মতিলাল শীল : সময় ও তাঁর অনন্যতা

রা  মমোহন রায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম এক অগ্নি-পরিধির যাত্রী। প্রথম প্রমিথিউস, যিনি আলোকবর্তিকা নিয়ে ফিরেছেন নিষ্ঠুর বিধিনিষেধের নিগড়ে পিষ্ট সমাজের অলিন্দে অলিন্দে। বলা চলে, তিনিই প্রথম মান্য Argumentative Indian। যুক্তির আঘাত দিয়ে ছিঁড়তে চেয়েছেন সমাজের প্রচলিত রীতি ও নীতি। আমরা জানি, চিরটাকাল এই সমাজে ভক্তির যূপকাষ্ঠে যুক্তিকে বলি দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে কঠিন ছিল তাঁর পথচলা। তারপর বিদ্যাসাগর এসে রামমোহনের শুরু করা কাজকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বে। রামমোহনে আরম্ভ এবং বিদ্যাসাগরে পরিণতি। শেষ নয়। সমাজের আঁধার এখনো গেছে সবটুকু এমন দাবি করা যাচ্ছে না। বরং আবার অন্ধকার গাঢ় হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আমাদের চেনা-চৌহদ্দিতে রোজই প্রত্যক্ষ করছি আমরা। এমন সময়ে এইসব প্রণম্য অগ্নির মুখোমুখি হওয়া ভীষণই জরুরি মনে হয়। তাঁরা সমাজকে ভেঙেছেন বারবার আবার নতুন করে গড়বেন বলে। রবীন্দ্রনাথ চারিত্রপূজা বইয়ের লেখাগুলোয় বারবার এঁদের কাছে আমাদের ঋণের কথা স্মরণ করেছেন। অবশ্য আমাদের ঋণ রয়েছে আরো একজনের কাছে। তাঁর অবস্থান রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মধ্যবর্তী সময়ে। তিনি মতিলাল শীল। অন্য দুজনের কাজের সঙ্গে তাঁরও নানান উদ্যোগের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায় তৎকালীন সমাজ প্রতিন্যাসে। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থে রামতনুর আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন প্রমুখের পাশে এই মতিলাল শীলের কথা গুরুত্ব দিয়ে উলেস্নখ করেছেন। আর বিনয় ঘোষ বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ গ্রন্থে তাঁকে নবযুগের কাণ্ডারি হিসেবে দেখেছেন। বাংলার সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনায় এই দুটি বইয়ের গুরুত্ব অনেক।

 

জন্ম : সম্প্রদায় পরিচয় : বিবিধ বিষয়

মতিলাল শীল (১৭৯২-১৮৫৪) জন্মেছিলেন সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা চৈতন্যচরণ শীলের কাপড়ের ব্যবসা ছিল তখনকার চীনাবাজারে। কিন্তু তিনি পিতাকে হারান মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। এক আত্মীয়ের সংসারে বাস করলেও লেখাপড়ার সুযোগ বেশি পাননি তিনি। অবশ্য তখন পড়াশোনার সুযোগও ছিল খুব সীমিত। পাঠশালায় তিনি বাংলা ভাষা ও শুভঙ্করের অঙ্ক প্রণালি মন দিয়ে আয়ত্ত করেন। কিছুকাল পড়েন Martin Bowl-এর ইংরেজি স্কুলে এবং পরে নিত্যানন্দ সেনের বিদ্যালয়ে। তখনো গৌরমোহন আঢ্যের উদ্যোগে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেই সময়ে কয়েকজনের ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় কলকাতার বিভিন্ন অংশে ইংরেজি শিক্ষাকেন্দ্র তৈরি হতে শুরু করেছে। সামান্য ইংরেজি জানলে কোম্পানির আপিসে কাজ পাওয়া যেত। মতিলাল শীল খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করতে না পারলেও তাঁর বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা ছিল প্রখর। ইংরেজ কোম্পানির অধীনে সামান্য বেতনে কিছুকাল তিনি চাকরি করেন। তারপর অল্প পুঁজি নিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করে শিখরে উঠেছিলেন। বাঙালি চিরকাল মেতে থেকেছে সাহিত্য, ধর্ম, সংগীত, রাজনীতি ও ফুটবল নিয়ে। নিত্যদিনের চর্চায় গুরুত্ব পায়নি অর্থকরী ব্যাপার নিয়ে আলাপ-আলোচনা। অর্থের পাশ কাটিয়ে অনর্থ ডেকে এনেছে জাতীয় জীবনে। আত্মবিস্মৃত বাঙালি তার আত্মঘাতী প্রবণতায় একদিন ভুলেও গেছে মতিলাল শীলকে।

এই মতিলাল শীলের পূর্বপুরুষরা বিহারের রামগড় থেকে ব্রহ্মপুত্রতীরের সুবর্ণগ্রাম হয়ে চলে আসেন হুগলির সপ্তগ্রামে। তাঁরা ছিলেন মূলত স্বর্ণব্যবসায়ী। মতিলালের পিতা চৈতন্যচরণ শীল সপ্তগ্রাম থেকে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন কলুটোলা অঞ্চলে। আর সেখানে মতিলালের জন্ম হচ্ছে জোর চার্ণকের আগমনের ঠিক একশ বছর পরে। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাবের পতন হয়েছে চৌত্রিশ বছর আগে। আর তখন বাংলার গভর্নর ছিলেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। দু-বছর পরে হবে জমিদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কিশোরী চাঁদ মিত্র লেখেন, কলকাতায় তখন দস্যু মোহনের বেজায় দাপট। ইংরেজ সরকারও তাকে বাগে আনতে পারছে না। চৈতন্যচরণ শীল মাথা খাটিয়ে দস্যু মোহনকে ধরিয়ে দেন ইংরেজদের হাতে। তাঁকে পুরস্কৃত করে ইংরেজ সরকার এবং সাধারণ মানুষ সাধুবাদ জানায়।

এই সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের কথা একটু বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। সুবর্ণগ্রামে বসবাসের আগে তাঁরা থাকতেন অযোধ্যার কাছে রামগড়ে। দশম-একাদশ শতকে এই বৈশ্য সম্প্রদায় সনক আঢ্যের নেতৃত্বে তখনকার বঙ্গদেশের রাজা আদিশূরের অনুমতিতে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে সুবর্ণগ্রামে আশ্রয় নেন। বলা হয়, রামগড় থেকে তাঁরা বিতাড়িত হয়েছিলেন বৌদ্ধদের অত্যাচারে। এই বৈশ্য সম্প্রদায় স্বর্ণ-ব্যবসায় পারদর্শী ছিল। রাজা তাম্রফলকে উৎকীর্ণ করে এই সম্প্রদায়ের নামকরণ করেন ‘সুবর্ণবণিক’ আর তাঁদের বাসস্থানের নাম দেন ‘সুবর্ণগ্রাম’। এই বণিকদের মধুকর ডিঙা পাড়ি দিত সমুদ্র পেরিয়ে ব্রহ্মদেশ, জাভা, সুমাত্রা, বালি, বাগদাদ, রোম ও চীনেও। তখনকার বাংলার বস্ত্রশিল্প ছিল পৃথিবীবিখ্যাত।
এই বণিকেরা সোনার সঙ্গে কাপড়ের ব্যবসাও করতেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আমরা পড়েছি – ‘বাংলার মসলিন, বাগদাদ-রোম-চীন/ কাঞ্চন তৌলে কিনতেন একদিন।’

মতিলাল শীলের জন্মের দুশো বছর পূর্তিতে যে-স্মরণিকা বের হয় তাতে শ্যামল দাস লিখেছেন –

১১৫৮ সালে বলস্নাল সেনের উত্থানে বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক চরম শৃঙ্খলার নামে স্বৈরাচারিতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ ছিলেন বলস্নভানন্দ আঢ্য। তিনি ছিলেন সনক আঢ্যের প্রপৌত্র। বলস্নাল সেন বলস্নভানন্দের কাছ থেকে দেড় কোটি নিষ্ক বা স্বর্ণমুদ্রা কর্জ চাইলে বলস্নভানন্দ কর্জের পরিবর্তে হরিকেনের রাজস্ব আদায়ের সনদ চান। ক্ষুব্ধ রাজা বলস্নভানন্দ তথা সুবর্ণবণিকদের জব্দ করতে এক গভীর চক্রামেত্ম লিপ্ত হলেন। ডোমকন্যা বিবাহের প্রায়শ্চিত্তের জন্য বা মতান্তরে মাতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে বলস্নাল সেন এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। যজ্ঞে ব্রাহ্মণকে দানকৃত স্বর্ণ-গাভীর মধ্যে অলক্ত পুরে দিয়ে সুবর্ণবণিক কোন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছে এক ব্রাহ্মণকে পাঠানো হয়, ঐ আলতা ভর্তি
স্বর্ণ-গাভী বিক্রয় করতে। স্বর্ণ ব্যবসায়ী বণিক পরীক্ষার নিমিত্ত স্বর্ণ-গাভীকে ছেনি দিয়ে কাটলে লাল রঙ বেরিয়ে পড়ে। বলস্নাল প্রেরিত ব্রাহ্মণ প্রচার করেন যজ্ঞে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত স্বর্ণ-গাভীকে সুবর্ণবণিক হত্যা করেছে। গো-হত্যাজনিত অপরাধের শাসিত্ম হিসাবে রাজা বলস্নাল বৈশ্য সুবর্ণবণিকগণকে জোরপূর্বক শূদ্রে পরিণত করে ফরমান জারি করেন। বৈশ্য সুবর্ণবণিকগণ পরিণত হয় হাড়ি, ডোম, মুচি, মেথর প্রভৃতি প্রায় অমত্ম্যজ শ্রেণির জল-অচল শূদ্রে।

অযোধ্যায় যে বৈশ্য সম্প্রদায় ছিলেন তাঁরা সনক আঢ্যের       নেতৃত্বে সুবর্ণগ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা ছিলেন রুচি, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধন-সম্পদে সমৃদ্ধ। … এহেন সুবর্ণবণিকেরা বলস্নাল সেনের খামখেয়ালিতে শূদ্রে পরিণত হলে বহু সুবর্ণবণিক সুবর্ণগ্রাম ছেড়ে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেন। একদল চলে যান উড়িষ্যার হিন্দুরাজা প্রতাপরুদ্রের রাজ্যে। একদল চলে যান তাম্রলিপ্ত ও সপ্তগ্রাম বা হুগলিতে। বঙ্গে যারা থাকলেন তাদেরকে উপবীত ত্যাগ করে বাধ্য হয়ে শূদ্রের আচার নিয়মে জীবন অতিবাহিত করতে হল। এ যুগের মানসিকতায় সে যুগের কথিত শূদ্র সম্প্রদায়ের আচার আচরণকে বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঐ সম্প্রদায়ের সম্পর্ককে বোঝা যাবে না। হাড়ি, ডোম, মুচি, মেথর ইত্যাদি অমত্ম্যজ শ্রেণীর মতই এই সম্প্রদায়ের মানুষের হাতের জল অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে চলত না।

… এহেন দুঃসহ লজ্জা-ঘৃণার মধ্যেও ‘বঙ্গের সওদাগর’ মতিলাল শীল সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও কিভাবে এক দরিদ্র যুবক হতে বাঙলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হয়ে সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন শাখায় সযত্নে হাত লাগিয়ে সমাজ প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন – স্বল্পশিক্ষিত লোক হলেও যাঁর কথায় ও কাজে রেনেসাঁর মূল সুর গভীর মূর্ছনায় ধ্বনিত হয়েছে সেটাই আজ বিশেস্নষণ আশু প্রয়োজন।

১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সপ্তগ্রামে ৩৯০ ঘর সুবর্ণবণিক বাস করতেন। সেখানকার সমৃদ্ধ মানুষের অধিকাংশ ছিলেন এই সম্প্রদায়ের। চৈতন্যদেব সপ্তগ্রাম পরিভ্রমণ করার সময় জমিদার দিবাকর দত্তকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেন। মতিলাল শীলের পূর্বপুরুষেরাও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন। বলস্নাল-নির্দেশিত পতিত থেকে দিবাকর দত্তের মাধ্যমে উদ্ধার লাভ করলে সুবর্ণবণিকেরা দিবাকর দত্তের নাম রাখেন উদ্ধারণ দত্ত। মনে রাখতে হবে, মতিলালের পিতার নাম চৈতন্যচরণ শীল।

 

উদ্যোগপতি মতিলাল

আমরা কবিতায় পড়েছি ‘বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী’, কিন্তু কাজে নামিনি। নেওয়া হয়নি উদ্যোগ। দিন কেটেছে নিবিড় অলসতায়। নিশ্চিন্ত মাস মাইনের একটা চাকরিই আজ আমাদের শ্রেষ্ঠতম চাওয়া। বাণিজ্য একটা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা কিন্তু সম্ভাবনাময়। সেখানে সফলতার জন্য দরকার দূরদৃষ্টি, সততা, সাহস, ধৈর্য ও কা-জ্ঞান। আমাদের অধিকাংশ জনেরই এসব গুণ থাকে না। মতিলালের ছিল। তিনি সফল হন। তখনকার মানুষদের সফল হওয়ার একটা পূর্বশর্ত ছিল ইংরেজ ঘনিষ্ঠতা ও আনুগত্য। তিনি ইংরেজ কোম্পানিতে চাকরি করেছেন এবং তাদের সঙ্গে ব্যবসা করেছেন; কিন্তু পদলেহন করেননি। সবসময় চলেছেন আত্মমর্যাদা রক্ষা করে। তিনি ব্রিটিশদের দেওয়া রাজা, মহারাজা, রায়বাহাদুর, স্যার ইত্যাদি খেতাব গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলেন না। সমসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যা এক বিরল ব্যতিক্রম।

মাত্র সতেরো বছর বয়সে ১৮০৯ সালে সুরতী বাগানের মোহন চাঁদ দে-র কন্যা নাগরী দাসীর সঙ্গে মতিলালের বিয়ে হয়। বিবাহের পর মোহন চাঁদ কন্যা, জামাতাসহ পরিবারের অন্যদের নিয়ে পানসি নৌকায় ভ্রমণে যান কাশী, গয়া, বৃন্দাবন, মথুরা, জয়পুর দর্শনে। মতিলাল এই ভ্রমণ থেকে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফেরেন। এবার সংসারযাত্রার পালা। অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে চীনা বাজারে তাঁদের কাপড়ের দোকান। জীবনের দুরূহ পথে চলা সহজ নয়, বিশেষ করে অভিভাবকদের অবর্তমানে এবং তিনি ১৮১৫ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে কর্মচারী হয়ে যোগ দেন। পরে গুদাম-সরকার হন। এখানে তিনি দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করেও কিছু বাড়তি রোজগার করতেন। ফোর্ট উইলিয়ামের কাজে ইস্তফা দিয়ে তিনি কিছুদিনের জন্য বালিখালের কাস্টমস দারোগার চাকরি করেন।

কিন্তু ব্যবসায় ছিল তাঁর তীব্র অনুসন্ধিৎসা। সামান্য মূলধন নিয়ে শুরু করলেন উদ্যোগ। ১৮১৯ সালে এক জায়গায় অত্যন্ত কমদামে প্রচুর খালি বোতল বিক্রি হচ্ছে দেখে বুদ্ধি করে সব কিনে নেন। কিছুদিনের মধ্যেই একটি বিয়ার কোম্পানি তাঁর বোতল বেশি দামে কিনে নেয় এবং মতিলালের যা লাভ হয় তা দিয়ে ঋণ শোধ করেও ব্যবসার একটা পুঁজি তৈরি হয় তাঁর। এই যে ঠিক সময়ে কমদামে কিনে সঠিক সময়ে চড়া দামে বেচে দেওয়া এটাই মুনাফার প্রাথমিক প্রক্রিয়া। তার জন্য বুদ্ধি লাগে এবং তা ছিলও তাঁর। আর ছিল সাহস করে নেমে পড়ার মানসিকতা। ইউরোপীয় বণিক সমাজে মতিলালের  পরিচিতি বাড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ১৮২০ সালে ইংল্যান্ডে ফ্রি ট্রেড আইন চালু হলো। ওই বছরই জন্মগ্রহণ করলেন বাংলার আরেক খ্যাতকীর্তি মনুষ্য বীরসিংহ গ্রামে। পরে তিনিও সিংহবিক্রমে অনেক বিধান ভাঙবেন নতুন সমাজ গড়ার জন্য। স্ট্যান্ড ফ্লাওয়ার মিলের বেনিয়ান হয়ে মতিলাল প্রচুর অর্থ উপার্জন করলেন। তিনি মেসার্স লিচ কেটেল অয়েল, লিভিংস্টোন সাইরেসেস অ্যান্ড কোং, ম্যাকলিয়ড ফ্যাগান অ্যান্ড কোং, চ্যাপম্যান কোং, টুলো অ্যান্ড কোং, র‌্যালি ম্যাভ্রোজানি, ওসওয়াল্ড শীল অ্যান্ড কোং, কোলসাল অ্যান্ড কোং প্রভৃতি কোম্পানির বেনিয়ান হিসেবে কাজ করেন। এভাবে প্রায়
১৪-১৫ বছর তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর বেনিয়ান হিসেবে কাজ করেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। বিদেশি জাহাজের অধ্যক্ষরা আমদানি করা সামগ্রী বিক্রি করার জন্য তাঁর ওপর নির্ভর করতেন। প্রতিভার গুণেই তিনি এ-সুযোগ পান। তাছাড়া এদেশীয় বাজার থেকে সস্তায় দেশীয় দ্রব্যসামগ্রী ইউরোপীয় বণিকদের ক্রয় করে দেওয়া সেকালে তাঁর মতো আর কেউ পারতেন না। এইভাবে মতিলাল এদেশীয় ও বিদেশীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে একটা যোগসূত্রের কাজ করেছেন। আর অর্থ রোজগার করেছেন প্রচুর।

মাঝে একটা সমস্যার উদয় হলো। এতদিন পর্যন্ত এই দেশের বণিকদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশি বণিকরা ব্যবসা করতেন। দেশীয় বণিকরা খেয়াল করলেন যে, তাঁদেরই টাকা খাটিয়ে বিদেশিরা মুনাফা করছেন তাঁদের থেকে অনেকগুণ বেশি। দেশীয় বণিকরাও আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করলেন। বাজার দখল নিয়ে দেশীয় ও বিদেশি বণিকদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা দেখা দিলো। পুঁজির অভাবে অনেক বিদেশি বণিকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক ইউরোপীয় কোম্পানি প্রভূত লোকসান করতে বাধ্য হলো। Calcutta Review পত্রিকায় বিস্তারিত বিবরণ ছাপা হয়েছে।

কথায় বলে, কারো সর্বনাশ কারো জন্য সুযোগ ডেকে আনে। এদেশীয় বণিকদের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের প্রচ- আগ্রহ তৈরি হলো। অনেকে বিশাল সম্পদের মালিক হলেন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। তাঁদের মধ্যে মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামদুলাল দে, নিমাইচরণ দত্ত, প্রাণকৃষ্ণ লাহা, অক্রূর দত্ত, সাগরলাল দত্ত প্রমুখের নাম বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। মতিলাল এদেশ থেকে রেশন, নীল, চিনি, সোরা, চাল ইত্যাদি ইউরোপীয় বাজারে রপ্তানি করতেন এবং ইউরোপ থেকে আমদানি করতেন বিলাতি কলে তৈরি বস্ত্র ও লৌহজাত সামগ্রী। বাংলার বাণিজ্যক্ষেত্রে জোয়ার এসেছে তখন। পুরাকালের গৌরব ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো আবার।

বাংলার বণিকরা যে নানা দেশে বাণিজ্য করতে যেতেন তার উলেস্নখ আমরা হিউয়েন সাং, মেগাস্থিনিস, ইবন বতুতা, আলবিরুনি প্রমুখ বিদেশি পর্যটকের বিবরণ থেকে জেনেছি। মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে বাঙালি বণিকদের সমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ধনপতি সদাগর আমি বসি হে উজানী,/ গন্ধ বণিক জাতি বিদিত অবণী।’ ধনপতি সদাগরের পিতৃশ্রাদ্ধ উপলক্ষে ‘সাতশত বেনে আইসে ধনপতি ধাম’ – তাঁদের মধ্যে চম্পকনগরের চাঁদ সদাগরও ছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বেনের মেয়ে উপন্যাসে বাংলার বণিকদের বিদেশযাত্রার কথা পাওয়া যায়। তাছাড়া সেখানে রয়েছে দেশে তৈরি বাণিজ্যতরির বিসত্মৃত বর্ণনা।

মনে রাখতে হবে, বণিকদের বৈদেশিক বাণিজ্যের কারণে দেশ হয়েছিল সমৃদ্ধ। মাঝখানে রইল কয়েক বছরের বাণিজ্যের বন্ধ্যা সময়। গুটিয়ে গেল এদেশি বাণিজ্যের ধারা। বৈশ্য বণিকদের ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে ঈর্ষায় ও ক্ষোভে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণরা তাঁদের ‘বেদ পাঠে ও শ্রবণে বিধিনিষেধ আরোপ করেন। নিষিদ্ধ হলো সমুদ্রযাত্রা। দশম শতাব্দীতে আলবিরুনি লিখছেন – ‘The Brahmins teach the Vedas to the Kshatriyas. The latter learn it, but are not allowed to teach it, not even to a Brahmin. The Vaisya and Sudra are not allowed to hear it much less to pronounce and recite it. It such a thing can be proved against one of them, the Brahmin drag him before the magistrate and he is punished by having his tounge cut off.’

(Al Berunis India, Translated by E.C. Sachau. Vol.1, P 125)

 

খালি বোতলের ব্যাপারি থেকে জাহাজের সওদাগরি

কালাপানি পার হওয়া নিষিদ্ধ হওয়ায় দেশীয় বণিকদের পরিবর্তে ভারতবর্ষের বৈদেশিক বাণিজ্যে আরব ও ইউরোপীয় বণিকেরা একচেটিয়া কারবার করেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে দীর্ঘ অমানিশা কাটল। এই সময় বাংলার বহির্বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিলেন মতিলাল শীল। তিনি জাহাজের কারবারে মন দিলেন। তিনি ছোট ও বড় মিলিয়ে বারো-তেরোটি জাহাজের মালিক হলেন। দেশি পণ্য নিয়ে তাঁর জাহাজ ভিড়েছে পৃথিবীর নানান বন্দরে এবং ফিরেছে সেসব দেশের সামগ্রী নিয়ে।

মতিলাল শীলের বড় মেয়ের নাম ছিল রাজরানী। তিনি আহ্লাদ করে কলকাতায় নির্মিত একটি জাহাজের নাম রেখেছিলেন মেয়ের নামে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও তখন জাহাজ তৈরি করছেন গার্ডেনরিচে। তাঁরও আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা বুয়েন্স, নিউইয়র্ক, গোটা ইউরোপ, চীন, জাপান জুড়ে। মতিলালও থেমে থাকলেন না। অন্যদের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন এবং তৈরি করলেন বাষ্পীয় পোত বা জাহাজ, যা এদেশে প্রথম এবং পথিকৃৎ মতিলাল শীল। ধনপতি সদাগর ও চাঁদ সদাগর আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের যে-ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন দ্বারকানাথ ও মতিলালে এসে তা পরিণতি পেল।

তবে ব্যবসায় বাঙালির সুদিন থাকল না বেশিকাল। আগেই বলা হয়েছে, দেশি ও বিদেশি পুঁজিপতিদের মধ্যেকার বিরোধে বিদেশি বণিকরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ইংরেজ শক্তির আনুকূল্য পেল। দেশীয় উদ্যোগপতিরা পড়ল তাঁদের রোষানলে। ঠিক এই সময় বাঙালি বণিকদের জায়গা দখল করে রাজস্থানি ও গুজরাটি বণিকেরা। তাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ইউরোপীয় বণিকদের দিকে। একই কাজ তাঁরা পরেও করবে। আমরা দেখব ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সময় বাঙালি দোকানদাররা যখন ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশ পণ্য বিক্রি বর্জন করেছে, পিকেটিং করেছে তখন কলকাতা শহরেই গুজরাটি ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা তাঁদের সামগ্রী সাগ্রহে কেনাবেচা করেছে এবং মুনাফা করেছে প্রচুর। ক্রমে রাজস্থানি ও গুজরাটি বণিকেরাই ইংরেজদের বেনিয়ান ও মুৎসুদ্দিতে পরিণত হয়। বাংলার বণিকদের রমরমা কমে আসে খোদ বাংলায়। আর এও তো ঠিক, সর্বকালে রাজার সঙ্গে বণিকদের সখ্য থাকে। পরস্পর স্বার্থ সম্পর্কে যুক্ত। বণিকরা রাজশক্তিকে দেখে আর রাজশক্তি দেখে বণিকদের। আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতির দিকে দৃষ্টি দিলে বলতে হয় – ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’ শুধু কুশীলবদের বদল ঘটে এই যা। বাংলার অর্থনীতিতে দখল নিল জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদের দল।

 

তখন মতিলাল ও অন্যরা যা করলেন

রামদুলাল দে, সাগর লালদত্ত, মতিলাল শীল, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ বণিক অবস্থা কিছুটা সামাল দিলেও ঊনবিংশ শতকের শেষাংশে এসে বাংলার ব্যবসায়িক আধিপত্য হাতছাড়া হয়ে গেল। বাণিজ্য অর্থনীতি ঘুরপাক খেতে লাগল গুজরাটি ও মাড়োয়ারি পুঁজির চারদিকে। ভারতের সবচেয়ে কেন্দ্রীভূত বাজার কলকাতার বড়বাজার সুবর্ণবণিক ব্যবসাদারদের হাত থেকে মাড়োয়ারিদের দখলে চলে গেল। ক্রমে কাশিমবাজার, হুগলী ও কলকাতায় তাদের আধিপত্য বিসত্মৃত হলো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মাড়োয়ার থেকে আসা এই ব্যবসায়ীরা ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, কলকাতাসহ সর্বত্র রাজশক্তির প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা করেছে এবং সফলও হয়েছে তাদের কৌশল। বাংলার ব্যবসায়ীরা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন ইংরেজ সরকারের। বেনিয়ানের কাজ বা বহির্বাণিজ্য ছেড়ে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেন। অনেকেই জমিদারি কিনলেন। কেউ কেউ শহর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ি বানিয়ে ভাড়া খাটানোর ব্যবসা শুরু করলেন। মতিলাল শীলও ব্যবসা গুটিয়ে জমিদারি কিনলেন মঙ্গলঘাট, বাগনান ও মহিষাদলে। কলকাতায় বহু বাড়ি কিনে ও বানিয়ে রোজগারের চেষ্টা করলেন। আজকের প্রমোটারি বিজনেসের মতো আর কি! জ্যাকসন সাহেবের কাছ থেকে ধর্মতলা বাজারও ক্রয় করেন। তা নিয়ে বিস্তর গ-গোল হয় সে-সময়। তবে বাণিজ্যে বাংলার সুবর্ণসময় আর ফিরে এলো না। পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালি উদ্যোগ নিতে জোর পেল না। একসময় তাঁরা বড়বাজারে মাড়োয়ারি দোকানে হিসাবের খাতা দেখার কাজে ব্রতী হয়ে নিশ্চিন্ত মাস মাইনের তৃপ্তিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। তারপর তো এক মহা অন্ধকার! মধ্যে প্রফুলস্নচন্দ্র এসে চিৎকার করে জাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

 

ধনী মতিলালের কীর্তিসমূহ

মতিলালের যৌবনকাল বাংলার চিমত্মাজগতের বিরাট তোলপাড়ের মধ্যে কেটেছে। রাজা রামমোহন রায় ১৮১৪ সালে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। স্থাপন করলেন ‘আত্মীয় সভা’, যা পরে ব্রাহ্ম সমাজে রূপ নেবে। দ্বারকানাথ যোগ দিলেন রামমোহনের পৌত্তলিকতাবিরোধী আন্দোলনে। ডেভিড হেয়ারও ধর্ম সংস্কারের জন্য সভা-সমিতি করে বেড়াচ্ছেন। নতুন যুগের সূচনা হয়েছে ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সেখানে ডিরোজিও লক ও হিউমের মানবতাবাদী দর্শনে ছাত্রদের দীক্ষিত করছেন। তাঁরা কূপম-ূকতা ও কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলছে। সবকিছুকে যুক্তির নিরিখে যাচাই করে দেখার প্রবণতা বাড়ছে।

 

সতীদাহ রদ করা

এতদিন ধর্মের নামে বেদামেত্মর দোহাই দিয়ে স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকেও চিতায় সহমৃতা হতে হয়েছে। মানবসভ্যতার অন্যতম বর্বর এই প্রথা। দেখা যাচ্ছে, ১৭৯৯ সালে নদীয়ার এক কুলীন ব্রাহ্মণের ২২টি স্ত্রীকে এবং শ্রীরামপুরে আরেক কুলীনের ৪০টির মধ্যে ১৮টি জীবিত স্ত্রীকে জোর করে সহমৃতা করানো হয়। ১৮০৪ সালে কলকাতায় সহমৃত হন তিনশো বিধবা এবং ১৮১২ সালে কাশিমবাজারে সহমৃত হন ৭২ জন। মানুষের এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও বেদনা প্রকাশ পেল রামমোহনের মধ্যে। সতীদাহবিরোধী আন্দোলন প্রবল হলে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর Sati Regulation Act পাশ হয় ব্রিটিশ শাসক উইলিয়াম বেন্টিংয়ের হস্তক্ষেপে।

তবে এর বিরোধী আন্দোলনও কম শক্তিশালী ছিল না। Sati Regulation Act-এর বিরোধিতা করেন অনেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু গোঁড়া সমাজপতি। এঁদের মধ্যে ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, মহারাজা কালীকৃষ্ণ ঠাকুর, গোপীমোহন দেব প্রমুখ। সতীদাহ প্রথা রদ আইনের বিপক্ষে তাঁরা ‘ধর্মসভা’ নামে এক সভার আয়োজন করেন ১৮৩০ সালে কলুটোলায় মতিলালের বাড়ির কাছে। তাঁকে ডাকা হয় ওই সভায়; কিন্তু তাঁর মানসিকতায় ওই সামাজিক হিংস্র কুসংস্কারের প্রতি ছিল তীব্র ঘৃণা। তিনি হয়তো লক, হিউম, বার্ক বা টমাস মান পড়েননি, তবে সাধক বৈষ্ণব কবির বাণী ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ তাঁর হৃদয়ে অনুরণিত হয়েছে। বৈষ্ণব মতিলাল জানতেন, চৈতন্যদেব মানুষকে ভালোবেসে সত্যের জয়গান গেয়েছেন। মতিলাল ওই ‘ধর্মসভাকে অধর্মসভা’ বলে ভৎর্সনা করেন। কিশোরী চাঁদ মিত্র লিখেছেন

… The operations of the shava were confined to the arrestation of progress and the excommunication of progressive men. Happily for the country, their efforts proved ineffectual and abortive.

পরে এই ‘ধর্মসভা’ আর কখনো হয়নি। ওই সভার আহবায়কদের তিনি ডাক দেন অনাথ ও বিধবাদের দুঃখ মোচনের জন্য ‘সাহায্যভাণ্ডার’ গড়ার এবং তাতে তিনি নিজে ত্রিশ হাজার টাকা দান করলেও অন্যরা সাড়া দেননি। রামমোহনের সতীদাহবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে মতিলাল প্রকৃত বন্ধুর কাজ করলেন।

 

বিধবা বিবাহ সমর্থন

সহমরণ থেকে বাঁচলেন কিন্তু সমাজে বিধবাদের লাঞ্ছনার শেষ হলো না। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে এদেশে মহিলাদের সম্মান ও মর্যাদা ছিল না। শোনা যায়, অষ্টাদশ শতকে রাজা রাজবলস্নভ নিজের বিধবা কন্যার দুঃখে ব্যথিত হয়ে তাঁর বিবাহের প্রয়াসী হন। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিরোধিতায় সে-বিবাহ হতে পারেনি। সহমরণ রদ হওয়ার পর বিধবা বিবাহের সমর্থনে চিমত্মা পুঞ্জীভূত হতে থাকে। রামমোহনের হঠাৎ মৃত্যুতে তা ধাক্কা খেল। মতিলাল শীলই প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজের সর্বস্তরে বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য প্রথম বিধবা বিবাহকারীকে বিশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর নিজের মতো করেই বিধবা বিবাহ-আন্দোলন করার চেষ্টা করেছেন। ১৮৩৭ সালের ২৯ এপ্রিল সমাচার দর্পণ লিখেছে –

আমরা আহ্লাদপূর্বক পাঠকবর্গকে ও সর্বসাধারণকে জ্ঞাত করিতেছি এতদ্দেশীয় কতিপয় সমৃদ্ধ সুবুদ্ধি ব্যক্তিরা পরামর্শ করিয়াছেন এক সভা করিবেন তাহার অভিপ্রায় এই যে বহুকালবধি যে সকল কুনিয়মেতে নীতি ব্যবহার মন্দ করিয়াছে … ঐ সকল নিয়ম পরিবর্তন করিতে হইবেক। আমরা শুনিলাম সভার প্রধান কার্য্য এই যে, এতদ্দেশীয় সম্ভ্রান্ত স্ত্রী লোকদিগের বিদ্যাশিক্ষার্থ চেষ্টা করিবেন এবং ব্রাহ্মণ দিগের কুপরামর্শতে শিশু কালাবধি বিধবা বিবাহ নিষেধ বিষয়ে যে কুসংস্কার হইয়াছে তাহাও বিনষ্ট করিতে হইবেক।

আবার ওই সমাচার দর্পণের ১৮৪০ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারির পাতায় আমরা পড়ি –

শ্রীযুত বাবু মতিলাল শীল এই বিধবা স্ত্রীগণের পরম বন্ধু, কারণ কিয়ৎকাল হইল উক্ত বাবুজী বিধবাদিগের বিবাহার্থ অত্যন্ত উদ্যোগ করিয়া ছিলেন।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মতিলাল ১৮৩৭-৪০ সালের মধ্যে বিধবা  বিবাহের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের বয়স তখন ১৭ থেকে ২০ বছর। আর ভারতবর্ষ পত্রিকার ১৩৩৮ সনের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় লেখা হয়েছে –

মতিলাল শীল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের বহুকাল পূর্বে তিনি হিন্দু বিধবার পুনর্বার বিবাহের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন যে যিনি সাহসপূর্বক সর্বপ্রথম বিধবা বিবাহ করিবেন তাঁহাকে তিনি কুড়ি হাজার টাকা দিবেন। এক ব্যক্তি এই পুরস্কার পাইয়া ছিলেন বলিয়া প্রকাশ।

বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ সালে বিধবা বিবাহ চালু হওয়া উচিত কি নাসে-বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন। তিনি ১৮৫৫ সালে ইংরেজ সরকারের কাছে আবেদন রাখেন। অনেক বিপত্তির পরে ১৮৫৬ সালের ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। মতিলাল দুবছর আগে গত হয়েছেন। বলা চলে মতিলালের আন্দোলন বিদ্যাসাগরের হাতে পরিণতি পেল।

 

প্রসঙ্গ : মেডিক্যাল কলেজ

মতিলাল শীলের অন্যতম অক্ষয় কীর্তি কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় অর্থ ও জমি দান। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগের কিছু পূর্বে ইংরেজ সরকারের প্রচেষ্টায় এবং দেশীয় ধনী ব্যক্তিদের উদ্যোগে কলকাতায় মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এগিয়ে আসেন প্রতাপ চন্দ্র সিংহ, সত্যচরণ ঘোষাল ও মতিলাল শীল। মতিলাল দিয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ভূখ- এবং এককালীন ১২০০০ টাকা। ওই উদ্যোগে জমি দানে তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ির দক্ষিণ-পূর্বদিকের বাগানের পুরোটাই চলে যায়। মেডিক্যাল কলেজের শতবার্ষিকী গ্রন্থে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে –

The matter of constructing a large hospital, in connection with the college, which have mosted and for which subscriptions had been raised for the last two or three years took a tangible form in this year by the presentation of a large piece of land in the vicinity of the college by Babu Mutty Lal Seal.

মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর এই দানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে রেখেছে – ‘Mutty Lal Seal word’ প্রতিষ্ঠা করে। অবশ্য তারও আগে মতিলাল অনেক টাকা দান করেন ‘ফিভার হসপিটাল’ প্রতিষ্ঠায়। তখনকার কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বর, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড লেগেই থাকত। এইসব রোগীর চিকিৎসার জন্য ফিভার হসপিটাল তৈরি হয়েছিল। সমাচার দর্পণ লিখেছে – ‘শুনিলাম শ্রীযুক্ত বাবু মতিলাল শীল কুষ্ঠু রোগীদের বাস নিমিত্ত মীর্জাপুরে একটি স্থান করিয়াছেন।’ আবার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের পূর্বে সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে একটি অস্থায়ী মেডিক্যাল কলেজ ছিল। সেখানে ত্রিশজন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করাতে পারতেন। সেখানকার ব্যয়ভারও বহন করতেন মতিলাল শীল। ১৮৪০ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারির সমাচার দর্পণ লিখেছে, ‘শ্রীযুক্ত বাবু মতিলাল শীল লক্ষমুদ্রা বার্ষিক ব্যয়ে ডাক্তার ওসাগ্রসী সাহেবের অধীনে গর্ভিণী স্ত্রী লোকদিগের উপকারার্থে এক চিকিৎসালয় স্থাপন করিয়াছেন।’ সেকালের সেই অন্ধ সংস্কারের যুগে তাঁর এই উদ্যোগ বিস্ময় সৃষ্টি করে।

তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন এদেশে গুণসম্পন্ন ডাক্তার তৈরি হোক। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির জন্য গোপালচন্দ্র শীলসহ দুজন ছাত্রকে ডাক্তারি পড়াতে নিয়ে যান বিলেতে। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রদের পড়াশোনায় উৎসাহী করতে মতিলাল ছাত্রদের মধ্যে পারিতোষিক বিতরণের জন্য দান করেছিলেন এক লাখ টাকা। লিটারারি গেজেটের ১৮৪০ সালের ২৯ ফেব্রম্নয়ারি সংখ্যায় এই সংবাদ মেলে। মনে রাখতে হবে, একালের মতো সেকালেও ধনী ব্যক্তিরা পিতৃ বা মাতৃশ্রাদ্ধে বা পুত্র-কন্যার বিবাহে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করতেন। সাধারণ লোকের দুরবস্থা লাঘব করতে অনেকেই এক কপর্দকও খরচ করতেন না। সমাচার দর্পণ থেকে জানা যায়, চিৎপুর থেকে কলুটোলা পর্যন্ত পাকা পয়ঃপ্রণালি করে দিয়েছিলেন মতিলাল নিজের খরচে। নিশ্চয় শহরের সাধারণ লোকের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে এ-কাজ করেন।

 

শীলস্ ফ্রি কলেজ

কলকাতায় প্রথম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৭৩১ সালে সেন্ট এন্ড্রুজ চার্চের পরিচালনায়। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ স্থাপনের পূর্বেও ২৫-২৬টি বিদ্যালয় চালু হয়েছিল মিশনারিদের ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে। আমরা জানি, ডিরোজিও পড়াশোনা করেন ডেভিড ড্রামন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে। মিশনারিরা শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হলেও এদেশীয়দের আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষাদানে ইংরেজ সরকার ছিল উদাসীন। ব্রিটিশ সরকারকে এ-বিষয়ে লেখা রামমোহনের বিখ্যাত চিঠির কথা আমরা জানি। ইংরেজি জানলে কাজ পাওয়া যেত। এই ভাষা শেখার আকাঙক্ষা ও দাবি নিয়ে ছেলের দল সাহেবদের পালকির পিছন পিছন দৌড় দিতে এবং করুণ মিনতি জানাত। এই ঘটনার সত্যতা মেকলের লেখা থেকেও জানা যায়।

মতিলাল বুঝেছিলেন, দেশের মানুষকে শিক্ষার মধ্য দিয়েই আত্মশক্তিতে জাগরিত করতে হবে। একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের সংকল্প করলেন এবং তা জেনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এক জেসুইট পাদ্রি তাঁর সঙ্গে দেখা করে বিবিধ সাহায্যের প্রতিশ্রম্নতি দেন। মতিলালও পাদ্রিদের শিক্ষকতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় দক্ষতার কথা স্বীকার করতেন। কলুটোলায় মতিলালের বাড়িতে ১৮৪৩ সালের ১ মার্চ একটা সভা হয় এই উপলক্ষে। ইয়ং বেঙ্গলদের মুখপত্র Bengal Spectator পত্রিকার মার্চ মাসের সংখ্যায় লেখা হয়েছে :

On Wednesday morning (10 O’clock) March the 1st, a very numerous and lightly respectable gathering of European and Native gentlemen (including seversal Ladies) took place at the house of Baboo Mutty Lal Seal for the Purpose of formally opening a college.

সেদিনের সভায় মতিলালের ডাকে কারা উপস্থিত ছিলেন সে-সম্পর্কেও পত্রিকায় লেখা হয় –

Among the party assembled at the opening ceremony were the chief Justice Sri J.P. Grant, the Advocate General, Principal member of the Bar, Baboo Dwarkanath Tagore, Captain Brich, Rev. K.M. Banerjee, George Tomson Esq, the Professors of St. Xavier’s College, J. Pattle etc.

বিদ্যালয়টির নাম রাখা হলো হিন্দু কলেজ অনুকরণে ‘শীলস্ কলেজ’ এবং ছাত্রদের বই, খাতা, কলম ইত্যাদি সাহায্য দেওয়া হলেও এক টাকা বেতন নেওয়া হতো। প্রথমে জেসুইট পাদ্রিরা শিক্ষা ও পরিচালন ব্যবস্থা দেখলেও পরে দেশীয় শিক্ষকদের ওপর সব দায়িত্ব অর্পিত হয়। মতিলাল এই বিদ্যালয়কে একসময় সম্পূর্ণ অবৈতনিক করে নাম দেন ‘শীলস্ ফ্রি কলেজ’। এটি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ওপর আজো বর্তমান। এই বিদ্যামন্দির মতিলাল বানিয়েছিলেন আলাদা একটা মুনাফার মাধ্যম হিসেবে নয়, মানবসেবার জন্য। এখন বিড়লা বা গোয়েঙ্কাদের মতো উদ্যোগপতিরা স্কুল বা নার্সিং হোম বানায় মুনাফার দিকে শ্যেনদৃষ্টি রেখে। এক্ষেত্রেও মতিলাল এক ব্যতিক্রম।

শীলস্ ফ্রি কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আদিত্যনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান সুরেন্দ্রনাথ দাস, প্রখ্যাত ডাক্তার মনি কুণ্ড‍ু, ইসকন প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণ দে, স্বামী প্রভুপাদ প্রমুখ। এভাবে জাতীয় জাগরণে মতিলাল অবদান রেখে গেছেন নীরব সেবায়।

 

গঙ্গার ধারে ঘাট : অতিথিশালা : কয়েদি মুক্তি : হীরাবুলবুল

সকালের আলো প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিষ্ঠাবান নরনারী গঙ্গায় অবগাহন সেরে পিতৃপুরুষের তর্পণ করেন। গঙ্গার স্নানার্থীদের দিকে দৃষ্টি ছিল মতিলালের। কলকাতায় গঙ্গার ধারে ভালো ঘাট ছিল না তখন। পুরনো নিমাই মল্লিকের ঘাটের খুব খারাপ দশা। হাওড়া ব্রিজের দক্ষিণে আরমানি ঘাটের কাছে তিনি স্থাপন করলেন একটি সুন্দর স্নানের ঘাট। এই ঘাটেই ১৮৫৪ সালের ২১ মে তাঁর জীবন দীপ নির্বাপিত হয়। তাঁরই ইচ্ছা অনুসারে।

মতিলাল শীল বংশানুক্রমে চৈতন্য অনুগামী পরম বৈষ্ণব ছিলেন। তিনি যেমন দুহাতে অর্থ উপার্জন করেছেন, তেমনি দরিদ্র-দুস্থ মানুষকে দান করেছেন অকাতরে। তখনকার দিনে দেশে খাদ্যের অভাব ছিল প্রকট। শহর কলকাতায় অনেক লোক দরিদ্র ছিল। তাছাড়া দুর্ভিক্ষ বা অন্য সময়েও বাইরে থেকে লোক আসত একমুষ্টি খাবারের জন্য। মতিলাল শীলের উদ্যোগে ধনী অথচ সমাজ হিতৈষণায় আগ্রহী ব্যক্তিদের একটি সভা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় কলকাতার চতুর্দিকে ১৬ মাইলের মধ্যে যেন কেউ অভুক্ত না থাকে তার ব্যবস্থা করা হবে। চোরা বাগানের মার্বেল প্যালেসের প্রতিষ্ঠাতা রাজেন্দ্র মল্লিক চাইলেন কলকাতার অন্নসত্রের ভার। মতিলাল শীল বন্ধুর আবেদনে সাড়া দিয়ে নিজে দায়িত্ব নিলেন কলকাতার উত্তর ও দক্ষিণে অতিথিশালা স্থাপনের। বেহালা ও বেলঘরিয়া অঞ্চলে দুটি বিশাল অতিথিশালায় প্রত্যহ তিন-চার হাজার মানুষ অন্ন গ্রহণ করতেন।

তিনি পূজা বা বিবাহ বা শ্রাদ্ধ উপলক্ষে বাড়াবাড়ি একদম পছন্দ করতেন না। অকারণ অপব্যয় না করে তিনি মানুষের দুর্দশা মোচনের জন্য অর্থদানে কৃপণতা দেখাতেন না। শারদীয় দুর্গাপূজার সময় কারাবন্দি দরিদ্র লোকদের টাকা দান করে কারামুক্ত করতেন। ওইসব পরিবারের মুখে হাসি ফুটত উৎসবের মরশুমে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হীরালাল শীলের বিবাহের সময় ঋণগ্রস্ত সকল কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে তিনি কারামুক্ত করেছিলেন বিশাল অর্থ ব্যয়ে। তাছাড়া তাঁরই নির্দেশে ও বদান্যে স্থাপিত ধনভাণ্ডার থেকে বহু অনাথ ও নিরাশ্রয় বিধবাকে সাহায্য করা হয় এখনো।

হীরাবুলবুল নামে এক পতিতাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সমাজে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। হিন্দু কলেজে তাঁর পুত্রকে পড়ার সুযোগ দেবে না পতিতার সমত্মান এই অজুহাতে। কয়েকজন সৎ ও সাহসী ব্যক্তি প্রশ্ন তুললেন, কেন সে বিদ্যা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। তাঁদের চেষ্টায় ছাত্রটি হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেও গোঁড়া হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে শিক্ষালয় থেকে তাড়াতে সচেষ্ট হন। তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকরসহ তখনকার পত্রপত্রিকায়। মতিলাল শীল পরামর্শ করলেন বউবাজারের রাজা রাজেন্দ্র দত্তের সঙ্গে। দুজনে গড়েন হিন্দু মেট্রোপলিটান কলেজ। এক পতিতার সমত্মান বিদ্যা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেখে মতিলালের সুস্থ বিবেক আজ থেকে দেড়শো বছরের বেশি আগে ব্যথিত হয়েছিল ভেবে আশ্চর্য হতে হয় এখনো। তিনি সামাজিক কালিমার তোয়াক্কা করেননি। কতটা ব্যতিক্রমী ও নিজের সময়ের থেকে এগিয়ে থাকলে একজন মানুষ এসব কাজে নামেন।

 

তোমার কথা কেহ যে বলে না

তখনকার দিনে যাঁরাই ধনে-সম্পদে প্রতিপত্তি লাভ করেছেন প্রত্যেকেই ধর্মের সিঁড়ি ধরে সামাজিক প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেছেন। এই মানসে তাঁরা মন্দির বা মসজিদ বানিয়েছেন। ‘কৈবর্ত রমণী’ রানী রাশমনিও দক্ষিণেশ্বরে মন্দির নির্মাণ করে সামাজিক ধাপের ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করেছেন। তারপর বাংলার প্রগতিবাদী আন্দোলনের অভিমুখ বদলে গেল। বিরাট খরচ করে মতিলাল মন্দির বানিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর ধর্মীয় জীবন সম্পর্কেও খুব বেশি তথ্য নেই। যেমন আমরা বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ সম্পর্কেও বেশি জানতে পারি না। মতিলালের মৃত্যুর পনেরো বছর পর ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বড়বাজারের Family literary club-এ কিশোরী চাঁদ মিত্র তাঁদের তেরোতম বার্ষিক অধিবেশনে মতিলাল সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন ‘The life and character of the late Baboo Mutty Lal seal’ শিরোনামে। এবং তা পুসিত্মকা আকারে প্রকাশ করে ‘The Trustees of the Estate of Baboo Mutty Lal seal’। সেখানে কিশোরী চাঁদ লিখেছেন :

He never tolerated the religious dodge, and considered it the worst, because the most dangerous of all dodges, enabling men to simulate virtue, and thereby influence and prey on the credulous. He believed that love to God and love to man constituted the quintessence of all real religion.

ওই পুসিত্মকার একেবারে শেষের পৃষ্ঠায় মতিলালের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আমাদের দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন :

His intense individuality alone raised him among the mass. The great lesson of his life is that
self-reliance and energy, industry and honesty, when directed in right channels, achieve great results. In a country where government is expected to do everything, and government employment is considered the ne plus ultra of life, it is necessary to hold up men like Mutty Lal Seal to the admiration and imitation of the rising generation.

১৮৬৯-৭০ সালে লেখা এই কথার সঙ্গে একমত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এখানেই মতিলাল শীলের অনন্য সার্থকতা।

 

সহায়ক তথ্যসূত্র

১. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, শিবনাথ শাস্ত্রী, নিউএজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

২.  বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৯৩, কলকাতা।

৩.           দ্বারকানাথ ঠাকুর : বিস্মৃত পথিক, কৃষ্ণ কৃপালনী, অনুবাদ : ক্ষিতীশ রায়, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, দিল্লি।

৪.  বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বিনয় ঘোষ, প্রকাশ ভবন, ২০০৭, কলকাতা।

৫.  বিদ্রোহী ডিরোজিও, বিনয় ঘোষ, প্রকাশ ভবন, কলকাতা।

৬. একাদশ অশ্বারোহী, শংকর, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা।

৭.  আপনার টাকা, সম্পাদনা : অমিতাভ গুহ সরকার, এবিপি প্রা. লিমিটেড, কলকাতা।

৮. দানবীর মতিলাল শীল : দ্বিশত জন্মবার্ষিকী সংকলন, শ্যামল দাস,  মতিলাল শীল ট্রাস্ট, কলকাতা।

৯.  Mutty Lall seal : Kissory chaund Mitter, Edited by Syamal Das, Toolat, Kolkata.

১০. Lectures From Colombo to Almora : Swami Vivekananda, Advaita Ashrama, Kolkata.