মুর্তজা বশীরের সঙ্গ

১৯৭৪ সালের জুলাই মাসের এক বর্ষণমুখর দিন, আমি এসেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে কনিষ্ঠতম শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে। মুর্তজা বশীর তাঁর বর্ষাতিটা টাঙিয়ে রেখে ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – হু ইজ দিস্? দেবুদা, ওরফে দেবদাস চক্রবর্তী, তাড়াতাড়ি পরিচয় করিয়ে দিলেন – ও অমুক, আজ থেকে আমাদের সঙ্গে বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলো। মুর্তজা বশীর বিশেষ পাত্তা দিলেন না। তখন বিভাগে আমার চার তারকা সহকর্মী বয়সে আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। রশিদ চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তীকে আগে থেকে চিনতাম, নাট্যকলার জিয়া হায়দারের সঙ্গেও খানিক পরিচয় ছিল। আমাদের ছাত্রাবস্থায় মুর্তজা বশীর অধিকাংশ সময় পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতেন। সত্তর-একাত্তরের আন্দোলনের সময় তাঁকে দেখেছি, তবে পরিচয় বিশেষ হয়নি। আমার চেয়ে কয়েক বছরের সিনিয়র মিজানুর রহিম আমি যোগ দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে বিদেশে পড়তে চলে যান।

ফলে বয়সের আর খ্যাতির ফারাকে একটু একলা পড়ে গেলাম। যাঁকে সবচেয়ে দূরের মনে হয়েছিল কেমন করে জানি সেই মুর্তজা বশীরের সঙ্গেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠল এক গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আজ অনুভব করি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতার সূত্রে বিশ বছরের অধিক সময় শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গ আমার জীবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। প্রাথমিক অপরিচয় আর দুরধিগম্যতার বেড়া ডিঙিয়ে মুর্তজা বশীরের সঙ্গেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল প্রায় বন্ধুপ্রতিম, এমনকি একটা সময় প্রায় প্রতিটি দিন একত্রে কাটানোর মতো ঘনিষ্ঠতা। আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে দৃশ্যশিল্প ও সৃজনকলার বিবিধ এলাকায় বিচরণ করা বশীরভাইকে নানান অনুভবে স্মরণ করি।

তাঁকে ঘিরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সূত্রের অসমবয়সী একটি দলও গড়ে উঠল। আমি আর আবদুল মান্নান (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, ইউজিসি-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান) ছোটবেলার বন্ধু, আর আমাদের কয়েক বছরের সিনিয়র বাহাদুরভাই ওরফে শামসুল হোসাইন (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের প্রাক্তন পরিচালক) এর স্থায়ী সদস্য। আমাদের নানাবিধ অভিযান ও পরিকল্পনার জাল বোনা চলতে থাকে এখানে-সেখানে, পথে চলতে চলতে। বাহাদুরভাইদের সমুদ্র-উপকূলবর্তী খামারবাড়ি ছিল আমাদের প্রিয় গন্তব্য, সেখানে সারাটি দিন কাটানোর নানা রঙিন স্মৃতি মনে গাঁথা রয়েছে। তখনো বাংলাদেশের বা আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এতোটা সচ্ছল ছিল না। পুরনো কাপড়ের বিশাল এক বাজার ছিল, এটি তখন ধনী-দরিদ্র আর আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সকলেরই আকর্ষণের জায়গা ছিল। বিশেষ করে শীতের নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য কম লোকেরই ছিল, আমাদের তো বটেই। তবে অন্য সময়েও আমরা কায়দামাফিক শার্ট ও প্যান্ট খুঁজতে ওখানে ঢুঁ মারতাম। এক্ষেত্রেও বশীরভাইয়ের চোখ ছিল অসাধারণ। শীতের সময় হাজার হাজার বস্তুর মধ্য থেকে সঠিক কোট-জ্যাকেট বা সোয়েটারটি চিনে নিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। তিনি খর্বাকৃতি মানুষ, তাঁকে ফিট করে এমন কিছু খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তবু তাঁর পরনের ঈর্ষণীয় কোটটির মতো কিছু খুঁজে পেতে আমরা অন্য তিনজনই ব্যর্থ ছিলাম। এ-প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম শুধু এজন্যে যে, মুর্তজা বশীরের অনন্যতা কত দিকে বিকশিত তার একটু আন্দাজ পাওয়ার জন্য।

দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক সহকর্মী হিসেবে তাঁর সাহচর্যের স্মৃতিতে নানান চড়াই-উতরাইয়ের পর্ব কম নয়। মুর্তজা বশীর এমন একটি চরিত্র, পছন্দ কিংবা অপছন্দের সীমাকে ডিঙিয়ে যিনি স্মৃতির কোঠায় স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারেন। তাঁকে দেখেছি কিছুটা দুর্বিনীত, অননুমেয় মেজাজের, আত্মসচেতন, কিছুটা বা আত্মকেন্দ্রিক রূপে। নানা বিপরীত বৈশিষ্ট্যের সমাহার এ-মানুষটির সঙ্গে মতের মিল আর অমিল দুটোই ঘটেছে, তবু তাঁর সাহচর্য বিস্মৃত হওয়ার নয়। এমনও হয়েছে, মতানৈক্য হয়ে সম্পর্ক ছিন্ন থেকেছে দীর্ঘদিন, আবার এ-অসম সখ্য এতোটা গাঢ় হয়েছে, সারাটি দিন কেটেছে একসঙ্গে। শহরের পথে পথে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে দেখেছি প্রতিটি বস্তুর প্রতি তাঁর অপার ও সজাগ কৌতূহল, – যেটি এক অনুসন্ধিৎসু শিল্পীমনের লক্ষণ। আবার বাসায় কিংবা বাইরে তাঁকে সর্বত্র পেয়েছি সদা-সক্রিয় উন্মুখ মানসিকতা এবং নিরলস কর্মোদ্যমী প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা মানুষ হিসেবে। তাঁর ভেতরে একটি বোহেমিয়ান মন সুপ্ত ছিল বটে, তবে তাঁর মতো সুশৃঙ্খল ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববান মানুষও আমি শিল্পীমহলে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল সজাগ, সকল দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। মনে পড়ছে স্ত্রীর গুরুতর অসুস্থতার মধ্যে আশি-ঊর্ধ্ব মুর্তজা বশীর সীমিত শারীরিক সামর্থ্যরে মধ্যেও নিজেকে কতটা উজাড় করে স্ত্রীর সেবা করেছেন। তবু পারিবারিক বন্ধন আর শিল্পীর বিবাগী সত্তা – এই দোলাচল তাঁর ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল বলেই আমার ধারণা।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পুত্রদের কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, মুর্তজা বশীরও তাই। অতি অল্প বয়সেই কমিউনিস্ট পার্টির পোস্টার সাঁটতে গিয়ে মুর্তজা বশীর গ্রেফতার হন, তখনকার আর্ট ইন্স্টিটিউটে ভর্তিও হন পার্টির নির্দেশে। ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে তিনি শামিল ছিলেন না, ঘটনাচক্রে উপস্থিত হলেও বরকতের শরীর বহনে তাঁর অংশ নেওয়া, রক্তসিক্ত জামায় বাড়ি ফেরার পর ড. শহীদুল্লাহ্র প্রতিক্রিয়া ও নিজের আচকান ছিঁড়ে কালো ব্যাজ পরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ – তাঁর এসব জবানিতে আমরা গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রত্যয়ের ইঙ্গিত দেখি।

তাঁর জীবনের একটি পর্যায়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তা থাকলেও আমরা যে-বশীরভাইকে চিনেছি সত্তরের দশক থেকে, তাঁর মধ্যে তেমন কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দেখা মেলে না। এর বদলে পাই এ-অঞ্চলের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর গবেষক-সদৃশ উদ্যম, প্রভূত জ্ঞান ও সচেতনতা, সেই সঙ্গে বাঙালির লোককলা ও কারুকর্ম বিষয়ে গভীর আগ্রহ। তাঁর ‘এপিটাফ ফর দ্য মার্টায়ার্স’ সিরিজচিত্রের কথা মনে রেখেই বলা যায়, এপিটাফ যত না শহিদ যোদ্ধার প্রতি শোক-স্মরণিকা, তার চেয়ে বেশি শিল্পী মুর্তজা বশীরের ব্যক্তিগত শিল্পকাঠামো সন্ধানের ফসল। আবার যখন নতুন করে অবয়বধর্মী কাজে ফিরেছেন, সেখানে দেখি নেহাত মানবরূপের উপস্থাপনেই তিনি সন্তুষ্ট নন, বাংলার লোকচিত্রধারা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি অর্থবহ পথ নির্মাণে তাঁর আগ্রহ। তাঁর শিল্পকলার জগৎটিও গড়ে উঠেছে এই উভয়বিধ মানসিকতার সংশ্লেষ ও সংঘাতে।

বয়সের ভার কিংবা অসুস্থতা নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন মানুষ তিনি নন। শেষ তাঁকে দেখতে গিয়েছি সম্ভবত মৃত্যুর ছ-সাত মাস আগে। অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া চলতে পারেন না সাতাশি বছরের সে-মানুষটি বলছেন বিশটি ক্যানভাস তৈরির কথা, ছবি এঁকে প্রদর্শনী করার কথা। এমনই এক ব্যতিক্রমী চরিত্র ছিলেন তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতায় যোগদান মুর্তজা বশীরের জীবনে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন সূচিত করে। দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চারুকলা শিক্ষার প্রথম শিক্ষালয় হিসেবে বিভাগটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, মুর্তজা বশীরের যোগদান তাকে আরো সমৃদ্ধ করে। নিয়মিত শিক্ষকতার বৃত্তি মুর্তজা বশীরের জীবনেও নিয়ে আসে স্থিতি ও শৃঙ্খলা। মুর্তজা বশীরের উপস্থিতি বিভাগটিকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি তাঁর মধ্যেও শিল্পভাবনার বিকাশ আরো গভীর হয়ে ওঠে। শিক্ষকতা মুর্তজা বশীরের নিজের জ্ঞানপিপাসা, বিশেষ করে চিত্রতলের নির্মাণবিষয়ক ভাবনা ও শিল্প-উপকরণ চয়ন ও ব্যবহারের চিন্তাকে আরো উজ্জীবিত করে তোলে, যা তাঁর এবং ছাত্রদের – উভয়ের জন্য সহায়ক হয়। চট্টগ্রামে স্থিত হয়ে ভাবনার পরিশীলনের ভেতর দিয়ে এক নতুন মুর্তজা বশীর নির্মিত হতে শুরু করেন, যাঁর গবেষণাকর্মে এদেশের স্বল্প-আলোচিত অতীতের বিভিন্ন উপকরণ আলোকিত ও অর্থময় হয়ে ওঠে আর তাঁর চিত্রকর্মে দেশ ও কাল ধীরে ধীরে অধিক প্রাসঙ্গিক হয়ে প্রকাশ পেতে শুরু করে।

তাঁর চট্টগ্রাম অবস্থানের সিকি শতাব্দীর সময়কালের সকল সৃজনকর্মকে এখানে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, মুর্তজা বশীরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিরিজ কাজ ১৯৭৫ থেকে আঁকা ‘এপিটাফ ফর দি মারটায়ার্স’ – মুক্তিযুদ্ধে নিহত নাম-না-জানা শহিদদের উদ্দেশে নিবেদিত চিত্রমালা চট্টগ্রামে বসে আঁকা। সাদা পটভূমিতে বিভিন্ন আকৃতির ভাসমান বর্তুলাকার ধরনের ফর্ম, ভেতরের আকৃতিসমূহ বিভিন্ন মোলায়েম রঙের সূক্ষ্ম পর্দায় পরস্পর-বিলীয়মান, মৃত মানুষের জন্য আদি মানব-সমাজে প্রচলিত পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ রচনার সঙ্গে যার সাযুজ্য মেলে। এখানে আকৃতি ও রঙের ব্যবহার নম্র ও কমনীয়, সম্পূর্ণ পরিহার করা হয়েছে টেক্সচার। চিত্রতলের সংগঠনের প্রেক্ষাপটে তাঁর এই সিরিজের চিত্রমালা বাংলাদেশে প্রচলিত চিত্রধারা থেকে একেবারেই ভিন্ন, এর ব্যঞ্জনাও একেবারে আলাদা। এসবের মাঝে মাঝে নানা ধরনের নিরীক্ষা চালিয়েছেন – কখনো কোলাজ, কখনো গাড়ির ডেন্টিং থেকে প্রেরণায় আঁকা ছবি, কখনো পর্দার দুলুনির ছন্দোময়তার চিত্ররূপ, এমনকি কখনো কলেমা তৈয়বায় অনুপ্রাণিত লিপিশিল্প। এসব নিরীক্ষা সবসময় তেমন ফলপ্রসূ হয়নি, তবে ঢাকাবাসের আগে থেকে শুরু করা বাংলার চিত্রশিল্পের বর্ণবিন্যাসকে ভিত্তি করে যে-চিত্রধারা তিনি সূচিত করেছিলেন তার মধ্যে নানামুখী সম্ভাবনার ইঙ্গিত চট্টগ্রাম বাসকালেই দেখা দিয়েছিল। চট্টগ্রামে শিক্ষকতাকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে করা তাঁর দেয়ালচিত্র ‘অক্ষয় বট’ তাঁর আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকৃতি। চট্টগ্রামে শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে আমার যে প্রায় সিকি শতাব্দীর সম্পর্ক তার অভিঘাত আমার জীবনে স্থায়ী হয়েছে বলেই মনে করি। বিবিধ প্রকার শিল্পের রসাস্বাদনের চোখ তিনি খুলে দিয়েছিলেন, শিল্পের উপকরণ ও নির্মাণ প্রক্রিয়া বিষয়ে তাঁর মতো নিবিষ্ট ভাবুক আমি দেখিনি। দৃশ্যকলা জগতের সকল বর্ণময়তাকে জীবনে ধারণের উদাহরণ তাঁর মধ্যেই দেখেছি। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও বর্ণিল জীবনচর্যায় চট্টগ্রামও পুষ্টি জুগিয়েছে, – এটি যেমন সত্য, তাঁর যাত্রাপথের অংশীদার হতে পেরে আমার মতো অনেকেই হয়েছেন সমৃদ্ধ, – এও সমান সত্য।