মিনু মাসির বাসাবদল

এক

‘আমার নাম মিনু। মিনুরানি নাথ। আপনার ঘরটি আমাদের ভাড়া দিলে প্রাণে বেঁচে যাই কর্তাবাবু।’ দুই হাত জড়ো করে বলল মিনুরানি। যাঁকে উদ্দেশ করে বলল, তিনি উদয়ন মিত্র। ‘মিত্রমশাই’ নামে এলাকায় তাঁর পরিচিতি। আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিলেন তিনি। শিশির সমতটীর লেখা ঢাকার বাঈজীদের ইতিবৃত্ত। জমিদার, বাঈজি, সামন্তযুগ, কৈবর্তবিদ্রোহ, সেন-পাল আমল – এসব বিষয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ। আরেকটি বইও তিনি সংগ্রহ করেছেন, পূর্ববঙ্গের জমিদারবাড়ি। বাঈজী ইতিবৃত্ত শেষ করে জমিদার বাড়ি পড়া শুরু করবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। এখন পড়ছিলেন এলাহীজান বাঈজির অংশটি। উত্তর ভারত থেকে এসেছিলেন। ঢাকায় শেষজীবন কাটিয়েছেন। যৌবনে ঢাকার নওয়াব সাহেবের আমন্ত্রণে বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউটের পেছনের পুকুরের মধ্যখানে তৈরি স্টেজে নাচতে গিয়ে কী মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, তা পড়তে পড়তে একেবারে নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন মিত্রমশাই।

মিনুরানির কথা শুনবেন কী, তার উপস্থিতিই টের পাননি তিনি। রেখা তা বুঝতে পারল। মৃদু খাঁকারি দিলে কর্তাবাবু মুখ তুললেন। এ খাঁকারি তার চেনা। স্ত্রী মারা গেছেন তেরো বছর হয়ে গেল। এই তেরো বছর ধরে রেখা উদয়ন মিত্রের বাড়িতে  কাজ করছে। অন্যের চোখে রেখা ঝি হলেও মিত্রমশাই তা মনে করেন না। পরিবারের একজন বলেই স্বীকার করেন তিনি। ঘর ঝাড়ামোছা থেকে রান্নাবান্না – সবই করে রেখা। এই রেখাই মিনুরানিকে দোতলায় তুলে এনেছে।

মিত্রমশাইয়ের তেতলা বাড়ি – ‘নিরিবিলি’। একসময় বাড়ির নামটি সার্থক ছিল। চারদিকে খোলামেলা। বাড়ির পাশে একটা পুকুরও ছিল। পুকুরপাড়ে
আম-কাঁঠাল-নারকেল গাছ। বসন্তকালে গাছের ডালে কোকিলও ডাকত মাঝে মাঝে। এখন এই বাড়ির নাম ‘কোলাহলই’ ভালো মানায়। চারদিকের সেই খালি জায়গা ইটপাথরের বাড়িতে ভরে গেছে কবে! পুকুর ভরিয়ে এখন উঁচু আবাসন। সেই নির্জনতা আর নেই। চতুর্দিকে হইচই আর কলরব। অলিগলিতে ছেয়ে গেছে গোটা এলাকা, যা কিছু শান্ত নীরবতা, তা এখনো ‘নিরিবিলি’ জুড়ে।

দুই ইউনিটের বাড়ি ‘নিরিবিলি’। দোতলাটা এক ইউনিটের। নিচতলা আর তৃতীয়তলা ভাড়া দিয়ে দোতলায় নিজেরা থাকবেন ভেবে বিল্ডিংটা বানিয়েছিলেন উদয়ন মিত্র।

পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। চাকরির শেষদিকে চকবাজার শাখার পোস্টমাস্টার হয়েছিলেন। এখনকার মতো জীবন্মৃত অবস্থা ছিল না পোস্ট অফিসগুলোর। রমরমা অবস্থা ছিল তখন। বেশ ভালো বেতন পেতেন উদয়ন মিত্র। না হলে ছেলেমেয়ে দুজনকে মানুষ করতে পারতেন না। চাকরি শেষে যে-টাকা পেয়েছিলেন, তা দিয়ে এই শহরতলিতে প্রথমে তিন কাঠা জায়গা কিনেছিলেন, পরে তেতলা বাড়িটি করেছিলেন।

নিচতলা এবং তৃতীয় তলায় চারটা ফ্যামিলিকে ভাড়া দিয়েছেন। খুব কম ভাড়াই নেন তিনি। ভাড়াটের কী কষ্ট, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন তিনি, যখন নিজে ভাড়াটিয়া ছিলেন। এ ছাড়া চব্বিশ ঘণ্টা পানি। বিদ্যুৎ আর রান্নার গ্যাস-সুবিধা তো আছেই। যারা ভাড়াটিয়া হিসেবে আসে, মিত্রমশাইয়ের প্রথম কথা, ‘বাড়িটাকে নিজের বাড়ি বলে ভাবতে হবে। সিঁড়ি-ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে।’

বছরের পর বছর পার হয়, মিত্রমশাই ঘরভাড়া বাড়ান না। এসব কথা চারদিকে চাউর হয়ে যায় মধ্যমগ্রামের মতো মফস্বলে। কম ভাড়ায় নির্ঝঞ্ঝাটে বাস করতে চায় যে-ভাড়াটেরা, মিত্রমশাইয়ের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখন কোন ফ্ল্যাট খালি হয়!

মিনুরানি অবশ্য সে লোভে ‘নিরিবিলি’তে আসেনি।

প্রকৃতপক্ষে এই বাড়ির সুযোগ-সুবিধার কথা তার বিন্দুমাত্র জানাও নেই। কারণ সে এই এলাকার বাসিন্দা নয়। সে এসেছে চট্টগ্রাম শহর থেকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর মিনুরানি ঠিক করেছে – এই শহরে আর নয়। মফস্বলে চলে যাবে। সেখানে লাঞ্ছনা নেই, নিন্দা নেই। তাকে এবং তার পরিজনকে চেনার কেউ নেই মধ্যমগ্রাম মফস্বলটিতে। খোঁজ নিতে নিতে এই পড়ন্ত বিকেলে ‘নিরিবিলি’র নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার উঁকিঝুঁকি মারা রেখার চোখে পড়ে গিয়েছিল। তরতর করে নিচে নেমে এসেছিল। মিনুরানিকে কাছ থেকে দেখে, তার কথা শুনে ভালো লেগে গিয়েছিল রেখার। বলেছিল, ‘গত সপ্তাহে তিনতলার একটা ফ্ল্যাট খালি হয়েছে। চাকরি করতেন ভদ্রলোক। কুমিল্লায় বদলি হওয়াতে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়েছেন।’

একটু থেমে রেখা আবার বলেছিল, ‘ভাড়া দেওয়া না-দেওয়া কর্তা মশাইয়ের হাতে। আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন।’

খুশির চোখে মিনুরানি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কীভাবে দেখা হবে তার সঙ্গে? ঘরটা যে আমার বিশেষ দরকার ভাই!’

রেখা মিনুরানিকে দোতলায় তুলে এনেছিল।

উদয়ন মিত্র বিছানায় দুপুরখানার আলস্য ঝেড়ে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে বাঈজী পড়ছিলেন তখন।

রেখার খাঁকারি শুনে চোখ তুলতেই মিনুরানির ওপর নজর পড়ল মিত্রমশাইয়ের। ‘কে কে!’ বলার আগেই রেখা বলে উঠল, ‘খালি ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিতে চাইছেন। ওর নাম …।’

রেখা কথা শেষ করার আগে ব্যগ্র কণ্ঠে মিনুরানি বলে উঠল, ‘আজ্ঞে আমার নাম মিনুরানি নাথ। আপনার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে চাই।’

‘তা আগে থাকতে কোথায়?’ স্বভাবগম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন উদয়ন মিত্র। মিনুরানি বলল, ‘আজ্ঞে চট্টগ্রাম শহরেই থাকতাম।’

‘শহর ছেড়ে সতেরো মাইল দূরের এই মফস্বলে আসতে চাইছ কেন?’

মিনুরানি মনে মনে হাত দুটো যুক্ত করে মনে মনেই বলল, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন কর্তাবাবু।  আপনার মতো একজন লোকের কাছে মিথ্যে বলছি বলে ভগবান আমার পাপ লিখবেন। তারপরও মিথ্যে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমি। মিথ্যে না বলে যে আমার উপায় নেই। সত্যি বললে, আমার প্রকৃত পরিচয় জানলে যে আপনি আমায় ঘরভাড়া দেবেন না কর্তাবাবু! মনে মনেই জোড় হাত কপালে ঠেকাল মিনুরানি।

স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘শহরে খাইখরচা আর ঘরভাড়া অনেক বেশি। চালাতে পারছি না। এদিকে ঘরভাড়া কম, জিনিসপত্রের দামও বেশি নয়। বড় ছেলের একা ইনকামে সংসার চালানো যাচ্ছে না। তাই শহর ছেড়ে এদিকে আসতে চাইছি।’ এক নিশ্বাসে বলে গেল কথাগুলো।

‘তা তোমার ছেলে-মেয়ে কজন?’ আগের ভাড়াটেদের এসব কথা জিজ্ঞেস করেননি কোনোদিন। আজ কর্তাবাবুর কী হলো কে জানে, মিনুরানিকে জিজ্ঞেস করলেন! মিনুরানির বৈধব্যবেশ দেখে স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করেননি তিনি।

মিত্রমশাইয়ের প্রশ্ন শুনে রেখাও বেশ অবাক হলো। আগে কেউ ফ্ল্যাট ভাড়া করতে এলে রেখার ওপর সব ছেড়ে দিয়ে বলতেন, ‘আপনারা রেখার সঙ্গে কথা বলে সবকিছু জেনে নিন। ও সব জানে।’

রেখা ফ্ল্যাট-প্রত্যাশীদের শর্তাদি বুঝিয়ে দিয়ে ঘর দেখায়। পছন্দ হলে রেখার সঙ্গে কথা পাকা করে ওঠে। আজ ব্যতিক্রম দেখে অবাক না হয়ে পারল না রেখা। অবাক হলেও চুপ থাকল।

মিনু মাথায় আঁচলটা টেনে মৃদু গলায় বলল, ‘আজ্ঞে দুজন। দুজনই ছেলে। বড় ছেলে একটা ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। বিয়ে করিয়েছি সুবলকে। একটা নাতনিও আছে। ছোট ছেলেটি চাকরি খুঁজছে। বিদেশ যাওয়ার বড় শখ তার।’ পারিবারিক সকল কথা গড়গড় করে কর্তাবাবুকে বললেও আসল কথা বলল না মিনুরানি।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। রেখার সঙ্গে গিয়ে ফ্ল্যাটটি দেখো। পছন্দ হলে রেখাকে বলে যেও। ভাড়া এবং অন্যান্য শর্ত রেখার কাছ থেকে জেনে নিও। আর কবে উঠবে – রেখাকে বলে গেলেই হবে।’ বলে বইটি আবার চোখের সামনে মেলে ধরলেন। হাই পাওয়ার চশমাটি নিচের দিকে একটু নামিয়ে দিয়ে এলাহীজান বাঈজিতে মন দিলেন।

রেখা মিনুরানিকে তেতলার পূর্বপাশের ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়েছিল। কোমরে গোঁজা চাবির তোড়া বের করে দরজা খুলে দিয়েছিল।

ভেতরে ঢুকে মনটা নেচে উঠেছিল মিনুরানির। দুই বেডরুম, বড় একটা ডাইনিং রুম,  কাপড় শুকানোর বারান্দা। রান্নাঘরটি খোলামেলা। টয়লেট কাম বাথরুমটাও মন্দ নয়। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখে রেখা বলল, ‘আরেকটা জিনিস দেখাই তোমাকে দিদি। থুড়ি তুমি বলে ফেললাম! দিদিও ডেকে ফেললাম আবার! আসলে অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ আমরা। বেশিক্ষণ আপনি আপনি করতে পারি না। দিদি, মাসি, পিসি, মামি – এরকম কোনো একটা সম্পর্ক না পাতালে ভালো লাগে না। তুমি রাগ করলে না তো?’

এতক্ষণ মিনুরানিও হাঁসফাঁস করছিল। তার চেয়ে অন্তত পনেরো বছরের ছোট একজনকে আপনি আপনি করে যাচ্ছিল। রেখার কথা শুনে হেসে মিনুরানি বলল, ‘না না! রাগ করব কেন! আমার মনটাও বেশ চুলবুল করছিল তোমাকে তুমি বলবার জন্য। অস্বস্তি থেকে বাঁচিয়ে দিলে তুমি আমায়! কী জিনিস দেখাবে বলছিলে না? দেখাবে না?’

‘হ্যাঁ চলো।’ সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেছিল রেখা।

রেখা মিনুরানিকে ছাদে নিয়ে গিয়েছিল।

পড়ন্ত বিকেল তখন। কার্তিক মাস। বাতাসে শীতের হালকা আমেজ। ছাদজুড়ে
রোদ-ছায়ার কারিকুরি। বুকসমান রেলিং দেওয়া ছাদ। রেলিংয়ের পাশ ঘেঁষে নানা ফুলগাছের বড় বড় প্লাস্টিকের টব। আম, জাম্বুরা, লিচু, কামরাঙা, জলপাই, আমড়া, পেয়ারা, লেবু – এসব গাছ টবে টবে। কোনো গাছে ফল আছে, আবার কোনোটা ফলহীন। একপাশে নানা ফুল গাছ। ঝাঁকড়া এক বাগানবিলাস অসংখ্য হলুদ ফুল মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মিনুরানির মনে হলো – এতদিনের সকল গ্লানি যেন মুহূর্তে উধাও হয়ে গেছে।

‘এই ছাদটা কর্তামশাইয়ের প্রিয় জায়গা। ওই যে ওদিকে একটা আধ-হেলান চেয়ার দেখছ, প্রতি বিকেলে ওখানে এসে বসেন তিনি। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।’ একটু হাসল রেখা। তারপর খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে, এরকম কণ্ঠে বলল, ‘এই ছাদটাকে খুব পছন্দ করেন কর্তামশাই। শুনেছি – গিন্নিমা যখন জীবিত ছিলেন, প্রতি বিকেলে ওই ওখানে এসে বসতেন দুজনে। গিন্নিমা মারা যাওয়ার পর দুটো চেয়ারের একটা সরিয়ে ফেলেছেন। এখন একা বসেন।’

‘আচ্ছা ওঁদের কোনো সন্তান নেই?’

মিষ্টি একটু হেসে রেখা বলল, ‘সব কথা একদিনে জেনে ফেললে কী করে হবে! এখনো তো তুমি ফ্ল্যাটেও ওঠোনি! তোমাকে সবকথা বলব কেন?’ কৃত্রিম রাগ চোখেমুখে ভেসে উঠল রেখার। তারপর বলল, ‘আগে এসো। তারপর সব জানতে পারবে।’

এবার উচ্ছল কণ্ঠে রেখা বলল, ‘শোন দিদি, কর্তামশাই কিন্তু ময়লা, নোংরা একেবারেই পছন্দ করেন না। তোমাদের দরজার সামনের লবিটা, যদি আসো তোমরা, এবং তোমাদের সামনের সিঁড়িটা পরিষ্কার রাখতে হবে কিন্তু। অ হ্যাঁ। ভাড়াটেদের ছাদে আসতে কোনো আপত্তি নেই কর্তামশাইয়ের। তবে ছাদটা পরিষ্কার রাখতে হবে, এই যা।’

মিনুরানি বলেছিল, ‘কর্তাবাবু যদি আমাকে ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেন, তাহলে ঘরদোর, সিঁড়ি, ছাদ পরিষ্কার রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করব।’

চোখ কপালে তুলে রেখা বলে উঠল, ‘যদি ভাড়া দেন মানে কী! ভাড়া তো দিয়েই দিয়েছেন! শুনলে না কর্তামশাই বললেন – কবে উঠবে রেখাকে বলে গেলেই হবে! এখন বলো, কখন আসছ তোমরা? আমি একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। ভাড়া কিন্তু সাত হাজার। কোনো অ্যাডভান্স দিতে হবে না।’

‘পারলে তো কালই আসি।’ স্বাগত কণ্ঠে বলল মিনুরানি। ‘বাড়িওয়ালা বলেছে কালই ছেড়ে দিবি আমার বাসা। ছি ছি ছি।’ স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আজ তো সতেরো তারিখ। কাল ছেড়ে এলেও গোটা মাসের টাকা নেবে বাড়িওয়ালা। কষ্টেসৃষ্টে আর তেরোটা দিন কাটিয়ে দিই। আগামী মাসের এক তারিখেই আসব আমরা। মালপত্র গোছগাছ করতেও তো কদিন সময় লাগবে!’

‘কেন কেন, কষ্টেসৃষ্টে থাকবে কেন!’ মেয়েলি ঔৎসুক্য রেখার কণ্ঠে। ‘না থাক। ও কিছু না। তাহলে এই কথাই রইল। ফ্ল্যাটটা আমরা পেলাম। এক তারিখ উঠব। কর্তাবাবুর সঙ্গে দেখা করে যাব একবার?’

রেখা বলল, ‘তার দরকার নেই। আমিই বলে দেবক্ষণ।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলে রেখার হাতটি সেই বিকেলে চেপে ধরেছিল মিনুরানি।

দুই

জন্ম থেকেই জন্মদোষটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে মিনুরানিকে।

মিনুরানির নানুদি ননীবালা দাসী ছিল গণিকা। গৃহবধূ হয়ে ননীবালা কী করে সাহেবপাড়ায় এসে পৌঁছেছিলেন, তা এক লম্বা বৃত্তান্ত। বৃত্তান্তে না গিয়ে এইটুকু বলা যায়, কাঞ্চনার গ্রাম্যবধূটির স্বামীর চেয়ে পাশের বাড়ির দূরসম্পর্কের দেবরের প্রতি টান ছিল বেশি। ওই টানেই রাত গভীরে দেবরের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিলেন। তারপর সব ঘরত্যাগী নারীর যা হয়, ননীবালার কপালেও তা-ই ঘটেছিল। হাউস মিটিয়ে দেবরটি বউদিটিকে নমিতা মাসির কাছে বেচে গিয়েছিল। নমিতা মাসি সাহেবপাড়ার জাঁদরেল মাসি। তার দ্বিতল বাড়ি। সেই বাড়িতে দশজন কসবি। ননীবালা এলে এগারোজন হয়েছিল। ননীবালা এই পতিতাপল্লি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ছটফট করেননি। আসলে এখান থেকে চলে যেতে চানওনি তিনি। কোথায় যাবেন? শ্বশুরবাড়িতে? বাপের বাড়িতে? সেখানে গিয়ে মুখ দেখানোর পথ কি সে খোলা রেখেছে? তাছাড়া প্রতিটা পতিতাপল্লি এমন একটা খাঁচা, যেখানে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না।

দেহব্যবসায় মন দিয়েছিলেন ননীবালা। তার গায়ের রং মাজা কাঁসার মতো। ত্বক টান টান, মসৃণ, পিছল। ভরাট গাল। পাতলা ফুরফুরে নাকের পাটায় লাল পাথরের নাকফুল। নিটোল লম্বাটে গলা। ঠোঁট দুটো কমলার কোয়ার মতো পুরু এবং ভেজা ভেজা। স্তন দুটো সুগঠিত, দৃঢ়, মাংসল। পাতলা কোমর। সুগভীর নাভি। পেছন দিকটা তানপুরার মতো – ভারী এবং বিশাল। ননীবালার শরীর থেকে তীব্র ঝাঁঝাল হল্কার মতো কী যেন অনবরত বের হয়। তার দিকে বেশিক্ষণ তাকালে মাথা ঝিমঝিম করে। এই ননীবালার বাজার মাৎ করতে বেশিদিন সময় লাগল না। নমিতা মাসির লক্ষ্মীর ভাণ্ড পূর্ণ হতে লাগল দ্রুত।

যাক সে-কথা। একটা সময়ে ননীবালা নমিতা মাসির বিল্ডিংয়ের মালকিন হয়ে গিয়েছিলেন। খুন হয়েছিলেন নমিতা। অসৎ লোকদের রটনা – জোর করে মালিকানা আদায় করে গুন্ডা দ্বারা খুন করিয়েছিলেন ননীবালা। পুলিশ এ-কথার সপক্ষে কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি। পুলিশ, উকিল, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, নেতারা ননীবালার দেহসান্নিধ্য পেলে বর্তে যায়।

ননীবালার দুজন সন্তান হয়েছিল। ছেলে বড়, মেয়ে ছোট। মাথা তোলা হলে বখে গিয়েছিল অমিয়। বড় আশা করে ননীবালা ছেলের নাম রেখেছিলেন অমিয়। ভেবেছিলেন, অমিয় লেখাপড়া শিখে নামের সার্থকতা বজায় রাখবে। কিন্তু ছোটবেলাতেই অমিয়ের ভেতর গরল ঢুকে গিয়েছিল। দিনরাত নারী-পুরুষের বেলেল্লাপনার মধ্যে বড় হচ্ছিল অমিয়।

মেয়েটিকে কিন্তু বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন ননীবালা। ফুলমালা দেখতে ঠিক তার মায়ের মতোই হয়েছিল। স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন ফুলমালাকে ননীবালা। ঠিকানা গোপন করেই ভর্তি করিয়েছিলেন। আসল ঠিকানা জানলে তো হেডমাস্টার ফুলমালাকে ভর্তি করাত না। এইট পর্যন্ত পড়তে পেরেছিল। তারপর ফুলমালার যাতায়াত পথটি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। পল্লির বাইরের মানুষেরা জেনে গিয়েছিল – ফুলমালা এক কসবির মেয়ে।

ষোলো না-পেরোতেই ফুলমালার বিয়ে দিয়েছিলেন ননীবালা। বর সুধাংশু। সুধাংশুর পদবি দাস। রেলে চাকরি করে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের কাউন্টারে টিকিট বিক্রির চাকরি। রেল কলোনিতে থাকে। একা। বরিশালের দিকে বাড়ি। নৌকাডুবিতে মা-বাপ মারা গেলে বরিশালের টান শিথিল হয়ে গেছে।

বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একদিন সাহেবপাড়ায় এসেছিল সুধাংশু। ননীবালা তখন দেহব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যাওয়ায় লজ্জায় ধরেছে তাকে। এখন তিনি মাসিগিরি করেন। তার আন্ডারে দশ-বারোজন গণিকা কাস্টমার বসায়। ননীবালা টাকা গোনেন। তিন-চারজন মিলে ননীবালার বাড়িতেই ঢুকেছিল। মূল দরজা পেরিয়ে ভেতর দিকে যাওয়ার সময় ফুলমালাকে দেখে ফেলেছিল সুধাংশু। তখন তখনই স্থির করেছিল – চরিত্র দিলে এই মেয়েটির কাছেই দেবে। দালালকে তার ইচ্ছার কথা বলায় আধহাত জিহ্বা বের করেছিল গণশা দালাল।

বলেছিল, ‘ও কী বলছেন! যা বলেছেন, আর বলবেন না। জিভ কেটে রেখে দেবে।’

‘কেন! কী হয়েছে! বেশ্যাপাড়ায় সতীপনা কেন?’ পাশে দাঁড়ানো বন্ধু সাইদুর ধমকের সুরে বলেছিল।

‘যা বলেছেন, আর বলবেন না।’ আগে বলা কথাটি গণশা পুনরায় বলল। তারপর চাপা অথচ ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘ওই মেয়েটি এ-কাজ করে না। ও এ-বাড়ির মেয়ে। ননীবালা মাসির মেয়ে।’

‘যত টাকা লাগে আমি দেবো। আমি ওকেই চাই।’ গলা উঁচুতে তুলে বলল সুধাংশু।

গণশা দালাল মারমুখী হয়ে উঠল। কোঁচড় থেকে এখনই ছুরি বের করে সুধাংশুর পেটে বসিয়ে দেবে যেন।

হইচই শুনে ননীবালা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। উৎকর্ণ হয়ে কথা-কাটাকাটি কিছুক্ষণ শুনলেন। ঠিক এই সময় ননীবালার মাথায় একটা বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে উঠল।

গণশাকে লক্ষ করে হাত-ইশারায় সুধাংশুকে ওপরে নিয়ে আসতে বললেন।

দুজনে ওপরে এলে গণশাকে ননীবালা বললেন, ‘তুমি নিচে যাও। ছেলেটায় সঙ্গে আমি কথা বলছি।’

সুধাংশুকে নিয়ে সজ্জিত একটা ড্রইংরুমে ঢুকেছিলেন ননীবালা। ঘণ্টাখানেক পরে সুধাংশু যখন বেরিয়ে এসেছিল, খুশিতে তার চোখমুখ ভেসে যাচ্ছিল।

এই ঘটনার পনেরো দিনের মাথায় সুধাংশুর সঙ্গে ফুলমালার বিয়ে হয়ে গেল। ওই রাতে ননীবালা নিজের সম্পর্কে, ফুলমালা সম্পর্কে, অমিয় সম্পর্কে সব কথা খুলে বলেছিলেন সুধাংশুকে। বারবার জোরের গলায় বলেছিলেন, ‘ফুলমালাকে বুকে ঢুকিয়ে রেখেছি বাবা। বাইরের কোনো ধুলা তার গায়ে পড়তে দিইনি। এখন বলো, বিয়ে করবে তুমি ফুলমালাকে?’ রাজি হয়ে গিয়েছিল সুধাংশু। সুধাংশুর চোখে তখন ফুলমালা তুলনাহীন রূপময়ী।

চট্টেশ্বরী কালীবাড়িতে মালাবদল করে বিয়ে হয়েছিল দুজনের। ননীবালা সঙ্গে
দু-চার-পাঁচজন নিয়ে গেলেও সুধাংশু কাউকে সঙ্গে নেয়নি। তাতে যদি ফুলমালার আসল পরিচয় জানাজানি হয়ে যায়!

বিয়ের পর রেল কোয়ার্টারেই তুলেছিল সুধাংশু ফুলমালাকে। আশপাশের মানুষ জেনেছিল – হুট করে সুধাংশু বিয়েটা করে ফেলেছে।

তারপর অনেকটা বছর কেটে গেল।

ননীবালা অমিয়কেও বিয়ে করিয়েছিলেন। অমিয় তখন সাহেবপাড়ার বড় মাস্তান। মাতাল হয়ে প্রতিরাতে বাড়ি ফেরে। বউয়ের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। ননীবালা প্রতিবাদ করার সাহস করেন না। যদি গায়ে হাত তোলে।

স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে বউটি একদিন পালিয়ে গিয়েছিল। ননীবালা পুত্রবধূর সন্ধান করার কোনো প্রয়োজনই অনুভব করেননি। তারপর এক রাতে সাহেবপাড়ার অন্ধকার গলিতে অমিয়ের পেটে কে যেন ছুরি চালিয়ে দিয়েছিল। ভখাত করে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছিল অমিয়র। বাঁচেনি অমিয়।

এরপর দু-বছর বেঁচেছিলেন ননীবালা। তার জায়গায় মাসি হয়েছিল চামেলি আকতার।

তিন

সুধাংশু আর ফুলমালার ঘরে একটি কন্যা জন্মেছিল। তারা কন্যার নাম রেখেছিল মিনুরানি। স্কুলে যখন ভর্তি হলো, মিনুর নাম হলো – মিনুরানি দাস।

নয় ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিল মিনুরানি। এর মধ্যে বারকয়েক নানা স্টেশনে বদলি হয়েছিল সুধাংশু। রেলের চাকরিতে প্রমোশন হয় না সহজে। বেতনও যে আহামরি, তা নয়। চেষ্টা-তদবির করে, কখনো কখনো ঘুষ দিয়ে চট্টগ্রামে ফিরে এসেছে সুধাংশু। শেষবার তার পোস্টিং হলো আমবাগানের রেল-অফিসে। এই অফিসটি ব্রিটিশ আমলে ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার দলবল নিয়ে এই ক্লাবেই আক্রমণ করেছিলেন একরাতে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর এই ক্লাবটি

রেল অফিসে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অফিসে ছোট একটা টেবিলের দায়িত্ব পেয়েছিল সুধাংশু। কাজ করতে করতে বারবার মেয়েটির কথা মনে পড়ে যায়। আহা! চাকরি শেষ হওয়ার আগে যদি মিনুকে বিয়ে দিতে পারতাম। শেষ পর্যন্ত ওই অফিসেই একটা ছেলে পেয়ে গিয়েছিল সুধাংশু। নতুন জয়েন করেছে। ক্লারিকেল পোস্টে। বয়স খুব বেশি নয়। আটাশ-বত্রিশ। নাম অখিল নাথ। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল – বান্দরবানের থানচিতে বাড়ি অখিল নাথের। বাপ নেই। বিধবা মাকে নিয়ে চট্টেশ্বরী রোডের একটা সেমিপাকা ঘরে থাকে। অফিসের পিয়ন জলিলকে অখিলের পেছনে লাগিয়েছিল। জলিল খবর এনেছিল – অখিলের মা ছেলের জন্য কনে খুঁজছে।

জলিলের প্রচেষ্টায় মিনুরানির সঙ্গে অখিলের বিয়েটা হয়েছিল। বিয়ের সময় নিজের পরিচয় ফলাও করে প্রচার করলেও ফুলমালার প্রকৃত পরিচয় গোপন রেখেছিল সুধাংশু। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে চলে গিয়েছিল মিনুরানি।

তারপর সেই ঘটনাটি একদিন ঘটল। সাইদুর রহমানের সঙ্গে সুধাংশুর দেখা হয়ে গেল এক সন্ধ্যায়, রিয়াজউদ্দিন বাজারে। সাইদুর রহমান সুধাংশুর সেদিনের সাহেবপাড়া গমনের অন্যতম সঙ্গী ছিল। ফুলমালাকে নিয়ে সুধাংশুর সেই সন্ধ্যার পাগলামির আগাগোড়া সাক্ষী এই সাইদুর। মাঝখানে দুবাই চলে গিয়েছিল। সেখানে প্রথমে চাকরি, তারপর দোকান দেয়। বহু বছর পর দেশের টানে বেড়াতে এসেছে। ভাগ্যক্রমে সুধাংশুর সঙ্গে দেখাও হয়ে গেছে! হাত ধরে রাস্তার পাশে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেমন আছ সুধাংশু?’ সুধাংশুর ভেতরে কাঁপুনি তখন। আমতা আমতা করছিল।

লম্বা দাড়িতে হাত বুলিয়ে সাইদুর চোখ চিকন করে বলেছিল, ‘আরে সুধাংশু, তুমি এরকম ছটফট করছ কেন! বহু বছর পর দেখা তোমার সঙ্গে, কেমন আছ – এই কথাটা তো জিজ্ঞেস করতেই পারি তোমাকে! কী বলো তুমি, পারি না?’

সুধাংশু এবার জড়সড় কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ আছি তো। ভালো আছি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। তা তোমার বউ কেমন আছে? শুনেছি সেই মেয়েটিকে, মানে সাহেবপাড়ার সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে ঘরে তুলেছ তুমি! তা বেশ করেছ। তোমাদের মতো কেউ না কেউ এগিয়ে না গেলে ওই অন্ধকার পাড়ার মেয়েরা আলোর মুখ দেখবে কী করে! একদিন যাব আমি তোমার কোয়ার্টারে। বউদিকে কী হালে রেখেছ, একবার দেখতে ইচ্ছে করছে আমার। তোমার বাসাটা কোথায় যেন সুধাংশু?’ সাইদুরের চোখে ক্রূরতা আর কামের সঘন উপস্থিতি।

নিজের অজান্তেই সুধাংশুর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, ‘পলোগ্রাউন্ড রেল কলোনির সি-টাইপে।’

‘একদিন আসব আমি তোমার বাসায়’ বলে সাইদুর এগিয়ে গিয়েছিল। দূর থেকে সাইদুরের কণ্ঠ ভেসে এসেছিল, ‘ভালো থেকো সুধাংশু।’

সেই সন্ধ্যায় অপ্রকৃতিস্থ সুধাংশু ঘরে ফিরে ধপাস করে বাজারের ব্যাগটা মেঝেতে রেখে হাউমাউ করে উঠেছিল। ছুটে এসেছিল ফুলমালা, ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে। তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?’

আর্তনাদ থামিয়ে সুধাংশু বলেছিল, ‘আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে যে ফুলমালা! তোমাকে বুঝি আর আড়াল করে রাখতে পারলাম না রে ফুলমালা!’

স্থির ও শান্ত স্বভাবের ফুলমালা সুধাংশুর মাথায়, বুকে হাত বুলিয়ে বলল, ‘হাহাকার করো না। বাইরের জামাকাপড় ছাড়ো। চোখেমুখে পানি দাও। তোমার সব কথা শুনব আমি।’

রাতে দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, চট্টগ্রামে আর থাকবে না। চাকরির আর বেশিদিন বাকি নেই। বড় কর্তার হাতে-পায়ে ধরে দূরের কোনো স্টেশনে বদলি নিয়ে চলে যাবে। এমন স্থানে যাবে, যেখানে সাইদুররা পৌঁছাতে পারবে না।

‘মিনুর কী হবে! আমরা চলে গেলে মিনুর কী হবে?’ কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করেছিল ফুলমালা।

‘অনেকদিন ধরে স্বামীর ঘর করছে মিনু। নাতি হয়েছে তোমার। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর সংসার সামলাচ্ছে। পাকা গিন্নিবান্নি হয়ে উঠেছে তোমার মেয়ে। আমাদের ছাড়া সে দিব্যি থাকতে পারবে। আর আমরা তো একেবারে দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না। চিঠিপত্র তো লিখব আমরা!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সুধাংশু আবার বলল, ‘মাঝেমধ্যে এসে নাতিকে দেখে যাব না আমরা! মিনুকে বাঁচাবার জন্য চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই ফুলমালা।’

কিছুদিনের চেষ্টায় বদলি নিতে পেরেছিল সুধাংশু। শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে। যাওয়ার আগে মেয়ে আর জামাতার সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, ‘বদলিটা ঠেকাতে পারলাম না আর! ভালো থেকো তোমরা, সুখে থেকো।’

চোখের জলে আঁচল ভেজাতে ভেজাতে কোয়ার্টারে ফিরেছিল দুজনে।

এরপর বহু বছর কেটে গেছে। চাকরি শেষ করে সুধাংশু সস্ত্রীক নিজ জন্মভূমি বরিশালে ফিরে গিয়েছিল।

মিনুরানির আরেকটা ছেলে হয়েছিল। মিনু-অখিল ছেলেদের নাম রেখেছিল বাদল আর মাদল।

বাদল যে-বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে, সে-বছরেই মারা গেল অখিল। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় আনমনে রেললাইন পার হচ্ছিল। ঢাকাগামী সোনার বাংলা কখন নিকটে পৌঁছে গেছে, খেয়াল করেনি।

মিনু রেল কর্তৃপক্ষ থেকে কিছু টাকা পেয়েছিল ঠিক, কিন্তু কোয়ার্টারে বেশিদিন থাকতে দেয়নি। ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় একটি ঘর ভাড়া করে রেলকলোনি ছেড়েছিল মিনুরানি। বছর দুয়েকের বেশি থাকতে পারেনি মিনুরা, সেখানে, সেই ফিরিঙ্গিবাজারে।

সুনামের ওজন বেশি, বাতাসে ভাসে না। দুর্নাম বড় হালকা, বাতাসে ভেসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একদিন কে বা কারা প্রচার করল, শ্রীপ্রকাশ বাবুর ভাড়াটে মিনু আর কেউ নয়, সাহেবপাড়ার এককালের বেশ্যা ননীবালার মেয়ের ঘরের নাতনি। একটা গণিকার নাতনির সঙ্গে আমরা থাকব! প্রথমে বিদ্রোহ করল ওই বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়ারা। তারপর আশপাশের বাড়ির মানুষ প্রতিবাদ করতে থাকল।

শ্রীপ্রকাশবাবু তিনদিনের সময় দিলেন মিনুরানিকে।

মুখমাথা আঁচলে ঢেকে পুত্রদের নিয়ে ফিরিঙ্গিবাজার এলাকা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মিনুরানি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে সরে গিয়েছিল। পাঁচলাইশের গফুর বিল্ডিংয়ে ভাড়া নিয়েছিল। এসএসসি পাশ করে বাদল একটা ফিশিং কোম্পানির অফিসে খাতা লেখার চাকরি করছে।  বাদল আধেক পথে থেমে গিয়েছে। সংসার কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে যখন মিনুর, ওই বদ-হাওয়াটা গফুর বিল্ডিং পর্যন্ত পৌঁছে গেল। রে রে করে উঠল গফুর সাহেব। লোক দিয়ে আসবাবপত্র রাস্তায় ছুড়ে ফেলাল। এবার আগ্রাবাদ পেয়ারা খাতুন গলিতে ঘর ভাড়া নিল মিনুরানি। এখানে বছর চারেক থাকতে পেরেছিল। এই পেয়ারা খাতুন গলিতেই বাদলকে বিয়ে করিয়েছিল।

এরপর একদিন বুয়া বলল, ‘মাসি, আপনাকে নিয়ে বাইরে কী কী যেন কানাঘুসা হইচ্ছে! কথাগুলো সইত্যে নাকি?’

মিনুরানির বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠেছিল। কী কথা জিজ্ঞেস করার সাহস করেনি মিনু। কী কথা হচ্ছে, সে তো জানে! কথাগুলো যদি বউয়ের কানে যায়, গলায় দড়ি দিতে হবে তাকে!

সেদিন বুয়াকে আর কথা বলার সুযোগ দেয়নি মিনু। এক সপ্তাহের মধ্যে বাসা পালটেছিল।

চার

এরপর পরবর্তী গত বছর ধরে একের পর এক বাসা পালটে গেছে মিনুরানি। কোথাও থিতু হয়ে জীবনযাপন করতে পারেনি। সেই বদনাম, ননীবালার নাতনি হওয়ার বদনামটা, ফুলমালার কন্যা হওয়ার কলঙ্কটা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। পালাতে পালাতে একটা সময়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মিনুরানি। ছোট শহর চট্টগ্রাম। শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে থাকার কোনো স্থান আর খুঁজে পাচ্ছিল না মিনুরানি। বাদলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে – এই শহরে আর নয়। শহর ছেড়ে দূরের মফস্বলে চলে যাবে। সেখানে হয়তো বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে মিনুরানিরা।

ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে শহর থেকে অনেক দূরের মফস্বল মধ্যমগ্রামে বাসা খুঁজতে চলে আসা মিনুরানির। ‘নিরিবিলি’তে বাসা পেয়েও গেছে। আগামী এক তারিখ নিরিবিলিতে উঠবে মিনু-পরিবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবে তো নিরিবিলিতে? মিনুরানিরা?