রিসেপশন থেকে ফোন এলো। ‘স্যার, এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আসিফ সেদিনকার খবরের কাগজ দেখছিল। এখন খবরের কাগজ আর পড়া হয় না। শুধু চোখ বোলানো। হেডলাইনগুলি দেখা। ওসব হেডলাইন দেখতে দেখতে বলল, ‘কী নাম?’
‘নাম বলেননি।’
আসিফ তেমন অবাক হলো না। সে যেখানেই যায় এরকম অনেক মহিলাই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। নানা রকম সমস্যার কথা বলেন। সমাধানের পরামর্শ চান। মফস্সলে এলে ব্যাপারটা বেশি ঘটে। তা ঘটবার কথা। আসিফের এনজিও সমস্যা জর্জরিত নারীদের নিয়ে কাজ করে, সুবিধাবঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করে। কয়েকটি দেশ থেকে ফান্ড আসে। বনানীতে সুন্দর অফিস তাঁর। কর্মীদের বেশিরভাগই মেয়ে। আসিফের চেহারাও ইদানীং মানুষের কাছে পরিচিত। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নারীদের নানা রকম সমস্যা নিয়ে টক শো করে। এসব বিষয় নিয়ে দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সেমিনার করে। নিজের সম্পর্কে নারীদের সচেতন করা, তাদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সেমিনার।
আসিফের বয়স একান্ন। সে একাকী জীবন কাটায়। সংসার ছিল। ভেঙে গেছে। প্রেম করে বিয়ে করেছিল সাদিয়াকে। বিয়ের দু-বছর পর মেয়ে হলো। সাদিয়া কাজ করত আমেরিকান একটা কোম্পানিতে। আসিফ তখন এনজিও নিয়ে নেমেছে। অন্য নারীদের সমস্যা দেখতে শুরু করেছে। নিজের নারীটির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিল না। উলটো মেজাজ দেখাত। খারাপ ব্যবহার করত। সাদিয়া প্রথম প্রথম কিছু বলেনি। পরে এই নিয়ে শুরু হলো বিরোধ। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স। মেয়েকে নিয়ে সাদিয়া চলে গেল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আসিফের। এখন সেই যোগাযোগও ক্ষীণ।
‘কী বলব, স্যার?’
‘ও, বলুন আজ দেখা হবে না। আমার একটা সেমিনার আছে। খুবই ব্যস্ত থাকব। কাল আসতে বলুন।’
‘জি স্যার।’
খানিক পর আবার ফোন এলো। ‘সরি, স্যার। উনি টেলিফোনে একটু কথা বলতে চান।’
আসিফ বিরক্ত হলো। ‘ঠিক আছে। দিন।’
ভদ্রমহিলা ফোন ধরেই বললেন, ‘আমি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা বা পরামর্শ চাইতে আসিনি। আপনাকে অন্য কিছু কথা বলব। আপনার অতীত জীবন নিয়ে।’
কণ্ঠস্বর পরিচিত মনে হলো। কোথায় যেন শুনেছে আসিফ। একটু হাস্কি ভয়েস। বেশ আকর্ষণ আছে কণ্ঠে।
আসিফ থতমত খেয়েছিল। নিজেকে সামলে বলল, ‘আমার অতীত নিয়ে কথা বলবেন? কে আপনি? কী নাম?’
‘আমার নাম শ্রাবণী। ঠিক আছে, আপনি যখন ব্যস্ত, আমি কাল আসবো। কখন এলে ভালো হয় বলুন তো!’
‘এ সময় এলেই হবে। কাল আমার তেমন কোনো কাজ নেই। লাঞ্চের পর ঢাকায় রওনা দেব।’
‘ঠিক আছে।’
কাজের ফাঁকে ফাঁকে সারাটা দিনই শ্রাবণীর কথাগুলি কানে বেজেছে আসিফের। রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবেছে। শ্রাবণী কে? তার অতীত জীবন নিয়ে কী বলতে চান? কণ্ঠস্বর পরিচিত মনে হলো! যেন এই কণ্ঠ আগে শুনেছে।
কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না আসিফ।
সকালবেলা ঠিক সময়েই শ্রাবণী এলেন। রিসেপশন থেকে ফোন আসতেই আসিফ ধরল।
‘স্যার, শ্রাবণী ম্যাডাম এসেছেন।’
‘ফোনটা তাঁকে দিন।’
শ্রাবণী ফোন ধরলেন। ‘জি, বলুন।’
‘আমার রুমে আসতে অসুবিধা নেই তো? চা খেতে খেতে আপনার কথা শুনলাম।’
‘কোনো আপত্তি নেই।’
খানিক পর রিসেপশনের একটি মেয়ে শ্রাবণীকে আসিফের রুমে পৌঁছে দিয়ে গেল।
কালো বোরখায় নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত করে রেখেছেন শ্রাবণী। শুধু তাঁর চোখদুটো দেখা যাচ্ছে। টানা টানা চোখ। এই চোখও আসিফের পরিচিত মনে হলো।
‘বসুন, প্লিজ।’
‘ধন্যবাদ।’
শ্রাবণী মুখোমুখি সোফায় বসলেন।
‘চা চলবে তো?’
‘না, আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি। আপনি খান। আপনার তো ঘন ঘন চায়ের অভ্যাস।’
‘জানলেন কী করে?’
‘আমি আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। তবে সেসব বলতে আসিনি। একটা ঘটনা বলতে এসেছি।’
‘আপনার কণ্ঠ পরিচিত মনে হচ্ছে। চোখদুটোও যেন আগে দেখেছি।’
‘এ রকম চোখ অনেক মহিলারই আছে। আমার মতো কণ্ঠও আছে কারো কারো।’
আসিফ বুঝল শ্রাবণী তার কথা এড়িয়ে গেলেন। সে চায়ে চুমুক দিলো।
‘একটা অনুরোধ করতে পারি?’
‘জানি কী অনুরোধ। সেটা না করাই ভালো। আমার মুখ আপনাকে আমি দেখাব না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তা হলে ঘটনাটা বলুন। কাল অবশ্য বলেছিলেন আমার অতীত জীবন নিয়ে কথা বলবেন।’
‘ওসব না বললে আপনি হয়তো আমার সঙ্গে দেখাই করতেন না।’
‘এই ধারণাটা ঠিক না। দেখা আমি করতাম। আপনার কথাও শুনতাম। ওসবই আমার কাজ।’
‘এবার তাহলে আসল কথায় যাই?’
‘প্লিজ।’
‘মেয়েটার নাম ছিল কলি। বাংলাদেশের গ্রামে এখনো গর্ভবতী নারীকে বাপের বাড়িতে রাখার নিয়ম। কলির মা গর্ভবতী হওয়ার পর তাকেও বাবার বাড়িতে রাখা হলো। মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে মা গেল অসুস্থ হয়ে। মেয়ের কিছুই হলো না, চার মাস পর মা মারা গেল। অসুস্থ স্ত্রীকে আর মেয়েকে কলির বাবা দেখতেও আসত না। দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করল। কলিকে কোলে তুলে নিল তার মামি। মামা গরিব কৃষক। সামান্য জমি আছে। ওই চাষ করে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে অতিকষ্টে চলেন। কলি হয়ে গেল মামা-মামির চতুর্থ সন্তান। নিজের ছেলেমেয়েদের তেমন লেখাপড়া করালেন না মামা কিন্তু কলিকে স্কুলে পাঠালেন। কারণ পড়াশোনায় ব্যাপক আগ্রহ মেয়েটির। অন্যদিকে কলি দেখতে সুন্দর। লম্বা, স্লিম। গায়ের রং ফর্সা, মাথাভর্তি চুল, টানা টানা চোখ। মুখটা মিষ্টি, মায়াবী। লেখাপড়ায় ভালো বলে স্কুলে বেতন দিতে হয় না। বইপত্রও কিনতে হয় না। টিচাররা কিনে দেন। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করল সে। উপজেলার কলেজে ভর্তিও হয়ে গেল।’
‘এ সময় মাস্তান লাগল কলির পেছনে।’
শ্রাবণী অবাক হলেন না। ‘এটা অবশ্য অনুমান করে বলা যায়। এ রকমই হয়। কলির পেছনে লাগল এলাকার এক টাকাওয়ালা লোকের বখাটে ছেলে।’
‘আমি কি সিগারেট ধরাতে পারি?’
‘আমার অবশ্য সিগ্রেটের গন্ধ একদমই পছন্দ হয় না। তবু আপনি খান।’
আসিফ সিগারেট ধরাল। ‘তারপর? বলুন।’
‘অবস্থা এমন দাঁড়াল, কলি না কলেজে যেতে পারে, না বাড়িতে থাকতে পারে। গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বার বা প্রভাবশালী লোকদের ধরেও কাজ হলো না। ছেলেটির নাম মিজান। কলিকে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে এসে হানা দিতে লাগল। ধরে নিয়ে যাবে কলিকে। জোর করে বিয়ে করবে। মামা-মামি খুবই বিপদে পড়েছেন মেয়েটিকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করার জন্য, মামার পরিবারটিকে শান্তিতে রাখার জন্য রাতের অন্ধকারে কলি পালালো। ঢাকায় তার এক দূরসম্পর্কের বিধবা, নিঃসন্তান খালা থাকে। তার কাছে এসে উঠল।’
সিগারেটে টান দিতে গিয়ে থামল আসিফ। শ্রাবণীর দিকে চোখ ফেরাল। ‘ঘটনাটা আমার কেমন শোনা শোনা মনে হচ্ছে।’
‘পুরোটা আগে শুনুন।’
‘বলুন, বলুন।’
‘কলির সেই খালা এক সাহেবের ফ্ল্যাটে কাজ করে। উত্তরায় তার ফ্ল্যাট। ভদ্রলোক একাই থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে। একমাত্র মেয়েটিকে নিয়ে স্ত্রী চলে গেছেন আমেরিকায়…।’
আসিফ এবার আপাদমস্তক কেঁপে উঠল। ‘এ তো, এ তো আমার জীবনের ঘটনা!’
শ্রাবণী হাসলেন। ‘ঘটনার মাঝের অংশটাও আপনার জানা। তার পরও আমার মুখ থেকে শুনুন।’
আসিফ তোতলাতে শুরু করল। ‘তুমি, তুমি কে?’
‘তুমি করে বলছেন কেন?’
‘সরি, সরি। আমি একটু দিশেহারা হয়েছি। সরি। বলুন, বাকিটা বলুন।’
‘সাহেবের বিয়ের আগে থেকেই কলির খালা তার ফ্ল্যাটে কাজ করে। চোখের সামনে দেখল সাহেব বিয়ে করলেন, বাবা হলেন। তারপর তাদের আলাদা হতেও দেখলেন। তবে ভদ্রলোক কলির খালাকে ছাড়লেন না। খালাই তাকে রান্নাবান্না করে খাওয়ায়, তার সংসার সামলায়। বিশ্বস্ত লোক। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকতে থাকতে ওই সংসারের সদস্য হয়ে গেছে। এক বিকেলে কলি এসে উঠল তার কাছে। মেয়েটির বিপদের কথা শুনে খালা বুঝে উঠতে পারল না, কী করবে এখন! সাহেবকে কেমন করে বলবে, বা মেয়েটিকে কেমন করে রাখবে তার কাছে! তারপরও তিনদিন ফ্ল্যাটে লুকিয়ে রাখল। চতুর্থ রাতে, গভীর রাতে কলি হঠাৎ শোনে সাহেবের রুম থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। সে ভয় পেয়ে খালাকে ডেকে তুলল। খালা উঠে সাহেবের দরজায় নক করল। ও-রকম গোঙানি বা করুণ আর্তনাদ চলছে। খালা চাবি এনে দরজা খুলতে গিয়ে দেখে দরজা খোলাই। লক করা হয়নি। কলিকে নিয়ে রুমে ঢুকল খালা। সাহেব কুকরেমুকরে শুয়ে আছেন। করুণ স্বরে গোঙাচ্ছেন। কলি কিছু না ভেবে তার কপালে হাত দিলো। দিয়ে চমকে উঠল। ভীষণ জ্বর। একশ চার ডিগ্রির কম হবে না। খালার কাছে জ্বর সর্দি কাশির ট্যাবলেট ছিল। কোনো রকমে সাহেবকে দুটো খাওয়ানো হলো। জ্বরের ঘোরে তিনি অচেতন। তারপর কলি শুরু করেছিল তার সেবা। নিজের কথা ভুলে প্রায় সারারাত সাহেবের মাথায় পানি দিলো। ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিলো। একসময় চোখ মেলে সাহেব তাকে দেখে অবাক। ‘তুমি কে? আমি কি জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি!’
কলির কথা খুলে বলল খালা। কিন্তু ওই যে চোখ মেলে সাহেব অপলক চোখে কলির দিকে তাকালেন, সেই চোখে যে কী ছিল কে জানে, মেয়েটি মুহূর্তে কেমন বদলে গেল! তার মনে হলো, এই মানুষটি যেন তার চেয়েও অসহায়। এই মানুষটির পাশে তাকে থাকতে হবে। সে থাকল। খালা প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ডাক্তার এলো, কলি সাহেবের একান্ত আপনজনের মতো ওষুধপথ্য সব জেনেবুঝে নিল। তারপরও সাহেব সাতদিনের মতো ভুগলেন। শরীর খুবই দুর্বল। দিনরাত কলি তার সেবা করছে। সারারাত সাহেবের পাশে বসে থাকে, কখনো কখনো তার পাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। খালা নানা রকমভাবে বোঝালো। ‘তুই একটা যুবতী মেয়ে। সাহেবের বয়সও তেমন কিছু হয়নি। এভাবে চলা ঠিক না। অঘটন ঘটবে। সাহেব কি তোকে বিয়ে করবেন?’ কলি অতদূর ভাবেইনি। তার মন জুড়ে শুধু ওই মানুষটা। চোখ জুড়ে শুধু ওই মানুষটির মুখ। তাকে ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। কিছুই ভাবে না। খালার কথায় কোনো কাজ হলো না। সাহেবও কলিকে ছাড়া কিছুই তখন বোঝেন না। কলির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন। সাহেবের একটাই বোন ঢাকায়। ভাই অসুস্থ শুনে একদিন দেখতে এলেন। কলি লুকিয়ে রইল। এইভাবে ফ্ল্যাটে কেউ এলেই সে লুকিয়ে থাকে। তবে সাহেবের ফ্ল্যাটে তেমন কেউ আসত না। বলতে গেলে তিনি একা একাই থাকেন। কয়েকদিনের মধ্যে এমন হলো, সাহেবের জন্য যেন সব করতে পারে কলি। নিজের কথা তার মনেই থাকে না। সাহেবও উতলা হয়েছেন তার জন্য। দেখতে দেখতে অলিখিত স্বামী-স্ত্রী হয়ে গেল তারা। নির্দ্বিধায় কলি তার সবকিছু তুলে দিলো সাহেবের হাতে।’
আসিফের চোখে তখন পলক পড়ছে না। মুখে ফুটেছে ভারি করুণ বিষণ্নতা। কোনো রকমে বলল, ‘তার নাম তো কলি ছিল না। তার নাম ছিল ঝুমকো।’
‘আপনি তাকে ডাকতেন ‘ঝুমকোলতা’ বলে। লতার মতোই সে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ভালোবেসেছিল তার সর্বস্ব দিয়ে। তখন তার কোনো অতীত ছিল না, ভবিষ্যৎ ছিল না। সে ছিল বর্তমান নিয়ে। আপনাকে নিয়ে। আপনি তাকে ভালোবাসেন কি বাসেন না তাও বোকা মেয়েটি জানতে চায়নি, বুঝতে চায়নি। সে বুঝেছিল নিজেকে। সে ভালোবাসে আপনাকে। এটাই তার কাছে সব। তার ভালোবাসাই তার কাছে মূল্যবান। মেয়েরা কাউকে ভালোবাসলে প্রথমেই বিয়ের কথা ভাবে। আপনার ডিভোর্স হয়ে গেছে। চাইলেই ঝুমকোকে বিয়ে করতে পারেন। ঝুমকো দেখতে খুবই আকর্ষণীয়া। যে কেউ তাকে দেখে মুগ্ধ হবে। কিন্তু সে এসব ভাবলোই না। নিজের গভীরতর ভালোবাসায় ডুবে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিল সে। এক রাতে আপনি তাকে নিবিড়ভাবে চাইলেন। সে তো রোজই চাচ্ছিলেন। সেও সাড়া দিত আপনার ডাকে। পাগল হতো আপনার জন্য। সেই রাতে তার শরীর-মন কোনোটাই সাড়া দিচ্ছিল না। ক্লান্ত লাগছিল। ফলে সে মানা করেছিল। তারপরও আপনি জোড়াজুড়ি শুরু করলেন। সে করুণ আবেদন করছিল, বাধা দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে আপনি খুবই বিরক্ত হলেন। প্রথমে বাজে বাজে কথা বললেন ঝুমকোকে তারপর অতি নির্দয় ভঙ্গিতে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলেন। ‘যাও, তুমি গিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে থাকো। তুমি ওই ক্লাসেরই মেয়ে। আমার সঙ্গে থাকার উপযুক্ত নও।’
‘খালা কিছুই টের পেল না। এমনিতেই সে ঝুমকোর ওপর বিরক্ত। আপনাকে সে চেনে। প্রেম করা স্ত্রীর সঙ্গে জীবন কাটাতে পারেননি বাজে ব্যবহারের জন্য। এমনিতে আপনি শান্তশিষ্ট ভালো মানুষ টাইপ, কিন্তু আপনার ভেতর এক অসভ্য, বদমেজাজি আর মহাস্বার্থপর মানুষও বাস করে। কখনো কখনো সেই মানুষটা বেরিয়ে আসে। তখন এই আপনাকে আর চেনা যায় না।’
‘সেই রাতে আপনার ভিতরকার মানুষটিকে দেখে ফেলল ঝুমকো। এত অপমান বোধ করল মেয়েটি! এত অভিমান হলো তার! সারাটা রাত বসে বসে কাঁদল। আপনি একবারও বেরিয়ে এলেন না তাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বা অনুতপ্ত হওয়ার জন্য। ভোরবেলা নিজের ব্যাগটা নিয়ে, বোরখা পরে যেভাবে ঝুমকো আপনার ফ্ল্যাটে এসেছিল ঠিক সেইভাবে সে বেরিয়ে গেল।’
আসিফ উদাস গলায় বলল, ‘তারপর আট বছর কেটে গেছে। ঝুমকোর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে যেন সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেল পৃথিবী থেকে। সেই খালাকে আমি গ্রামে পাঠিয়েছিলাম, যত চেনা-পরিচিত জায়গা আছে সর্বত্র পাঠিয়েছিলাম। ঝুমকোর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।’
‘পাওয়ার কথাও না। ওই শর্তেই মিজানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল সে। আপনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে একটা মোবাইল ফোনের দোকান থেকে মিজানকে ফোন করেছিল। সেদিনই পাগলের মতো ঢাকায় ছুটে এলো মিজান। ঝুমকো সারাটা দিন এদিক-ওদিক কাটিয়ে বিকেলের দিকে সেই ফোনের দোকান থেকে আবার মিজানকে ফোন করল। কোথায় আছে তা জানালো। সন্ধ্যাবেলায় ওদের দেখা হলো। মিজান অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। প্রচুর টাকার মালিক ওর বাবা। ঝুমকো মিজানকে অনেকগুলি শর্ত দিলো। সে মিজানকে বিয়ে করবে ঠিকই কিন্তু পরিচিত কারো সঙ্গে কখনো দেখা করবে না। সে থাকবে সবার চোখের আড়ালে, দূর কোনো মফস্বল শহরে। সে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করবে। বাংলা সাহিত্য পড়বে। নিজেকে বোরখায় ঢেকে চলাফেরা করবে। মিজান তাকে সেই জীবনটাই দিয়েছে। একটা ছেলে আছে তাদের। এই শহরে বিশাল বাড়ি। মিজান এখানকার বড় ব্যবসায়ী। খুবই সুখের জীবন ঝুমকোর।’
আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘আমি বুঝেছি তুমিই ঝুমকো। আমার ঝুমকোলতা।’
‘এত কিছু বলার পর যে-কোনো শিশুরও তা বোঝার কথা। শ্রাবণী এবং কলি নাম দুটো আমি বানিয়ে বলেছি। আমি ঝুমকো। তবে ‘আমার ঝুমকোলতা’ কথাটা আর বলবেন না। আপনি আমার কেউ নন। আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে ওই নামে ডাকার।’
ঝুমকো ঝট করে মুখ থেকে বোরখার আবরণ সরাল। ‘বলেছিলাম আমার মুখ আপনাকে দেখাব না। এখন দেখাচ্ছি। কারণ আমার মুখ দেখলে আপনি বুঝবেন, কতটা ভালো থাকলে মেয়েদের মুখে সকালবেলার আলোর মতো লাবণ্য ঝলমল করে। আপনার কাছ থেকে সরে এসে আমি নর্দমায় পড়ে যাইনি। বোরখা পরে গ্রাম থেকে পালিয়েছিলাম। আপনার ফ্ল্যাট থেকেও বোরখা পরেই বেরিয়েছিলাম। নিজের বাড়ি ছাড়া বোরখা এখন আর কোথাও খুলি না। আজ আপনার সামনে খুললাম। দ্বিতীয় আরেকটা কারণ আছে বোরখা খোলার। আমার মুখ দেখে আপনার যেন গভীর অনুশোচনা আর তীব্র অপরাধবোধ হয়। আপনি যেন সারা জীবন এই অপরাধবোধে ভোগেন। অন্তরজ্বালায় জ্বলেন।’
আসিফের মুখ ততক্ষণে একেবারেই ম্লান হয়ে গেছে। ঝুমকোর দিকে সে তাকাতেই পারছে না। অসহায় ভঙ্গিতে আরেকটা সিগারেট ধরাল।
ঝুমকো বলল, ‘মানুষ দুরকম। বাইরে এক, ভিতরে আরেক। মিজান পাগল হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। তার আচরণ আর গুণ্ডামি দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখি তার ওরকম হওয়ার কারণ ছিলাম আমি। আমাকে পাওয়ার জন্য সে অমন করেছে। আপনার ওখান থেকে বেরিয়ে আমি নিজ থেকে যখন তাকে ডাকলাম, সে যখন আমার সামনে এলো, এসে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। আমি যা যা বললাম সব মেনে নিল। দিনে দিনে দেখি সে একজন সত্যিকার মানুষ। খাঁটি মানুষ। খাঁটি প্রেমিক, খাঁটি স্বামী। প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীর প্রতি আছে আশ্চর্য রকম শ্রদ্ধাবোধ, গভীর মমত্ববোধ, গভীর ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতা। সংসারের বাইরে, স্ত্রী-সন্তানের বাইরে কিচ্ছু ভাবে না সে। খুবই সৎভাবে বিজনেস করে। যে মামা-মামি আমাকে তাদের সন্তানের মতো প্রতিপালন করেছেন তাদের অবস্থা মিজান বদলে দিয়েছে। বাড়িতে পাকাঘর করে দিয়েছে। মামার মেয়ে দুটোর ভালো বিয়ে দিয়েছে। ছেলেটিকে বাজারে দোকান করে দিয়েছে। আপনার ফ্ল্যাটে থাকা সেই খালা যখন গ্রামে চলে গেল, তাকেও সামান্য জমি কিনে ঘর করে দিয়েছে মিজান। অর্থাৎ আমার অসহায়ত্বের সময় যারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রত্যেকের পাশে মিজান দাঁড়িয়েছে। আমার চেহারা দেখে নিশ্চয় আপনি বুঝেছেন কতটা ভালো আমি আছি।’
আসিফ সিগারেটে টান দিয়ে শুকনো গলায় বলল, ‘তুমি আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছ। একবার তাকালে তোমার দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না।’
‘এরকম সৌন্দর্য মাত্র কয়েকদিনের জন্য আগেও একবার শরীরে এসেছিল আমার। যে মুহূর্ত থেকে আমি আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম, আপনাকে সর্বস্ব দিয়েছিলাম, আপনার ওপর নির্ভর করেছিলাম, নিজেকে আপনার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, সেই সময়। মানুষ যখন সবদিক থেকে নির্ভার হয়, তখন তার চেহারায় আলাদা লাবণ্য আসে। নারীপুরুষ দুজনারই। আমি ওই সময় নির্ভার হয়েছিলাম। তবে যার হাত ধরে নির্ভার হলাম, সেই মানুষটি, আমার প্রেমিকটি আসলে মানুষ ছিল না। মানুষের মতো দেখতে একটি জন্তু। অমানুষ। অসভ্য। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। প্রেমিকাকে চূড়ান্ত অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল নিজের স্বার্থ উদ্ধার হয়নি বলে। তাকে পাঠাতে চেয়েছিল দারোয়ানের ঘরে। ছি!’
আসিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। হাতে সিগারেট পুড়ছে। লম্বা হয়ে ঝুলছে ছাই।
ঝুমকো বলল, ‘কথা বলছেন না কেন? কথা বলুন।’
মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকাল আসিফ। ‘কী বলব, বলো!’
‘আপনার তো বলার কথার অভাব নেই। টিভিতে দেখি মেয়েদের নিয়ে কত বড় বড় কথা বলেন। ‘নারী শুধু নারী নয়, তার প্রধান পরিচয় হবে ‘মানুষ’। আগে মানুষ হতে হবে। তাকে সচেতন হতে হবে নিজের সম্পর্কে। নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। শিক্ষিত হতে হবে।’ আজ আমি যদি আপনাকে প্রশ্ন করি, আপনি নিজে কি মানুষ হয়েছেন? হ্যাঁ বুঝলাম সেই রাতে শরীরের নেশায় আপনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে যতটা সম্ভব অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিলেন। আপনি তো মাতাল ছিলেন না। মদও খাননি সেই রাতে। তারপর পুরোটা রাত কেটে গেল। আপনি বুঝেছিলেন আমি ফ্ল্যাটেই আছি এবং কাঁদছি। আপনি বেরিয়ে এলেন না কেন? ভুল স্বীকার করে, আমাকে ফিরিয়ে নিলেন না কেন? সারারাত দরজা বন্ধ করে ঘুমালেন। দরজা বন্ধ করলেন এই কারণে যেন আমি আপনার কাছে যেতে না পারি। আপনি মানুষ? কোন মুখে এত বড় বড় কথা বলেন টিভিতে? লজ্জা করে না? নিজের দিকে আপনি তাকান না? নিজে মানুষ হতে পারেননি কেন – এই নিয়ে আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না? মিজান তেমন লেখাপড়া করেনি আর আপনি একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ। দুজনের তুলনা করলে আপনাকে আমার চূড়ান্ত অমানুষ মনে হয় আর মিজানকে মনে হয় প্রকৃত মানুষ। নারীর সম্মান কী, মিজান সেটা জানে। আর আপনি নারীকে মানুষ ভাববার কথা বলছেন, তাদের অধিকার সম্মান ইত্যাদি আদায়ের কথা বলে বিদেশ থেকে টাকা এনে খাচ্ছেন। নারীদের নিয়ে দালালদের মতো এক ধরনের ধান্দা করছেন! ছি! ঘৃণায় আমার বমি আসে। সবকিছুর আগে নিজে মানুষ হন। তারপর অন্যকে জ্ঞান দিতে আসবেন।’
ঝুমকো থামল। বোরখায় আগের মতো মুখ ঢাকল। তারপর উঠে দাঁড়াল। ‘আমার এত ঘৃণা আপনার ওপর, এত রাগ ক্রোধ, বলে শেষ করতে পারব না। আমার ভালোবাসাকে আপনি অপমান করেছেন। নারীত্বকে অপমান করেছেন। আমি একজন শিক্ষিত মানুষ, রুচিবোধ তীব্র। আমার রুচিতে বাধছে, নয়তো আপনার মুখে আমি থুতু ছিটিয়ে দিতাম।’
ঝুমকো আর দাঁড়াল না। রাজরানির ভঙ্গিতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.