সুধা চুপিচুপি শতদ্রুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন, ‘এই যে দ্রুভাই, তোমার দাদাভাই সারাবাজার চষেও খুঁজে পাননি তোমার নরেন মিত্তিরের রস।’ শতদ্রু তখন ঘুমের দেশ ছেড়ে ধীরে ধীরে তরী ভেড়াবে তীরে। সুধার কথাটা শুনে আচ্ছন্নের মতো বলে ওঠে সে, ‘আহা, বউমণি, দাদাভাইয়ের কি মাথা খারাপ হলো, বাজারে গেছে খুঁজতে, ওটা তো পাওয়া যাবে কলেজ স্ট্রিটে, বই পাড়ায়।’
সুধা অবাক হয়ে বলে ওঠেন, ‘বলো কী দ্রুভাই, গুড়ও পাওয়া যায় নাকি তোমার ওই বইপাড়ায়!’
এবার ধড়মড়িয়ে উঠে বসে শতদ্রু। সে ঘুম-ঘুম চোখে জানতে চায়, ‘তুমি কী বলতে চাইছ একটু বুঝিয়ে বলো তো বউমণি?’
সুধা দু-চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন শতদ্রুর দিকে। তারপর বলেন, ‘তোমারও মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি দ্রুভাই!’
শতদ্রু একটা লম্বা হাই তুলে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে যেন গলা খোলে এবার, ‘মাথা খারাপ হওয়ারই শামিল, সারারাত জেগে একটা উপন্যাস নামাচ্ছি, আসছে বৈশাখের নববর্ষ সংখ্যার জন্য, না দিতে পারলে দেবুদা পেঁদিয়ে ছাড়বেন…!’
– তাই বলে কি আমার বানানো গেলবারের নলেন গুড়ের পিঠের কথা বেমালুম ভুলে যাবে? যে মন-মাতানো গুড় দিয়ে বানিয়েছিলাম সেটা তো তুমিই এনে দিয়েছিলে আমাদের এখানকার বাজারের কোন ‘নরেন মিত্তিরের রস’ থেকে। ওই সুস্বাদু গুড় নাকি কেবল ওই দোকানেই পাওয়া যায় – তুমিই বলেছিলে। মাজু খাতুন না কে যেন বানায় ওই গুড়। তাই আজ ঘুম থেকে উঠেই তিনি ওই গুড়ের খোঁজে এক চক্কর মেরে এসেছেন বাজার। খুঁজে পাননি।
এবার শতদ্রুর মাথায় ঢুকলো ব্যাপারটা। আর কোনো রা না করে সে দ্রুত উঠে পড়ে। চটপট প্রাতঃকৃত্য সেরে নিয়ে বসে চায়ের টেবিলে। এ-বাড়ির সকালের চায়ের পাট চুকে যায় সাত-সকালেই। সুধা শতদ্রুর জন্য ফ্লাস্কে চা রেখে দেন। কারণ শতদ্রু যখন বিছানা ছাড়ে ঘড়ির কাঁটা তখন দু-পাক মেরে ফেলে। দুধওয়ালার দুধ দেওয়া হয়ে যায়, রাধেশ্যাম বাজার নিয়ে চলে আসে, দাদাভাই আপিস পৌঁছে ঘাড় গুঁজে কাজ শুরু করে দেন, বউমণি সকালের রান্না সেরে বসেন টিভি চ্যানেলে ‘হারানো দিনের গান’ শুনতে।
শতদ্রু ফ্লাস্ক থেকে ওর বরাদ্দে থাকা ঢাউস কাপটায় চা ঢালে। তারপর বয়াম থেকে বিস্কিট নিয়ে আজকের খবরের কাগজের টাটকা হেডিংগুলোতে চোখ বুলোতে বুলোতে চা পানে মজে যায়। ওই মুহূর্তে সুধা টিভি ছেড়ে চেয়ারটা টেনে শতদ্রুর কাছে এসে বসেন। তারপর বলেন, ‘জানো তো দ্রুভাই, কাল বাদে পরশু পৌষপার্বণ, তোমার দাদাভাই কিন্তু ওই খাসা গুড় ছাড়া অন্য কোনো গুড় দিয়ে বানানো পিঠে-পায়েস খাবেন না বলে দিয়েছেন, গুড়টা ওই দোকান থেকেই আনতে হবে …।’
বলে একটু থামেন তিনি। তারপর আবার শুরু করেন, ‘এরই মধ্যে কৃষ্ণনগর থেকে বিভুনন্দাই, বর্ধমান থেকে দোলা, কোন্নগড় থেকে অলকামাসি, মাধ্যমগ্রাম থেকে সরোজকাকাবাবু ফোনে পরশু সপরিবারে পিঠে খেতে আসছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। গৌহাটি আর ঢাকা থেকে দাদার ছোট ছেলে বুবুন ও তোমার বন্ধু ইকবাল এবারো ছাড়বে না বলেছে, ওরাও ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলেছে …। ওরা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, গেলবারের মতো স্পেশাল যাতে হয় এবারের পিঠে-পায়েস। মানে তোমার ওই দোকানের কী খাতুন যেন বলে, ওর বানানো গুড় চাই …।’
শতদ্রু চা পান করতে করতে খবরের কাগজে চোখ রেখেই অনেকটা বিহ্বল হয়ে বলে ওঠে, ‘ওহ্, তাই নাকি, এতো তোড়জোড়, তাহলে তো এনে দিতেই হবে …।’
সুধা এবার শতদ্রুর দিকে অনেকটা ঝুঁকে গিয়ে টানটান গলায় বলে ওঠেন, ‘তোমার অসুবিধে হলে আমিই গিয়ে নিয়ে আসতে পারি। আমাকে শুধু দোকানটার লোকেশনটা বলে দাও, দোকানটা কি একেবারে চিপায়-চাপায়, তোমার দাদাভাই খুঁজেই পেলেন না!’
শতদ্রু খবরের কাগজ থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘না না, তোমার অতো কষ্ট করতে হবে না বউমণি, আমিই নিয়ে আসব।’
সুধা নম্র হাসেন, তারপর বলেন, ‘কী আর কষ্ট, দোকানটা চেনা হবে, মাজু খাতুনের সঙ্গে কথাও বলা যাবে।’
– না না বউমণি, তুমি কিছুতেই খুঁজে পাবে না, দোকানটা বড্ড বিটকেলে জায়গায়। আর মাজু খাতুনের সঙ্গে তো আমার প্রতিদিনই দেখা হয়, একদিন না হয় কথা বলিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।
সুধা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, ‘মা-নে, ওর সঙ্গে তোমার প্র-তি-দি-ন মোলাকাত হচ্ছে, কেন, এ কী হচ্ছে!’
বলে তিনি হা করে তাকিয়ে রইলেন শতদ্রুর দিকে কিছুক্ষণ। শতদ্রু মুচকি মুচকি হাসছে। সুধা আবার বলা শুরু করেন, ‘মনে হচ্ছে তোমার ফিয়াসেঁ হয়ে গেছে সে …।’
বলে সশব্দে হেসে উঠলেন তিনি। শতদ্রুও হাসি মেলায়। তারপর বলে, ‘ধরে নিতে পারো ফিয়াসেঁ, যে এতো চমৎকার গুড় বানাতে পারে সে কি ফিয়াসেঁ হতে পারে না?’
– চেহারাটাও বুঝি খুব মিষ্টি?
মজা করার ঢংয়ে সুধা এই ফোড়নটা ছোড়েন। শতদ্রু শ্রাগ করে মুখে একটা ফিচেল হাসি এনে জবাব দেয়, ‘ঠিকই বলেছো বউমণি, লোকে যা-ই বলুক না কেন, আমার কাছে দারুণ চেহারা, একেবারে ফিল্মের হিরোইন।’
– এজন্যেই বুঝি মুখে এতো মাজু খাতুন, মাজু খাতুন, এতো মোলাকাত, অবশ্য কবি-সাহিত্যিকরা তো ভাবের পাগল হয়, কাকে কখন মন দিয়ে বসে ঠিক নেই।’
বলে আবার ওই মজা করার চপল হাসি ছড়িয়ে দেন তিনি মুখে।
শতদ্রু এবার কোনো হেলদোলে থাকে না। শুধু ভাবতে থাকে, হ্যাঁ, ওকে নিয়েই তো তার দিনরাত কাটছে এখন। ওকে এক অন্য পরম্পরায়, এক অন্য উপস্থাপনায় হাজির করেই তো নজির গড়ে তুলতে চাইছে সে …
– কী হলো, কী ভাবছেন লেখক মশাই, আমি কথাটা কি ভুল বলেছি?
সুধার এই কথাটিকে অতোটা আমল না দিয়ে শতদ্রু বলে ওঠে, ‘বাদ দাও তো ওসব কথা, এবার বলো, কী কী গুড় আনতে হবে।’
সুধা দ্রুত হেঁসেল থেকে বাজারের ব্যাগটা এনে শতদ্রুর হাতে তুলে দিতে দিতে মুখে তাঁর চিরাচরিত সুন্দর হাসিটি ফোটান। তারপর বলেন, ‘কেন, নলেন গুড়, গেলবার যেটা এনেছিলে।’
– নলেন গুড় ছাড়া আরো তো গুড় রয়েছে, খেজুরের রস দিয়েই বানানো হয়।
শতদ্রুর এই কথাটি শুনে সুধার কৌতূহলী গলা আঁটোসাঁটো হয় –
– ওগুলো কী বলো তো?
– এই যেমন পাটালি, খেজুরের রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে বানানো হয়। এই গুড় অনেকদিন রাখা যায়। নলেন গুড় তো শীতের সময়েই হয়, প্রতি শীতে সে নতুন রূপে দেখা দেয়, ‘নলেন’ মানেই তো নতুন। অন্য সময় সে হয় না, তখন তাকে চিনি মিশিয়ে পাটালি গুড় করে রেখে দেওয়া হয়। এই পাটালি গুড়ই ব্যবহার হয় বেশি, সারাবছরই আমরা খেতে পারি। খেজুরের রসকে ঝোলা গুড়ের ফর্মেও ব্যবহার করা হয়। নানা রকম খাদ্যদ্রব্য তৈরিতে ঝোলা গুড়ই কাজে লাগে বেশি। দানা কম ঝোলা গুড়ের স্বাদ অসামান্য। তবে ওর আয়ু শীত পর্যন্ত। যে-ঝোলা গুড়ে দানা বেশি থাকে সেগুলোর স্বাদ সেরকম নয়, তবে সারাবছর রাখা যায়।
বলে একটু থামলো শতদ্রু। এই সুযোগে সুধা একটা ফিচকে মন্তব্য ছোড়েন, ‘বাহ্, খেজুরের রস নিয়ে রীতিমতো সরস রিসার্চ করেছো দেখছি, গাইড কে ছিল, মাজু খাতুন নাকি?’
শতদ্রু সুধার ওই ফাজলামোতে মন না দিয়ে জেদ করে ওর কথার সূত্র ধরে, ‘শোনো, বউমণি, এই খেজুরের রস অর্থাৎ নলেন গুড় বাঙালির রসবোধকে ঝাঁজিয়ে তোলে, কত রকমের যে খাবার বানায় বাঙালি এই রস দিয়ে, শীতকালে পৃথিবীর সারা বাঙালি মহলের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ালে এটা তোমার চোখে পড়বেই।’
সুধা শতদ্রুর বলার মাঝখানে অনেকটা হইহই করে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, রস খেয়ে রসবোধ, মনে পড়ছে, শুধু খাবার নয়, এ-সময় কে একজন যেন একটা দারুণ বাংলা গল্পও লিখেছিলেন খেজুরের রস নিয়ে, এই রস খেয়েই বুঝি! গল্পটা নিয়ে একটা সিনেমাও হয়েছিল, দেখেছিলাম, অমিতাভ বচ্চন ছিল, সে অনেকদিন আগের কথা।’
শতদ্রু মনে মনে খিস্তি দেয় সুধাকে, তোমার দৌড় ওই সিনেমা পর্যন্ত, মাথায় তো কিছু রাখো না …
তারপর মুখ খোলে সে, ‘ওই লেখকের নাম নরেন্দ্রনাথ মিত্র গো, আমরা কলকেতে ভাষায় বলি নরেন মিত্তির।’
সুধা চমকে ওঠেন, ‘মানে, যার নামে তোমার ওই গুড়ের দোকানটা!’
– হ্যাঁ, তাই ধরে নিতে পারো।
শতদ্রু উদাস গলায় জবাব দেয়।
– বাহ, লোকটা তো বেশ আছে, রসের দোকান চালায়, তাড়িয়ে তাড়িয়ে রসও খায় আবার রস নিয়ে গল্পও লেখে।
শতদ্রু উদাস গলায় ওভাবেই জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, তাই ধরে নিতে পারো, এবার বলো কোন কোন কিসিমের গুড় আনবো।’
সুধা ভাবলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, ‘তাহলে এবার পাটালিটাই বেশি করে এনো, সারা শীত আর বসন্তটা অল্প অল্প করে খেতে পারব, আর ঝোলাটাও নিয়ে এসো, শীতে খাবো।
– তো, কী কী আইটেম বানাচ্ছ?
– পায়েস তো থাকছেই, এ ছাড়া থাকছে পাটিসাপটা আর পুলি পিঠে। এ-বছর ভাবছি চিতই পিঠেও বানাবো।
– ওহ্, ইউনিক, দারুণ হবে, আমি তো বউমণি এক বাটি পায়েস খাবো, তোমার হাতের নলেন গুড়ের পায়েস জগদ্বিখ্যাত, এসিমিলেশনটাই কিন্তু মূল কথা …
কথাটা বলতে বলতে শতদ্রু বেরিয়ে যায় বাজারের উদ্দেশে।
পৌষপার্বণ এসে গেল। বাড়িতে সাজসাজ রব। সবাই এসে হাজির। দোলা, অলকামাসি দুজনেই লেগে পড়েছে পিঠে বানানোর ভিয়েনে, সুধাকে সঙ্গ দিতে। আজ সারাদিন চলবে পিঠেপুলি, চিতই পিঠে, পাটিসাপটা আর পায়েস খাওয়া। রাতে গরম গরম মাংস-ভাত।
দুপুরে ডাইনিং টেবিলে পিঠে খাওয়ার আসরে সুধার ভাইপো বুবুন পিঠে খেতে খেতে বলে ওঠে, ‘পিসিমণি, অভূতপূর্ব, মন মজে যাওয়া আস্বাদ নিচ্ছি, বাজারের নলেন গুড়ের চাইতে এ-নলেন গুড়ের স্বাদ যেন আরো কুলীন, তীব্র, জিহ্বায় অনেকদিন লেগে থাকবে।’
তারপর শতদ্রুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দ্রু আঙ্কেল, এবার আমি ভেবেছি ফেরার সময় এক কার্টন কিনে নিয়ে যাবো মাজু খাতুনের গুড়। আমাদের ওখানে, মানে গৌহাটিতে এ-গুড় পাওয়া যায় না।’
শতদ্রু তখন পায়েস খাচ্ছে। খেতে খেতে বিভোর হয়ে গেছে যেন। ওই বিভোর অবস্থাতেই সে জানায়, ‘মাজু খাতুনের গুড় পড়ে থাকে না ভাইপো বুবুন, দুদিনেই হাপিশ হয়ে যায়, দু-মাস আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়।’
– ওহ্! তা-ই নাকি!
টেবিলের পিঠেচক্রে চর্বণে-চুষ্যণে ব্যস্ত বাকিদের গলায় উঠে এলো লম্বা বিস্ময়।
– তা নয়তো কী, মাজু খাতুনের গুড় বলে কথা।
শতদ্রুর মন্তব্য শুনে কৃষ্ণনগরের বিভুনন্দাই বলে ওঠে, ‘শতু, আমার ওখানে মাজু খাতুনের গুড়ের কথা প্রায় সবাই জেনে ফেলেছে, তাই এক পরিচিত গুড়অলা আমার কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করছিল মাজু খাতুনের চ্যানেল ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে।’
শতদ্রু গম্ভীরভাবে বলে, ‘মাজু খাতুনের সঙ্গে চ্যানেল করতে পারে কেবল এই শর্মা, আমাকে ছাড়া মাজু খাতুন কারো কথা শোনে না, কাউকে পাত্তাও দেয় না।’
টেবিলের চারপাশে বসে থাকা মানুষগুলো খাওয়া ভুলে হা-করে তাকিয়ে থাকে শতদ্রুর দিকে।
ওই মুহূর্তে ঢাকার ইকবাল একটু ধাতস্থ হয়ে পিঠেপুলি চিবোতে চিবোতে পরিহাসছলে বলে ওঠে, ‘দোস্ত, মাজু খাতুন মনে হইতাছে তর নয়া নভেলের সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হইয়া উঠছে।’
বলতে বলতে হেসে ফেলে সে। শতদ্রু ইকবালের হাসির সঙ্গে হাসি মিলিয়ে বলে ওঠে, ‘ইকবাল তুই এসেছিস ভালোই হয়েছে, আজ রাতে তোকে আমার মাজু খাতুনের কাছে নিয়ে যাবো, তৈরি থাকিস।’
ইকবাল জিজ্ঞাসু নয়নে কপালে ভাঁজ তুলে তাকিয়ে থাকে শতদ্রুর দিকে।
পরদিন। কাছের কুটুমরা সবাই চলে গেছে। রয়েছে বুবুন আর ইকবাল। ওরা যাবে আগামীকাল। বুবুন সকালে উঠেই চলে গেছে স্থানীয় বাজারে ‘নরেন মিত্তিরের রস’ আর ‘মাজু খাতুনে’র সন্ধানে। ইকবাল সারারাত জেগে শতদ্রুর নতুন উপন্যাসের খসড়া পাঠ শুনেছে। এখন সে গভীর ঘুমে। দাদাভাই আপিস চলে গেছে। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেছে। রাধেশ্যাম বাজারে গেছে। ঘর এখন মোটামুটি শান্ত। যদিও সারাবাড়িতে ম-ম করছে তখনো নলেন গুড়ের ঘ্রাণ। সুধা হেঁসেলে বসে তাওয়ায় সেঁকছেন পাটিসাপটা। শতদ্রু চোখে সরষের তেল লাগিয়ে ডুবে আছে ওর হয়ে-ওঠা নতুন উপন্যাসে। এমন সময় বাইরের দরজার ওপাশে কে যেন ডাকে।
শতদ্রু উঠে গিয়ে দরজা খোলে। দেখে দাঁড়িয়ে মাজু খাতুন। যেন সোনার মূর্তি। মাথায় ওর টুকরিভর্তি গুড়, নলেন গুড়। শতদ্রু চেঁচিয়ে ডাকে সুধাকে –
– বউমণি, এসো, দেখে যাও কে এসেছে!
শতদ্রুর ডাক শুনে পিঠে বানানো ছেড়ে উঠে আসেন সুধা। এসে দেখেন কোথাও কেউ নেই। জিজ্ঞেস করেন শতদ্রুকে, ‘কে এসেছে দ্রুভাই?’
শতদ্রু ভাবলেশ কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘মাজু খাতুন।’
সুধা চাতালে নেমে বারবার চারদিক খোঁজেন, কাউকেই দেখতে পান না। সেখানে বইছে শুধু হিমেল হাওয়া। বাগানের জুঁই, পলাশ, নাগেশ্বর গাছগুলো সে-হাওয়ায় দুলছে। টুনটুনি, শালিক আর চড়ুই পাখি ডালে ডালে উড়ে কিচিরমিচির করছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা দোয়েল ডেকে উঠছে, মনে হচ্ছে নারীকণ্ঠ। তিনি শতদ্রুর দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় বলে ওঠেন, ‘দ্রুভাই, এবার বুঝি তোমার মাথাটা সত্যি সত্যিই খারাপ হলো গো!’
ওদিকে বুবুন সারাবাজার খ্যাংরা মেরেও খুঁজে পেল না ওই নামে কোনো দোকান, ওই নামে কোনো মানবী। শুধু বাজারের এক কোণে একটি মুদিদোকানে দু-তিনটি টুকরিভর্তি নলেন গুড় আর ঝোলা গুড়ের দুটি কলসি নিয়ে বসে থাকতে দেখলো এক দেহাতি মহিলাকে। কেউই বলতে পারলো না, এ-বাজারে আদৌ ওই নামে কোনো দোকান বা ওই নামে কোনো মানবীর অস্তিত্ব আছে কি না। বুবুন বিফল মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। শতদ্রু হেঁকে জানতে চাইল, ‘কী ভাইপো, কাজের কাজ কিছু হলো ?’
বুবুন বিষণ্ন গলায় জবাব দিলো, ‘না গো দ্রু আঙ্কেল, তুমি যে কোথা থেকে আনো?’
শতদ্রু একটা দেঁতো হাসি ছড়িয়ে আবার ওর উপন্যাসে ডুবে গেল। ইকবাল মনে হলো ওই মুহূর্তে ঘুমের ঘোরে আওড়ালো, ‘মাজু খাতুন।’
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.