মজা নদীর মানুষ

লু ঙ্গি পর্যন্ত খোলা পিঠটা চিকচিক করছে। ঘামের ওপর পড়ছে জ্যৈষ্ঠের রোদ। খালি গায়ে আছে কুদ্দুস। লুঙ্গিটা অবশ্য আঁটসাঁট করে বাঁধা। তার গিঁটের মতো কুদ্দুসের শরীরখানাতেও গিঁট পড়ে গেছে। যেভাবে নদীটা শুকিয়ে খোল পড়ে গেছে, তার শরীরটাও সেরকম একটা খোল। বিত্তির খিলের মতো হাড় বেরিয়ে এসেছে কবেই! এই হাড়গিলে শরীরটায় রোদ পড়লে বুকের বাতিগুলি স্পষ্ট দেখা যায়। কুদ্দুসের আগে ডাহুক চোখ ছিল। তখন নদীতে জল ছিল। সে-জলে স্রোত ছিল। এখন সে-চোখজোড়া কোটরে ঢুকে গেছে! কুদ্দুস ছুকছুক করে তাকায়। অবশ্য কুদ্দুসের আগের মতো একখানা মোটা গোঁফ আছে। সে-গোঁফ পাতলা না হলেও পেকেছে। কাঁচাপাকা গোঁফখানি নিয়ে কুদ্দুসের অহংকারের শেষ নেই। সে নাকি মস্ত মরদ! তার গোঁফ আছে তো ইজ্জত আছে। অবশ্য দাড়ির কাছে দরিদ্র কুদ্দুস। একখানি চাপ দাড়ি রাখবে, লোকে ‘মুরুব্বি’ ‘মুরুব্বি’ বলবে তা আর হয়নি। দাড়ি রাখা সুন্নত। পরকালে হাশরের ময়দানে এই দাড়ি জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। জুমা মসজিদের ইমাম সে-কথা কবেই বলেছেন কুদ্দুসকে। কিন্তু সে-দাড়ি গজালে তো? তবুও সুন্নত ছাড়েনি কুদ্দুস।

থুঁতনির কাছে একঝাড় ধানের শেকড়ের মতো যে দাড়িগুলি বের হয়েছিল সেগুলিকেই সুন্নত বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে কুদ্দুস আর ভুল করেও ক্ষুর লাগায়নি। সেসব আর কতদিনের পুরনো? তখন নদীটায় কিছু কিছু জল ছিল। তিন কিংবা পাঁচ দিনের ঢল হলে কোমর অবধি জল জমত। আর ভাসান হলে তো রীতিমতো স্রোত বইত নদীতে। তখন নদীর সেই টলটলে জল কুদ্দুসের মনে খুশির উছল মারত। স্রোতটা যেন জমিনের নদীতে নয়, কুদ্দুসের শরীরের ভেতরের নদীতে বইত। তখন কুদ্দুস ভরসন্ধ্যায় নদীর পাড়ে বসে গাইত – ও নদী রে/ একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে …। পশ্চিমে সূর্য হেললে ফরিদাকে নিয়ে নৌকা ভাসাত। পশ্চিম দিগন্তের লাল-হলুদ রং যতটা না নদীর জলে এসে মিশত তার ঢের বেশি মিশত কুদ্দুসের মনে। সে-রং ফরিদাও মাখত। সে-রঙে মহুয়ার রসের মতো মাদকতা থাকত। কুদ্দুস রোমান্টিক হয়ে উঠত। হাত দিয়ে নদীর জল ছিটিয়ে দিত ফরিদার গায়ে। আর বলত, ‘এই নাও, প্রেম। ভালো করে মেখে নাও।’ ফরিদা তখন লজ্জায় ঢলে পড়ত। আর ছোঁয়াছুঁয়ি চোখে সে লাজুক প্রেম মিশিয়ে বলত, ‘আমি মাখতে পারি নে, তুমি মাখিয়ে দাও।’ কুদ্দুস তখন মশকরা করত, ‘এক ছিটেনিতেই পিরিত পেকে উঠছে দেখছি!’ ‘ধরে নাও। না হলে গলে যাবে।’ মুখে আঁচল টেনে বলত ফরিদা। কুদ্দুস এখন নদীর পাড়ে এলেই সেই বিকেলগুলিকে খোঁজে। আর না পেয়ে তার বুকটা হু-হু করে ওঠে। আজ সেজন্যে আসেনি কুদ্দুস। মিয়ার বাগানের হাটে গিয়েছিল। ভ্যাদভ্যাদে গরম পড়ায় গায়ের গেঞ্জিটা খুলে বকুলতলায় দু-দণ্ড জিরোচ্ছে। গেঞ্জিটাকে সাইকেলের রডে জড়িয়ে বেঁধেছে। সাইকেলটার রডে আরো একটা জিনিস বাঁধা আছে। সেটা হলো গামছা। সাইকেলটারও বয়স এক কুড়ি হয়ে গেল। অবশ্য সেই কুড়ি বছর আগের সাইকেলের রডগুলি ছাড়া প্রায় অন্য কিছুই নেই এখন। অনেকবার সেসবের বদল হয়েছে। শুধু বদল হয়নি কুদ্দুসের। মানুষ নাকি বদলানোর জীব। পরিস্থিতি বদলালে মানুষও বদলে যায়। কিন্তু কুদ্দুস বদলায়নি! বদল বলতে গেলে তার ওই গোঁফের রং, মুখের দাড়ি আর চোখের কোটরের গঠন। আর একটা জিনিস বদলেছে কুদ্দুসের; আগে নদীর ধারে এলে একখানা কুদ্দুস দেড়খানা হয়ে উঠত আর এখন আধখানা হয়ে যায়! এই করতে করতে কবে না নদীটা মজে যাওয়ার মতো কুদ্দুসও মজে যায়! চরা পড়েছে কবেই তার মনে। এখন শরীরটাও তিন মাথার হয়ে উঠছে! দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে কাঁদে কুদ্দুস। কুদ্দুসের সে-কান্না দেখে নদীটাও কাঁদে।

নদীটা মরতে বসেছে। একটু একটু করে বুজছে তার দেহ। ফাল্গুন মাস না আসতেই শুকিয়ে যায়। সে-শুকনো খোল নদীর বুকে তখন ঝোপঝাড় জন্মায়। মাথা তুলে ওঠে ঢোলকলমির ডগা। ঘাসে আচোট হয় পাড়। সেখানে গরু বেঁধে দিয়ে যায় গ্রামের মানুষ। এসব দেখে কুদ্দুস। আর আসমানের খোদার ওপর রাগ দেখায়, ‘তোমার এত জল, এই হাভাতে নদীটাকে এক আঁচল দিতে পারো না?’ মাঝেমধ্যে আসমানের খোদার মুনিশ ফেরেশতাদের ওপরেও অভিমান করে কুদ্দুস, বলে, ‘নদীর জান কবজ করতে কোন ফেরেশতা আসে গো? দেখতে পেলে তাকে ধরে রাখতাম।’ কুদ্দুসের সে কুফরি কথা শুনে জুমা মসজিদের ইমাম শেখ কাইতুল্লা ফতোয়া দিয়েছিলেন, ‘তোমার আস্পদ্দা তো কম নয় কুদ্দুস! আল্লাহর ফেরেশতাদের ধরে রাখার কথা বলো! তুমি জাহান্নামবাসী হবে। পাপে ঢেকে যাবে তোমার শরীর!’ কুদ্দুস তখন বিড়বিড় করে বলেছে, ‘ইমাম সাহেব, আপনি বলে বড় আলেম! তো দুয়া পড়ে ফুঁ দেন না? নদীটায় জল ভরে যাক।’ কুদ্দুসের সে-কথা শুনে বাঁদরের মতো তিড়িংবিড়িং করে উঠেছিলেন ইমাম কাইতুল্লা। মুখের সুন্নত দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসবে, কুদ্দুস। তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।’ গজব? গজব তো নেমে এসেছেই। তবে কুদ্দুসের একার ওপর নয়, তামাম গ্রামবাসীর ওপর। গোটা আব্দুলপুর গ্রামের মানুষের ওপর আল্লাহর গজব নেমে এসেছে। নদীটা মরলে গ্রামটাও মরে যাবে।

নদীটা মজার সঙ্গে সঙ্গে কুদ্দুসের সাত পিরির কাজটাও চলে গেছে! নদীটা ছিল পেটের ভাত আর পরনের কাপড় জোগানোর উৎস। ভরা বর্ষায়, নদীটা যখন তার বউ ফরিদার পোয়াতি পেটের মতো ফুলে থাকত, তখন মাছ ধরত কুদ্দুস। নদীতে জাল ফেলত। সে-জালে বড় বড় বোয়াল উঠত। রুই-কাতলায় ছেয়ে থাকত জাল। তখন কুদ্দুসের চোখ খুশিতে মাছের মতো খলবল করত। তখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেত কুদ্দুস। সারাদিন ডিঙি নৌকাটায় বসে থাকত। দূর থেকে দেখলে মনে হতো, ডিঙি নৌকায় একটা মানুষের মাথা বসে আছে! তখন আলকাতরা মাখা নৌকাটার মতো কুদ্দুসের চুলের রংও ছিল কালো কুচকুচে। শ্যামা গাখানিও তেল মেখে চুকচুক করত। নৌকাতেই রাখা থাকত সরষের তেল। কন্টোলের সাবান। সূর্যটা পশ্চিমে ঢললেই গায়ে তেল ডলে ‘চবাং’ করে নদীর জলে ডুব দিত কুদ্দুস। ‘ভুস’ ‘ভুস’ করে তিনবার ডুব দিত। একবার দুবারের ডুবে তো জলের মধ্যে ভুরভুরি কাটত কুদ্দুস। কেন এমন করে সে? জিজ্ঞেস করলে কুদ্দুস বলত, ‘নদীটার সঙ্গে দুটো কথা কই গো। বলি, আমি বেহেশতে গেলে তোমাকেও বেহেশতে নিয়ে যাব। তুমিই তো আমার ইহকালের রিজিক জোগাও? কোনো দোষ করে থাকলে আমাকে ধমক দিও, দু-থাপ্পড় মেরো; কিন্তু মজে যেও না।’ কুদ্দুসের সে-পাগলামির কথা নদীপাড়ের সব মানুষই জানে। সেজন্য সবাই কুদ্দুসকে ‘নদীর ফেরেশতা’ বলে। সে-ডাক শুনলে গর্বে বুকটা ভরে যায় কুদ্দুসের। চোখ খিলখিল করে ওঠে। কুদ্দুস এখন বুঝতে পারছে, সে ফেরেশতা তো নয়ই, কোনো ক্ষমতাবান মানুষও নয়। সে একটা লাশের কবরযাত্রী! হ্যাঁ, নদীটা এখন একটা লাশই তো? যে-নদীতে জল থাকে না, একটু একটু করে মজে, সে-নদী লাশ নয় তো কী? নদীটার দাফন হবে। আর সে-দাফনে মাটি দেবে কুদ্দুস! কুদ্দুস স্বপ্নেও ভাবেনি তার জীবদ্দশায় নদীটার ইন্তেকাল হবে! তার মৃত্যুর পরে নদীটার মৃত্যু হতে পারত? তাহলে এ-কষ্ট বুকে নিয়ে মরতে হতো না কুদ্দুসকে। নদীর মরণ দেখা মানুষ যে বড়ই গোনাহগার। বড়ই অভাগা।

অঘ্রান-পৌষ মাসে যখন নদীতে জল কমে আসত তখন বিত্তি পাততো কুদ্দুস। সেই বিত্তিতে ধরা পড়ত খচ্চা মাছ। সেসব ডেরকে পুঁটি, খলসে মাছ হাঁড়িতে করে মিয়ার বাগানের হাটে নিয়ে যেত কুদ্দুস। ‘মরা ভৈরবের মাছ’ শুনে খদ্দেররা ছেঁকে ধরত কুদ্দুসকে। দেখতে দেখতে হাঁড়ি ফাঁকা হয়ে যেত। তখন কুদ্দুসের চোখে-মুখে শালুক ফুলের হাসি। লুঙ্গির ঘুনসিতে বাঁধা বিড়ির প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরাত কুদ্দুস। ফুঁক ফুঁক করে সুখটান দিত। তখন মনে হতো, দুনিয়ায় তার চেয়ে সুখী মানুষ আর নেই! এখন বিড়ির মতোই পুড়ছে কুদ্দুস। শরীরটাও বিড়ির মতো দুমড়ানো-মুচড়ানো হয়ে গেছে! নদীটা মরার সঙ্গে সঙ্গে বংশের কাজটা তো গেছেই এখন শরীর থেকে রুহটা না চলে যায়!

একসময় নদীর পাড়ে বিঘেখানেক জমি ছিল কুদ্দুসদের। বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে চাষাবাদ করে আসছিল। বাপ বেঁচে থাকতেই সে-জমি ভট্টদের কব্জায় চলে গেছে। জমিটা ছিল খাস। বড় ভট্ট কথা দিয়েছিলেন, কুদ্দুসের নামে পাট্টা করে দেবেন। কিন্তু ছোট ভট্ট অর্থাৎ বিমল ভট্টের ছেলে জয়ন্ত নিজের নামে পাট্টা করে নিলেন! সে-শোকে কুদ্দুসের বাপ গিয়াস একদিন দুনিয়া ছাড়লেন! আর মরার আগে ছেলে কুদ্দুসকে বলে গেলেন, ‘নদীটাকে বুক দিয়ে আগলে রাখিস, কুদ্দুস। দেখবি পেটের ভাতের অভাব হবে না।’ নদী থাকলে তো নদীকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে? নদীটাই তো থাকছে না! কুদ্দুস মরার আগে নদীটাই মরে যাচ্ছে!

নদীটার নামের আগে ‘মরা’ বললেই রেগে যায় কুদ্দুস। অথচ ‘মরা ভৈরব’ – এটাই এখন নাম নদীটার। আগে ‘ছোট ভৈরব’ বলত। কুদ্দুস গজগজ করে বলে, ‘মানুষ মরার আগে তার নামের আগে ‘মরা’ বললে কেমন কষ্ট হবে? ইয়াসিনকে ‘মরা ইয়াসিন’ আব্বাসকে ‘মরা আব্বাস’ সাইফুলকে ‘মরা সাইফুল’ বললে কেমন রাগবে ওরা? লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে না? তো নদীটা না মরতেই তার নামের আগে ‘মরা’ বলা কেন?’ অথচ এটাই সত্য, নদীটা মরতে বসেছে। ওপার থেকে তার ডাক এসে গেছে। তেকোনা গ্রামের যেখানে ভৈরবের পেট থেকে উৎপন্ন হয়ে এসেছে নদীটা সেখানে অন্যদিকে বাঁক নিচ্ছে ভৈরব! চরা পড়ে যাচ্ছে মুখে। আর সে-চর দখল করে বাড়ি বানাচ্ছে রাক্ষুসে মানুষ! বাঁধ দিচ্ছে পাড়ে। সরকারও উদাসীন। সরকার বলছে, নদী নাকি তার আপন খেয়ালে চলে। কখন কোথায় দিক পাল্টাবে কেউ বলতে পারবে না। আর নদীর সেই দিকবদলকে জোর করে রুখাও যায় না। তাতে নদী ফুঁসে ওঠে। বন্যা ঘটায়। এমন আহামরি স্রোত বইত না নদীটায়। তবে তিরতির করে যখন বয়ে চলত তখন মনে হতো, নদীটা বেঁচে আছে। আর নদী বেঁচে আছে মানেই নদীর পাড়ের মানুষগুলিও বেঁচে আছে। কুদ্দুস সে তিরতিরে স্রোত দেখত চোখ ভরে। সেই হা-ঘরের মতো নদী দেখা দেখে ফরিদা কুদ্দুসকে ঠেস মারত, ‘তোমার নদী দেখেই যখন পেট ভরে যায় তখন ভাত খাও কেন?’ কুদ্দুস বউর সেকথা শুনে তার বিড়ি খাওয়া দাঁতগুলি বের করে খিলখিল করে হাসত। সেই দাঁত-ঠোঁট দেখে ফরিদা বলত, ‘যে তো দাঁত-ঠোঁটের ছিরি তার আবার বের করে হাসা!’ কুদ্দুস তখন বলত, ‘এই ঠোঁটই তো নদী আঁকে গো।’ কুদ্দুস ফরিদার সঙ্গে প্রেমের কথা বলত। কুদ্দুস তার বিড়িপোড়া ঠোঁট দিয়ে ফরিদার কোমল ঠোঁটে নদী আঁকে। সে-নদীতে জল থাকে। উছাল মারে মাছ। তারপর একসময় দুজনেই সে-নদীতে ভেসে যায়। গ্রামের নদীটা যত শুকিয়ে যাচ্ছে কুদ্দুস-ফরিদার ঠোঁটের সেই নদীটার তত উছাল বাড়ছে। সে তিরতিরে স্রোত এখন হু-হু করছে। প্রেমটা মরেনি। মরবেও না কোনোদিন। জীবনের এই দুটো নদীতেই বাঁধা কুদ্দুসের ইহকাল। কুদ্দুস ফরিদাকে বলে, ‘দুটো জিনিসের দিকে আজীবন তাকিয়ে থাকতে সাধ জাগে, যেন মনে হয় এই তাকানো যেন কোনোদিন শেষ না হয়, এক ‘নদী’ আর দুই ‘তুমি’।’ তখন ফরিদা মুখটা ভেংচে বলে, ‘মরদের ঢং!’ ফরিদা যতই মুখ ভেংচাক আসলে সে ভেতরে ভেতরে একটা সুখ পায়। ভাবে, মানুষটা তাকে কত ভালোবাসে!

সাইকেলের রড থেকে গামছাটাকে খুলে মুখ মুছল কুদ্দুস। ঘাড়-পিঠও মুছল। তারপর ঝাঁপিটায় হেলান দিয়ে ছায়ায় দাঁড়াল। কাওসারের পান-বিড়ির দোকান। দোকান না বলে ঢপ বলাই ভালো। হাট থেকে ফিরলেই এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় কুদ্দুস। পাঁচটা লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। সুখ-দুঃখের দুটো কথা হয়। আর সেসবের মাঝে বিড়িতে সুখটান দেয় কুদ্দুস। আজ কেবলই বিড়িটা ধরিয়েছে কুদ্দুস অমনি সালেমুদ্দি হাত ইশারা করে দেখাল জায়গাটা। জায়গাটার দিকে চোখ পড়তেই খুঁটল চোখগুলি ডাহুক হয়ে বেরিয়ে এলো! ঠোঁটের ডগায় এসে জমল খিস্তি, ‘বাহিঞ্চত মাটিখোররা।’ ঝনঝনে রোদে ফিরফিরে হাওয়ার মধ্য দিয়ে দৃষ্টি ফেলে যতটুকু বুঝতে পারল কুদ্দুস তাতে বোঝা যাচ্ছে, পাঁচখানা ট্রাক্টর নেমেছে আজ! দুটো জেসিবি! নদীর তলা বের করে ছাড়বে আজ। একেই বলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! ইটভাটার মাটি কাটছে। নদী মজতে দেখে কিছু মানুষ নদীর পাড়ের জমির মাটি বেচতে শুরু করে দিয়েছে! সে-মাটি কাটতেই নদীতে জেসিবি নেমেছে। আলম বক্স দুঃখ করে বলল, ‘মাছধরা জালগুলেন বেচি দিব। নদীটাই য্যাখুন থাকচে না ত্যাখুন অ থুয়ি কী মাহাল হবে?’ আলম বক্স টোটো কিনেছে। হদ্দিন ভাড়া মারে। যা রোজগার হয় তাতে সংসারটা কোনোমতে পুষিয়ে যায়। আলম বক্স কুদ্দুসকেও টোটো কিনতে বলেছিল। কুদ্দুস কেনেনি। কুদ্দুস বলেছিল, ‘ডিঙিটা ছাড়তে পারব না। ওই ডিঙিটাই তো এতদিন সংসারে ভাত এনে দিয়েছে। দেখি না নদীটা যদি আবার জাগে!’ কুদ্দুস এখনো প্রত্যেক হপ্তায় নিয়ম করে ডিঙিটায় তেল-আলকাতরা দেয়। জোড়াতালি ঠিক করে। ঠুকঠুক করে প্রায়ই পেরেক ঠুকে। আর মাছধরা জালগুলি ছড়িয়ে দেয় উঠানে। জালগুলি রোদ পায়। সে-রোদে জালের ফাতনা ভারগুলি খিলখিল করে। জালগুলিতে আর আঁশটে গন্ধ নেই। মাছ না ধরে না ধরে সে-গন্ধ জালের গা থেকে উধাও হয়ে গেছে। এখন জালে ধুলোর গন্ধ। ঝুলের গন্ধ। কেমন যেন পুরনো পুরনো গন্ধ। বিলপাড়ার হাফিজুল আবার কুদ্দুসকে ভিন খাটতে যাওয়ার কথা বলেছিল। হাফিজুল কেরল খাটতে গেছে। কুদ্দুস যায়নি। ফরিদাও একসময় বাধ্য হয়ে কুদ্দুসকে বলেছিল, ‘ঘরে যা ছিল তা তো শেষ হতে চলেছে। অন্য কিছু একটা করে রুজগারপাতির ব্যবস্থা করো? টোটো না চালাও রাজমিস্ত্রি খাটতে যাও।’ সে-কাজও কুদ্দুসের ধাতে সয়নি। সে করিৎকর্মা লোক হলেও খুঁতখুঁতে। বাপ-ঠাকুরদার কাজ ছেড়ে দুনিয়ার অন্য কোথাও তো দূরের কথা বেহেশতেও যাবে না। কিন্তু পেট তো আর কথা শুনবে না? খিদে পেলে তার ভাত লাগবেই? তাও একটা পেট হলে হয়, ছ-খানা পেট। আবার বড় মেয়ে সোমত্ত হয়ে উঠছে। তার বিয়েথাও দিতে হবে। সেজন্যেও তো কম টাকা-পয়সা লাগবে না! কুদ্দুসের দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলেটা নামলা। এছাড়াও বাড়িতে আশি বছরের মা রয়েছেন। তার অসুখ-বিসুখ তো লেগে আছেই। সেখানেও একটা বড় পয়সা ধসে যায় কুদ্দুসের। এত বড় সংসারের ভরণপোষণের দায়িত্বে ছিল এই ছোট ভৈরবটা।

‘চ দেখি আসি।’ মাটি কাটা দেখতে যাওয়ার কথা বলল সালেমুদ্দি। ‘আমি যাব না। তুই যা। অ আমার সহ্য হবে না।’ বলল কুদ্দুস। ‘আর নদীডা যে মচ্চে সিডা সহ্য হচ্চে?’

কুদ্দুসকে ঠেস মারল আলম বক্স। ‘বুকের হাড়ভাঙ্গা বুঝিস? নদীডা যেদিন থেকি মজতে শুরু করিচে সেদিন থেকি আমার বুকের হাড় ভাঙতে শুরু করিচে।’ বলল কুদ্দুস। কুদ্দুসের কথা শুনে আলম বক্স কুদ্দুসের উদোম গায়ের দিকে তাকাল। দেখল কুদ্দুসের হাড়জিরজিরে বুকটা। বাঁশের বাতার মতো বুকের হাড়গুলি মাচা বেঁধে আছে! কুদ্দুস ঠাট্টা করে বলে, বিত্তি না পেতে যদি এই বুকখানা পাতি নদীতে তাহলে আরো বেশি মাছ আটকাবে। বলে হো হো করে হেসে ওঠে কুদ্দুস। আলম বক্স আর টিটকিরী কাটল না কুদ্দুসকে। সে ঠাহর করতে পারল, নদীটা যেভাবে একটু একটু করে মরছে কুদ্দুসও হাড়গিলে দাঁতলা ঝাঁঝরা-বিত্তি হয়ে উঠছে! সেকথা একদিকে যেমন জানান দিচ্ছে তার হিলহিলে শরীরটা তেমনি অন্যদিকে তার কোটরে ঢুকে যাওয়া ছিপছিপে চোখগুলি। কুদ্দুস জানে, জেসিবির খামচা নদীর বুকে পড়ছে না, পড়ছে তার নিজের বুকে! খাবলা খাবলা মাটি তার বুক থেকে উঠে যাচ্ছে ট্রাক্টরে! এখন নদীর পাড়ে থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না কুদ্দুস। পা হড়কে যায়। তার ভেতরে একটা কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। মাথা চিনচিন করে। হাড় থেকে মাংস ছাড়ার অনুভূতি হয়। তখন নিজেকে ভারশূন্য মনে হয়। মনে হয় যেন একটা ঠোঙা দাঁড়িয়ে আছে! একটুখানি ফুঁ পেলেই উড়ে যাবে! সালেমুদ্দি আরো একটা জিনিস দেখাল। জেসিবিগুলি যেখানে মাটি কাটছে তার মাইলখানেক দূরে যেখানে নদীটা পেঁচানো চিচিঙ্গার মতো বাঁক নিয়েছে সেখানে মাথা তুলে উঠছে কাদির প্রধানের পেল্লাই বাড়ি। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভালো। হাবভাব দেখে বোঝা  যাচ্ছে, বাড়ির মাথা আকাশ ঠেকে যাবে! কাদির প্রধান একদিন বলছিলেন, এমন বাড়ি বানাব দূরদূরান্ত থেকে নদীর পাড়ের মানুষেরা দেখতে পাবে। কাদির প্রধান সেটাই বানাচ্ছেন। নদীর ওপর পিলার তুলে প্রাসাদ বানাচ্ছেন! আশেপাশে আরো অনেক পিলার নদীতে পুঁতে আছে। সেগুলিও বাড়ি হবে। প্রথমে পিলার তুলছে পরে নিচের সে-ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করে দিচ্ছে মাটি দিয়ে। ফলে সরু হয়ে যাচ্ছে নদী। নদী হাঁসফাঁস করছে। সে-হাঁসফাঁস শব্দ কেউ শুনতে না পেলেও কুদ্দুস শুনতে পায়। তখন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কুদ্দুস ভেজা কণ্ঠে বলে, ‘নদী কাঁদছে গো! তোমরা আর আঘাত করো না নদীকে। এমন করলে নদীর যে পরকাল হয়ে যাবে!’ আড়তদার লুতফল শেখ আবার তার নদীতে লেগে থাকা জমিটার সামনে ‘সাইনবোর্ড’ ঝুলিয়েছেন! তাতে বড় বড় হরফে লেখা, ‘এই জমি বাড়ির জন্য প্লট করে বিক্রয় করা হবে।’ নিচে লুতফলের ফোন নম্বর। বাড়ি বানানোর জন্য আর কত জমি লাগবে? গোটা দুনিয়াটাই মানুষের বাড়ি হয়ে যাবে নাকি? হোক। সব বাড়ি হোক। মাঠঘাট নদীনালা সব বাড়ি হোক। তখন আবাদ করবে কোথায়? মানুষের মাথায়, না আকাশে? আবাদ না হলে খাবে কী? হাওয়া খাবে? তখন বুঝবে ঠেলা। বিড়বিড় করে কুদ্দুস। বকুলতলা থেকে আড়তদার লুতফলের সেই ‘সাইনবোর্ড’টাও টিমটিম করে দেখা যাচ্ছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন নদীর ওপর মাটি পড়ছে না বা নদীর মাটি কাটা হচ্ছে না! ‘তোরা যাস না যাস আমি যাই। একবার দেখি আসি।’ বলল সালেমুদ্দি। বলেই সে নদীর পাড় ধরে হাঁটা দিলো। লম্বা সালেমুদ্দির ঠ্যাংগুলি একসময় নদীর নিচে নামল। তার হিপ্পি চুলগুলি দক্ষিণী হাওয়ায় ফিরফির করে উড়ছে। সালেমুদ্দির হাড়-ওঠা কাঁধগুলির ওপর দিয়ে নদীটাকে আরো একবার দেখল কুদ্দুস। ভেতরটা ফুঁপিয়ে উঠল তার। ততক্ষণে চোখের কোণে এসে জমেছে অশ্রু। একটা ডাক শুনতে পেল কুদ্দুস। নদী তাকে ডেকে বলছে, আমার বুকে আর নামিস নে কুদ্দুস। আমার লজ্জা লাগে।

দুই

শেষমেশ ঠুকমুকটা হয়েই গেল ফরিদার সঙ্গে। ‘আবার কদ্দিন ভবঘুরে হয়ি বেড়াবা? শেষে না ফেরালি হয়ি যাও! খাটো। দেহ খাটিয়ে রুজগার করো। পেট তো আর কম নয়? টোটো না চালাও, লছিমন না বহাও, শহরে যাও। রাজমিস্ত্রির জোগালগিরি করো গে। কিন্তু বাড়িতে আর বসি থাকা যাবে না খ।’

কথাগুলি আজ জাব্দা করে বলল ফরিদা। কুদ্দুস দাওয়ায় থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু-কুঠুরির বাড়ি কুদ্দুসের। ইটের দেয়াল। তবে ছাদ ঢালাই নয়, টালির। ছোট্ট উঠোনের মাঝে একটি ডালিম গাছ আছে। সে ডালিম গাছের ছায়া দাওয়ায় গিয়ে মিশেছে। কুদ্দুসের বড় মেয়ের বয়স আর ডালিমগাছটার বয়স একই। যখন নদীতে মাছ ধরার ভরা মরসুম চলত তখন এই ডালিমগাছটার ডালে ঝুলত মাছ ধরার জাল। জালে আটকানো মাছের রঙে ডালিমগাছটাকে মনে হতো যেন সাদা কোনো গাছ! ‘কই? কিচু বুলচ না যে?’ গলা খেঁকাল ফরিদা। মাথায় দেওয়া আঁচলের ঘোমটাটা কখন মাথা থেকে পড়ে গেছে খেয়ালই নেই ফরিদার। মাথায় পেঁয়াজের শেকড়ের মতো উসকোখুসকো চুল। তেল না পড়ে ফেঁসো হয়ে গেছে! আগে নাদুসনুদুস শরীর ছিল ফরিদার। পেটে সন্তান ধরার পর থেকে সেই শরীর ভাঙতে শুরু করে। তারপরে সংসারে গেঁড়ে বসে অভাব। পেটে খাবারেরও টান পড়ে। তখন নাদুসনুদুস শরীরের সে-মাংস গলে গলে শরীরটাকে খাটায়, হাঁটায়। কোনোরকমে জানে বেঁচে থাকে দেহখানা। ফরিদার সে-শরীর এখন পাকানো দড়ি! সেই শরীরের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল কুদ্দুসের ওপর। কুদ্দুস বলল, ‘কী বুলব? কপালে যা আছে তাই করব।’ বলেই বাইরে বেরিয়ে গেল কুদ্দুস। ফরিদা স্বামীর আচরণ দেখে অবাক হলো। সংসারটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে আর লোকটার কোনো হেলদোল নেই! রাতটা কোনোরকমে কাটল। কুদ্দুস বাড়ি ফিরে এলেও সেরকম বেশি কথা বলল না। শুধু কিছু একটার আভাস দিয়ে রাখল ফরিদাকে, ‘আগামীকালকে বুঝতে পারবা।’

আরো একটা দিন কাটল। ডালিমগাছটার ফাঁক দিয়ে উঠল সূর্য। নদী যেমন খোলের মতো পড়ে আছে তেমনই থাকল। রোদের যখন তেজ বাড়ল অর্থাৎ সূর্যটা আলম বক্সের গোয়ালঘরের মটকায় উঁকিঝুঁকি মারল তখন আচমকা কোথা থেকে দুটো ছাগল সঙ্গে করে বাড়ি ঢুকল কুদ্দুস! একটা দুই বিহেনের ধাড়ি আর একটা পাঠি। ফরিদা স্বামীর কাজ দেখে আকাশ থেকে পড়ল! ভ্রু কপালে তুলে বলল, ‘ইসব কতি পালা! অ্যা কী হবে?’

‘পুষব। পুষানি লিনু।’ ছোট্ট করে বলল কুদ্দুস। ফরিদার ভ্রু আরো ওপরে উঠে গেল। সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘শেষে তুমি ছাগল চরানে রাখাল হবা!’

‘শুদু ছাগল লয়। একটা গাইগরুও দেখি এসচি। হালিমের গরু। কেবলই এক বিহেন দিয়িচে। বিকেলে লিয়ি আনব।’ নিঃসংকোচে বলল কুদ্দুস। মানুষটার কীর্তি দেখে ফরিদার এবার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। সে কতদিন কুদ্দুসকে বলেছে, কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করেছে, ‘একটা গাই পুষো গো, তাও হাতে দুটো পয়সা আসবে। সংসারের কিছুটা হিল্লে হবে।’ সে-কথা শুনে কুদ্দুস বলেছে, ‘আমরা নদীর মানুষ। মাছ ধরা আমাদের বাপ-ঠাকুরদার গর্বের পেশা। সেসব ছেড়ে
ছাগল-গরু চরানে রাখাল হবো! তুমি কোন মুখে এ-কথা বললে!’ সেই কুদ্দুস এখন বলছে, ছাগল-গরু পুষব! হিসাব মেলাতে পারছে না ফরিদা। কিন্তু হিসাব একটা আছে কুদ্দুসের কাছে। সে-হিসাব কষেই সে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে কুদ্দুস নদী ছাড়তে চায় না। জান গেলেও না। সে এমন কিছু একটা করতে চাইছিল যাতে তার দুটো পেটের ভাতও হয়, আবার নদীটাও কাছেপিঠে থাকে। সেসব ভেবেচিন্তে এই ছাগল-গরু পোষার সিদ্ধান্ত।

দুদিন না কাটতেই পাটকাঠির একটা ছাউনি বানিয়ে দিলো কুদ্দুস। সে-ছাউনির নিচে থাকল গাই গরুটা আর ছাগলদুটো। সারাদিন নদীতে গরু-ছাগল চরায় কুদ্দুস। ফেরার সময় মাথায় করে এক বোঝা ঘাস আনে। সে-ঘাস বাড়িতে বিচালি বানায় ফরিদা। নানে মাখিয়ে দেয়। কিন্তু এই ছাগল-গরু চরানো নিয়ে আরেক বিড়ম্বনায় পড়ল ফরিদা। কুদ্দুস বাড়ি ফিরতেই চায় না। ছাগল-গরু নিয়ে সারাদিন নদীতেই পড়ে থাকে! বাড়ি ফেরার নাম নেয় না! কুদ্দুস একধরনের পাগলামি করে। সে
ছাগল-গরুগুলিকে নদীতে ছেড়ে দিয়ে কখনো নদীর বুকে গজিয়ে ওঠা ঘাস-কচুরিপানা-কলমিলতা ছাঁটে তো কখনো নদীর পাড়ের শিমুলগাছের ছায়ায় গামছা পেতে শোয়। কুদ্দুস ছাগল-গরুর খাবার হবে বলে ঘাস-পানা ছাঁটে না, সে এই কারণে ছাঁটে যাতে নদীটা আবার জেগে উঠলে যেন বলতে না পারে, আমি ক-দিন ছিলাম না বলে তোরা আমার শরীরটাকে বুন বাঁধিয়ে রেখেছিস? আমার জল বইতে কষ্ট হবে না? কুদ্দুসের শোয়াটাতেও অদ্ভুত পাগলামি থাকে। সে উপুড় হয়ে নদীর বুকে কান পেতে শোয়। আসলে সে শব্দ শোনার চেষ্টা করে। সে-শব্দ নদীর জল গড়ানোর শব্দ। নদীর স্রোতের শব্দ। এই বুঝি নদীটা আবার ফিরে আসছে!

ক-মাস না যেতেই গরুটা ডাকল। তার কিছুদিন পর পাঠি ছাগলটাও ডাকল। ধাড়ি ছাগলটা আগে থেকেই ভরানি (গর্ভবতী) ছিল। সেসব ডাকে জান ভরল না কুদ্দুসের। সে একজনের ডাকের অপেক্ষায় আছে। নদীটা কবে ডাকবে! এখন আবার নতুন পাগলামি শুরু করল কুদ্দুস। সে সারাদিন মিনমিন করে একা একা কীসব গাহায়! এটা তখনই হয় যখন কুদ্দুস নদীতে থাকে। যেন সে নদীর সঙ্গে কথা বলে। নদীর দুঃখ-কষ্ট শোনে। নিজের দুঃখ-কষ্টের কথা নদীকে বলে।

হঠাৎ একদিন ডাক এলো! তখন সবেমাত্র বিকেল গড়িয়েছে নদীর পশ্চিমপাড়ে। শ্রাবণের ভেজা দিন। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তার আগে তিনদিনের একটা বড় ঢল হয়ে গেছে। খাল-বিল সব জলে টইটম্বুর। মরা নদীটা কোমর অবধি ডুবে আছে জলে। কিন্তু সে-জল শুধু বৃষ্টিরই, নদীর নয়। নদীর জল হলে নদীতে স্রোত বইবে। তাই নদীর সে-জল নিয়ে উৎফুল্লতা নেই কুদ্দুসের। সে জানে, বৃষ্টি থামলেই দিন পনেরোর মধ্যে এ-জল শুকিয়ে যাবে। ‘ডাক’টা নদীর নয়, মানুষের। চারদিকে
হই-হুল্লোড়, নদীতে জল এসেছে! নদীতে স্রোত বইছে! ডাকটা শুনেই নদীর পানে দৌড় দিলো কুদ্দুস। যেন তার পিঠে
‘বোরাক’-এর ডানা! সে পারলে উড়ে যায়! হাশরের ময়দানে আল্লাহ যদি তাকে বলেন, কুদ্দুস তুমি বেহেশতবাসী হলে, বেহেশতে দৌড়ে যাও, তখনো মনে হয় এমন দৌড় দেবে না কুদ্দুস! যাকে বলে ‘উদোধুম দৌড়’, সেই ‘উদোধুম দৌড়’ দিলো কুদ্দুস। আবার মনে একটা খটকাও হচ্ছে তার, কথাটা মিথ্যে নয় তো? কেউ চালাকি করছে না তো? পেছনে ফরিদাও ছুটেছে! আসলে ফরিদা আর কুদ্দুস একা নয়, গোটা গ্রামটাই ছুটছে! ভৈরবতলা পেরিয়ে মানুষ শঙ্করপুরের ব্রিজের দিকে ছুটে চলেছে। সবাই বলছে, নদীকে বাঁচানোর জন্য পদ্মা থেকে জল ছেড়েছে সরকার। কেউ কেউ বলছে, ঢলে পদ্মার বাঁধ ভেঙে গেছে, সে ভাঙা বাঁধ দিয়ে জল ঢুকছে ভৈরবে, ভৈরব থেকে পরে এই মরা ভৈরবে। কিন্তু কোথায় স্রোত? স্রোতের সেই গ-গ ডাকই বা কোথায়? গ-গ ডাক না হোক তিরতিরে শব্দ তো হবে? সে-শব্দই বা কোথায়? তবু সবাই ছুটে চলেছে। কুদ্দুস সবার আগে। কুদ্দুস যখন শঙ্করপুরের ব্রিজে উঠল তখন পেছন থেকে একটা বিকট শব্দ শুনতে পেল! সবাই চোখ ছানাবড়া করে দেখল, নদীর ওপর গড়ে তোলা কাদির প্রধানের নির্মীয়মাণ প্রাসাদ বাড়িটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে! সে-দৃশ্য দেখে আলাদা একটা আনন্দ হলো কুদ্দুসের। কুদ্দুস মনে মনে বলল, ‘নদীকে খাবি। নে, নদীই তোকে খেয়ে নিল।’ বাড়ি ভাঙার দৃশ্য দেখতে যখন বিভোর তখনই কুদ্দুসের কানে এলো একটা মিহি গ-গ শব্দ! ধেই করে উঠল কুদ্দুস। এ-শব্দ তার চেনা। এ-শব্দের জন্যই তো সে এতদিন অপেক্ষা করে আছে। ব্রিজের ওপর থেকে দূরে রামকৃষ্ণপুরের দিকে কুদ্দুস তার খুঁটল চোখ ফেলে দেখল, স্রোত ঠেলে এগিয়ে আসছে নদী! আর তখনই বাড়ির গোয়ালঘরের ছাউনির ভেতর গর্ভবতী গাইটা প্রসব করল একটা ফুটফুটে বাচ্চা। সে-শব্দ বাতাসে মিশল। সে-বাতাস আউরিবাউরি খেল। তারপর কুদ্দুসের কানের দিকে ধিধ্ধির করে এগোতে থাকল।