশ থেকে আরেক দেশে সম্পদের যাওয়া-আসা; প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার (ইন্টারনেটসহ); প্রযুক্তির হস্তান্তর (প্রতিরক্ষা-প্রযুক্তিসহ); প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি; বৃহত্তর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ; পৃথিবীব্যাপী বৈদ্যুতিন সংযোগ (মোবাইল, স্যাটেলাইট, টিভি); দেশে দেশে তথ্য-জ্ঞানের সহজ ও ব্যাপক লেনদেন; আন্তর্দেশীয় সাংস্কৃতিক বিনিময় (যেমন, আইপিএল)।

এই তালিকা থেকে আমরা একটা কথা সমস্বরে বলতে পারি, বিশ্বে গত তিরিশ বছরে যে-পরিবর্তন আমরা যে-দ্রুততায় দেখতে পেয়েছি, তার আগে তিনশো বছরেও এমন মাত্রার পরিবর্তন আমাদের পূর্বপুরুষরা দেখেননি।

তার মধ্যে বা তার ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াস্বরূপ যা যা ঘটে চলেছে তার মধ্যে ইতিবাচক-নেতিবাচক আলাদা করে দেখা যাক। যেমন, বিশ্বায়নের এই স্বল্পকালীন-দীর্ঘকালীন পরিবর্তনগুলোর মধ্যে সুফল বলতে চিহ্নিত করতে পারি – পুঁজির বাজারে দ্রুত বিকাশ, নতুন প্রযুক্তির রমরমা, বৈজ্ঞানিক গবেষণার নতুন ছক (যেমন, হিগস-টিম), জীবনযাত্রার বস্ত্তগত মানোন্নয়ন, বাণিজ্যের উন্নতি ও উৎপাদন বৃদ্ধি, নতুন নতুন মতাদর্শ ও চিন্তনপ্রক্রিয়া, পশ্চিমি গণতন্ত্রের প্রভাব ইত্যাদি। আর কুফলের তালিকা বেশ দীর্ঘ – আয়ের অসম ও অনৈতিক বণ্টন (পুঁজির অতিরিক্ত গতির ফলে), পরিবেশদূষণ ও জাতীয় সম্পদের অপব্যবহার (দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি ও মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায়); মূল্যবোধের সংকট, জাতীয় সংহতির সংকট (প্রতিযোগিতার কারণে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার নীতি অপসৃত হওয়ায়), কাজ খোয়ানোর দ্রুতি, জাংকফুড ও জীবনযাত্রাজনিত রোগের মহামারি, হিংসা ও সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত, আঞ্চলিক শিল্পের অবনতি, বহুজাতির সংস্থার রমরমা ও শ্রমকল্যাণ প্রকল্পের হ্রাস, অদক্ষ শ্রমিকের সর্বনাশ, উন্নত দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি, পুরনো ঐতিহ্য-রীতি-সংস্কৃতির অবক্ষয় ও বিস্মৃতি, কাজের পরিবেশ যান্ত্রিক হয়ে-ওঠা, কোনো উন্নত অর্থনৈতিক জাতির পতনে সামগ্রিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা।

 

বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি

আমরা জানি, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কেন্দ্র পশ্চিমে। স্বভাবতই পশ্চিমের সংস্কৃতিকেই ওই ক্রিয়াকা–র মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়। তো সেই সংস্কৃতিটা কীরকম? উদাহরণস্বরূপ উন্নত প্রযুক্তি, আর্থিক প্রাচুর্য, হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা, আণবিক পরিবার, যেনতেন সাফল্য …। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বায়নের মূল দর্শন – একীকরণ তথা সমরূপকরণ, যার চিহ্ন অন্য সংস্কৃতিকে গিলে ফেলার লক্ষণ। আরো আছে – ক্ষুধার প্রদর্শন, তামসিক পুলকের সংস্কৃতি, বহুত্বকে-রোমান্সকে-জীবনের রহস্যকে হত্যা করার সংস্কৃতি।

বস্ত্তগতভাবে দেখতে পাচ্ছি – প্রত্যেক কিছুই পে প্যাকেজ, ক্যান্ড ফুড, হোটেলে খাওয়া-থাকার প্রবণতা, যোগাযোগের চূড়ান্ত ব্যবহার, প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন – যার ফলে আদিকল্পের দ্রুত সরণ। অর্থাৎ শুধু বাণিজ্যে নয় – সংস্কৃতি, ভাষা, খাবার, জীবনশৈলী, চিমত্মা, পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক ও মানসিক ধরন – সবকিছুতেই একচেটিয়া প্রভাব।

তার আঘাতে বিপন্ন প্রাচ্যের সংস্কৃতি, যা ছিল সর্বাংশে জীবনমুখী, যার উপাদানগুলো ছিল যৌথ পরিবারব্যবস্থা, পারস্পরিক বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, মানসিক শামিত্ম, জীবনকে উপভোগ করার সৃজনশীলতা …।

এর অনুষঙ্গে আমরা বরং একটু গভীরে যাই। কেউ কেউ মনে করছেন, বিশ্বায়নের প্রভাবে সংস্কৃতির পশ্চিমায়ন চলছে দ্রুততালে, আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এর ফলে ‘উপভোগের সংস্কৃতি’র বাড়বাড়ন্ত। কেউ কেউ সাংস্কৃতিক প্রভাবের এই করালী চিত্রকে সাংস্কৃতিক চিত্তবিভ্রম বা কালচারাল স্কিৎজোফ্রেনিয়া নামের অভিধাও তৈরি করে ফেলেছেন।

সাম্প্রতিককালে কলকাতার মেট্রোতে তরুণ-তরুণীর প্রকাশ্য চুম্বনের ঘটনাকে আমরা পশ্চিমায়নের এক টুকরো নজির হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি; কিন্তু এক তরুণীকে লক্ষ করে এক অশিক্ষিত প্রৌঢ়ের প্রকাশ্যে হসত্মমৈথুনের ঘটনাকে কিসের প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করব? গণমাধ্যমের পক্ষে তাকে অপ্রকৃতিস্থ তকমা দিয়ে চেপে দেওয়াই ভালো।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শক্তিশালী দেশগুলো দাবি করছে যে, উন্নতশীল বা অনুন্নত দেশগুলো দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক বিধিনিষেধগুলো ভেঙে দিক; কিন্তু নিজেদের দেশের নিয়মকানুনগুলোর ক্ষেত্রে তারা আরো রক্ষণশীল হয়ে উঠছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অর্থনৈতিক দড়ি টানাটানি চলছে কূটনীতি এবং চোখ রাঙানিতে, সংলাপ এবং পেশি প্রদর্শনের মধ্যে।

এরই সূত্র ধরে পশ্চিমি সংস্কৃতির আধিপত্যকে মোকাবেলা করার শক্তি গরিব দেশগুলোর নেই। তাদের ঐতিহ্যবাহী ক্লিশে জীবনযাত্রার বিপরীতে চোখ-ধাঁধানো মোড়কযুক্ত, ব্র্যান্ডেড ‘সংস্কৃতি’ সহজেই তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করে। এই সময়ে আমরা কজন সুসংস্কৃত তরুণকে পাব, যারা নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল থেকেই অর্থাৎ অন্যথা প্রভাবিত না হয়েই এই ভোগ্যপণ্যের বাজারে সংযতভাবে নিজের প্রয়োজন মেটায়, নিজেকে আপডেট রাখে?

আসলে চিমত্মার বা সংস্কৃতির বিনিময়ে দোষের কিছু নেই। ঐতিহাসিকভাবে সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া শিল্পে, বিজ্ঞানে, ভাষায়, খেলাধুলায়, খাবারে অগ্রগতির নজির রেখেছে বহুকাল ধরেই। কিন্তু বিশ্বায়নের আগে, সাংস্কৃতিক প্রভাবগুলো ধীরলয়ে, রয়েসয়ে আসত, যার ফলে ততোধিক আতংকের কারণ হতো না। ধনী, গরিব যে-সমাজেই হোক সেই প্রভাব প্রতিফলিত হতো, বিবেচিত হতো এবং একটা সময় নিয়ে তা অঙ্গীভূত হতো অপর সংস্কৃতিতে। কিন্তু গণমাধ্যমের বিশ্বায়ন হয়েছে অনৈতিক। কোনো কিছুই গভীরভাবে চিমত্মাভাবনা করার, তার উপকার বা ক্ষতিকে আন্দাজ করার, তথা কোনো ধরনের মূল্য-বিশেস্নষণের সুযোগ দেয় না। সবরকমের খবর, সংগীত, চলচ্চিত্র এমনকি পর্নোগ্রাফি সরাসরি সম্প্রচার করে সবরকমের স্ক্রিনে, চ্যানেলে, গ্যাজেটে।

আমরা বুঝতে পেরেছি, বিশ্বায়ন কোনো সুস্থ খেলা নয়। যার অর্থনীতি যত বড়, সামূহিক সিদ্ধামেত্ম সে-ই সিংহভাগ অর্জন করবে। যার অর্থ বেশি এবং নেটওয়ার্ক বড়, তারই গণমাধ্যমের ওপর দখল বেশি হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির দেশ আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে বিশ্ববাজারে তার অর্থনৈতিক অসিত্মত্ব বজায় রাখতে এবং সানুপাতিকভাবে তার সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বজায় রাখার চেষ্টা করবে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঐতিহাসিক সূত্রে প্রবাহিত হয়ে এসেছে। সেই চেষ্টা কতখানি সফল হবে তা শুধু রাষ্ট্রের হাতে আর নেই।

বর্তমানে আমরা নিজেদের কা-জ্ঞান দিয়ে, বিদ্বজ্জনদের বিশেস্নষণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বুঝেছি কি না জানি না, আঞ্চলিক ভাষা, লোকসংস্কৃতি অর্থাৎ যে যে জিনিসের বিশ্ববাজারে কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই তাদের অসিত্মত্ব ও উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নত কিছু দেশে, বিশেষত আমেরিকায়, আমরা যাকে বলি মানবিকীবিদ্যা অর্থাৎ হিউম্যানিটিস, যাকে আগে বলা হতো কলাবিদ্যা তথা আর্টস অর্থাৎ ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, চারুকলা – এসব বিষয় পড়ানোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে এসব বিষয়ে গবেষণার সুযোগও। এমনকি বিদ্যালয় সত্মরে সরকারি ফান্ডের বেশিরভাগ যাচ্ছে STEM (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইকোনমিকস, ম্যাথমেটিকস) পাঠক্রমে। অর্থাৎ কার্যকারিতার ভিত্তিতেই পাঠক্রমের অসিত্মত্ব নির্ভর করছে। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, আমেরিকার নোবেলজয়ী দার্শনিক ও সাহিত্যিকরা একযোগে এই সিদ্ধামেত্মর বিরোধিতা করেছিলেন, যে-সভায় রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। তাহলে যেসব বিষয়ের অধ্যয়ন চিমত্মাশীল মানুষ তৈরি করে তার প্রয়োজন আর উন্নত দেশে থাকছে না। ক্রমশ এই প্রবণতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে সভ্যতা নিয়ে আমাদের দুশ্চিমত্মা বাড়ে বইকি। আমরা এখনই আমাদের মতো দেশে দেখতে পাচ্ছি, বৃত্তিমুখী (বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি) শিক্ষায় বাবা-মা-ছাত্রদের বর্ধিষ্ণু ঝোঁক আর ইতিহাস-দর্শন-ভাষা সাহিত্যে ছাত্রদের আগ্রহ ক্রমহ্রাসমান।

বিশিষ্ট তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর অ্যান এসথেটিক এডুকেশন ইন দ্য এরা অফ গেস্নাবালাইজেশন গ্রন্থের মাধ্যমে পরামর্শ দিয়েছেন কল্পনা ও নন্দনতত্ত্বের প্রশিক্ষণ চালু করতে, যেখানে সাহিত্যের গভীরতর অধ্যয়নের মাধ্যমে ছাত্ররা সমালোচনামূলক তথা ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠবে নিজস্বতার আলোকে। বহুভাষিক আন্তর্বিষয় দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সংস্কৃতিকে দেখার গুরুত্ব তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, বিশ্বায়নের প্রভাবে একপ্রকার একশিলা জাতীয় বর্গ তৈরি হয়, যা বিভিন্নতাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে, আত্মপরিচয়ের অনন্যতাকে অগ্রাহ্য করে এবং লিঙ্গ ও যৌন বিভিন্নতার গুরুত্বকে হ্রস্বায়িত করে। কল্পনার প্রশিক্ষণের লক্ষ হলো মানব সংস্কৃতির বিপুল বৈচিত্র্যকে বোঝার ও শ্রদ্ধার পরিস্থিতি তৈরি করা। এর মধ্যেই রয়েছে পরমতসহিষ্ণুতার অর্থাৎ মৌলবাদ বিরোধিতার সূত্র।

 

বিশ্বায়ন ও আত্মপরিচয়

বিশিষ্ট মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ফ্রেডরিক জেমিসন বলেছিলেন, যদি সাম্রাজ্যবাদ হয় পুঁজিবাদের সাম্প্রতিক সত্মর, তবে বিশ্বায়নবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রতিক সত্মর। এই উপলব্ধি কতটা সত্যি তা একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই টের পাওয়া যাবে। ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রম্নয়ারি ব্রিটিশ হাউজ অব কমনসে লর্ড মেকলের বক্তৃতা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে, যাকে ভারতীয়রা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সূচনা বলে চিহ্নিত করেছে। এখানে তার প্রাসঙ্গিক অংশ তুলে ধরছি – ‘আমি ভারতের দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সর্বত্রই ঘুরেছি এবং একটিও ভিখিরি অথবা চোর আমার নজরে পড়েনি। এমন সম্পদ আমি দেখেছি এই দেশে, এত উঁচু নৈতিক মূল্যবোধ, এত মেধাবী মানুষজন – আমি মনে করি না, এই দেশকে প্রকৃত অর্থে জয় করা যাবে, যদি না এই জাতির মেরুদ- আমরা ভেঙে দিতে পারি – যা হলো তার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সুতরাং আমার প্রস্তাব হলো, তার পুরনো ও প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা, তার সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপিত করা – এমনভাবে, যাতে ভারতবাসীরা ভাবতে শুরু করে যে, যা কিছুই বিদেশি ও ইংরেজি তা-ই ভালো এবং তাদের নিজেদেরটির চেয়ে ঢের ভালো – যার ফলে তারা তাদের আত্মসম্মানবোধ, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে হারাবে এবং তারা হয়ে উঠবে যা আমরা চাই, একটি বিশ্বসত্ম পরাধীন জাতি।’ আজ আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকে তাকালে মেকলে ও তার বশংবদ বাহিনীর সাফল্য মর্মে মর্মে টের পাওয়া যায়।

বর্তমানে আইডেনটিটি তথা আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে আমরা বাওম্যানের কথার সূত্র ধরে বলে ফেলতে পারি যে, আমরা এখন এক মুক্ত স্থান-কালে বাস করি, যেখানে কোনো পরিচয় আর নেই, আছে শুধু রূপান্তর। আত্মপরিচয়কে এখন ‘থাকা’র চেয়ে ‘হয়ে ওঠা’ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়, কেননা, তা ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে ঐতিহাসিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ও চর্চার মাধ্যমে, অর্থাৎ বিশ্বায়ন, উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা এবং প্রযুক্তির নতুনতর আবিষ্কার ইত্যাদির মাধ্যমে। কিন্তু আত্মপরিচয়ের আগেকার ধারণা ছিল যে তা নির্দিষ্ট ও ইতিহাসব্যাপী। বর্তমানে তা হয়ে গেল নমনীয় ও অনিশ্চিত। একে অবশ্য কেউ বলতে পারেন অপরিহার্যতাবাদী (দেকার্তে, হুসের্ল) সঙ্গে গঠনবাদীদের (হিউম, নিৎসে, সার্ত্র) বিতর্ক-বিবাদ। এরই সূত্র ধরে বাওম্যান জানান, আধুনিকতাবাদীদের লক্ষ্য ছিল আত্মপরিচয়কে দৃঢ় ও নির্দিষ্ট হিসেবে বিচার করা আর উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা তাকে অনির্দিষ্ট ও উন্মুক্ত রাখার পক্ষপাতী। আরো একটু খুলে বললে, আধুনিকতাবাদীদের কাছে আত্মপরিচয় ছিল ক্রিয়েশান বা সৃজন আর উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের কাছে তা হলো রিসাইক্লিং বা পুনরুপযোগীকরণ।

মানবেতিহাসের অধিকাংশ পর্যায়ে, মানুষের জীবন ও মানসকল্পকে অর্থপূর্ণ করেছিল যে মূল সুর, তা প্রাথমিকভাবে আকৃত হয়েছিল আঞ্চলিক ভূগোল ও জলবায়ু, আঞ্চলিক
সম্পর্ক-রীতি ও সামাজিক সংগঠন, আঞ্চলিক বিশ্ববীক্ষা ও ধর্ম দ্বারা। এমনকি কয়েকশো বছর আগেও, আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন কার্যত আকৃত হয়েছিল আঞ্চলিক অর্থনীতি, আঞ্চলিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক জ্ঞান দ্বারা। বিশ্বায়ন নামক এই সাম্প্রতিক অভিযান ও দখলের আগে গ্রামবাসী জন্ম নিত, বেড়ে উঠত, শিক্ষা পেত, কাজ করত, বিয়ে করত, সমত্মানের জন্ম দিত এবং অমেত্ম্যষ্টি সম্পন্ন হতো একই অঞ্চলে। কয়েকশো মাইল দূরে সংঘটিত কোনো পরিবর্তন সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ ছিল না, হলেও কালক্রমে বিস্মৃত হওয়ার কারণ অনেক শক্তিশালী। কার্যত গ্রামটিই ছিল তার জগতের সূচনা ও সমাপ্তি : প্রদর্শক ছিল বিরল, বহিরাগত পথিক থাকত খুবই কম এবং গ্রামের যে-কোনো দেশভ্রমণ হতো বড়জোর নিকটতম শহরের হাটবাজার। অর্থাৎ বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ কোনো নিয়ম ছিল না, বরং ব্যতিক্রমই ছিল।

বিশ্বায়নের সৌজন্যে এই বিশ্ব এখন এক অচেনা জগৎ। মানুষ যেখানে আঞ্চলিক বাসত্মবতায় বাঁচার অভ্যেস বজায় রেখেছে, সেই বাসত্মবতা উত্তরোত্তরভাবে সম্পর্কের বিশ্বজোড়া বৃহত্তর নেটওয়ার্কের দ্বারা চ্যালেঞ্জের বা সমাকলনের সম্মুখীন। বিশ্বায়নের শক্তিগুলো বিশ্বজুড়ে চাপ দিচ্ছে যুবশক্তি, পরিবার ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ওপর। সব সামাজিক ব্যবস্থাই অন্য অঞ্চল বা জাতির কাছ থেকে মূল্যবোধ, নীতি, দক্ষতা, প্রতিযোগিতামূলকতা ধার করার প্রয়োজন দ্বারা কলুষিত। বিশ্বায়ন ও তার তত্ত্বাবধায়ক পরিণামের প্রক্রিয়ায় আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ঝরে পড়ছে।

সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রভাববিষয়ক এ-বিষয়টিকে আমরা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে পারি। বিশ্বায়নের কেন্দ্রীয় মনস্তাত্ত্বিক পরিণাম হলো, এর ফলে আত্মপরিচয়ের রূপান্তর ঘটে, অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশের সাপেক্ষে মানুষ নিজেদের সম্পর্কে কীভাবে ভাবে! বিশ্বায়নের সম্পর্কিত ইস্যু হিসেবে আত্মপরিচয়ের দুটো ব্যাপার পাওয়া যায়। প্রথমত, বিশ্বায়নের ফল হিসেবে বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখন আত্মপরিচয়ের দ্বিত্বে বিভ্রান্ত – যার মধ্যে একটি তার আঞ্চলিক সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত আর অন্যটি বিশ্বায়িত সম্পর্কে তার চেতনা থেকে উদ্ভূত। দ্বিতীয়ত, অপাশ্চাত্যীয় সংস্কৃতির যুবসমাজের মধ্যে আত্মপরিচয়ের বিভ্রমের পরিব্যাপ্তি সম্ভবত বেড়েই চলেছে। যেহেতু বিশ্বায়নের প্রভাবে আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে, যুবসমাজের অনেকেই না আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে, না বিশ্বসংস্কৃতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।

বিশ্বায়ন ও সাহিত্য

আগে উদ্ধৃত করেছি মেকলের ১৮৩৫-এর বক্তৃতা যাকে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রথম দলিল বলা হয়। তার বিপরীতে, তার আগে ১৮২৭-এ মহাকবি গ্যেটে-বর্ণিত বিশ্বসাহিত্যের ধারণা, যাকে জার্মান ভাষায় তিনি অভিহিত করেছিলেন ওয়েলত্ লিতেরাতুর বলে। তার ধারণায় ছিল বিশ্বের বিভিন্ন জাতির সাহিত্যিকদের মধ্যে খোলাখুলি সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় সাহিত্যগুলোর বিবর্তন-সংক্রান্ত ঐতিহাসিক প্রকল্প, যেখানে সেগুলো দ্রবীভূত হয়ে এক মহৎ সংশেস্নষে রূপান্তরিত হবে। জাতি অর্থে তিনি এক সাংস্কৃতিক ও ভাষিক সম্প্রদায়কে বুঝেছেন, যার এক স্বাতন্ত্র্য-নির্দেশক আধ্যাত্মিক সত্তা রয়েছে, যাকে তিনি তাঁর ভাষায় বলেছেন ভক্সজেইস্ট। প্রত্যেক জাতির প্রতিনিধিস্থানীয় সাহিত্যিকদের বিদেশি সাহিত্য পাঠে যে সংকর-সাংস্কৃতিক ধারণা তৈরি হবে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিব্যাপ্তি ঘটবে – তার ফলে মানব-অভিজ্ঞতার এক বিশ্বজনীনতা প্রকাশ পাবে। গ্যেটের কাছে বিশ্বসাহিত্য হলো সবার জন্য সমান এক সুযোগ, তা কোনো জাতির সাংস্কৃতিক আধিপত্য অন্য জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং প্রতিবেশীদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা, যার মাধ্যমে সংহতিপুষ্ট হয় এবং সংঘাতের সম্ভাবনা কমে। মানবতার ভবিষ্যৎ-সংক্রান্ত গ্যেটের এই আদর্শবাদী ধারণায় বর্তমানে ইউরোপের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের নেপথ্যে যে সমসাময়িক ঐতিহাসিক শক্তি সক্রিয় তাকে আন্দাজ করা অবশ্যই সম্ভবপর ছিল না।

প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য, গ্যেটের ওই উক্তির প্রায় চলিস্নশ বছর পর মার্কসের লেখায় (কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো), আমরা ভিন্ন প্রাসঙ্গিকতায় বিশ্বসাহিত্যের রেফারেন্স পাই। সেই বিখ্যাত পরিচ্ছেদে (১৯৬৭ সংস্করণ, পৃ ৮৪) বুর্জোয়াদের দ্বারা বিশ্ববাজারের অন্তহীন সম্প্রসারণ এবং সমাজের সবরকম সম্পর্কের আমূল পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নতুনতর আধ্যাত্মিক প্রয়োজনের পক্ষে মত দেন, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন বিশ্বসাহিত্যের প্রয়োজনকে। তাঁর মতে, পুরনো স্থানীয় ও জাতীয় একান্ততা ও আত্মপ্রত্যয়ের জায়গায় আমরা পাচ্ছি জাতিগুলোর পারস্পরিক নির্ভরতা এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মিথস্ক্রিয়া। জাতিগুলোর বৌদ্ধিক সৃষ্টিগুলো হয়ে ওঠে সাধারণ সম্পত্তি। জাতীয় একদেশদর্শিতা ও সংকীর্ণ মনোভাবাপন্নতা হয়ে ওঠে আরো আরো অসম্ভব এবং অনেক জাতীয় ও স্থানীয় সাহিত্য থেকেই উদ্ভাবিত হয় বিশ্বসাহিত্য।

ফ্রেডরিক জেমিসনের ব্যাখ্যায়, গ্যেটে কিন্তু বিশ্বের ধ্রম্নপদী সাহিত্যসম্ভারকে একত্রে জড়ো করার কথা বলতে চাননি, বরং বিভিন্ন দেশের (মূলত, ইউরোপের) সাহিত্যিকদের মধ্যে এক নেটওয়ার্কিং চেয়েছেন – একে অন্যের সাহিত্য-পাঠের মাধ্যমে, জার্নাল বা ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রে জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। এর সঙ্গে বর্তমানকালের বিশ্বসাহিত্যের লক্ষে বহুজাতিক আন্দোলনের মিল পাওয়া যায়। এর অনুষঙ্গে ইতিহাস পর্যালোচনায় না গিয়ে আমরা বরং সাম্প্রতিককালের একটি সংলাপের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করি। বহুজাতিক সাহিত্য আন্দোলনের এক ভাষ্যকার জাহান রামাজানি ২০১৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ট্রান্সন্যাশনাল পোয়েটিক্স শীর্ষক তাঁর গ্রন্থটির মাধ্যমে তিনি সন্ধান করেছেন কীভাবে কবিতা জাতীয় সীমানা পেরিয়ে যায়। কবিতার প্রকরণের রয়েছে এক দীর্ঘ স্মৃতি। কবিতার প্রথানুগ কাঠামো পুনর্বিন্যসত্ম হয় স্থানীয় বা জাতীয় পরিস্থিতির দ্বারা, যা কখনো কখনো বিভিন্ন সংস্কৃতির বৈচিত্র্য থেকে আহরিত। তাঁর সন্ধান হলো, একটি কবিতার বুনন কীভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে প্রকরণ, বাকরীতি, শব্দচয়ন, উত্তরাধিকারকে আত্মসাৎ করে। আধুনিকতাবাদীদের মধ্যে, মূলত ইয়েটস, এলিয়ট ও পাউন্ডের দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতির অভ্যন্তরে রূপান্তরকামী অনুপ্রবেশের নজির আমরা পাই। তাঁর ধারণা, আধুনিক ও সমসাময়িক কবিতা রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত থাকার বিষয়টিকে তোয়াক্কা করে না।

প্রসঙ্গত উত্থাপন করা যায় যে, উত্তর-আকরণবাদী তাত্ত্বিকরা এই বিশ্বজনীনতা, ইয়োরোকেন্দ্রিকতার তুমুল সমালোচক।

বিশ্বায়ন পর্বের আগে একটা ধারণা ছিল যে, সাহিত্য প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যের প্রতি, বিষয়ীদের নিয়ন্ত্রণের লক্ষে, উৎসারিত এক আবেগ। বিশ্বায়নের যুগে জনসংখ্যার এক বৃহত্তর অংশ সাম্রাজ্যের ধারণার ক্ষেত্রে বেশ সমালোচনামুখী। আমাদের মনে হয় না যে, এই প্রগতির ধারা সরলরৈখিক, বরং গত ষাট ও সত্তরের দশকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের উত্থানে নারীবাদের উদ্ভবে, সবরকম আত্মপরিচয়ের রাজনীতির জাগরণে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সাম্রাজ্য, জাতিভেদ ইত্যাদি যে বেশ বড় বড় সমস্যা এই চেতনার উদ্ভব হয়, কিন্তু মাত্রার পরিবর্তন হয় ডিকলোনাইজেশনের জোয়ারে। এই ভূকম্পমাত্রিক সরণের প্রবল প্রভাব আছে লেখালেখির ওপর। বিশ্বের বিভিন্ন প্রামেত্মর লেখকদের মধ্যে এরকম বিক্ষুব্ধ সময়কালে এক সাধারণ থিম আমরা লক্ষ করি। কিন্তু এই দৃষ্টিপাতে একটা ভেদ চোখে পড়ে – ইংরেজি থেকে অন্য ভাষায় লেখালেখি যত অনূদিত হয়, উলটোদিকে অনেকটাই কম। ইংরেজি ভাষার কোনো পাঠকদের মধ্যে ভিনদেশি ও অনূদিত সাহিত্য পাঠে ততোধিক আগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় না। ইউরোপ, আমেরিকা ভিন্ন অন্য দেশের অন্য ভাষার লেখকদের এই ধারণা হয়েছে যে, লেখক হিসেবে বইয়ের পরিবেশন বাড়াতে, নজরে আসতে গেলে রফতানি বাজারের জন্য লিখতে হবে। নববইয়ের দশকে, দক্ষিণ এশীয় লেখকদের ইংরেজি ভাষায় লেখার বন্যা বয়ে গেল – যাঁরা হয়ে উঠলেন যথেষ্ট পরিশীলিত ও প্রশংসিত – বিশ্বসাহিত্যের প্রতিনিধিস্থানীয়।

সংস্কৃতির অন্য শিল্পমাধ্যম যেমন সংগীত, চলচ্চিত্র, দূরদর্শনের সঙ্গে সাহিত্যের একটি মৌলিক তফাৎ আছে। সাহিত্য-পাঠ এককভাবে সৃজিত ও পঠিত হয়। তাদের পরিবেশন ব্যবস্থাও ভিন্ন। ইন্টারনেট, লিটারারি বস্নগ এবং আমাজন ইত্যাদি সাইটের দ্রুত প্রসারের এক প্রভাব রয়েছে সাহিত্যের ওপর, যা জনপ্রিয় সংস্কৃতির চেয়ে বেশি। বইয়ের দোকানের চেয়ে বেশি পাঠক খুঁজে বের করার দিকে ঝোঁক বেড়েছে লেখকদেরও। কিন্তু প্রযুক্তিই একমাত্র বিষয় নয়। সরল অর্থনীতির এক বড় ভূমিকা আছে সাহিত্যের বিশ্বায়নে। চীনে দেখা যায়, পুরনো দিনের পশ্চিমি সাহিত্য সহজে পাওয়া যায় কিন্তু সাম্প্রতিক বইপত্র পেতে গেলে বেশ কসরত করতে হয়। তার কারণ হয়তো যে, বইগুলো কপিরাইট-মুক্ত হয়ে গেছে, সেগুলোর আঞ্চলিকভাবে মুদ্রিত সংস্করণ বেশ সস্তা। সাবওয়ে বুকশপে অবশ্য দেদার হ্যারি পটার পাওয়া যায়। এটা ভাবা কি ভুল হবে যে, এর প্রভাব মানুষ কী পড়ছে শুধু তারই ওপর, নাকি মানুষ কী লিখছে তার ওপরও আছে! লেখকরা নির্বিশেষ পাঠক। যে নতুন বইগুলো হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায় তা প্রযুক্তি, অর্থনীতি বা পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবস্থা – যার ওপরেই হোক, তাদের প্রভাব দ্রুত বাড়ে। হ্যারি পটারের পাশাপাশি চীনে সমগোত্রীয় বিষয়ে স্থানীয়ভাবে মুদ্রিত অনেক বই পাওয়া যায়। অর্থাৎ বাজার নির্ধারণ করে দিচ্ছে কী বিষয়ে লেখা হবে, অবশ্য তার সৃজনমূল্য সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা বাতুলতা।

বিশ্বায়িত উপন্যাসের উদ্ভব সমাপতিত হয় এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে যে, পাশ্চাত্যের উপন্যাসের ভরবেগে ঘাটতি পড়েছে। প্রকৃতই তা সংকীর্ণ হয়েছে – ‘কী জন্য উপন্যাস’ এই অর্থে। মানুষ যখন পরিধি বিস্মৃত করে ভাবা শুরু করল – পরিযান, স্থানান্তর, বিভিন্ন রকম মানুষের সঙ্গে সংঘাত যাদের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে কখনো সংস্পর্শ ছিল না – এসব বিষয়ে, তখনই দেখা গেল উপন্যাস হঠাৎ খুঁজে পেল আবার এক মহাকাব্যিক উদ্দেশ্য (অথচ মার্কস সাহেব কিন্তু এই সময়কে মহাকাব্যের যুগ নয় বলে চিহ্নিত করেছিলেন)। গত কয়েক দশকে সবচেয়ে উদ্ভাবনী পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমরা দেখলাম শৈলীতে, প্রকরণে – উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিসর থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষণসহ। উদাহরণস্বরূপ, সালমান রুশদির মিডনাইটস চিলড্রেন, যা গত তিরিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশীল উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত। এটি ভারতীয় ঐতিহ্য ও ইংরেজি ভাষার এক আদর্শ সংকরায়ণ – ভাষাতাত্ত্বিকভাবে ও বিষয়বস্ত্তগতভাবে।

কখনো কখনো, খুবই ব্যুৎপত্তিগতভাবে, আমেরিকান লেখকরা এই ট্রান্সন্যাশনাল উপন্যাসকে অনুকরণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ ম্যাজিকাল রিয়ালিজম, যা শুরু হয়েছিল এশীয় ও লাতিন সংস্কৃতির স্বীকৃত স্বাক্ষর হিসেবে। কালক্রমে পাশ্চাত্যে সেটি এতটাই সাধারণ হয়ে গেল যে, পাশ্চাত্যের লেখকরা এই ধারায় বেশ জনপ্রিয় উপন্যাসের রচয়িতা হয়ে উঠলেন। আরো একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, যে-লেখকদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, সেসব লেখকের ভাষাকে ‘উদ্ভট-ইংরেজি’ বলে চিহ্নিত করেন পাশ্চাত্যের লেখকরা ও তাঁদের ভুলভ্রামিত্মকে বেশি বেশি করে তুলে ধরেন পাশ্চাত্যের সাহিত্য-সমালোচকরা। কিন্তু তাঁদের নান্দনিক সক্ষমতাকে অস্বীকার করার সুযোগ না থাকায় একপ্রকার শক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বিশ্বায়িত সাহিত্যের এক অগ্রণী আলোচক ভেঙ্কট মানির মতে, বিশ্বসাহিত্যকে সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় বিশ্বায়িত গণমাধ্যমের বৃহত্তর প্রাসঙ্গিকতায়। তাঁর মতে, বর্তমান বিশ্বায়িত ভুবনে একটি সাহিত্যকর্মের উৎসস্থান ওই কাজটির সাংস্কৃতিক বা জাতীয় প্রসঙ্গকে নির্দেশ করে না। তাঁর বিশ্বাস, সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্য সৃজিত ও পরিব্যাপ্ত হয় এক জনপরিবেশে, যার নেপথ্যে রয়েছে গণমাধ্যম প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার পরস্পরসম্পর্কিত রসায়ন। মানির এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্যেটের সঙ্গে মেলে এই মর্মে যে, উভয়ের মতেই জাতীয় সাহিত্য এখন এক অর্থহীন অভিধা।

বিশ্বসাহিত্যের এই নব্য-পর্বের হয়ে-ওঠা ও পরিবেশন প্রক্রিয়ায় অনুবাদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা অনস্বীকার্য। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতে, বিশ্বসাহিত্যের পাঠ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূল ভাষায় তার যে সামর্থ্য তাকে অগ্রাহ্য করে। তাঁর মতে, অনূদিত বয়ানের পাঠে সংস্কৃতি ও ভাষাকে একীকরণের চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে, অর্থাৎ সাহিত্যে ভাষা ও সংস্কৃতির যে বৈচিত্র্য বিদ্যমান তাকে রক্ষা করতে হবে।

 

বিশ্বায়ন ও কবিতা

তা হলে খুব সহজ করে বললে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিশ্বায়নের ক্রিয়াকা–র ফলে যে-পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে তা যান্ত্রিক তথা অমানবিক, তা বিধিবদ্ধ তথা অনমনীয়, শ্রেণিকাঠামো তথা শ্রেণিক্রমকেন্দ্রিক, একচেটিয়া তথা একঘেয়ে। অথচ বলা বাহুল্য, কাব্যিক জগৎ মহৎ সুন্দর, নির্জন, সংবেদী, উন্মুক্ত …। কাজেই বিশ্বায়নের সংস্কৃতি ও কবিতার আবহ বিপ্রতীপ। বিশ্বায়ন তো কোনো বিমূর্ততাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং যাপনের এক সংকট।

আমরা বরং ঈষৎ কাব্য করে কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করি। এ বিষয়ে আমরা নিশ্চয়ই একমত যে, মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তি হলো ভিশন বা ‘অতীন্দ্রিয় প্রজ্ঞা’, যাকে বলা যায় আদর্শায়িত লক্ষ্য। এই ভিশনকে জাগ্রত রাখে যেসব চর্চা তার মধ্যে অন্যতম হলো কবিতা, যা মানুষের অসিত্মত্বের গরিমাকে অক্ষত রাখে। তাই কবিতা হলো মহত্ত্বের সার। বিশ্বায়ন যখন সবকিছুকে হ্রস্বায়িত করে আনে টাকায়, কবিতার দমবদ্ধ হয়ে আসে। সেটাকে বলা যায় ‘আধুনিকতার অসুখ’।

আজকের পৃথিবীতে বড় বড় সমস্যা হলো – আমরা প্রত্যেকে হয় ছিন্নমূল না হয় শিকড়হীন; পৃথিবীটা আমাদের কিন্তু আমরা কোথাও নেই; জীবনে প্রশ্ন বেড়ে গেছে কিন্তু উত্তর কমে যাচ্ছে; গ্রাম ও গোষ্ঠী-জীবনে যে বিশ্বসত্মতা ছিল আজ তা হারিয়ে যাচ্ছে …। যদিও আমরা জানি যে, এভাবে ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করা যায় না; আমাদের চাপ বাড়ানোর, সাফল্যের উচ্চাশার সীমা থাকতে হবে। তাই আমাদের দ্বন্দ্ব হলো একদিকে রুশোর মতো প্রকৃতির কাছে তথা শিকড়ে ফেরার ডাক অন্যদিকে উন্নত জীবনযাত্রার পুলক আমরা একসঙ্গে চাইছি। কেননা, প্রগতির যে স্বাচ্ছন্দ্য তার দাস হয়ে পড়েছি। তার ফলে বিশ্বায়ন হয়ে উঠেছে এক প্রয়োজনীয় ক্ষতি, ইংরেজিতে যাকে বলে নেসেসারি এভিল – এমনই এক ড্রাগন যার থেকে আমরা মুক্তি পেতে চাই না।

আমাদের কাব্যিক আত্মা শৌর্য, মহাপ্রাণতা, প্রেম, উৎসর্গ, সৌন্দর্যের জগৎকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। কিন্তু বিশ্বায়িত আত্মা চাইছে তাৎক্ষণিক চরিতার্থতা, দ্রুত সাফল্য, দ্রুত প্রতিশোধ, স্বল্পকালীন সম্পর্ক। অন্যদিকে কবিতা উপভোগ করতে চায় প্রকৃতি, নির্দোষিতা, শৈশব, নির্জনতা, সংগ্রাম …। কবিতা কোনো হাতেগড়া প্রসাধন নয় – কবিতা কখনোই দুমিনিটের রেডিমেড প্যাকেজ হতে পারে না – কবিতা পাশব প্রবৃত্তিকে লুকিয়ে রাখে না – কবিতা নির্দোষ, সৎ অকপট বলার জগৎ – কবিতা কখনো ভড়ংকে আশ্রয় করে না – কবিতা ব্যক্তির মর্যাদাকে উন্নীত করে – ।

আজকের পৃথিবীতে আমরা সবাই কূটনৈতিক; আমরা সবাই সঠিক জীবনযাপন করি; নিখুঁত মুখ দেখানোর শিল্প আমরা খুব ভালো আয়ত্ত করেছি; আমাদের যাপন পুরোপুরি প্রদর্শনমূলক – সম্পূর্ণ ধোলাই করা – মাঞ্জা দেওয়া আর মঞ্চসফল; ব্যাপক জাহিরি চলছে সর্বত্র; প্রেম-শ্রদ্ধা-সম্পর্ক এসবই মিথ্যা, সত্য শুধু অর্থ আর সাফল্য; আমরা সবাই হয়ে উঠেছি অভিনেতা আর আমাদের যাপনে উদ্দেশ্যহীনতার ব্যাপক উদাহরণ ছড়ানো।

একটা সময় ছিল যখন কবিতা জগৎ পালটে দিত, রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল এবং বৈপ্লবিক সংগ্রামে নিরন্তর প্রেরণা জোগাতো। ঐতিহাসিকগতভাবে সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় অনেক মূল্য সংশিস্নষ্ট আছে। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক ও সাহিত্য-তাত্ত্বিক উমবার্তো একো সাহিত্যকে বলছেন ‘অধরা ক্ষমতা’ তথা ইনট্যানজিবল পাওয়ার। বলছেন, সাহিত্যই ভাষাকে আমাদের সমষ্টিগত ঐতিহ্য হিসেবে জীবিত রাখে। সাহিত্য এক ধরনের আত্মপরিচয় ও গোষ্ঠীপরিচয়ের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে; কিন্তু বিশ্বায়িত ভুবনের বেসুরো ঝংকারে এখন কবিদের স্বর শোনা যাচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানুষের ধর্মে বলেছেন, কবিতা ব্যক্তির মর্যাদাকে উন্নীত করে, তার আত্মাকে অতীন্দ্রিয় করে এবং বিশ্বলোকের সঙ্গে তাকে সংশিস্নষ্ট করে।

তাই কবিকে এখনই তো ভীষণ প্রয়োজন! বিশ্বায়নের শক্তিগুলো ব্যক্তির দুর্বলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যক্তি তার অসিত্মত্বের অর্থ হারাচ্ছে। সে শুধুই দৌড়াচ্ছে। জানে না, কেন দৌড়াচ্ছে বা কোথায় পৌঁছাতে চায়।

আমাদের বিশ্বাস – কোনো দুর্যোগ, কোনো আন্দোলন, কোনো ধ্বংস, কোনো নবজাগরণ এই অন্ধ সভ্যতাকে সৌন্দর্য ও সত্যের আশ্রয়ে কবিতার শক্তির প্রাসঙ্গিকতায় জাগিয়ে তুলবে। ততক্ষণ পর্যন্ত কবিতার সলতেকে জাগিয়ে রাখতে হবে আমাদের।

বিশিষ্ট মার্কসবাদী তাত্ত্বিক কার্ল ক্রস বলেছিলেন, পৃথিবীর প্রকৃত সমাপ্তি হলো ‘চৈতন্যের মৃত্যু’। কবি তো সেই মগ্ন-চৈতন্যের ধারক-বাহক। বহুকাল ধরে সামাজিক ন্যায়বিচার, পরিবর্তন এবং মানুষের প্রেম ও সংহতির অগ্রদূত হয়েছেন কবি ও সাহিত্যকরা। মানব-অভিজ্ঞতার বেদনা ও জয়ের সূক্ষ্মতম আভাস আমরা কবির মাধ্যমেই পেয়ে আসছি। তাঁর সংবেদ শুধু নান্দনিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেই নয়, মানব-অভিজ্ঞতার সত্যকে উপরিতলে তুলে আনার কাজটিও করে চলেছে। মানব-অভিজ্ঞতার সামগ্রিকতার সত্যতাকে প্রতিপন্ন ও প্রতিপাদন করার ক্ষেত্রে কবি ও কবিতার সামূহিক স্বর ও প্রজ্ঞার অবদান অনস্বীকার্য।

মানব-অভিজ্ঞতাকে প্রশ্ন করা, তদন্ত করা ও ওকালতি করা কবির দায় এবং তার অনুসন্ধানের রিপোর্ট বৃহত্তর ক্ষেত্রে পেশ করাও তাঁর কর্তব্য। সত্যকে উন্মোচিত করা ও মানবতার পক্ষে ওকালতি করার ক্ষেত্রে কোনো কিছুই তো বাদ থাকার কথা নয়।

কবিরা হলেন সভ্যতার বিবেক। এই পৃথিবীগ্রামে, জাতি গঠনের কাজে কবির ভূমিকা নেতৃস্থানীয়। আটপৌরে শব্দগুলোকে তিনি বিশুদ্ধ করেন এবং চৈতন্যের বৃহত্তর মাত্রায় তাদের উন্নীত করেন।

বিশ্বায়নের যুগে :

অন্যেরা যখন অন্ধ – তিনি তখন দেখেন

অন্যেরা যখন জীবন্মৃত – তিনি তখন জীবিত, জাগ্রত

অন্যেরা যখন বধির – তিনি তখন একাই শোনেন

অন্যেরা যখন ভীত – তিনি তখন স্পর্শ করেন এবং সোচ্চার হন।