মরণোত্তর বিলাপ

আমি মরতে চাইনি। তবু আমাকে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলা হয়েছে!

আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আমগাছ, যে তার পাতার নিচে, ডালের নিচে, রোদ, আলো, ছায়ার নাচনের  ভেতরে থিরথির কাঁপন লেগে থাকা দু-চোখ মেলে যুগের পর যুগ ছাত্রদের আন্দোলন, তাদের ভাষাসংগ্রাম, তাদের সংবিৎ, তাদের স্বাধীনতার সংকীর্তন চোখভরে, কখনো আনন্দে উদ্বেল, কখনো অশ্রুভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকিয়ে দেখেছিল – সে কীভাবে এরকম নীরবে-নিভৃতে মারা যাবে জাতীয় ঘোষণা ছাড়া?

এসব ঐতিহাসিক ক্ষণের নীরব সাক্ষী আমি ছাড়া আর ছিল কে?

কেউ না!

আমার স্মরণে আছে সেদিনটি ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল।

ভাষার দাবিতে বাংলার ও বাঙালির জীবনের এক ক্রান্তিলগ্ন, এক মাহেন্দ্রক্ষণ। আর সত্যি বলতে আমার জীবনেরও সবচেয়ে শোকাবহ দিন ছিল সেই দিনটি। এরও বহু আগে আমি আমার গাছের নিচে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ছাত্রদের মোতায়েন হতে দেখেছি অজস্রবার, অজস্র দিন, সময়ে বা অসময়ে, গ্রীষ্ম বা বর্ষা, হেমন্ত বা শরৎ; গোধূলির আঁধারে প্রেমও হতে দেখেছি কত অজস্রবার; ভালোবাসার লাল ফিতে মাথায় বাঁধতে দেখেছি কতজনকে। মধুর ক্যান্টিন থেকে চা-শিঙাড়া খেয়ে কত ছাত্রকে দেখেছি আমার ছায়ায় পা মেলে বসে পকেট থেকে খাতা বের করে প্রেমের প্রথম কবিতাটি লিখতে, কারণ হয়তো সেদিন পথ চলার সময় সবুজ শাড়ি পরা একটি মেয়ে স্মিত মুখে তার দিকে একবার তাকিয়েছিল বলে।

কিন্তু সেই দিন, সেই একুশ তারিখের দিনটি ছিল যেন সব দিনের চেয়ে ভিন্ন একটি দিন, ভিন্ন একটি সময়, কারণ আমি নিজের শেকড়ের ভেতরে অনুভব করছিলাম সেই স্পন্দন, সেই থরথর ভাব, যা আমি জীবনে এর আগে কোনোদিন অনুভব করিনি।

আমার ভয় করছিল। শঙ্কা জেগেছিল মনে।

বিগত কয়েকদিন ধরেই আমার মনের ভেতরে এরকম যে কিছু হবে এর আভাস পাচ্ছিলাম। ছেলেরা ঘন ঘন এসে আমার পাতার নিচে জড়ো হচ্ছিল। বচসা করছিল। কখনো বা বাকবিতণ্ডা। তারা সকলেই ছিল সেসব দিনে বেশ গম্ভীর এবং অশান্তমনা।

আমার মন, মানে আমার শেকড়, সেখানেও বেশকিছু নটঘট হয়ে যাচ্ছিল। লক্ষ করছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই ছাত্ররা ছিল বিক্ষুব্ধ ও অস্থির। সেই যে পাকিস্তানের জনক কায়েদে আজম এসে বলে গেলেন, ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের মূল ভাষার বাহন’, সেদিন থেকেই ছাত্রদের মনে ধিকিধিকি জ¦লছিল বিদ্রোহের আগুন। তারা ‘না, না’ করে প্রতিবাদ করার পরেও সেই আগুন শুধু যেন বছরের পর বছর ধরে ধিকিধিকি জ¦লছিল, একদিন অগ্নিগিরির লেলিহান হবে বলে।

সেই সময় এলো ১৯৫২ সালে।

সেবার বছরের শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ছেলেদের ভেতরে বাকবিতণ্ডা চলছিল। যদিও এর উৎপত্তি হয়েছিল সেই ১৯৪৮ সালে। তখন থেকে আরবি হরফে বাংলা ভাষার প্রচলন করে ভাষাটাকে মুসলমানের লেবাস পরানোর চেষ্টা চলছিল। এর জন্য খরচ করা হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা।

নীরবে চারটা বছর চলে গেল। রাষ্ট্রভাষা কী হবে – সে-সম্পর্কে সব রাজনীতিবিদ চুপচাপ।

ঠিক এরকম একটি সময়ে ১৯৫২-র জানুয়ারির শেষভাগে খাজা নাজিমউদ্দীনের উটকো এক ঘোষণা শুনে দেশের মানুষ যেন স্তম্ভিত। তিনি চার বছর আগে ছাত্রদের এবং দেশবাসীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, বাংলা হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা; কিন্তু চার বছর সময়কাল হজম করে নিয়ে হঠাৎ এখন এক জনসভায় বলে বসলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা! তাঁর এ-বক্তব্য শুনে দেশের মানুষ যেন হতবাক হয়ে গেল। ভাবল, আরে, ইনি বলেন কী?

ফলে দেশজুড়ে তাঁর এ-বক্তব্যের জোরালো প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল মিটিং, মিছিল, ঘরোয়া সভা।

জানুয়ারির ৩০ তারিখে ছাত্র ও জনসাধারণের বিশাল মিছিল দেখে শহরবাসী অবাক হয়ে গেল। তারা নিজেরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই মিছিলে যোগ দিলো।

জননেতা মওলানা ভাসানী কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠন করলেন।

মন্ত্রী নুরুল আমিন সাহেবকে কর্মপরিষদের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য অনুরোধ করা হলো। সে-অনুরোধে নুরুল আমিন কর্ণপাতই করলেন না, সুতরাং এই কর্ম পরিষদের এক সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারিতে দেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করা হয়ে গেল।

আমার চোখের সামনে সবকিছু যেন ছবির মতো ভেসে চলে গেল।

অনেকে ভাবতে পারে আমি সামান্য একটি আমগাছ হয়ে এতো খবর কোত্থেকে জানছি?

অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমারই তো সবচেয়ে প্রথমে জানার কথা। আমি তো সেই আমগাছ, ছাত্ররা  যে বিদ্যাপীঠে এসে প্রথমেই যার ছায়ার নিচে দাঁড়ায়; গোপনে একটা-দুটো বিড়ি ফোঁকে; ভাষা, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ  বা দেশের যে কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়। যে-কোনো সংকটে, হোক সে দেশ বা ব্যক্তিগত, তারা প্রথমে তো আমার কোলে এসে জড়ো হয়।  আলোচনা করে। আমার ছায়ার নিচে বসে কত ছাত্র যে তার জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি লিখেছে!

দেশের যে-কোনো ক্রান্তিকালে তো ছাত্ররাই সবচেয়ে আগে পা বাড়ায়। আর পা বাড়ানোর আগে আমারই নিচে এসে  ছাত্র জমায়েত হয়। সেখানে যোগ দেয় কিছু সাহসী ছাত্রীও।

এ-দৃশ্য আমি তো আমার যৌবন থেকেই দেখে আসছি।

তারপর সেই ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন।

সেইদিন সকাল থেকে আমারই আস্তানার নিচে ছাত্র জমায়েত।

অথচ গতকাল বিকাল থেকেই ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার কোরাইসি ১৪৪ ধারা জারি করে বসে আছেন! পাগল আর কাকে বলে! দেশের মানুষকে যারা চেনে না, তারা কিসের ওপরে ভর করে রাজত্ব করে, আল্লাহ মালুম।

এর আগে কত জনসভা, কত মিছিল, কত বিক্ষোভ বাংলার মাটিতে ঘটে গেছে। বিশ^বিদ্যালয়েও ঘটে গেছে সেসব। সেসব আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র ও জনসাধারণ নিয়মতান্ত্রিকভাবে, আইন বরখেলাপ না করে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। কখনো এমন কিছু হয়নি যেজন্যে কালা আইন বলবৎ করতে হবে; কিন্তু এবারে দেখা গেল রাষ্ট্র তার ছাত্র ও জনতাকে রক্তচক্ষু দেখানোর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে আছে।

১৪৪ ধারা জারি হতে দেখে ছাত্রদের ভেতরেও দেখা গেল ক্রোধ ও জেদ। বারে বাহ্! এ কেমন রাষ্ট্র! যার নাম পাকিস্তান, যার জন্মই মাত্র হয়েছে সেদিন, যেখানে সে সংখ্যাগুরু দেশবাসীর কোনো বক্তব্য মানতে রাজি নয়?

ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণও ভয়ানকভাবে বিক্ষুব্ধ।

তবু ঘোষণা দেওয়া হলো যে, শান্তিপূর্ণভাবে পূর্বঘোষিত হরতাল হবে। তবে সরকারের ১৪৪ ধারা মেনে মিছিল ও শোভাযাত্রা বন্ধ রাখা হবে। চারজনের বেশি কেউ একসঙ্গে রাস্তায় হাঁটবে না।

এরপর, আমি সামান্য এক আম্রবৃক্ষ,  আর কিছু বলতে আমার সাহস হয় না।

দেশবাসী সকলেই জানে একুশ তারিখের সেই মর্মন্তুদ ঘটনার কথা।

বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সভা করার সময় সশস্ত্র পুলিশের পাহারা, টিয়ার শেল নিক্ষেপ, বিনা অজুহাতে দলে দলে ছাত্র গ্রেফতার, তাতেও সন্তুষ্ট না হলে বিকালের দিকে জোর করে মেডিক্যাল হোস্টেলে ঢুকে নির্বিচারে ছাত্রদের গুলি করে হত্যা, তাদের ভাষ্যমতে – ২৭ রাউন্ড গুলি করেছে, আমার নিজের ভাষ্যমতে – সাতাশ নয় , অজস্রবার গুলি করে ছাত্র হত্যা করেছে। আমার মাথার ওপর দিয়ে সেই গুলির র্ছরা ছুটে গেছে, আমি সবই লক্ষ করে দেখেছি। দেখেছি তারা কি চতুরতার সঙ্গে রাস্তায় ছিটকে পড়া মৃতদেহগুলো তাদের পুলিশভ্যানে তুলে হাওয়া হয়ে গেছে; কিন্তু ঈশ^র আমাকে বাকরুদ্ধ করেছেন, আমার  সাধ্য ছিল না যে আদালতে গিয়ে সকলের চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিই।

হায়, ঢাকার বুড়িগঙ্গায় সেদিন আর তার পরদিনও যেন কোনো স্রোত খেলেনি। মাঝি তার নৌকার রশি খোলেনি, দাঁড় বায়নি, যাত্রী পারাপার করেনি, দোকানদার তার দোকান খোলেনি, কৃষক-শ্রমিক-মজুরেরা একযোগে তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে গেছে, খুলনা জেলার মোড়েলগঞ্জের রোজ ছয় আনা পয়সার দিনমজুর শ্রমিকও পরদিন কাজ করতে অস্বীকার করেছে। কোদাল বগলে নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে ক্ষোভে, রাগে, বিতৃষ্ণায়। কারণ তাদের বিশ^বিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলেদের গায়ে লাঠির বাড়ি পড়েছে বলে, টিয়ার গ্যাসে তাদের চোখ অন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে, ছাত্রাবাসের ভেতরে অনধিকার প্রবেশ করে তাদের ওপর বেপরোয়া গুলি করে তাদের মাথার খুলি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে।

কিন্তু তারপরও এই নির্লজ্জ সরকারের বোধোদয় হলো না।

তারা তাদের সহিংস কর্ম থেকে বিরত হলো না। বরং দেশের যুবক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সকলকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও গুণ্ডা আখ্যা দেওয়া হলো। দেশরক্ষার নামে তাদের অনেককে জেলে ঢোকানো হলো।  মোটকথা, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে গলাটিপে মারার জন্য দেশব্যাপী গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করল সদ্য প্রতিষ্ঠা হওয়া পাকিস্তান সরকার।

নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনো কৈফিয়তই দেওয়া হলো না দেশবাসীকে।

এসব কথা এতো বছর পরেও বলতে গেলে আমার চোখ ভরে আসছে পানিতে, ক্ষোভে আমার ভেতরটা চৌচির হয়ে যাচ্ছে, রুদ্ররোষে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে।

কিন্তু আমি কী করতে পারতাম!

হায়, আমি সামান্য একটা আমগাছ বই আর কিছুই তো ছিলাম না!

আমার স্মরণে আছে, ২২ তারিখে, মানে ২২শে ফেব্রুয়ারি, ছাত্ররা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে গায়েবি জানাজা পড়ে। যে-নেতার সেখানে জানাজা পড়ানোর কথা ছিল তিনি ভয় পেয়ে সেদিন আসেননি।  যদিও আগের রাতে ছাত্রদের আশ^াস দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি আসবেন। গায়েবি জানাজা পড়াবেন; কিন্তু আসেননি। তখন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সাধারণ লোক জানাজা পড়ান। সেই লোকটি সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, যারা আমাদের ছেলেদের এভাবে খুন করেছে, আল্লাহ তাদের বিচার করবেন।

পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করে যে, বিচার তাদের ঠিকই একদিন হয়েছিল এবং বড় নির্মম ছিল সেই বিচার।

এসব কথা আমি ছেলেদের মুখে শুনেছি।

তারা আমারই নিচে বসে রাতভর এসব আলোচনা করেছে। হলের ছেলেরাও তাদের হল ছেড়ে এসে আমার ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। আমার গায়ে তাদের শরীর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্মপন্থা স্থির করেছে। কত খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে যে তাদের ভেতরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বচসা হতো, দেখে আমি নিজের মনে খিকখিক করে হাসতাম। মনে মনে বলতাম, ছেলেপুলে আর কাকে বলে!

দুই

কে কবে আম খেয়ে আমার উৎসটিকে ফেলে দিয়েছিল বিশ^বিদ্যালয় চত্বরে, আমার স্মরণেও নেই, থাকার কথাও নয়। তবে এটুকু বলতে পারি, বিশ^বিদ্যালয় গড়ে ওঠার অনেক আগেই আমি তার বৃহত্তর সীমানার মধ্যেই অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিলাম। ডালপালা ছড়ানো বিশাল একটি আম্রবৃক্ষ হিসেবে সকলেই তখন আমাকে বেশ সমীহ করে চলত। ক্যান্টিনের মধুদা তখনো তরুণ। তাঁকে ছেলেমানুষই বলা যায়, পেছনের রেললাইনের ও-ধারে তিনি তখন থাকতেন। বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে বিশ^বিদ্যালয় চত্বরে আসতেন। একদিন দুপুরবেলায় আমার ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে মধুদাকে তার বাবা বললেন, বুঝলিরে মধু, এই জায়গায় একটা চা-শিঙাড়ার দোকান দিলে কেমন হয়? আমি নিজে তো বসতে পারবো না, তুই বসতে পারিস। বড় হয়ে তোকে কিছু না কিছু করে তো খেতে হবে।

বাবার উপদেশে বিশ^বিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে মধুদা একদিন আমার সীমানার ভেতরেই চায়ের দোকান দিলে। তার দোকানের চা-শিঙাড়া খেয়ে কত ছাত্র এই বিশ^বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে দেশ এবং বিদেশের ঘাটে ঘাটে ছড়িয়ে পড়ল; কিন্তু মধুদার কাছে তারা সারাজীবনই প্রায় ঋণী থেকে গেল। বাকিতে খাওয়া মধুদার দোকানের শিঙাড়া ও চায়ের বিল পরিশোধ না করেই তারা চলে গেল নিজেদের কর্মক্ষেত্রে।

শুনেছিলাম, মধুদার স্মৃতিশক্তি এতো প্রখর ছিল যে, যে-কোনো সময়ে প্রাক্তন কোনো ছাত্র বিশ^বিদ্যালয়ে ঢুঁ মারলেই মধুদার সঙ্গে দেখা হলে মধুদা নাকি বলতেন, আপনার কাছে এক টাকা চৌদ্দ আনা পয়সা এখনো বাকি রহিয়াছে!

এসব কথা নিয়ে বিকালবেলা ছেলেরা আমার গাছের নিচে বসে হাসি-আড্ডায় মেতে উঠত।

 আমার মনে আছে, মধুদা যখন তাঁর যৌবনে, তখন মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে বসত। গাছের গুঁড়িতে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আমার ছড়ানো ডালপালায় সে হাত বুলিয়ে দিত। মাঝে মাঝে আমাকে হাতজোড় করে নমস্কারও করত। কেন করত জানিনে। হয়তো আমার প্রাচীনত্ব দেখে বা অন্যকিছু।

একদিন ভীষণ এক গ্রীষ্মকালে আমার গোড়ায় মাটি খুঁড়ে কিছু পানিও ঢেলেছিল। সেবার বড় কঠিন গ্রীষ্মকাল এসেছিল। বৃষ্টিহীন ক্ষরায় মানুষ হিমশিম খাচ্ছিল। সেই দুর্দিনে মধুদা আমার গোড়ায় পানি ঢেলেছিল। এ-কথা আমার এখনো মনে আছে।  সেদিন আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম।

আমার যৌবনের অনেক কথা মনে আছে। একদিন বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজির প্রফেসর মিস্টার টার্নার বাগানে ঘুরতে এসে তরুণ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে ডেকে বলেছিলেন, মুনীর, ইট লুকস লাই অ্যা ম্যাঙ্গো ট্রি। ইজিন্ট ইট?

আর মিস্টার টার্নারের কথা শুনে তরুণ টগবগে মুনীর চৌধুরী বলে উঠেছিলেন, ইউ আর জাস্ট রাইট, স্যার। বলে হেসেছিলেন।

মনে মনে হয়তো ভেবেছিলেন, মিস্টার টার্নার এতোদিনেও, এতো বছর ইন্ডিয়াতে থেকেও, আমগাছ ঠিকমতো চিনলেন না!

এরকম একদিন নির্জন দুপুরবেলা, কেউ কোথাও নেই, একটি মেয়ে ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে দাঁড়াল, আমার গায়ে হাত রেখে অন্যমনস্ক তাকিয়ে রইল দূরে। আমি নিজেও মনে মনে অবাক। কারণ সাধারণত মেয়েরা একাকী আমার কাছে আসত না।  দলবেঁধে আসত। বা কোনো সভা-সমিতি হলে যোগ দিতে আসত। একটু পরে দূর থেকে দেখতে পেলাম ভার্সিটির একটি ছেলে, যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ে বলে আমি শুনেছিলাম, বন্ধুরা বলাবলি করেছিল একদিন, তার নাম রাশেদ, সে কাছে এসে দাঁড়াল।

তাঁকে একবার তাকিয়ে দেখে মেয়েটি মুখ নিচু করে ফেলল।

রাশেদ বলল, কখন এসেছো এলিজা?

এলিজা নিচু মুখে বলল, এই তো একটু আগে।

রাশেদ বলল, তাহলে তুমি মনস্থির করে ফেলেছো যে, বাড়িতে আমার নাম তুমি করতে পারবে না?

এ-কথার কোনো উত্তর দিলো না এলিজা। চুপ করে শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে লাগল।

রাশেদ একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, তাহলে আমি নিজে তোমাদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলি?

এ-কথা শুনে যেন আতঙ্কিত হয়ে এলিজা বলে উঠল, ও কি, ছিঃ, না না!

এবার যেন একটু রাগ করে রাশেদ বলল, তাহলে আমার মাকে বলি তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে?

উত্তরে এলিজা বলল, অসম্ভব!

রাশেদ এবার বলল, তাহলে তুমি কী চাও? তোমার বিয়ের প্রস্তাব আসছে বাড়িতে, হয়তো তোমার অভিভাবকেরা রাজি হয়ে যাবেন, তখন কী হবে এলিজা? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব কী করে?

এ-কথার উত্তরে এলিজা যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল।

রাশেদ বলতে লাগল, তাহলে এই যে আমরা এতোদিন এভাবে মন দেওয়া-নেওয়া করলাম, এই যে তুমি আমার জীবনটাকে এভাবে পাল্টে দিলে, আগে আমি কত একরোখা ছিলাম, কত রাগী ছিলাম, কত মারপিট করতাম, তোমাকে ভালোবাসার পর থেকে আমার সবকিছু যে তুমিময় হয়ে গেল, এখন তুমি যদি সাহসী না হও, আমার কী উপায় হবে, এলিজা?

এলিজা এবার নিচু স্বরে বলে উঠল, আমাকে আরো কিছুদিন সময় দাও, লক্ষ্মীটি। বাবা-মায়ের চেয়েও আমার বড়ভাই বেশি রাগী। সে বাবা-মাকেও তার কন্ট্রোলে রাখে। বাবা-মা রাজি হলেও সে রাজি হবে না। তার একটা বাজে বন্ধু আছে, অনেক টাকার মালিক –

রাশেদ এবার ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল, তাহলে চলো, আমরা কাজির অফিসে যাই। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যাই।

উত্তরে এলিজা আবারো বলল, আমাকে একটু সময় দাও, লক্ষ্মীটি।

যাওয়ার আগে রাশেদ চেষ্টা করল এলিজার হাতটা একটু ধরতে, কিন্তু সেটা মুহূর্ত মাত্র। তারপরই হাত টেনে নিয়ে দ্রুতপায়ে হেঁটে মেয়েদের কমনরুমের দিকে চলে গেল এলিজা।

আর রাশেদ ছেলেটি ব্যাকুল হয়ে তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকল।

তারা যতক্ষণ আমার নিচে দাঁড়িয়েছিল, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করলাম তাদের একটু বাতাস দিতে। তখন মৃদু বাতাস হচ্ছিল চারদিকে। এলিজা ভয়ে, চিন্তায় একভাবে ঘামছিল।

এলিজা চলে গেলে তার চলার পথের দিকে অনেকক্ষণ ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে থাকল রাশেদ। আপনমনে তাকিয়ে থাকল। বিষাদে ভারাক্রান্ত তার মুখ। এই রাশেদের ওপরে আমার একটু রাগ ছিল। একদিন ভরভরন্ত ফাগুন মাসে আমি যখন মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছিলাম, আমার শাখাভর্তি হলুদ বোল, ফলের সম্ভাবনায় আমি খুশিতে উজ্জ্বল, তখন কোত্থেকে এই রাশেদ ছেলেটি এসে বলা নেই কওয়া নেই, আমার গায়ে ঢিল মেরেছিল। একটার পর একটা ঢিল। আর জোর স্বরে বারবার করে বলছিল, ধুর, আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না!

তখন এই ছেলেটির ওপরে আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল।

কারণ আমার ব্যথা লেগেছিল।

সেদিন তো বুঝিনি এলিজার ওপরে অভিমান করে সে হাতের কাছে আমাকে পেয়ে আমাকেই আঘাত করছিল!

কিন্তু আজ রাশেদের মুখ দেখে আমার মায়া হলো। আমি আমার সেই আঘাতের কথা যেন বেমালুম ভুলে গেলাম। পোলাপান মানুষ, মনে মনে বললাম।

তারপর আমি আর কোনোদিন রাশেদকে চোখে দেখিনি। এলিজাকেও নয়।

আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করত তাদের কথা শুনি। কী হলো না হলো শুনি।

কিন্তু কিছু আর শুনলাম না। কোনোদিন না। ভাবলাম, এই কি তাহলে প্রকৃতির জীবন? জীবন সমুদ্রের ঢেউয়ে ক্রমাগত ভেসে চলে যাওয়া? হারিয়ে যাওয়া?

আমার তখন একটা মধুর স্মৃতি মনের ভেতরে ভেসে উঠেছিল। সেটি ছিল কবীর চৌধুরী আর মেহের চৌধুরীর স্মৃতি। মেহের চৌধুরীকে কবীর চৌধুরী চোখে দেখেই ভীষণ ভালোবাসতে শুরু করেন। তাঁরা তখন দুজনেই এই বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। একজন বিজ্ঞান, আরেকজন মানবিক। সুতরাং ক্লাসে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। যেটুকু দেখা শুধু পথ চলাতেই। তো কবীর চৌধুরী মেহের চৌধুরীর চলার পথে অপেক্ষা করে থাকতেন। কিছুদিন পরে মেহের লক্ষ করলেন, একটি ফর্সা চেহারার সুদর্শন যুবক তাঁর চলার পথে দূর থেকে তাঁকে অনুসরণ করে। যুবকটি যে বিশ^বিদ্যালয়েরই ছাত্র, সেটা তিনি জানতেন। মনে মনে একটু অবাক হতেন মেহের। কারণ তিনি এমন কোনো সুন্দরী মেয়ে ছিলেন না যে যুবকেরা তাঁকে অনুসরণ করবে।

একদিন মেহের কার্জন হল থেকে আর্টস বিল্ডিংয়ে যাচ্ছেন, দেখেন কবীর চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন। মেহের সাহসী মেয়ে। তিনি বললেন, আপনি রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন?

কবীর বললেন, আপনার জন্যে। আপনি আর্টস বিল্ডিংয়ে যাবেন তো? চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই।

মুখে সাহসের সঙ্গে এ-কথা বললেও কবীর চৌধুরীর গলার কম্পন মেহের চৌধুরীর কানে ধরা পড়তে বাকি থাকল না। অবস্থা দেখে মেহের হেসে ফেললেন। তারপর তাঁদের আলাপ ধীরে ধীরে পরিণয় পর্যন্ত গড়াল।

এসব ঘটনার কথা আমার সব কানে শোনা। আমার গাছতলায় যখন আড্ডা বসত আর আসর গুলজার হয়ে উঠত, তখন এসব রোমান্সের কথা আমার কানে আসত।

কিন্তু প্রেম-ভালোবাসা যা-ই হোক, আন্দোলন কোনোদিন থেমে থাকল না।

শিক্ষা-আন্দোলনের কথা মনে পড়ে।

চার বছরের আইয়ুবশাহির রাজত্ব সেদিন যেন টলে উঠেছিল। এটাও ছিল ছাত্রদেরই আন্দোলন।  শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছিল সেই আন্দোলন। ১৯৫৮-র অক্টোবর মাসে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সমগ্র জাতির।

ছাত্ররা আবার জড়ো হলো আমার ছায়ার নিচে। শুরু হলো তর্ক, বিতর্ক, সভা। সাহসী ছেলেরা ডেকে বসল  হরতাল। লৌহমানব আইয়ুবশাহির মসনদ উঠল নড়ে। ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৬২-তে সেই প্রথম ছাত্রদের মাধ্যমে দেশবাসী স্বস্তির নিশ^াস ছাড়ল। সফল হলো হরতাল।

সত্যি বলতে, গরিব বাঙালির সাহসী কণ্ঠস্বর এই ছাত্ররা ছাড়া আর কে-ই বা ছিল?

বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় আমার অস্তিত্ব ছিল বলে মিথ্যা বলছি না, দেশের সংকটে, দুঃসময়ে বাঙালি মায়ের আঁচলছেঁড়া ধন তো এসব ছাত্রই?

তারাই তো দেশের যে-কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে রুখে ওঠে, নিজের জীবন বলি দেয়। তাছাড়া আর কে?

এর পরের ইতিহাস তো সকলের জানা। যে-আন্দোলন একদিন আমার গাছতলার নিচে বসে শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলন শেষ হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে।

সেই সংগ্রামে আমরা সর্বপ্রথম মধুদাকে হারালাম। হারালাম আরো শত শত ছাত্রছাত্রীকে।

সেই ভয়াবহ স্মৃতির রক্তক্ষরণ আমার শেকড়ের মধ্যে বয়ে চলল তিরতির করে।

কিন্তু আমি মূক, আমি সামান্য একটি আমগাছ। তবু আমি দিনের পর দিন নীরবে সবকিছুর অতন্দ্র সাক্ষী হয়ে থাকলাম।

কিন্তু দেশের শত্রুরা এত কিছুর পরেও চুপ করে বসে ছিল না। তারা গোপনে গোপনে হননের প্রক্রিয়ায় মেতে উঠল। তাদের কাছে ভাষা-আন্দোলন বা ছাত্রদের ন্যায়সংগত সংগ্রামের যেন কোনো মূল্যই ছিল না।

কিন্তু তাদের রোধ করার ক্ষমতাও তাদের আর ছিল না।

দেশ ক্রমাগত স্বাধীনতা ও মুক্তির দিকে অগ্রসর হলো।

কিন্তু এতোকিছুর পরেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকল না।

তাদের আক্রোশ এবার আমার দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলো।

আমি সামান্য একটি আমগাছ। আমার প্রতি আক্রোশ। কারণ যেন আমিই ছাত্রদের উসকে দিয়ে ভাষা-অন্দোলন, শিক্ষা-আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে স্বাধীনতা-আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছি!

সেই আক্রোশ তারা প্রশমিত করল একদিন। একদিন গভীর রাতে সকলের অগোচরে আমার ছড়ানো ডালপালার নিচে এসে চোরের মতো দাঁড়াল তারা দুজন। রাতের অন্ধকারে তারা আমার শরীরে কার্বলিক অ্যাসিড ঢেলে দিলো। একজন ফিসফিস করে আরেকজনকে বলল, শালার আন্দোলনের এবার বারোটা বাজাবো। কিছু হলেই আমতলায় এসে জড়ো হওয়া! জ¦ালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া! এবার দেখাচ্ছি মজা!

অ্যাসিডে শরীর জ¦লেপুড়ে যেন ছাই হয়ে গেল আমার। আমার কাণ্ডে কাণ্ডে, শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায় যেন আগুনের হলকা বয়ে গেল, আমি নীরবে আর্তনাদ করে উঠলাম।

আমি মরে যেতে লাগলাম।

সকালবেলা কিছু ছাত্র আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে বলতে লাগল, গাছের পাতাগুলো এরকম হলুদ হয়ে গিয়েছে কেন রে?

তার উত্তরে আরেকজন বলল, রোদের তাপে। দেখছিস নে কতদিন ধরে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয় না?

হায়, আমি তাদের মুখ ফুটে বলতে পারলাম না আমাকে ধ্বংস করার সেই নীল ষড়যন্ত্র। কীভাবে বলব? সৃষ্টিকর্তা আমাকে তো বাকযন্ত্র দেননি।

এরপর থেকে আমি ক্রমাগত যেন নিঃশেষ হয়ে যেতে লাগলাম। ছাত্ররা তাদের মতো করে প্রাণপণে চেষ্টা করল আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে। কারণ আমার সঙ্গে তাদের সংগ্রামের দিনগুলো জড়িত। তারা আমাকে হারানোর ভয়ে কাতর হয়ে উঠল। একদিন একজন বৃক্ষবিশারদকে তারা ডেকে আনল আমাকে পরীক্ষা করার জন্য। তিনি অনেকক্ষণ আমাকে দেখে, ডালপালা নাড়াচাড়া করে বললেন, এ তো মরে গেছে!

কী বলেন স্যার, মরে গেছে? একজন ছাত্র কাতর হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

উত্তরে বৃক্ষবিশারদ বললেন, আর আশা নেই!

তাঁর এই উক্তি শুনে ছাত্ররা করুণ চোখে এ-ওর দিকে তাকাল। ডাকসুর সহ-সভাপতি চলে এলো। সে পোড়খাওয়া একজন ছাত্রনেতা। দেখেশুনে গম্ভীর হয়ে সে বলে উঠল, ঠিক আছে, যদি মরে যায়, যদি মরে গিয়েই থাকে – এটা যে একটা স্যাবোটাজ তা আমরা জানি; কিন্তু বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই – এখন যেটা আমরা করতে পারি, এর কাণ্ডটিকে তুলে নিয়ে আমরা ভার্সিটির ডাকসু মিউজিয়ামে রেখে দিতে পারি।

তো সেটাই করা হলো।

আমি এখন মৃত হলুদ একটি আমগাছ। যার ছায়ার নিচে একদিন রচিত হয়েছিল ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস,  শিক্ষা-আন্দোলনের সাহসী হরতাল, মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল ঐতিহাসিক সংগ্রাম, সে এখন মৃত। এখন সে স্পেসিমেন হিসেবে বিশ^বিদ্যালয়ের ডাকসুর জাদুঘরে রক্ষিত। অথচ আমার মরে যাওয়ার কোনো কথাই ছিল না। আমার এখনো বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু এসব কথা কাকে আর বলব? আমার যে করুণ ইতিহাস এটা তো বাংলারই করুণ ইতিহাস। বাংলাকে ধ্বংস করার ইতিহাস।

তার প্রমাণ এরপরও বাংলার মানুষ বারবার পেয়েছে। কারণ আমার জানামতে, দেশের মানুষেরা বেশ কয়েকবার আমার নাম স্মরণে রেখে সেই একই জায়গায় একটি করে নতুন আমের চারা পুঁতেছে; কিন্তু কোনোবারই সেই আমচারাগুলো বেশিদিন বাঁচতে পারেনি। প্রত্যক্ষদর্শীর চোখের সামনেই দেখা গেছে মানুষেরা চা খাওয়ার সময় একটু করে গরম চা বা কফি কচি আমগাছের গোড়ায় প্রথমে ঢেলে দিয়ে তারপর পান করে! সিগারেট খেতে খেতে জ¦লন্ত সিগারেটের টুকরো তাদের শরীরে ছুঁড়ে মারে। মালি প্রায় ওই গাছের গোড়ায় পানি দিতে ভুলে যায়।

ভাষার প্রতি, সংগ্রামের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, সর্বোপরি মাতৃভূমির স্বাধীনতার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য তারা এভাবেই প্রকাশ করে।

তবু এতো কিছুর পরেও সংগ্রাম থেমে থাকেনি। কোনোদিন থেমে থাকবেও না, যেহেতু বাংলার প্রাণশক্তি যে তরুণ ছাত্রসমাজ, তারা সদাই তন্দ্রাহীন, সদাই জাগ্রত, সদাই দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে উদগ্রীব।

কিন্তু আমার মাত্র কিছু অংশ ডাকসুর জাদুঘরে রক্ষিত। বাকি অংশ কালের ধুলায় কোথায় মিলিয়ে গেছে।

আমার যে-গৌরবের ইতিহাস, তাতে করে আমার মৃত্যুটিকে জাতীয় ঘোষণায় আনার দরকার ছিল। আমি সেটা দাবি করতে পারি। রেডিও, টেলিভিশন এবং খবরের শিরোনাম হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু দেশবাসী সেটা আজো করেনি। আমার ব্যক্তিগত মরণোত্তর বিলাপ তো চলতেই থাকবে!