বেনিফিট অব ডাউট

মাসউদুল হক

কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই আনিসকে খুন করে ফেললাম আমরা। আমরা মানে, আমি আর কাসেদ। বিপুল ছিল তখন টয়লেটে। হুড়োহুড়ির শব্দ শুনে সে যখন টয়লেট থেকে বের হয়ে এলো, তখন বিস্ময়ভরা চোখে ছাদের দিকে চেয়ে আছে আনিস। তার মুখ যন্ত্রণামাখা। সামান্য বের হয়ে আসা জিভটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা। আজরাইল যখন তার জানটা নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে কতটা কষ্ট পেয়েছে তা বের হয়ে আসা জিভের কামড় দেখে বুঝে নেওয়া যায়। আমি আর কাসেদ একই সঙ্গে বিস্মিত, নির্বাক এবং ভয়ার্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একসঙ্গে এত পদের অনুভূতির মিশেল আমাদের জীবনে আগে কখনো হয়নি। আনিসের হৃদ্স্পন্দন না শুনে কিংবা কব্জিতে আঙুল না চেপেও বুঝতে পারছিলাম – আনিস শেষ। ছুটির দিনগুলোতে মেসে বসে তাস খেলা আমাদের অনেকদিনের অভ্যাস। সরকারের শেষ সময়টায় হরদম হরতাল থাকায় নিয়মিত ছুটির বাইরেও আরো বেশি বেশি অলস সময় ধরা দিচ্ছিল। সঙ্গে যোগ হয়েছে আগাম বর্ষা। অবরুদ্ধ এ-সময়গুলোকে আনন্দময় করতে আমরা দিন দিন তাস খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছিলাম। দুই-একবার লুডু বা দাবার মতো ঘরোয়া খেলার কথা আমাদের যে মনে হয়নি তা নয়। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রুচির পরিবর্তনের কারণে সেসব খেলা তাস খেলার বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাসের একটা মজা হলো, একই তাস দিয়ে নানা প্রকারে খেলা যায়। ফুটবল দিয়ে শুধু ফুটবলই কিংবা ক্রিকেট বল দিয়ে শুধুই ক্রিকেট খেলা যায়; কিন্তু তাসের বিষয়টা আলাদা। আজ তাস দিয়ে টোয়েন্টি নাইন, তো কাল ব্রে। পরশুদিন মন না চাইলে স্পেকট্রাম। এক একটা তাসের আবার এক একটা অদ্ভুত নাম। হরতন, রুইতন, টেক্কা। নামগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা ঘোর লাগানো ভাব জমে থাকে। তাই কম্পিউটার আর ফেসবুকের বদলে আমাদের তাস-আসক্তি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। খেলার আসক্তি নিশ্চয়ই মাদকাসক্তির মতো নয়। তা না হলে, কে জানত, তাস খেলাও একসময় একঘেয়ে মনে হবে আমাদের। আর তাস খেলাটাও যখন একঘেয়ে মনে হলো অথচ কোনো উপযুক্ত বিকল্প খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন আমরা খেলাটাকে আরো বৈচিত্র্যময় করলাম টাকার ব্যবহারে। এই টাকার আমদানি দারুণ একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে দিলো আমাদের মধ্যে। শেষবার যে হেরে যেত সে শোধ তোলার আশায় উদগ্রীব হয়ে থাকত। সব পরাজিতের মতো সেও বিশ্বাস করত, পরবর্তী সুযোগটাই তার। টিভিতে হরতালের ঘোষণা শুনলেই তাস বের করে সর্বশেষ পরাজিত ব্যক্তিটি সেগুলো নাড়াচাড়া শুরু করত। এই তাস নিয়ে নাড়াচাড়াটা ষাঁড়ের পা দিয়ে মাটি খুঁচিয়ে প্রতিপক্ষকে লড়াইয়ে আমন্ত্রণ জানানোর মতো। তাস খেলায় আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোদিন হেরে যেতাম। সুতরাং মাটি খোঁচানো ষাঁড়ের অভাব হতো না কোনোদিন। বেশ কদিন তাস খেলার পর আমরা আবিষ্কার করলাম, আনিস তাস খেলায় আমাদের তিনজনের তুলনায় একটু কমই হারে। তাস খেলে জেতা টাকায় আনিস নতুন নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে আমাদের সামনে দিয়ে যখন হাঁটত, তখন আমাদের খুব কষ্ট হতো। পরাজয়ের বেদনা বেশ আয়োজন করে বুকের ভেতর ঘুরপাক খেত। আনিস খেলেই জয়ী হতো; কিন্তু তারপরও আমরা কেন যেন তাতে ছিনতাই ছিনতাই গন্ধ পেতাম। এমনিতে আমার, আসিম, বিপুল বা কাসেদের মধ্যে যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল তা নয়। এ মেসের গোড়াপত্তন আমার হাতে হলেও নানা কারণে আদি সদস্যরা একে একে মেস ছেড়ে চলে গেলেও বন্ধুর বন্ধু হিসেবে আমরা চারজন এই দুই রুমের ঘরে একত্রিত হয়েছিলাম। একসময় ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়েও আমরা নতুন দ্বীপে ভালোই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। তবে তাস খেলায় আনিসের প্রায়শ জয় আর আমাদের তিনজনের প্রায়শ পরাজয় আমাদের  সঙ্গে আনিসের একটা মানসিক দূরত্ব তৈরি করেছিল বলে আমার ধারণা। সেজন্য আজ যখন আনিসকে আমরা তাস চুরি করতে দেখলাম, তখন আমি আর কাসেদ নিজেদের ঠিক রাখতে পারিনি। গত মাস দুয়েকের পরাজয়ের বেদনা ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছিল। কাসেদ ‘চোর’ সম্বোধন করে আনিসের গালে একটা থাপ্পড় মারার পর আনিস থেমে গেলেও পারত। কিন্তু আনিস না থেমে উলটো কাসেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমার বিবেচনাবোধ বলে, চুরিও করবি আবার চুরির শাস্তি দিতে গেলে প্রত্যাঘাত করবি – এটা মেনে নেওয়া দুষ্কর। ঝগড়া থামানোর অজুহাতে আমি আনিসের দুই হাত চেপে ধরে কাসেদকে আরো কয়েকটি চড়-থাপ্পড় মারার সুযোগ করে দিতে চেষ্টা করি; কিন্তু আনিস যেন কী করে আমার গোপন উদ্দেশ্য বুঝে যায়। সে কনুই দিয়ে আমার পেটে আঘাত করতেই আমি আরো ক্রোধান্বিত হয়ে যাই। আমি আনিসকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দেয়ালের দিকে ধাক্কা দিই। আর তখনই প্রাথমিক আঘাত সামলে উঠে আনিসের বুক বরাবর একটা প্রচন্ড লাথি কষে কাসেদ। সেই লাথির আঘাতে আনিসের মাথা সজোরে আঘাত করে কংক্রিটের কঠিন দেয়ালে। আঘাতের শব্দ শুনে যে কেউ ভাবতে পারে, একটা বড় নারকেল প্রচন্ড জোরে কেউ ছুড়ে মেরেছে বাড়ির দেয়ালে। তাতে চারতলা বাড়ির পুরোটা যেন কেঁপে ওঠে। পিনপতন নীরবতার মধ্যে আনিসের দেহটা ধপ করে মেরুদন্ডহীন মাংসের দলার মতো ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। যদিও আনিসকে খুন করার কোনো ইচ্ছা ছিল না আমাদের। কিন্তু ঘটনাগুলো এমনভাবে ঘটেছে যে, দুর্ঘটনা বলে আমরা ঘটনার দায়ও এড়াতে পারছিলাম না। আমরা অনুভব করি, আনিসের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা দুজন সাধারণ মানুষ থেকে একজোড়া খুনিতে পরিণত হলাম। আমি একটা বিদেশি এনজিওতে মাত্রই যোগ দিয়েছি। কাসেদ আছে একটা খ্যাতনামা বায়িং হাউসে। আমাদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। আমার বা কাসেদের জন্য আরো উচ্চপদে আরোহণ এবং দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। কাসেদ তার প্রেমিকা নাজরানাকে বিয়ের প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল আর আমার অভিভাবকরা আমার জন্য একটা টুকটুকে বউ খুঁজছিল। আমিও মনে মনে বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন সাজাচ্ছিলাম। ইউরোপের রাস্তায় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর ভাবনাটা হানা দিচ্ছিল যখন-তখন। কাসেদকেও একদিন ফোনে বলতে শুনেছিলাম, ‘আমরা হানিমুনটা নেপালে বা সিঙ্গাপুরে করব, তুমি শিওর থাকো।’ এমন একটা সম্ভাবনাময় সময়ে আনিসকে মেরে ফেলার মতো মনমানসিকতা কারো থাকার কথা নয়। যদি জানতাম আনিস এভাবে মরে যাবে তাহলে সে প্রতিদিন তাস চুরি করে আমাদের ফতুর করে দিলেও আমরা চুপ করে থাকতাম। কিন্তু বন্দুক থেকে গুলি বের হওয়ার পর করা আফসোস অর্থহীন। বিপুল টয়লেট থেকে বের হয়ে একবার কী মনে করে যেন আনিসের বুকে কান পাতল। একবার ওর নাড়িও টিপে ধরল। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী করলি তোরা?’ ওর তাকানোর মধ্যে ততক্ষণে ঘৃণা ফুটে উঠেছে। সেই ঘৃণা আমাদের চেতনামূলে আঘাত করে। আমরা ছাড়া বাংলাদেশের বাকি পনেরো কোটি লোক এখন এ-ঘৃণা নিয়ে আমাদের দিকে তাকাবে বলে আমরা অনুভব করতে সমর্থ হই। অথচ গতকালও আনিসের তাস-সাফল্যে বিপুলের চরম ঈর্ষা দেখেছি। ও আমাদের বলেছিল, ‘আমি শিওর, আনিস শালা তাস চুরি করে। একবার মামারে ধইরা নিই। তারপর গত দুই মাসের লস ওর পুটকি দিয়া বাইর করমু।’ কিন্তু বিপুলের সেসব কিছু মনে নেই। কাসেদ আমতা-আমতা করে ঘটনা বর্ণনা করতে চেষ্টা করল কয়েকবার, কিন্তু বিপুল কোনো অজুহাতই শুনতে রাজি নয়। তার আচরণ আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা এবং একটা আগাম সতর্কবার্তাও দিতে থাকে। দিনের পর দিন তাস চুরির অপরাধে কাউকে খুন করা আমাদের কাছেই যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। আর বিপুলের কাছে তো নয়ই। সে উঠে দাঁড়িয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘যা, থানায় যেয়ে সব খুলে বল। এতে শাস্তি কম হতেও পারে।’ আমি আর কাসেদ খেয়াল করি, আমাদের কর্মের দায় বিপুল নিতে রাজি নয়। সে যে দিনের পর দিন আনিসকে হাতেনাতে ধরে পরাজয়ের শোধ তোলার অপেক্ষায় ছিল, সে-কথা তার আদৌ মনে আছে বলে মনে হলো না। সে শুরুতেই ঘটনা থেকে সরে পড়তে চাইছে। ওর চোখমুখ বলছে, আমরা যদি থানায় যেয়ে নিজেদের দোষ স্বীকার না করি, তবে সে নিজেই তা থানায় জানাতে দ্বিধা করবে না। অথচ থানায় দোষ স্বীকার করা মানে নিশ্চিত শাস্তি। যে চকচকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমরা গত আঠাশ-ঊনত্রিশ বছর কঠোর পরিশ্রম করেছি, যে-স্বপ্ন সদ্যই আমাদের হাতে ধরা দিতে শুরু করেছে – সে-স্বপ্ন আমরা নিজেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নষ্ট করতে নারাজ। নিজেদের বাঁচানোর কোনো চেষ্টা না করেই আত্মসমর্পণ করার পক্ষপাতী আমরা নই। যারা ঠান্ডা মাথায় এবং পরিকল্পিতভাবে খুন করে তারাও নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত। আর আমরা তো অনেকটা নিয়তির হাতে ধরা পড়া অপরাধী। আমরা কেন স্বেচ্ছায় কারাবরণ করব? পৃথিবীর কোনো যুক্তিই সর্বশেষ যুক্তি হতে পারে না।

কাসেদই প্রথম শক্ত হয়ে ওঠে। ‘থানায় যদি আমরা যাই-ই তবে বলব – তুই আনিসকে মেরেছিস।’ কাসেদের কথায় বিপুল চমকে ওঠে। এমন একটা কথা যে আমরা বলতে পারি তা তার কল্পনায়ও ছিল বলে মনে হলো না। একটু ঢোক গিলে শুধু বলল, ‘মানে?’

কাসেদ আবারো দৃঢ়চিত্তে জানায়, ‘তুই একা কী বললি সেটা বড় কথা নয়; আমরা দুজন কী বললাম সেটাই বড় কথা, তাই না?’ আমি বিপুলকে স্তব্ধ হয়ে কাসেদের মুখের দিকে তাকাতে দেখলাম। হঠাৎ করে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে তার শরীরটা একটু দুলে উঠল যেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি দরজার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ঘর থেকে বিপুলের বের হওয়ার পথটা বন্ধ করে দিই। বিপুল এবার আমার মুখেও নিষ্ঠুরতার ছায়া দেখতে পেল এবং আবার বিস্মিত হলো। তাকে আমরা মুখে ঘোষণা না দিলেও বস্ত্তত বন্দি করে ফেলেছি। আমি কথা বলার আগেই কাসেদ বলল, ‘এক খুনের যা শাস্তি, দশ খুনেরও তাই। তুই যেহেতু এ-খুনের একমাত্র সাক্ষী, সেহেতু তোকে আমাদের নিয়ম অনুযায়ী মাইরা ফেলানো উচিত। কিন্তু আমরা আর রক্ত নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাই না। তুই যদি বুদ্ধিমান হস, তবে আমাদের সাহায্য কর।’ বিপুলের দুই চোখে পানি চলে এলো। আমাদের নিষ্ঠুরতা দেখে নাকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের অপকর্মের সঙ্গী হতে গিয়ে তার চোখে পানি চলে এলো তা বোঝা দুষ্কর। সে শেষবারের মতো অনুনয় করে বলল, ‘দোস্ত প্লিজ, আমারে ক্ষমা কর। আমার বাপ-মায়ের আমি একমাত্র পোলা। এসব কামে আমারে জড়াইস না। আমার পুরা পরিবার আমার ইনকামের ওপর চলে, প্লিজ দোস্ত। আমি কাউরে কিছু বলমু না। সারাজীবন চুপ কইরা থাকমু। এই মেস ছাইড়াও চইলা যামু। দরকার হইলে ঢাকা শহর ছাইড়া দিমু কিন্তু আমারে ছাইড়া দে।’ অন্যসময় হলে এ-ধরনের আকুতিতে আমার মন গলে যেত, কিন্তু আমি জানি এখন সারা পৃথিবী আমার শক্র। সমাজ আমাদের শত্রু। নিজের জীবন বাঁচাতে আমাদের এখন নিষ্ঠুর হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি এই প্রথম বেশ কঠোর ভাষায় বলে উঠি. ‘তুই যেমন বাঁচতে চাস। আমিও বাঁচতে চাই। কাসেদও বাঁচতে চায়। আমাদের সবার উদ্দেশ্য এক। সুতরাং তুই আমাদের হেল্প কর। তারপর তুই তোর পথে চইলা যা। তোরে আমরা আটকামু না।’ ‘কী সাহায্য?’ বলে একটা পরিপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকায় বিপুল।

আমি এবার একটু চমকে যাই। আসলে বিপুলের কাছ থেকে ধার করে আমিও ‘সাহায্য’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। নিজস্ব বিচারবুদ্ধি আমার লোপ পেয়েছে আগেই। বিপুলের কাছ থেকে ঠিক কী ধরনের সাহায্য চাই – তা আমারো অজানা। আমি শুধু কাসেদের কথার পুনরাবৃত্তি করেছি মাত্র। নিজের চিন্তাশক্তি ব্যবহার করিনি। আমি এবার উত্তরটা জানার জন্য কাসেদের দিকে তাকাই। সে সম্ভবত আমার চেয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে বলল, ‘আমরা এই ঘর থেইকা লাশটা সরাই ফেলমু। আর ওই লাশ সরানোর কামে তুই আমাদের লগে থাকবি।’ আমি বুঝি, আমাদের খুনের একমাত্র প্রমাণ বিপুল। এখন বিপুলকে আমাদের দুষ্কর্মের সাথি করে ফেলতে পারলে সে আর কোনোদিন মুখ খুলতে পারবে না। তাই তাকে আমাদের প্রয়োজন। তবু আমি জানতে চাই, ‘লাশটা কোথায় সরামু ভাইবা দেখছিস?’

কাসেদও বোধহয় জানে না, আনিসের লাশটা ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে। সে খাটে বসে চোখজোড়া বন্ধ করে ধ্যান করে কিছুক্ষণ। আমি এবং বিপুল ওহি নাজেল হওয়ার মতো উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি; কিন্তু কাসেদ নিজেও কোনো ঠিকানা বলতে পারে না। শেষে আমি বলি, ‘কোনো খাল-বিল বা পুকুরে ফালাই দেই?’ আমার কথা যেন শুনতেই পায়নি এমনভাবে ধ্যান ভেঙে কাসেদ বলে, ‘সবচেয়ে ভালো হইতো, যদি আশপাশে ইটভাটা থাকত। ইটভাটার চুলার মধ্যে ঢুকায় দিলে কোনো প্রমাণ থাকে না। সবকিছু পুইড়া ছাই হইয়া যায়।’

তারপর আবার একটা বিরতি দিয়ে বলে, ‘কিন্তু শালার এমন এক এলাকায় থাকি, যেইখানে কোনো ইটভাটা নাই।’ আমরা থাকি মিরপুর, কাজিপাড়া। মূল রাস্তা থেকে সাপের মতো ঢুকে যাওয়া গলির পর গলি, তারপর আরো কিছু উপগলি পার হয়ে আমাদের বাসা। এখানে অনেক কিছু নেই। গ্যাস নেই। পানি নেই। বৃষ্টি হলে হাঁটুসমান পানি পেরিয়ে অফিস যেতে হয়। এতসব কিছু নিয়ে আমাদের নিত্য অনুযোগগুলো একটা ইটভাটা না থাকার হাহাকারের নিচে চাপা পড়ে যায়। আমিও মনে মনে আফসোস করতে থাকি, ‘আহা, যদি একটা ইটভাটা থাকত?’ কাসেদ এমনিতে অলস। কোনো ধরনের দায়দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী। আমাদের মেসে কী রান্না হবে, কবে পানির বিল দিতে হবে – এসব কিছু নিয়ে তাকে কোনোদিনও মাথা ঘামাতে দেখিনি। ছুটির দিনগুলোতে বাজারে যেতে বললে সে আর বিছানাই ছাড়ত না। অথচ আমি আবিষ্কার করি, কাসেদই এখন সবচেয়ে বেশি সচল। কেউ আমাকে বলে দেয়নি কিন্তু আমি মনে মনে কাসেদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছি। কাসেদ এখন যা বলবে আমি তা-ই করতে উদগ্রীব। আমার নিজের ওপর যতটা আস্থা আছে, তার চেয়ে বেশি আস্থা এখন কাসেদের ওপর। পারলে সে-ই পারবে আমাকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে। কাসেদ আবার অনেকক্ষণ ভাবে। তারপর ধ্যানভাঙা দরবেশের মতো বলে, ‘আমাদের বেনিফিট অব ডাউট পেতে চেষ্টা করতে হবে।’ ‘বেনিফিট অব ডাউট?’ আমি আর বিপুল দুজনেই একসঙ্গে উচ্চারণ করি। ‘বাংলায় বললে দাঁড়ায় – সংশয়ের সুবিধা। কোনো মামলায় কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিতে গেলে বিচারককে নিঃসংশয় হতে হয়। আর বিচারকের যদি দ্বিধা থাকে তবে সে সুবিধা পায় আসামি।’

আমার কাছে কাসেদের কথা দুর্বোধ্য মনে হয়। আমার জগতে এধরনের কোনো শব্দমালার অস্তিত্ব কখনো ছিল না। ক্রিকেট খেলায় এধরনের শব্দ দু-একবার ব্যবহার হতে শুনেছি বলে মনে হয়। কিন্তু মানুষের জীবনেও এমন শব্দ ব্যবহার হতে পারে তা আমার অজ্ঞাত ছিল এতদিন।

বিপুলই প্রথম বলে, ‘কিন্তু তোরা আসামি হবি – এইটা নিশ্চিত হস কেমনে? লাশটা এইখান থেইকা সরায়া ফেললেই তো তোরা নোবাডি?’ আমি খেয়াল করি, বিপুল এখনো আমাদের এবং তার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম প্রভেদ রাখতে চাচ্ছে। আমি চাই না আমাদের এ-প্রভেদটা থাকুক। বিপুলের এই মানসিকতা দূর করতে হবে দ্রুত। কাসেদ এবার বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, ‘হুম, আমাদের প্রথম চেষ্টা হইবো সন্দেহের তীরটা অন্য দিকে সরাইয়া দেওয়া। এবং দ্বিতীয় চেষ্টা হইবো সন্দেহের তীর আমাদের দিকে এলেও আমরা যেন আইনের দৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্ত না হই। জনিস তো অভিজ্ঞরা বলে, খুনি সবসময় কোনো না কোনো প্রমাণ রাইখা যায়। সুতরাং ধরা পড়তে হইবো ধইরাই আমি আগাইতে চাই।’ আমার এইসব অাঁতেল মার্কা কথা ভালো লাগে না। এক ঘণ্টার ওপরে আনিসের লাশটা পড়ে আছে মেঝেতে। যে কেউ যে কোনো সময় এসে পড়তে পারে। আমাদের বাইরে অন্য কেউ এই লাশ দেখে ফেললে হয় আমাদের তাকে মেরে ফেলতে হবে অথবা পুলিশের কাছে আমাদের ধরা পড়তে হবে। আমি ঝুঁকি নিতে নারাজ। ‘যা ডিসিশন নিবি তাড়াতাড়ি নে। লাশটা পইচা গন্ধ বাইর হইলে তখন আর কোনো উপায় থাকবো না ’ বলে আমি কাসেদের দিকে আবার তাকাই। কাসেদ উঠে যেয়ে আনিসের মানিব্যাগ তুলে নেয়। মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার জাগতিক সব জিনিসের ওপর জীবিত মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আনিসের মৃতদেহের সামনেই তার মানিব্যাগে রাখা টাকা গুনতে থাকে কাসেদ। হাজার তিনেক টাকা আছে সেখানে। সেই টাকা থেকে তিনটি পাঁচশো টাকার নোট আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ‘যা, তিনটা পলিথিনের বস্তা আর একটা চাপাতি নিয়া আয়।’ আমি টাকা নেওয়ার আগে কী কারণে যেন আনিসকে একবার দেখি। আনিস নির্বিকার। সে আগের মতোই ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার আগে কী মনে করে যেন বিপুল উঠে দাঁড়ায়। ‘আমারে দে, আমি নিয়া আসি।’ আমি খুব কঠিন গলায় বলি, ‘চান্দু, তোমারে বাইরে পাঠাইলেই তুমি পালাইবা; চুপচাপ বইয়া থাক।’ বিপুল আস্তে আস্তে করে বলে, ‘তোরা আমারে বিশ্বাস করলি না?’

আমরা বিশ্বাসের জায়গা থেকে অনেক আগেই সরে এসেছি। একজন মানুষ যখন জেনে যায় সে অবিশ্বাসী, তখন সে নিজেও সবার ওপর বিশ্বাস হারায়। আমরা বিপুলকে কেন পৃথিবীর কাউকেই আর বিশ্বাস করি না। সুতরাং তার মৃদু কণ্ঠের প্রতিবাদ, যা তার নিজের মধ্যকার বিরাজমান সংশয়ই তীব্র করে তুলেছে – তার প্রতি ভ্রূক্ষেপও করি না। টাকা কয়টা নিয়ে আমি দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার আগে কাসেদকে চোখের ইশারায় বিপুলের ওপর নজর রাখতে বলে পথে নামি।

বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। গলির মধ্যে হাঁটুপানি। হাঁটুপানিতে স্যুয়ারেজ লাইন থেকে সদ্য বের হওয়া মল ভাসছে। অন্যসময় আমি নাক চেপে পানি ভাঙি। আজ আমি কিছুই চেপে ধরি না। শরীরে কোনো ময়লা লাগল কি-না কিংবা কোনো ম্যানহোলে পা পড়ল কি-না তা আমার কাছে আবেদন হারায়। এসব ময়লা দুর্গন্ধ পেছনে ফেলে ইউরোপের মসৃণ রাস্তায় পরিবার নিয়ে ঘোরার স্বপ্নে আমি বিভোর হয়ে থাকি। আমি জেলাখানার গারদের পেছনে যৌবন নষ্ট না করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর। সুতরাং যত কষ্টই হোক সব পেছনে ফেলে আমাকে সামনে এগিয়ে যেতেই হবে। বস্তা আর একটা চাপাতি কিনে আমি ঠিক ঠিক বাসায় ফিরে আসি। দরজায় খটখট শব্দ শুনে কাসেদ বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। খুব মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’ আমি আশ্বস্ত করতে জবাব দিই, ‘কাসেদ, আমি।’ কিন্তু আমার গলার স্বর আমার কাছেই যেন কেমন লাগে। ওইপাশ থেকে আবার মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘আমি, কে?’ মানুষ নিজে কখনো নিজের গলার স্বরটা আসলে কেমন তা নিয়ে ভাবে না। আমিও ভাবিনি কোনোদিন। তবু আন্দাজে আমার গলার পুরনো স্বরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে জবাব দিই, ‘আমি জুনায়েদ।’ এবার আস্তে করে দরজাটা খুলে যায়। তিনটা বস্তা আর একটা চাপাতি নিয়ে ঘরে ঢুকি। আমার সারা শরীর থেকে চপচপ করে পানি ঝরতে থাকে। ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকা ঘরের বাতিটার দিকে হাত বাড়ালে কাসেদ হিসহিস করে ওঠে, ‘বাতি জ্বালাইস না।’ আবছা অন্ধকারে হাঁটুর ওপর থুঁতনি রেখে বসে থাকা বিপুল আমার নজরে পড়ে। বেচারার জন্য একটু মায়াই লাগে। একই ঘরে একই মানুষদের সঙ্গে থেকেও সে গৃহবন্দি। আমার মনে হয় শুধু হাজতবাস মানেই বন্দিত্ব নয়। যে-ঘরকে মানুষ প্রচন্ড ভালোবাসে, যে-ঘরে সারাদিন কর্মক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে শান্তি খুঁজে পায়, সে-ঘর থেকে নিজ ইচ্ছায় বের হতে না পারা মানেও বন্দিত্ব। বিপুলকে দেখার পরই আমি লাশটা দেখতে চাই; কিন্তু যেখানে শুয়ে থেকে আনিস সারা দুপুর ছাদ দেখেছে সেখানে আনিসের লাশটা নেই। আমি আস্তে করে বলি, ‘আনিস?’ কাসেদ টয়লেটের দিকে মুখটা উঁচু করে। টয়লেটের দরজা বন্ধ। লাশটা সরিয়ে ফেলায় আমি একটু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল আনিসও নীরব দর্শক হয়ে আমাদের নির্মম হয়ে ওঠা দেখছে। মানুষ তার দয়াকে আড়াল করতে চায় না; আড়াল করতে চায় নির্মমতাকে। মানুষ আর পশুর সর্বশেষ পার্থক্য বোধহয় এটাই। সুতরাং লাশটা আড়ালে টেনে নেওয়ায় সেই অস্বস্তি থেকে অন্তত মুক্তি পেলাম আমি। আস্তে আস্তে বলি, ‘তাইলে বাত্তি জ্বালা। অন্ধকার আমার অসহ্য লাগতেছে।’ কাসেদ নিজেই বেশ সাহস নিয়ে বাতিটা জ্বালায়। ঘরটা আলোকময় হয়ে উঠতেই বিপুল বেশ কষ্ট করে চোখ মেলে। তার চোখগুলো বেশ ফোলা ফোলা। সে বোধকরি সারা বিকেল কেঁদেছে। আমার নজরে পড়ে দেয়ালের যেখানটায় আনিসের মাথা আঘাত করেছিল সেখানটায় চাপচাপ রক্তের দাগ। ঘরের মেঝেতেও রক্ত লেপ্টে আছে। মানুষের খুন আড়াল করার সবচেয়ে বড় অন্তরায় এই রক্ত। শরীরের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে প্রমাণ তৈরি করার জন্যই যেন রক্তের জন্ম। আমি চাপাতির মাথাটা দিয়ে দেয়ালে লেগে থাকা রক্ত ঘষতে শুরু করি। কাসেদ বেশ কঠোর ভাষায় বিপুলকে বলে, ‘যা ন্যাকড়া আইন্না ঘরের মেঝের রক্ত মুছ।’ বিপুল আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে, ‘আমি পারমু না।’

সঙ্গে সঙ্গে কাসেদ ওর পিঠ বরাবর একটা লাথি কষে। কেঁদে উঠতে গিয়ে বিপুল থমকে যায়। এবার কাসেদ রান্নাঘরের বঁটিটা এনে বিপুলের গলার কাছে ধরে। হিসহিস করে বলতে থাকে,  ‘আমরা জেলে বইসা পইচ্চা মরমু আর তুমি আরাম কইরা বউ-বাচ্চা লইয়া সংসার করবা। তা হইতে দিমু না। আনিসের বিরুদ্ধে আমাদের কি তুই উসকানি দেস নাই? তুই বিভিন্ন সময় আমাদের প্ররোচনা দিছস। সুতরাং তোরেও দায়িত্ব নিতে হইবো?’

‘কিন্তু তাই বইলা তারে মাইরা ফেলবি?’ বিপুল ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দেয়।

এবার আমি এগিয়ে আসি। একধরনের সহমর্মিতা নিয়ে বলি, ‘আমরা চাইছিলাম শালারে দুই-চারটা চড়-থাপ্পড় দিয়া শেষ করমু। কিন্তু তার মাথাটা এতজোরে দেয়ালে বাড়ি খাইলো যে, আমাদের কিছুই করার ছিল না। হয়তো তোর কাছে এইটা খুন কিন্তু আমাদের কাছে এইটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আফসোস, তোর চোখই এখন সমাজের চোখ; তোর চোখই রাষ্ট্রের চোখ।’

বিপুল কী বোঝে কে জানে? সে রান্নাঘর থেকে কার যেন একটা পুরনো লুঙ্গি এনে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত পরিষ্কার করতে থাকে। তার চোখের পানিতে জমাটবাঁধা রক্ত কোথাও কোথাও আবার নরম হয়ে যায়। আর আমি দেয়ালের রক্ত তুলতে যেয়ে ঘষে ঘষে দেয়ালের রং তুলে ফেলি। দেয়ালের অনেকটা জায়গার রং তোলার পর রং ওঠা জায়গাটা কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। বাড়ির মালিক দেখলে রাগ করবে জেনেও আমি রং ওঠা জায়গাটাতে একটা সাইনপেন এনে বড় একটা পাঁচ পাপড়িবিশিষ্ট ফুলের ছবি অাঁকি। আবার ফুল অাঁকার পর আস্ত দেয়ালে একটা মাত্র ফুলের ছবিও বেখাপ্পা লাগে। তাই ফুলের পাশে আরো কিছু ফুল অাঁকি। আমি জানি বলেই হয়তো এতগুলো ফুলের আড়ালে রং তোলা জায়গার ফুলটা অন্তত আমার কাছে ম্লান মনে হয়। তবু রক্তের দাগ আড়াল করতে ফুলের ব্যবহার ভীষণ যৌক্তিক মনে হয় আমার কাছে।

ঘর পরিষ্কারের কাজ শেষ হলে চাপাতিটা হাতে নিয়ে আমার এবং বিপুলের উদ্দেশে ছোটখাটো একটা পরিকল্পনা পেশ করে কাসেদ। আনিসের লাশটাকে মূলত তিন টুকরা করা হবে। এই টুকরোগুলি ভরা হবে তিনটা বস্তায়। আমরা তিনজন তিন দিকে চলে যাব। হাত যদি যায় আশুলিয়ায়, তবে পা যাবে বুড়িগঙ্গা। মাঝখানের কিছু অংশ ফেলে দেওয়া হবে বিরুলিয়ার কাছের তুরাগ নদীতে। যেহেতু সবচেয়ে সেনসেটিভ মানুষের মুখ সেহেতু আনিসের মুখটা এসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়া হবে, যাতে আনিস মারা গেছে এ-বিষয়টাই কেউ কোনোদিন প্রমাণ করতে না পারে।

বিপুল যে সত্যি সত্যি আমাদের সাহায্য করতে চাচ্ছে তা বোঝানোর জন্য সে বলতে থাকে, ‘আইডিয়া খারাপ না। কিন্তু হাত-পায়েও তো কিছু জন্মচিহ্ন থাকে। সেগুলো দেখেও তো আপনজন কেউ আনিসের লাশ শনাক্ত করে ফেলতে পারে?’ কাসেদের মুখ এই প্রথম উজ্জ্বল হতে দেখি। বিপুলের যুক্তির চেয়েও বিপুল আমাদের দলের একজন হয়ে উঠতে শুরু করায় কাসেদ খুশি হয়ে ওঠে। সে সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়, ‘ভালো কথা কইছস। আয় ওর কাপড় খুইলা উলটাইয়া-পালটাইয়া দেখি কোথায় কোন জন্মদাগ আছে? যেসব জায়গায় জন্মদাগ আছে, সেসব জায়গায় এসিড ঢাইলা দিতে হইবো।’ বিপুল খুব উৎসাহে কাসেদের সঙ্গে মিলে আনিসের শরীরের কাপড় খুলতে শুরু করে। আনিসের ঘাড়ের কাছে এবং বাঁ-হাতের কব্জিতে দুটি বড় তিল এবং বাঁ-পায়ের পাতায় একটা বড় কাটা দাগ তাদের নজরে পড়ে। ওই দাগগুলোর চারপাশে আমার সাইনপেন দিয়ে রং করে ফেলে কাসেদ। তারপর বিপুলকে দেখি, খুব উৎসাহ নিয়ে একবার হাত টেনে ধরে তো একবার পা টেনে ধরে আর কাসেদ চাপাতি চালিয়ে আনিসের দেহটাকে অনেকগুলো টুকরো করে ফেলে। বিপুলের চোখে আর পানি নেই। সে বিপুল উৎসাহে আনিসের কাজে সাহায্য করে যাচ্ছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রে পেতেছি সজ্জা, শিশিরে ভয় কী?

এবার কাসেদ আমাদেরকে টুকরোগুলো আলাদা আলাদা বস্তায় ভরার দায়িত্ব দিয়ে এসিড কিনতে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে এসিডের দাম মেটাবার জন্য আমাদের সবার মানিব্যাগ খালি করে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে যায়। আমি আর বিপুল একটা একটা করে টুকরোগুলো বস্তায় ভরতে থাকি। আর কাসেদের পরিকল্পনার প্রশংসা করি। আশুলিয়ার বেড়িবাঁধ এবং বুড়িগঙ্গায় আজকাল এত বেশি লাশ কিংবা কাটা হাত-পা পাওয়া যায় যে, কোনটা কার বুঝে নেওয়া বড়ই কঠিন।  আবার একেকটা এলাকা একেকটা থানার অন্তর্গত। এত এত হাত-পা মিলিয়ে একটা মানুষের শরীর ফুটিয়ে তুলতে পুলিশদের দফায় দফায় মিটিং করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব। সুতরাং কাসেদের পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকলে আনিসের লাশ শনাক্ত করা বড়ই কঠিন হবে। ‘বেনিফিট অব ডাউট’  বলতে কাসেদ আসলে কি বোঝাতে চাইছিল আমি তা এতক্ষণে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।

ঘণ্টাখানেক পর দরজায় খটখট শব্দ হলে আমি আবার কাসেদের মতোই উঠে যেয়ে নরম গলায় বলি, ‘কে?’

ওপাশ থেকে শব্দ আসে, ‘জুনায়েদ দরজা খোল, আমি কাসেদ।’

আমি দরজা খুলে মুখ ঘোরাতে যেয়ে দেখি কাসেদ একা নয়, তার পেছনে বেশ কজন পুলিশ।

সামনে তিন বস্তা লাশের টুকরো আর পেছনে সদ্য আঁকা ফুলের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিপুলকে শুধু বলতে শুনি, ‘এইটা তুই কি করলি কাসেদ?’