ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কবিতাগুচ্ছ

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

গ্রন্থটির শিরোনাম ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পোয়েট্রি। এটি একটি ইংরেজি কবিতা-সংকলন। বিলেতে বসবাসরত ও বিলেতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত চোদ্দজন কবির ইংরেজি কবিতা ও কয়েকজনের বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। সম্পাদনা করেছেন শামীম আজাদ ও স্টিভেন ওয়াটস। ঠিক এ-ধরনের সংকলন প্রথম হলেও এটি অনেকটা নিভৃতেই ফেব্রুয়ারি ২০১৭-তে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়ে এখন অবধি আছে। আগামী প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করেছে। দেশে এর কোনো প্রকাশনা অনুষ্ঠান না হলেও গত মাসেই লন্ডনে কভেন্ট গার্ডেন পোয়েট্রি ক্যাফেতে হয়ে গেছে এর প্রথম প্রকাশনা ও প্রচার। এমন ধরনের কাজ এটি প্রথম বলে প্রশংসিতও হয়েছে।

ইংরেজি সাহিত্যে বাংলাদেশ বিষয় অত্যন্ত আগ্রহের ব্যাপার হলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কবি-সাহিত্যিকরা সে-আগ্রহ মেটাতে পারেননি। এ প্রায় ফাঁকা মাঠ। সে-ফাঁকে খেলে বেড়াচ্ছেন অন্যরা। গত কয়েক বছরের মধ্যে মনিকা আলী, জিয়া হায়দার রহমান এবং তাহমিমা আনামই কেবল আলোচনায় এসেছেন। তাঁদের তিনজনের ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় মজ্জাগত বলেই তাঁদের লেখা জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভাবলে অন্যায় হবে। তাঁদের প্রত্যেকেই লেখক হিসেবে যে-কোনো ভাষায়ই নিজ স্থান করে নেওয়ার যোগ্যতা নিয়েই আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের কাঁচামাল বাংলাদেশি বলে যারা সে-দেশটি সম্পর্কে আগ্রহী তারা এবং যারা শুধুই বাংলাদেশ-কাতর তারাও এর পাঠক। ফলে পাঠকপ্রিয়তা ও আগ্রহের একটি মূল কারণ বাংলাদেশের প্রতি কৌতূহল বলে ভেবে নিলেও নিতে পারি।

এ-অবস্থায় কবিতার ক্ষেত্রে আমরা ইংরেজিতে তেমন সুনাম অর্জন করেছি বলতে পারি না। আর একখানা বা কয়েকখানা কবিতা লিখলেও এমনকি আস্ত একটি কবিতার গ্রন্থ প্রকাশ করলেও সেভাবে লাইমলাইটে আসা কঠিন। ব্রিটেনে কবি হওয়া গেলেও কবি-পরিচিতি পাওয়া দুরূহ।

তাহলে কি ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কবি নেই। আছেন। কিন্তু তাঁরা দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে ওঠেননি এখনো। কবি হিসেবে তাঁরা চিহ্নিত হয়েছিলেন কিনা সেটাও কথা। কবি আছেন, বিলেতি-সংকলনে তাঁদের কবিতা ছাপা হচ্ছে; কিন্তু প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সত্যিই কম। এমন সময় আলোচ্য এ-সংকলনে চোদ্দজন ব্রিটিশ অভিবাসী বাংলাদেশি কবি এক পাত্রে উঠে এসেছেন, এ বড় আনন্দের কথা। সম্পাদনা করেছেন প্রখ্যাত ইংরেজ কবি ও অনুবাদক স্টিভেন ওয়াটস এবং বাংলাদেশি কবি ও অনুবাদক শামীম আজাদ।

এ-সংকলনে আছে মীর মাহফুজ আলী, আতাউর রহমান মিলাদ, সালাম জোন্স, ফরিদা মমতাজ, নজরুল ইসলাম নাজ, ফারাহ নাজ, তওহীদ শাকিল, সুমি ইসলাম, মিজানুর রহমান ও শামীম আজাদের ইংরেজি কবিতা এবং ইকবাল হোসেন বুলবুল, মিলটন রহমান, তানভীর রাতুলের বাংলা কবিতার অনুবাদ। সংকলনের ভূমিকায় সম্পাদকদ্বয় লিখেছেন, বইটিকে ব্রিটিশ অভিবাসী বাংলাদেশি কবিদের কবিতা নিয়ে পরিপূর্ণ একটি সংকলন করার চিন্তা ছিল। কিন্তু যে-কোনো সংকলনেই বাছাই করা এবং তা করতে গিয়ে কাউকে বাদ দেওয়া, কাউকে কাউকে একসঙ্গে করার বিষয়টা চলে আসে। তাই কোনো সংকলনেই আসলে সব লেখকের সমন্বয় হয় না। সংকলনে অনেক কবির মধ্য থেকে কিছু কবিকে বাছাই করা হয়েছে। আবার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কবি বাদ পড়ে গেছেন। তাই মনে হয়, পরীক্ষামূলকভাবেই সংকলনটি প্রকাশ হয়েছে। তবে এতে ব্রিটিশ অভিবাসী বাংলাদেশি কবিদের লেখার প্রতি পাঠকদের আরো আগ্রহ জাগাবে, এবং পাঠক ও কবিদের মধ্যে একটা আনন্দঘন মেলবন্ধন তৈরি হবে তা নিশ্চিত। সেইসঙ্গে সংকলনটি যুক্তরাজ্যের পাঠকের হাতে তুলে দিলে নিশ্চয়ই অনেকে পাঠক থেকে কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন। একটা ভিন্নরকমের বৈশ্বিক অস্থিরতায় মানুষ যেখানে সৃষ্টিশীলতা ভুলতে বসেছে তখন পাঠকের হাতে কবিতা তুলে দিয়ে কবি হওয়ার স্বপ্ন বুনে দেওয়াটাও এই সংকলনের উদ্দেশ্য হতে পারে।

বিষয়-বৈচিত্র্যে ভরপুর এই সংকলনে যেমন প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত কবির কবিতা আছে, তেমনি ভালোবাসায় স্থান পেয়েছে তরুণ ও স্বল্পপরিচিত কবিদের লেখা কবিতা। এখানে চার নারী আর দশজন পুরুষের কবিতা স্থান পেয়েছে। নারী-পুরুষ কবির এই ভারসাম্য ঠিক সমানুপাতিক না বলেই হয়তো যুক্তরাজ্যে অভিবাসী লেখকদের একটা বাস্তবতা প্রকাশ পায়।

বাংলা ভাষায় লেখেন এমন পাঁচজন সমসাময়িক কবির কবিতা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ইংরেজিতে অনূদিত। অনুবাদ আসলেই কবিতাকে সবার সম্মুখে নিয়ে আসে আর ভালো অনুবাদ হলে তো আরো যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে, আঞ্চলিক ও সর্বজনীন রূপ ধরে, বাংলা ও ইংরেজি ভাষার কবিতার আঙ্গিক ঠিক রেখে কবিতার প্রকাশ একমাত্র অনুবাদ শিল্পের দ্বারাই সম্ভব। লক্ষ করেছি, বাংলা অনুবাদের ব্যাপারে যেখানে দু-ভাষার দুই কবি একত্রে কাজ করেছেন সে-কবিতা হয়ে উঠেছে ইংরেজি কবিতার সমতুল্য। কে অনুবাদ করছেন সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও বটে।

যে-সময়ে বাংলাদেশে কবিদের কলম বিপন্ন, ঠিক সে-সময়ে নতুন ধারার এই সংকলনে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কবিদের আওয়াজ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁরা যেমন বাংলাদেশকে ঘিরে ধরে তাঁদের সংহতি, রোমন্থিত স্মৃতি আর নানা যন্ত্রণা তুরে ধরেছেন, তেমনি যুক্তরাজ্যের যাপিত জীবনের জটিলতা, আর প্রায়শই বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরা হয়েছে। বিষয়বস্তুতে স্থান পেয়েছে সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিগত আবেগগাথা, অভিনয়ধর্মী কবিতা এবং সমাজ বদলে দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত কবিতা।

এই সংকলনটি ব্রিটিশ অভিবাসী বাংলাদেশি কবিদের সঙ্গে বাংলাদেশের কবিদের, এমনকি ব্রিটিশ কবিদের সঙ্গেও এক সুদূরপ্রসারী মেলবন্ধন সৃষ্টি করবে। বইটি তাদেরই জয়গাথা – যাঁরা তাঁদের ঘর ভিনদেশের মাটিতে গড়েছেন। এই সংকলন কবিদের মধ্যে নতুন পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটাবে এবং যুক্তরাজ্য আর বাংলাদেশের মাঝে খুলে দেবে যোগাযোগের নতুন দ্বার, যা কবিতার চিরাচরিত প্রয়াস। মূলত কবি শামীম আজাদের সুকুমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন হচ্ছে এই সংকলন। শামীম আজাদ কেবল কবিই নন; একই সঙ্গে তিনি কথাশিল্পী ও গল্পকথক। তিনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখছেন তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অভিবাসী লেখক, সেহেতু তাঁকে ডায়াস্পোরা লেখকও বলা যায়। আশা করি, এই সংকলন ব্রিটিশ অভিবাসী বাংলাদেশি কবিদের কবিতার প্রথম পদচারণা হিসেবে ভবিষ্যতে আরো অনেক কবির জন্য দ্বার খুলে দেবে এবং আরো অনেক সংকলন বেরোবে, আরো অনেক কবির লেখা আমরা পাব এই ব্রিটিশ-বাংলাদেশি জনপদের মধ্যে, এই যুক্তরাজ্যে।