মাজহারুল ইসলাম ও গ্লেন মারকাট : স্থাপত্যের দুই প্রবাদপুরুষ

রফিক আজম

সময়টা ২০০৩ সালের শীতকাল। শ্রদ্ধেয় স্থপতি সাইফুল হকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, বিশ্বখ্যাত অস্ট্রেলীয় স্থপতি গ্লেন মারকাটের অধীনে একটি ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়া যায়। জানামাত্র আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিলাম। গ্লেনসহ আরো তিনজন স্বনামধন্য অস্ট্রেলীয় স্থপতি-শিক্ষক এ-ওয়ার্কশপটি বেশ কয়েক বছর ধরে আয়োজন করছিলেন। আমি বেশ কিছুদিন ধরেই গ্লেনের কাজ মনোযোগ সহকারে দেখছিলাম। সাদামাটা উপকরণ দিয়ে, বিশেষভাবে টিনের চালে একতলা দালানগুলো অস্ট্রেলীয় নিসর্গের মাদকতার মধ্যে যেন এক মানবতার প্রতীক। এখানে গ্লেন সম্পর্কে কিছুটা বলা দরকার বলে মনে করি, বিশেষ করে সেসব পাঠকের জন্য, যাঁদের কাছে গ্লেন তেমন একটা  পরিচিত নন। বর্তমান বিশ্বস্থাপত্যে গ্লেন মারকাট একটি উজ্জ্বলতম নাম। গ্লেন একজন সুফি স্থপতি, যিনি ছোট অসংখ্য কাজ করেছেন এবং করছেন। যেখানে বাড়িঘর ডিজাইন করেন, সেখানেই বাস করে কাজটি করেন। একাই কাজ করেন, কোনো সঙ্গী নেই। মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না, নেই কোনো ই-মেইল অ্যাড্রেস। এমন দূরে বা ভিন্ন দেশে কাজ করেন না, যেখানে ইচ্ছামতো তিনি যেতে পারেন না। সুতরাং সব কাজই তাঁর মূলত যাতায়াত উপযুক্ত জায়গায়। হতে পারে তা কাছের কোনো জঙ্গলে বা শহরে। পৃথিবীতে স্থাপত্যের যত সম্মাননা আছে প্রায় সবই তাঁকে দেওয়া হয়েছে তাঁর জীবনদর্শন আর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ। সৌভাগ্যক্রমে এই ওয়ার্কশপে আমি যোগদান করি এবং তাঁর কাছে ১৫ দিন নিবিষ্টভাবে কাজ শেখার সুযোগ পাই, যা আমার জীবনের এক পরম পাওয়া। গ্লেন প্রায়ই বলতেন – মাটি হচ্ছে মা, ওকে কষ্ট দিও না, স্থাপত্য করো আলতো ছোঁয়ায়। তাঁর কাজ দেখে মনে হয়, এ যেন এক পাখি মাটিতে উড়ে এসে বসলো আর খানিক বাদেই ডানা মেলে উড়াল দেবে।
এ লেখার শুরুতে গ্লেনের প্রসঙ্গ টানার উদ্দেশ্য হলো এই যে, এরকম একজন মানুষ আমাদেরও আছেন। কেউবা বলবেন ছিলেন। সে যা-ই হোক, দুঃখ হচ্ছে এই মানুষটাকে আমরা ঠিক কেউ বুঝতেই পারিনি। অবশ্যই আমি মাজহারুল ইসলাম স্যারের কথা বলছি। আমার ধারণা, মানুষ যখন দূরদর্শী ও মহান হয়, আমরা বা সমাজ তাঁকে বুঝতে পারি না। বিশেষভাবে আমাদের অঞ্চলে। ফলাফল, তাঁকে রাখা হয় দূরে ঠেলে। কারো কারো বেলায় এরকমটা না ঘটলেও মাজহারুল ইসলামের বেলায় এমন ঘটেছে, যিনি গ্লেনের অনেক আগেই বলেছেন দেশ আর মাটির কথা। ইসলাম স্যারের সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, যা বিশ্বের খুব বেশি স্থপতির মধ্যে দেখা যায়নি বা যায় না, তা হচ্ছে – স্থাপত্যকে ব্যবহার করে সমাজ গঠন করার ইচ্ছা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তিনি যে-সময়ে এ-চিন্তা করছিলেন সে-সময়ে এমন সমাজই গঠন হয়নি যা স্থাপত্যকেই ধারণ করতে পারে। ফলে তিনি ভাবলেন, আগে সমাজটাকে গঠন করতে হবে। আর সমাজ গঠনের একটি মোক্ষম উপায় হতে পারে রাজনীতি। সুতরাং একজন স্বপ্নদ্রষ্টা স্থপতি গোছানো একটি সমাজের আশায় রাজনীতিতে যুক্ত হলেন। আমার সামান্য জ্ঞান দিয়ে আমি বলতে পারি, স্থপতি রাজনীতিবিদ এ-পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। এখানে ফরাসি-সুইস স্থপতি লে কর্বুসিয়েরের কথা বলতে পারি, যিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন সমাজের দৈন্য দূর করার জন্য। এটা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা; আধুনিকতাবাদের একটি সময়ে যখন শিল্পায়ন রমরমা অথচ কর্মীদের থাকা-খাওয়ার জায়গা নেই, শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই, হাসপাতাল নেই, স্কুল নেই বাচ্চাদের। কর্বু অবশ্য এক্ষেত্রে তাঁর স্থপতিসত্তাকে মোটেও বাদ দেননি। এখানে একটি কথা পরিষ্কার যে, কর্বুসিয়ের রাজনীতিকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন শুধু সমাজের কিছু অসংগতি শোধরাতে যা কিনা সরাসরি স্থাপত্যের সঙ্গে জড়িত ছিল। যেমন গণহারে বাড়িঘর নির্মাণ, কাজের উপযুক্ত কারখানা নির্মাণ, স্কুল নির্মাণ, গণশৌচাগার নির্মাণ, নগরের নকশা ইত্যাদি। মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে কর্বুসিয়েরের পার্থক্য হচ্ছে, ইসলাম সাহেব তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে নিজেকে শুধু ত্রিমাত্রিক নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, পুরো সমাজকে গোছানোর কথা বলেছেন। এখানে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক সবই সম্পূরক। ফলে ইসলাম সাহেবের রাজনৈতিক সত্তা আর স্থপতিসত্তা সাংঘর্ষিক নয়। যেখানে কর্বুসিয়েরের বেলায় তাঁর রাজনৈতিক দর্শন আর স্থাপত্য দর্শন সাংঘর্ষিক ছিল। এর ফলই হলো শুদ্ধ আধুনিকতাবাদের পতন এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদের মাধ্যমে প্রশ্ন উত্থাপন। সুতরাং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থপতি লে কর্বুসিয়েরের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে, যা সময়ের সঙ্গে সঠিক থাকলেও সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ‘সঠিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অথচ মাজহারুল ইসলাম যে এক দারুণ স্থপতি তার প্রমাণ সেই পঞ্চাশ দশকে দিয়েছেন এবং রাজনীতি করার কারণে তাঁর সামগ্রিক সততায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, ইসলাম সাহেব যদি চাইতেন তাহলে তিনি রাজনীতিকে ব্যবহার করতে পারতেন ভালো স্থপতি হওয়ার সুযোগ তৈরিতে। তিনি তো তা করেনইনি বরং এই রাজনীতি তাঁর স্থপতি হয়ে ওঠার পেছনে বাধা হয়ে দাঁড়াল। এভাবে দেখলে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, মাজহারুল ইসলাম একজন আদর্শ স্থপতি। এই লেখার মধ্য দিয়ে আমি অবশ্যই সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বসেরা স্থপতি লে কর্বুসিয়ের বা গ্লেন মারকাটকেও। অথচ আমাদের সামনে একজন বিশ্বসেরা স্থপতি ছিলেন, যাঁকে এই দেশ, এই সমাজ চিনতেই পারেনি। কী ছিল ইসলাম স্যারের  সামগ্রিক দর্শন?
এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ইসলাম স্যারের সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতি মনে করতে চাই। আমি যখন স্কুলে পড়ি, ক্লাস সিক্স বা সেভেনে, নিয়মিত শামসুন্নাহার শিশুকলা ভবনে ছবি আঁকা শিখতে যেতাম। এটা ছিল তৎকালীন আর্ট কলেজের ক্যাম্পাসের ভেতর একটি টিনের ঘরে। ঘরের ভেতরে বসে ছবি আঁকার সব ব্যবস্থা থাকলেও আমি কোনোদিন ভেতরে ছবি আঁকিনি। আমি ওখানে যেতামই ঘুরে ঘুরে আমার ভালোলাগার জায়গাটায় বসে ছবি আঁকতে, পানিহীন পুকুরপাড়ে বৃত্তাকার হাঁটাপথের পাশে বসে পামগাছের লম্বা একহারা শরীরের মাথায় ঝাঁকড়া পাতাগুলো আঁকতে, বারান্দায় বসে মোটা লিচুগাছটার আঁকাবাঁকা ডালগুলো আঁকতে কিংবা টানা বারান্দায় কিরকমভাবে শীতের দুপুরে হেলানো রোদ পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে এসে নাড়াচাড়া করে তা দেখতে। নিজের অজান্তেই আমি বোধহয় দেখেছি প্রকৃতিকে এতো কাছ থেকে আর দালানোর সঙ্গে প্রকৃতিকে মিশে যেতে। আমার কাছে  এ-বিষয়টা এতটাই স্বাভাবিক মনে হতো যে, ভাবতাম সবটুকুই স্রষ্টার সৃষ্টি। এর পেছনে কোনো স্থপতি থাকতে পারেন, তা মনেই হয়নি। তাই কোনোদিন মনে এ-প্রশ্ন আসেনি, এটার স্থপতি কে? অবশ্য এটাও সত্য, ‘স্থপতি’ শব্দটির সঙ্গে আমার তখন কোনো পরিচয়ও ছিল না। পরবর্তীকালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে ভর্তির জন্য অনেক স্থপতির নাম মুখস্থ করতে হয়েছে, কিছু কিছু স্থাপত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, যার মধ্যে এ-কলেজও ছিল।  ছাত্রাবস্থায় এই মহান স্থপতিকে কাছ থেকে দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে বেশ কয়েকবার। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, এই উন্নত মানুষটাকে  দেখে কখনো আমার মনে হয়নি, অন্যদের মতো আমিও একটু কথা বলি, পরিচয় দিই যে, আমি স্থাপত্যের একজন ছাত্র। আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা বোধ কাজ করতে লাগল যে, আমি তাঁর মতো হতে চাই। চুপি চুপি ইসলাম স্যার হয়ে উঠলেন আমার স্বপ্নপুরুষ। মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকলাম যেন আমিও স্থাপত্যে এমন কিছু করতে পারি, যার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়টা হয়ে উঠবে অর্থবহ। আমার সৌভাগ্যের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে ১৯৯৭ সালে। সে-বছর দক্ষিণ এশিয়া স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় আমি একটি পুরস্কার পাই ‘দৃক পিকচার লাইব্রেরি ও গ্যালারি’ প্রকল্পটির জন্য। একই সময় এই পুরস্কার অনুষ্ঠানে মাজহারুল ইসলাম স্যারকে ‘গ্রেট মাস্টারস অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করার সিন্ধান্ত হয়। অনুষ্ঠানটি ভারতের জয়পুরে অনুষ্ঠিত হয় এবং তৎকালীন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী আশোক গেলোটে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন। আমরা একদল ঢাকা থেকে জয়পুরের উদ্দেশে রওনা দিই। অনুষ্ঠানে আরো একজন বাঙালি স্থপতি পুরস্কৃত হন। তিনি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টটিউট ও একই সঙ্গে কমনওয়েলথ দেশসমূহের স্থপতিদের সভাপতি। আরো ছিলেন অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস, যিনি প্রতিযোগিতায় একজন বিচারক ছিলেন। সেবারই প্রথম আমি ইসলাম স্যারের কাছে গিয়ে আমার পরিচয় দিয়ে কথা বলি। আমার স্বপ্ন পূরণ হয় এবং তাঁকে নিয়ে পরবর্তীকালে মাজহারুল ইসলাম মাস্টার ক্লাস পরিকল্পনা ও পরিচালনা করি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায়। এরই মধ্যে একদিন তাঁর অফিসে যাই দেখা করতে এবং তিনি হঠাৎ করে একটি রাইস পেপারের রোল আমার হাতে দিয়ে বলেন, এটা আপনাকে দিলাম, ড্রইং করবেন। এ ছিল আমার জীবনে এক পরম পাওয়া। এ যেন আমার হাতে ব্যাটনটা তুলে দেওয়া। আজীবন আমি যেন এটা বহন করতে পারি আর আমার যাওয়ার সময় অন্য কোনো যোগ্য হাতে এটা দিয়ে যেতে পারি – এই আমার স্বপ্ন।
আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
কী ছিল ইসলাম সাহেবের সামগ্রিক দর্শন? এটা এরকম নয় যে, আমি স্যারের কাছ থেকে তাঁরই দর্শন আলাদাভাবে শুনে নিয়ে এ-লেখা লিখছি। কিছু কিছু সময় স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁর ওপর এ-লেখা পড়েছি, তাঁর কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফরহাদ মাযহার সাহেবের সঙ্গে কথা হয় রাজনীতি ও দর্শন নিয়ে। মনে মনে মাজহারুল ইসলাম স্যারের কথা এলোমেলোভাবে ভাবি। দেশের সামগ্রিক নগরায়ণ প্রক্রিয়া দেখে কেন যেন মনে হয় যে, আমরা ইসলাম স্যারকে না বোঝার খেসারত দিচ্ছি। আজকাল অনেকেই সামগ্রিক পরিবেশ, নগরায়ণ, যানজট, ফ্লাইওভার, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছেন, আন্দোলন করছেন। এগুলোর ফল তো অবশ্যই  হয়েছে, এ বিষয়গুলো বলা যায় রীতিমতো একটা পলিটিক্যাল এজেন্ডা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এটাই বা কম কী? কিন্তু এর মধ্যে দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে। ইসলাম স্যারের কল্যাণমুখী নগরায়ণ বাস্তবে আনতে হলে একে রাষ্ট্রকাঠামোর অংশ হিসেবে স্থাপন করতে হবে বলে আমি মনে করি। কোনো পলিটিক্যাল এজেন্ডা হিসেবে এটা মোটেও যথেষ্ট নয়। প্রতিরক্ষা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, সরকার, অর্থনীতি ইত্যাদি রাষ্ট্রকাঠামোর অংশ যা বাদ দিলে রাষ্ট্রই হয় না। তেমনি নগরায়ণ/ ত্রিমাত্রিক পরিকল্পনা রাষ্ট্রের কাঠামোতে আসা দরকার। বাংলাদেশে অনেক মন্ত্রণালয় আছে কিন্তু ত্রিমাত্রিক পরিকল্পনা (physical planning)  ও নগর  পরিকল্পনার (Urban planning) জন্য আলাদা কোনো মন্ত্রণালয় নেই। এরকম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ন্যস্ত রয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাতে। এমনিতেই তো এই নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কাজ করে। তার ওপর এ-প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের ধারার মধ্যে রয়েছে সাংঘর্ষিক বৈপরীত্য। এরা না ব্যবসায়ী, না পেশাজীবী। ফলে পুরো বাংলাদেশের জন্য একটি সামগ্রিক দর্শনযুক্ত সুদূরপ্রসারী ত্রিমাত্রিক পরিকল্পনা এভাবে সম্ভব নয়। এ-মুহূর্তে বাংলাদেশের জমির পরিমাণ আর জনসংখ্যা বিবেচনায় নিলে যোগাযোগহীন এলাকাভিত্তিক ত্রিমাত্রিক পরিকল্পনা আত্মহত্যার শামিল। এ-মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে দরকার ‘ত্রিমাত্রিক নগর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়’, যার প্রধান দায়িত্বে থাকবেন একজন স্থপতি, যিনি physical planning & Urban design-এ পারদর্শী। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকতে হবে সৎ ও যোগ্য একদল পেশাজীবী, যাঁদের দায়িত্বের মধ্যে থাকবে ত্রিমাত্রিক ও নগর পরিকল্পনা করা সমগ্র বাংলাদেশের। প্রয়োজনীয় পরিবর্তন,  পরিবর্ধন করার দায়িত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূল দর্শন ও কাঠামোকে পরিবর্তন না করে। এজন্য দলে দরকার দার্শনিক, স্থপতি, ত্রিমাত্রিক ও অন্যান্য পরিকল্পনাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ/ লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ ও অন্য ব্যক্তিবর্গ। আমি বলতে চাচ্ছি যে, এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাদের এলাকার ত্রিমাত্রিক ও অন্যান্য পরিকল্পনা করতে পারেন। কিন্তু সেটা হতে পারে একটা কেন্দ্রীয় দর্শনের ভিত্তিতে। পরবর্তীকালে প্রতিটি আঞ্চলিক পরিকল্পনা একত্রিত হওয়া দরকার এবং বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ত্রিমাত্রিক ও নগর পরিকল্পনা হওয়া দরকার। এজন্য একটি সঠিক ও নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় দরকার। সঠিক নগরায়ণ একটি রাষ্ট্রকে অনেকদূর নিয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফ্রান্সের মিতেরাঁ সরকার ঘোষণা করে যে, ১১টি দালান নির্মাণের মধ্যে দিয়ে প্যারিসকে পৃথিবীর একটি প্রধান কেন্দ্রস্থল বানানো হবে। এটা প্রায় ২০ বছর আগের কথা। এরপর দুই জার্মানি এক হওয়ায় তাদের দুই দেশের মিলনস্থল যে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ খালি পাওয়া যায়, তাকে নগরায়ণের মধ্যে দিয়ে ‘পোসডামার প্লাটজ’ নামে জায়গাটা নির্মাণ করে ও পৃথিবীর প্রধান শহর প্যারিসকে পেছনে ফেলে নতুন শহরকেন্দ্র তৈরি করে নেয়। এভাবে বহু শহরের রূপান্তর হয়েছে ভালোর দিকে। অথচ আমরা এক জাতি নগর বিষয়ে এতটাই উদাসীন যে,  যেন ‘শরীরে ক্যান্সার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো’। ইদানীং আমরা এও দেখছি, DMDP,  DAP ইত্যাদি নিয়েও বেশ হইচই হচ্ছে। অথচ আমরা যদি মাজহারুল ইসলাম স্যারের ঢাকার মাস্টারপ্ল্যানের উপস্থাপনা দেখি, দেখবো তিনি বলছেন, মাস্টারপ্ল্যানের আগে মাস্টারপ্ল্যানের দর্শন কতটা জরুরি। বর্তমান যে-মাস্টারপ্ল্যান বা Detail area plan হয়েছে বলা যায় তা কোনো প্রকার দর্শন ছাড়াই। এখানেই আমাদের Master plan ও মাজহারুল ইসলামের দূরদর্শিতার মধ্যে পার্থক্য। এবার স্থাপত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম স্যারকে বোঝার চেষ্টা করি, যাতে তাঁর দর্শনের সঙ্গে কিছু হলেও পরিচিত হতে পারি। আচ্ছা মাজহারুল ইসলাম কি একজন আধুনিক স্থপতি? কিংবা উত্তর-আধুনিক? কিংবা অন্য কিছু? আমরা জানি তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি লাভ করার পর চাকরিতে যোগ দেন। পরে স্কলারশিপ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। আমার জানামতে সে-সময়ে স্থাপত্যশিক্ষায় আধুনিক ধারার একটা influence ছিল। পরে লন্ডন A A-স্কুলে স্থাপত্য ও জলবায়ু বিষয়টি তাঁর পড়াশোনায় যুক্ত হয়। আমার ধারণায়, যদিও তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত; কিন্তু তাঁকে এ-ধারায় ফেলাটা দুষ্কর। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে তাঁর দেশের প্রতি মায়া, মাটির গন্ধ, মানুষের মঙ্গল কামনাও যুক্ত হয়েছে। তাঁর কাজ হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক ভাষায় সমৃদ্ধ দেশজ। যেমন এখানে যদি চারুকলা ইনস্টিটিউট পর্যালোচনা করে দেখি।
আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগের ঢাকা আর্ট কলেজের (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট) দিকে তাকালে বোঝা যায়, তিনি কীভাবে সবুজ লন আর উঠানকে এক করেছেন। দক্ষিণদিকে বাংলাবাড়ির আদলে টানা বারান্দা, লিচুর গাছ, শীতের হেলানো রোদ, পোড়ামাটি ও কাঠের ব্যবহার এই আধুিনক কাঠামোকে করেছে বাংলার স্থাপত্যের উজ্জ্বল স্বরূপ। তাঁর কাজ কথা বলে স্থানের, মানুষের এবং বিশ্বের। এজন্যেই তিনি পৃথিবীর একজন সেরা আধুনিক স্থপতি। তখনকার এই ইনস্টিটিউটের ডিজাইনটি ভালো করে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, এটা নেহায়েত একটি তথাকথিত আধুনিক ধারার কাজ নয়। এখানে আধুনিক ধারায় শিক্ষিত ইসলাম সাহেব তাঁর দেশপ্রেম, দেশের জলবায়ু, Traditional Space Typology, সমাজদর্শন ইত্যাদির মিলন ঘটিয়েছেন। ভিন্নমাত্রার গুণাবলি বিচারে তাঁর কাজ আদতে কোনো ধারার মশালবাহক নয়, বরং সমসাময়িক। আধুনিকতা আর স্থানিকের এক অপূর্ব সমন্বয়। প্রথমদিককার তাঁর দুটো কাজের মধ্যে একধরনের ভাষাগত মিল থাকলেও পরবর্তীকালে তাঁর কাজে পরিবর্তন লক্ষণীয়। আমার নিজের যতটুকু মনে হয়েছে, প্রথমদিকে তাঁর কাজে বাউহাউস (Bauhaus) স্কুলের প্রভাব ছিল বেশি। যেমন আর্ট কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি- এসব কাজে একধরনের সরলতা, উপকরণ-ব্যবহারে ভিন্নতা, মাটিতে দালান হালকাভাবে স্থাপন ইত্যাদি বিশ্লে¬ষণে আপাতদৃষ্টিতে তাঁকে আমার সেরকমই মনে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষ করে লুই আই কানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পর ধীরে ধীরে কাজে তাঁর বোজার্টের (Buex-Art) ছাপ দেখতে পাই। দালানের হালকাভাব সরে  গিয়ে দৃঢ়ভাবে মাটিতে প্রোথিত হওয়া, সরলতা উন্মত্ততার ভাষা পালটে গিয়ে একধরনের গাম্ভীর্য, ঠাস বুনন, উপকরণ-ব্যবহারে একমুখী হওয়া আর জ্যামিতিক প্রকটতা প্রকাশ পেয়েছে। যেমন – জাতীয় আর্কাইভস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এসবই বোজার্টের বা কানের কারণে ঘটেছিল বলে আমার ধারণা। তবে মজার ব্যাপার হলো, কোনো অবস্থাতেই তিনি তাঁর কাজে স্থানকে অবহেলা করেননি। সে-সময়ে আধুনিক স্থাপত্যধারা বহমান ছিল, বিশেষ করে এসব অঞ্চলে, তখন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম সেই প্রবাহে গা ভাসাননি। ভাবতে অবাক লাগে, কীভাবে তিনি এ প্রভাবশালী স্থাপত্যধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্থানের জলবায়ু, সংস্কৃতি, পরিবেশ ইত্যাদি বিবেচনায় এনেছিলেন সেই পঞ্চাশের দশকে। অথচ এই বিষয়গুলো মূলত আলোচনায় এসেছে ষাট এবং সত্তরের দশকে প্রকটভাবে। এছাড়া তাঁর ভাবনার সবচেয়ে দৃঢ় দিক হচ্ছে চিন্তার সামগ্রিকতা। ছোট একটা স্থানকে ভাবতে চাইলে এর অবস্থান দেশজুড়ে কিংবা বিশ্বজুড়ে করতে পারা তাঁকে একজন দূরদর্শনীয় স্থপতি বললে ভুল বলা হবে। বরং বলতে হয় দূরদর্শী মানুষ। স্থাপত্যর গণ্ডি ছাড়িয়ে মানুষের কল্যাণই ছিল দর্শন। একসময়ে স্থাপত্যকে বেছে নিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের মাধ্যম হিসেবে। যখন দেখলেন স্থাপত্যের হাত-পা রাজনীতির কাছে বাঁধা, তখন রাজনীতিতে প্রবেশ করে চাইলেন স্থাপত্যকে মানুষের কল্যাণের শক্ত হাতিয়ার বানাতে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর নিয়ন্ত্রণহীন ক্রম-অবক্ষয়ের রাজনীতি, তৎকালীন বামঘেঁষা বাংলাদেশের রাজনীতির বিরুদ্ধে পুঁজিবাদীদের ষড়যন্ত্র বা অসহযোগিতা সামগ্রিকভাবে দৃশ্যপটকে করে তোলে কোনোপ্রকার শিল্পবিকাশের অননুকূল। ফলে ইসলাম সাহেবের সময় চলে যায় স্থাপত্যধারা ঠিক করার আগে রাজনীতির ধারা ঠিক করতে। বঙ্গবন্ধুর আশ্বাসে যে ক্ষীণধারা নির্মাণের ক্ষেত্র যদিওবা তৈরি হয়েছিল, তাও নিঃশেষ হলো ১৯৭৫-এর কালো অধ্যায়ের পর। তাই অনেকটা দুঃখ করে বলতে হয়, এদেশের রাজনীতিও ঠিক হয়নি এবং মাজহারুল ইসলামের পক্ষে তাঁর নিজের মতো করে পরিপূর্ণ স্থাপত্যে ফেরাও হয়নি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে ইসলাম সাহেবের বয়স ছিল পঞ্চাশের কাছে এবং লক্ষণীয়, স্বাধীনতার পর দুই-তিনটা প্রধান কাজ ছাড়া তাঁর আর কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ নেই বললেই চলে। সত্যি বলতে কাজ দেওয়া হয়নি। মূলত এদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাবান স্থপতিকে কাজশূন্য করা হলো। আমি নিজেই এখন ৪৬ বছর বয়সের স্থপতি এবং এই কিছুদিন আগেও আমি তরুণ স্থপতি হিসেবে বেশকিছু আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছি। অর্থাৎ বিশ্বস্থাপত্যে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত একজন স্থপতিকে মোটামুটি তরুণই বলা যায়। সুতরাং মাজহারুল ইসলাম তাঁর ৫০ বছর বয়সের পর স্থাপত্যচর্চা না করতে পারা যে এদেশের কত বড় ক্ষতি তা আঁচ করার সামর্থ্যও এই সমাজের নেই। এটা অনেকটা ‘যদি রবীন্দ্রনাথ তাঁর পঞ্চাশ বছরের পর আর কোনো সাহিত্য রচনা না করতেন’ তাহলে কী ঘটত? প্রশ্নটা এরকম। মাজহারুল ইসলামের একটা ব্যাপার মাঝেমধ্যে আমার মনে আক্ষেপ জাগায় না তা নয়, আর সেটা হচ্ছে, মাজহারুল ইসলামের রাজনীতিকে পাশে ঠেলে স্থাপত্যশিল্পকে আরো বেশি সময়ে জোর করে না দেওয়া। জানি যতটুকু করেছেন তা-ই বাংলার আধুনিক স্থাপত্যের মাইলফলক। তারপরও তাঁর আরো কাজ, অনেক কাজ পরবর্তী প্রজন্মের স্থপতিদের মধ্যে তাঁর জ্ঞান ও দর্শনপ্রবাহের আয়োজন তাঁর নিজের দ্বারা অথবা অন্যদের দ্বারা ব্যাপক হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে খানিকটা অভিমান বা খানিকটা এই অর্ধশিক্ষিত সমাজকে বোঝাতে না পারার বেদনা হয়তো স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে খানিকটা অন্তর্মুখী ও আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে বলে মনে হয়। তারপরও এ-কথা সত্যি যে, বাংলাদেশের স্থাপত্য এই সময়ে ধীরে ধীরে নতুন এক অবয়ব নিচ্ছে। তার মধ্যে লক্ষণীয় অনেক উপাদান দেখা যায় যার সম্পর্ক এদেশের স্থাপত্য, সংস্কৃতি, নির্মাণ-উপাদান, মানুষের চাহিদা, জলবায়ু ইত্যাদির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতকিছুর পরও দেশের স্থাপত্যশিল্পের মূল ভিত্তি সেই মাজহারুল ইসলামই। এখনো এদেশের তরুণ স্থপতিদের কাছে মাজহারুল ইসলাম একজন দূরদর্শী, হার-না-মানা তেজি, ভালোবাসায় সিক্ত এক রহস্যপুরুষ।