তানভীর মোকাম্মেল
সত্তরের দশকের রাজশাহী শহরে মামুনদের পাড়ায় ছিল তিন পিন্টু – ল্যাথারি পিন্টু, মাথামোটা পিন্টু আর মিচকে পিন্টু। তো নিত্যদিনের মতো সেদিনও মামুনরা ওদের পাড়ার সুধীরকাকার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। ল্যাথারি পিন্টুই খবরটা আনল :
‘শুনছিস বেটা, ধলুভাইয়ের ভাগ্নের জন্মদিন। খুব বড় করে করছে।’
‘কী বুলছিস? আমাদের তো দাওয়াতই দিলো না!’
এক পাড়ায় বাড়ি। সকাল-বিকেল দেখা হয়। এতবড় একটা অনুষ্ঠান, অথচ মামুনদের নিমন্ত্রণই করল না! অবশ্য চরম কৃপণ হিসেবে ধলুভাইয়ের আববা মকিম সাহেবের নাম আছে এলাকায়। পাড়ায় ওনার নামই হচ্ছে ‘কঞ্জুস মকিম’।
কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল ধলেন মানে মামুনদের ধলুভাই সুধীরকাকার দোকানে এসে হাজির। বেশ আয়েশ করে বসে বললেন –
‘হ্যা রে ল্যাথারি, বড় মুরগি-টুরগি কোথায় পাওয়া যাবে বুল তো?’
‘মুরগি? তা, সাহেববাজারে লিতে পারেন। নিউ মার্কেটের বাজারেও। তো ধলুভাই, বাড়িতে
কোনো ফাংশন করছেন নাকি?’ সরল মুখে প্রশ্ন করল মিচকে পিন্টু।
‘না, কাল ভাগ্নেটার জন্মদিন। প্রথম জন্মদিন তো, তাই কিছু ভদ্দরলোককে বুলছি।’
মামুনরা বুঝে নিল এই ‘ভদ্দরলোক’দের তালিকায় ওরা নেই। এ কি সহ্য হয়!
মিচকে পিন্টুই বুদ্ধিটা দিলো। দুটো সাইকেলে, একটায় ডাবলিং করে মামুন ও ল্যাথারি পিন্টু, আরেকটায় মিচকে পিন্টু ও হাজি বাবু বেরিয়ে পড়ল। মামুনদের পাড়ায় দুজন বাবু থাকায় বাবা হাজি হওয়ায় ওঁর নাম হয়েছিল ‘হাজি বাবু’। প্রথমেই যাওয়া হলো রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে। স্টেশন অঞ্চলের সব ভিক্ষুককে ধলুভাইদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বলে আসা হলো কাল রাতে ও-বাড়িতে সবার খাওয়ার দাওয়াত। এরপর যাওয়া হলো শাহ মখদুম পিরের দরগায়। রাজশাহী শহরে এই দরগাতেই ফকিরদের সবচেয়ে বড় আস্তানা। জনে জনে ডেকে সব ফকিরকে বলে দেওয়া হলো রাতে অমুক পাড়ার মকিম সাহেবের বাড়িতে ওদের দাওয়াতের কথা। মাজারের হুঁশিয়ার বুড়ো ফকিরটা যখন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম?’ মিচকে পিন্টু নির্দ্বিধায় বলে দিল, ‘আমার নাম ধলু। আমারই ভাগ্নের জন্মদিন।’ এরপর শহরে ঘুরে ঘুরে আর যত ফকির পাওয়া গেল সবাইকেই দাওয়াতের কথাটা জানিয়ে আসা হলো।
সন্ধ্যাবেলা সারা গাঁয়ে বিদ্যুতের লাল-নীল বাতি জ্বেলে ধলুভাইদের বাড়িতে যখন মাইকে জোরে জোরে গান বাজছে – ‘চল্ চল্ চল্ মেরা হাতি/ মেরা সাথি’, তো এমন সময় দেখা গেল বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে সার দিয়ে ফকিররা সব আসছে। স্টেশনের ফকির, রাস্তার পাশের খঞ্জ ফকির, আর দরগাহর দাড়ি-টুপিওয়ালা ফকিরের বিশাল বাহিনী তো আছেই। আর একটু পরেই ধলুভাইদের বাড়ি থেকে শোনা গেল মহাচিৎকার। ‘কে তোমাদের আসতে বুলেছে?’ ‘আবার দাওয়াত!’ ‘কে? কে বুলেছে?’ ‘আপনার ছেলে ধলুই তো বুলল’ – এক ফকিরের তেজি উত্তর। আর দরগাহর সেই বুড়ো ফকিরটা প্রচন্ড রাগে গজরাতে লাগল – ‘আমরা দরগার ফকির। ডেকে লিয়ে অপমান করছেন! আমাদের একটা আলাদা সম্মান আছে…।’
পরদিন ধলুভাই খুব বিমর্ষ ভঙ্গিতে সুধীরকাকার দোকানে এসে বলল, ‘বুঝলেন সুধীরকাকা, লটির বেটারা সব!… শয়তানগুলা ভাগ্নের ফাংশন নিয়েও পেছনে লাগে!… বাপকে বুলেছি বাড়ি বেচ, পাড়া ছাড়!’
ধলুভাইয়ের মা কিছু ঘটলেই জোরে জোরে গোটা পাড়াকে শুনিয়ে জানান দিতেন, ‘আশপাশের সব ছোটলোক! কোথায় আমরা ছিলাম মুর্শিদাবাদের জমিদার।… আর এখানে এসে পড়েছি সব থার্ড ক্লাস লোকজনের সঙ্গে।… আমার ছেলে ধলুর তো পুরা জমিদারি ভাব।… বড় রুইমাছ আর মুরগির রান ছাড়া ভাতই খায় না!’
একই কথা বারবার শুনে হদ্দ হয়ে ল্যাথারি পিন্টু একদিন বলল, ‘বেটা শোন, কাল সকালে ধলুভাই বাজার করে ফেরার সময় ওর বাজারের ব্যাগটা হাইজ্যাক করে লিয়ে দেখব।… দেখি ধলুভাই কত বড় রুই মাছ খায়!’
পরদিন সকালে ধলুভাই তো হেলতে-দুলতে সাহেববাজার থেকে বাজার করে ফিরছেন। তো হঠাৎ হাজি বাবু এক টানে বাজারের ব্যাগটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সোজা সুধীরকাকার দোকানে। ধলুভাই ‘এই ব্যাগ দে হারামজাদা!… ব্যাগ দে!… ব্যাগ লিয়ে কী…’ বলতে বলতে দৌড়ে ওর পেছন পেছন ছুটল। ততক্ষণে ল্যাথারি পিন্টু বাজারের ব্যাগটা থেকে বের করে ফেলেছে এক গোছা শজনের ডাঁটা, কয়েকটা ঝিঙে আর কিছু কাঁচকি মাছ। কাঁচকি মাছগুলি দেখিয়ে ‘সক্কলে দ্যাখ বেটা, এই হলো ধলুভাইয়ের বড় বড় রুইমাছ!’ ধলুভাই ক্ষেপে গেলেন, ‘কাঁচকি মাছে কত ভিটামিন আছে, তা জানিস?’ মিচকে পিন্টু শজনের ডাঁটার গোছাটা ওর মুখের কাছে ধরে বলল, ‘এই শজনের ডাঁটা হচ্ছে ধলুভাইয়ের মুরগির রান!’ ধলুভাই আরো ক্ষেপে গেলেন, ‘এই তো চিনিস মিঞারা!… ওগুলো শজনা নাকি?… এগুলো হচ্ছে ল্যাজনা… ল্যাজনা। বুঝলা?’
ধলুভাইদের বাড়িতে মুরগি পালা হতো। বেশ কিছু নাদুস-নুদুস মুরগি ছিল ওঁদের। ধলুভাই রাজশাহী পলিটেকনিকে পড়তেন আর প্রতি বছর পরীক্ষা দিয়ে ফেল করতেন। ধলুভাই যখনই পড়তে বসেন, মামুনরা গিয়ে ‘ধলুভাই, একটু চা খাবেন না?’ ধলুভাই বলতেন ‘যা যা, তোরা আমাকে মানুষ হতে দিবি না!’ ওরা তখন ‘ধলুভাই, একটা সিগারেট তো খাবেন?’ এ-কথা বললে ধলুভাই আর না পেরে ‘তা তোরা যখন বুলছিস’ বলে বেরিয়ে আসতেন।
তো সেদিন সকালে ধলুভাই খুব উত্তেজিতভাবে সুধীরকাকার দোকানে এসে বললেন, ‘এত করে মাকে বুলি মুরগি পুষো না!… মুরগি পুষো না!’
– ‘কেন ধলুভাই, মুরগিতে দোষ কী করল?’ – মাথামোটা পিন্টু জিজ্ঞেস করল।
– ‘দোষ! তোরা কী বুঝবি মিঞা? দ্যাখ না, বাড়িতে এত জায়গা থাকতে বদমাইশ মুরগিটা ঠিক আমার নোটের ওপর বসেই ডিম পাড়বে!… আর পা দিয়ে হ্যাঁচড়িয়ে মুরগিগুলো আমার নোটগুলান সব শেষ করে দিল!… মুরগিগুলো আমারে মানুষ হতে দিবে না !’
পাড়ার ছেলেদের পিকনিকে কঞ্জুস মুকিম সাহেবের পরিবার কোনো চাঁদাই দিত না। তো সেবার মিচকে পিন্টু বুদ্ধি দিলো, এবার ধলুভাইদের বাড়ির মুরগি দিয়ে পিকনিক করা হোক। অনেক টাকা বেঁচে যাবে! তো পিকনিকের আগের রাতে টর্চ, দড়ি, বস্তা, এসব নিয়ে বেশ বড়সড় এক অপারেশন টিম গঠন করা হলো এবং বেশ ‘সাকসেসফুল অপারেশন’ই হলো। মোট চারটে মুরগি, না মানে তিনটে মুরগি আর একটা মোরগ মিলল। হাজি বাবুদের বাড়ির পেছনের আমবাগানে পিকনিকের রান্নার তো তুমুল আয়োজন। মুরগির মাংস যখন আলু দিয়ে রান্না হচ্ছিল চারিদিক গন্ধে একেবারে ম-ম! তো ধলুভাইও এসে হাজির। ‘কী রাঁধছিস রে?’ ‘মুরগি’। ‘ফার্স্ট ক্লাস’! আর খাওয়ার সময় ধলুভাইয়ের সে কী প্রশংসা – ‘কী টেস্টি মুরগি রে!… আর শালা মিলু রেঁধেছেও এমন চমৎকার। দে… আরেক পিস দে!’
বিকেলবেলা ও-বাড়ির উঠোন থেকে শোনা গেল ধলুভাইয়ের মায়ের তারস্বরে চিৎকার : ‘আমার ডিমপাড়া মুরগিগুলা যারা খেয়েছে সবগুলার কলেরা হবে… আল্লাহ ডাকার সময় পাবে না!’ ইত্যাদি। মামুনরা দিনকয়েক কিছুটা আড়ালে-আবডালে থাকল।
তো সেদিন সুধীরকাকার চায়ের দোকানে মামুনরা বসে রয়েছে। ধলুভাই দোকানে ঢুকে বেশ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিমায় ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিরে বেটা? সারাদিন এই সুধীরকাকার দোকানে বসে উজির-নাজির মারলে চলবে?’ মামুনরা বললেন, ‘একটু চা খাবেন না, ধলুভাই?’ ধলুভাই ‘না মিঞা, আমার এখন সময় নাই। আমি এখন খুব বিজি।’ তারপর বেশ একটা ঘোষণা দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘আইয়ুবকাকার সঙ্গে গুলের ব্যবসায় নেমে গেলাম।’ মাথামোটা পিন্টু জিজ্ঞেস করল ‘গুল কী জিনিস, ধলুভাই?’ ‘গুল চিনিস না বেটা?… গুল হচ্ছে কাঠের গুঁড়ি। কাঠের ব্যবসা করছি আইয়ুবকাকার সাথে।’ ‘কাঠের ব্যবসা?… আইয়ুব আলী তো এক পাক্কা চিট!’ বলল ল্যাথারি পিন্টু।
মধ্যবয়সী আইয়ুব আলীকে মামুনরা চিনত। লুঙ্গি ও হাফশার্ট পরে এবং কাঁধে একটা গামছা ফেলে আইয়ুব আলী মাঝে মাঝে এ-পাড়ায় আসত। শোনা যেত কখনো সীমান্তে গরু কেনাবেচার ব্যবসা করে, আবার কখনো পাটের দালালি। আবার প্রতিবার কোনো না কোনো একটা ঝামেলা পাকিয়ে কিছুদিন পালিয়েও বেড়ায়। আইয়ুব আলী এবার তাহলে কাঠের ব্যবসা ধরেছে!
দুদিন পর ধলুভাই সুধীরকাকার দোকানে বসে পকেট থেকে চকচকে একটা একশ টাকার নোট বের করে বলে, ‘চা আর শিঙাড়া দেন তো সুধীরকাকা। এদেরকেও দেন।’ তারপর মামুনদের বিস্মিত ও জিজ্ঞাসু চোখগুলির দিকে তাকিয়ে বললেন :
‘মিঞা, এখন বুল্ আরো, আইয়ুবকাকা চিট! ব্যবসায় লাভ শুরু হয়ে গেছে, বুঝলি? আইয়ুবকাকা এক হাজার টাকা দিয়ে বুলেছেন, ভাতিজা, যেমন খুশি খরচ করো। সাতদিন পরে একেবারে লাখপতি হয়ে যাবা!’
– ‘সাত দিনেই লাখপতি?’ মামুনদের প্রশ্ন।
– ‘আরে বেটা, সাত দিন পর তো কাটাখালির স’মিলে যেয়ে সমস্ত কাঠ লিয়ে আসতে হবে। আইয়ুবকাকা তিনটে ঠেলাগাড়ি লিয়ে যেতে বুলেছে। গ্রাম থেকে কাঠ কিনে সাজিয়ে রাখবে। খবর দিলেই যেতে হবে। ল্যাথারি, তৈরি থাকিস, সাথে যেতে হবে।’ তারপরে চায়ে চুমুক দিয়ে ‘ছি ছি, এমন একটা ভালো মানুষকে তোরা চিট বুলিস!’
এরপরে সাত দিন গেল, পনেরো দিন গেল, বিশ দিন গেল, আইয়ুব আলী কাকা আর খবর দেয় না। ধলুভাই একদিন বললেন, ‘বেটা, তোরা আইয়ুব কাকাকে দেখেছিস?’ মামুনেরা ‘না’-সূচক মাথা নাড়াল। হতাশ ধলুভাই বললেন, ‘চল তো আমার সঙ্গে, একবার কাটাখালি যাই।’
তো সবাই মিলে কাটাখালি গিয়ে দেখা গেল, যে-স’মিলের নাম আইয়ুব আলী বলেছে সে নামে কাটাখালিতে কোনো স’মিলই নেই। তাছাড়া আইয়ুব আলীকেও কেউ চেনে না। ধলুভাই তো রাগে গজগজ করতে থাকলেন। ঠিক হলো যে, সবাই মিলে আইয়ুব আলীর বাড়ি যাওয়া হবে।
তো রাজশাহীর শহরতলিতে আইয়ুব আলীর বাড়িতে ওরা সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে পৌঁছল, বাড়ির ভেতর থেকে আইয়ুব আলীর রোগা বউটা বলল যে, আইয়ুব আলী আজ বিশ-পঁচিশদিন বাড়িতে আসে না। কোথায় গেছে, ওরা তা জানেও না। শুনে ধলুভাই এক্কেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল – ‘হায় হায়! আমার ষাট হাজার টাকা!… আমি ওই ব্যাটার নল্লি ছিঁড়ে লিব!’ ইত্যাদি।
তো মাঝে মাঝেই খবর মেলে আইয়ুব আলীকে রেলওয়ে স্টেশনে দেখা গেছে, আইয়ুব আলীকে নিউ মার্কেটের বাজারে দেখা গেছে, ইত্যাদি। প্রতিবারই ধলুভাইয়ের সঙ্গে মামুনরা ছুটে যায় কিন্তু আইয়ুব আলীকে আর ধরা যায় না।
বুদ্ধিটা মিচকে পিন্টুই দিলো। ‘ধলুভাই, কিছুদিন পরেই তো ঈদ। আইয়ুব আলী যেখানেই পালিয়ে বেড়াক না কেন, ঈদের দিন তো ব্যাটা বাড়িতে আইসবেই। তখন চলেন ব্যাটাকে ধরি।’ কথাটা ধলুভাইয়ের বেশ মনে ধরল। ঈদের দিন সকালে নামাজ পড়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি পরে আটটা রিকশা ভাড়া করে মামুনরা দল বেঁধে সব চলল শহরতলিতে আইয়ুব আলীর বাড়িতে। দরজায় ধাক্কা দিতে দরজা খুলে এক্কেবারে সামনেই আইয়ুব আলী! ওকে দেখে ধলুভাই প্রায় চিতা বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল – ‘মিঞা চিটিংবাজ! নল্লি ছিঁড়ে লিব এক্কেবারে!’ আইয়ুব আলী ‘ভাতিজা… আমার টাইফয়েড…!’ কিন্তু কিসের কী! ধলুভাইয়ের অন্য রূপ ‘ব্যাটাকে বাঁধ, লিয়ে চল!’
আইয়ুব আলী বারবার ‘ভাতিজা, তোমার মাল রেডি… কাঠ সব কিনা আছে… সব এ-গ্রেডের মাল’ এসব নানা কথা বলছিল; কিন্তু ধলুভাই আর ভোলার পাত্র নয়। ঠিক হলো এখানে নয়, যা হবে ধলুভাইয়ের বাড়িতে। আইয়ুব আলী ভেতর থেকে হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে এলো।
ধলুভাইয়ের বাড়িতে ঢুকেই আইয়ুব আলী ধলুভাইয়ের মায়ের পায়ে পড়ে গেল ‘ভাবি… আজ ঈদের দিন… আমি টাইফয়েডের রোগী!’ ধলুভাইয়ের মা কিছুটা নরম হয়ে পড়লেন; কিন্তু ওখানে উপস্থিত ছিলেন ধলুভাইয়ের মেজমামা নওগাঁর আয়নাল লস্কর। লস্করমামা মহা ক্ষেপে উঠলেন ‘আইয়ুব মিঞা, কাকে লড়েছ? চিটিংবাজি করো মামুর ব্যাটা!… লিয়ে আয় স্ট্যাম্প… আজ তুমি স্ট্যাম্পে লিখে যাবা যে, পনেরো দিনের মধ্যে এক লক্ষ টাকা ফেরত দিবা… আর না হলে তোমার বাড়িঘর সব লিখে দিবা আমার ভাগ্নে ধলুর নামে।’ আইয়ুব আলী প্রথমে অনেক গাঁইগুঁই করছিল; কিন্তু সবার সম্মিলিত চাপে এবং মাঝে মাঝেই ধলুভাইয়ের ‘নল্লি ছিঁড়ে লিব’র হুঙ্কারে শেষমেশ রাজি হলো। নিয়মিত কোর্ট-কাছারি করে বলে এই ঈদের দিনেও লস্করমামার কাছে স্ট্যাম্প পেপার মজুদ ছিল। তবে পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্প পেপারের দাম লস্করমামা অবশ্য দেড়শ টাকা করে রাখলেন। টাকাটা আইয়ুব আলীকেই দিতে হলো।
দলিলে লেখা হলো যে আইয়ুব আলী পনেরো দিনের মধ্যেই ধলুভাইকে কাঠ ব্যবসার লাভসহ মোট এক লাখ টাকা ফেরত দেবে। অন্যথায় ওঁর বাড়ি ধলুভাইয়ের নামে রেজিস্ট্রি হয়ে যাবে। কিছুটা দোনোমনো করে আইয়ুব আলী শেষমেশ রাজি হলো। সই-স্বাক্ষরের পর আইয়ুব আলীকে ছেড়ে দেওয়া হলো।
এদিকে ধলুভাই তো প্রতিদিন সুধীরকাকার দোকানে এসে দিন গোনে। যে-কোনো দিন আইয়ুব আলী এক লাখ টাকা নিয়ে আসবে। একদিন যায়। দুদিন যায়। একে একে পনেরো দিন গেল; কিন্তু আইয়ুব আলীর আর খোঁজ নেই! শেষমেশ মামুনরা সবাই ধলুভাইয়ের নেতৃত্বে আবার একদিন আইয়ুব আলীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো।
ও-বাড়ি থেকে গোলগাল চেহারার এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন ‘আইয়ুব আলী! কোথায় ও মামুর ব্যাটা? আমিও তো ওই হারামজাদাটাকে খুঁজছি।’ জানা গেল, উনিই এ-বাড়ির মালিক। ভাড়াটে আইয়ুব আলী চার মাস ধরে বাড়ির ভাড়া দেয় না। আর এক সপ্তাহ আগে সপরিবারে এই বাড়ি ছেড়ে কোথায় যে চলে গেছে কেউই জানে না। বাড়িতে কিছু নেই, শুধু উঠোনের এক কোণে একটা ভাঙা মাটির কলস পড়ে আছে!
তো সেবার শীতকালে এক বিকেলে দেখা গেল ধলুভাই খুব খুশিমনে হেলতে-দুলতে সুধীরকাকার দোকানে এসে ঢুকলেন। মামুনদের দিকে তাচ্ছিল্যভরে তাকিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ‘কী মিঞা, নড়েচড়ে কিছু কর।…’ তারপর বললেন, ‘দোকানটা কিনেই লিলাম। এবার একটা বড় দোকান দিচ্ছি।’
– ‘কিসের দোকান ধলুভাই?’
– ‘গণেশ তো ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে। ওর দোকানটা কিনে লিলাম।’ পরে মামুনদের দিকে তাকিয়ে খুশিমনে বললেন, ‘চল বেটা, সকলে যাই, দোকানটায় তালা দিয়ে আসি।’
অলকার মোড়ে গণেশের মনিহারি দোকান। বেশ চলত দোকানটা। কিন্তু গণেশরা এখন সব বিক্রি করে সপরিবারে ভারতে চলে যাচ্ছে। গণেশ এলো। ধলুভাইয়ের হাত ধরে আবেগজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘দোকানটা যত্ন করে রেখো ধলুভাই। বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে ছিল। তোমরা পাড়ার ছেলে। তাই অল্প দামে…।’ দোকানটায় নতুন তালা লাগানো হলো। ধলুভাই ওঁদের গ্রামে গেলেন জমির ধান-আলু বেচে কিছু নগদ টাকা নিয়ে আসতে। বড় করে দোকান সাজাবেন; কিন্তু দিন সাতেক পরে ওই দোকানঘরে দিয়ে দেখা গেল ধলুভাইয়ের তালার বদলে নতুন আরেকটা তালা।
‘কী ব্যাপার?’ ধলুভাই ক্ষেপে চেঁচিয়ে উঠলেন। রাস্তার ওপারের ‘সিদ্দিক পাইপ’য়ের দোকান থেকে ওদের বড়ভাই আবুবকর সিদ্দিক এগিয়ে এলেন।
‘আ রে, এ দোকান তো তিন দিন আগে গণেশ আমাদের কাছে বেচে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে।’
‘কী বুলছেন!… আমি যে সাতদিন আগে টাকা দিয়ে দোকানটা কিনলাম!’
‘আপনি রেজিস্ট্রি করেছিলেন ধলুভাই?’ সিদ্দিকভাই ভালোভাবেই জিজ্ঞেস করলেন।
ধলুভাই একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘না, রেজিস্ট্রি করিনি।’ তারপর গলা বাড়িয়ে ‘রেজিস্ট্রি কেন লাগবে?’
যা হোক, সিদ্দিকভাই সরকারি স্ট্যাম্পে রেজিস্ট্রি করা কাগজ দেখালেন। তিনদিন আগের তারিখে ওরা জমিসহ দোকানটা কিনেছেন। দলিলে গণেশের সই আছে।
ফেরার সময় সারাটা পথ ধলুভাই গজরাতে থাকলেন, ‘শালা গণশারে যদি আবার পাই… ওর নল্লি ছিঁড়ে লিব!’
বোয়ালিয়া থানার ওসি হাজি বাবুর দূর-সম্পর্কের ফুফাত ভাই আনোয়ার দারোগা সেদিন সুধীরকাকার দোকানের সামনে ভট্ভট্ করে মোটরসাইকেলে এসে থামলেন। মামুনরা সবাই তার মুখচেনা। আনোয়ার দারোগা বললেন, ‘আজকাল রাজশাহী শহরে ইভটিজিং বেড়েছে। খবরের কাগজে রিপোর্ট বের হয়েছে। ওপরমহল তাই খুব চাপে রেখেছে। এরপর মেয়েদের কলেজের সামনে কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলেই অ্যারেস্ট করা হবে।’
মামুনরা তো মেয়েদের কলেজ দূর অস্ত, বড় রাস্তার দিকেই আর যায় না। তো সেদিন দুপুরে হঠাৎ শোনা গেল, ধলুভাই গ্রেপ্তার! ওই বোয়ালিয়া থানাতেই আছেন। মামুনরা সব ছুটে গেল থানায়। হ্যাঁ, খবর সত্যি। ঘটনা যা জানা গেল, তা হচ্ছে, সেদিন দুপুরে ধলুভাই মোড়ের খলিলের দোকান থেকে সাবান কিনতে বেরিয়েছিলেন। এমন সময় পুলিশ মেয়েদের কলেজের সামনে থেকে কয়েকটা বখাটে ছেলেকে তাড়া করে। ধলুভাইও দৌড় দেন। দৌড়ে উনি মাথামোটা পিন্টুদের বাড়ির পাশে ওঁর এক খালার বাড়িতে ওঠেন। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু কী হচ্ছে দেখার কৌতূহলে ধলুভাই জানালা খুলে রাস্তায় উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। সে সময়ই এক পুলিশ ওকে ডাকে, ‘অ্যাই খোকা!’ ধলুভাই তীব্র আপত্তি করেন ‘আমি খোকা নই।’ তখন পুলিশটি ওকে ডাকে – ‘এদিকে আসেন।’ ধলুভাই বের হতে বাধ্য হন এবং পুলিশটা ওর পায়ে একটা লাঠির বাড়ি মেরে ওকে গ্রেপ্তার করে। মিচকে পিন্টু অনেক খোঁজখবর রাখে। ও বলল, এ হচ্ছে পুলিশের ‘গ্রেফতার বাণিজ্য’!
হাজতে আটক ধলুভাইকে দেখে মামুনদের খুব দুঃখ লাগছিল। ওরা কলা আর পাউরুটি কিনে এনে ওঁকে দিলো। ধলুভাই বললেন, ‘পাউরুটি খাব কী?… দেখছিস না!… শালারা সব এখানে মুতে রেখেছে!’ তা অবশ্য ঠিক। গোটা হাজতটায় মল-মূত্রের ভয়াবহ দুর্গন্ধ! নোংরার এক শেষ!!
সব শুনে আনোয়ার দারোগা সহানুভূতিশীল হলেন। বললেন, ‘ধরে তো ফেলেছি। এখন তো এমনি এমনি ছাড়া যাবে না।’ তারপর একটু চিন্তা করে বললেন, ‘তোমরা এক কাজ করো। কোনো লিডারকে ধরো। তেমন কোনো লিডার বললে আমরা ছেড়ে দেবো।’ এখন তেমন কোনো লিডার মামুনরা পায় কই?
শেষে ঠিক হলো, মিচকে পিন্টুর বড় মামা মোক্তার ফজিলত হোসেন, যিনি একবার আওয়ামী লীগ, একবার বিএনপি, একবার জাতীয় পার্টি, এসব নানা দল করে এখন শহরের সরকারি দলের মাঝারি গোছের এক নেতা, ওকেই ধরা হবে। মিচকে পিন্টু ওর মামাকে বোঝাল, ‘ধলুভাই আপনাদের দলের নির্যাতিত কর্মী।’ অবশ্য ওর মামার কোন সময়ের কোন দলের নির্যাতিত কর্মী সেটা আর ভেঙে বলল না। তো মোক্তার ফজিলত হোসেনের ফোনে কাজ হলো। থানা থেকে ধলুভাইকে নিয়ে বের হওয়ার সময় ল্যাথারি পিন্টু হঠাৎ স্লোগান ধরল – ‘জেলের তালা ভেঙেছি/ ধলুভাইকে এনেছি!’ মামুনরাও গলা মেলাল। ধলুভাই ছোট মিছিলটার সামনে নতুন বরের মতো কিছুটা কুণ্ঠিতভাবে হাঁটতে থাকলেন। কিন্তু ওদের বাড়িতে পৌঁছানো মাত্র মকিম খালু একেবারে তেড়েমেড়ে উঠলেন – ‘হারামজাদা! মেয়েদের কলেজের সামনে ঘোরাফেরা করিস! আবার নেতা হওয়ার শখ হয়েছে!! তোর এবার বিয়া না দিয়ে আমি ছাড়ছি না!’ তাতে ধলুভাই দুঃখিত হলেন, না খুশি হলেন সেটা ঠিক বোঝা গেল না।
এর বেশ কিছুদিন পরে একদিন সুধীরকাকার দোকানে ঢুকে ধলুভাই বললেন, ‘বুঝলি বেটা, একটা জিনিস বুঝি না !… লিসারা তিন বোন আমাকে দেখলেই হাসাহাসি করে। যখনই ওই রাস্তা দিয়ে যাই… দেখলেই হাসে। বল তো কুড়কা রানা (রানার চুল কোঁকড়া ছিল বলে ওকে কুড়কা রানা নামে ডাকা হতো), ব্যাপার কী?’
কুড়কা রানা আর মিচকে পিন্টু চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিল। কুড়কা রানা বলল, ‘মনে হয় ধলুভাই, লিসা আপার আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে।’ কথা শুনে ধলুভাইয়ের রোগা মুখটা খুশিতে বেগুনি হয়ে উঠল। ‘যা! কী যে বুলিস তোরা?… ঠিকমতো খোঁজ লে তো!’
বুদ্ধিটা মিচকে পিন্টুই দিলো। ‘ধলুভাই, আপনি ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যান। আমরা পান্থশালা স্কুলের জানালা দিয়ে লুকিয়ে দেখি। তখন বুঝব, লিসা আপার আসল ব্যাপারটা কী।’
ধলুভাই বললেন, ‘বুলছিস তোরা?…। ঠিক আছে।’
ল্যাথারি পিন্টু যোগ করল, ‘তবে ওরকম ল্যাছড়া মার্কা হয়ে লুঙ্গি পরে সামনে ঘুরলে কিছু হবে না। আপনাকে প্যান্টের ভেতরে শার্ট ইন করে পরতে হবে।’
‘এঃ… শার্ট ইন করে পরব!’ ক্ষেপে গেলেন ধলুভাই। ‘আমার কী হিপ আছে যে, প্যান্ট ইন করে পরব!’
মিচকে পিন্টু বুদ্ধি দিলো, ‘কোনো চিন্তা কইরেন না ধলুভাই। গোলকিপাররা যেরকম প্যাড দেওয়া হাফপ্যান্ট পরে… প্যান্টের ভিতরে আন্ডারওয়্যারের বদলে ওরকম একটা হাফপ্যান্ট পরবেন।’
‘প্যাড দেওয়া হাফপ্যান্ট!’ ধলুভাইকে কিছুটা বিহবল দেখা গেল – ‘ও কোথায় পাব রে?’
‘ফোম কেটে বানাতে হবে।’ মিচকে পিন্টু বলল। ‘কোনো চিন্তা কইরেন না। দোস্ত মোহাম্মদ বানিয়ে দেবে। বিকেলে টাকা লিয়ে আসেন।’
দোস্ত মোহাম্মদ হচ্ছে মামুনদের পাড়ার ‘নিডল ফাইট টেইলার্সে’র টেইলর মাস্টার।
বিকেলে মামুনরা সব দল বেঁধে গেল। ধলুভাইয়ের মাপ-টাপ নিয়ে দোস্ত মোহাম্মদ বলল, ‘দেড় হাজার টাকা লাগবে।’ ল্যাথারি পিন্টু অবশ্য দুপুরে একবার দোস্ত মোহাম্মদের সঙ্গে বিষয়টা আলাপ করে গিয়েছিল।
‘দেড় হাজার! কী বুলছ?’ ধলুভাই কাতর হয়ে পড়লেন।
‘একটা নতুন ফোম কাটতে হবে। নতুন ফোমের দাম জানেন?’ দোস্ত মোহাম্মদ শক্ত গলায় বলল।
‘একটু সস্তায় হয় না। কোনো পুরনো ফোম… ’
‘এই তো আপনার দোষ ধলুভাই।’ মিচকে পিন্টু না বলে পারল না ‘প্রেম করবেন, তাও লিসা আপার মতো ওরকম একজন সুন্দরী মেয়ের সাথে! আর সেখানেও সস্তা খোঁজেন!! ছিঃ ছিঃ!’ শেষে ছশো টাকায় রফা হলো।
যেদিন বিকেলে দোস্ত মোহাম্মদের টেইলার্সে যাওয়া হয়েছিল সেদিন সন্ধ্যায় ল্যাথারি পিন্টু সবাইকে মোগলাই পরোটা খাওয়াল। ধলুভাই বললেন, ‘আকাশে চাঁদ আজ কোনদিকে উঠেছে রে! ল্যাথারি সবাইকে খাওয়াচ্ছে!’
তো পরদিন ধলুভাই প্যান্টের ভেতরে শার্ট ইন করে পরে চুল অাঁচড়ে বেশ ফিটফাট হয়ে লিসা আপাদের বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করলেন অনেকক্ষণ। মিচকে পিন্টুরা ‘পান্থশালা স্কুলে’র জানালার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখল যে ঠিকই, ওদের বাড়ির ছাদের কার্নিশে বুক রেখে লিসাআপারা তিন বোন ধলুভাইকে দেখে খুব হাসাহাসি করছে।
লিসা আপারা আসলে ভারতের উত্তর প্রদেশের মানুষ। সাতচল্লিশ সালে ওদের পরিবারটি রাজশাহী শহরে এসে বাস করা শুরু করে। উত্তর প্রদেশের মানুষ বলে ওদের সব ভাইবোনের রং ফর্সা এবং সবাই বেশ লম্বা। শারীরিক এই সৌন্দর্য নিয়ে লিসা আপা ও ওর বোনদের অহঙ্কার ছিল বেশ।
ধলুভাইয়ের আর তর সয় না। সন্ধ্যা নামার আগেই সুধীরকাকার দোকানে এসে ‘সত্যি করে বল তো ব্যাটা, কী বুঝলি?’
মিচকে পিন্টু একগাল হেসে বলল, ‘ধলুভাই, আপনার কাজ হয়ে গেছে।… চা খাওয়ান।’ চা এলো। কুড়কা রানা বলল, ‘দেখলেন না, আপনাকে কেমন ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল!… যতবার ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে আপনি হেঁটে যাচ্ছিলেন… ততবারই ঘাড় ফিরিয়ে দেখছিল, আর হাসছিল। এর মানে বোঝেন না?… শিঙাড়া খাওয়ান।’
শিঙাড়া এলো। ধলুভাই তো সেদিন খুবই খুশিমনে বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে কুড়কা রানার হাত ধরে বললেন, ‘রানা, একটু ভালোভাবে খোঁজ লিয়ে জানাস।… মা তো আমার বিয়ের কথাবার্তা বুলছে।… একটু তাড়াতাড়ি জানাস ভাই!’
এরপর থেকে ধলুভাই প্রতিদিনই বিকেল না হতেই প্যান্টের ভেতর শার্ট ইন করে পরে জুতামোজা পায়ে লিসা আপাদের বাসার সামনে দিয়ে হাঁটতেই থাকলেন। আর লিসাআপা আর ওর বোনেরা ছাদে দাঁড়িয়ে হেসেই গেলেন। একদিন আর থাকতে না পেরে ধলুভাইয়ের বন্ধু মিলুমামা বললেন, ‘এভাবে হাঁটাহাঁটি করে হবে না রে ধলু… লিসার মনের দরজায় আঘাত করতে হবে।’ ‘কী বুলছিস,.. মনের দরজায় আঘাত করব কীভাবে?’ ধলুভাইয়ের হতাশ প্রশ্ন। ‘পত্রাঘাত কর।’ – বললেন মিলু মামা।
যে-কথা সেই কাজ। বেলদারপাড়ার নাজিরভাইয়ের খুব নামডাক আছে প্রেমপত্র লেখার। নাজিরভাইয়ের লেখা প্রেমপত্র নাকি ‘বাই-অ্যান-এক্সপার্ট-হেডমাস্টারে’র লেখা নোটবইয়ের মতোই ‘সিওর সাকসেস’। নাজিরভাই নিজে অবশ্য জীবনে যে তিনটে প্রেম করার চেষ্টা করেছিলেন তার একটাতেও সফল হননি। দুবার নাকি মেয়েদের অভিভাবকদের হাতে চড়-থাপড়ও খেয়েছিলেন। সেই থেকে নাজিরভাই নিজে আর প্রেম করেন না। তবে অন্যদের প্রেমপত্র লিখে দেন। তো নাজিরভাই এলেন। সুধীরকাকার দোকানে চা-শিঙাড়া সামনে নিয়ে বসে সব শুনে বললেন, ‘ধলু, এত ছোটখাটো কামানে হবে না।… মিসাইল ছুড়তে হবে। সোজা হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করবে।’
‘মিসাইল?’ – ধলুভাইয়ের শঙ্কিত প্রশ্ন।
‘আরে না, খুব আবেগ দিয়ে একটা চিঠি লিখতে হবে।’ তারপর একটু চিন্তা করে বললেন, ‘তাতে খরচটা একটু বেশি পড়বে।’
‘খরচ লিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না নাজিরভাই।… লিসাকে ছাড়া আমি…’ ধলুভাইয়ের গলা ধরে এলো।
মিসাইল চিঠি লেখা হলো। নাজিরভাই অবশ্য চিঠির জন্যে ফিস বেশি নিলেন না। মাত্র দুশো টাকা। মিসাইল চিঠির জন্যে উনি অন্যত্র অনেক বেশি নেন। ধলুভাইয়ের জন্যে স্পেশাল কনসেশন!
এখন চিঠি তো লেখা হলো, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে, মানে চিঠিটা লিসা আপার হাতে দেবে কে? তাছাড়া এরকম মিসাইল-চিঠি! ধলুভাই সাফ জানিয়ে দিলেন যে, উনি পারবেন না। ওর অত সাহস নেই। শেষমেশ সবচেয়ে নিরীহ দেখে মামুনের ঘাড়েই দায়িত্বটা পড়ল চিঠিটা পৌঁছানোর।
সেদিন দুপুরে লিসা আপা কলেজ থেকে ফেরার সময় মামুন অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে ওঁদের বাড়ির গেটে লিসা আপাকে দাঁড় করাল। ‘লিসা আপা, আপনার চিঠি।’ ‘চিঠি! কে দিয়েছে?’ ‘ধলুভাই’। ধলুভাইয়ের নাম শুনেই কিনা, লিসা আপার মুখটা বাংলা পাঁচের মতো হয়ে গেল। তারপর ‘দেখি তো চিঠিটা’ বলে মামুনের হাত থেকে চিঠিটা প্রায় কেড়ে নিয়ে না পড়েই খস্খস্ করে ছিঁড়ে ফেললেন। নাজিরভাইয়ের সিওর সাকসেসের এরকম করুণ পরিণতি দেখে মামুন বেশ দুঃখ পেল। লিসা আপা সাপের মতো বেণিটা দুলিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধু বললেন, ‘তোদের ধলুভাইকে বুলিস, প্রেম করতে হলে কচুঘেচু না খেয়ে ব্যায়াম করে শরীর ঠিক করতে।… আর পকেটে টাকা-পয়সা নিয়ে ঘুরতে।… চায়ের স্টলে ওই হাফকাপ চা খেয়ে প্রেম হয় না! নিজের চেহারা আয়নায় দেখেছে কখনো?’ বলে লিসাআপা বাড়ির ভেতরে ঢুকে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
সব শুনে ধলুভাই খুবই রেগে গেলেন। ‘ব্যায়াম করে স্বাস্থ্য… ও মেয়ে কি মোহাম্মদ আলি ক্লেকে বিয়ে করতে চায়?… আর টাকা-পয়সা তো আমারও হচ্ছে। আকামাটা পাঠালেই তো সৌদিতে যাচ্ছি। সৌদি থেকে ফিরে সোনা কেটে কেটে ওই বাড়ির সামনে ফেলে দেবো! লাগবে না আমার ওই মেয়ে!!’
মিচকে পিন্টু বলল, ‘ধলুভাই, আপনি অতো রাগ করছেন কেন? লিসা আপা তো আপনাকে না বলেনি, শুধু দুইটা শর্ত দিয়েছে।’
‘তোরা বুলছিস?’
‘দেখেন না, স্বাস্থ্য তো সব মেয়েই চাইবে। আর বরের টাকা-পয়সা চায় না এমন মেয়ে কি দুনিয়ায় আছে? লিসা আপার কী দোষ? আপনি হতাশ হচ্ছেন কেন?’ তো, এ-কথা শুনে ধলুভাই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন এবং মামুনরা ওর পয়সায় আরেক প্রস্থ চা-বিস্কুট খেল।
এর সপ্তাহখানেক পরে এক সকালে লিসা আপার বড় ভাই আরশাদভাই সুধীরকাকার দোকানে এসে বললেন, ‘লিসার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে ইরানে ডাক্তারি করে।’ তারপরে বললেন, ‘আববা পাড়ার ছেলেদের ডেকেছেন।… তোমাদের সাহায্য লাগবে তো।… বিকেলে বাসায় মিটিং। এসো কিন্তু তোমরা।’
শুনে ধলুভাই বললেন, ‘কোন কোন মামুর ব্যাটা যায়, দেখে লিব!… ঠ্যাং ভেঙে দিব!’
তো মামুনরা ঠিক বিকেলে নয়, অন্ধকার নেমে এলে সন্ধ্যার কিছু পরে লিসা আপাদের বাসায় গেল। টেবিলভরা নানা খাবার। লিসা আপা-আরশাদভাইয়ের আববা সৈয়দ মাজেদ আলী বললেন, ‘শোন, আমিও তো এ পাড়ায় থাকি। ধলু আমার মেয়েকে ডিসটার্ব করে জানি। তা তোমরাই বলো, ধলু কি আমার লিসার যোগ্য?’
মামুনদের তখন মুখে কাবাব, হাতে ঘিয়েভাজা পরোটা। বড় একটা গ্রাস মুখে নিয়েই মাথামোটা পিন্টু বলল ‘কী যে বলেন চাচা… ধলুভাই লিসা আপার যোগ্য কী করে হবে?’
মাজেদ সাহেব বললেন, ‘তাহলে বাবারা… গেট বানানো, বিয়ের অতিথিদের খাওয়া-দাওয়া, এসব তো তোমাদেরই সব দেখতে হবে। নিজের বোন মনে করে করো।’
মাজেদ আলী চাচার কথাবার্তা শুনে মাথামোটা পিন্টু কিছুটা আবেগায়িত হয়ে পড়ল। একটা আস্ত চমচম মুখে দিয়ে বলল, ‘এসব লিয়ে আপনি কিচ্ছু ভাববেন না চাচা। আমরা সব কাজ লামিয়ে দেবো।… কত বিয়ে পার করলাম!’
ফেরার পথে মাজেদ আলী চাচা আরো বললেন, ‘ধলুকে তো আমিও চিনি। বোয়ালিয়া ইনসানিয়াৎ ক্লাবে সন্ধ্যায় বসে মোনাজাত করে!’ মোনাজাত মানে পয়সা দিয়ে তাস খেলা। মাজেদ আলী চাচা সব খবর রাখেন দেখে মামুনরা বেশ বিস্মিতই হলো।
পরদিন সকালে ধলুভাই মামুনদের চেপে ধরল। ‘জানি তো… সব মামুর ব্যাটাই মিটিংয়ে গিয়েছিলি।… আমার পয়সায় চা-শিঙাড়া খাবি আর খাতিরজমা করবি লিসার বাপের সাথে!… সব ব্যাটাকে চেনা হয়ে গেছে আমার!… তো কী বুলল, বল?’
‘না, মানে, আপনি লিসা আপার যোগ্য কি-না’ বলল মাথামোটা পিন্টু।
‘যোগ্য না মানে? সৌদিতে এই যাচ্ছি বুলে!… দাঁড়া, লস্কর মামারে খবর দিয়েছি। চরে উনার লাঠিয়াল বাহিনী আছে। অমিতাভ বচ্চনের ওই ছবিটা দেখিসনি? রেখাকে কেমন করে বিয়ের আসর থেকে তুলে লিয়ে গেল! ওই রকম করে লিসাকে তুলে লিয়ে আসব।’
‘লিসা আপা যদি আসতে না চায়?’ হাজি বাবু নিরীহ প্রশ্ন করল।
‘তাহলে… তাহলে… বিয়ের আগেই ওকে বিধবা করে দিব!’ বলেই ধলুভাই সামনের চায়ের টেবিলে চাপড় মেরে একটা হুঙ্কার ছাড়লেন। ধলুভাইয়ের ‘বিয়ের আগেই বিধবা’ কথাটা নিয়ে মামুনরা অনেকক্ষণ খুব ভাবল। কিন্তু ধলুভাই ‘বিয়ের আগেই বিধবা’ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা বুঝতে পারল না!
এরপর ধলুভাই ওঁর বন্ধু মিলুমামাকে নিয়ে পড়লেন – ‘আর আমি মোনাজাত করি, স্টেশনের পেছনে বিহারিপট্টিতে যেয়ে তালরস খাই এসব কথা লিসার বাপ জানল কেমন করে?… নিশ্চয়ই তুই বুলেছিস!’ মিলুমামা জোরেশোরে তা অস্বীকার করলেন, ‘আমি ওসব বুলি নাই ধলু।… বাতাসেরও কান আছে।… তার চেয়ে আমি বলি কি, তুই বরং সৌদি যা… সোনাদানা লিয়ে আয়। আর তারপর লিসার ছোট বোনটা আছে না?… নির্ঘাত… ওকে বিয়ে করে লিবি।’
এতে ধলুভাই আরো ক্ষেপে গেলেন; ‘প্রেম করি একজনকে আর বিয়ে করব তার ছোট বোনকে… তোরা কি আমাকে অমানুষ ভাবছিস!’
তো লিসাআপার বিয়ের দিন তো মামুনরা সব গেট বানাচ্ছে। অন্যরা বাড়ির ভেতরে বিয়েবাড়ির নানা কাজে ব্যস্ত। এমন সময় দেখা গেল ধলুভাই উস্কোখুস্কো চুল ও মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি নিয়ে ব্যাগ কাঁধে রাস্তা দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন।
ল্যাথারি পিন্টু ডেকে উঠল, ‘ধলুভাই, কোথায় যাচ্ছেন?’
ধলুভাই বললেন, ‘ছ্যাড়!… টেলিগ্রাম এসেছে দুলাভাইয়ের অসুখ। তাই দিনাজপুর যাচ্ছি।’ সব শুনে মিলুমামা ফিসফিস করে বললেন, ‘ধলুটা দেবদাস হয়ে গেল!’ তো চলে যাওয়ার আগে হঠাৎ ঘুরে ধলুভাই বললেন, ‘বুঝলা মামুন, ওই-ই করবা, চিরকাল গেইট বানিয়েই যাবা আর অন্যরা এসে মেয়ে লিয়ে যাবে।’
বিয়েটা হলো। সবকিছুই খুব ভালোয় ভালোয় ঘটল। তবে বরের মাথায় ছিল বিরাট টাক। এ নিয়ে পাড়ার মেয়েরা বেশ হাসাহাসি করল।
মাসখানেক পরে ধলুভাই ফিরলেন। সুধীরকাকার দোকানে এসে বললেন : ‘আরে ছ্যা ছ্যা!… টাকার লোভে শেষমেশ একটা টেকো বুড়ো লোকের সঙ্গে বিয়ে দিল!… আমার তো তাও মাথায় চুল ছিল!’
বছর দুই পরে লিসা আপা ইরান থেকে ফিরলেন। সঙ্গে বছরখানেকের ফুটফুটে একটা বাচ্চা। সেদিন সকালে আরশাদভাই বাচ্চাটা নিয়ে গর্বিতভাবে ওদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পাড়ার যে-ই যায় সে-ই মিষ্টি চেহারার শিশুটাকে একটু আদর করে দেয়। এক সময় ধলুভাইও বাজারের থলি হাতে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আরশাদভাই বাচ্চাটাকে ধলুভাইয়ের কোলে দিলেন। ধলুভাই বাচ্চাটাকে বেশ আদর করলেন। বাচ্চাটাও হাসি হাসি মুখে আদর নিল। আরশাদভাই এক সময় বললেন, ‘লিসার ছেলে।’ সঙ্গে সঙ্গে ধলুভাই বাচ্চাটাকে আরশাদভাইয়ের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে হন হন করে বাজারের পথে হেঁটে চললেন। পরে সুধীরকাকার দোকানে এসে বললেন, ‘ফর্সা আর নাদুস-নুদুস হলেই কি বাচ্চা সুন্দর হয়? ওটা একটা চেহারা হলো? ওই রকম পুতুপুতু চেহারা!… ছ্যা!’
তবে ধলুভাইয়ের বোন, মানে প্যাটরাবুর বিয়ের সময়কার ঘটনাটাও বেশ নাটকীয়। আসলে ওনার নাম ছিল ক্লিওপেট্রা। ধলুভাইয়ের মা সংক্ষেপে ডাকতেন ‘প্যাটরা!’ ‘ও প্যাটরা!’ সেই থেকে ওর ‘প্যাটরা’ নামটাই চলছে। গড়নটাও অনেকটা প্যাটরার মতোই। ধলুভাইদের বাড়িতে লজিং থাকত ‘খচ্চর জববার’। মানে আসল নাম মোহাম্মদ আবদুল জববার খান; কিন্তু ওর খচ্চরের মতো স্বভাবের জন্যে পাড়ায় ওর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘খচ্চর জববার’। তো একদিন দুপুরে ধলুভাইদের বাড়িতে মহাগোলমাল। দেখা গেল, ‘খচ্চর জববার’কে প্রায় মারতে মারতে মকিম সাহেব বাড়ির বাইরে বের করে দিচ্ছেন। পেছনে ঝাঁটা হাতে ধলুভাইয়ের মা তেড়ে আসছেন। মাঝে মাঝে খচ্চর জববারের গায়ে দু-এক ঘা বসিয়েও দিচ্ছেন। পেছন থেকে ধলুভাইয়ের ছোট ভাইবোনরা খচ্চর জববারের বিছানা, বাক্স, এসব দরজা দিয়ে ছুড়ে ছুড়ে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। খচ্চর জববার একটা রিকশায় ওর জিনিসপত্র তুলে পাড়া ছাড়ল। সে প্রায় বছরচারেক আগের কথা।
তো সেদিন বিকেলে ধলুভাইকে দেখা গেল সুধীরকাকার দোকানে এসেছেন চকচকে নতুন একটা বড় হাতঘড়ি পরে। মামুনরা জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘জববরভাই লিয়ে এসেছেন। দুবাই থেকে।’ পরে বৃত্তান্ত যা জানা গেল তা হচ্ছে মোহাম্মদ আবদুল জববার খান, মানে সেই ‘খচ্চর জববার’, কয়েক বছর দুবাইয়ে থেকে দেশে ফিরেছে। আর আসার সময় মকিম সাহেবের বাড়ির সবার জন্যে নানা রকম উপহার কিনে এনেছে। ধলুভাই আর ওর আববার জন্যে কিনে এনেছে ওরকম দুটো দামি ঘড়ি। বাড়ির মেয়েদের জন্যেও নানা রকম উপহার। দুদিন পরই শোনা গেল এক তাৎপর্যপূর্ণ খবর। তা হচ্ছে, ধলুভাইয়ের বোন প্যাটরাবুর সঙ্গে খচ্চর জববারের বিয়ে হতে চলেছে এবং এই শুক্রবারেই বিয়ে। ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে থাকল। পাড়ার লোককে তেমন না জানিয়েই, আর এটাই নাকি খচ্চর জববারের ইচ্ছে। বিয়েটা হয়েও গেল।
বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই একদিন ধলুভাইদের বাড়ি থেকে শোনা গেল প্রচন্ড হইচই, চিৎকার, কান্নাকাটি। কী? না, বিবাহিত লোককে আবার বিয়ে দেবার কারণে ধলুভাইয়ের আববাকে, মানে মকিম খালুকে, পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। পাড়ার ছেলে হিসেবে মামুনরা তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারে না। সবাই ছুটে গেল। ঘটনা যা জানা গেল তা হচ্ছে, খচ্চর জববার কোনোদিনই দুবাই যায়নি। ও এতদিন রংপুরে গ্রামে ছিল। ওখানকার এক পয়সাওয়ালা জোতদারের মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই বসবাস করত। তারই টাকায় ওর যত ফুটানি। ঘড়ি-টড়ি কেনা সব ওই টাকায়। গত দুদিন ধরে খচ্চর জববার লাপাত্তা!
বিয়েটা পড়িয়েছিলেন যিনি, বেলদারপাড়ার মসজিদের হুজুর সেই রহিমউল্লা মোল্লাকে ডেকে আনা হলো। রহিম হুজুরের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। কয়েক বছর ধরে এই পাড়ার মসজিদে ইমামতি করছেন। গোলগাল চেহারার মোল্লা রহিমউল্লাহর মুখে ছাগলের মতো একগুচ্ছ দাড়ি। রহিম মোল্লা বললেন, ‘আঁই কী অর?… এঁয়ারা হগলে কলেন, অঁই তাই বিয়াডা হরায় দিলাম।… আঁর কী কসুর?’
প্যাটরা আপুর জন্যে মামুনদের দুঃখ লাগছিল; কিন্তু দুঃখ করবে কী? ধলুভাইয়ের মেজমামা, মানে আয়নাল লস্কর, এলাকায় ‘টাউট লস্কর’ হিসেবেই যিনি বেশি পরিচিত এবং যিনি নওগাঁয় শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকলেও মাঝে মাঝেই মামলা-মোকদ্দমা করতে রাজশাহী শহরে আসেন এবং বোনের বাড়ি সুদীর্ঘ সময় থেকে যান, সজোরে চেঁচাতে থাকলেন ‘লিয়ে আয় তো!… লিয়ে আয়!… আজ দেখিয়ে ছাড়ব সব মামুর ব্যাটাকে!’
মামুনদের দেখে লস্কর মামার সে কী উত্তেজনা। ‘তোমরা পাড়ার এতগুলান জোয়ান মর্দ থাকতে দুলাভাইরে পুলিশে ধরে লিয়ে গেল! কী করো মিঞারা? অ্যাঁ!!’ তারপর আবার চোটপাট ‘লিয়ে আয়!… আজ ডিসি-এসপি সব হেলিয়ে দিবো। লিয়ে আয়!’
মামুনরা ভাবছিল কী আনতে বলছে মামা? বন্দুক, না পিস্তল? কিন্তু মামা যখন সত্যিকার ক্ষেপে উঠে অন্দরের দরজা দিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন – ‘লিয়ে আয়… আমার পায়জামাটা লিয়ে আয়!’ তখন বোঝা গেল, মামা ঘরে পরার লুঙ্গি ছেড়ে বাইরে যাবার পায়জামা পরবেন। তো পায়জামা এলো। লস্কর মামা তাতে পা গলিয়ে বের হওয়ার সময় খুব ব্যস্তভাবে ধলুভাইয়ের মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ‘পাঁচশ টাকা দাও তো, বুবু। দুলাভাইকে ছাড়িয়ে আনি।’ তো ধলুভাইয়ের মা, মানে আমাদের ফাতেমা খালা, বিষণ্ণ মুখে বললেন, ‘পাঁচশ টাকা তো ঘরে নেই, ভাই।’ ‘তো কত আছে?’ মামার অসহিষ্ণু প্রশ্ন। ‘তিনশর মতো হবে।’ ‘তাই দাও।’ ফাতেমা খালা দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকে তিনশো টাকা এনে লস্কর মামার হাতে দিলেন। লস্করমামা মুখে মহাবিরক্তিভাব ফুটিয়ে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন। মামুনরা সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু লস্কর মামা রক্তচক্ষু তাকিয়ে বললেন, লাগবে না। উনি একাই পারবেন।
তো লস্কর মামা তো ওই বের হলেন। এরপর তিন মাস আর মামার খবর নেই। শোনা গেল ওই বাড়ি থেকে বেরিয়েই উনি সোজা নওগাঁয় শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন এবং জমি কেনাবেচার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
বিয়ে নিয়ে একটা না একটা রগড় মামুনদের পাড়ায় লেগেই থাকত। যেমন সুধীরকাকাই খবরটা দিলেন। ধলুভাইয়ের চাচাতো ভাই বয়লার আনসারের বিয়ে। ওকে বয়লার আনসার নামে ডাকা হতো কারণ সান্তাহারে ওদের ধান-চালের কল আছে। বয়লার আনসার মামুনদের পেছনের পাড়ায় থাকলেও মাঝে মাঝেই মামুনদের আড্ডাতেও এসে যোগ দিত। বিয়ে নাকি বগুড়ায়। কথাটি যে ঠিক তা বোঝা গেল দুদিন পরে আনসার নিজেই এসে যখন মামুনদেরকে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেল। তবে প্রথমে যেতে হবে সান্তাহারে। বরের বাড়ি। ওখান থেকে বরযাত্রী বগুড়ার কাহালুতে রওয়ানা হবে।
বিয়ের দিন সকালে রাজশাহী থেকে ট্রেন ধরে মামুন আর মাথামোটা পিন্টু সান্তাহারে বয়লার আনসারের গ্রামের বাড়িতে এলো। ওদের দেখে বয়লার আনসার তো মহাবিরক্ত – ‘তোমরা?’
‘আপনিই তো বিয়ের দাওয়াত দিলেন। তাই এলাম।’
‘দাওয়াত দিলেই কি আসতে হবে?’ বলে বয়লার আনসার গজগজ করতে করতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
তো পরে বরযাত্রীদের গোটা দলটি বগুড়ার কাহালু যাওয়ার ট্রেন ধরার উদ্দেশে হেঁটে সান্তাহার স্টেশনে রওয়ানা হলো। বরযাত্রীদের মুরুবিব আনসারের ফুফা গোঁ ধরলেন যে, ট্রেনের টিকিট কাটা হবে না। বরযাত্রীদের আবার টিকিট কী? তো মামুনেরা প্রায় তিরিশজন বরযাত্রী। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, ট্রেনে চলেছে। বরের পরনে সাদা চোস্ত পায়জামা, শেরওয়ানি, পায়ে নাগরা জুতো, মাথায় পাগড়ি আর মুখে সাদা রুমাল। পোশাকগুলো মামুনদের পাড়ার কালাম ডেকোরেটরের কাছ থেকে ভাড়া করে আনা। বর বয়লার আনসার মুখে রুমাল দিয়ে ওর পাশে বসা দুই বন্ধুর সঙ্গে ফিসফিস করে নানা কথা বলে চলেছে আর মাঝে মাঝে খিকখিক করে হাসছে। দুই স্টেশন পরেই হঠাৎ করে ট্রেনটা থেমে গেল এবং গোটা ট্রেনে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। কী? না, মোবাইল কোর্ট বসেছে। রেলের পুলিশ বিনা টিকিটের যাত্রী পেলেই ধরছে। বয়লার আনসার তড়াক করে লাফিয়ে আর্তনাদ করে উঠল ‘ফুফা!’ ফুফা বললেন, ‘ঘাবড়াসনে, আনসার! তোর বিয়ে আজ হবেই।’ ফুফা এবারে গেরিলা কমান্ডারের ভূমিকায়। তার নির্দেশে মামুনরা সব সুড়সুড় করে ট্রেনের পেছনের দরজা দিয়ে নেমে এ বগি ও বগির ফাঁক গলে স্টেশনের বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। মামুন হঠাৎ পেছন ফিরে দেখে দুই বগির মাঝখান দিয়ে দৌড়ে পার হতে গিয়ে বর বয়লার আনসার, তখনো মুখে রুমাল ধরা, দুই লোহার খাঁজে ওর পাগড়িটা আটকে যাওয়ায় আর নড়তে-চড়তে পারছে না। উবু হয়ে বসে আছে। ‘ফুফা!’ বরের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। আবার ফুফা মুশকিল আসানের ভূমিকায়। যাহোক, বর বয়লার আনসার মুক্ত হলো এবং মামুনরা কোনো বড় রকম ঝামেলা ছাড়াই সবাই স্টেশনের বাইরে বের হতে পারল। শুধু বরের ছোটভাই, মানে সনু এবং বরের ছোটমামা রেলপুলিশের সামনে পড়ে যাওয়ায় নিতম্বদেশে কয়েকটা করে লাঠির বাড়ি খেয়েছিলেন। ছোটমামা অবশ্য এ-কথা অস্বীকার করলেন যে না, লাঠি মারেনি। পুলিশ লাঠি তুলে ভয় দেখিয়েছে শুধু। তবে সারাটা দিন মামাকে প্রায়ই পশ্চাদ্দেশে হাত বোলাতে দেখা গেছে।
তো স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখা গেল, কয়েকটা হাড় জিরজিরে ঘোড়ার গাড়ি ছাড়া আর কোনো বাহন নেই। বরকর্তা ফুফা বললেন, ‘কুছ পরোয়া নেই! পায়দলে চলো।’ তো বর্ষাকালে সেই কয়েক মাইল কাদাভরা রাস্তায় কাহালুর পথে বরযাত্রীরা হেঁটে চলল। কাদা ছিটে ছিটে বরের সফেদ পায়জামা, প্রায় ঊরু পর্যন্ত, ভরে গেল কালচে দাগে।
তো কনেপক্ষ বরসহ মামুনদের তুলল, না, ওদের নিজেদের বাড়িতে নয়, সেটা বিয়ের সময় হবে, তুলল সামনের একটা অফিসঘরে। ওটা এক এনজিওর অফিস। আজ এনজিও অফিস দুপুর পর্যন্ত ছুটি। তাই আপাতত ওখানেই থাকার ব্যবস্থা।
দুপুরে খাওয়ার পরে সবাই একটু জুত হয়ে বসেছে, এমন সময় শোনা গেল হইচই! অনেক নারীকণ্ঠের মাঝে দু-একটা পুরুষকণ্ঠ। কী? না আজ এনজিও অফিসটি বন্ধ বটে, তবে আজ আবার ওদের ঋণের কিস্তি শোধের শেষ দিন। তাই দলে দলে গ্রাম থেকে গরিব মহিলা সব আসছে কিস্তির টাকা শোধ দিতে। মামুনদেরকে বরসহ অফিসঘর ছেড়ে দিয়ে তাই বাইরের রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হোল। আর দু’জন পুরুষলোক টেবিলে বসে লাইনে দাঁড়ানো মহিলাদের কাছ থেকে কিস্তির টাকা নিয়ে খাতায় লিখে রাখতে লাগল। বয়লার আনসার মুখে আবার রুমাল দিয়ে রাস্তার ড্রেনের পাশে এক দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। গ্রামের মহিলারা পাশ দিয়ে যাবার সময় অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। একজন ফোঁড়ন কাটল – ‘এ ক্যাংকা বরগো! ঢ্যাঙ্গার মতো ঢেড়িয়েই আছে!’
তো সেবার যে কাহালু থেকে আনসারের বউ নিয়ে শেষমেশ নিরাপদে রাজশাহীতে ফিরতে পারা গিয়েছিল, সে নেহাত শাহ মখদুমের কৃপায়!
তবে সবচেয়ে রগড় হলো ধলু ভাইয়ের নিজের বিয়ের সময়। মেয়ে মোটা ও কালো হলেও মেয়ের বাবার চাঁপাইনবাবগঞ্জে বড় দোকান আছে। ধলুভাইদের পরিবার তাই খুব খুশি। কয়েক দিন বেশ উত্তেজনায় কাটল। সবাই মিলে বাসে বরযাত্রী যাওয়া হবে। তো বিয়ের দিন বিকেলে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সময় বরের রিকশা ধলুভাইদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা যাওয়া মাত্রই ধলুভাই হঠাৎ রিকশা থেকে নেমে ‘মাগো’ বলে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটে গেল। ওদিকে বাড়ির সামনে দাঁড়ানো ধলুভাইয়ের মাও ‘ধলু রে’, বলে এক মহাচিৎকার দিয়ে দৌড়ে গিয়ে ধলুভাইকে জড়িয়ে ধরলেন। মনে হলো, ধলুভাই বিয়ে করতে যাচ্ছেন না, ফাঁসিতে চড়তে যাচ্ছেন!
বিয়েতে ধলুভাই নতুন শার্ট, প্যান্ট, জুতো ছাড়াও নগদ বারো হাজার টাকা পেলেন। বুদ্ধিটা মিচকে পিন্টুই দিলো। ‘ধলুভাই, সবাই-ই তো বউ লিয়ে হানিমুনে যায়, আপনি একটা নতুন কিছু করেন।’ ‘কী করব?’ ‘আপনি আপনার বন্ধুদের লিয়ে হানিমুনে যান। এটা একটা বলার মত ঘটনা হবে।’ কেন জানি ধলুভাইয়ের আইডিয়াটা বেশ পছন্দ হলো। ‘বুলছিস?… কোথায় যাওয়া যায় বল্ তো?’ ‘কেন? কলকাতায়।… এত্তো বড় শহর। হিন্দি সিনেমা দেখবেন… রাজেশ খান্না… ডিম্পল কাপাডিয়া।’ মিচকে পিন্টু একটু নেচেও দেখাল। ‘তাছাড়া কলকাতার নিউমার্কেট থেকে অনেক কিছু কিনবেন…. ভাবির জন্যে শাড়ি।’
তো যেমন কথা তেমন কাজ। ধলুভাইয়ের বন্ধুদের মধ্যে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। বটুভাই, সুভাষদা, খশবুভাই আর ধলুভাই এই চারজন একদিন ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে সত্যি সত্যিই কলকাতার পথে রওনা হলো। সুভাষদা আগে কলকাতায় গেছেন, উনিই এই দলের গাইড।
মামুনরা তো প্রতিদিন সুধীরকাকার দোকানে বসে হিসাব করে, ওরা আজ কতদূর গেছে? কলকাতায় কী কী মজা করছে? বারো হাজার টাকায় চারজনের কলকাতা শহরে কত দিন থাকা সম্ভব? ল্যাথারি পিন্টু অনেক হিসেব কষে গম্ভীরমুখে জানাল, ওই টাকায় কলকাতায় পনেরো দিনের বেশি থাকা সম্ভব না। পনেরো দিন কী? ছয় দিনের মাথায়ই এক বিকেলে দেখা গেল, ধলুভাই, বটুভাই আর খশবুভাই সুধীরকাকার দোকানের বেঞ্চে বিষণ্ণভাবে বসা। কেবল সুভাষদা নেই। উনি কৃষ্ণনগরে ওর মাসির বাড়ি দিন কয়েক থেকে পরে ফিরবেন। ‘তা আপনাদের কলকাতা ভ্রমণ কেমন হলো?’ এ-প্রশ্নে বেশ তেতো মুখ নিয়ে ধলুভাই যা বললেন তা হচ্ছে, প্রথম দুদিন ভালোই কেটেছিল। নিউ মার্কেটে যেয়ে সবার জন্যে রঙিন পাঞ্জাবি কিনেছেন, বিখ্যাত ‘শ্রীলেদার’ জুতোর দোকানে গিয়ে চামড়ার স্যান্ডেল কিনেছেন আর নিজাম হোটেলে কাবাব-পরোটা খেয়েছেন। ওখানকার খিরি কাবাব নাকি অনবদ্য! তারপর? মামুনদের এই প্রশ্নের জবাবে বোঝা গেল যে, ওই ‘তারপর’ই সমস্যা! কারণ সুভাষদা বুদ্ধি দিয়েছিলেন, ‘চল, সবাই মিলে পুরী যাই। ওখানে সি-বিচ আছে।’ আর ছোট করে বলেছিলেন, ‘রাতে ওখানে সস্তায় মদ-টদ পাওয়া যায়!’
এটা শুনে বটুভাই খুবই উৎসাহিত হয়েছিলেন এবং তারপর ওরা দল বেঁধে পুরীতে যান। এরপরের ঘটনাটা কিছুটা ধোঁয়াশা। বটুভাই বলেন, ধলুভাইয়ের টাকার ব্যাগটা হারিয়ে গিয়েছিল হোটেলের কামরায়। আর খশবুভাই বলেন, এক রাতে সমুদ্রসৈকতে বসে পান একটু বেশি হওয়ায় ওঁদের টাকার ব্যাগটা ওঁরা সৈকতেই ভুলে ফেলে রেখে হোটেলে চলে এসেছিলেন। পরদিন সকালে মনে পড়লে খুঁজতে গিয়ে আর পাননি। এরপর সুভাষদার এক দূর সম্পর্কের কাকার কাছ থেকে ছশো টাকা ধার করে কোনো রকমে আবার রাজশাহী ফেরা। ধলুভাই খুব বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকলেও বটুভাইয়ের তেমন দুঃখ নেই। কারণ, এত ঝামেলার মধ্যেও ওরা হাতি মেরা সাথি ছবিটা দেখেছেন দুবার, আর ববি তিনবার!
তবে পশ্চিমবঙ্গ সফরে যাবার মামুনের অভিজ্ঞতাও তেমন ঘটনাহীন নয়। পাঠানপাড়ার গৌতম মামুনের দীর্ঘদিনের বন্ধু। গৌতম মাঝে মাঝে ভারতে যায়। ওখানে ওদের আত্মীয়স্বজন আছে। তো সেবার দুর্গাপূজার সময় গৌতম বলল, ‘আমি পুজোয় কলকাতায় যাচ্ছি। যাবি?’ মেজভাবি ও বড়আপাকে ধরে মামুন হাজারদেড়েক টাকা ম্যানেজ করল। কলকাতা যাওয়া আর ঠেকায় কে?
কলকাতার কাছে ব্যারাকপুরে গৌতমের এক দাদার বাড়ি উঠেছিল মামুনরা। পুজোয় তো পাড়া বেশ জমজমাট। গৌতমের দাদা জানালেন, আগে পাড়াতে একটা পুজো হতো। এবার দুটো হচ্ছে। তো দাদাদের পুজোটাতেই পাড়ার ভারিক্কী মানুষেরা সবাই আছেন, আর আরেকটা পুজো, গৌতমের দাদার ভাষায় ‘ওটা ছেলে-ছোকড়াদের ব্যাপার’!
তো পুজোর সপ্তমী দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। ‘ছেলে-ছোকড়াদের’ পুজার প্যান্ডেলটা তো খুব জমে উঠেছে, কারণ ওখানে মাইকে জোরসে হিন্দি ছবির গান আর মঞ্চে নাচ চলছে। আর এদিকে গৌতমের দাদাদের পুজায় আজ আবার সেমিনার। বিষয় ‘বাংলা কথাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ ও করণীয়’। প্রধান বক্তা কলকাতার এক বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক। বিকেল চারটেয় অনুষ্ঠান। তো কথাসাহিত্যিক মশায় তো কলকাতা থেকে ট্যাক্সিতে চেপে চলে এসেছেন। পরনে কোঁচানো ধবধবে সাদা ধুতি ও সোনালি রঙের বোতাম লাগানো ঘিয়ে পাঞ্জাবি। অন্যান্য বক্তারাও মঞ্চে হাজির। কিন্তু দর্শকসারি এক্কেবারে শূন্য। সামনের সারিতে কেবল মাইক আর ডেকোরেটরের ছেলে দুটো গেঞ্জি পরে বসে আছে। গৌতমের দাদা আর দু-তিনজন আয়োজক হন্যে হয়ে লোক ডাকাডাকি শুরু করলেন। একজন মাইকে ঘোষণা করতে থাকলেন – ‘আসুন!… আসুন! কলকাতা থেকে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক অমুকবাবু আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছেন। আপনারা আসুন!’ কিন্তু কাউকেই আসতে দেখা গেল না। গৌতমের দাদাকে উত্তেজিত কণ্ঠে একজনকে বলতে শোনা গেল, ‘তখনই পইপই করে বারণ করেছিলুম ওসব কথাসাহিত্যিক-টাহিত্যিক আনিস্ না।… এখন বোঝ ঠ্যালা! মানীর মান যাচ্ছে!!’ মাইকে আরো অনেকক্ষণ আহবান চলল। ‘আসুন!… আসুন! আপনারা আসুন!’ কিন্তু কেউই এলো না। সামনে শুধুই সারি সারি খালি চেয়ার। এদিকে বেচারা কথাসাহিত্যিক মঞ্চে ক্রমশই কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন! শেষমেশ না পেরে বললেন, ‘তা উত্তমবাবু… আমি না হয় আজ…!’ তা উত্তমবাবু, মানে গৌতমের দাদা বললেন, ‘সে কী! একটু জলখাবার খেয়ে যাবেন তো? পুজো বলে কথা!’ এদিকে ওদিককার প্যান্ডেলটার সামনে তখন মহাভিড়। মাইকে বাজছে ‘হাম তোম এক কামরেমে বন্দ হ্যায়/ আওর চাবি খো গ্যয়ে!’
পরদিন গৌতম মামুনকে নিয়ে গেল সিঁথির মোড়ে ওর এক দূর-সম্পর্কের বউদির বাড়ি। ভুল বাসে ওঠার ফলে সে-বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে ওদের বেজে গেল প্রায় বারোটার মতো। বউদি ওদের দেখে বললেন –
‘এমন সময় এলে, না দিতে পারি অন্ন, না দিতে পারি জলখাবার!… তাছাড়া, আমরা হলাম গিয়ে শাকাহারী। কী যে দিই!’ তারপর জিজ্ঞেস করলেন; ‘তা তোমরা চা খাবে তো?… গোয়ালাটাও আজ এলো না!’
মামুন তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি চায়ে দুধ খাই না।’
বউদি বললেন, ‘তা হলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল!’
শেষমেশ হাতলভাঙা কাপে দুধ-চিনিহীন দুকাপ চা খেয়ে ভরদুপুরে দু’জনে আবার রোদের মধ্যে পথে বের হলো। যাওয়ার সময় বউদি অবশ্য দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গৌতমকে বললেন;
‘গতবার পেঁয়াজ রঙের যে জামদানিটা এনেছিলে, সেটা আমার খুবই ভালো লেগেছে।… পরের বার ওরকম আরেকটি নিয়ে এসো।’
বিয়ে তো বিয়ে, মৃত্যু নিয়েও মামুনদের পাড়ায় রগড় কিছু কম হতো না। যেমন ওদের পাড়ায় মুর্শিদাবাদ থেকে এসে বসতি গড়া তালেব আলী মিয়া সুদের ব্যবসা করতেন। তালেব মিয়ার তিন ছেলে – বুজু, বদি আর বটু। ওঁর তিন ছেলেরই কিছু নেশার অভ্যাস ছিল। ছোট ছেলে বটুভাই তো সাত বছর বয়স থেকেই সিগারেট ফুঁকতে পটু। তো সেবার শীতকালে তালেব মিয়া মারা গেলেন। বুজুভাইয়েরা চল্লিশা খানার আয়োজন করছেন। এমন সময় মিচকে পিন্টু বুদ্ধি দিলো, ‘বুজুভাই, চল্লিশা তো সবাই-ই করে। এমন কিছু করেন যে, আপনার আববার নাম অমর হয়ে থাকে।’ ‘কী করব, বেটা?’ বুজুভাইয়ের প্রশ্ন। ‘ওইদিন কাওয়ালি লাগিয়ে দেন। রাতভর দুঃখের কাওয়ালি গান হবে। একেবারে অন্য রকম ঘটনা হবে!’ কেন জানি কথাটা বুজুভাইয়ের খুব মনে ধরল।
তো সেদিন সন্ধ্যায় চল্লিশার কোরান খতম অনুষ্ঠানের বদলে কাওয়ালি হবে। স্টেশনপাড়ার বিহারি মোকসেদ কাওয়াল গলায় লাল রুমাল, মাথায় জরি-টুপি পরে কাঁধে একটা পুরনো হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ওর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে উপস্থিত। বুজুভাইদের উঠোনের পেয়ারা গাছটার তলায় চাঁদতারা মার্কা রঙিন চাঁদোয়া টানিয়ে নিচে একটা চৌকি পেতে, আর তার ওপর সবুজ চাদর বিছিয়ে, সামনে হারমোনিয়াম নিয়ে মোকসেদ কাওয়াল দলবল নিয়ে বসল। মামুনরাও সব উপস্থিত। কাওয়ালি শুরু হলো ‘ইয়ে জিন্দেগি, কেয়া জিন্দেগি/ সব ঝুটা হ্যায়/ মেরে দিল সেরেফ/ মক্কা জানে মাঙতা হ্যায়…’। তো মোখলেস কাওয়ালের কাওয়ালি তো চলছে। এর মাঝে দেখা গেল বুজু, বদি আর বটু তিন ভাইয়ের কারো পাত্তা নেই। কিছুক্ষণ পরে কারণটা বোঝা গেল। বদি আর বটুভাই ওদের বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে বোতল খুলে বসেছে। মাঝে মাঝে ওদিক থেকে বেসুরো চিৎকার শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল শীর্ণ বুজুভাই কিছুটা ঝিমাতে ঝিমাতে আসরে এসে একটা খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছেন। মুখে একটা স্বর্গীয় ধরনের হাসি। বুজুভাইয়ের বন্ধু মিলুমামা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হলো রে বুজু?’ এই সময় পেছনের বাগান থেকে আবার বেসুরো চিৎকার ভেসে উঠল। বুজুভাই বললেন, ‘দ্যাখ্, দ্যাখ্, হারামজাদাদের কান্ড দ্যাখ্!… আজ আববার চল্লিশা, আর বদমায়েশ দুইটা আজ বোতল খুলে বসেছে! এক্কেবারে ল্যাঙটা!… আর আমি, দ্যাখ্ বেটা, একটু শুকনো টেনে চুপচাপ বসে আছি। কোনো ঝামেলা করছি, বুল?’ শুকনো মানে গাঁজা। তো মিলু মামা আর কী বলবেন! ওদিকে মোকসেদ কাওয়াল তখনো গেয়েই চলেছে – ‘ইয়ে জিন্দেগি, কেয়া জিন্দেগি/ সব ঝুটা হ্যায়!’
তো সেবার হাজি বাবুর মা মারা গেল। হাজি বাবু তো কেঁদেকেটে একসা! হাজি বাবুর আববা ওকে পাঠাল শহরের বড় মাদ্রাসা থেকে কয়েকজন তালেব এলেম নিয়ে আসার জন্যে, যারা কোরান খতম পড়বে। হাজি বাবুর সঙ্গে মামুনও গেল। মাদ্রাসার বড় হুজুরের সঙ্গে এ-ব্যাপারে দেখা করে হাজি বাবু যখন কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘আমার মা মারা গেছে… কোরান খতম’… বড় হুজুর তখন খুবই নির্লিপ্ত পেশাদারি ভঙ্গিমায় ‘কোন পাড়া? কয় খতম? কতজন তালেব এলেম লাগবে? দুপুরে কী খাওয়াবেন?’ এসব জিজ্ঞেস করলেন। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পর মাদ্রাসা থেকে ওরা যখন বের হচ্ছে, বড় হুজুর তখন পেছন থেকে শেষ নির্দেশটা দিলেন, ‘শোনেন, গোস্তে আলু কম দেবেন।’
সুধীরকাকার চায়ের দোকানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে থাকলে এবং মামুনদের বাড়ি ফেরার কোনোই লক্ষণ দেখা না গেলে সুধীরকাকা ওঁর চুলোর আগুনে কাঁচা কাঠ ঢুকিয়ে দিতেন। আর বলতেন, ‘সব এক্কেবারে ল্যাচ্ছোড়! বাড়িঘর নাই নাকি? খরিদ্দার আসতে দাও!’ চুলায় কাঁচা কাঠ দেওয়ায় ঘন কালো ধোঁয়া উঠে মামুনদের চোখ প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করত। তখন সবাই বুঝত আড্ডার আসর ভেঙে এখন ওর দোকান ছেড়ে চলে যাওয়ার এটা সুধীরকাকার শেষ ওয়ার্নিং। আবার মামুনরা দু-একদিন সুধীরকাকার দোকানে না গেলে এই সুধীরকাকাই রাস্তায় ওদের দেখলেই দোকান থেকে চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘তোমরা সব মরলে না-কি?… অ্যাঁ! দেখি না!’ মামুনরা আবার সুড়সুড় করে ঢুকে সুধীরকাকার দোকানের খালি চেয়ারগুলি দখল করত এবং নতুন কিছু একটা করার পরিকল্পনা আঁটত।
আজ বিদেশের এক রাজধানী শহরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বড় করপোরেট অফিসের গদিআঁটা চেয়ারে বসে কফি খেতে খেতে মামুন প্রায়ই সেই সব দিনের কথা মনে করে। আর মনে মনে ভাবে, সুধীরকাকার দোকানের সেই ভাঙা চেয়ার, নড়বড়ে বেঞ্চ, আর হাতলবিহীন কাপে চা খাওয়ার সেসব দিনকালই বোধহয় ভালো ছিল!
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.