মথুরা পাখি

পাখিটাকে কেন যে তার বাসাতেই নিয়ে এসেছিল সেটা ভেবে কোনো কূল-কিনারা করতে পারেন না আরিফ সাহেব। তার রাত করে ঘুমানোর অভ্যাস। সকালে একটু দেরিতে ওঠেন। ভোররাতে দরজার বেল শুনে তাড়াহুড়া করে উঠে দরজা খুলতেই দেখেন একজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা। মাথায় একটা গামছা বাঁধা। মুখে সাদা-কালো দাড়ি। হাতে একটা খাঁচা। তবে খাঁচার ভেতরে ঠিক কী সেটা দেখা যাচ্ছে না। খাঁচাটা কলাপাতা দিয়ে মোড়ানো, তার ওপরে আরেকটা গামছা দিয়ে ঢাকা দেওয়া।

– কে?

– স্যার আমার নাম আবুল কাশেম। সবাই আমারে সবজি কাশেম বলে ডাকে।

– তো এই সাত সকালে আমার বাসায় কেন?

হাতের খাঁচাটা আরিফ সাহেবের সামনে তুলে ধরে বলল, ‘স্যার, একটা পাখি ছেলো। মথুরা পাখি।’

– না না, আমি পাখি-টাখি কিনব না। পাখি দিয়ে আমি কী করব? অন্য কোথাও দেখ।

– দাম দিতে হবে না স্যার। সবজি ক্ষেতের জালে আটকেছিল। তাই নিয়ে আসলাম। ইচ্ছা করলে আপনি কাইটা খাইতে পারেন। আবার পুষতেও পারেন। মা জননীরে দেবেন। দেখবেন সে আদর-সোহাগ কইরা পালবো। মথুরা হইল শান্ত স্বভাবের পাখি। আদর-সোহাগের পাখি।

এমন সময় রাবেয়া উঠে এসে আরিফের পেছনে দাঁড়িয়েছে। বলল, ‘পাখির নাম মথুরা? এমন নামে কোনো পাখি আছে জীবনে শুনি নাই।’

সবজি কাশেম খাঁচাটা রাবেয়ার সামনে ধরে পাখিটাকে দেখাল। বলল, ‘পাহাড়ি এলাকার পাখি। গভীর জঙ্গলে থাকে। ভোররাইতের দিকে একটু বাইরে বেরোয়। আবার সূর্য উঠতে উঠতে জঙ্গলে ঢুইকা যায়। ওরা আলো সহ্য করতে পারে না।’

পাখি দেখে রাবেয়ার বেশ পছন্দ হলো। বলল, ‘রেখে দাও ওটাকে, আমি পুষবো।’

সবজি কাশেম অনেক সাধাসাধির পরেও টাকা নিল না। শুধু খাঁচার ওপর থেকে গামছাটা তুলে নিয়ে মাজায় বেঁধে হাঁটা দিলো।

আরিফ সাহেব ভাবলেন, ভালোই হলো। রাবেয়ার কিছুটা সময় কাটবে পাখিটাকে নিয়ে। বাসায় একা থাকতে থাকতে কেমন যেন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। যে-কোনো কিছু নিয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ঝগড়াঝাঁটি করে। শান্ত স্বভাবের পাখিটার সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়তো রাবেয়াও কিছুটা শান্ত হয়ে উঠবে। রাবেয়ার ঢাকায় একটা চাকরি ছিল। বেসরকারি। আরিফ সাহেবের সরকারি অফিসের বদলির চাকরি। পাহাড়ি এলাকায় বদলি হওয়ার কারণে রাবেয়াকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। এই পাহাড়ি এলাকায় রাবেয়া চাকরি করুক সেটা আরিফের ঠিক পছন্দ নয়। এই মফস্বলে মেয়েদের জন্য সম্মানজনক কোনো চাকরি পাওয়াও সমস্যা। পেলেও হয়তো খুব বেশিদিন করা যাবে না। হয়তো আবার অন্য কোথাও বদলি হয়ে যাবে। এই নিয়ে সংসারে অশান্তি চরমে। আরিফ সাহেবের বিয়ে হয়েছে তিন বছর। এখনো কোনো বাচ্চা হয়নি। ডাক্তার ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে পরামর্শ দিয়েছে নিজেদের সময়গুলো আনন্দে থাকতে। ঢাকায় দুজনের চাকরির ব্যস্ততায় নিজেদের সময়গুলো ছিল ক্লান্তিতে ভরপুর। জোর করে আনন্দে থাকার চেষ্টাটা ছিল দায়ে পড়ে তেতো ওষুধ গোলার মতো। মফস্বলের অলস সময়টা আরিফ সাহেব যতটা উপভোগ করার চেষ্টা করছেন, রাবেয়া ততটাই বিরক্ত। সবসময় তার মেজাজ খিটখিটে থাকে। আরিফ সাহেব কোনো ভালো কথা বললেও রাবেয়া তার একটা খারাপ অর্থ খুঁজে বের করেন। এমনকি রাবেয়ার কথায় সায় দিলেও তার একটা খারাপ উদ্দেশ্য খুঁজে বের করে ফেলেন। তখন আরিফ সাহেবের চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

খাঁচাটা হাতে নিয়ে আরিফ সাহেব বললেন, ‘পাখিটার ভালোই হলো। ওকে আর আলোয় যেতে হবে না। তোমার সঙ্গে সারাদিন ঘরে থাকতে পারবে। তোমার একজন সঙ্গী হলো।’

রাবেয়া বললেন, ‘আমাকে ঘরের ভেতরে আটকে রেখেছ বলে কি ওকেও ঘরে রাখব মনে করেছ? ওর অন্ধকারে থাকার শখ আমি মিটিয়ে দেবো। ওকে খাঁচা ধরে সারাদিন বাইরের বারান্দায় রোদে ফেলে রাখব। বলে কি না পাখির নাম মথুরা পাখি। ছায়ায় থাকে। যেন মথুরার কেষ্ট ঠাকুর – তমাল গাছের ছায়ায় থাকে। ওর মথুরা বৃন্দাবন আমি ছুটাচ্ছি দাঁড়াও।’ কথাগুলো বলতে বলতে রাবেয়া আরিফ সাহেবের হাত থেকে খাঁচাটা নিয়ে বাইরে বারান্দায় রেখে এলেন।

আরিফ সাহেব রাবেয়াকে সমর্থন করে বললেন, ‘ঠিকই বলেছ। পাখির আবার এত আলো-ছায়ার পছন্দ কী? কয়েকদিন আলোয় রেখে দিলেই অভ্যাস হয়ে যাবে।’

গরম তেলে বেগুন দিলে যেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠে, রাবেয়া তেমনি রেগে উঠে বললেন, ‘তুমি তো তাই বলবে। ওইটাই তো তুমি বিশ^াস করো। খাঁচায় পুরে যাকে যেভাবে রাখবে সেটাই তার অভ্যাস হয়ে যাবে।’

আরিফ সাহেব বুঝতে পারলেন তিনি ভুল করে একটা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। 

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা খাঁচার ভেতরে ছটফট করা শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা শব্দ করা শুরু করল যা শুনলেই মনে হয় পাখিটা খুব কষ্ট পাচ্ছে। আরিফ সাহেব অসহ্য হয়ে খাঁচাটা ঘরের ভেতরে এনে রাখলেন। ঘরে আনার সঙ্গে সঙ্গে পাখিটার ছটফটানি ডাকাডাকি সব বন্ধ হয়ে গেল।

আরিফ সাহেব মজা করে বললেন, ‘দেখেছো পাখিটা কিন্তু তোমার মতোই বেশ শান্তশিষ্ট। দেখতেও তোমার মতো খুব সুন্দর।’

রাবেয়া আবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘আমি দেখতে ওই বনের পশুপাখির মতো? তুমি তো দেখতে শেয়ালের মতো। মনের ভেতরে শুধু শেয়ালের মতো কুবুদ্ধি।’ আরিফ সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। তবে রাবেয়ার কথা চলতেই থাকল। আরিফ সাহেব অসহ্য হয়ে নাস্তা না করেই অফিসে বেরিয়ে গেলেন। দুপুরে বাসায় খেতে এসে দেখলেন পাখিটা বাইরের বারান্দায় ছটফট করছে। আরিফ সাহেব সংসারে অশান্তির ভয়ে পাখি নিয়ে কোনো কথাই বললেন না।

অফিস ক্যাম্পাসের ভেতরে বাসা। মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। সবজি কাশেম আরিফ সাহেবের বাসায় একটা মথুরা পাখি দিয়ে গেছে। ঘটনা নতুন নয়। এলাকায় নতুন কোনো অফিসার এলে সবজি কাশেম এই কাজটা করে। সবজি আবাদ করে লোকটা তার অবস্থার খুব উন্নতি ঘটিয়েছে। আরিফ সাহেব ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো একসময় লোকটা সরকারি অফিস থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিল। তার প্রতিদান হিসেবে সে এই কাজটা করে। অথবা অন্য কোনো লাভের আশায় পাখি উপহার দিয়ে অফিসারদের সঙ্গে ভাব জমাতে চায়। এখন তো মফস্বলেও টাউট-বাটপারের অভাব নেই। তবে আরিফ সাহেব কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে খবর নিয়ে জেনেছেন, লোকটা কোনো টাউট-বাটপার না। অবসর সময়ে গান-বাজনা করে। সবজিক্ষেতে বসে বাঁশি বাজায়। তার ধারণা, সবজিক্ষেতে গান-বাজনা করলে সবজি দ্রুত বাড়ে, ফলন ভালো হয়। এলাকায় কোনো কোনো মানুষ তার এই কথা বিশ্বাস করে। যারা বিশ্বাস করে না তারা তাকে পাগলা কাশেম বলে ডাকে।

আরিফ সাহেবের পিয়ন বছির মিয়া সরাসরি প্রশ্ন করে বসল, ‘স্যার, আপনি কি বিশ্বাস করেন গান-বাজনা করলে ফসলের ফলন বাড়ে?’

আরিফ সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘বিশ্বাস করি, আবার করিও না।’

বছির হেসে বলল, ‘এইটা কেমন উত্তর হলো স্যার – বিশ্বাস করি আবার করিও না।’

– এই যেমন ধরো, মানুষের অনেক অসুখের চিকিৎসায় এখন বিজ্ঞানীরা গান-বাজনার ফলাফল পরীক্ষা করে দেখছেন। গাছের ক্ষেত্রেও এমন অনেক পরীক্ষা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো গান বা সুর বের হয়নি যেটা বাজালে ফসলের ফলন বাড়ে।

– তাহলে তো স্যার, পাগলা কাশেমের কথা মিথ্যা।

– ঠিক মিথ্যা বলাও যাবে না। ফসল তার গান শুনছে, এই কথা বিশ্বাস করে যে সবজিক্ষেতে বসে গান গায়, বাঁশি বাজায়, তার নিশ্চয় ফসলের প্রতি অনেক ভালোবাসা। ভালোবাসা থাকলে মানুষ তার যত্ন নেয়। সুখ-দুঃখ বুঝতে পারে। ভালোবাসা পেলে মানুষের চেহারা সুন্দর হয়ে ওঠে। ফসলের ফলনও হয়তো বাড়ে।

বছির আরো কী একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল। এমন সময় হাসান সাহেব এসে ঢুকলেন আরিফ সাহেবের অফিসে। হাসান সাহেব ইঞ্জিনিয়ার। আরিফ সাহেবের বাসার ওপরতলায় থাকেন। বললেন, ‘আরিফ সাহেব, আপনার পাখির অত্যাচারে তো আর বিল্ডিংয়ে বসবাস করা যাচ্ছে না। সারাদিন শুধু ক্যাঁ ক্যাঁ করেই যাচ্ছে। বাসায় পোষার মতো না হলে কেটে খেয়ে ফেলেন। আমাদের একদিন দাওয়াত দেন। বেশ আয়েশ করে পাখির মাংস খাওয়া যাবে।’

– আমরা তো আসলে পোষার জন্যই পাখিটাকে রেখেছি। কেটে খাওয়ার কথা কখনো ভাবিনি।

বছির টেবিলে চা দিতে দিতে বলল, ‘স্যার মথুরা পাখি গভীর জঙ্গলে থাকা পাখি। আলো সহ্য করতে পারে না। তাই অমন ক্যাঁ ক্যাঁ করে।’

আরিফ সাহেব বললেন, ‘ওটাই তো হয়েছে সমস্যা। রাবেয়া কিছুতেই পাখিটাকে ঘরের ভেতরে রাখতে চায় না। ওর কথা, পাখিটা কেন এমন অন্ধকার পছন্দ করবে। ওকে সে রোদে রেখে শাস্তি দিতে চায়।’

হাসান সাহেব বললেন, ‘আপনারা তো ভাই বন্যপ্রাণী নির্যাতন আইনে পড়ে যাবেন। ভাবিকে বুঝিয়ে বলেন।’

– ঢাকা থেকে চাকরি-বাকরি ছেড়ে এসে রাবেয়ার এখানে মন টিকছে না। আচার-আচরণও কেমন যেন সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। যে-কোনো কিছু বললেই খুব রাগারাগি করে।

– শোনেন আরিফ সাহেব, বউদের ঠান্ডা রাখার তিনটা বুদ্ধি। এক, গহনাগাটি কিনে দেওয়া আর দুই, কঠিন শাসনে রাখা। আপনি তো ভাই এ-দুটোর কোনোটাই করেন না। এমন হলে তো বউ গরম থাকবেই।

– আর তিন নম্বরটা?

– তিন নম্বরটা আসলে এক নম্বর পয়েন্ট। সেটাতে নিশ্চয় আপনাদের কোনো সমস্যা নেই। থাকলে বলবেন, তারও ব্যবস্থা আছে।

কথাটা বলেই হাসান সাহেব সিনেমার ভিলেনদের মতো হো হো করে হেসে উঠলেন।

বছির চায়ের কাপগুলো নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। হাসান সাহেব হাসি থামিয়ে তাকে একটা ধমক দিলেন। বললেন, ‘তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী শুনছিস। যা বাইরে গিয়ে দাঁড়া।’

একজন শিক্ষিত মানুষের মুখ থেকে এমন কথাবার্তা আর আচরণ দেখে আরিফ সাহেবের মাথাটা বেশ গরম হয়ে উঠল। পিয়নটা বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার পর হাসান সাহেব গলা একটু নিচু করে বললেন, ‘শোনেন আরিফ সাহেব, বউ হলো ঢাকের মতো। সব সময় লাঠির আগায় রাখবেন। লাঠি ঠিক না থাকলে ঢাক বেতাল হয়ে যাবে।’ কথাটা শেষ করে হাসান সাহেব আবার একটা ভিলেনমার্কা হাসি দিলেন।

আরিফ সাহেব টেবিলের ড্রয়ার খুলে ছুরিটা এক নজর দেখে নিলেন। তারপর কী একটা ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে হাসান সাহেব, আমি দেখছি কী করা যায়।’

হাসান সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার পর আরিফ সাহেব ছুরিটা তাঁর পকেটে তুলে নিলেন। তারপর বাসায় গিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। পাখিটা তখনো ক্যাঁ ক্যাঁ আওয়াজ করে চলেছে। রাবেয়া একমনে কিচেনে কিছু একটা রান্না করছিলেন। আরিফ সাহেব রাবেয়াকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। রাবেয়া মুখ ঘুরিয়ে আরিফ সাহেবকে দেখা মাত্র এক ধাক্কায় তাকে দূরে সরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমি সারাদিন বাসায় একা একা রান্না করে মরছি আর উনি এসেছেন এখন আদর-সোহাগ করতে। তোমার মতলব বুঝি না মনে করেছ?’ তারপর আরিফ সাহেবকে কিচেনের বাইরে ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন, ‘আজ থেকে দুজন দুই ঘরে ঘুমাব। তুমি আমার কাছেই আসবা না।’

আরিফ সাহেব বারান্দায় গিয়ে দেখলেন পাখিটা খাঁচার ভেতরে ছটফট ছটফট করছে আর ক্যাঁ ক্যাঁ করে ডাকছে। যেন ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আরো কিছু সময় ডাকলে হয়তো তার গলা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। আরিফ সাহেব পকেট থেকে ছুরি বের করে খাঁচার বাঁধনটা কেটে পাখিটাকে মুক্ত করে দিলেন; কিন্তু পাখিটা বেরোল না। ডাকা বন্ধ করে ভীরু চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকল। আরিফ সাহেব হাতে ধরে পাখিটাকে গ্রিলের বাইরে বের করে দিলেন। পাখিটা কাছেই একটা আমগাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে গেল। আরিফ সাহেব কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থেকে নীরবে-নিঃশব্দে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

পরদিন সকালে রাবেয়া আরিফ সাহেবকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। বললেন, ‘দেখ তো খাটের নিচে কিসের যেন শব্দ হচ্ছে।’ আরিফ সাহেব একটা দুষ্টুমির হাসি দিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘খাটের নাট-বোল্টগুলো সব লুজ হয়ে গেছে। কাল টাইট দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এখন ঘুমাও।’

রাবেয়া বললেন, ‘আরে না, মনে হয় চোর-টোর ঢুকে লুকিয়ে আছে। একটু উঠে দেখই না! কিছুক্ষণ পরপর কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে।’ আরিফ সাহেব ধড়ফড় করে উঠে খাটের নিচে তাকিয়ে দেখেন, ছেড়ে দেওয়া পাখিটা খাটের নিচে এসে লুকিয়ে আছে। তিনি বারান্দা থেকে খাঁচাটা এনে পাখিটাকে খাঁচায় ঢোকালেন। তারপর রাবেয়াকে বললেন, ‘চলো, আজ পাখিটা সবজি কাশেমকে ফেরত দিয়ে আসি।’

রাবেয়া তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। হয়তো তার ভেতরে একটা অনুশোচনা বোধ কাজ করছিল। বললেন, ‘কত দূরে তোমার সবজি কাশেমের বাড়ি?’

– এই তো কাছেই। পাহাড়ের ওদিকটায়।

আরিফ সাহেব ও রাবেয়া যখন সবজি কাশেমের বাড়ি পৌঁছালেন তখন পাহাড়ি বনজঙ্গলের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে সবজিক্ষেতে। একটা উথাল-পাতাল বাতাসে সবুজ ফসলের ওপর যেন একটা আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সেই ফসলের মাঝে বসে কাশেম বাঁশি বাজাচ্ছে আর দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে গান গাইছে। ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন ভরা …’। গান শুনে ওরা দুজনেই খুব অবাক। এই পাহাড়ি জঙ্গলে একটা বাচ্চা মেয়ে এমন সুন্দর করে রবীন্দ্রসংগীত গাইছে! একটা পাহাড়ি আঞ্চলিক গান গাইলে কোনো কথা ছিল না। রাবেয়া বিয়ের আগে ছয় বছর ছায়ানটে গান শিখেছেন। তাঁর বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয় না যে, এই গান ওস্তাদের কাছে শেখা গান। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মেয়ে, তুমি এই গান শিখলে কোথায়?’

হঠাৎ অপরিচিত মানুষের এমন আচমকা প্রশ্ন শুনে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কাশেম ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিলো, ‘ওই তো গানের ইস্কুল থেকে শিখেছে। আপনাদের অফিসের পাশেই তো ইস্কুল। আমার নাতনির গানের খুব শখ। গানের মাস্টার ঢাকা চলে যাওয়ায় ইস্কুলডা বন্ধ হয়ে গেল।’ রাবেয়া মেয়েটাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী? তুমি স্কুলে যাও? কোন ক্লাসে পড়ো?’ মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। কোনো উত্তর দিলো না। কাশেম বলল, ‘ওর নাম সাগরী। সাগরে সেবার বড় বান হলো, সেই সময় ওর জন্ম। ও পড়ে সিক্সে।’ তারপর সাগরীকে লক্ষ করে বলল, ‘শোনাও, মা জননীকে একটা গান শোনাও।’ বলা মাত্রই সে এবার শুরু করল, ‘ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা…।’ রাবেয়াও সঙ্গে গলা মেলালেন। গান শেষ হলে রাবেয়া বললেন, ‘গানের স্কুলটা আবার চালু করা যায় না?’ সাগরী এবার কথা বলল, ‘তাহলে তো খুব ভালো হয়। আপনি আমাদের গান শেখাবেন?’ তারপর কাশেমকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আজ তাহলে সবাইকে খবর দিই? কাল থেকে আবার গানের ইস্কুল খুলবে।’ আরিফ সাহেব বললেন, ‘কাল কেন? আজ থেকেই শুরু হোক। তোমরা সবাই মানে কতজন?’

– আমরা আগে ছিলাম আঠারোজন। দুইজনের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ষোলোজন।

সাগরী বলল, ‘আইজ আমার কী খুশি যে লাগতেছে। গানের ইস্কুল আবার চালু হইবো।’

রাবেয়া বললেন, ‘চলো সাগরী আজ আমাদের এই খুশির দিনে একটা ভালো কাজ করা যাক। আমরা পাখিটাকে এখন খাঁচা থেকে ছেড়ে দেবো।’

পাখিটা ছেড়ে দেওয়া মাত্র কাছেই একটা গাছে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর উড়ে গহিন বনের ভেতরে মিলিয়ে গেল।