মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য দলিল

মজিবর রহমান

অন্তর্দাহ l মঞ্জু সরকার l বেঙ্গল পাবলিকেশন্স l ঢাকা, ২০১৩ l ৬৫০ টাকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নানামুখী ও বিচিত্র ঘটনায় পরিপূর্ণ। এসব ঘটনা নিয়ে নিরন্তর লেখালেখি ও গবেষণা হচ্ছে। স্বাধীনতার সংগ্রাম কেবল নয় মাসের যুদ্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক পটভূমি। আর এর নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগপ্রধান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; তাঁর হাতেই ছিল জাদুর কাঠি। কিন্তু ইতিহাসের পথ সরলরৈখিক নয়, আছে পথে-পথে ঘূর্ণন। আছে নানা মত, নানা পথ ও রাজনৈতিক বিভেদ। ব্যক্তিস্বার্থ আছে। আদর্শের পাশাপাশি আছে স্খলন। মঞ্জু সরকার তাঁর আশ্চর্য পর্যবেক্ষণক্ষমতা ও নিবিড় অনুশীলন দ্বারা উন্মোচন করেছেন সেই নিগূঢ় বাস্তবতা। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অন্তর্দাহ  হয়ে উঠেছে কালের সাক্ষী।

উনিশশো একাত্তর। বছরে শুরু থেকেই টানটান উত্তেজনা; মার্চে সেই উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। ছাত্রসমাজ তখন রাস্তায়। দফায় দফায় মিছিল-স্লোগান, আর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে নেতার কথা শোনা – এই-ই হয়ে ওঠে ঢাকায় ছাত্রসমাজের নিত্যদিনের করণীয়। উপন্যাসের প্রধান এক চরিত্র মানিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাজনীতি বিষয়ে কিছুটা নিস্পৃহ থাকলেও পরিপার্শ্বের প্রভাব এড়াতে পারে না, হলের বন্ধু আরিফের সঙ্গে ৩২ নম্বরে যায়, ঢাকায় মামার বাসায় গিয়ে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনায় শরিক হয়। মামার শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্ত্রী জাতিগতভাবে বিহারি হওয়ায় কিছুটা বিরূপ আচরণ লক্ষ করে তাদের দিক থেকে, তবে মামাকে পক্ষে পায়, যদিও মামার পিতা বা মানিকের ‘নানাজি’ গ্রামে মুসলিম লীগ সমর্থক চেয়ারম্যন, ভাবাদর্শগত কারণে আন্দোলনবিরোধী। নানাজি খবর পাঠান গোলযোগের সময়টা গ্রামে এসে থাকার জন্য। মানিক ঢাকায় আন্দোলনে তেমন সম্পৃক্ত হতে পারছিল না, সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে গিয়ে সংযুক্ত হওয়ার। তার এ সিদ্ধান্ত ফিউডাল আচরণের প্রকাশ বলে খোঁচা দেয় সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ রুমমেট আরিফ। 

মানিকের গ্রামের নাম রতনপুর। বাবা সজব ভূঁইয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা। একই ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা তার নানাজি কাজী আফতাব এলাকায় কাজী চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচিত। সজব ভূঁইয়া ও কাজী চেয়ারম্যান আত্মীয়তাসূত্রে জামাই-শ্বশুর হলেও দুয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘকালের। এই দ্বন্দ্ব যতটা না নীতি-আদর্শগত, তার চেয়ে বেশি স্বার্থের। চেয়ারম্যান পদ নিয়ে দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক দিনের। সজব ভূঁইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কখনো জেতেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে ভূঁইয়া এবার ক্ষমতা ও সম্পদের নতুন স্বপ্নে বিভোর হন।

গ্রামে ফিরে মানিক খবরাখবরের জন্যে পড়ে থাকে রেডিও নিয়ে। ৭ই মার্চের ভাষণ পরদিন প্রত্যুষে প্রচার শুরু হলে মনোযোগ দিয়ে শোনে বাবা সজব ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগ কর্মী পরেশ, সমর্থক নজিবরসহ অন্যদের নিয়ে। মানিক ধীরে ধীরে স্বাধীনতাকামী এক সচেতন রাজনৈতিককর্মী হয়ে ওঠে। স্বাধীনতাবিরোধী নানার সঙ্গ ত্যাগ করে। সংশ্লিষ্টতা বাড়ায় গ্রামের যুবসমাজসহ অন্যদের সঙ্গে। ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর খবর পেয়ে নিজেও দলবল নিয়ে পার্শ্ববর্তী ঠ্যাংভাঙ্গা হাটে পতাকা ওড়ায় নানা কাজী চেয়ারম্যানের রোষ উপেক্ষা করেই।

কাজী চেয়ারম্যানের সঙ্গ ত্যাগ বিষয়ে ভিন্নমত আছে আওয়ামী লীগ কর্মী পরেশের মায়ের। মানিকের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি বলেন, ‘তোর দাদা মারা যাওয়ার পর কি চেয়ারম্যান ছুটিয়ে আইসে নাই? আসছিল, ক্যানে আসছিল? পাকিস্তান হওয়ার পর বড় বড় হিন্দুরা দেশান্তরী হইল, তোর দাদাও একবার প্লান করছিল ইন্ডিয়া যাওয়ার। কিন্তু কাজী চেয়ারম্যান আর তোর বাপ-দাদারাই আমাদের আপনজনদের মতো বুকত আগলে থুইছে। আর তোর নানার কথা কইস, অমন ভালো মানুষ মুসলমান আর কয়জন আছে রে? একবার ভোটের সময় ঠেকায় পড়ি তোর দাদার কাছে পাঁচ হাজার টাকা নিছিল, তোর দাদা সেই টাকা ফেরত নিতে চায় নাই। কিন্তু তারিখ মতো বাড়িতে আসিয়া সেই টাকা কড়ায়গণ্ডায় শোধ দিয়া গেইছে।’  সত্য অস্বীকার করার মতো নয়, মঞ্জু সরকার তা করেনওনি।

মানিক গ্রামের অভিজাত পরিবারের সন্তান, সাধারণ্যে তার মেলামেশার কথা নয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম এ-দূরত্ব ভাঙে, নৈকট্য বাড়ায় সাধারণ ও অসাধারণে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ, এমনকি তাদের ১৫ বছর বয়েসি চাকর বাংটু বক্করও তার আপনজন হয়ে উঠেছিল। স্বদেশ হয়ে উঠেছিল সকলের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। মঞ্জু সরকারের চোখে এ-বাস্তবতা ধরা পড়ে। আবার বিচ্যুতিও তাঁর চোখ এড়ায় না। সেটি ঘটে স্বয়ং মানিকের বাবা সজব ভূঁইয়ার বেলায়।

২৫ মার্চ গণহত্যার পর পরিস্থিতি রুদ্ররূপ ধারণ করলে শহরের মানুষ জীবন রক্ষার তাগিদে গ্রামে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। আওয়ামী লীগের জেলা শাখার সভাপতি ও এমএনএ মশিয়ার উকিল মানিকদের বাড়িতে আশ্রয় নেন পরিবারসমেত। মানিকের বাবা খাতির-যত্ন করেন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি, হয়তো মশিয়ারের মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা আঁচ করেই। অবশ্য শহরের মানুষ যারা গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদেরকে সমাদরে আশ্রয় দেওয়ার প্রবণতা গোটা দেশেই ছিল। গ্রামের মানুষ কেবল বিপদগ্রস্ত শহুরে মানুষদেরই আশ্রয় দেয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদেরও আশ্রয় ও খাবার জুগিয়েছে বিপদের আশংকা মাথায় নিয়ে। নিজের পাতের খাবার তুলে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার পাতে, পথঘাট চিনিয়েছে, খবরাখবর দিয়েছে। বস্তুত যুদ্ধাবস্থায় গ্রাম ও গ্রামের মানুষ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভরতার উৎস। প্রতিরোধের প্রথম পর্বে ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধের প্রচেষ্টা নেয় গ্রামেরই সাধারণ মানুষ, আর যুবসমাজ থাকে অগ্রণী ভূমিকায়। বক্ষ্যমাণ উপন্যাসে তার প্রতিফলন দেখা যায়। ইউনিয়নের লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে অদূরবর্তী কুণ্ডার ব্রিজ ভেঙে দেয়, যাতে হানাদাররা সহজে প্রবেশ করতে না পারে এ-অঞ্চলে। যুদ্ধযাত্রায়ও গ্রামের মানুষ, বিশেষত যুবারা ছিল আগোয়ান। এটিই প্রকৃত বাস্তবতা। মঞ্জু সরকারের অন্তর্দাহ সে-বাস্তবতাকে ধারণ করেছে।

মশিয়ার উকিল তাঁর পরিবারের সদস্যদের সজব ভূঁইয়ার বাড়িতে রেখে কিছুদিনের মধ্যে ভারত যান, এবং যুদ্ধ সংগঠনের কাজে সংশ্লিষ্ট হন। মানিক দ্বিধায় ভোগে; ভারত যাবে – নাকি এলাকায় অবস্থান করে প্রতিবেশী যুবকদের সংগঠিত করে স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে! মানিকের দোদুল্যমানতার ফাঁদে পা দেয়নি বাংটু বক্কররা, কয়েকজন মিলে রাতের আঁধারে পাড়ি জমায় ভারতে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। দলের মধ্যে বাংটুই সবার থেকে ছোট, কিশোর বয়েসি। নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা বিত্তহীনের সন্তান এরা, শিক্ষার আলোবঞ্চিত বেশিরভাগ। সেদিনের বাস্তবতা ছিল অনেকটা এরকমই।

উপন্যাসটিতে বাংটু বক্করের চরিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ, সে-কারণে তার কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। বিত্তহীন, একান্তভাবে নিঃস্ব এক পরিবারের সন্তান এই বাংটু। বাবা সেরাজ ছিল সজব ভূঁইয়ার বাড়ির চাকর। ভূঁইয়ার স্ত্রী অর্থাৎ মানিকের সৎমার হাতে ঝাড়ুর বাড়ি খেয়ে স্ত্রী আছিমন এবং বাংটুসহ দুই পুত্র ও দুই কন্যা রেখে দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ। কোথায় গেছে, কেমন আছে, বেঁচে আছে  কি নেই; কেউ তার হদিস জানে না। চুলায় হাঁড়ি চাপানোর উপায় নেই, তার ওপর আছে বাবার পাওনা পরিশোধের তাগিদ – উপায়হীন বাংটু বাবার বদলি হিসেবে ভূঁইয়াবাড়ির চাকর হয়। সেই বাংটু রাতের আঁধারে চাল কিনে দেওয়ার কথা বলে ছোটভাই মাদুকে নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়, জানায় যে, তারা যাচ্ছে ভারতে মুক্তিফৌজ হয়ে যুদ্ধ করতে। নির্দেশ দেয় খবরটি সজব ভূঁইয়াকে জানাতে। মাদু ভবিষ্যতের কথা ভেবে কান্না শুরু করলে মানিকের বোন বিউটির কাছ থেকে নেওয়া দুটি টাকা থেকে একটি টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে তাকে বলে, ‘ইয়াকে দিয়া মাকে কাইল এক সের চাউল কিনি দিস। জগন্নাথে বেশি করি মাছটাছ মারিয়া মাকে দেখিস। মুই দেশ স্বাধীন করি ফিরি আসলে হামার আর কোনো অভাব থাকপে না।’ – এই প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তির খবর জানা যাবে পরে।

বাংটুর মা আছিমন ও ছোটভাই মাদু পরদিন সজব ভূঁইয়াকে খবরটা দিলে তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেন, ‘কীসের মুক্তিবাহিনীতে গেইছে বাংটু! এ বাড়ির কারো টাকা পইসা সোনার জিনিসপত্র চুরি করিয়া পালাইছে কি না, ভালো করি খোঁজ করো।’ যাদের সঙ্গে গেছে তাদের সজব ভূঁইয়া বখাটে বলে আখ্যায়িত করেন। এতদিন পিতার বদলি খাটছিল বাংটু, এবার ভাইয়ের বদলি খাটা শুরু করে মাদু ভূঁইয়াবাড়িতে, সেখানকার চাকর হয়। পেটপুরে ভাত খাওয়ার বাসনা তাকে উদ্দীপ্ত রাখে। সজব ভূঁইয়ার কাছ থেকে বিরূপ আচরণ পেলেও আছিমন ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করে, বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়ায় তার ছেলের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কথা। এই বলাবলিই কাল হয়, ধরা পড়ে সে রাজাকারদের হাতে। মানিক নানাজি কাজী চেয়ারম্যানের পরিচয় দিয়ে ছাড়িয়ে আনে আছিমনকে ক্যাম্প থেকে।

এদিকে মশিয়ার উকিল তাঁর পরিবারের সদস্যদের ভারতে নিয়ে যান। মানিকও একসময় পরেশ ও তাঁর বউ-বাচ্চাদের সঙ্গে ভারতের পথ ধরে। নিরাপত্তার কথা ভেবে সজব ভূঁইয়া সন্তানের এ-সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকেন। যাত্রার বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করে পরেশ। আরো কয়েকটি পরিবার নিয়ে তারা নৌকায় ওঠে রাতের আঁধারে। পথে নদীতে টহলরত রাজাকার-মিলিটারি কর্তৃক আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় নৌকার মাঝি ও পরেশসহ কয়েকজন। মানিক, পরেশের স্ত্রী মালতী ও তাদের শিশুসন্তান শিবু বেঁচে যায়। তিনজন রাতের মতো আশ্রয় নেয় এক মুসলমান বাড়িতে। একজন বৃদ্ধ ছাড়া বাড়িটির অন্যরা পালিয়ে গিয়েছিল। নিজের ও আশ্রিতদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বৃদ্ধ ভোরের আলো ফুটতেই তাদের বাড়ি ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে পথ দেখিয়ে দেন ভারতের। এরপর অপারেশনফেরত একদল মুক্তিযোদ্ধার সহায়তায় তারা পৌঁছে যায় সীমান্তসংলগ্ন এক মুক্তাঞ্চলে। সেখানে এক হিন্দু পরিবারে আহারও জোটে।

মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দলের কনিষ্ঠতম সদস্য জিয়াদ, ১৫-১৬ বছরের কিশোর। অপারেশনে গিয়ে খানসেনাদের হাতে ধরা পড়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়ে। প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আবেগঘন কণ্ঠে বলে – জয় বাংলা। পরে প্রচণ্ড পিটুনি শুরু হলে আকাশফাটা চিৎকারে সে কেবল জয় বাংলাই বলছিল। বিস্ময়াভিভূত সেনা কর্মকর্তা অতঃপর জিয়াদকে বেঁধে রাখার হুকুম দেয়, খেতেও দেয়নি কিছু। মাঝরাতে মিলিটারিটি সামনে এসে দাঁড়ালে জিয়াদ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়। ‘কিন্তু খানসেনাটি টর্চের আলো ফেলে কী যেন খুঁজেছে তার মুখে। গুলি করার বদলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে। তারপর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছে। ঘাড়ে আদুরে চাপড় দিয়ে ক্যাম্পের গেটের বাইরে অন্ধকারে ছেড়ে দিয়ে বলেছে – ‘যাও বেটা জয় বাংলা, জলদি ভাগ যা হিয়াসে।’ – পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই সদস্যটি কি জিয়াদের মুখে নিজের সন্তানের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেল, অথবা  পরাভূত হলো কি তার মন কিশোরের দুরন্ত সাহসের কাছে? – হতে পারে এর যে-কোনোটি অথবা অন্য কিছু। মানুষের মন কত না বিচিত্র! স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল অঙ্গীকার ও প্রতিরোধের মহার্ঘ্য, শক্তির উৎস।

শরণার্থী শিবিরের করুণ অবস্থা দেখে মালতী বেঁকে বসে, কোলের সন্তান ও মানিককে নিয়ে গিয়ে ওঠে কোচবিহারে নিজের মামার বাসায়। মালতী ও তার সন্তানকে ওখানে রেখে মানিক যুদ্ধে যোগ দিতে চায়, মালতীর কারণে পারে না। স্বামীহারা মালতী নিজের মামা-মামির চেয়েও মানিককে আপন ভাবে বেশি, মানিকও যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ধীরে ধীরে এই সম্পর্ক নিবিড় হওয়া শুরু করে। কোচবিহারে মানিকের পর্যবেক্ষণ তেমন সুবিধার নয়। মালতী মানিককে তার মামার বাসায় রাখে হিন্দু পরিচয়ে, মামা মুসলমানবিদ্বেষী বলে। বাংলাদেশের মানুষের ভারতে এসে আশ্রয় নেওয়াকে মামা সুনজরে দেখছিলেন না। তাছাড়া তার লোভাতুর স্বভাব মালতীর কাছে ছিল অপ্রীতিকর। এ-কারণে মালতী মানিককে নিয়ে অন্য কোথাও বসবাসের কথা ভাবে। কলেজের সহপাঠী পঙ্কজের সঙ্গে মানিকের দেখা হয়ে যায় অকস্মাৎ, জানতে পারে যুদ্ধে না গিয়ে ঘুরেফিরে সময় কাটাচ্ছে সে। তবে আশ্রয় দেওয়া আত্মীয়স্বজন যে তাকে বোঝা ভাবছে সে-কথাও জানায় অবলীলায়। দেশ স্বাধীন না হলে মুসলমান হিসেবে মানিকরা ঠিকই দেশে ফিরে যাবে, আর পঙ্কজদের থাকতে হবে ভারতে রিফিউজি হয়ে – পঙ্কজের এমন মন্তব্য ভালো লাগেনি মানিকের। সহানুভূতির পাশাপাশি বিরূপতাও ছিল ভারতীয় জনগোষ্ঠীর একাংশের ভেতর – সেটি সেদিনের বাস্তবতা, যা মঞ্জু সরকারের চোখ এড়ায় না।  

এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মশিয়ার উকিল কোচবিহারে সাময়িক অবস্থান করছিলেন। খবর পেয়ে মানিক তাঁর সঙ্গে হোটেলে দেখা করতে যায়। সেখানে তিনি মানিকের ও পরিবারের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন, বাবা সজব ভূঁইয়াকে আরো কিছুদিন সাবধানে থাকতে বলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাঁর পরিবারকে দুঃসময়ে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। যুদ্ধে যোগদানের জন্যে মানিক ইয়ুথ ক্যাম্পে ভর্তি হওয়ার সার্টিফিকেট চাইলে তা দেন বটে, কিন্তু যেসব কথাবার্তা বলেন তাতে মানিক হতাশ বোধ করে। এমএনএ সাহেবের মতে, অতিরিক্ত মুক্তিযোদ্ধার আর প্রয়োজন হবে না। ভারতীয় সেনাবাহিনী শিগগিরই যুদ্ধে যোগ দেবে, তাতে জয় বিলম্বিত হবে না। ভারতীয় সেনা দেশের ভেতর ঢুকে পড়লে সেটা দেশের জন্যে মঙ্গলজনক হবে কি না ভেবে মানিক শঙ্কা বোধ করে।

মশিয়ার উকিল অসত্য বলেননি। ভারত-বাংলাদেশ উভয়পক্ষ মিলে পরিকল্পনা করেছিল চূড়ান্ত অভিযান পরিচালিত হবে যৌথভাবে, যাতে খুব দ্রুত ঢাকা দখলে আনা যায়। একটা ভয় তাড়িত করছিল দুই সরকারের নীতিনির্ধারকদের যে, যুদ্ধ বিলম্বিত হলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, তাতে দেশের মানুষের মনোবল ভেঙে গিয়ে সহানুভূতি কিংবা সমর্থন হ্রাস পাবে। সেক্ষেত্রে অনিশ্চিত হয়ে যাবে বিজয়। অতএব তড়িঘড়ি বিজয়ের চিন্তা মাথায় রাখে বাংলাদেশ-ভারতের নেতৃত্ব। তাছাড়া প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর বোঝা দীর্ঘ সময় বহন ভারতের জন্যও অসহনীয় ছিল।

রাজনীতির প্রতি মানিকের যেটুকু মোহ তা তৈরি হয়েছিল হলের রুমমেট আরিফের সৌজন্যে। আরিফ বামধারার রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট। মানিকের ওপরও তার প্রভাব পড়েছিল হয়তোবা কিছুটা। বামদের একটা অংশ ভারতের সহায়তা ছাড়া যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখত। অস্ত্র ও ট্রেনিংয়ের জন্যে ভারতে না গিয়ে স্থানীয়ভাবে তার ব্যবস্থার কথা ভাবত। প্রথমাবস্থায় মানিক নিজেও এরকম দৃষ্টিভঙ্গি লালন করত, কিন্তু বাস্তবতার খাতিরে পরে ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভব হচ্ছিল না নিহত পরেশের স্ত্রী মালতীর বাধার কারণে। অবশেষে রিপুর প্রতারণায় কাকতালীয়ভাবে তা সম্ভব হয়, মালতীর সঙ্গে দৈহিক মিলনের লজ্জা তাকে ঘরছাড়া করে। শহরের সীমানার বাইরে সীমান্তলাগোয়া এক যুবশিবিরে এসে ভর্তি হয় সে। যুবশিবিরটি আসলে বাংলাদেশ থেকে আসা যুবকদের অভ্যর্থনা কেন্দ্র, সেখান থেকে বেছে অন্যত্র পাঠানো হতো ট্রেনিংয়ের জন্যে। কিন্তু ট্রেনিং কিংবা যুদ্ধ কোনোটিই তাকে করতে হয়নি, ভারত- বাংলাদেশ সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণে দেশ স্বাধীন হয়ে যায় দ্রুত। এবার দেশে ফেরার পালা।

মানিক সিদ্ধান্ত নেয় প্রথম কলকাতা যাবে, এরপর বেনাপোল হয়ে ঢাকা, সেখান থেকে নিজের গ্রাম রতনপুরে। কলকাতা যাওয়ার উদ্দেশ্য এমএনএ মশিয়ার উকিলের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে যাতায়াতের কটা টাকা নিয়ে বেনাপোলমুখো হওয়া। কিন্তু পরিস্থিতি সেরকম ছিল না। পরিবারের সদস্যরা তখন মার্কেটিং সেরে দিল্লি হয়ে বিমানে দেশে ফেরার লক্ষ্যে ব্যস্ত। সেখানে সৌহার্দ্যরে আচরণ জুটলেও এক কাপ চাও মেলেনি। টাকা চাওয়ার অবকাশ তো ছিলই না। অগত্যা শূন্য পকেটে পা বাড়ায় দেশের উদ্দেশ্যে। সীমান্ত অতিক্রম করে ঘনায়মান সন্ধ্যায় অচেনা এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নেয়, সেখানে একবেলা খাওয়া জোটে। বাড়িটি ছিল এক রাজাকারের। রাতে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় বৃদ্ধার পুত্র রাজাকার আইনুল এবং তার বাবার খোঁজে আসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের না পেয়ে মানিককে আস্তানায় ধরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। আরো দুজনের হাত-পা বাঁধা ছিল সেখানে। সকালে কমান্ডারসহ এক সাইকেল আরোহী এসে তাকে এবং বেঁধে রাখা অপর দুজনের একজনকে উদ্ধার করেন। দালাল সন্দেহে তাদের ধরে এনে বীরত্ব জাহির করায় স্থানীয় এই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করেন সাইকেল আরোহী। এই সাইকেল আরোহী সে-অঞ্চলে মাস্টারদা বলে পরিচিত, বাম আদর্শে বিশ্বাসী। তারই বদান্যে মানিক যশোর-খুলনা হয়ে ঢাকাগামী লঞ্চে ওঠে তাজুল ও প্রবালকে সঙ্গে নিয়ে। এরা দুজন মাস্টারদার শিষ্য, সঙ্গে দেওয়া হয়েছে মানিকের নিরাপত্তার জন্যে।

লঞ্চে মানিক আরেক লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে একদল লোক অবাঙালি লঞ্চযাত্রীদের ওপর চড়াও হয়ে হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাটে মেতে ওঠে। এই প্রথম মানিকের মনে হয়, ‘জাতীয়তাবাদী আবেগ ও ঘৃণার নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক মানবিক বিবেচনাও।’ তবে রুখে দাঁড়ায় সঙ্গী তাজুল ও প্রবাল, বেডিং ও চাদরের নিচে লুকানো অস্ত্র হাতে। তাদের দমন করার পর যাত্রীদের অভয়বাণী শোনায় প্রবাল, ‘আপনাদের কোনো ভয় নাই ভাইসব। মুজিববাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধার নামে কয়েকজন সন্ত্রাসী ডাকাত লঞ্চে এতক্ষণ লুটপাট চালাচ্ছিল। কিছু নিরীহ অবাঙালিকে ওরা খতম করেছে। বেঁচে থাকলে ওরা এ দেশে আরো লুটপাট করত। আমরা প্রতিশোধ নিয়েছি, খতম করেছি শত্রুদের। সর্বহারাদের রাজত্ব কায়েম না হওয়া পর্যন্ত, সর্বহারাদের ওপর শোষণ-নির্যাতন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবেই।’ মানিককে আশ্বস্ত করে সহযোগী দুজন বরিশালে নেমে যায়। এরপর বরিশাল থেকে লঞ্চটি নির্বিঘ্নে ঢাকা পৌঁছে। মানিক শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দেখে গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হয় বড় দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার নিয়ে।

গ্রামে ফিরে দেখে বাংটুসহ মুক্তিযোদ্ধারা আগেই ফিরে এসেছে এবং দালাল-রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালাচ্ছে। বিপুল জনউল্লাসের মধ্যে তারা এলাকার কুখ্যাত রাজাকার খোরশেদকে হত্যা করেছে। পিতা সজব ভূঁইয়ার নির্দেশে মানিকের নানাজি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান কাজী আফতাবকে ধরে এনে মানিকদের বাড়িতেই রেখেছে। ভূঁইয়ার কথামতো তাকে পাহারা দিয়ে রাখছে বাংটুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। মানিক ফিরে এসে ঘরে নানার উপস্থিতি দেখে অবাক হয়ে যায়। পরে জানতে পারে সজব ভূঁইয়ার আসল মতলব। মানিককে ডেকে নিয়ে নানার সব বিষয়-সম্পত্তি তার নামে লিখিয়ে নিতে বলে বাবা। মানিক রাজি না হয়ে উলটোটি করে, নানাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মানিকের নির্দেশ পেয়ে বাংটু কাজী চেয়ারম্যানকে সাইকেলে বসিয়ে রাতের আঁধারে পৌঁছে দিয়ে আসে রেলস্টেশনে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে। বাংটু আসলে মনেপ্রাণে মানিককেই কমান্ডার মানে, তার কথার অবাধ্য হয় না।

ততদিনে মালতীও ফিরে এসেছে গ্রামে। নিহত পরেশের ছোটভাই নরেশ তাকে কোচবিহার থেকে নিয়ে এসেছে। দেখা হলে মানিক নিশ্চিত হয় যে, কোচবিহারে মালতীর মামার বাসায় সংঘটিত রিপুতাড়িত ঘটনাটিকে মালতী সহজভাবে নিয়েছে, তার মতো মালতীরও মোহ আছে মানিকের প্রতি। নরেশদের দোকান-ঘরবাড়ি মালামাল ও আসবাবশূন্য, যুদ্ধের দিনগুলোতে লুট হয়ে গেছে সবই। তবে প্রশ্নের উদ্রেক করে দোকানে থাকা খালেক খলিফার সেলাই মেশিনটি অটুট থাকায়।

মানিক সিদ্ধান্ত নেয় সে ঢাকায় ফিরে যাবে না, গ্রামে থেকেই মানুষের সেবা করবে। প্রতিষ্ঠা করবে জাগরণী যুবসংঘ নামের প্রতিষ্ঠান, যেখানে ধর্ম-বর্ণের বিভেদ থাকবে না, বাঙালি পরিচয় থাকবে শীর্ষে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, বিজয়মুকুট পরবে মানবতা। স্বপ্ন দেখে কৃষকের কল্যাণে কৃষক সমিতি, নারীর কল্যাণে নারী প্রগতি সমিতি, সাধারণ স্কুল, বয়স্কদের জন্যে নৈশশিক্ষা কেন্দ্র, পাঠাগার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার। সেজন্যে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও যুবকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়। নানা কাজী চেয়ারম্যানের বাড়িকে ব্যবহার করে বৈঠকাদির কাজে।

বাবা সজব ভূঁইয়া এখন ক্ষমতাধর, থানা রিলিফ কমিটির সমন্বয়ক ও ইউনিয়ন রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলা তখন শূন্যভাণ্ডার, রিলিফের জন্যে হাহাকার চতুর্দিকে। এ অবস্থায় রিলিফ নিয়ে নয়ছয়ের ঘটনা কানে আসায় বাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় মানিকের। বাবাও পুত্রের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট নন। রিলিফ বিতরণ নিয়ে বাবার সমালোচনা, পড়াশোনা বাদ দিয়ে ‘কমিউনিস্টে’র মতো আচরণ, জাতপাত বিচার না করে ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে মেলামেশা ও তাদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা, মালতীর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা ইত্যাদি মানিকের প্রতি সজব ভূঁইয়ার অসন্তুষ্টি বাড়িয়ে তোলে।

সজব ভূঁইয়ার অসন্তোষের শিকার ছিল বাংটুও। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে বাংটু আর ভূঁইয়াবাড়ির চাকর থাকেনি; বাড়ি ও কাজী চেয়ারম্যানের পাহারায় নিযুক্ত থাকে, কখনোবা রিলিফ বিতরণের কাজে সহায়তা করে ভূঁইয়াকে। বিনিময়ে আহারাদি সারে এ-বাড়িতেই। সজব ভূঁইয়া এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না, সন্তুষ্ট থাকেননি তার স্ত্রীও। তিনি বাংটু-বিষয়ে স্বামীকে প্ররোচিত করেন বানোয়াট নানান অভিযোগ তুলে। পাহারারত অবস্থায় কাজী চেয়ারম্যানের পালিয়ে যাওয়া সজব ভূঁইয়াকে আরো বেশি ক্ষুব্ধ করে। কী করবে ভেবে পায় না বাংটুও! এর মধ্যে খবর চাউর হয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের। অস্ত্র জমা দিয়ে সেই বাহিনীতে নাম লেখানো যাবে খবর পেয়ে বাংটু ও তার মা ভীষণ উল্লসিত হয়। সজব ভূঁইয়াও অস্ত্র জমা দিতে বলেন। বাংটু অস্ত্র জমা দেয়, কিন্তু বাহিনী গঠনের খবর সঠিক নয় জেনে ফিরে আসে বিমর্ষ হয়ে।

কাজী চেয়ারম্যানকে মানিকের কথামতো পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার ঘটনাটি মানিক ছাড়া জানত আর একজন, সে হলো মানিকের ছোট বোন বিউটি। কসম কাটিয়ে বিউটিকে খবরটি দিয়েছিল বাংটু। সজব ভূঁইয়া মেয়ের কাছ থেকে ঘটনা জানতে পারেন। সে-অভিযোগে, এবং বিউটির সঙ্গে বাংটুর সম্পর্ক গড়ার অহেতুক প্রচেষ্টার কথা তুলে সালিশ ডেকে বাংটুকে বাড়ি থেকে তাড়ান ভূঁইয়া। প্রচণ্ড মনোকষ্ট নিয়ে বাংটু মানিকের কাছে যায়, মানিক তখন হরিপুরে নানার বাড়িতে হান্নান মুক্তিসহ কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠক করছিল জাগরণী সংঘ বিষয়ে। কিছুটা লেখাপড়া জানা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এই হান্নানই প্রকৃতপক্ষে প্রণয়-প্রত্যাশী ছিল বিউটির, যেকথা জানে বাংটু। অথচ দায় চাপল কি না বাংটুর ওপর! ক্ষোভে-দুঃখে মানিকের কাছে এর প্রতিকার চেয়ে উলটো আঘাতপ্রাপ্ত হলে সে-ও আঘাত করে হান্নানকে। সেখানেও অপরাধী হয় বাংটু, তাকে বের করে দেওয়া হয় ঘর থেকে।

মুক্তিযোদ্ধা বাংটু বক্কর ফিরে আসে ডেরায়, অহেতুক রাগারাগি আর এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা ছাড়া কিছুই করার থাকে না তার। এর মধ্যে সে একটি সাহসী কাজ করে। প্রতিবেশী ঢোঁড়া তার স্ত্রীকে রাগের মাথায় তিন তালাক বলে পুত্রসমেত গৃহত্যাগে বাধ্য করেছিল, বাংটু তাদের দুজনকে ফিরিয়ে এনে দেয়। স্বাধীনতাই তাকে সাহস জোগায়। সে-রাতেই বাংটুকে মানিকের কথা বলে ডেকে নিয়ে যায় আরেক মুক্তিযোদ্ধা আম্বার। বাংটু আর ফিরে আসেনি, ফিরে আসে তার লাশ। মা আছিমনের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মানিকের সৎমার ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে স্বামী, এবার গেছে মুক্তিযোদ্ধা পুত্রের প্রাণ। নিজের এবং অবশিষ্ট এক পুত্র ও দুই কন্যার ক্ষুধা মেটাবে কীভাবে এরপর?

লাশ দাফনশেষে বাড়ি ফিরে মানিক বিউটির কাছ থেকে সত্য জানতে পারে। বাংটু নিরপরাধ। বিউটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছিল হান্নান, বাংটু বক্কর নয়। নিরর্থক তর্কবিতর্ক হয় বাবা সজব ভূঁইয়ার সঙ্গেও। নানা কাজী চেয়ারম্যানের বাড়ির দরজাও তার জন্যে বন্ধ, মামা নিষেধ করে গেছেন বলে। মালতীর কাছে যায় মানিক – প্রস্তাব দেয় শিবুকে নিয়ে তার সঙ্গে ঢাকা যাবার, একসঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে চায় সে। প্রত্যুত্তরে মালতী বলে, ‘একবার দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে তোমার কাকাকে হারিয়েছি। আবার তোমার সঙ্গে পালাতে গিয়ে বাপের ভিটার উপর শিবুর অধিকার আমি হারাতে চাই না। একজনের জন্য কাঁদছি, বাকি জীবনটা না হয় তোমার জন্যও ডবল কাঁদব।’ এরপর মানিককে দ্রুত গ্রাম ছেড়ে যেতে বলে মালতী, নয়তো বাংটুর পরিণতি বরণ করতে হতে পারে উভয়ের।

পরদিন সকালের ট্রেন ধরার জন্যে খুব ভোরে বাড়ি ছাড়ে মানিক। ভোরের আবছা আলোয় চোখ পড়ে বাংটুর কবরের ওপর। পাশে দাঁড়িয়ে তার মা আছিমন। ‘রাতের ঝড়বৃষ্টিতে কবরে পানি ঢুকেছে কিনা, বাংটু নিরাপদে শুয়ে থাকতে পারছে কিনা – তাই পরীক্ষা করছে যেন।’ মানিককে দেখে ছুটে এসে বলে, ‘ও বাবা মোর মুক্তিযোদ্ধা বেটার খুনের বিচার না করিয়া তোমরা কোনঠে যান?’

মঞ্জু সরকারের উপন্যাস অন্তর্দাহ খুব মনোযোগ দিয়ে না পড়লে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি ব্যবহার ব্যবহার না করায় অনেকে লেখককে ভুল বুঝতে পারেন। কিন্তু না, স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে তুলে ধরতে মোটেও ভুল করেননি তিনি। অপরিহার্য মেনেছেন তাঁর নেতৃত্ব যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও। বস্তুত মূলধারার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেননি মঞ্জু সরকার কোথাও, এ নিয়ে তেমন আলোচনায়ও যাননি। তবে বিতর্কিত ও ক্লেদাক্ত এমন অনেক বিষয় সামনে এনেছেন, যা সমালোচনার ভয়ে এড়িয়ে যান অন্যরা। লেখককে ভুল বোঝার অবকাশ এখানেই বেশি। তিনি যদি সমগ্রের সঙ্গে মিলিয়ে এসব বিষয় সামনে আনতেন তাহলে ভুল বোঝার সে-সুযোগ থাকত না। পাঠক সতর্ক না থাকলে সত্য ভাষণ বিকৃত বলে গণ্য হতে পারে। পঙ্কজদের মতো কিছু যুবকের ভারতে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধে যোগদানের পরিবর্তে ঘোরাফেরায় সময় ব্যয় অপ্রিয় হলেও সত্য। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ও জাতীয়তাবাদী আবেগ হতে লেখক মানবিক বিবেচনাবোধকে আলাদা রাখতে চেয়েছেন। সে-কারণে মানিকের নানাজি পাকিস্তানপন্থি হলেও পরেশের মায়ের মুখ দিয়ে তার মানবিক ও নৈতিক আচরণের গল্প শুনিয়েছেন। বিজয়োত্তর নিরীহ অবাঙালি নিধনেও লেখকের অন্তরাত্মা বিষাদিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান শুধু বীরত্বগাথা নয়, এর মধ্যে বিচিত্রতা ও বৈপরীত্যও আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কেউ কেউ রাজাকার হয়েছিল স্রেফ মাসমাহিনা হিসেবে কটা টাকার জন্যে। আবার কেউ শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েও মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে বিসর্জন দেননি। মঞ্জু সরকার তাঁর উপন্যাসে এরকম বৈপরীত্যের ইঙ্গিত দিয়ে বাস্তবতাকে সামনে এনেছেন, অসত্য কিছু বলেননি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে প্রবল দেশাত্মবোধের জাগরণ ঘটিয়ে মুক্তির বার্তা বয়ে এনেছিল। এর প্রভাবে মানিকের মতো বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়াদের অনেকে গ্রামে থেকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছিল। বাংটু বক্করের মতো কিশোর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগদান, কিংবা অন্য কাজের সংস্থান করে দুবেলা আহার জোটানোর স্বপ্ন দেখেছিল। স্বাধীন দেশে সে-স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিরূপ পরিপার্শ্বের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হলো বাংটুকে, পালিয়ে আসতে হলো মানিককে নিজের জীবনের শঙ্কা নিয়ে। মঞ্জু সরকারের উপন্যাস অন্তর্দাহ প্রকৃতই মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বহুমাত্রিক বাস্তবতার এক সফল আখ্যান। পাঠক সেটি হাতে নিলে তুষ্টিলাভ করবেন।