বিহঙ্গ পুরাণের অন্তিম পরিচ্ছেদ

হুমায়ূন মালিক
দীপ্রর খুব পাখি ধরার সাধ; কিন্তু সে না পারে পাখি ধরতে, না পাখি তারে ধরা দেয়। আসলে ও পাখি ধরতে চায় না পাখির ওড়াউড়ি নাকি ওদের বুনো জীবন! কারণ তার জন্য একটা গাড়ি কিনে আনা হলে প্রথমে সে দেখে চাকা ঘুরে ছুটছে গাড়ি, তারপরই সে একে একে গাড়ির চাকা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুলে খোঁজে কোথায় গতি, কোথায় তার ছোটা। আজ বিকালে খেলার বদলে পাখি ধরাটা তার মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে বাধ্য হয়ে আমি তাকে নিয়ে পক্ষী ধরা-ধরা খেলি কিংবা তার চাওয়ার উৎপাত থেকে রেহাই পেতে একটা পাখি যাতে তারে ধরে দিতে পারি সেই চেষ্টাই করি। শতাব্দীপ্রাচীন আমার বিশাল অফিসভবনে চড়ুই, জালালি কবুতর আর অনেক আবাবিল পাখির বাস। শুধু পাখি নয়, যখন-তখন প্রত্ন নিদর্শনতুল্য স্থাপনাটির আনাচ-কানাচ থেকে ডেকে ওঠে তক্ষক। দীপ্র কয় চকোলেটের লোভে ওরা ডাকে চক্লেট, চক্লেট… ভবনটির চারপাশের গাছপালায় চড়ে বেড়ায় প্রচুর কাঠবিড়ালি, বানর, হনুমান – যারা কিনা প্রায়ই শিকার বা খাবারের সন্ধানে ঢুকে পড়ে ভবনে। আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল থেকে সজারু, বাঘডাশ, হরিণ কী অজগরও শিকার বা খাবারের সন্ধানে চোরা-নজর বুলায় এদিকটায়, সুযোগ বুঝে হানা। এভাবে এখানে এই পাহাড়ি এলাকায় এমনসব প্রাণীর জীবনযাপন এই ভবন এবং তার ক্যাম্পাসকে আলাদা এক মহিমা দিয়েছে। আমরা বাপ-বেটা এর মধ্যে আবাবিল পাখির পিছে পিছে ছুটে হয়রান হই।
জানো, এরাই সেই আবাবিল, একটা গল্প পাড়ার ঢঙে আমি দীপ্রকে বলি, যারা একটা কমান্ডো অভিযান করে মিথ হয়ে আছে।
লোকমুখে শুনে আমার যদিও বলতে, ভাবতেও বেশ লাগে যে এরাই সেই ঐশিক পাখি তবে-কিনা প্রায় চামচিকার মতো ক্ষীণদেহী, সাদাটে বুক, কফি রং পেছনভাগ এই পাখিগুলোর আসল কী পরিচয় তা হয়তো পক্ষীবিশারদ ড. সালেম আলী কিংবা শরীফ খানই বলতে পারেন! কারণ পক্ষিবিষয়ক গ্রন্থে আবাবিলের যে পরিচয় আমি পাই তার সঙ্গে এর ফারাক বিস্তর। তবে হয়তো পাতলা দেহ গড়নের কারণে যথেচ্ছ গতিমুখ পালটে ওরা এমন চমৎকার ওড়ে এবং দলবেঁধে ঝাঁকে-ঝাঁকে এমন ভঙ্গিতে ওড়ে যে তারা সব কথিত সেই কমান্ডো অভিযানে!
ওরা ওই অভিযানে কী করেছিল? কমান্ডো অভিযান বা মিথ কী – আমার কথায় তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে দীপ্র জানতে চায়।
যে কোনো বাধা পিষে ফেলতে পারে এমন এক শক্তিশালী  হস্তিবাহিনী নিয়ে ইয়ামেনের বদ, দুষ্ট শাসক আবরাহা লুটতরাজ করতে করতে এগোচ্ছিল, সে-সময় ঝাঁকে-ঝাঁকে এই এরা মুখে-পায়ে কাঁকর নিয়ে তা বৃষ্টির মতো ওই বাহিনীর ওপর ফেলতে লাগে। তাতে তার দলের হাতি-সেনা মরে সাফ! রক্তাক্ত রাজা প্রাণটা হাতে নিয়ে দে ছুট্।
তাই!
হ্যাঁ। তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে চলো এক্ষণই আমরা কেটে পড়ি, না হলে আমরাও এদের আক্রমণের শিকার হতে পারি। দেখতেছ না আমাদের ডিস্টার্বেন্সের জন্য ওরা বাসায় ফিরতে পারছে না!
ও! আমারে বাসায় ফিরায়া নেওয়ার জন্য এই চালাকি!
কিন্তু বিশ্বাস করো পাখিরা সত্যি কমান্ডো অভিযানে পারদর্শী। জানো না পাখিরা দল বেঁধে-বেঁধে দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যায়, দলবেঁধেই তারা বিল-বাঁওড়-ক্ষেত-খলায় নামে – তাতে শত্র“র হামলার ব্যাপারটা নানা দিক থেকে নানা চোখে নজরে রেখে মোকাবিল বা পালানোর পথ বেছে নিতে পারে।
করুকগা, আমারে তুমি একটা পাখি ধইরা দেও, দীপ্রর একগুঁয়েমি, যে কোনো একটা পাখি।
তার অনড় অবস্থানের মুখে আমি যখন বলতে গেলে অসহায় তখনই তার মা শ্যামা নাজেল হয় – এখনও আমাদের ঘরে না ফেরায় বিরক্ত। সমস্যাটা তাকে বুঝিয়ে বলতে গেলে সে দীপ্রকে পরোক্ষ মাধ্যম করে একটা গোসা উগরে দেওয়ার সুযোগ নেয় – একটা পাখি পালা তো তেনার কাছে সাদাহাতি পোষা তাই বলছিলাম অন্তত ট্যাক্সিডার্মি করা একটা দোয়ল কিনেই বরং ড্রয়িংরুমে রাখুন।
তার বড়লোক মামার বাসায় একটা ঈগল এমন অসম্ভব নিখুঁত স্কিনিং, স্টাফিং করে মাউন্টিং করা যে, কারো বোঝার উপায় নেই প্রাণ দূরে এর ভেতর মাংস, নাড়িভুঁড়ি, মাথার ঘিলু, এমনকি তার চোখের কোটরে চোখ নেই! সিগারেটের গায়ে লেখা ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকরের মতো তার বেদিতে রচিত পরিহাস – ‘পাখিরে তুই খাঁচা ভেঙে বনে ফিরে আয়!’ এই পক্ষীপ্রেম যদি সংক্রামক হয় তবে নিশ্চয়ই একদিন পক্ষীজাতির পরিণতি গিয়ে ঠেকবে এমন কয়েকটি স্টাফিং বা নিছক ছবিতে।
দীপ্র তুমি জ্যান্ত একটা পাখি চাচ্ছ কিন্তু… তার মাকে পালটা জব্দ করার ইনটেনশন নিয়ে আমি তাকে বলি, তোমার মা যে ড্রয়িংরুমে একটা দোয়েলের মমি পেলেই খুশি!
না। দীপ্রর দুর্দমনীয় পাখি-সাধ আমার বাক্যটা কাট করে, আমাকে একটা জ্যান্ত পাখিই দিতে হবে।
আমরা আমাদের কোয়ার্টারের বারান্দায় উঠে অবাক। একটা পাখি চুপচাপ বসে আছে ছাদে ওঠার সিঁড়ির রেলিংয়ে। পাখিটা আমাদের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, উড়াল দেয় না, যেন আমরা তারই কেউ। এরই মধ্যে আনন্দে চিৎকার করে উঠেছে দীপ্র, তবু সে অনড়! পাখিটা কি অবুঝ, নাকি অসুস্থ? শ্যামা তাকে অনায়াসে হাতে তুলে নেয়। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে দীপ্র তা হাতে নিতে অস্থির। তার মা তাকে তা দিতে গেলে ও ফুড়–ৎ করে উড়াল দেয়, বসে সিলিং ফ্যানের প্লে¬টে। দীপ্র সুইচ টিপে ফ্যান চালিয়ে দিলে আমি প্রমাদ গুনি। পাখিটা সহসাই উড়ে গিয়ে শোকেসের ওপর বসে – ও তবে আত্মরক্ষা করতে জানে।
পাখিটা চেনার চেষ্টা করি। তার রং, আকৃতি কোনো এক প্রজাতিতে শনাক্ত হতে হতে রহস্যই হয়ে থাকে। একপর্যায়ে বোঝা গেল, আসলে এ বাড়ন্ত এক পক্ষীছানা। এখনও তার মধ্যে সেভাবে আপন জাতের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেনি। দিন কয়েক আগে ভোরে বাসার ছাদে উঠে দেখি এমনই এক পক্ষীছানা, তবে অনেক ছোট। রাতের ঝড়ে বাসা থেকে উড়ে এসে পড়েছে নিশ্চয়ই। আমি নিচে এসে দীপ্রকে নিয়ে আবার ছাদে যাই। ততক্ষণে ছানাটি উধাও। ইতিউতি তাকিয়ে দেখি অর্জুনের ডালে হলুদের মাঝে নীল-সাদার ডোরাকাটা চমৎকার পাখি জোড়ার মধ্যে ও! মাসখানেক আগে  নাম-না-জানা বিরল ওই পাখি-দম্পতিকে অর্জুন গাছটায় বাসা বানাতে দেখা যেত। আশ্চর্য, ওরা তাদের এতো ছোট বাচ্চাটাকে, যার এখনও ওড়া আয়ত্তে আসেনি, অর্জুনের এমন উঁচু ডালে তুলিল ক্যামনে! প্রতি গ্রীষ্মে পরিযায়ী কয়েকটা গায়ক পাখি আশপাশের বনজঙ্গলে অনেকটা ডাহুকের ঢঙে কিন্তু তারও চে মধুরতর সুরে এমন ডাকে যে আমার সাধ জাগে এদের ধরে রেখে বারো মাস গান শুনি! ধরাপড়া এই ছানা তো ওদেরও হতে পারে! ওদের ছানা হিসেবে একে মেলাতে গিয়ে এর ধূসর পাখা দেখতে দেখতে আমার মনে হয়, এ কোনো বর্ণিল পাখির উত্তরাধিকারী তো নয়ই, হয়তো নয় ওই সুকণ্ঠীদেরও কেউ।
আজ পুরো অফিস টাইম গেছে দৌড়-ঝাঁপে, এর মধ্যে ঘরে বিছানা দেখে শরীর আমার তাতে এলিয়ে পড়তে কাতর, আমি তারই প্রস্তুতি নিই। ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাহর হয় ওদিকে অতিসাধারণ এক পক্ষীছানা নিয়ে কেমন মেতে উঠেছে দীপ্র – তাকে উড়িয়ে উড়িয়ে তার সেই গতি ধরার খেলা। দীপ্রর জন্য করুণা হয় : এই পাহাড়ি দ্যাশে তার জন্ম এবং এই পর্যন্ত বেড়ে ওঠা অথচ আমার সমতটের শৈশব-কৈশোর যত বিচিত্র বর্ণের, গানের, স্বভাবের পাখি দেখেছে তার ভাগ্যে তা জোটেনি! ফাগুন পূর্ণিমায়, সে ৪০ বছর আগে, পাখিরা সারারাত এমন গানের উৎসবে মাতে যে ঘুমিয়ে নিজেকে তা থেকে বঞ্চিত করা দায়! কিন্তু সে সভায় কর্কশকণ্ঠী কেউ কী আবেগে মুখর হয়ে তাল ভঙ্গ করেনি? তেমন তো মনে পড়ে না! হয়তো বাদুরের চন্দ্রভীতি বলে কথা! কিংবা কর্কশ করতাল, মধুর বাঁশি সব মিলিয়েই সে এক অখণ্ড অনন্য সংগীত! সেখানে প্রাতে কোকিল বা হরিয়াল, নিশিতে পাপিয়া ডাকে আর ‘কেমনে রাখি আঁখি বারি চাপিয়া’ বলে বিরহী নিত্য ওদের ওপর দায় চাপে! তাদের বিরুদ্ধে আজ আর তেমন মধুর অভিযোগ নেই, সেদিন টিভির এক টক শোতে ইঁদুর-নিধন কর্মসূচি নিয়ে বলতে গিয়ে এক কৃষিবিদ পাখিদেরও ছাড় দেন না – এরা মাঠের শস্য, বিল-বাঁওড়ের মাছ সাবাড় করছে, তার বদলে উপহার আনছে রোগবালাই।
এরা যে ক্ষতিকর পোকামাকড়, ইঁদুর, এক পরিবেশবিদ তাকে জব্দ করার প্রয়াস নেন, মরা জীবজন্তু খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ…
যাকে লোকে বলছে আমাদের সবচে পাখি সমৃদ্ধ জায়গা সে মনপুরা দ্বীপে এরা কত টন ধান খেয়ে কৃষকের কী সর্বনাশ করছে খোঁজ রাখেন?
ওদিকে এখনও বসন্তে ঢাকার মতো মহানগরে কোকিলের ডাক শোনা গেলেও দীপ্র এখানে এই পাহাড়ি নগরে তার বিগত জীবনে কোকিলের একটা ডাক শুনেছে কিনা সন্দেহ! হয়তো ফুড-হ্যাবিটের কারণে কোকিল এদিকটা পরিহার করে চলে; কিন্তু এমন পাহাড়ি এলাকায় পশুপাখির দৈন্যের জন্য নিশ্চয়ই দায়ী তারা যারা বংশানুক্রমে উল্লুক থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র মুনিয়া ধরে পাচার করে করে ততদিনে এখানকার এক ক্ষুদ্র শিকারি নৃগোষ্ঠীই বনে গেছে।
ফিটিং হচ্ছে না! সহসাই ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে মুখ বাড়ায় অতৃপ্ত দীপ্র – হাতে একটা কার্টনে বন্দি পক্ষীশাবক, বলে, এর জন্য একটা খাঁচাই কিনে আনতে হবে।
আমি খাঁচা সূত্রে তার ম্যাকাও পাখির পুরনো দাবি উঠে আসার আশঙ্কায় – খাঁচা কিনতে যে তাকে নিয়ে যেতে হবে পাখি মলেই। টিভিতে পাখি সংক্রান্ত এক রিপোর্টে ম্যাকাও দেখে তা পোষার এক উদ্ভট দাবি করে বসে ও, আর যা কিনা এ দেশে পাওয়ারই কথা নয় পাখির বাজারে গিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে তা মেলায় দাবিটা কিনা ভিত পেয়ে যায়। তবে কিনা দুনিয়াজুড়ে বহু মানুষ পাখির প্রশ্নে এক দীপ্র – শিশু-কিশোর! তারা পাখির সমুদয় সৌন্দর্যকে খাঁচায় আটকে উপভোগ করতে চায়, এ আভিজাত্য ফলানোও বটে। তাই এখন তাবৎ বিশ্বে যতকিছু চোরাচালান হয় তার মধ্যে মাদক আর অস্ত্রের পরই লাভজনক এবং অর্থনৈতিক লেনদেন প্রশ্নে দ্বিতীয় এই পশুপাখি! পাচারকারীরা তা থেকে বছরে আয় করে হাজার কোটি ডলারেরও বেশি আর তাতে থাকে ২০ থেকে ৫০ লাখ পাখি – ক্ষুদ্রতম হামিংবার্ড থেকে অতিকায় ঈগল। তো দীপ্রর ম্যাকাও পাখির দাবির মুখে মানুষ কিভাবে পাখি পোষার নামে দুনিয়ার পাখি বিনাশে লিপ্ত আছে তা বোঝানোর প্রয়াসের শেষে তার সামনে প্রশ্ন রাখি, তুমিও শেষে পক্ষীখুনিদের দলে যাবে!
এমন এক প্রশ্নের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে যখন আমিই এর চে’ বড় এক প্রশ্নের মুখে যে, ও তা মোকাবেলার যোগ্য কিনা তখনই সে বলে বসে, দুনিয়ায় পাখি না থাকলেই কী!
তবে পরিবেশের ভারসাম্য বা জীববৈচিত্র্য কী বস্তু দীপ্রর তা-ই বোঝার কথা না, তার ওপর অভিব্যক্তিবাদের খুঁটিনাটি! সার্বিক বিবেচনায় নিশ্চয়ই হোমোস্যাপিয়েন্সই শ্রেষ্ঠ। তবে কিনা অনেক প্রাণী কিছু-কিছু বৈশিষ্ট্যে তার চে’ অনেক অনেক অগ্রগামী, যেমন ঘ্রাণশক্তিতে কুকুর। গ্রীষ্মে বউ-কথা-কওয়ের এমন যে সুর যাকে কোনো পাপ-কষ্ট-গ্লানি কখনো স্পর্শ করতে পারে না, চোখগেলর কোমল কণ্ঠে যে হৃদয়-চেরা বিলাপ কী বসন্ত বাউরির মিড় যে আশ্চর্য সুধা – জনম-জনম সেধে কেউ কি তা সাধন করতে পারে!
দীপ্রর কথায় এমন এক পাখিহীন বিশ্ব আমার চেতনে উদিত হতে থাকে যেখানে পাখির গান ও সৌন্দর্যের সাথে লুপ্ত সব বৃক্ষলতা, ফুল, ফুলের সৌরভ! তো তাকে পাখির মর্ম বোঝানোর চিন্তাটা তার তা বোঝার মতো বেড়ে ওঠাতক স্থগিত থাক।
কিন্তু তার পাখি কেনার চাপ থেকে আমি নিস্তার পাই না। তবে ম্যাকাও যেহেতু আমাদের দেশি পাখি নয়, পরিযায়ী হিসেবেও এখানে আসে না, এমনকি বাজারে পাওয়াও অসম্ভব তখন মুনিয়া কী টিয়া দিয়ে দীপ্রকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে একদিন তাকে নিয়ে আমি বন্যপ্রাণীর বাজারে যাই। মুনিয়ার দামদর করতে-করতে তৃতীয় দোকান ঢুকেই আমার টাস্কি লাগে – দুর্দান্ত নীল এক ম্যাকাও, যেন এ বার্ড ফ্রম প্যারাডাইস!
এটা এখানে কী করে এলো!
আমার বন্ধু পক্ষীগবেষক ড. রকিব গেল আমাজন ঘেঁষা পাখির এক সমৃদ্ধ রাজ্যি ইকুয়েডরে। তার বিমানবন্দরে এক পাচারকারী কী করে তাকে চিনে ফেলে যে ওদিকে এই বাবুরই আবার পশুপাখি পোষার শখ আছে। তার সামনে তারা বনসাই ধাঁচের দুর্লভ প্রজাতির এক বাট্টু টিয়া দুলিয়ে দাম হাঁকে পাঁচশ ডলার! ব্যাটা তাকে পুঁজিপতি ঠাউরেছে নিশ্চয়ই!
তা না-হয় দিলাম কিন্তু প্লেনে তো এ চেঁচিয়ে সিকিউরিটি ডেকে আমায় ফ্যাসাদে ফেলবে!
একটু ভদ্কা খাইয়ে পকেটে পুরে নাও, ব্যস।
ধরার সময় তো মরে এই সব পাখিদের অর্ধেক এরপর এভাবে নানা কায়দায় – পার্লারের উপকরণ বা ওষুধের বাক্স, থার্মোফ্লাস্ক, টয়লেট পেপার টিউব ইত্যাদিতে পাচারকালে চাপে-তাপে-ক্ষুধায় মারা পড়ে জীবিত ধরাপড়াদেরও শতকরা পঞ্চাশ।
অতঃপর এই ম্যাকাওটার দাম কত দাঁড়াল!
এটা কিন্তু দুর্লভ প্রজাতির… দাম জানতে চাইলে লোকটা নিশ্চয়ই আমাকে ম্যাকাওটার উপযুক্ত ক্রেতা মনে করে না, তাই হয়তো নিছক জব্দ করার জন্য কয়, আমেরিকায় এ বিকায়  দশ হাজার ডলারে – আপনি কত দিতে পারবেন?
এত দাম দিয়ে কেনার মতো টাকাওলা এই দ্যাশে আছে নিশ্চয়ই, না হলে তা এতদূর থেকে এখানে আসছে কেন! এখানকার অসৎ আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী তো এমন সব পশু-পাখির জন্য বাড়িতে আস্ত চিড়িয়াখানা বানাচ্ছে! আর একটা প্রমোশন হলে তেমন অঙ্কের ঘুষের টাকা আমারও হাতে আসবে। কিন্তু দীপ্রর ম্যাকাও দেখার পর তাকে যে মুনিয়া দিয়ে তুষ্ট করার উপায় থাকে না। উপায় না দেখে আমি দোকানিকে নিতম্বে সাদা বা কালোর ফুটফুট ডিজাইনের টুকটুকে লাল রূপসী মুনিয়ার কথা পাড়ি।
চড়া দামে হলেও কয়েক বছর আগেও ঘরের শোভার জন্য মিলত ওই মুনিয়া কিন্তু শিকারিরা এরে এখন খোঁজে গুপ্তধনের মতো – পায় না, পাশ থেকে সেল্স-গার্ল বলে, ওই দুর্দান্ত লাল রূপই কাল হলো তার।
ম্যাকাওটার দারুণ ওই নীল রূপও নিশ্চয়ই একদিন কাল হবে তার।
ল্যাটিন আমেরিকার অভাবী মানুষেরা পাইকারের কাছ থেকে আগাম অর্থ নিয়ে কিংবা তা পাওয়ার প্রত্যাশায় দলে দলে আমাজান অববাহিকার পাখিসমৃদ্ধ গভীর বনে ঢুকে পাখির জন্য রীতিমতো কমান্ডো অভিযান চালায়। কৈশোরে যেমনটা দেখি ফাঁস-ফাঁদ, জাল নিয়ে আমাদের গাঁয়ের একদল হতদরিদ্র এই বলাবলি করে  হাওরের দিকে যাচ্ছে যে, শহুরে লোকদের অতিথি পাখির মাংস ভারি পছন্দ! ওদিকে দৃষ্টিনন্দন বুনো পাখির মধ্যে অন্যতম ম্যাকাও। এ বাঁচেও কয়েক দশক। মেক্সিকো থেকে পেরু, বলিভিয়া, ব্রাজিল পর্যন্ত তার বাস। এর বাচ্চা সংগ্রহ করতে গিয়ে ল্যাটিন লুম্পেনগুলো গাছ কেটে কেটে বনও সাফাই করে চলেছে! আর বাসাসমেত সুদীর্ঘ সেই গাছ যখন মাটিতে পড়ে তখন গড়ে তার অর্ধেক বাচ্চারই জান খতম।
জানো, শিকারিরা চলে যেতে না যেতেই বাবা-মা তাদের মরা বাচ্চাগুলোর কাছে উড়ে আসে, দীপ্রকে আমি ম্যাকাও পাখির ছোটগল্পের পরিণতি টানতে গিয়ে বলি, ছোট্ট বুকে কী কষ্ট নিয়ে যে ওরা মরা সন্তান নিয়ে বসে থাকে!
কিন্তু এসব বলে ম্যাকাও থেকে তার মন মুনিয়ার দিকে ফেরানো যায় না।
নীল ম্যাকাও কিংবা লাল মুনিয়া নয়, ধূসর এক অজ্ঞাত কুলশীল পক্ষীছানা নিয়ে এখন মেতে উঠেছে ও।
শৈত্যপ্রবাহে কাতর পৌষ-রাত। দরজা-জানালা বন্ধ করে শিশুপাখিকে আপাতত আমরা বেডরুমে অবমুক্ত করি। পাখিটা উড়ে গিয়ে বসে টিউবলাইটের বিপজ্জনক ব্যালাস্টে। বিদ্যুতের তারে প্রতি মুহূর্তে যত পাখি মরে তা ফসলের কীটনাশকে মরার চে’ কম না বেশি, তার পরিসংখ্যান কেউ কি রাখে!
সম্ভবত পায়ে গরম বোধ হওয়ায় ও সেখান থেকে উড়ে বুক-শেলফের ওপর বসে।
বাবা দেখ ও কার্টুন সিনেমা দেখছে!
ও আর কোনো ওড়াউড়ি করে না। সম্ভবত এভাবেই আমাদের সঙ্গে ঘুম যায়।
ভোরে আমার ঘুম ভাঙে পাখিদের চেঁচামেচিতে! এত ভোরে ওঠা আমার অভ্যাস নয়। এখানে তো এত পাখি নেই যে তাদের কোলাহলে ঘুম ভেঙে যাবে! ওদের কিচিরমিচিরে ঘুমের রেশ আর একটু টুটে গেলে মালুম হয় এ জীবন-মরণ বিবাদ এবং তা চড়ুইকুলে। বোঝা গেল বাইরে থেকে একাধিক উদ্বিগ্ন – বিক্ষুব্ধ চড়–ই আমাদের বেডরুমের ছানাটিকে টার্গেট করে চেঁচিয়ে ডাকছে আর সঙ্গে-সঙ্গে ভেতর থেকে এ সাড়া দিচ্ছে, আবার এখান থেকে এটি ডাক দিলে বাইরে থেকে ওরা। তো বোঝা গেল এ আসলে অকুলীন এক চড়ুই ছানা! তবে কিনা ঘরের মানুষগুলোর পরেই এই চড়–ই, সবচে’ কাছের পাখি! ওদের বাসা নিশ্চয়ই আমাদের সিঁড়িকোঠার কোণে ভেনটিলেটরে, একটু বড় হয়ে ওঠায় মা-বাবার অজান্তে ছানাটি বাসা থেকে উড়ে রেলিংয়ে বসেছে কিংবা কোনো কারণে বাসা থেকে পড়ে গিয়ে থাকবে। যাক, ধরার পর থেকে যে ছিল শান্ত সুবোধ বালক সে এখন এতটাই মুক্তিকামী – দ্রোহী হয়ে উঠেছে পারলে দেয়াল ভেঙে বা ফেঁড়ে বাবা-মা তথা বাইরে যায়!
যেহেতু এমন পরিস্থিতিতে ঘুমানো অসম্ভব আমি বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে ওদের তাড়া করতে জানালা খুলি। খুলে হেইস্ হেইস্ বলে তাদের তাড়া করছি কিন্তু কী দুঃসাহস দুটি চড়ুই চেঁচাতে চেঁচাতে উড়ে আমার খোলা জানালার  ফ্রেমের ওপর বসে। এরাই নিশ্চয়ই এই শিশু চড়ুইয়ের মা-বাপ। যদিও ওরা আমার হাতের নাগালের বাইরে তবু আমি হাত বাড়িয়ে ওদের ধরার ভঙ্গি করে ভয় দেখাই, তারা তেমন গা করে না।
এরই মধ্যে শিশুটা জানালার ফ্রেমে মা-বাবাকে দেখে কিংবা তাদের ডাক শুনে সেদিকে উড়াল দিয়ে এখনও সেভাবে ওড়াউড়ি রপ্ত না হওয়ায় আধপথ উড়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।
আমার ধমক-ধামক শুনে দীপ্র, ‘জানলাটা বন্ধ করো’ বলতে বলতে শ্যামাও ওঠে। আমি বেডরুম ছেড়ে তার পরের দীর্ঘ স্পেসরুম পেরিয়ে বাইরে আসি। ওদিকে বেডরুমে দীপ্রর পাখি ধরার চেষ্টা আর বাইরে বাচ্চার মুক্তির জন্য মা-বাবার চিৎকার, ওড়াউড়ি – সংগ্রাম চলছেই।
করিডোরে পায়চারি করার মধ্যে আমার দুরন্ত কৈশোর আমাকে পেয়ে যায়। ডিম, ছাঁ, এমন কী তাদের মা-বাপকে খেতে পাখির বাসায় নাকি সাপ ঢোকে, তার মধ্যে কেউ হাত ঢুকিয়ে ছানা ধরতে গেলেই দে ছোবল! এমন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বড় কায়ক্লেশে তালগাছে উঠে তার কোটর থেকে টিক্কাময়নার দুটো বাচ্চা পেড়ে আনলাম। কয়েকদিন কেঁচো, প্রজাপতি, খুদ খাওয়ালাম কিন্তু একরাতে ঘরে বেজি ঢুকে বাঁশের খাঁচা ভেঙে খেয়ে ফেলল তাদের। এক কিশোর যেন আপনজন খুন হওয়ার দুর্বহ যন্ত্রণায় মধ্যে। তাদের চুইচাই ডাক, হাঁ মেলে আহার চাওয়া, খাঁচার ফাঁক-ফোক দিয়ে মুক্তি খোঁজা, নানা স্মৃতি কয়েকদিন তাকে তাড়া করে – আমি স্বস্তি পাই না।
এবার আমি পাকা কোড়া শিকারি বলে খ্যাত এক পাখিঅলার কাছ থেকে একটা কিশোর ঘুঘু কিনলাম। কেনার সময় তার কাছে লালন-পালনের খুঁটিনাটি সব জানতে চাইলে লোকটা নিজেকে জাহির করার জন্য ডুফি দিয়ে ডুফি শিকারের যাবতীয় কৌশল, তার অভিজ্ঞতা সোৎসাহে কইতে থাকে। এমন এক ডাক সে নকল করে শোনায় যা শুনে অন্য ডুফি প্ররোচিত হয় মারামারিতে, আরেকটা ডাক ডাকতে ডাকতে সে পক্কির পিঠ-বাওয়ার অশ্লীল ভঙ্গি করে।
তো উত্তেজিত হইয়া যেই-না বুনোটা ওইড়া গিয়া খাঁচার বারান্দায় বইল তৎক্ষণাৎ ঝাপ পইড়া লম্পট বন্দি, সে আমার গাল টিপে বলে, বাস তুমি তারে ধইরা জবাই দিয়া মাংস খাও।
কিন্তু এই কিশোর যে কী চায় কে তাকে তা বোঝাবে! ও যে সোলায়মান পয়গম্বরের মতো পক্ষীবিষয়ে ঐশ্বরিক ক্ষমতাপিয়াসী। তার মধ্যে এক ক্ষুদে পয়গম্বরের সাধ তাদের ভাষা বুঝে তাদের সঙ্গে কথা কয়। যখন ইচ্ছা তখন তাদের কায়া নিয়ে তাদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে ওড়ে। কোকিল, ডাহুক, বুলবুলি – যখন খুশি যার সুরেলা কণ্ঠে গায়। হয়তো তা না পারা থেকে তখন তার পাখি পোষার সাধ। ধান রোয়ার জন্য জমি চাষ করায় মাটির তলা থেকে বেরিয়ে পড়েছে কেঁচো-কীট-পতঙ্গ-শস্যদানা আর তার জন্য সেখানে উড়ে এসেছে রাজ্যির পাখি – দোয়েল-শালিখ-ফিঙে-বক, তাদের পিছে দৌড়াচ্ছে ও কিন্তু একটা ভাওত্তা শালিখও কিনা তারে ধরা দেয় না, ছুটে ছুটে বেফানা ও, ঘুমেও – নিজের মধ্যে ছোটে, বোবাধরা! কিন্তু দীপ্রর চাওয়া কী তেমন! যেদিন নীল ম্যাকাও না-কিনে ফিরে এলাম সে-রাতে ও ঘুমে কিংবা অদ্ভুত সম্মোহনে জল থেকে জলহীন কাদায় পড়া মাছের মতো পাখির জন্য গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানাময় ছোটে, যেন এ এক অদ্ভুত ইলুশানের মধ্যে বিশ্বময় মানুষের পাখি চাওয়া!
তো কুড়া শিকারির কাছে ঘুঘু পরিচর্যার যা-যা আমি জেনেছিলাম তা ঠিক-ঠিক ফলো করলাম কিন্তু দিনে-দিনে ছানাটা কেবল দুর্বল হতে থাকে। আমি তার দুপুরের ঝিম ধরানো ঘুমপাড়ানিয়া ডাক শোনার তেষ্টা থেকে কত ডু… ডু… ডাক শিখাই কিন্তু কে জানে কী অভিমানে এই ক্ষুদে পয়গম্বরের সাধনায় একটুও সাড়া না দিয়ে এক অমাবস্যায় মরে যায় ও! বেশ কয়দিন আমি তার জন্য বিষণœতায় ভুগি।
মাথাভাঙা পেঁপে গাছের খোড়লে দোয়েলের বাসা দেখে এবার পরিণত বয়সী একটা পাখি ধরার বাসনা আমার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। খোড়লের মুখ ঘিরে শক্ত সুতার গেরোর ফাঁদ পেতে তার গোরাটা বাঁধলাম ছিপের ডগায়। সন্ধ্যায় দোয়েল জোড়া উড়ে এসে প্রথমে বাসার পাশের পেঁপে ডালটায় বসে, তার একটা এমন হঠাৎ বাসায় ঢুকে পড়ে যে আমার কিছু করা হয়ে ওঠে না। বাসা থেকে সে আদুরে গলা বাড়িয়ে দিতেই দ্বিতীয়টা উড়ে গিয়ে যখন খোড়লের মুখে দাঁড়িয়ে চঞ্চু দিয়ে তার মুখে চুমো বা আদর দিচ্ছে ঠিক তক্ষণই আমি ছিপের গোড়া ধরে দিলাম টান। আৎকা টানটা এত জোরে হয়ে গেল যে তাতে শুধু দোয়েলটার পায়ে কঠিন একটা গেরো লাগাই নয়, তার প্রাণও যায়। কদিন নজর রেখে যখন দেখলাম জোড়ার অন্যটাও আর বাসায় আসছে না টুলে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখি পড়ে আছে চারটা নীলচে সবুজ ডিম – বুঝলাম কী অপরাধ আমি করেছি।
বাবা, বাবা… আমার ওই অতীতের মধ্যে সহসাই দীপ্রর এমন চিৎকার ভেসে আসে যেন বাসায় ডাকাত পড়েছে। তার সঙ্গে কয়েকটা চড়ুইয়ের ডাকাডাকি, চিৎকার – কুরুক্ষেত্রের সবটাই যেন এখন বাসার ভেতরে।
স্পেসরুমে ঢুকে ঘটনা দেখে আমার টাস্কি লাগে – বেডরুমের ভেতর থেকে একটা বড় চড়–ই উড়ে দরজায় ওপর বসে ভেতরের দিকে মাথা ঘুরিয়ে ডাকে; সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটা উড়ে বেডরুম থেকে বেরিয়ে স্পেসরুমের মাঝামাঝি এসে পড়ে যায়। ছানার ওড়াকে কভার দিতে গিয়ে বাবা কিংবা মা বেডরুমের দরজা থেকে তার পাশাপাশি উড়তে উড়তে ততক্ষণে বাইরের দরজার পর্দার চেইনের ওপর গিয়ে বসে টাল সামলাচ্ছে। সহসাই কোথা থেকে যে আরেকটা চড়ুই এসে বাচ্চাটার সামনে দাঁড়িয়ে পাখা মেলে উরু উরু ভঙ্গি দেখিয়ে চি… চু পাখির ভাষায় বলছে, ওড়… ওড়…
অন্তত যে কোনো একটাকে তো ধরো মা, দীপ্র কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বাবা তুমি…
তার কথায় আমার ঘোর ভাঙে বটে কিন্তু ততক্ষণে তার মা কিংবা বাবাকে ফলো করে আবারও উড়াল দিয়েছে শিশু। তার পেছনে ছুটছে শ্যামা।
এর মধ্যে বাবা-মা বিপদসীমা অতিক্রম করে গেলেও তাদের সন্তান বারান্দার টবে নাইট-কুইনের ডাটায় বাধা পেয়ে পড়ে যায় সিঁড়িতে। খোলা দরজা দিয়ে তা দেখে আমরা বাপ-বেটা দুজনেই ছুট্ দিই তাকে ধরতে। পেছনে শামা – না, ও দরজায় দাঁড়িয়ে বোবাধরা মানুষের মতো দৌড়াচ্ছে। এরই মধ্যে আবার পাখিটার মা-বাবা তার সামনে নেমে এসে মুখে, পাখার ভঙ্গিতে বলছে, ওড়…
আমি বাপ কিংবা মাটাকে ধরে ফেলছি প্রায় সহসাই, মুহূর্তের ব্যবধানে, তিন-তিনটা পাখিই উড়াল দেয়। এ দেখি এদের এক সফল কমান্ডো অভিযান!
কিন্তু এমন একটা অপরিপক্ব বাচ্চা নিয়ে ওরা যাবে কত্দূর! এই সেদিনও শিকারিরা বিশ্বসেরা হান্টিং গ্রাউন্ড ল্যাটিন আমেরিকায় ৩০ শতাংশ টিয়ার বাসা ধ্বংস করে প্রতিবছর আট লাখ ছানা পাচার করত যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ ইউরোপের ধনী-ধনী দেশে। যেন এও এক উত্তর-দক্ষিণ কারবার! শিল্পায়ন তো উত্তরের পাখির ঘর ভেঙে তাকে শেষ করেছে আগেই। এখন বিশ্বায়ন, বিনিয়োগের নামে তারা সে খেলায় মেতেছে দক্ষিণে। ততদিনে কিন্তু পাচার প্রশ্নে দক্ষিণের আইন বড় কড়া। হলে কী –  এমনসব কাণ্ডকীর্তিতে ইতিমধ্যেই সে যে প্রায় নিঃস্ব!
বাবা-মার মধ্যে ওড়ায় যে চড়–ইটা অগ্রগামী সে গিয়ে বাউন্ডারি গ্রিলে বসে কথা ও দেহভঙ্গিতে বাচ্চাকে তার পাশে বিরতি দিয়ে দম নিতে বলে। বাচ্চা সে অনুযায়ী গ্রিলে বসতে না বসতেই সে উড়াল দেয় বাউন্ডারির ওপারে অদূরের, তবে আমাদের নাগালের বাইরে, গামারি গাছটার দিকে। তাকে অনুসরণ করে গ্রিলের আকাশমুখী চোখা বল্লম থেকে সন্তান নিয়ে পাখা মেলছে অন্যটি, সহসাই কে যেন বলে চড়–ইয়ের মাংস ভায়াগ্রার চে’ যৌনোত্তেজক। আর সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে ছোড়া এক ঢিল চড়–ইটাকে গেঁথে ফেলে বল্লমে, যেমনটি কদিন আগে দেখা গেল পত্রিকায় – ওপর তলা থেকে ফেলে দেওয়া এক কুমারী মাতা বারবনিতা গেটের এমনি এক ঊর্ধ্বমুখী ফলায় গাঁথা! নারী ও পাখির মাংস বড় মোহের! পশুপাখি পোষা ল্যাটিনদের ঐতিহ্য হলেও বুনোদের আজ আর সে আদরের ভাগ্য হয় না, তারা সব চালান হচ্ছে হোটেল-রেস্তোরাঁয় পক্ষীখাদকদের থালায় থালায়।
মাংস ভোজের স্বপ্ন ভেদ করে বেঁচে যাওয়া চড়–ইটা গামারি ডাল থেকে উড়ে তার বাচ্চাকে ডাকতে ডাকতে অর্ধেক পথ ফিরতে না ফিরতে উড়াল দিয়েছে মুহূর্ত কাল আগে মা কী বাবাহারা সন্তান।
বাবা, মা তোমাদের জন্যই… দীপ্র ক্ষোভে-দুঃখে সাপের মতো ফোঁসে।
আজই আমি তোমাকে একটা আগুনরঙা, আমি স্বস্তির নিশ্বাস নিতে নিতে বলি, জমকালো ম্যাকাও পাখি কিনে দেব।