তোর বহুত ভুখ, তাই না রে বউ?

জাবেদ আলি পাশে শুয়ে থাকা কমলার  তপ্ত পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো। প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না কমলা, তারপর বালিশ থেকে মাথা তুলে জাবেদ আলির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়লো।

দুপুর পর্যন্ত চালকলে কাজ করে খুব ক্লান্ত। তার ওপর ফিরে এসে জাবেদ আলিকে গোসল করিয়ে খাইয়ে একটু বিশ্রাম করলো কি করলো না, ছুটতে হয় আশেপাশের বাড়িগুলিতে। মাটির ঘর লেপে দিতে হয়, নাহলে কারো ঢেঁকিতে চাল কুটে দিতে হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে দুজনের খাওয়া-পরা আর জাবেদ আলির ওষুধের খরচ চালাতে হয়। খুব কষ্ট করেই চালিয়ে নিচ্ছে।

জাবেদ আলি চিনিকল শ্রমিক। কমলা ওদের পাশের বাড়ির মেয়ে। ছোটবেলা থেকে দুজন দুজনকে দেখে বড় হয়েছে। জাবেদ আলি যেন জানতো, কমলাই ওর বউ হবে। সেই ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখেশুনে রাখতো। কমলা যখন পুকুরে নামতো, জাবেদ আলি ছিপ নিয়ে ঘাটের পাশে বসে থাকতো, স্কুলে গেলে জাবেদ আলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কখনো কমলা সম্পর্কে কিছু বলে পার পায়নি। তার হাতে দু-চার ঘা খেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।

কমলাও তেমন, বড় হতে হতে বাবা-মায়ের সঙ্গে জাবেদ আলিকে নিজের অভিভাবক ভাবতে শুরু করেছে। যখন ওর বিয়ের কথা চলছে, জাবেদ আলি বরপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, হুনেন, কমলার লগে আমার বিয়া অইবো, আপনেরা ভুল জাগাত সম্বন্ধ নিয়া আসছেন।

ওরা যারপরনাই অপমানিত হয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় কমলার বাবাকে বেশ কিছু কটু কথাও শুনিয়ে দিতে ছাড়লো না। কবির মুন্সী রেগেমেগে বললেন, –       হোন জাবেইদ্যা, তুই যহন আমার মেয়ার বিয়া ভাঙছোস, আইজই তর বিয়া করন লাগব, নইলে কহনো অইবো না।

জাবেদ আলি যেন এ অপেক্ষাতেই ছিল।

সঙ্গে সঙ্গে ওর ইয়ার বন্ধুরা মসজিদ থেকে মাওলানা ডেকে আনলো। দুপুরের মধ্যে বিয়ের কাজ শেষ করে জাবেদ আলি কমলাকে নিয়ে নিজের বাড়ি চলে এলো।

বাড়িতে জাবেদ আলির বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। মা-ছেলের সংসারে কমলা এলো নতুন সদস্য হয়ে। জাবেদ আলির মা কমলাকে বউ হিসেবে পেয়ে যেমন খুশি হলেন না, তেমনি অখুশির ভাবটাও লুকানোর চেষ্টা করলেন না।

তাতে কমলা বা জাবেদ আলির কিছু যায়-আসে না। তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। রাত কাটে ভালোবাসার উষ্ণতায়, দিনভর জোড়া কবুতরের মতো নিজেদের মধ্যেই মশগুল থাকে।

কমলার বাবা-মা দূর থেকে তাদের সুখের আঁচ পান। মাঝেমধ্যে কলাটা-মুলোটা মেয়ের বাড়ি পাঠান।

তবে জাবেদ আলির মায়ের নজর বড় যৌতুকের দিকে। কমলার বাবা কবির মুন্সী যৌতুকের ধারেকাছেও যেতে রাজি নন। কমলার মায়ের খুব ইচ্ছা, মেয়ের জন্য একটা কিছু করা। কবির মুন্সীকে অনেক বুঝিয়ে জাবেদ আলির চাকরির ব্যবস্থা করলেন। সুগার মিলে মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ পেল। কমলা খুব খুশি।

ওদের সংসার-তরী তরতর করে চলছে সুখের নদীতে।

দেখতে দেখতে বিয়ের বয়স পাঁচ বছর হয়ে গেল। আশপাশের লোকজন কানাকানি শুরু করলো। কমলা পুকুরঘাটে গেলে অন্য বাড়ির বউরা ঘাট থেকে সরে যায়। কোনো শুভ অনুষ্ঠানে তাকে ডাকে না।

জাবেদ আলির মাও কেমন যেন খোঁচা দিয়ে কথা বলেন। শুনতে শুনতে কমলা ক্লান্ত, তবে জাবেদ আলির ভালোবাসা তাকে উজ্জীবিত রেখেছে।

তারা নিজেদের নিয়ে এতো মশগুল যে এসব বিষয়ে কিছু ভাবেই না। তাদের যে কোনো সন্তান নেই, এ-কথা মনেও নেই।

জাবেদ আলি মিলের কাজ শেষ করে ফিরে বাড়ি আর কোথাও যায় না। কমলার সঙ্গে সুখে সময় কাটায়। প্রতিদিন একই সময় ফিরে আসে।

একদিন জাবেদ আলি আর আসে না। কমলা তেলের পিঠা বানিয়ে অপেক্ষা করছে। এ-পিঠা সে গরম গরম খেতেই ভালোবাসে। কমলা একবার ঘরে যায় আর একবার বাইরে আসে।

আজ টিনের চালে বেশ কয়েকটা অনাহূত কাক ডাকাডাকি করেছে। কমলার শাশুড়ি বারবার কাক তাড়িয়ে বিরক্ত, পরে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে কমলাকে খোঁচা দিয়েও শান্তি পাচ্ছেন না।

শেষে গলা ছেড়ে কান্না জুড়ে দিলেন।

কান্নাকাটির ভেতরে জাবেদ আলির অফিস থেকে কয়েকজন লোক এলো একটা দুঃসংবাদ নিয়ে। সকালে আখের মেশিন চালাতেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে। জাবেদ আলি হাসপাতালে। মা আর বউকে নিতে এসেছে।

কমলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।

কাঁদতে কাঁদতে মা আর বউ হাসপাতালে এলো। শুরু হলো কমলার যুদ্ধ। জাবেদ আলির মা কয়েকদিন বউয়ের সঙ্গে হাসপাতাল-বাড়ি যাতায়াত করে অসুস্থ হয়ে মেয়ের বাড়ি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় কমলাকে শাপশাপান্ত করে গেলেন।

মাসেকখানেক পরে জাবেদ আলিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো কমলা। এই ফেরা খুব কঠিন হয়ে গেল ওদের দুজনের জন্য। জাবেদ আলি প্রাণে বেঁচে গেলেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল। কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ। চাকরিও চলে গেল। চিনিকল কর্তৃপক্ষ যা দিলো তাতে চিকিৎসার খরচও হয়নি। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ধারদেনা করে, পোষা গরু-ছাগল বিক্রি করে অর্ধমানুষটিকে ফিরিয়ে আনলো ঠিকই কমলা, এখন বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু হলো। এ-যুদ্ধ ভাতের যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে হেরে যাওয়াও যায় না। বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে হয়।  কমলা এখন বাঁচার যুদ্ধের অগ্রগামী সৈনিক।

জাবেদ আলিকে বাড়িতে রেখে প্রতিদিন কাজ করে। কত ধরনের কাজ যে সে করে, তার ঠিক নেই। যেখানে এক থালা ভাতের নিশ্চয়তা পায় সেখানেই শ্রম বিক্রি করে আসে।

জাবেদ আলির কোমরের নিচটা অবশ হয়ে গেছে, সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে, মাঝেমধ্যে হেলান দিয়ে বসে, বাইরে যাওয়ার সময় কমলা তাকে দাওয়ার কাছে বসিয়ে দিয়ে যায়।

রাতে কমলার পাশে শুয়ে ওর দেহের আগুনের আঁচ পায়, কিন্তু সে-আগুনে দাহ্য হওয়ার ক্ষমতা যে নেই ওর। বালিশে মুখ গুঁজে কমলা কাঁদে, প্রতিদিন পেটের ক্ষুধার সঙ্গে দেহের ক্ষুধাও তাকে বিদীর্ণ করে।

জাবেদ বুঝতে পারে কিন্তু অক্ষম দীর্ঘশ^াস ছাড়া আর কিছুই যে নেই তার। জাবেদ আলির পৃথিবীও সীমিত হয়ে গেছে।

প্রথম প্রথম বন্ধুরা এসে গল্প করে যেত। ধীরে ধীরে আসা কমতে লাগলো। একে একে বন্ধুবান্ধব সবাই সরে গেল।

 কিন্তু শুরু থেকেই জাবেদ আলির ছোটবেলার বন্ধু সামির আলি সঙ্গে আছে। বিপদে-আপদে সাধ্যমতো সাহায্য করে।

তার নিজের তো সংসার নেই। অনেক ভাইবোনের বড় ভাই। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। ছোট ভাইবোনদের ‘ছিটে দিলে খুঁটে খাওয়ার’ অবস্থানে নিতে নিতে নিজের বিয়ের কথা ভুলে গেছে। বোনদের বিয়ে হলো, ভাইয়েরা পালক-গজানো পায়রার মতো উড়াল দিলো। এর মধ্যে মা মারা গেছেন। বিয়ের কথা বলারও কেউ নেই। জাবেদ আলির সঙ্গে সময় ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কমলার সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। এর মধ্যে ওদের বড় বিপদ ঘটে গেল। সামির আলি সারাক্ষণ তাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে।

তবে তারও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সবসময় টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারে না। কিন্তু যখন যেখানে দরকার সঙ্গে থাকে। তারা তাতেই খুশি।

কমলা এখন ধানকলে কাজ করে, দিন শেষে বেশ কিছু টাকা আর আঁচলে কিছু খুদ বেঁধে নিয়ে আসে। যেদিন চাল থাকে না, খুদের জাউ রান্না করে খেয়ে নেয়।

হঠাৎ করে চৌকিদার মাইকে বলে গেল, ঝড় আসতে পারে। সবাই যেন সাইক্লোন শেল্টারে চলে যায়। কয়েকবার করে বলে গেছে, কিন্তু কমলা গেল না। পঙ্গু মানুষটাকে নিয়ে কীভাবে যাবে? জাবেদ আলিকে নাড়ানো কঠিন। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে তারা বাড়িতেই থেকে গেল। সারারাত ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে ওদের টিনের বাড়িটা বেঁচে গেল। সকালে কমলা বেশ খুশিমনে বাইরে এলো।

কিন্তু এ কী দেখছে সে? চারপাশটা তো চেনাই যাচ্ছে না। গ্রামটা চেনাই যাচ্ছে না। যেদিকে চোখ যায় সব গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। কোথাও কোথাও টিনের চাল উড়ে গেছে। কমলার চোখ ছানাবড়া। এতো ভাঙচুর হয়েছে যে, পা রাখতে হচ্ছে সাবধানে। ওদের রান্নাঘরের ছন উড়ে গেছে।

জাবেদ আলি জেগে গেছে। কমলাকে ডেকে খাবার চাইলো।

খুদের পাতিলে হাত দিয়ে দেখে এখনো দু-মুঠো খুদ আছে। ঢিলা করে রান্না করলে জাভেদ আলির পেট ভরে যাবে।

কমলা চিন্তিত মুখে ভাঙা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে থকথকে কাদা – এখানে কখনো রান্না হতো, তা বোঝার উপায় নেই। কমলা ওদের শোয়ার ঘরের একপাশে তোলা খড়ির চুলাতে খুদটুকু বসিয়ে দিলো।

তারপর যতটুকু সম্ভব উঠানটা পরিষ্কার করলো। 

জাবেদ আলিকে খাইয়ে কমলা বের হয়ে গেল। যেতে যেতে ভাবছে, কে জানে ধানকলের কী অবস্থা।

কিছুদূর যেতেই পশ্চিম পাড়ার কুতুবের মা তার সঙ্গী হলো। বিধবা কুতুবের মা অনেকদিন থেকে সামাদ আলির ধানকলে কাজ করে। কমলাকে বললো, – যাইতাছি তো, আল্লাহ মালুম কাম অইবো কি না, ঝড়বাদলার দিনে মালিক কল বন্ধ রাহে।

কথাট শুনে কমলা চিন্তিত হলো, রাতে খাবার মতোও কিছু নেই। কী করবে বুঝতে পারছে না।

কুতুবের মায়ের কথাই ঠিক। মালিক ওদের দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলো। বললো, –   ঝড়বাদলার দিনে মানুষ বাঁচে না আর তরা আইছস কাম খুঁইজতে? অহন যা, রইদ উইডলে আইছ, যত্তোসব।

কমলা ভাবছে, ঘরে কোনো খাবার নেই। রাতে জাবেদের সামনে কী দেবে? তখন থেকে ঘরে বসে আছে মানুষটা শুধু খাবারের অপেক্ষা করে। যা দেয় চেটেপুটে খায়। থালা হাতে বসে থাকে, মনে হয়, যেন আর একটু পেলে ভালো হতো। তখন কমলা নিজের থালা থেকে খাবার তুলে দিয়ে দেয়। এমনভাবে দেয় যেন জাবেদ না বোঝে, সে নিজের অংশ থেকে দিয়েছে।

যে মানুষটা ক্ষিধে সহ্য করতে পারে না, একবারেই না খেয়ে কীভাবে থাকবে?

ভাবতে ভাবতে সামির আলির বাড়ির দিকে চললো। কিছু টাকা যদি ধার পাওয়া যায় তাহলে চাল আর ওষুধ কেনা যাবে।

সামির আলি বাড়িতেই ছিল। কমলার ডাকে বের হয়ে এলো।

–         ভাউজ, কী মনে কইরা? বাড়িত বেতরে চলেন।

–         অহনই যামুগা, একখান কথা আছিল।

–         কন না, হুনি।

–         ঘরত ট্যাহা নাই, অসুদ কিনন লাগবো। কয়ডা ট্যাহা দিবেন? চাইলের কল খুইল্লে দিয়া দিমু।

–         বাড়ির বেতরে আহেন। বাইরা খাড়াইয়া কী কথা?

কমলা সামির আলির পেছন পেছন বাড়ির ভেতর এলো।

কাঁঠাল কাঠের খাটে বসে আঁচলটা মাথার ওপর টেনে বললো,

–         দ্যাহেন বাই, আমি ভুখা থাকবার পারি, কিন্তুক মানুষটা তো ভুখ সইহ্য করবার পারে না।

–         আপনেরে কইছে কেডা ভুখ সইয্য করইতে?

–         কেউ কয় নাই, তয় খাওন না থাইকলে ভুখা থাহন লাগে।

সামির আলি কমলার পায়ের কাছে বসে পড়লো, দু-হাত ওর হাঁটুর ওপর রেখে ভিখিরির মতো বলে উঠলো,

–         ভাউজ, আপনের মতো আমিও ভুখা। জাবেইদ্যা, আপনে, আমি হগলেই ভুখা, আমরা হগলে হগলের ভুখ মিডাইতে পারি না?

–         এইডা কী কইলেন সামির বাই?

–         ভাউজ, আপনে আমার ভুখ মিডান, কথা দিলাম, হারাজীবন আমি জাবেইদ্যা আর আপনের ভুখ মিডামু।

–         আমারে যাইতে দ্যান।

–         হাঁচা কইরা কন, আমার লাহান আপনেও কি ভুখা না, যদি কথাডা হাঁচা অয়, আমার  জ্বালাডা বোঝেন। ভাউজ, আমার ভুখ মিডাইয়া দ্যান।

কমলা বের হয়ে যেতে যেতে মনে পড়লো, মানুষটার ওষুধ কিনতে হবে, রাতের খাবারও নেই।

চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো কমলা।

তারপর দরজাটা বন্ধ করে সামির আলির দিকে ফিরলো।