ব্যক্তিমানুষ ও সমাজভাবুক বদরুদ্দীন উমর

বদরুদ্দীন উমর কেন?

‘দেখো, তোমরা কমিউনিস্টরা ভুল করো না, যুদ্ধের চাপে ইংরেজ যাই বলুক, তাকে বিশ্বাস করো না। সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বাসঘাতকতা করবেই।’১ জীবনের শেষপর্বে এক সাক্ষাৎকারে বলা রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য বদরুদ্দীন উমর পুরো জীবনই রক্ষা করে এসেছেন, দেখা যায়! তিনি ‘সাম্রাজ্যবাদ’কে বিশ্বাস করেননি। কেননা সে যে চিরন্তন ‘শ্রেণিশত্রু’! বাংলাদেশে, বিশেষভাবে, রাজনীতির ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, বিসত্মার ও প্রচারে এই ধারণা ও চিন্তনে তিনি একক ও অদ্বিতীয় ব্যক্তি। তাঁর নৈতিক সংগ্রামী আদর্শ ও বিশ্বাস এই সত্যে দৃঢ় ও স্থিরতা পায়, জীবনে লক্ষ্যর আকাঙ্ক্ষায়। কীভাবে তিনি এই নৈতিক সংগ্রামী আদর্শ বেছে নিয়েছিলেন এবং তা নিয়ে জীবনব্যাপী লড়াই জিইয়ে রেখেছেন, তার কিছু আভাস দেওয়া বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। কেননা আমাদের মতো আবেগসর্বস্ব সামাজিক মনের পক্ষ এ যেমন ব্যতিক্রম, তেমনি বিস্ময়কর। অতএব যাঁর জীবন একাধারে অবিরত সংগ্রামের, কর্ম নিরত ও কার্যকর চিন্তায় সমুন্নত, যত্নের সঙ্গে সে-জীবনের কথা আলোচনাযোগ্য।

এখানেই বলে নেওয়া ভালো, কলম ধরেই বদরুদ্দীন উমর যে ‘যুক্তিবাদ ও বস্তুতান্ত্রিকতার’ সঙ্গে ‘হৃদয়ধর্ম’ও রক্ষা করে বিদ্বৎসমাজের নিকট সম্মানিত হয়েছিলেন মাত্র তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে এবং সেটা পাকিস্তান আমলে, বাংলাদেশ পর্বের প্রায় পুরো সময়টায় তিনি পেয়েছেন ঠিক তার বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় – অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা, ঈর্ষান্বিত উপেক্ষা এবং অনেকক্ষেত্রে হয়েছেন অযথার্থভাবে নিন্দিত।

অল্প কথায় বিষয়টা উল্লেখ করতে বাধা নেই। বদরুদ্দীন উমরের প্রধান পরিচয়, তিনি রাজনীতিবিদ। চিন্তক হিসেবেও তিনি অনন্য। আগামী দিনে হয়তো শেষোক্ত পরিচয় তাঁকে আরো বিশিষ্টতা দেবে, বলা যায়। কেননা সেখানে তাঁর অসামান্যতা আমাদের যে-কোনো সময়ের তুলনায় খুবই উল্লেখযোগ্য। তাঁর ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক মনোভাব তাঁকে সেই অসাধারণত্বে উত্তীর্ণ করেছে। তাঁর প্রথম ঐতিহাসিক কাজ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (তিন খণ্ড)। দলীয় রাজনীতির খপ্পরে আটকা পড়ে অধিকাংশ লেখক-বুদ্ধিজীবী সত্যান্বেষণ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলে উমরের নৈতিক জীবন ও চিন্তার প্রভাব তেমন কার্যকর হতে পারেনি আমাদের সমাজে। বাংলাদেশ পর্বে যে-তরুণের মন তার সমাজে সত্য ও ন্যায়ের খোঁজে ব্যাপৃত হওয়ার কথা, তাকেই যখন পরিচালিত করা হয় ভুল ও বিভ্রান্ত পথে, তখন সেখানে মিথ্যা ও ভ্রান্তির বিস্তার ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে অনায়াসে। অথচ বদরুদ্দীন উমরের রচনা এক্ষত্রে এক অতুলনীয় প্রতিষেধক।

একটি নৈতিক আদর্শ

এবার মূলে ফেরা যাক। মানুষ যা বিশ্বাস করে, তাই নিয়ে কাজ করে – অবিরত, অবিশ্রান্ত – দৃঢ়স্থির এই মন। এই মানুষই উত্তম। বিশ্বাস করি একটা, কাজ করি ভিন্নটা, দোলাচলে আর অস্থির-শিথিল এই মন। এই মনের বিচার আলাদা। বদরুদ্দীন উমর যৌবনে বিশ্বাস করেছিলেন মার্কসীয় রাজনীতি, মানুষের মুক্তি এই সত্যে আসা সম্ভব – এর প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাওয়া তাঁর পুরো জীবনে স্পষ্ট। তিনি যে-বিশ্বাসে উপনীত হয়ে তার নৈতিক প্রশ্নে নিজের জীবন খরচা করে গেলেন, সমাজে তার প্রতিফল সহসা চোখে পড়বে না। তবু যা সম্ভব, তা কার্যকর করার জন্য তিনি চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কেননা তিনি এরই মধ্যে একটা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আর
সে-ভাষা হচ্ছে যুক্তির ভাষা, বুদ্ধির ভাষা, ন্যায় ও নৈতিকতার ভাষা। ‘সাম্রাজ্যবাদ’-এর জুলুম থেকে তাঁর এ শিক্ষা প্রাপ্ত। মার্কসীয় চিন্তা ও কর্মধারার সঙ্গে এর যোগ গভীর ও অবিচ্ছেদ্য। তিনি জেনেছিলেন মার্কসীয় ধারায় বহন করা নৈতিক জীবন পুরোপুরি সংগ্রামের। এটা বোঝা সম্ভব নয়, যিনি এই জীবন যাপন করেননি। অথবা যিনি জীবনের কোনো একটা পর্বে এটা পরীক্ষা করে দেখেননি। এই বিবেচনায় বদরুদ্দীন উমরকে বাঙালি বলা কঠিন। যদিও জন্মসূত্রে তিনি বাঙালি। শুধু তাই নয়, তাঁর নিজের দেওয়া বিখ্যাত ও অসাধারণ সংজ্ঞা অনুযায়ী তিনি বাঙালি। মনোজগতে তিনি কেবল বাঙালি থাকতে চাননি। বাঙালি অতিক্রমী মন তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজের মধ্যে। ব্যক্তি থেকে বিশ্বের দিকে তার গতি।

কর্মীপুরুষ হিসেবে তাই বদরুদ্দীন উমরের স্থান খুব বড় হবে বলে মনে হয় না। কিন্তু চিন্তক ও সমাজ-দার্শনিক হিসেবে বাংলাদেশে তাঁর প্রতিভার সম্যক খুব বেশি কাউকে পাওয়া যাবে না, গত একশ বছরের মধ্যে। এ-কথা চিন্তাভাবনার দিক থেকে যেমন, ব্যক্তিত্বের দিক থেকেও তেমনি। তিনি জীবনে প্রচলিত অবস্থার প্রভুত্ব স্বীকার করেননি, অবস্থাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। এই মনোভাব তাঁকে বদরুদ্দীন উমর হতে সহায়তা করেছে। কী ভাবে তিনি এলেন এই ধারণায়?

আত্মপরিচয়ে ও ব্যক্তিত্বে স্বাতন্ত্র্য

বদরুদ্দীন উমর তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, তিনি বাঙলার এক মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক পরিবারে জন্মেছেন। এর থেকে তাঁর পরিবারের বিশেষত্বটা বোঝা যাচ্ছে। আর্থিক দিক থেকে তাঁরা মধ্যবিত্ত-সাংস্কৃতিক পরিচয়ে রাজনৈতিক মনোভাবসম্পন্ন। তাঁর পরিবারের লোকেরা প্রায় সকলেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি – এই ছিল তখনকার রাজনীতির ধারা। মানবমুক্তি সম্পর্কে ধারণা এবং বিশ্বাস অনুযায়ী এইসব ধারার সঙ্গে উমরের পরিবারের লোকজন যুক্ত ছিলেন। কাজ করতেন তাঁরা এইসব রাজনৈতিক ধারার অনুকূলে। এই নিয়ে পরিবারের মধ্যে কোনো কলহ তৈরি হয়নি। চিন্তার স্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা মান্যতা পেয়েছে পরিবারে।

অন্য একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য যুক্ত হতে পারে এখানে। সামাজিক পরিচয় সমাজে বাস করার ভিত্তি। ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে ভিন্ন পরিচয় আমাদের সমাজে গৃহীত হয়নি। নিজের অর্জিত ধর্ম গ্রহণ করার অধিকার আমাদের নেই। মানবতাবাদে আমার বিশ্বাস স্থাপন করব, নাকি বস্তুবাদে, নাকি অন্য কোনো এক নিরেট সত্যে – এ-অধিকার উচ্চায়ত শিক্ষার গুণেও সম্ভব হয় না! আমরা স্বাধীন সমাজের কথা ভাবতেও পারি না। আমাদের মুক্তচিন্তা মরে গেছে। পিতৃপুরুষের পরিচয় নিয়ে আমাদের পথ চলা! বদরুদ্দীন উমরের নিজের পরিচয় আছে। কিন্তু সমাজ
সে-পরিচয় গ্রহণ করেনি। কাজেই তাঁর অর্জিত বাস্তবের আগের অবস্থাটা জেনে নেওয়া জরুরি। সেজন্যে
সে-পরিচয়টা উল্লেখ করা দরকার।

বদরুদ্দীন উমরের জন্ম মুসলিম পরিবারে। তাঁদের ছোটখাটো জমিদারিও ছিল। অপরদিকে তাঁর পরিবারের লোকেরা প্রায় সকলেই চাকরিজীবী ছিলেন। পূর্বপুরুষদের থেকে এই পরম্পরা চলে এসেছে। এই জন্য বদরুদ্দীন উমরের কথা বলতে গেলে তাঁর পরিবারের কথা আসবে। সেইসঙ্গে তাঁর পিতা আবুল হাশিমের কথাও উঠবে।

আবুল হাশিম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। অখণ্ড ভারতের ইতিহাসে, শক্তিমান রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তাঁর নাম থাকবে। আবুল হাশিম বাঙলা বলতে বুঝতেন বাঙালি জাতি। একই সঙ্গে অখণ্ড ভৌগোলিক বাঙলা তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর টান ছিল একাত্ন। অনুভব ছিল সত্য। তাই বাংলা ভাষার আন্দোলনের দিনে তাঁর লড়াই ছিল অকৃত্রিম। তাঁর সেই লড়াইয়ের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

কিন্তু তাঁর মন-মানস ছিল ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসের সঙ্গে বাঁধা। এই বিশ্বাসে তাঁর কৃত্রিমতা ছিল না। ভিন্ন ধর্মের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর মন, ধর্মের পথ তত্ত্বের আলোয় গড়া ছিল। এই পথেই তিনি মানবমুক্তির সন্ধান করতেন।

বদরুদ্দীন উমর প্রথম জীবনে তাঁর পিতার গভীর বিশ্বাসের অনুগামী ছিলেন। এই বিশ্বাসের ফল কিছু ফলেছিল। পঞ্চাশের দশকে পিতার মতো উমর নিজেও ‘তমদ্দুন মজলিস’-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানটি পাকিসত্মানি আদর্শের পতাকা বহন করত। প্রতিষ্ঠানের দুটো মুখপত্র ছিল। একটি সাপ্তাহিক সৈনিক, অন্যটি মাসিক দ্যুতি। দুটো পত্রিকাতেই উমর কিছু লেখালেখি করেছিলেন। ফলে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ফররুখ আহমদ প্রমুখের কাছ থেকে তাঁর কিছু প্রশংসাও জুটেছিল। পরবর্তীকালে ষাটের দশকে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন বদরুদ্দীন উমরের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। কেন? কারণ ততদিনে উমর র‌্যাডিক্যালি পরিবর্তিত মানুষ।

এইমাত্র বলা হলো, ‘তমদ্দুন মজলিস’ পাকিসত্মানি আদর্শের প্রচারে নিয়োজিত ছিল। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক তৎপরতাও চালিয়েছিল। এ-সংগঠনের লোকেরাই ‘খেলাফত পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। আবুল হাশিম এ-পার্টির নাম ‘খেলাফত রববানী পার্টি’ করার প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর প্রসত্মাব সম্ভবত গৃহীত হয়নি। তবু এ-পার্টিতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম আর ‘খেলাফত পার্টি’র আবুল হাশিম এক নন। পার্থক্যটা মৌল নয়, তবু উল্লেখযোগ্য। প্রথম আবুল হাশিম, অবিভক্ত ভারতের গুরুতবপূর্ণ রাজনীতিবিদ – ‘উদারনৈতিক চিন্তাধারা ও বিজ্ঞানমনস্ক’ তাত্ত্বিক – যিনি খাড়া চরিত্রের জন্য সমকালে সকলের কাছে সম্মানিত ছিলেন। গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছিল। দ্বিতীয় আবুল হাশিম ‘ধর্মীয় চিন্তার’ শিকার। অন্যে পরের কথা, স্বয়ং বদরুদ্দীন উমরও পিতার এই ‘ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তার শিকার হওয়াটাকে ‘তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ট্র্যাজেডি’ বলে উল্লেখ করেছেন। উমর নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আত্মজীবনীতে এ-প্রসঙ্গে লিখেছেন, ছেলেবেলা থেকে আমার প্রাথমিক যৌবন পর্যন্ত আমি স্বাভাবিকভাবে ছিলাম আমার পিতার চিন্তার অধীনস্থ, যে পিতা ছিলেন intellectually খুবক্ষমতাশালী ব্যক্তি। কিন্তু সেই প্রভাব উত্তীর্ণ হয়ে, নিজের চিত্তশক্তির ওপর নির্ভর করে আমি যে স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে পেরেছি এটা আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

অতি যত্নে আগলে রাখা পিতার কোল থেকে পুত্রের বেরিয়ে আসাটা পিতার পক্ষ কতটা অনুতাপের বিষয় ছিল, স্বভাবতই তা জানতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, বদরুদ্দীন উমর তাঁর জীবনের যে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে গেলেন, তার সূচনা কোথায়। দুটো সংবাদ একই সঙ্গে উমরের মুখে শুনে নেওয়া ভালো। তিনি লিখেছেন,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আমার চিন্তর মধ্যে পরিবর্তনের ধারা আমি লক্ষ করি। এই ধারার বিকাশ আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হতে থাকে। আমার পিতাও আমার এই পরিবর্তন লক্ষ করেন। এতে তিনি দুঃখ পান, কিন্তু কোন সময়েই তিনি এ ব্যাপারে আমার ওপর কোন চাপ সৃষ্টি করেননি। তাঁর চিন্তার একটা উদারনৈতিক দিক ছিল এবং তাতে জবরদস্তির স্থান ছিল না।

ভিন্ন মতের অধিকার উচ্চায়ত মানবিক মূল্যবোধের লক্ষণ। মুক্ত সমাজের পক্ষ এবং গণতান্ত্রিক ধারায় এর মূল্য অতুল্য। আবুল হাশিম এটা স্বীকার করতেন। পুত্রের সেই মতের প্রচারে পিতা বাধা দেননি। এ এক মহত্তম দৃষ্টান্ত। সেই জন্য কী বদরুদ্দীন উমর তাঁর চিন্তার পরিবর্তনের কথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করেন? সেটা মিথ্যা নয়, কিন্তু তিনি যে তাঁর পিতা, তথা পারিবারিক আবহ থেকে বেরিয়ে আসবেন – সে-আবহাওয়া তো তাঁদের পরিবারের মধ্যেই ছিল। উমর নিজেও বলেছেন, ‘বর্ধমানে থাকার সময় থেকেই আমার মধ্যে ইসলামী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তার মধ্যে একটা টানাপোড়েন ছিল, যদিও সে সময় এসব নিয়ে কোনো গভীর চিন্তাভাবনা বা লেখালেখি আমি করিনি।’

এইখানে উমরের মধ্যে আমরা আবিষ্কার করি এক ভিন্ন মানুষকে। এই পর্যায়ে আমরা দেখি – প্রথম মানুষটি ধর্মীয় চিন্তার অধীন, দ্বিতীয় মানুষটি স্বাধীন। আগের মানুষের সঙ্গে পরের মানুষের কোনো মিল নেই। সবমিলে মানুষটি তাঁর পিতার বিপরীত নন, কিন্তু নতুন মানুষ। ভারতবর্ষে যুগপ্রবর্তক চরিত্র যতগুলো মনে করা যায় – গুরু নানক থেকে রামমোহন হয়ে গান্ধী – সকলেই গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ। অক্ষয়কুমার দত্ত কিংবা বিদ্যাসাগরের দলে লোকসংখ্যা অল্প। বলা ভালো, করগণ্য। অথচ তাঁদের যে একটা দল ছিল, অন্তত উনিশ শতকের কলকাতাকেন্দ্রিক ব্রাহ্মসমাজে তাঁদের দলই যে শক্তিশালী, প্রাণবন্ত আর কার্যকর ছিল, সেটা আমরা অনেকেই জানি।

লক্ষ্যর আকাঙক্ষা, কর্ম ও ত্যাগ

এইবার দ্বিতীয় একটা বক্তব্যে আসা যাক। রাজনীতির ক্ষেত্রে মার্কসের চিন্তা কাজে লাগানোর চেষ্টা বদরুদ্দীন উমরের জীবনের সর্বপ্রধান দিক। দিকটি সম্পর্কে তিনি জানতেন, এ-ব্যাপারে গন্তব্য বন্ধুর, সাফল্য অনিশ্চিত, বিরুদ্ধশক্তি প্রবল। কিন্তু মেহনতি মানুষ পরিবর্তন চান। বৈষম্য তাঁদের অসহ্য। কেবল অসহ্য নয়, সমাজ থেকে তা নির্মূল হোক, এই তাঁদের একান্ত চাওয়া। প্রতিভার কাজ এই চাওয়াকে সুসংগঠিত করা। লেনিন যেমন করেছিলেন রাশিয়ায়, মাও যেমন করেছিলেন চীনে, ফিদেল কাস্ত্রো যেমন করেছিলেন কিউবায়।

প্রতিভার একটা প্রধান লক্ষণ মহৎ আকাঙ্ক্ষা। বড় চিন্তায় বৃহৎকে ধরা। এই ভাবনার সঙ্গে আসে কর্মক্ষত্রের কথা। কর্মক্ষত্র ছোট হলে বড় চিন্তা বাধা পায়। বড় চিন্তা বিস্তারের জন্য বড়ক্ষেত্র চাই। কিন্তু দুনিয়ার সমস্ত শাসকশ্রেণি এই চিন্তাবস্তুকে ভয় পায়। কোথাও এর যথার্থ উদ্ভব হলে শুরু থেকে বাধা দেয়। আর্থিকভাবে দুস্থ, চিন্তার দিক থেকে দরিদ্র এবং রাজনৈতিকভাবে দুর্বল জাতির শাসকশ্রেণির মধ্যে এই দুর্বৃত্ত মনোভাবটা আরো ভয়ংকর।
দু-একটা বই লিখেই বদরুদ্দীন উমর বুঝলেন, তাঁর চিন্তার চাপ পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি সইতে পারছে না। পরিবর্তে, তাঁকে হেনস্তা করতে চাইছে। এই অবস্থায় অধ্যাপনার কাজ করা যায় না। অধ্যাপনার কাজক্ষুদ্র নয়। মহৎ কাজ সেটা। শুধু মহৎ নয়, মহত্তম। চিন্তা ও চরিত্রে ঐক্য থাকলে নিষ্ঠাবান অধ্যাপক জাতির অলংকার। এর ব্যত্যয় হলে সেটা লেনদেন – ব্যবসা মাত্র। উমরের অধ্যাপক জীবন অল্পদিনের। তাতেই লক্ষ করা যায়, সেই সময়টুকু হীরকোজ্জ্বল। দু-বাক্যে তার কথা বলে নেওয়া কঠিন নয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দু-তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা উল্লেখযোগ্য। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো অনেক বিভাগ চালু করার বাকি ছিল। তিনি দর্শন বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। অক্সফোর্ড থেকে ফিরে আসার পর সিন্ডিকেট তাঁকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বদলি করে এ-বিভাগ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেন। উমর যথাবিধি সিলেবাস তৈরি করে দুজন লেকচারার নিয়োগ করেন। তিনজন শিক্ষক আর পনেরো জন শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৬৩ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ চালু করেন। ১৯৬৪ সালে একইভাবে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাও হয় হয় তাঁর হাতে। এ-বছরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘সোশাল ওয়ার্ক কলেজ’ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জীবনের আলোচনায় সেই সময়ের এসব অবদানের কথা আসা উচিত।

বদরুদ্দীন উমরকে অধ্যাপনা ছাড়তেই হতো। শাসকশ্রেণি তাঁর প্রতি উপদ্রব না-করলেও তিনি সে-চাকরি করতে পারতেন না। কারণটা এরই মধ্যে বলেছি। তিনি কর্মক্ষত্র চাইছিলেন। যেখানে বড় চিন্তার সংকুলান হয়, তেমন একটাক্ষেত্র। রাজনীতি তাঁর রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল। পরিবার থেকেই তিনি রাজনীতির পাঠ অনেকটা স্বাভাবিকভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। সেটা দৃঢ়তর হয় তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষায় – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড। অধ্যাপনা তিনি ছেড়ে দিলেন ১৯৬৯ সালে। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে (মার্কসবাদ-লেনিনবাদী) যোগ দিলেন সে-বছরই।

এই পর্বে বদরুদ্দীন উমরের মধ্যে একই সঙ্গে দুই মানুষের সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। একজন মানুষ রাজনীতিক, কর্মতৎপর – অন্য মানুষটি চিন্তাশীল, মানববিদ্যায় সচেতন। একের ভেতর দুইয়ের বাস সহসা মেলানো কঠিন। এই মানুষকে সভ্যতার বড় প্রয়োজন। কিন্তু সভ্যতার ইতিহাস এই মানুষকে সব সময় ধরতে পারে না। এই জন্য কৃতিত্বের সঙ্গে ব্যর্থতার ইতিহাসও জায়গা পায়। উমর গভীর এক বিশ্বাস ভেঙে নতুন এক তত্ত্বের মুখে এলেন। চিন্তার সঙ্গে কর্মের যোগ বিচ্ছিন্ন হলে এই তত্ত্বের তাল কেটে যায়। তিনি পার্টিতে যোগ দিয়ে দেখলেন, পার্টির নেতৃত্ব দুর্বল। এমন দুর্বল যে, সেখানে নেতৃত্বের ঘাটতি ও দেউলিয়াপনা একটা ধ্বংসমুখী ব্যাপার। উমর দেখলেন, পার্টির কর্মতৎপরতার লাইন সম্পূর্ণ ভ্রান্ত পথে পরিচালিত। কর্ম কিছু ছিল, কিন্তু পার্টির ভেতরে নিজস্ব চিন্তা বলে কিছু ছিল না। ফলে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদ-লেনিনবাদী) নেতৃবৃন্দ চারু মজুমদারের লাইন ধরে ‘তৎকালীন পরিস্থিতিতে সংগ্রামকে বিভক্ত ও বিপথগামী ক’রে, শেষ পর্যন্ত নিজেদের পার্টিকেও বিভক্ত ও ধ্বংস করেছিলেন।’ পার্টিতে যোগ দিয়ে তিনি যে গণশক্তি (১৯৭০) সম্পাদনায় মনোযোগ দিয়েছিলেন, বামধারার রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতার ইতিহাসে তার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য হলেও সেখানে কেবল পার্টি নয়, উমরের নিজের ভাবনার প্রতিফলও প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালে পার্টি থেকে পদত্যাগ করে উমর নিজস্ব চিন্তায় রাজনীতির পথে এগিয়ে গেলেন।

রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে তিনি এই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর জীবনে সেই চেষ্টার একটা অসাধারণ ভূমিকা স্বীকার্য। বদরুদ্দীন উমর নীরবে নিজের জীবন দান করে গেলেন। তাঁর মনীষা এবং সংগ্রাম দুইয়েরই শিক্ষা আমাদের সামনে রইল।

ব্যক্তিত্বের দৃষ্টান্ত

এখান থেকে একটা তৃতীয় বক্তব্য উঁকি দিচ্ছে। চিন্তার স্বাতন্ত্র্য থেকে ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে। ব্যক্তিত্বের প্রকাশ এই চিন্তায়, আচরণে। সামাজিক সমস্যার প্রশ্নে এই ব্যক্তির চিন্তা স্বতন্ত্র মূর্তি অর্জন করে। বদরুদ্দীন উমরের মধ্যে একটা দৃঢ় চরিত্রবল দাঁড়িয়ে যায়। সমাজের বাস্তব অবস্থার মধ্যে তার বিকাশ ঘটে। চিন্তার স্বচ্ছতা পরিষ্কার মনোভাবের ফল। মনোভাব পরিষ্কার না হলে চিন্তায় স্বচ্ছতা আসে না। জানা বিষয়কেও ধোঁয়াটে করে তোলা দুর্বল চরিত্রের লক্ষণ। বিচারপ্রবল মন শুদ্ধ তত্ত্বে আনন্দ পায়। ভবিষ্যতের দিকে নজর দেওয়া শুদ্ধ তত্ত্বের লক্ষ্য। চেতনার বিবেকী স্তরে এই দাবি মান্যতা পায়। সমাজের ভিন্ন স্তরে এর অবহেলা দেখলে বিবেকী মন তাই বিদ্রোহ করে। আমরা এই মনের মানুষকে ‘বিপরীত-স্রোতে’র ব্যক্তিত্ব বলে জানি। সক্রেটিসের প্রসঙ্গ তুলে জন স্টুয়ার্ট মিল আমাদের উপদেশ দিয়েছিলেন, এ-রকম মানুষকে আমরা যেন ভালোবাসতে শিখি। তাঁর স্বজাতির বিদ্বান লোকেরাও কিন্তু এই উপদেশক্ষেত্রবিশেষে মানেননি। গল্পটা এইখানে বলায় ক্ষতি নেই।

বদরুদ্দীন উমর অনার্স পড়তে গিয়েছিলেন অক্সফোর্ডে। সময়টা ১৯৫৯। তাঁর অনার্স ডিগ্রির বিষয় ছিল
দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি। বিষয়টি PPE নামে পরিচিত। উমরের এক শিক্ষক ছিলেন মিস্টার হেনরি পেলিং। হেনরি পেলিং একদিন উমরকে International Relation-এর ওপর একটি টিউটোরিয়াল লিখতে দিয়েছিলেন। বিষয়টি ১৯৩৯ সালে সোভিয়েত-জার্মানি অনাক্রমণ চুক্তি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই চুক্তিটা করতে একরকম বাধ্য হয়েছিল। উমর এ-ব্যাপারে চুক্তির যুক্তিসংগতার কথা বলে, তথ্যসমেত তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে উমর বলেন, আমার লেখা পড়ে শেষ করার পর পেলিং বললেন, তোমার এ লেখা ঠিক হয়নি, কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের কথা বললেও হিটলারের সঙ্গে স্ট্যালিনের এই চুক্তি ছিল সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদের পক্ষ।

উমরের তাৎক্ষণিক বক্তব্য এবং খাতায় পরিবেশিত তথ্য ও যুক্তি মিস্টার পেলিং খণ্ডন করতে পারেননি। এই অক্ষমতা পেলিংকে সহজ না-করে ‘বিরক্ত’ করে তোলে। উমর লিখেছেন, আমি আমার বক্তব্য শেষ করার পর তিনি যা বললেন, সেটা শুনে আমি স্তম্ভিত হলাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে, কিন্তু এভাবে তুমি যদি পরীক্ষার খাতায় লেখো তাহলে নম্বর পাবে না। আমি তখন অগ্রপশ্চাৎ কোনো চিন্তা না করেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বললাম, Yes Mr. Pelling, if for getting marks I have to write as you say. I will certainly do so। এতে পেলিং সাহেবের ফর্সা মুখ লাল হলো। বুঝলাম তিনি আমার ওপর ভীষণ রেগেছেন। কিন্তু পরবর্তী কোনো টিউটোরিয়াল ক্লাসে এর কোনো রেশ আমি লক্ষ করিনি। তাঁর আচরণ ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের যা হওয়া উচিত তাই ছিল। তবে তিনি যে আমাকে আমার ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা করেননি, এটা পরে অন্য ঘটনার মধ্যে আমি ভালোভাবেই টের পেয়েছিলাম।

প্রমথ চৌধুরী আমাদের একটা অমূল্য কথা শুনিয়েছিলেন ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে – লোকে যা আত্মসাৎ করতে পারে না, তাই সে ভস্মসাৎ করতে চায়। বদরুদ্দীন উমর PPE পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজের বিবেকনিষ্ঠ বিচার থেকে সরে দাঁড়াননি।

অবস্থা অতিক্রমী লড়াই

চতুর্থ বক্তব্যটা এই প্রসঙ্গে আসা উচিত। বদরুদ্দীন উমর জীবনে চারটি চাকরি করেন। তার একটিতেও তিনি লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করতে পারেননি। কারণটা স্পষ্ট করা দরকার।

চাকরি বস্তুটা অমূল্য। চাকরি জিনিসটা চরিত্রধ্বংসের গোড়া। এই দুই বক্তব্য সমান সত্য। সমাজে এই দুইয়ের উপযোগী দুই মনোভাবের মানুষ বাস করেন। বদরুদ্দীন উমর দ্বিতীয় বক্তব্যে সায় দেবেন। প্রথম বক্তব্যে
মন-না-থাকা তার প্রধান কারণ। দ্বিতীয় বক্তব্য সম্পর্কে উমর বলবেন যে, চরিত্র নষ্টের এ হচ্ছে অদ্বিতীয় পথ। কেন তিনি এই কথা বলবেন, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। সংক্ষপে কথাটা বলে নিই।

চাকরি – সেটা সরকারি-বেসরকারি যাই হোক, কর্তৃপক্ষর মন চুগিয়ে, কর্তৃপক্ষর মেজাজ-মর্জি লক্ষ করে, কর্তৃপক্ষর চাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা হচ্ছে অলিখিত নিয়ম। এসবের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারলে তবেই এ-পথে চলা সার্থক হয়। অন্যথায় ভিন্ন কলহ বাধে। এ ব্যাপারে মজার শব্দবন্ধ তৈরি হয়েছে। হাল আমলে এই মানিয়ে চলার নাম good management। আমাদের মধ্যে কেউ যদি চিন্তাশীল থাকেন, তাঁর যদি নিজের ভাবনার কিছু থাকে, সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি তথা মানববিদ্যা সম্পর্কে তিনি যদি সচেতন হন – অন্যের বক্তব্যের সঙ্গে, অন্যের মতের সঙ্গে তাঁর যদি দ্বিমত হয়, তাঁর ভিন্ন মতটা যদি তিনি প্রকাশ করেন, তবে এই চাকরি তাঁর সইবে না। কারণ গড্ডলপ্রবাহের মানুষ কারো স্বাতন্ত্র্য সইতে পারে না। মানুষ স্বভাবতই পরশ্রীকাতর এবং রক্তে তার হিংসার বীজ মিশে থাকে। কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব এবং মানববিদ্যার মতো বিশিষ্ট গুণের ধারে-কাছে তিনি যদি না-থাকেন, তবে তিনি good management-এর সেরা লোক। এর চরম ফল তার চরণতলে এসে পড়বেই। সহসা সবার কপালে এই ফল জোটে না। বদরুদ্দীন উমর এই কপাল-পোড়া লোকদের একজন। তিনি কর্তৃপক্ষর অলিখিত নিয়ম good management অনুসরণ করতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান এজন্য বদরুদ্দীন উমরকে হয়রানি করতে ছাড়েননি। ব্যাপারটা কিছু খোলাসা করে নেওয়া যাক।

সময়টা বিশ শতকের ষাটের দশক। বদরুদ্দীন উমর তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পূর্বমেঘ নামের সাময়িকপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর দুজন সম্মানিত শিক্ষকের সম্পদনায় বেরুচ্ছে। উমর তাতে সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ক প্রবন্ধ লিখছেন। পাকিসত্মানের রাজনৈতিক লাইন ও সাংস্কৃতিক আবহাওয়া সম্পর্কে উমরের মতামত
সে-সব প্রবন্ধে বিশ্লেষিত হতো। প্রবন্ধগুলোর বক্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষত জনসাধারণে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, নতুন প্রজন্মের কাছে আর ছাত্রদের মধ্যে ইতিবাচকভাবে একটা অসাধারণ চাঞ্চল্যের পরিবেশ তৈরি করে। জনসাধারণের ওপর পড়া এই প্রভাব স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানি আদর্শের বিরুদ্ধে যায়। শাসকশ্রেণি বিচলিত হয়ে পড়ে। এর বিষফল একা বদরুদ্দীন উমরকে ভোগ করতে হয়।

এর থেকে একটা বিষয়ে ধারণা করা যায় যে, বদরুদ্দীন উমরের সংস্কৃতি-চিন্তা রূপ নিয়েছিল একটি সুগঠিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, যা একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। জাতীয় সংকট নিরসনে রাজনীতির মতো তাই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকাও স্বীকার্য। কেননা অনেক ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক আন্দোলনই জাতীয় সংকট-মুক্তির অন্যতম শর্ত। আমাদের ভাষা-আন্দোলন তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাফল্যেও আছে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যোগাত্মক ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর ব্যত্যয়কে বলা যেতে পারে ইতিহাস-বিকৃতি। এই বিকৃতি আজ একটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কেননা স্বাধীনতাপূর্ব কালের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে বদরুদ্দীন উমরের যে চিন্তাভাবনা ও কর্মপ্রয়াস এবং তার ফলে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং সে-আন্দোলন যে স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি শক্তিমত্তা হাতিয়ার ছিল, এই কথাটি আজ আর কোথাও শোনা যায় না।

বদরুদ্দীন উমরের আত্মজীবনী যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা সকলেই এইসব অবগত আছেন। তাঁর বন্ধুরা সে-সময়ের সব খবর জানেন। তাঁদের মুখ বন্ধ। আমাদের তরুণদের সামনে সে-ইতিহাসের প্রচার নেই। আমাদের অতীত সম্বন্ধে আমরা অন্ধ। অথচ প্রলয় ঠেকানো কারো সাধ্যে নেই। বর্তমান বলতে কোনো পদার্থ নেই। ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে! কিন্তু মুক্তমনের সাহস এবং বাঙালি জাতির মহৎ আকাঙ্ক্ষা এই দুইয়ের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ তৈরি হতে পারে। এই সম্ভাবনাটুকু যদি অন্তরে ধরে রাখা সম্ভব হয়, একটু চোখ-কান খুলে যদি চারপাশে দেখা যায়, তা হলে ইতিহাসের ঘন কালো পর্দাগুলো দৃষ্টির আড়াল হয়ে পড়ে। বদরুদ্দীন উমর এইখানে আমাদের পরম বন্ধু হতে পারেন। কেননা ইতিহাসে শরিক হওয়ার ভূমিকায় তিনি আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। দু-একটা  নয় – তাঁর পুরো জীবনই এই দৃষ্টান্তের একটা আলোকস্তম্ভ।

বদরুদ্দীন উমর জাতীয় দুর্দিনে সরকারি দুর্বৃত্ত নীতি ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলতে ছাড়েননি। চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি ভাবেননি। তিনি জানতেন যে, চাকরি তাঁকে ছাড়তে হবে। রাজনীতি তাঁর স্ব-ক্ষত্র।

কীর্তি ও কৃতিত্ব

ইতিহাস তৈরি হয় কীর্তি দিয়ে। কৃতিত্ব ছাড়া কীর্তি অকল্পনীয়। ইতিহাস অর্থ তাই কৃতিত্বের কথা। যেখানে এই কৃতিত্বের কথা নেই, সেখানে ইতিহাস নেই। বদরুদ্দীন উমর আমাদের ইতিহাসের দুটি গৌরবপূর্ণ ঘটনার অন্যতম সংগ্রামী পুরুষ।

ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ – দুইয়েরই তিনি কর্মী ও ভাষ্যকার। আজ আমাদের জাতিকে এই সত্য জানানো দরকার। আমাদের স্বীকার করে নেওয়া দরকার তাঁর কৃতিত্বের ঋণ। ইতিহাস প্রচার একপেশে হওয়া উচিত নয়। ভাষা-আন্দোলনের একেবারে চরম মুহূর্ত থেকে তার পরিণতি পর্যন্ত সমস্ত লড়াইয়ের মধ্যে তিনি কাজ করেছিলেন। ভাষা-আন্দোলনকে তিনি বেগবান করেছিলেন আমাদের ভাষার লড়াই শীর্ষক পুস্তিকা লিখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তখন ভাষা-আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল এক অবিস্মরণীয় ব্যাপার। নানা রকম দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্ররা তখন ব্যাপকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। এ সময় উমর ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ছাত্র। তখন ছাত্র-আন্দোলনে যা কিছু হতো, প্রতিটি মিছিল-মিটিংয়ে তিনি উপস্থিত থাকতেন। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে তিনি নেতা নয়, কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি আমাদের ভাষার লড়াইয়ের দশ হাজার কপি ছাপিয়ে প্রচার করেছিল। মাঠে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, কর্মীরা বক্তৃতায় যখন শ্রান্ত, গণতান্ত্রিক অধিকার যখন ন্যায্য, ভাষার দাবিটা যখন যথার্থ – আমাদের ভাষার লড়াই তখন মাইকে পড়ে শোনানো হতো। এরই মধ্যে আমরা জেনেছি, ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস রচনা তাঁর মহত্তম কাজ। তাঁর তিন খণ্ডে রচিত এই আন্দোলনের ইতিহাস, আমরা ইচ্ছা করলে অনায়াসে ও অবলীলাক্রমে পড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু তিনি এই গ্রন্থ অনায়াসে লিখতে পারেননি। আর্থিক সামর্থ্যের কথা ভুলে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে, বহু আয়াসে, অনেক পরিশ্রমে এবং দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বিস্তর চিন্তাভাবনা করে তাঁকে এই ইতিহাস লিখতে হয়েছে। ভাষা-আন্দোলন চলাকালে রচিত আমাদের ভাষার লড়াই পুস্তিকাটি ছিল তাঁর এই কাজের সূচনা আর তিন খণ্ডে লিখিত ইতিহাস গ্রন্থটি তার পরিণতি। তিনি এই কাজের পথিকৃৎ।

বদরুদ্দীন উমরের রাজনীতির কথা যদি ছাড়ি এবং তাঁর মনীষার কথা যদি ধরি – তবে দেখব যে, গত পঞ্চাশ বছরের ভেতর আমাদের চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রটাকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। মনীষা জিনিসটা এজমালি সম্পত্তি নয়। আমরা চাইলে আমাদের চাহিদামতো তা পেতে পারি না। যার গায়ে জোর আছে সে-ই তা দখল করতে পারে না। এটা ব্যক্তি মানুষের অর্জিত সম্পদ। ব্যক্তি মানুষকে এটা অর্জন করতে হয়। সমাজে বাস করলে জল-হাওয়ার মতো আপনাতে ওটা পাওয়া যায় না। বাংলা ভাষা, বাঙালি, বাঙালিত্ব, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মার্কসবাদ প্রভৃতি পাকিসত্মান আমল থেকে আজকের বাংলাদেশ পর্বের বৃহৎ পটভূমি সম্বন্ধে তাঁর মতামত তিনি অক্লান্তভাবে লিখেছেন। একমাত্র বিজ্ঞান এবং বিশুদ্ধ সাহিত্য তথা কবিতা, গল্প, উপন্যাস ছাড়া সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ, ইতিহাস, ভাষা ও ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস, ধর্ম প্রভৃতি তাঁর আলোচনার বিষয়। এসব বিষয়ে সুচিন্তিত ও নির্ভরযোগ্য বক্তব্য পেশ করতে চেষ্টা করেছেন তিনি, যাতে আলোচিত হয়েছে তাঁর দর্শনগত মৌল নীতি। সে-নীতির মূল কথা হচ্ছে ইতিহাসের সকল ঘটনার মধ্যে রাজনীতির নির্ধারক ভূমিকাকে স্পষ্ট করা। তাঁর এ-নীতি কেবল আজকের বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানগত বাঙালি সংস্কৃতি সম্বন্ধে নির্ণীত হয়নি, সমকালীন বিশ্বের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মনোভাবের পরিচয়ও তাঁর রচনায় পাওয়া যায়, যা এই নীতির দ্বারা বিশেষভাবে আলোচিত। তাঁর এসব চিন্তাভাবনা বিস্তারে এবং গভীরতায় যেমন ব্যাপক, তেমনি প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক পটভূমি জানার ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাভাবনা ও গ্রন্থাদি সাধারণ পাঠক, লেখক ও গবেষকদের কাছে এক অপরিহার্য উপাদান বলে মনে হয়। আমাদের সংস্কৃতির প্রগতিশীল ধারা এবং আমাদের জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রেও তাঁর গ্রন্থাদি ও চিন্তাভাবনা এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা।

শেষ কথা

বদরুদ্দীন উমর তাঁর নববই বছরের জীবনে বহু কাজ করেছেন। এইসব কাজের কোনো মূল্যমান নির্ণীত হয়নি। এমনকি তাঁর কোনো গ্রন্থের যথার্থ আলোচনা পর্যন্ত দেখা যায় না। এ নিয়ে উমর নিজেও তাঁর আত্মজীবনীতে
দু-বাক্য ব্যয় করেছেন। তাঁর প্রায় প্রতিটি গ্রন্থ একাধিকবার সংস্করণ অথবা মুদ্রিত হয়েছে। অসংখ্য পাঠক-গবেষক তাঁর গ্রন্থ ব্যবহার করছেন, কিন্তু তাঁর বক্তব্য নিয়ে তাঁদের বলার কিছু নেই! উমর কেবলি কাজ করেছেন। সেই কাজের ফল নিজে ভোগ করতে চাননি। ফলের প্রতি তাঁর লোভ নেই। যে-কাজে সাংসারিক লাভ হয়, তেমন কাজ তিনি জীবনে করেননি। দেখা যায় – লাভ নেই, লোভ নেই, পারিবারিক, সামাজিক কর্তব্যের তাড়া নেই – এমন কাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ সীমাহীন। অপরদিকে, বৈষয়িক অর্থে তাঁর শরীরটা যেন মোহহীন! এ-মানুষের জাতই আলাদা, স্বতন্ত্র এঁর প্রকৃতি। বাঙালি মুসলিম সমাজে এই চরিত্র সুলভ নয়।

আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, আমরা আমাদের জাতীয় জীবনের অপরিমেয় সংকট ও সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির শিকার হয়ে বদরুদ্দীন উমরের মহৎ জীবনের কথা আমাদের কালের তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরিনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। তবে তিনি পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশপর্বে আমাদের সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেন, তা মৃত্যুহীন। 

টীকা ও তথ্য

১.         হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সার্বভৌম কবি ও অন্যান্য প্রবন্ধ, কলকাতা, বসুমতি করপোরেশন লিমিটেড, জানুয়ারি ১৯৯৩, পৃ ৩৫।

২.         উল্লেখ দরকার, ‘আবেগসর্বস্ব’ কথাটি এখানে আমি রাগ-দ্বেষ অর্থে বুঝিয়েছি। আমাদের সমাজে ‘আবেগ’-এর ব্যবহার এই তত্ত্বের বশীভূত। আবেগের অন্য বিশুদ্ধ স্তরও আছে। সেসব স্তর উচ্চতায় এত মানবিক যে, তা যেমন সুন্দর, তেমনি নির্মল। যেমন – মায়ের ভালোবাসা, শিশুর মুখের হাসি।

৩.        কাজী আবদুল ওদুদ, ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (বদরুদ্দীন উমরের জীবন ও কাজ : নিবেদিত প্রবন্ধাবলি), ঢাকা, বাঙ্গলা গবেষণা, ফেব্রম্নয়ারি ২০২২, পৃ ১৫। ৪.         আজ থেকে এক যুগ আগে বর্তমান লেখক বদরুদ্দীন উমর রচনাসংগ্রহের পরিকল্পনা করেন বিশ খণ্ড। এই পরিকল্পনা অনুসারে শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে তিন খণ্ড (প্রথম খণ্ড মার্চ ২০১২, দ্বিতীয় খণ্ড ২০শে ডিসেম্বর ২০১২ এবং তৃতীয় খণ্ড জুন ২০১৩) বদরুদ্দীন উমর রচনাসংগ্রহ প্রকাশিত হয়। আর্থিক অসংগতি ও অন্য একাধিক কারণে এ-পরিকল্পনা কার্যকর করা যায়নি। তবে এর আগে আমার সম্পাদনায় প্রথম বদরুদ্দীন উমর-এর গ্রন্থপরিচয় (২০১০) প্রকাশিত হয় উলিস্নখিত প্রতিষ্ঠান থেকে। অন্যদিকে বয়স আশি বছর উপলক্ষ, তাঁর সংগ্রামী জীবন নিয়ে রচিত আমার একটি বিশেষ প্রবন্ধ, যা ‘বুকলেট’ (কমরেড বদরুদ্দীন উমরের ৮০তম জন্মবার্ষিক উদযাপন কমিটি প্রকাশিত পুস্তিকা, ২০শে ডিসেম্বর ২০১১) আকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। সেই সঙ্গে তাঁর সংগ্রামী জীবন ও কর্ম নিয়ে চমৎকার একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে, ওই তারিখে। ‘বুকলেট’টি সে-অনুষ্ঠানে বিতরণ করা হয়।