ব্রহ্মবিদ্যালয় থেকে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ

রবীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত শান্তিনিকেতন শিক্ষায়তন নানা কারণেই শিক্ষা-আগ্রহী ভাবুকদের কাছে স্বতন্ত্র এবং আকর্ষণীয় বলে বিবেচ্য হয়েছে। বাঙালি ছাড়াও অবাঙালি ভারতীয় শিক্ষানুরাগী মানুষজন, পাশ্চাত্যের কতিপয় নিবেদিত প্রাণশিক্ষক ও গবেষক নানা সময়ে শান্তিনিকেতনে এসে উপস্থিত হয়েছেন, কর্মকাণ্ডে কমবেশি অংশ নিয়েছেন। এর ফলে শান্তিনিকেতন শিক্ষায়তনের ছাত্র ও শিক্ষকমণ্ডলী আলোকপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেইসঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের একটা সর্বভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি বৃদ্ধি হয়েছে। যদিও এটা স্বাভাবিক যে, কোনো কোনো কর্মী, শিক্ষক বা ছাত্র এ-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। অভিমান, মোহভঙ্গের বেদনা-এসবের কথাও শোনা যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয় তথা বিশ্বভারতী বিশ্ববাসীর কাছে অব্যাহত আকর্ষণ রাখতে পেরেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সে এক আদ্যিকালের কথা। কথার মালা গাঁথার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অন্তরে তাগিদ এলো এক অভিনব বিদ্যালয় স্থাপনের। বোলপুর ব্রহ্মবিদ্যালয় অঙ্কুর একদা কালের যাত্রায় হয়ে ওঠে বিশ্বভারতী। একদিকে নিজেকে প্রকাশের অন্যদিকে তপোবনের আদর্শকে রূপ দেওয়ার বাসনাযুক্ত হয়েছিল কবির। ১৯০১ থেকে ১৯২১ সাল এক অভিনব যাত্রা। এক চিঠিতে লিখছেন- ‘অতীতকে ফেরানো আমার কর্ম নয়।’ নতুন জীবনের সহায়ক সেই সমিধটুকু শুধু তিনি নিতে চান ভারতের তপোবনের শিক্ষাদর্শ থেকে। পুত্র রথীন্দ্রনাথকে জানাচ্ছেন যে, তিনি সন্ধান করেছেন স্বপ্ন-কল্পনা বাস্তবায়নের এক উপযোগী স্থান। একদিকে সেই বিদ্যালয়ের ভিত্তিতে থাকবে তপোবনের আদর্শ, অন্যদিকে সেই আশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে জগৎ পারাপারের উপযোগী আবহ।

শিশুরা প্রত্যহ উজ্জীবিত হবে ঔপনিষদিক মন্ত্রে, সেইসঙ্গে চলবে শিল্প ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা-এই কবির অন্তরের বাসনা। প্রকৃতির সান্নিধ্যে অণুবীক্ষণ ও দূরবীক্ষণে জগতের সজীবতাকে আত্মস্থ করে নেওয়ার চেষ্টা ব্রহ্মচর্য ও বহুমুখী জীবনচর্যা নিয়ে নবজাত বিদ্যালয় এগিয়ে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যাতীর্থ প্রাঙ্গণে। এই বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রার অভিনবত্ব বিশ্ববাসীর হৃদয়ে আজো সাড়া জাগায়।

নিখিল বিশ্বাত্মার আশীর্বাদ নিয়ে এখানে গড়ে ওঠে গুরু-শিষ্যের সুগভীর সম্পর্ক। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যাঁরা অধ্যয়নরত ছিলেন, সেকালে তাঁদের বৈদিক ভাষায় বলা হতো ‘মানবক’, আর যাঁরা বিদ্যাশিক্ষা দিতেন তাঁরা ছিলেন ‘গুরু’। শিষ্য আর গুরুকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মাচর্যাশ্রম’। গানে-নাচে-চিত্রাংকনে মুক্তশিক্ষাদর্শে আপাত-দারিদ্র্যে সেইসঙ্গে অভ্যন্তরে ছিল নানান চিন্তাভাবনার ঐশ্বর্য। সে-কারণেই দেশ-দেশান্তর থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এসেছেন শান্তিনিকেতনে। এছাড়াও কবির অভিনব উৎসবকল্পনা, প্রকৃতিকে অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করা, ঘরে-বাইরে শিক্ষা, অবহেলিত ভূমিপুত্রদের আলোকদান-একদা এসব রবীন্দ্রকল্পনার অন্তর্গত ছিল।

পৃথিবীর সংস্কৃতি ও পঠন-পাঠনের ইতিহাসে বিশ্বভারতীর পরিকল্পনা ছিল একেবারে অভিনব। পাঠ্যসূচি, পাঠ্যদান প্রকল্প, পাঠনক্রিয়া-সবকিছুই ছিল একেবারে আলাদা। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ছিল নানামুখী শিকড়ে প্রসারিত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পাঠ্যপ্রসঙ্গ, গ্রাম ও শহরের সংস্কৃতির সম্মিলন, পাঠ্যপুস্তক ও প্রকৃতিপাঠ, পল্লী-পুনর্গঠন, গ্রামসেবা, স্বাস্থ্যসমবায়, তার সঙ্গে সংগীত, নাটক, নৃত্য এবং সমাজসেবাকে অঙ্গীভূত করা। ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানকে সমভাবে গুরুত্বদান-এসবই ছিল বিশ্বভারতীকে ঘিরে কবির ভাবনাচিন্তার অন্তর্গত। সব মিলিয়ে উৎকর্ষের সাধনা ছিল রবীন্দ্রভাবনার এক বিশেষ লক্ষ্য।

বস্তুত এই বিচিত্রতার টানেই দেশ-বিদেশের মহামনীষীরা বারেবারে দৃষ্টি দিয়েছেন বিশ্বভারতীর দিকে, তাঁরা এসেছেন গভীর আগ্রহ নিয়ে অধ্যাপনায়, আত্মোৎসর্গ করেছেন আশ্রম-সক্রিয়তায়। কিন্তু শান্তিনিকেতনের বাইরে রযে-সমাজ তার মননবৃত্তের চেহারা ছিল অনেকটাই আলাদা। সেই টানাপড়েনের ইতিহাস গত একশ বছর ধরে চলেছে। বার্মাটিকের ফার্নিচারে এবার পরিবেশের চাপে ঘুণ ধরেছে, তবুও রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কীর্তির এবং আগ্রহের ইতিহাস নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই।

বয়সের ব্যাপারে কারো নিজস্ব কোনো রকম কৃতিত্ব নেই। সময় তার মতন, নিজের গতিতে, আপনবেগে এগিয়ে চলতে থাকে। এই এগিয়ে চলার হিসাব অনুযায়ী মানুষজন, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষের গড়া প্রতিষ্ঠানাদি-সবকিছুরই বয়স বাড়তে থাকে। দেখতে দেখতে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের বয়স হলো একশ কুড়ি বছর। বিশ্বভারতীর ভিত্তি স্থাপনা হয়েছিল আজ থেকে একশ তিন বছর আগে। এ-বছর বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। ‘যত্রবিশ্বম্ভরত্যেকনীড়ম’ –আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ এই মন্ত্রের মধ্য দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনের কথা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা কার্যকরী করার প্রকল্প গড়ে তুলেছিলেন।

কবির মুক্ত শিক্ষার কল্পনা বাস্তব রূপ পেতে শুরু করে ব্রহ্মচর্য আশ্রম থেকে ব্রহ্মবিদ্যালয় মারফত। বিশ্বভারতী বলতে যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটিকে আজ দেশ-বিদেশের মানুষজন সকলেই চেনেন-জানেন, তার সূচনা হয়েছিল শান্তিনিকেতন আশ্রমের একটি খুব ছোট বিদ্যালয়-ব্রহ্মবিদ্যালয় হিসেবেই। প্রথমদিকে এই বিদ্যালয়টির নাম ছিল- ‘বোলপুর ব্রহ্মবিদ্যালয়’। আবার অনেকে বলে থাকেন ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’।

১৮৯০ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর পিতামহতী দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে, পরের বছর রবীন্দ্রনাথ গেলেন অধুনা ওপার বাংলার শিলাইদহে-তাঁদের পারিবারিক জমিদারির কাজ দেখাশুনো করার জন্যে। তখন তাঁর বয়স তিরিশ বছর। শিলাইদহে প্রাকৃতিক সবুজিমায় জমিদারির নানান কাজে নিয়ত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও রবীন্দ্রনাথ নিভৃতে সাহিত্যচর্চা করতেন। আর এখানেই ‘গৃহবিদ্যালয়’-এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা বিষয়ে কবির সরাসরি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। পুত্র-কন্যাদের জন্য পাঠদান, পাঠ নির্বাচন, শিক্ষক নিয়োগ ও তাঁর অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছিল।

পল্লি অঞ্চলে জমিদারির কাজে নানাবিধ ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও কবি বিশেষভাবে অনুভব করেছিলেন যে, এখানে গৃহশিক্ষক রেখে শিক্ষাদানের চেষ্টা হলেও এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষাসামগ্রিক ও যথার্থ হয়ে উঠতে পারবে না।

১৩০৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ়ে (১৯০১) কবির লেখা নৈবেদ্য বই হিসেবে প্রকাশিত হলো। সেই বছরের শুরুতেই কবির সপরিবারে শিলাইদহ বাসের সমাপ্তি ঘটল। এর পেছনে দুই কন্যার বিবাহ, শিলাইদহে নিভৃতবাসে ফিরে যেতে কবিপত্নীর অনীহা-এই ধরনের বিভিন্ন পারিবারিক কারণ ছিল। শিলাইদহে বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘গৃহবিদ্যালয়।’ কবির গৃহবিদ্যালয়ে তাঁর পাঁচটি সন্তানের শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিযুক্ত হন শিবধন বিদ্যার্ণব, জগদানন্দরায় ও লরেন্স। পুত্র রথীন্দ্রনাথের এন্ট্রান্স পরীক্ষা। ‘… রথীন্দ্রনাথকে পড়াবার সমস্যা এল সামনে। তখন প্রচলিত প্রথায় তাকেই স্কুলে পাঠালে আমার দায় হ’ত লঘু এবং আমার আত্মীয় বান্ধবেরা সেইটেই প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বক্ষেত্র থেকে যে বিদ্যালয় বিচ্ছিন্ন, সেখানে তাকে পাঠানো আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব।’ শান্তিনিকেতনের ক্ষেত্র সর্বত্রগামী, নানা শহরের সঙ্গে সহজ সংযোগসিদ্ধ। তাছাড়া বিভিন্ন ভূমি থেকে ছাত্র আসছে, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দূরে-বহুদূরে।

একদিন কবি তাঁর গৃহবিদ্যালয়কে শিলাইদহের গৃহকোণের সীমানা থেকে বের করে বিকল্প হিসেবে শান্তিনিকেতনকে সহজেই মনে মনে বেছে নিয়েছেন। অন্যসব কাজের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর সম্যক আয়োজন করেছিলেন। কবির মনে এই কল্পনা এসেছিল ১৯০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে। কবি শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতনেএসেছিলেন- ‘একটা সৃষ্টির সংকল্প’ নিয়ে। কবির এই সৃষ্টির সংকল্প ছিল-শান্তিনিকেতনে ভারতবর্ষের প্রাচীন কালের আশ্রমের শিক্ষা, তপোবনের আদর্শ এবং গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাঅর্জনের জন্য একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছরে, তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুকে ১৯০১ সালের আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন- ‘শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীনকালের গুরু-গৃহবাসের মতো সমস্ত নিয়ম। বিলাসিতার নামগন্ধ থাকিবে না-ধনী-দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হইতে হইবে।’

শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার ওপর ভিত্তি করেই এই বীজ বপন হয়েছিল। উদারদিগন্তে বিস্তৃত মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে একদিন অলক্ষিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই আশ্রম, ১২৬৯ বঙ্গাব্দের (১৮৬৩ সাল) ১৮ই ফাল্গুন। সেই বছরেই একটি অতিথিশালার ভিত স্থাপিত হয়, বাড়িটির নাম ‘শান্তিনিকেতন’ বা ABODE OF PEACE। এই বাড়িটি এখন, আমাদের সবার কাছে ‘শান্তিনিকেতনগৃহ’ বলেইপরিচিত। এরপর একটি উপাসনাগৃহ বা মন্দির (১২৯৮ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ, ১৮৯১) প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজ থেকে একশ কুড়ি বছর আগে, ‘উপাসনামন্দির’ ও ‘শান্তিনিকেতনবাড়ি’কে কেন্দ্র করে আশ্রমের নির্জন নিভৃত পরিবেশে, প্রকৃতির নিবিড় স্পর্শে, সীমাহীন আনন্দের স্রোতে মাত্র পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়। ১৯০১ সালের ২২শে ডিসেম্বর, ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ৭ই পৌষ মন্দিরের সাংবাৎসরিক উপাসনাদিশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত নব বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সেকালে পুরনো লাইব্রেরির নিচের তলায় তিনটি ঘর ও বারান্দা ছিল। তখন ব্রহ্মবিদ্যালয়ের একমাত্র ইমারত-ছাত্র-শিক্ষক ওই তিনটি ঘরেই থাকতেন। প্রথম পাঁচজন ছাত্ররা হলেন-কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ, গৌরগোপাল গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত ও সুধীরচন্দ্র নাথ। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রথমপর্বে বহুমুখী শিক্ষা প্রকল্প থাকলেও তীব্র হিন্দুত্ব, নিরামিষ গ্রহণ, কঠোরভাবে ছাত্রশাসন, জাতিভেদ-এসব ছিল। কিছুদিন পর জাতিভেদ দূর হয়, নিরামিষ প্রথা লুপ্ত হয়, খাদ্যঘরে পঙ্ক্তিভোজও উঠে যায়।

কবির এই আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সম্মতি ও আশীর্বাদ ছিল। একটি স্বদেশি ধাঁচের বিদ্যালয় গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজন ও আন্তরিক ইচ্ছে ছিল তাঁর। এই বিদ্যালয়টি হবে এদেশে নতুন অথচ ছাত্রদের মনোবিকাশের উপযোগী। আর এই সঙ্গে কবির ভাবনাবৃত্তে ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যেজ্ঞান-বিজ্ঞানসমন্বয়ে পাঠ্য ও অন্যান্য চারুকলা শিক্ষার ভাবাদর্শ। কবি চেয়েছিলেন, আকাশভরা কোলে ছাত্র হয়ে উঠুক- ‘পূর্ণমানুষ’।

১৯০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবি সপরিবারে বোলপুরে এসে ‘শান্তিনিকেতনে’ বাস করেন। চিঠিপত্রের একাদশ খণ্ডে দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- ‘জায়গাটি বড় রমণীয়। আলোকে আকাশে বাতাসে, আনন্দে শান্তিতে যেন পরিপূর্ণ। … পূর্বেই লিখিয়াছি এখানে একটি বোর্ডিং বিদ্যালয় স্থাপনের আয়োজন করিয়াছি। পৌষ মাস হইতে খোলা হইবে। গুটি দশেক ছেলেকে আমাদের ভারতবর্ষের নির্মল শুচি আদর্শে মানুষ করিবার চেষ্টায় আছি।’

কবির আদর্শকে রূপায়িত করবার জন্য তাঁর এই কর্মযজ্ঞে যোগ দিয়েছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ও তাঁর সিন্ধি অনুজ বন্ধু রেবাচাঁদ। সিমলা স্ট্রিটে রেবাচাঁদের একটি পাঠশালা ছিল। সেই পাঠশালার চারজন ছাত্র ও কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ মোট পাঁচজন ছাত্রকে নিয়ে ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

প্রসঙ্গত বিশেষভাবে উল্লেখ্য, মহর্ষিদেবের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। বলতে গেলে, ব্রহ্মবিদ্যাচর্চা এই বিদ্যালয়ের ভিত্তি। বলেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিলেন ১৮৯৮ সালে। এই সময় বিদ্যালয়ের জন্য একটি বাড়ি নির্মাণ শুরু হয়েছিল। তিনি প্রয়াত হন ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৩রা ভাদ্র। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পৌত্র, বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র বলেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুতে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের কাজ ঠিক তেমনভাবে আরম্ভই হতে পারেনি। দেখতে দেখতে একটি বছর কেটে গেল।

১৯০১ সালে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ও অনুমতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গৃহবিদ্যালয়কে আরো অনেক বেশি প্রসারিত করে, শান্তিনিকেতন আশ্রমের শান্ত পরিবেশে প্রকৃতির কোলে একটি আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর এই ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল টান। তার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল পাশ্চাত্য ও সর্বতোমুখী বিদ্যাসাধনা। তিনি এসবের মধ্য দিয়ে শান্তিনিকেতনে প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে যথার্থ সম্পর্কের একটি আদর্শ ‘মডেল’ গড়ে তোলার প্রয়াসী হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে যে অর্থাভাব ছিল, তা রবীন্দ্রনাথ মিটিয়েছেন সানন্দে নিজস্ব সঞ্চয় থেকে, স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর অলংকারের বিনিময়ে। কবির আর্থিক সংগতির দিকটা যে কী পরিমাণ দুর্বল ছিল তা তাঁর বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকেতাঁর লেখা চিঠিগুলোই সাক্ষ্য দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

কবি তাঁর বিদ্যালয় পরিচালনার শুরুর পর্বে কয়েকজন আদর্শবাদী শিক্ষককে নিকটসঙ্গী ও সহকারী হিসেবে পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, অজিত কুমার চক্রবর্তী, মোহিতচন্দ্র সেন, সতীশচন্দ্র রায়, জগদানন্দ রায়, তেজেশচন্দ্র সেন, নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী, ক্ষিতিমোহন সেন, বিধুশেখর শাস্ত্রী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৯০২ সালের জুন মাসে গ্রীষ্মাবকাশের শেষে বিদ্যালয় খোলার পর একজন ‘তরুণ গ্র্যাজুয়েট’ মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন ভদ্রলোককে কবি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করলেন। সে-সময় প্রায় ছয় মাস আশ্রম বিদ্যালয়ে গুরু-শিষ্যের সম্বন্ধের মধ্যে আর্থিক বিষয়ক লেনদেন ছিল না। ছাত্রদের কোনো বেতন দিতে হতো না। ছাত্র-শিক্ষকদের খরচপত্র কবিই বহন করতেন।

এরপর ধীরে ধীরে বিদ্যালয়ের কাজে যোগ দিয়েছিলেন রেবাচাঁদ (ব্রহ্মচারী অণিমানন্দ), শিবধন বিদ্যার্ণব, রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (যিনি অর্থসচিবও ছিলেন), নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ডা. কানাই লাল বসু, নগেন্দ্রনাথ আইচ প্রমুখ। ‘চালচুলোহীন ইংরেজি শিক্ষক’ মি. লরেন্স শিলাইদহ পর্ব থেকেই ছিলেন। লরেন্স শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথম বিদেশি শিক্ষক, যিনি পড়াতেন ইংরেজি ভাষা। কবি লরেন্সকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন ১৯০৩ সালের মার্চ মাসে। একসময়, মতবিরোধবশত ব্রহ্মবান্ধব ও রেবাচাঁদ এই বিদ্যালয় ত্যাগ করেন।

হোরিসান শান্তিনিকেতনের প্রথম বিদেশি ছাত্র। জাপানের বিশিষ্ট মনীষী ও ভাবুক তেনসিন ওকাকুরার মাধ্যমেই জাপানের প্রাচীন পুরোহিত বংশের নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ হোরিসান সংস্কৃত ও পালি ভাষা অধ্যয়নের জন্য শান্তিনিকেতনেএসেছিলেন। হোরিসান নিজেই নিজের নামকরণ করেছিলেন ‘চিদানন্দ’।

কুঞ্জলাল ঘোষ নামে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের একজন ভদ্রলোককে আশ্রমের কাজে বহাল করলেন কবি। সেটা ১৯০২ সালের ১০ই নভেম্বরের কথা। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কাজকর্ম কীভাবে সম্পাদিত হবে, সে-সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখে রবীন্দ্রনাথ কুঞ্জলাল মারফত শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়েদেন। এই দীর্ঘ চিঠি থেকে জানতে পারি যে, বিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য প্রথম ‘অধ্যক্ষ সমিতি’ গঠিত হয়েছিল। মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদানন্দ রায় ও সুবোধচন্দ্র মজুমদার-এই তিনজন প্রথম সদস্য হলেন। সমিতির সভাপতি হলেন মনোরঞ্জন। এই সমিতির প্রয়োজনীয় নির্দেশমতো বিদ্যালয়ের কাজকর্ম সম্পাদন করতেন কুঞ্জলাল ঘোষ। এর মাস দুয়েক বাদে বিদ্যালয়ের যাবতীয় কাজকর্মের দায়িত্বভার অর্পিত হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ওপর।

অসুস্থ কন্যাকে নিয়ে কবি আলমোড়াতে আছেন। এই দূরদেশে থাকলেও কবির মন সবসময় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত আশ্রম বিদ্যালয়কে ঘিরে। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় হয় সিটি কলেজের অধ্যাপক মোহিত চন্দ্র সেনের। এই তরুণ অধ্যাপকের সহায়তায় কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থ নতুনভাবে সম্পাদনার কাজে ব্রতী ছিলেন। এটা ১৯০৩ সালের ২০শে মে থেকে ৩রা জুনের কথা। মোহিতচন্দ্রর সঙ্গে নানান কথাবার্তা-আলোচনার পর কবি তাঁর ওপর আশ্রম বিদ্যালয়ের অধ্যাপনা বিধিনির্ধারণ ও তত্ত্বাবধায়নের ভার তুলে দেন।

এই সঙ্গে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, ডাক্তার দুর্গাদাস গুপ্ত ও মোহিতচন্দ্র সেনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং স্থির হয়ে ছিল যে, ‘মাসে একবার করিয়া আসিয়া বিদ্যালয়ের কার্য পরিদর্শন করিয়া যাইবেন।’ এর পরের বছর গ্রীষ্মাবকাশের পর মোহিতচন্দ্র সেন প্রধান শিক্ষকের ভার গ্রহণ করেন। তিনি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, বিদ্যালয়ের ভার পড়ল ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালের ওপর। কোনো কোনো শিক্ষক চলে গেলেও, অধ্যাপক থাকলেন-হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল, জগদানন্দ রায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী ও নগেন্দ্রনাথ আইচ।

এর মধ্যে ১৯০৫ সালের ১৯শে জানুয়ারি (১৩১১ বঙ্গাব্দের ৬ই মাঘ) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ ঘটে। আশ্রমে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পঠন-পাঠন অনুশীলন, অধ্যাপনা আর রচনাকার্যে নিয়মিতভাবে উৎসাহ দিতেন। ১৯০৫ সালের ২রা জুন কবি এক চিঠিতে লিখছেন- ‘আমি অধ্যাপকদের লইয়া মাসখানেক প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় কিছু না কিছু বলা কহা কহিয়াছি …।’ কবি আশ্রমে থাকলেই নিয়ম করে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন, ক্লাসের খাতা বাড়িতে এনে তা সংশোধন করেদি তেন। কেবল ক্লাস নেওয়াই নয়, ছাত্রদের জন্য সবসময় নতুন নতুন ক্রীড়াকৌতুক উদ্ভাবন করতেন। সে-বছরেই আশ্রম-বিদ্যালয়ের পরিচালন-পদ্ধতি ও সংবিধানে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল।

সেকালে এই নতুন কার্যবিধির প্রধান কথা ছিল আত্মশাসন ও ডেমোক্রেসি। তিনি জানতেন, শাসন ও সংযম উভয়ের পরিপূরক। ছাত্র ও শিক্ষক পরস্পরই শিক্ষালয়ের পক্ষে নিতান্ত অপরিহরণীয়। সেকালে আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ দেশের নতুন পরিস্থিতিকে যথার্থভাবে সমাধান করার জন্য গঠনমূলক কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তখন বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভূগোল-শিক্ষা বিষয়ের কয়েকটি বোর্ড থাকত। প্রত্যেক বিষয়ের জন্য এক-একজন পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯১১ সাল নাগাদ বিদ্যালয় পরিচালন-ব্যবস্থায় কিছু কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। যেমন সব ধরনের কার্য সম্পাদন, দেখাশুনো ও পরিচালনার জন্য সর্বাধ্যক্ষ হয়েছিলেন জগদানন্দ রায়। তিনটি বিভাগের ছাত্র পরিচালনার জন্য তিনজন অধ্যক্ষ নির্বাচিত হলেন। অধ্যাপকমণ্ডলীর দ্বারা সর্বাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় শাসন প্রথা চলেছিল। আশ্রমজীবনের নানান জনকল্যাণমূলক কাজ সম্পাদিত হয় ‘আশ্রম সম্মিলনী’র মধ্য দিয়ে। সেই থেকে আজো এই প্রথা চলছে।

দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ছাত্ররা আসছেন। আগেই বলেছি, হোরিসান শান্তিনিকেতনের প্রথম বিদেশি ছাত্র। সারা পৃথিবীর সঙ্গে শান্তিনিকেতনকে যুক্ত করার ভাবনা-চিন্তা-ইচ্ছা কবির মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি শান্তিনিকেতনকে আন্তর্জাতিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবেন। এখানে কোনোরকম প্রাদেশিকতা বা সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না।

১৯১২ সালে শারীরিক কারণেই রবীন্দ্রনাথের বিলেত যাওয়ার কথা। সেবারের যাত্রা তিনি কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখে, এই সময়টা শিলাইদহে কাটিয়েছিলেন। বিদেশ যাওয়ার আগে, কবি লিখছেন (‘যাত্রারপূর্বপত্র’, আষাঢ়, ১৩১৯) – ‘মানুষের জগতের সঙ্গে আমাদের এই মাঠের বিদ্যালয়ের সম্বন্ধটিকে অবারিত করিবার জন্য পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিবার প্রয়োজন অনুভব করি।’ শিলাইদ হেথা কাকালে কবির গান রচনা চলছে (গীতিমাল্য)। এইসঙ্গে তিনি গীতাঞ্জলি প্রভৃতি গানের ইংরেজি তর্জমা শুরু করলেন।

১৯১২ সালের ১৬ই জুন তিনি লন্ডনে পৌঁছেযান। লন্ডন থেকে যান আমেরিকায়। কবি মাসদুয়েক অতিবাহিত করেন সেই দেশে। সে-সময় থেকে কয়েক বছর তিনি বিদেশের নানান জায়গায় ভ্রমণ করলেন। এই ভ্রমণকালে সেইদেশের তৎকালীন বিভিন্ন আন্দোলন বিশ্লেষণ করে কবির মনে হয়ে ছিল যে, একটি বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানব-সম্মিলনেরপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতনে ‘সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র’ স্থাপন করার ভাবনাচিন্তা ১৯১৬ সালেই কবিরমন একেবারে দখল করে ফেলেছিল।

‘বিশ্বভারতী’ –এই নামটি কখন কীভাবে প্রদত্ত হয়েছিল, তার পটভূমিটুকু সংক্ষেপে বলছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা সফরে কয়েকটি জায়গায় বক্তৃতা দেন। কয়েকটি বিদ্যালয়ও পরিদর্শন করেন। সেখানকার কাজকর্ম ও গবেষণার বিশদ ব্যবস্থাদি দেখে কবি মুগ্ধ হন। রবীন্দ্রনাথ এক পত্রে লিখেছেন- ‘শান্তিনিকেতনে দুইএকজন যোগ্য লোক যদি নিজের মনে পরীক্ষার কাজে প্রবৃত্ত হন, তাহলে ক্রমশঃ আপনিই বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হবে।’ শান্তিনিকেতনে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনার সম্ভাবনার কথা কবির এই চিঠিতে দেখতে পাই।

প্রথম মহাযুদ্ধের বিপুল ধ্বংসলীলা, পৈশাচিক বর্বরতা আর মানব হত্যাসংবেদনশীল কবির মনকে দীর্ণ করে দিয়েছিল। আমেরিকা থেকে ফেরার পথে জাপানে থাকার সময় তিনি দেখলেন-জাপানিদের জাতীয়তাবোধ তথা সাম্রাজ্যলোলুপতার উগ্রমূর্তি। কবি গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, শিক্ষা বিধিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া এর প্রতিকার সম্ভব নয়। জাতীয় মহাবিদ্যালয় বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় মানুষের সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। কবির মতে, বিশ্বমানবিক শিক্ষাই যথার্থ শিক্ষা। ১৯১৬ সালে মহাযুদ্ধ চলাকালীন জাপান ও আমেরিকায় ‘ন্যাশনালিজম’ ও যুদ্ধবিরোধী নানা বক্তৃতায় কবির বিশ্বমানবিকতা, আন্তর্জাতিকতা এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের কথা বারবার প্রকাশ পেয়েছিল।

১৯১৬ সালের (১৩২৬ বঙ্গাব্দ) ২৮শে অক্টোবর শিকাগো থেকে রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে লিখছেন- ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে-ঐখানে সার্বজাতিক মনুষ্যত্বচর্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে-স্বাজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসচে-ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতির মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে। ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোল বৃত্তান্তের অতীত করে তুলব এই আমর মনে আছে-সর্বমানবের জয়ধ্বজাঐখানে রোপণ হবে।’

কবির মনে সংকল্প ছিল-ভারত বর্ষের মধ্যে যে সর্বধর্মের সমন্বয় ও মিলন ঘটেছে, তার যথাযথ অনুসন্ধান ও চর্চা হবে বিশ্বভারতীর পঠন-পাঠন আর গবেষণার ক্ষেত্রে।

১৯১৭-১৮ সালের কথা। সেবার বেশকিছু গুজরাটি ছাত্র ব্রহ্ম বিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন। এর আগে নেপালি, রাজস্থানি, মারাঠি, মালয়ালি ছাত্ররা এসেছিলেন। কিন্তু গুজরাটের মতন কোনো একটি প্রদেশের একই ভাষার এতো ছাত্র এর আগে আসেননি। নতুন ছাত্রদের দেখে ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার পর রবীন্দ্রনাথের এক নতুন ভাবনা-চিন্তা মনে স্থান করে নিয়েছিল-সেটা ১৯১৬ সাল। তখনই কবির মনে হয়ে ছিল যে, শান্তিনিকেতনে ‘সার্বজাতিকমনুষ্যত্বচর্চারকেন্দ্র’ স্থাপন করতে হবে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাসখানেকপর শান্তিনিকেতনে-শান্তি, সংহতি ও বিশ্বমৈত্রীর প্রতীক হিসেবে ১৯১৮ সালের ২৩শে ডিসেম্বর, ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ৮ই পৌষ, মহাসমারোহে বিশ্বভারতীর ভিত্তিপত্তন হলো। এই কাজে গুজরাটীরা কয়েক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ভিত্তিপত্তন করার জন্য যে-স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল-সেখানে গৃহনির্মাণ হয়নি। এখানে শিশু বিভাগের হোস্টেল নির্মিত হয়। এর ফলে ভিত্তিপ্রস্তরের মাঙ্গলিক দ্রবাদি সোনা-রুপোর মন্ত্র লেখা ফলক মাটির নিচেই থেকে যায়।

বঙ্গভূমিতে হবে এ এক ভারতভূমি। উদ্দেশ্য-যথার্থ ভারতীয় শিক্ষাগ্রহণ, নিজস্ব আচারচর্চা, জাতীয় আদর্শের চর্চা। প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানসাধনা, সংস্কারমুক্ত মনের গঠন, পুঁথিগত ও পরিবেশগত শিক্ষা এবং শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মৈত্রী-এইসমবেত অভীপ্সার উদ্দেশ্য নিয়েই সর্বভাষাভাষি শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিশ্বভারতীকে কবি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

জাপান ও আমেরিকা ভ্রমণ শেষে, শান্তিনিকেতনে ফিরে এসেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার আয়োজন করেন। ১৯১৮ সালের ১১ই নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো। তার ৪১ দিন পরে শান্তিনিকেতনে শান্তি ও বিশ্বমৈত্রীর প্রতীক হিসেবে ১৯১৮ সালের ২৩শে ডিসেম্বর, ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ৮ই পৌষ, বিশ্বভারতীর ভিত্তি স্থাপিত হলো। কবি এ-বিষয়ে পরামর্শ করেন চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড রুজের সঙ্গে। বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেন বেদ অনুসারে বললেন-‘অথেয়ংবিশ্বভারতী। যত্রবিশ্বমভবত্যেকনীড়ম’ –এই সেই স্থান যেখানেসমস্তপৃথিবী একটি নীড়ে এসে মিলিত হবে।

বিশ্বভারতীর ভিত্তি স্থাপনার ১৮ বছর আগে, বালক রথীন্দ্রনাথের পঠন-পাঠন শিক্ষাদির জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবারে কবি তাঁর নবকল্পিত বিদ্যায়তন বিশ্বভারতীকে গড়ে তোলার কাজে নানাভাবে সহায়তার জন্য পুত্র রথীন্দ্রনাথকে পাশে নিয়ে এসেছিলেন।

এর মধ্যে অ্যানিবেসান্ট মাদ্রাজে এক নতুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আয়োজন করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে এই প্রতিষ্ঠানের ‘চ্যান্সেলর’ করলেন। মহীশুর ব্যাঙ্গালুর নাট্যনিকেতন থেকে, সেখানে যাওয়ার জন্যে কবির কাছে আমন্ত্রণ এলো। জ্ঞানশরণ চক্রবর্তী তখন মহীশুর রাজ্যের দেওয়ান। মূলত তাঁরই আন্তরিক উদ্যোগে কবির এই সফর আয়োজিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসের বীন্দ্রনাথ দক্ষিণ ভারত সফরে গিয়েছিলেন, বিশিষ্ট শিল্পী সুরেন্দ্রনাথ করছিলেন তাঁর সফরসঙ্গী।

আডিয়ারে অ্যানিবেসান্টের পরিকল্পনায় নবগঠিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে ১৯১৯ সালের ১০ই মার্চ থেকে ১২ই মার্চ-এই তিনদিন রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনটি ভাষণ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে The Centre of Indian Culture প্রবন্ধটির মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

আবার ১৩২৬ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (১৯১৯) শান্তিনিকেতন পত্রিকার প্রথমবর্ষের প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম তাঁর বিশ্বভারতী সম্পর্কে অন্তরের কথা জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য লিখলেন। এরপর বিশ্বভারতী সোসাইটি গঠিত হলো। বিশ্বভারতীর আইনানুগ কর্মপ্রবর্তনের ইতিহাস পর্বের সূচনা হলো। ১৯১১ সাল থেকেই শান্তিনিকেতনে বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো কলাবিদ্যা ও সংগীতশিক্ষা। বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মাবকাশের পর আরম্ভ হলো বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার কাজ।

১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথের আবার পশ্চিমযাত্রা। ইউরোপ থেকে কবিকে অভ্যর্থনা জানানো হলো বিপুলভাবে। ইউরোপের বিভিন্ন সভায় কবি ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বমানবীয় ভাবধারার সঙ্গে বিশ্বভারতীর মেলবন্ধনের কথা বলেন। বিদেশের সফর শেষ করে যখন তিনি আশ্রমে ফিরে এলেন, তখন রবীন্দ্রনাথের মনে গভীরভাবে জাগছে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় মূলত তিনটি কার্যসূচি। প্রথম কথা, শান্তিনিকেতনে প্রাচ্যের সর্ববিধ ভাবধারা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র গঠন। দ্বিতীয় দিক হচ্ছে, শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে পল্লির উন্নতি, পল্লি-পুনর্গঠন, গ্রামসেবা, স্বাস্থ্য সমবায় আর গ্রামবাসীর আর্থ-সামাজিক এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উন্নতিতে সহায়তা করা। আর তৃতীয়, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাববিনিময়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং সমগ্র মানবজাতির ঐক্য-সংহতি ও মৈত্রীস্থাপন।

ইউরোপ থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীকে সর্বসাধারণের হাতে উৎসর্গ করার জন্য এক সভা আহ্বান করলেন। ১৯২১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর, ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৮ই পৌষ আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বমৈত্রীর সংকল্পে প্রতিষ্ঠিত হলো বিশ্বভারতী। বিশিষ্ট দার্শনিক আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। সেদিন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলনকেন্দ্রঐতিহাসিকআম্রকুঞ্জে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল। সেদিন আম্রকুঞ্জে এই স্মরণীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন-ক্ষিতিমোহন সেন, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ডাক্তার নীলরতন সরকার, ডাক্তার শিশিরকুমার মৈত্র, সি.এফ. এনড্রুজ, উইন্টারনিট্জ, সিলভাঁলেভি, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে বলেছেন- ‘আজ বিশ্বভারতী-পরিষদের প্রথম অধিবেশন। কিছুদিন আগে বিশ্বভারতীর এই বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ হয়েছে। আজ সর্বসাধারণের হাতে তাকে সমর্পণ করে দেব। …

‘… এই বিশ্বভারতী ভারতবর্ষের জিনিস হলেও একে সমস্ত মানবের তপস্যার ক্ষেত্র করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেবার কী আছে। কল্যাণরূপী শিব তাঁর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়েছেন। সে ঝুলিতে কে কী দান করবে? শিবসমস্ত মানুষের কাছে সেই ঝুলি নিয়ে এসেছেন। আমাদের কী তাঁকে কিছু দেবার নেই? হ্যাঁ, আমাদের দেবার আছে এই কথা ভেবেই কাজ করতে হবে। এইজন্যই ভারতের ক্ষেত্রে বিশ্বভারতীকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’

এরপর সভাপতি ব্রজেন্দ্রনাথ শীল অনুষ্ঠানে একটি দীর্ঘ ভাষণ দেন। আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ বলেন- ‘আজ এখানে বিশ্বভারতীর অভ্যুদয়ের দিন। বিশ্বভারতীর কোষানুযায়িক অর্থের দ্বারা আমরা বুঝিযে, যে ‘ভারতী’ এতদিন অলক্ষিত হয়ে কাজ করছিলেন আজ তিনি প্রকট হলেন। কিন্তু এর মধ্যে আর-একটি ধ্বনিগত অর্থও আছে-বিশ্বভারতের কাছে পৌঁছবে, সেই বিশ্বকে ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিতক’ রেভারতের মহাপ্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে উপস্থিত করব। সেইভাবেইবিশ্বভারতীর নামের সার্থকতা আছে।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানশেষে সন্ধ্যায় প্রতিনিধিদের আনন্দবর্ধনের জন্য সংস্কৃত নাটক বেণী সংহারের তৃতীয় অঙ্ক ও বিসর্জন নাটকের কয়েকটি নির্বাচিত দৃশ্য অভিনীত হয়।

বিশ্বভারতীর কার্যধারায় আচার্য,

ছাত্র, অধ্যাপক ও বান্ধব-এই চার ধরনের মানুষকে কবি বিশেষভাবে যুক্ত করেছিলেন। সেকালের শান্তিনিকেতন আশ্রমে সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, বৃত্তিমূলকশিক্ষা, কলা, সংগীত, নৃত্য, ভাষাচর্চা, কৃষিবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যসমবায়, পল্লীউন্নয়ন, সমবায় শিক্ষার সঙ্গে সার্বিক সর্বাঙ্গীণ শিক্ষাসূচির কার্যধারা অব্যাহত ছিল। রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক ইচ্ছা ও প্রেরণায় খ্যাত কীর্তিগ্রন্থাগার বিজ্ঞানী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার।

যেসব বিদেশি অধ্যাপক ও বান্ধব মূলত রবীন্দ্রনাথের টানেই শান্তিনিকেতনের কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছিলেনতাঁরা হলেন-পিয়ারসন, এন্ডরুজ, সিলভাঁলেভি, মরিটসউইন্টারনিট্জ, তুচ্চি, বগদানফ, পলরিশার, ড. মার্ককলিন্স, স্ট্যানলিজোনস, ঙো-চে-লিম, আঁদ্রেকার্পেলে, কাসাহারা, স্টেনকোনোপ্রমুখ।

দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা আসছেন। সেকালে পঠন-পাঠনের দায়িত্বে ছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, ভীমরাও শাস্ত্রী, ইন্দিরাদেবী চৌধুরাণী, জগদানন্দ রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নকুলেশ্বর গোস্বামী, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর প্রমুখ।

বিশ্বভারতীর প্রথমপর্বেই বিভিন্ন ভাষাচর্চার আয়োজন হয়েছিল। বিদেশি ভাষাচর্চার মধ্যে ফরাসি ভাষাই প্রথম শেখানো শুরু। বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, উর্দু, তিব্বতি ভাষাচর্চার সঙ্গে চীনা ভাষা ও সাহিত্যচর্চাও শুরু হয়েছে। সেইসব চর্চায়, পণ্ডিতবর্গের বক্তৃতায় ছাত্রদের মতো শিক্ষকরাও অংশগ্রহণ করতেন। আবার কোনো কোনো বক্তৃতায় যোগদান করতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সেকালের আশ্রমে চরম আর্থিক সংকটের মধ্যেও কবি জাপান থেকে দুজন জুজুৎসু বিদসানো ও তাকাগাকিকে এনেছিলেন। তাঁরা শান্তিনিকেতনে জুজুৎসু শেখাতেন।

বহু বছর আগে থেকে চীনা ভাষা ও সাহিত্যচর্চাও শুরু হয়েছে। আজ থেকে ৮৪ বছর আগে ১৯৩৭ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিন রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বভারতীর মধ্যমণি’ চীন ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে প্রতিষ্ঠিত চীন ভবনই সর্বশ্রেষ্ঠ স্বতন্ত্র প্রাচ্যবিদ্যা কেন্দ্র। এই বিশাল কর্মসমূহে কবির নিকট সহযোগী হিসেবে তান-য়ুন-শানের নাম আমাদের কাছে উজ্জ্বল ও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে হিন্দি ভবনের উদ্বোধন হয়। জহরলাল নেহরু এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে সমগ্র বিশ্বভারতী পরিচালনার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

পল্লী ও শহরের সমন্বয়চিন্তা সম্পর্কে কবি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার সময়কাল থেকেই কর্ম ও ধ্যানের সমন্বিত সাধনা রবীন্দ্রনাথের মনকে নিবিড়ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তিনি চাইতেন, শিক্ষার মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন জীবনে সমস্ত ধরনের কাজ ও সৃষ্টির যোগাযোগ গড়ে উঠুক। শ্রীনকেতন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি এই আয়োজনের এক বিশাল ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি শ্রীনিকেতনে গ্রাম উন্নয়ন ও পুনর্গঠন এবং পল্লিসেবার কাজ তিনি শুরু করেছিলেন প্রণালিবদ্ধভাবে। ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন উদ্বোধনকরেন।

কবির পল্লি-সংগঠনের কর্মযজ্ঞে তাঁর প্রধান সহযোগী ও অন্যতম কারুকৃৎ ছিলেন বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতি বিদলেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট। তাঁর স্ত্রী বিশ্বভারতীর বান্ধব ডরোথি এলমহার্স্ট শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার সূচনাপর্বে অসামান্য আর্থিক সাহায্য করেছেন। শ্রীনকেতনের কর্মকাণ্ডে যোগ দেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ, কালীমোহন ঘোষ, হেমন্তকুমার সরকার, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ধীরানন্দ রায়, উপেন্দ্রনাথ বসু, মণি রায়, মণি সেনপ্রমুখ নিষ্ঠাবান কর্মী।

ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শান্তিনিকেতনে ছাত্রছাত্রী আসছেন। বিশ্বভারতী যখন ক্রমে ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে-এমন সময় ১৯৪১ সালের ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হলেন। সেই সময়ে বিশ্বভারতীর ভার গান্ধীজী সানন্দে গ্রহণ করলেন। এরপর বিশ্বভারতী সোসাইটির অনুমোদন ক্রমে বিশ্বভারতীর দায়িত্ব অর্পিত হলো ভারত সরকারের ওপর। এরপর স্বাধীন ভারতের পার্লামেন্টে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৯৫১ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করল।

প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে বিশ্বমৈত্রীর সংকল্পে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। আমাদের কাছে বিশ্বভারতী শুধু একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এর একটা আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা জড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তার গুরুত্ব যে আলাদা হবে সে-কথা বলাই বাহুল্য। বিশ্বভারতীর পঠন-পাঠনে একটা স্বাতন্ত্র্য আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু আদর্শ আছে। কিন্তু সেই রাবীন্দ্রিক বাতাবরণ ও আন্তর্জাতিকতার চরিত্র আজকের সময়ে বিশ্বভারতী কতটা ধরে রাখতে পেরেছে এবং নিজস্ব সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার জন্য কী ধরনের ভূমিকা নিতে পারছে-সেই প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক ও প্রাসঙ্গিকও। বিশ্বভারতীতে যে আন্তর্জাতিকতার চরিত্র তা অনেকটাই ক্ষুণ্ন হয়েছে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার যে, বিশ্বভারতী পুনরায় পঠন-পাঠনে, গবেষণায় হয়ে উঠুক যথার্থ আন্তর্জাতিক। রবীন্দ্রঐতিহ্য-আদর্শ এবং আন্তর্জাতিকতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর এখনো বিপুল সম্ভাবনা আছে-একথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা, কবির কর্মকাণ্ড ও ভাবনার সঙ্গে পরিচয় এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি যথার্থ অনুরাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, আশ্রমিক ও রবীন্দ্র-বান্ধবদের যূথবদ্ধ চেষ্টায় বিশ্বভারতীর হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার ও মৌল চরিত্র রক্ষা করা আজো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সক্রিয় সচেতনতা, উন্নত মানসিকতা, আন্তরিক উদ্যোগ ও সদিচ্ছা-আর কিছু নয়। বিশ্বভারতীর বিত্ত আছে, তার সঙ্গে দরকার চিত্তের সংযোগ-তাহলে বিশ্বভারতী পুনরায় ফিরে পাবে তার বিলীয়মান ঐতিহ্য ও গৌরব।