ভ্রমণকথা বয়ানের ভিন্ন মাত্রা

রফিকউল্লাহ খান

শাকুর মজিদের দুটি বই
অবসর
ঢাকা, ২০১২
ভ্রমণ করে, পৃথিবীতে এমন লোকের অভাব নেই। কিন্তু প্রকৃত ভ্রমণকাহিনির অনেক অভাব। প্রকৃত ভ্রমণকাহিনিতে লেখকের বস্ত্ত-অভিজ্ঞতার সূত্রে পাঠকের কাছে উন্মোচিত হতে পারে বিশ্বজগতের নতুন-নতুন বিষয়-অভিজ্ঞতার দ্বার। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ভ্রমণকারী মন/ ভ্রমণ করার তীর্থ তাহার আপন ঘরের কোণ।’ আমার তো মনে হয় ঘরের কোণের এই ভ্রমণসাধনাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারে ভ্রমণকাহিনি। রবীন্দ্রচেতনায় ওই ভ্রমণের অর্থ হয়তো ভিন্ন, কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভ্রমণপিপাসা পরিতৃপ্ত করার অবলম্বন হতে পারে কৌতূহলী, সচেতন ও সংবেদনশীল লেখকের ভ্রমণকথা। ভ্রমণকাহিনি এমন একধরনের গদ্য-আখ্যান, যা থেকে উপন্যাসপাঠের আনন্দও পেয়ে যেতে পারেন পাঠক। কিন্তু উপন্যাসে জীবনের বস্ত্তসত্য এবং অভিজ্ঞতার অবিকল রূপ অভিব্যক্ত হয় না। ভ্রমণকথার মূলনীতি হওয়া উচিত ঘটনা ও বর্ণনার বস্ত্তনিষ্ঠা ও সততা।
ভ্রমণ কারো কাছে পেশা হতে পারে, আবার কারো কাছে পেশা ও নেশা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু ভ্রমণকথা রচনা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না, আবার অনেক ভ্রমণকাহিনি অভিজ্ঞতার যথাযথ বৈশিষ্ট্য, কৌতূহলের ধাঁচের ওপর নির্ভর করে তার ভ্রমণবৃত্তান্তের চরিত্র। যাত্রীতে রবীন্দ্রনাথ বিচিত্র দেশ ও সংস্কৃতির যে-বর্ণনা আমাদের কাছে তুলে ধরেন, সেখানে কবির দর্শন, কথাশিল্পীর ব্যঞ্জনা এবং উপলব্ধির গভীর সত্য প্রকাশিত হয়েছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় দেখি অভিজ্ঞতার জগৎকে কৌতুক ও মমতার আশ্রয়ে তুলে ধরা। সময়ের বিবর্তনে, পাঠকরুচির অভাবনীয় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কোনো দেশ ও জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রগতির ভ্রমণকথার জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
শাকুর মজিদের দুটি ভ্রমণকথা সুলতানের শহর ও লেস ওয়ালেসার দেশে পাঠ করতে গিয়েই ওপরের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ‘পেশায় স্থপতি নেশায় অনেক কিছু’ – তাঁর জীবনপাঠ সূত্রে একথা জানা যায়। নাটক লেখেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সংগীত ও সংস্কৃতির ওপর পরীক্ষামূলক কাজ করেন। কিন্তু তাঁর আগ্রহের বড় জায়গা হলো ভ্রমণ। এই বিশ্বজগৎটাকেই তিনি মনে করেন বিশাল একটি গ্রন্থ। কিন্তু সেই গ্রন্থের রূপ বিচিত্র, প্রকৃতি ভিন্ন-ভিন্ন। শাকুর মজিদ পৃথিবীর ৩০টিরও অধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং সেই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা ও ছবির মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ভ্রমণের নেশার সঙ্গে ছবি তোলার নেশা তাঁর ভ্রমণকথার বাস্তব পটকে অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ও সত্যনিষ্ঠ করেছে। আর সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থপতির কারুদৃষ্টি। আলোচিত বইয়ের পটভূমি ও সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও এই কারুদৃষ্টি লেখকের পর্যবেক্ষণ ও রূপ-নির্মাণের নিজত্ব ও মৌলিকতাকে চিহ্নিত করে। চোখ দিয়ে দেখা আর মন দিয়ে পড়া – জীবন ও জগৎ-উপলব্ধির ক্ষেত্রে এ-সত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
‘পড়া’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে পাঠ হিসেবে গ্রহণ করতে চাই। একজন কবি যেভাবে প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের সৃষ্টি দেখেন, একজন বিজ্ঞানী কিংবা স্থপতি সেভাবে দেখেন না। পঠন-অভিজ্ঞতা ও পঠন-প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়েই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভাষ্য তৈরি করেন তাঁরা। প্রয়োজনীয় ইতিহাস-ভৌগোলিক জ্ঞান না থাকলে কোনো দেশ ও তার সংস্কৃতির অনেক কিছুই যে অস্পষ্ট থেকে যায়, মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর অনেক ভ্রমণকথায়ও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শাকুর মজিদ তাঁর ভ্রমণভাষ্যে ভ্রমণ-বিশ্বের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পূর্ণতাকেই সন্ধান করেন। সেইসঙ্গে বিজ্ঞান ও রাজনীতির বিবর্তনধারায় তাঁর অবস্থান শনাক্ত করেন। ভূমিকায় লেখক বলেন, ‘এশিয়া ও ইউরোপ মিলে গড়ে ওঠা যে শহরকে ওসমানি শাসকেরা প্রায় ছয়শ বছর ধরে লালন করেছিল, সেখান থেকে গোটা পৃথিবীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ দেশ এবং প্রায় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব শাসিত হয়েছিল, সেই ইস্তাম্বুল নিয়েই এই গ্রন্থ সুলতানের শহর।’ এভাবেই সমগ্র ইতিহাসের ধারণার সূত্র ধরে লেখক তাঁর ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণকথার জগতে প্রবেশ করেন। ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইস্তাম্বুল শহরের বিবর্তনের ধারাক্রম এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তার যে-রূপ ও সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য তা অনুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন। সুলতান আহমেদ চত্বর থেকে তাঁর ভ্রমণকথার যাত্রা শুরু হয়, তারপর অটোমান সাম্রাজ্য, বাইজেনটাইনের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, টপক্যাপির হারেম, সুলতানের বাজার প্রভৃতি অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ করেন। বর্তমান ইউরোপের সমাজ-বাস্তবতার ইস্তাম্বুলের নারীরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোন স্তরে পৌঁছে গেছেন তারও বর্ণনা পাওয়া যাবে শাকুর মজিদের ভ্রমণকথায়। পাশ্চাত্য এবং মুসলিম সংস্কৃতির মিশেলে তুরস্কের মেয়েরা যে মিশ্র সংস্কৃতিকে ধারণ করে তার প্রকাশ আমরা লক্ষ করি এক তুর্কি নারীর উচ্চারণে – ‘আমরা মুসলিম, আমরা ইউরোপিয়ান।’
হাজার বছরের ভাঙাগড়ার ইতিহাসের পাঠ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে কামাল আতাতুর্কের বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক সংস্কার মুসলিম বিশ্বে তুরস্ককে এক নতুন চেতনার রাষ্ট্রে উন্নীত করে। শাকুর মজিদ বর্তমানকে নতুনভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনেই এই ভ্রমণবর্ণনাকে এক ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যান। আমরা জানি, শাকুর মজিদ এক স্থপতি। তাঁর অভিজ্ঞতার পাঠ যে শুধু স্থাপত্যকলার অনুপুঙ্খ অনুসন্ধানে পর্যবসিত হতে পারে সুলতানের শহর মূলত তারই প্রামাণ্য দলিল।
অভিজ্ঞতা পৃথিবীর বহু মানুষেরই থাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতাই শিল্প নয়, অভিজ্ঞতাকে শিল্প হয়ে উঠতে অভিজ্ঞতা ও চেতনার রসায়ন প্রয়োজন। পৃথিবীর লক্ষ-কোটি মানুষ প্রতিদিন অজানা জগৎ ভ্রমণ করে। কিন্তু তার কোনো শিল্পসাক্ষ্য আমরা দেখি না। যিনি বাইরের চোখ ও মানসদৃষ্টিকে অভিন্ন বোধের কেন্দ্রে স্থাপন করতে পারেন, তিনিই রচনা করতে পারেন ভ্রমণশিল্প। শাকুর মজিদ তাঁর ভ্রমণকথায় বাইরের চোখ ও মানসদৃষ্টির সঙ্গে মিলিয়ে নেন নিজের পাঠ-অভিজ্ঞতার বিস্তৃত পরিসর। যে-কারণে তাঁর ভ্রমণকথা যেন কোন ‘কাহিনি’ থাকে না, শিল্প হয়ে ওঠে। ইস্তাম্বুল শহরের প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের মধ্যে ঐতিহ্যপরম্পরা ও আধুনিকতার মিশেলে গড়ে ওঠা এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই আমরা। আমার কাছে যে-বিষয়টি সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে, তা হলো, প্রতিটি স্থাপনার ইতিহাসসূত্রও শাকুর মজিদ একজন গবেষকের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেন তাঁর গ্রন্থে। লেখকের স্থাপত্য দর্শনের প্রকৃতি তাঁর এ-বিষয়ক ধারণার সীমাকেই প্রকাশ করছে। তাঁর বর্ণনাভঙ্গির একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক –
হাজীয়া সোফিয়ার ভেতরটি এখনও জাঁকজমকের সমাজ। প্রায় এক হাজার বছর ধরে (১৫৫২ সাল পর্যন্ত) এই স্থাপনাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গম্বুজবিশিষ্ট বেসিলিকার মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই স্থাপনাটি এমনিতেই এক স্থাপত্যিক বিস্ময়। ভেতরের গম্বুজটি ৫৫ মিটার উঁচু, ৭০ মিটার প্রশস্ত। নিচের দিক থেকে তাকালে মনে হবে ছাতার মত কতগুলো রিব তার অবয়বকে ধরে রেখেছে। দেয়ালের গায়ে কারুকাজ। ক্রুশবিদ্ধ যিশু, মেরি, আরো কত বেবিলনীয় চরিত্র। (সুলতানের শহর)
শাকুর মজিদের লেস ওয়ালেসার দেশে অভিজ্ঞতা ও মুগ্ধতাভরা পর্যবেক্ষণের অপর নাম। তবে লেখকের এই মুগ্ধতার পেছনে কারণ রয়েছে অনেক। রাজনীতি থেকে শুরু করে বিশ শতকী ইতিহাসের অনেক কিছু স্থান করে নিয়েছে। আমার কাছে পোল্যান্ড অপার বিস্ময়ের একটি দেশ। এই দেশের গণ-অভিরুচি কীভাবে পুরো পূর্ব-ইউরোপের রাজনীতির চেহারা পালটে দিলো, তা নিঃসন্দেহে গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। লেস ওয়ালেসা একজন বড় মাপের বিপ্লবী নিঃসন্দেহে, যাঁর দ্রোহী স্বভাব পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত সমাজ রাষ্ট্রিক ধারার পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ওয়ালেসার নেতৃত্বে ১৯৮৯ সালে সমাজতন্ত্রের বলয়মুক্ত হওয়ার পর দুই দশকে দেশটির পুঁজিবাদী অগ্রযাত্রাকেই নির্মোহভাবে দেখতে চেয়েছেন শাকুর মজিদ। ফলে বইটি নিছক ভ্রমণকথা না হয়ে পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের দলিল হয়ে উঠেছে।
গ্রন্থটির প্রতিটি পর্যবেক্ষণেরই একটি শিরোনাম আছে – যেমন, প্রথম পর্যবেক্ষণের নাম; ‘গিদাইনস্ক : লেস ওয়ালেসার নগরী’। এখানেই শুরু নয়, পরে থাকে একটি কাব্যিক উপশিরোনাম : ‘সেই বন্দর’। এই প্রক্রিয়ায় বিন্যস্ত হতে থাকে ‘বাল্টিক তীরের বিকেল’, ‘সপোত : পোল্যান্ডের স্পা নগরী’, ‘গিদাইনস্কের রাজবাড়ি’, ‘লেস ওয়ালেসার সাথে এক ঘণ্টা’ প্রভৃতি উপ-শিরোনাম। দৃশ্যনির্মাণ ও নাটকীয়তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে শাকুর মজিদের প্রতিটি পর্যবেক্ষণ। একটি বর্ণনা –
ওয়ালেসা সাহেব সবে এসেছেন তাঁর অফিসে, সেক্রেটারির রুমে দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। আমাদের নিয়ে এক সাথেই ঢুকলেন কামরায়। খুব সাধারণ মানের একটি কাঠের টেবিল, সামনে ৫-৬শ টাকার সস্তা চেয়ারের এক পাশে ফুলদানিতে তাজা ফুল, আর দূরের দেয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর একটা ছবি। এই হলো প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বর্তমান অফিস।
আরেকটি পর্যবেক্ষণের নাম ‘তরুণ : কোপার্নিকের শহর’, উপ-শিরোনামগুলো এরকম : ‘রোড টু তরুণ’, ‘মিকোলাই কোপার্নিক’, ‘কোপার্নিকের জন্মশহর’ প্রভৃতি। শাকুর মজিদের উপস্থাপন পদ্ধতি ও বিষয় নির্বাচন বইটিকে ওই দেশ ভ্রমণকারীদের জন্য পূর্বপাঠ্য করে তোলে। স্থপতি শাকুর মজিদ এ-গ্রন্থে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবিষ্কারের প্রতিই বেশি মনোনিবেশ করেন যেন।
ভ্রমণকথায় মানবেতিহাসের অনেক উপাদান থাকে। কিন্তু প্রত্যেক লেখকই স্বতন্ত্র হয়ে যান তাঁর জীবন প্রত্যক্ষণের দর্শনের কারণে। বাংলা ভাষার ভ্রমণকাহিনিগুলোতেও আমরা লক্ষ করব, প্রত্যেক লেখকের নেপথ্যে সক্রিয় এক অন্তরিত ‘ভ্রমণকারী মন’ শুধু বস্ত্তজগৎ নয়, লেখকসত্তার প্রতিফলনই ভ্রমণকথাকে করে তলে এক সম্পূর্ণ আখ্যান।
শাকুর মজিদের ভ্রমণ-আখ্যান আমরা পড়েছি। যেগুলো আমাদের অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করার সমান্তরালে আগ্রহী করে তোলে ওইসব ভ্রমণ বিশ্বের প্রতি। তাঁর ভ্রমণ-পিপাসা পাঠকচিত্তকেও আগ্রহী করে তোলে সেইসব জগতের প্রতি, যে-জগৎ বর্তমানের চলমানতায় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সমগ্র সত্তাকে অাঁকড়ে থাকে। 