মার্কেজ, জীবন ও রাজনীতি

সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ গত ১৭ এপ্রিল (২০১৪) প্রয়াত হয়েছেন। ১৯৮২ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ‘for his novels and short stories, in which the fantastic and the realistic are combined in a richly composed world of imagination, reflecting a continent’s life and conflicts’। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন : ‘I have the impression that in giving me the prize, they have taken into account the literature of the subcontinent and have awarded me as a way of awarding all of this literature.’ তাঁর নোবেল পুরস্কার বক্তৃতা (‘The Solitutude of Latin America’) পড়লেই দেখা যায়, লাতিন আমেকিার ওপর ইয়োরোপ ও আমেরিকা কয়েক শতাব্দী ধরে যে পীড়ন ও লুণ্ঠন চালিয়েছে তার ইতিহাসের দিকে তিনি বারবার নজর দিয়েছেন। বক্তৃতায় উইলিয়াম ফকনারের উদ্ধৃতি দিয়েছেন : ‘I decline to accept the end of man’। লাতিন আমেরিকাতেও মৃত্যুকে অতিক্রম করে গিয়ে জীবনের প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ‘In spite of this, to oppression, plundering and abandonment, we respond with life. Neither floods nor plagues, famines nor cataclysms, nor even the eternal wars of century upon century, have been able to subdue the persistent advantage of life over death.’ জীবনের জয় দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই মার্কেজ বেঁচেছিলেন, লিখেছিলেন ও আমাদের বাঁচার অনুপ্রেরণা দিয়ে গিয়েছিলেন। জীবনের শেষ জন্মদিনে আমাদের রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন নতুন মানব অভ্যুদয়ের জয়-ঘোষণা, আর ওইদিনই জানিয়েছিলেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। তাঁর দীর্ঘ আশি বছরের শুভ্র সমুজ্জ্বল জীবনে যে-পাপ তিনি কোনোদিন স্বীকার করেননি। বক্তৃতায় মার্কেজ মানবমুক্তির স্বপ্নের কথা বলেছেন। ‘A new and sweeping utopia of life, where no one will be able to decide for others how they die, where love will prove true and happiness be possible, and where the races condemned to one hundred years of solitude will have, at least and forever, a second opportunity on earth.’ মানুষ যেন নিজের জীবনের নিয়ন্তা নিজেই হতে পারে তার জন্য, ভালোবাসা ও সুখকে সকলের জীবনে সত্য করে তোলার জন্য, মানবজাতিকে শতাব্দীর অনন্বয় থেকে মুক্ত করার জন্য মার্কেজ স্বাভাবিক ও যুক্তিসিদ্ধ ভাবেই সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

মার্কেজ চেয়েছিলেন, গোটা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে পরিণত হোক। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজ হোক বা কাল হোক, তা হবেই। কিন্তু তার জন্যে লেখকের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার তিনি বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, লাতিন আমেরিকার জনগণ উপন্যাসে কেবল অত্যাচার-অবিচার উন্মোচন ছাড়াও আরো কিছু আশা করেন। জনগণ জানে, নির্যাতন ও নিপীড়ন কী। লেখককে সামাজিক দায়বদ্ধতার বা অঙ্গীকারের নামে যদি নির্দেশ দেওয়া হয় কী লিখতে হবে, তাহলে লেখকের সৃজনশীলতার ওপর বিধিবিষেধ আরোপ করে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করা হবে। মার্কেজের মতে, ‘একজন লেখকের দায়িত্ব – বলতে পারেন বিপ্লবী দায়িত্ব – হলো ভালো লেখা।’ তাঁর মতে, ভালো উপন্যাস মাত্রই বাস্তবতার রূপান্তর। ‘আমার মতে উপন্যাস গোপন সংকেতের মাধ্যমে, পৃথিবী সম্পর্কে এক ধরনের ধাঁধার মাধ্যমে, বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। উপন্যাসে যে-বাস্তবতা নিয়ে কাজ করছেন তা জীবনের বাস্তবতা থেকে ভিন্ন – যদিও অবশ্য তা জীবনের বাস্তবতায় গভীরভাবে প্রোথিত।’ ‘আমার উপন্যাসে একটি লাইনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যা বাস্তবতায় প্রোথিত নয়।’

ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে উচ্ছ্বসিত মার্কেজের অনেক পাঠকই গল্পের জাদু বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন, কিন্তু তার পেছনে যে বাস্তবতা রয়েছে তা দেখতে পায় না। তার কারণ হিসেবে মার্কেজ নিজেই বলেছেন, ‘নিঃসনেদহে এর কারণ এই যে, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি এই সাধারণ তথ্য অনুধাবনে বাধ সাধে, যে বাস্তবতা কেবল টমেটো বা ডিমের দৈনন্দিন বাজারদরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। লাতিন আমেরিকার দৈনন্দিন জীবন একথাই প্রমাণ করে যে, বাস্তবতা অসাধারণ উপকরণদ্বারা পূর্ণ।’ লাতিন আমেরিকার ইতিহাস ও বাস্তবকে বাদ দিয়ে মার্কেজকে বোঝা সম্ভব নয়। নোবেল বক্তৃতায় তিনি পরোক্ষে আমাদের সেকথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই বাস্তবতা ও ইতিহাসকে গভীরভাবে বুঝতেন বলেই তিনি মানবমুক্তির স্বার্থে আমৃত্যু সমাজতন্ত্রের প্রতি নিজের বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন। জীবন, মানবমুক্তি ও সমাজতন্ত্র – মার্কেজের কাছে – পরস্পর অভিন্ন ছিল।

জিগাকুইরা শহরে মাধ্যমিক স্কুলের বোর্ডিংয়ে থাকার সময়ে মার্কেজ মার্কস পড়েন। তাঁর ইতিহাসের শিক্ষক গোপনে তাঁকে মার্কসের বই পড়তে দিতেন। ওই স্কুলের শিক্ষকরা ত্রিশের দশকে প্রেসিডেন্ট আলফনসো লোপেজের বাম সরকারের আমলে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে একজন মার্কসবাদী শিক্ষকের কাছে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বীজগণিতের শিক্ষক তাঁদের ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদ শেখাতেন। রসায়নের শিক্ষক লেনিনের বই দিতেন। তখনই মার্কেজ এই বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন : ‘মানুষের অদূরভবিষ্যৎ নির্ভরশীল সমাজতন্ত্রের ওপর।’ কমিউনিস্টদের সঙ্গে তাঁর নানা বিষয়ে মতান্তর হলেও তিনি কখনোই জনসমক্ষে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে কোনো অভিযোগ করতেন না। মাধ্যমিক স্কুলের আগে শৈশবে তিনি বড় হয়েছিলেন তাঁর মায়ের বাবা ও মায়ের (দাদামশায় ও দিদিমা) কাছে। তাঁর দাদামশায় কর্নেল নিকোলাস রিকার্দো মার্কোয়েজ মেজিইয়া তাঁকে গৃহযুদ্ধের বর্ণনা, মুক্তচিন্তার সমর্থকদের কথা, রক্ষণশীল সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই, আরাকাটাকাতে কলাকর্মীদের ওপর হত্যাযজ্ঞ ইত্যাদি বিষয়ে গল্প শোনাতেন। শৈশবে ও কৈশোরে প্রগতিশীল  চিন্তার দিকে তাঁর আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল এভাবেই।

১৯৫৭-তে মার্কেজ পূর্ব জার্মানি গিয়েছিলেন। সেখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার তিনি সমালোচনা করেছিলেন বোগোতার একটি কাগজের ধারাবাহিক লেখায়। ১৯৮২ সালে বলেছিলেন : ‘এখনো আমি মনে করি যে পোল্যান্ডের সাম্প্রতিক সংকটের আদি সূত্রাবলি ওই নিবন্ধগুলিতে পাওয়া যাবে। সে-সময়ে রাজনৈতিক হঠকারীরা প্রচার করে যে, ওইসব নিবন্ধ আমি যুক্তরাষ্ট্রের টাকা খেয়ে লিখেছি।… অথচ, ইতিহাস আমার বক্তব্যই সঠিক প্রমাণিত করেছে।’ পূর্ব ইয়োরোপে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার তিনি প্রবল সমালোচক ছিলেন। আবার কিউবা হচ্ছে সোভিয়েতের লেজুড় – এই মতেরও তিনি সমর্থক ছিলেন না। কিউবা ও সোভিয়েতের সম্পর্ককে তিনি ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক শর্ত ও সম্পর্কসমূহের মধ্যে স্থাপন করে বিচার করেছিলেন। আবার কিউবার পার্টির বা কাস্ত্রোর সব পদক্ষেপকে তিনি সমর্থন করতেন না। যেমন ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত হস্তক্ষেপকে কাস্ত্রো সমর্থন করলেও মার্কেজ সমর্থন করেননি। আবার তাঁর সঙ্গে কাস্ত্রোর বন্ধুত্বের কথা আবিশ্বে বহু আলোচিত বিষয়। কাস্ত্রো মার্কেজের লেখার নানা ধরনের ভুল ধরেছিলেন এবং তিনি তা মেনেও নিয়েছিলেন। জাহাজ ডোবা নাবিকের গল্প পড়ার পর কাস্ত্রো তাঁকে বলেছিলেন : ‘আমি (মার্কেজ) নৌকার গতি গণনায় ভুল করেছি এবং নৌকা ভেড়ার সময় যা লিখেছি তা ঠিক নয়। তাঁর কথাই ঠিক।’ আবার আগাম মৃত্যুর দলিল ছাপানোর আগে পান্ডুলিপিটি মার্কেজ কাস্ত্রোকে পড়তে দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শিকারের বন্দুকের নামের ভুল ধরেছিলেন। পাঠক কাস্ত্রো সম্পর্কে মার্কেজ লিখেছেন : ‘কত কম লোকই না জানে যে ফিদেল কাস্ত্রো একজন গোগ্রাসী পাঠক। সব যুগের ভালো সাহিত্য তিনি পছন্দ করেন এবং তার গুণী সমঝদারও বটে। এমনকি চরম গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতেও তিনি সঙ্গে একটা ভালো বই রাখেন যেন অবসর সময়ে পড়তে পারেন। রাতে বিদায় নেওয়ার সময় আমি তাঁর জন্য একটি বই রেখে গেলাম। পরদিন বারোটার সময় যখন আবার দেখা, তখন তিনি পুরো বইটাই পড়ে ফেলেছেন।’ কাস্ত্রো তাঁকে বলেছিলেন : ‘পরজীবনে যখন জন্মাবো, তখন একজন লেখক হতে চাই।’ ক্ষমতা ও খ্যাতি থেকে যে বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয় – তা নিয়েও তাঁদের দুজনের মধ্যে প্রচুর তর্ক ও আলোচনা হতো।

মার্কেজের স্টাইল নিয়ে আবিশ্বে প্রচুর আলোচনা হয়। আমরা আগেই দেখেছি মার্কেজ নিজেই বলেছেন, তাঁর উপন্যাসের প্রতিটি লাইন বাস্তবতায় প্রোথিত। নিজেই বলেছেন : ‘জার্মান ভাষায় কাফকা অবিকল আমার দিদিমার ভঙ্গি ব্যবহার করেছেন। তাঁর মেটামরফোসিস গল্পটি ১৭ বছর বয়সে পড়ে মনে হয়েছিল যে, আমিও লেখক হতে পারি।’ ‘দিদিমার পদ্ধতিতেই আমি হানড্রেড ইয়ারস অফ সলিচ্যুড লিখি।’ হেমিংওয়ে, সফোক্লিস, বারোজ, কনরাড, তলস্তয়, ফকনার, ভার্জিনিয়া উলফ, র্যাঁবো, গ্রাহাম গ্রিন ইত্যাদি অনেকের লেখা বিষয়ে, তাঁদের লেখার বৈশিষ্ট্য ও শিক্ষণীয় বিষয় সম্পর্কে, তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা বলেছেন। তলস্তয় বিষয়ে বলেছেন : ‘আমি তাঁর কাছ থেকে কিছুই নিই না, কিন্তু আমার বিশ্বাস, এযাবৎকালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস যুদ্ধ ও শান্তি।’ আবার ভার্জিনিয়া উলফের মিসেস দ্যলওয়ের একটি বাক্য বিষয়ে বলেছেন : ‘এই কথাগুলি যদি না পড়তাম তো আজ আমাকে যেমন দেখছেন, আমি হয়তো তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের লেখক হতাম।’ আবার সচেতনভাবে একথাও বলেছেন, ‘আমি সবসময়ে চেষ্টা করেছি কাউকেই অনুকরণ না করতে। যাঁদের লেখা ভালো লাগে তাঁদের অনুকরণ করার চেয়ে বরং তাঁদের কাছ থেকে আমি বারবার পালাতেই চেষ্টা করি।’ মার্কেজের স্টাইল ক্যারিবিয়ান জীবনযাপন ও রাজনীতির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন। ‘In every book I try to make a different path… One doesn’t choose the style. You can investigate and try to discover what the best style would be for a theme. But the style is determined by the subject, by the mood of the time… I only respond to our way of life, the life of the Caribbean.’ তিনি ক্যারিবিয়ান জীবনযাপন ও তার স্টাইলকে অবিচ্ছিন্ন করে তুলতে পেরেছিলেন বলেই ক্যারিবিয়ান যৌথচেতনার সব থেকে প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে আমৃত্যু অবিচ্ছিন্ন ছিলেন। ক্যারিবিয়ান নিঃসঙ্গতার মুক্তি ও সমাজতন্ত্রের বিজয় তাঁর চেতনায় অবিচ্ছিন্ন ছিল। ‘আমি কোনো বিশেষ তৃতীয় পথে বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি বহু পথ আছে – সম্ভবত আমাদের আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যত দেশ, ততো পথ। আমি নিশ্চিত যে, আমাদের ঠিক পথটি চিনে নিতে হবে। অন্যান্য মহাদেশ তাদের দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় যা লাভ করেছে আমরা যথাসম্ভব তা থেকে নেবো, কিন্তু যন্ত্রের মতো তা অনুকরণ করা চলবে না কিছুতেই – যদিও এ-পর্যন্ত আমরা  তা-ই করে এসেছি। এইভাবে ক্রমে ক্রমে আমরা নিজেদের স্বকীয় সমাজতন্ত্র অর্জন করবো।’ বর্তমান শতাব্দীতে লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের যে পরীক্ষা চলছে তা ১৯৮২ সালে বলা মার্কেজের বক্তব্যকেই যথার্থ প্রমাণ করে। ক্যারিবিয়ান জীবন ও রাজনীতি এবং মার্কেজের নান্দনিক শৈলী এতোটাই অবিচ্ছিন্ন যে – মার্কেজ তাঁর সময়ের ও একটি ভূখন্ডের এক অসামান্য প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।