মণিপুরিনৃত্যের গুরু দেবযানীর চলিহার

তপন বাগচী

সাক্ষাৎকার তো তথ্যসংগ্রহের হাতিয়ার মাত্র। সেই সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করেই যে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করা যায়, আবুল আহসান চৌধুরী তা দেখালেন তাঁর আলাপচারী আহমদ শরীফ এবং ন্তরঙ্গ অন্নদাশঙ্কর গ্রন্থের মাধ্যমে। আলাপচারী আহমদ শরীফ গ্রন্থটি এখন পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে শরীফ স্যারের কাজ নিয়ে, তার সব কাজেই রসদ জুগিয়েছে। কারণ সাক্ষাৎকারে যত খোলামেলা সত্য আবিষ্কার করা যায়, তা গবেষণা করে অন্যের মুখ থেকে শুনতে হয়। তাতে প্রকৃত সত্য থাকে প্রমাণসাপেক্ষ। সাক্ষাৎকারে গবেষণার বিষয় নিজেই মূর্তিমান থাকেন সম্মুখে। তাই এভাবে তথ্যসংগ্রহ করা হলে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। অন্নদাশঙ্করের বিশদ সাক্ষাৎকার ছাড়াও তিনি সুফিয়া কামাল : অন্তরঙ্গ আত্মভাষ্য নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যসহযোগে। এ ছাড়া তিনি কবি আবুল হোসেন, কবি শামসুর রাহমান, সাহিত্যিক প্রতিভা বসু, কণ্ঠশিল্পী যূথিকা রায় প্রমুখের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, যা তথ্যবহুল এবং উপভোগ্য। একই ধারার সাম্প্রতিক কাজ ন্তরঙ্গ দেবযানী (২০১৬)।

বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে যত তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে তা প্রবন্ধের ভাষায় সাজালে অন্যরকম স্বাদের এক গবেষণাগ্রন্থ হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু আবুল আহসান চৌধুরীর হাতে দেবযানী চলিহার (১৯৩৪) জীবনতথ্য বিন্যস্ত হয়েছে ১৬টি পর্বে – পূর্বপুরুষের সন্ধানে, শিবসাগরের মেয়ে, কলেস্নালিনী কলকাতায়, সাহিত্য-সাময়িকপত্রের ভুবনে, নাচের দেবযানী, স্মৃতির সরণি বেয়ে, দিনযাপনের কড়চা প্রভৃতি। কিন্তু প্রতিটি পর্ব কথোপকথনের ভঙ্গিতে রচিত। এতে পাঠের উপযোগিতা বেড়েছে। তথ্য জানতে পারছি নাটকের সংলাপের ঢঙে। গল্প বলার ঢংটিও আছে উত্তর-ভাষ্যে।

ন্তরঙ্গ দেবযানী বইটি প্রকাশকের মাধ্যমে হাতে আসার পরেও দীর্ঘদিন পড়া হয়নি। শিল্প ও শিল্পী পত্রিকায় ‘দেবযানী চলিহা : এক মান্য নৃত্যশিল্পীর আলেখ্য’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন আবুল আহসান চৌধুরী। সেখান থেকে দেবযানী সম্পর্কে কিছুটা ধারণা অর্জন করি। এর আগে দেবযানী সম্পর্কে আমার কেন, বাংলাদেশের অনেক সচেতন পাঠকের আগ্রহ দূরে থাক, নাম শোনার অভিজ্ঞতাও হয়নি। নাচের মেয়ে দেবযানী যদি কলকাতার হতেন, তবে হয়তো নাচ দেখার সৌভাগ্য না হলেও নাম শোনার সুযোগ ঘটত। কিন্তু আসামের মেয়ে মণিপুরি নাচের শীর্ষনাম দেবযানী চলিহা। ভারতে তো বটেই, বহির্বিশ্বে তাঁর নাম সুবিদিত। কেবল নৃত্যপটীয়সী নন তিনি; সংগীত, সাহিত্য, সাংবাদিকতা এবং অধ্যাপনাতেও তাঁর দক্ষতা প্রমাণিত। তাঁর কাকা বিমলাপ্রসাদ চলিহা ছিলেন আসামের দীর্ঘদিনের (১৯৫৭-৭১) মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর পিতা ছিলেন শিল্পপতি। চলিহা পরিবার আসামের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সেই পরিবারের কীর্তিময়ী মেয়ে এই দেবযানী। তাঁকে নিয়ে বাংলাভাষায় তো নয়ই, অসম ভাষাতেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো রচনা প্রকাশিত হয়নি। আবুল আহসান চৌধুরীর এ-কাজটি তাই দেশ-কাল-ভাষার সীমা পেরিয়ে কেবল সংস্কৃতির টানে মুগ্ধ হওয়ার মতো প্রশংসনীয়।

আবুল আহসান চৌধুরীর এই গ্রন্থের ভেতরে প্রবেশের আগে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া ভালো। অন্নদাশঙ্কর রায় ও দেবযানী চলিহার মতো ব্যক্তিত্ব নিয়ে শ্রমসাধ্য গবেষণাগ্রন্থ লিখছেন আবুল আহসান চৌধুরী এবং তা প্রকাশ করছেন বাংলাদেশ থেকে। আবার মীর মশাররফ হোসেনের হিতকরী পত্রিকার সংকলন-সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছেন কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পর্ষদ থেকে। কাজটি নিয়ে দেশ পত্রিকায় নেতিবাচক সমালোচনা প্রকাশিত হলে তার দাঁতভাঙা জবাবও দেন, কলকাতার পাঠকেরাই। এর আগেও ‘রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত লালনের গানের খাতা’র সংকলন নিয়েও দেশ পত্রিকায় বিরূপ সমালোচনার শিকার হয়েছেন। তারও জবাব এসেছে পাঠকের পক্ষ থেকে। এ থেকে বোঝা যায় যে, আবুল আহসান চৌধুরীর দুদেশের সেতুবন্ধজাতীয় গবেষণা অনেকেরই এখন ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আবুল আহসান চৌধুরীর অনেক গবেষণাই যে অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে, সে-কথা মানতে আর বাধা থাকবে না। যেমন ধরুন, ন্তরঙ্গ দেবযানীর কথাই। এ-কাজটি হয়েছে বলেই তো এই নৃত্যগুরু দেবযানীকে নিয়েই ইন্দ্রজিৎ নারায়ণ ও সুদীপ সরকার সহজে বানাতে পেরেছেন এক ঘণ্টার তথ্যচিত্র আ সাইলেন্ট জার্নি অব রিদম। আবুল আহসান চৌধুরীর বইখানা হাতের কাছে আছে বলেই এর পা-ুলিপি নির্মাণে সহায়ক হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। এটি যে আবুল আহসান চৌধুরীর কাজের বড় স্বীকৃতি, তা যে কেউ অনুধাবন করবেন। এই তথ্যচিত্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবুল আহসান চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন কলকাতায়। তথ্যচিত্রের উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য অধ্যাপক স্বপনকুমার দত্ত।

আবুল আহসান চৌধুরী এখন কলকাতা এবং ঢাকার বিবেচনাতেই শীর্ষস্থানীয় গবেষক। নতুন তথ্য সংগ্রহে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সাহিত্যের নতুন-নতুন উপকরণ তিনি উদ্ধার করে চলছেন। অনেকেই তাঁর এই অবদানের কথা বুঝতে না পেরে কেবল সংগ্রহ ভেবে ভুল ধারণা পোষণ করে বসে আছেন। সংগ্রহটাও গবেষণার প্রথম ধাপের বড় কাজ। সংগ্রহ করতে পারলে ব্যাখ্যা-বিশেস্নষণ করে তার প্রতিবেদন তৈরি তো ফরমায়েশি লেখকেরাও পারেন। আবুল আহসান চৌধুরী সে-ধরনের ফরমায়েশি লেখক নন। তিনি গবেষণার উপকরণও নিজে হাতে প্রস্ত্তত করেন। তাঁর প্রতিটি গবেষণাই তাই স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার।

এই গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট লেখক জানিয়েছেন এভাবে, ‘দেবযানী চলিহা – মণিপুরি নাচের সূত্রে এই নামটি জানা ছিল, কিন্তু কখনো তাঁর সঙ্গে যে আলাপ-পরিচয় হবে, তা ভাবিনি। হঠাৎ করেই সে-সুযোগ এসে গেল লোকগানের শিল্পী বন্ধু রমেন সাহার সুবাদে। তারিখটা মনে আছে ৬ মার্চ, ২০১৪। সেই সামান্য ক্ষণের দেখাশোনা যে গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কে রূপ নেবে সে-কথা ভাবলে বেশ আশ্চর্য হতে হয়। যত তাঁর সঙ্গে মিশেছি তত তাঁর গুণপনার খবর পেয়ে বিস্ময় জেগেছে মনে। এক বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প শুনতে-শুনতে মুগ্ধ হয়েছি। তখন ভেবেছি, প্রচারকুণ্ঠ এই মানুষটির এসব কথা তো প্রকাশ হওয়া দরকার। সেই ভাবনা থেকেই তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার চিন্তা আসে মাথায়।’ [নিবেদন] তাঁর পরের কাহিনি তো এই গ্রন্থ।

আমরা আনন্দিত যে, এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। দেবযানীকে আশৈশব দেখা নবনীতার ভাষ্যে এই সম্পর্কে জানা যায়, ‘প্রথমত, আমরা এই একটি গুণী, বিশিষ্ট মানুষের জীবনের কাহিনি খুঁজতে খুঁজতে অসমের সামাজিক ইতিহাসের একটি বিস্তারিত বিবরণ আবিষ্কার করে ফেলি। দ্বিতীয়ত, এই বই একটি বহু গুণসম্পন্না ভারতীয় মেয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ জীবনচিত্র। বিবাহোত্তর জীবনে স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়া, এবং সব অবস্থা থেকেই মুক্ত হয়ে নিজেকে ঠিক নিজের মনের মতো করে গড়ে তোলার একটি সম্ভ্রান্ত কাহিনি পাঠকের সামনে ভেসে ওঠে।’ [ভূমিকা] নবনীতা দেবসেনের এই বক্তব্য থেকেই আমরা এই গ্রন্থের তাৎপর্য বুঝে নিতে পারি।

আবুল আহসান চৌধুরী এক প্রবন্ধে জানিয়েছেন দেবযানীর সাংস্কৃতিক পরিম-লের কথা। তাঁর ভাষায়, ‘অসমিয়া-বাংলা-মণিপুরি – দেবযানী এই তিনটি সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করেছেন। জন্মসূত্রে তিনি অসম-কন্যা, অসমিয়া তাঁর মাতৃভাষা, অসমিয়া-সংস্কৃতি মিশে আছে তাঁর রক্তে। কিন্তু শৈশব থেকে বাংলায় বসবাস, বাংলা ভাষায় লেখাপড়া, বাঙালি পরিবারে বিয়ে – এ সবকিছু তাঁকে ভাব-ভাষা-ভাবনা-আচার-আচরণ-সংস্কৃতিতে বাঙালি করে তুলেছে। আর মণিপুরি নাচের মাধ্যমে তিনি মণিপুরি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। অনেকগুলো ভাষা, যেমন – অসমিয়া, বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি, মণিপুরি জানার ফলে তাঁর সংস্কৃতিচেতনা ভারতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আরো দৃঢ় হতে ও প্রসার লাভ করতে পেরেছে।’ আর সে-কারণেই হয়তো বাংলাদেশের আবুল আহসান চৌধুরী এই দেবযানীকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করতে আগ্রহী হয়েছেন।

গ্রন্থের প্রথম পর্বে চলিহা পরিবারের গৌরবের ইতিহাস উঠে এসেছে দেবযানীর বয়ানে। তাঁর দাদু কালীপ্রসাদ চলিহা ছিলেন আসামের নামকরা উকিল এবং চা-বাগানের মালিক। তাঁর বড় ছেলে তারাপ্রসাদ ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ জনহিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দ্বিতীয় ছেলে যাদবপ্রসাদ চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করেন, চা তৈরির বেশ কয়েকটি যন্ত্র নির্মাণ করে তার পেটেন্টও লাভ করেন। পরে তিনি ‘চলিহা রিরোলিং স্টিল মিল’ও স্থাপন করেন। এঁর মেয়েই আমাদের আজকের দেবযানী। তৃতীয় ছেলে গুরুপ্রসাদও নিজের  পেটেন্ট নিয়ে চা-বাগানের জন্য যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। চতুর্থ ছেলে বিমলাপ্রসাদ হয়েছিলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী। ১৯২৭ সালে দেবযানীর পিসিমা কমলালয়া আর জেঠিমা কুকলতা চলিহার সম্পাদনায় ঘরজেউতি নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। পরে দেবযানী এই পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। এসব নানা তথ্য উঠে এসেছে প্রথম পর্বে।

‘শিবসাগরের মেয়ে’ নামাঙ্কিত দ্বিতীয় পর্বে দেবযানীর শৈশবের কথা জানতে পারি। তাঁর ডাকনাম আইজনি ছাড়াও আরেকটি নাম আছে, মীনাক্ষী। সব ভাইবোনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এখানে। তৃতীয় পর্বে পাই আসাম থেকে কলকাতায় আসার কাহিনি। ছয় বছর বয়সে অর্থাৎ ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আসেন প্রথমবারের মতো। বাল্যসখী হিসেবে পান নবনীতা দেবসেনকে। আমরা চতুর্থ পর্বে পাই শান্তিনিকেতনে পড়ার কাহিনি। পঞ্চম পর্বে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে আসার ঘটনা। এই পর্বে আশুতোষ কলেজ আর প্রেসিডেন্সি কলেজের পরিবেশ সম্পর্কেও একটা ধারণা মেলে।

পড়াশোনা শুরু শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে। সেখান থেকে বেলতলা গার্লস ও সেন্ট জন ডায়োসেশন। ১৯৫০-এ ম্যাট্রিক পাশ করে নাচগান শিখতে শুরু করেন ভবানীপুরের ‘বাণী বিদ্যাবীথি’তে। এবং কয়েক বছর ব্রজবাসী সিংহের কাছে মণিপুরি নৃত্যে তালিম নেন। আশুতোষ কলেজ হয়ে শিলংয়ের লেডি কেন কলেজে পড়তে চলে যান। ফিরে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে স্নাতকোত্তর। দিলিস্নতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গুয়াহাটির এক নৃত্যশিল্পীকে দেখে বুঝতে পারেন, এতদিন যে-শৈলী রপ্ত করেছেন, সেটা ঠিক মণিপুরি নয়। তাই ১৯৬৭ সালে উদয়শঙ্করের পরামর্শে ইম্ফলে গুরু মাইস্নাম আমুবি সিংহের কাছে মণিপুরি নৃত্যে তালিম শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মণিপুরের ধনমঞ্জরি কলেজে প্রভাষকের চাকরি নেন। এই কাহিনি রয়েছে ষষ্ঠ পর্বে। এরপর কলকাতায় শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ, বর্ধমানের আসানসোলে বিধানচন্দ্র কলেজে দর্শনের অধ্যাপনা শেষে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সপ্তম পর্বে আমরা তাঁর সাহিত্য-সাময়িকপত্রের ভুবনে বিচরণের খবর পাই। তিনি বেতার জগত পত্রিকার অহমিয়া ভার্সনের সাব-এডিটরের দায়িত্বও পালন করেছেন। ছোটদের উপযোগী সাহিত্য তিনি রচনা করেন।

অষ্টম পর্বে দেবযানীর প্রেম ও বিবাহ-কাহিনি বর্ণিত। তাঁর স্বামী বিশ্বপ্রিয় বসু তো আমাদের বিক্রমপুরের শেকড়ছেঁড়া মানুষ। নবম পর্বে রয়েছে উদয়শঙ্কর আর গুরু অমবি সিংয়ের কাছে নৃত্যশিক্ষার পরিচয়। দশম পর্বে এসে ‘নাচের দেবযানী’কে পাই। একেবারে শেষ পর্বে এসে অশীতিপর এই নৃত্যগুরুর জীবনের হিসাব-নিকাশ তুলে ধরেন লেখক। এই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ উক্তি আমার কাছে মনে হয়েছে, ‘তুমি আমাকে এতগুলো প্রশ্ন না করলে আমি বুঝতেই পারতাম না যে আমার এত কিছু বলার আছে।’ এই একটি উক্তির মধ্য দিয়ে এই গ্রন্থের গুরুত্ব যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি দেবযানীর প্রকৃতি প্রচারকুণ্ঠা মনের পরিচয়ও বিধৃত হয়। এই যে বলিয়ে নেওয়া, কথকের জানা যে, কী বলার আছে তার, তার কাছ থেকে কথা বের করে এনে নতুন ইতিহাস নির্মাণের ধারায় এখন আবুল আহসান চৌধুরীই নিষ্ঠাবান সাধক। বইয়ের শেষে অজস্র আলোকচিত্র রয়েছে যা আজ অনেক ইতিহাসের দলিল হিসেবে গণ্য।

এই গ্রন্থপাঠে আমরা একজন নারীর শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প জানতে পারি। যে-নারী বেড়ে উঠেছেন রাজপরিবারে, শিক্ষাদীক্ষায় পেয়েছেন সর্বতো সহযোগিতা। তবু পারিবারিক জীবনযাপন করেও শিল্পীর শিরোপা লাভের যে লড়াই, সেটাই এই গ্রন্থের উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় দিক।

কাগজের মান ও আলোকচিত্রের কারণে গ্রন্থের দাম একটু বেশিই রাখতে হয়েছে। তবু প্রকাশককে ধন্যবাদ যে, বিক্রির তোয়াক্কা না করে এরকম একটি ভালো বই প্রকাশে উদ্যোগী হওয়ার জন্য। ধ্রম্নব এষের প্রচ্ছদ খারাপ লাগার কথা নয় কারো।

গ্রন্থ-রচনার তাৎপর্য পড়েছিলাম নবনীতা দেবসেনের ভাষ্যে। এবার এই গ্রন্থপাঠের তাৎপর্যটাও জেনে নিতে পারি তাঁর ভাষায় – ‘এই বইতে যেভাবে পারিবারিক ইতিহাস ঘেঁটে তাঁর জীবনের কথা বলিয়ে নেওয়া হয়েছে তাতে দেবযানী-আইজনি-মীনাক্ষীর গল্প একটি ব্যক্তির জীবনকে ছাড়িয়ে আরো দূরে আমাদের পৌঁছে দেয়, একটা পেরিয়ে আসা সময়ের কাছে। অনেকেরই ছোটবেলার ছায়া পড়বে এর পাতায়-পাতায়। আমরা পৌঁছে যাই একটি আদর্শ-উজ্জ্বল, বিনয় এবং আত্মবিশ্বাসের দুর্মূল্য ছন্দে বাঁধা জীবনযাপনের সূত্রের কাছে। আমার আন্তরিক অভিনন্দন সাক্ষাৎকার-গ্রাহক লেখক আবুল আহসান চৌধুরীকে। অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা মীনাক্ষীকে। লেখক ও কথক, দুজনেরই কর্মময় দীর্ঘজীবন কামনা করি। আর সেসঙ্গে স্মরণ করি, মীনাক্ষীর জীবন অনেকের অনুপ্রেরণা হতে পারে।’ [ভূমিকা] নবনীতা যে অনুপ্রেরণার আশা করেছেন, সেটিই এই গ্রন্থপাঠের উদ্দেশ্য হতে পারে। আর চলিহা পরিবারের ইতিহাস তো রইলই গল্পের রঙে আঁকা। নতুন কোনো গবেষক নতুন আঙ্গিকে এই পরিবার নিয়েও এখন গবেষণা করতে পারেন। আর দেবযানীর নৃত্যকলা নিয়ে গবেষণা করতে গেলেও এই গ্রন্থ হবে তার অবশ্যমান্য উৎস। আবুল আহসান চৌধুরীর কৃতিত্ব এই যে, তিনি প্রাথমিক উৎস থেকে তথ্য গ্রহণ করেন, তা হয়ে ওঠে আরো নতুন গবেষণার পথনির্দেশনা। r