নূরুজ্জামান কায়সার
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন – এই তিন ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাণকারী ভারতীয় চলচ্চিত্রকে দেশে ও বিদেশে যেভাবে প্রসারিত করেছেন, অনেক আধুনিক চলচ্চিত্রকার সেটি পারেননি। তাঁরা তিনজনই ছিলেন খুব কাছাকাছি সময়ের। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক গত হয়েছেন আগেই। তিন টলস্টয়ের শেষ নায়ক মৃণাল সেনও চলে গেলেন ২০১৮ সালের শেষ দিনে। তাঁর প্রয়াণে যেন বাংলার স্বর্ণতারকাখচিত চলচ্চিত্রজগতের একটা যুগের অবসান হলো। শেষ সময় তাঁর কাটছিল নীরবে-নিভৃতে, একাকী। স্ত্রী গীতা সেনের বিয়োগের পর মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েছিলেন। বহু সংগ্রামের সহযাত্রী বন্ধু আর স্ত্রী গীতা সেনের বিদায় তিনি যেন মেনে নিতে পারেননি। তাই ঠিক এক বছর পর তিনিও চলে গেলেন অনেকটা আকস্মিকভাবে। সত্যজিৎ রায় ভীষণ ধ্রম্নপদি ক্লাসিক্যাল, ঋত্বিক ঘটক ভীষণ বাঙালি আর মৃণাল সেন বাঙালি মধ্যবিত্ত ও আন্তর্জাতিক এবং মর্ত্যনিষ্ঠ। তাঁরা কাছাকাছি সময়ের হলেও তাঁদের নির্মাণশৈলী ছিল ভিন্ন। খুব সাধারণ গল্পকে কীভাবে অসাধারণ করে তোলা যায় তাঁরা সেটা খুব ভালোভাবে জানতেন। আর সে-কারণে হয়তো তাঁদের প্রজ্ঞা, মেধা, নির্মাণশৈলী আজো বিশ্বনন্দিত।
তবে মৃণাল সেনের ছবিতে গভীর জীবনবোধের এক দারুণ ছাপ সবসময় ফুটে উঠত। এছাড়া রাজনৈতিক দৃষ্টি, ডি-কলোনাইজেশন, বিকল্প আধুনিকতা তিনি তুলে ধরতে পারতেন সহজে। তিনি তাঁর চলচ্চিত্রে নতুন এক ফর্ম তৈরি করেছিলেন, যেটি আগে কখনো কেউ আনতে পারেননি। তিনি সিনেমাকে করতে চেয়েছিলেন নমনীয় ও সহনীয়। তথাকথিত সিনেমা থেকে দর্শকদের একটা বিশেষ স্তরে নামিয়ে আনার প্রয়াসে মৃণাল সেনের ভূমিকা অপরিসীম। মেলোড্রামা বা কমেডিকে পাশ কাটিয়ে ঘটনানির্ভর এক নিখাদ গল্পকে সেলুলয়েডে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। তাঁর এই নতুন ধারার চলচ্চিত্রে তিনি সবসময় ধরতে চেয়েছেন মানব-মানবীর মনস্তাত্ত্বিক দিক, মধ্যবিত্তের চাওয়া-পাওয়া, মূল্যবোধ, দর্শন সব মিলিয়ে অদ্ভুতভাবে জীবনটাকে এক আয়নায় নতুন করে ফিরে ফিরে দেখা। সে-কারণে তাঁর চলচ্চিত্রের তফাৎ দর্শকরা সহজে অনুধাবন করতে পারতেন। তাঁর সিনেমাতে তাই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক দিক – রাজনীতি, সমাজনীতি, সমাজবিপস্নব, মধ্যবিত্তের নানা অসহায় ঘটনা। সে-কারণে তাঁর সিনেমা সবসময় ছিল জীবন্ত, বাস্তব। জীবন্ত অভিনেতাদের সামনে দর্শকরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠত; মনে হতো তাদের জীবনের প্রতিদিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অবসর কাটানো বা আনন্দের জন্য তিনি সিনেমা তৈরি করেছেন বলে মনে হয় না। তাঁর ছবি ছিল সবসময় মানবাধিকারের পক্ষে। বাঙালির গৌরবের জন্য যথাসর্বস্ব দিয়ে লড়াই করে গেছেন সেলুলয়েডের ভেতর দিয়ে। তাই তাঁর ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার আসনটি পোক্ত হয়ে গিয়েছিল দেশ ও বিদেশের সর্বস্তরের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে। তাঁর ছবি, তাঁর জীবনযাপন, তাঁর রাজনৈতিক চিমত্মাভাবনা সব মিলিয়ে যেন এক আশ্চর্য মিথ।
বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালের ১৪ মে। স্কুলের পাঠ শেষ করে মাত্র সতেরো বছর বয়সে চলে যান কলকাতায়; স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন পদার্থবিদ্যা নিয়ে। বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জেলও খেটেছিলেন। সিনেমার প্রতি শুরুতে তাঁর বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না। এটি তিনি অনেকবার বলেছেন। বরং পাঠাভ্যাসে ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান এসব বিষয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে সিনেমার কারিগর হয়েই থাকতে হলো আমৃত্যু।
সিনেমার গঠনপদ্ধতি ও পরিবেশ রচনার জটিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল তাঁর মন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরেছিলেন মধ্যবিত্তের নানা সমস্যা – পারিবারিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, দুর্ভিক্ষ, রাগ, দুঃখ-বেদনা, সাম্রাজ্যবাদ আর মানুষের অন্ধকার জীবনের নানা কাহিনি। তাঁর ছবি যেন এক ভাষ্যকারের গভীর কণ্ঠস্বর, যেখানে থাকত
অন্যায়-অবিচার, পাওয়া না-পাওয়ার দোদুল্যমান এক বয়ান।
১৯৫৫ সালে রাতভোর দিয়ে শুরু তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রযাত্রা। যদিও আশার কোনো প্রদীপ জ্বলে ওঠেনি সে-যাত্রায়। চলচ্চিত্রের গল্পটা ছিল এমন – অতি সাধারণ গরিব একটা ছেলে শহরে এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে। ছেলেটিকে নিয়ে এসেছিল ধনী উচ্চবিত্ত এক পরিবার। তাকে ঘিরে নানা ঘটনার উত্থান-পতন। ছবিটি একদমই চলেনি। মৃণাল সেন বুঝতে পেরেছিলেন, কোথাও একটা বড় খামতি আছে। বুঝেছিলেন, ছবি তৈরি তাঁকে শিখতে হবে। তাই প্রায়ই তিনি রাতভোরের কথা পারতপক্ষে এড়িয়ে যেতেন। উত্তম
কুমার-সাবিত্রী জুটি ছিল এ-ছবিতে। এই প্রথম ছবিটি তাঁর মধ্যে একটা প্রচ- টেনশনের আবেশ গড়ে তুলেছিল। মনে হয়েছিল, এই ছবি দিয়ে কোনো বার্তাই তিনি সমাজে দিতে পারেননি।
কিছুটা সময় নিয়ে ১৯৫৮ সালে পরের ছবি নীল আকাশের নীচে তৈরি করলেন। মাঝখানের সময়টাতে বলা যায় তিনি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। মুক্তি পেল নীল আকাশের নীচে। দর্শকরা সানন্দে গ্রহণ করলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ছবি ফুটে উঠেছিল এই চলচ্চিত্রে। এছাড়াও ছিল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ফ্যাসিজমের বিরোধ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। প–ত জহরলাল নেহ্রম্ন খুব পছন্দ করেছিলেন এই ছবিটি এবং বহুকাল মনেও রেখেছিলেন। যদিও ছবিটি নিয়ে একটা ঝক্কি-ঝামেলা তাঁকে পোহাতে হয়েছিল। সরকারি আমলারা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছবিটি তাঁকে আলোয় এনেছিল সে-সময়। মৃণাল সেনের নামটি যেন অনেকে তখন চিনেছিল। ১৯৬০ সালে বাইশে শ্রাবণ নির্মিত হলো। ষাটের দশকে তৈরি চল্লিশের দশকের যুদ্ধ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ ছিল এই ছবির মূল উপাদান। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের চিত্র এবং দুর্ভিক্ষের এক করুণ সুর ছিল এই ছবিতে। ছবিটির নাম নিয়ে তাঁকে পড়তে হয়েছিল এক বড় বিপাকে। কারণ বাইশে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান দিবস, তাই এই নামে কোনো ছবি হোক তা কেউই চাইছিলেন না। অনেক ভোগান্তির পর বাইশে শ্রাবণ আলোর মুখ দেখে। তিনি এতটাই অনড় ছিলেন যে, কোনোভাবেই নাম পরিবর্তনের কাছে মাথা নত করেননি। দর্শকদের ভীষণভাবে ছবিটি নাড়া দিয়েছিল। মৃণাল সেন এবার বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি সত্যিই ভালো কিছু একটা করতে পেরেছেন; যেটিকে মহৎই বলা যায়। মানুষের সৌন্দর্যকে দুর্ভিক্ষের নির্মম যন্ত্রণা কীভাবে ধ্বংস করছে সেটিকে তিনি উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এই ছবির মধ্য দিয়ে।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি দেখানো হয়েছিল সাবটাইটেল ছাড়াই একটি বিশেষ ছবি হিসেবে। বলা যায় সৌজন্যমূলক প্রদর্শন, যা ছিল প্রতিযোগিতার বাইরে। অর্থাভাবে মৃণাল সেন উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েও যেতে পারেননি। তবে আনন্দে ছিলেন আত্মহারা। অনেক রিভিউ বের হয়েছিল। ডাকযোগে তাঁকে সেগুলো পাঠানো হয়েছিল, যা তাঁকে সে-সময় দারুণভাবে উৎফুলস্ন করেছিল।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের পর ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটার লন্ডন চলচ্চিত্র উৎসবে শুধু ইংরেজি সংলাপে প্রদর্শিত হয়েছিল সেটি। এই ছবি তৈরির পর তিনি অপকটে বলেছিলেন, ‘আমি এখন আবিষ্কার করলাম ছবি কীভাবে বানাতে হয়।’ বাইশে শ্রাবণ ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র দুনিয়ায় তাঁকে প্রবেশ করিয়ে দেয়। ১৯৬১ সালে পুনশ্চ, ১৯৬৩ সালে অবশেষে, ’৬৪-তে প্রতিনিধি মুক্তি পেয়েছিল। দর্শকরা গ্রহণ করেছিলেন ছবিগুলো। ১৯৬৫-তে আকাশ কুসুম আর ১৯৬৬ সালে মাটির মনিষ। বাংলা ও উড়িয়া ভাষায় তৈরি এই ছবিদুটিও জাতীয় পুরস্কার পায়। ছবিদুটি মোটামুটি সাড়া ফেলেছিল। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পেল ভুবন সোম। একটু আলাদা মাপের ছবি। তিনি নিজেও এটা স্বীকার করেছেন, ‘যেন সব দিক থেকে এটা একটা আলাদা মাপের এবং অনেকটাই নতুন আমার কাছে।’ এটি ছিল তাঁর নির্মিত প্রথম হিন্দি ছবি। খুব কম বাজেটের ভিন্ন ধারার এ-ছবিটি দারুণভাবে সাড়া ফেলেছিল। এত অল্প খরচের ছবি তৈরি করা ছবির জগতে একটি রেকর্ড। ভুবন সোম যেন তাঁর নিজেরই একটা গল্প। গল্পটা এরকম – ভুবন সোমের পৃথিবী তার অফিস, ফাইলপত্র, টেলিফোন ইত্যাদি। বিপত্নীক রেল কোম্পানির কর্মচারী ভীষণভাবে বিশ্বাস করে তার নিয়মনীতিতে। সততা, পরিশ্রম, কর্তব্যপরায়ণতা – এসব মূল্যবোধে বিশ্বাসী দীর্ঘদিনের একঘেয়ে কাজ তার মধ্যে এক বিচিত্র অনুভূতি তৈরি করেছিল, যার ব্যাখ্যা সত্যিই কঠিন। তার জীবন যেন কাজ আর কাজ। একটা বিষাদ-যাতনা তার মধ্যে তৈরি করেছিল অন্য কিছু। সবকিছু ফেলে তাকে পালাতে হয়েছিল অবশেষে। এমনই এক গল্প নিয়ে ভুবন সোম। ভীষণ সাড়া ফেলেছিল দর্শকমহলে, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিল। জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল আর ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে হয়েছিল প্রশংসিত।
১৯৭০ সালে ইচ্ছাপূরণ এবং ইন্টারভিউ। ইচ্ছাপূরণ ততটা আলোচিত না হলেও ইন্টারভিউ একদম হিট। ভিন্নধারার কলকাতার টিপিক্যাল মধ্যবিত্তের আশা-নিরাশার গল্প নিয়ে। একটি যুবকের চাকরির ইন্টারভিউকে কেন্দ্র করে এই ছবি। কাহিনির নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কলকাতা শহরের নানা দ্বন্দ্ব, নিষেধ আর এগিয়ে যাওয়ার এক লড়াই। রঞ্জিত মল্লিকের প্রথম ছবি এটি। কলকাতায় বেশ সাড়া ফেললেও ছবিটি ছোট শহরগুলোতে এগিয়ে যেতে পারেনি ততখানি। কিন্তু কার্লো ভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে রঞ্জিত মল্লিক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। এই ছবি করার পর তিনি ভেবেছিলেন আর কোনো ছবি করবেন না; কিন্তু বাস্তবে তা আর হয়নি। ১৯৭১ সালে এক আধুরি কহানি হিন্দি ভাষায় এবং ১৯৭২-এ কলকাতা-৭১ এই দুটি ছবি মুক্তি পায়। বিশেষ জুরি পুরস্কার পায় সানহাইম চলচ্চিত্র উৎসবে। কলকাতা-৭১-এর মূল গল্প ছিল ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনা। কয়েক বছর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাকে ক্যামেরাবন্দি করেন। দারিদ্রে্যর ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, শোকের ইতিহাস এসব নিয়েই কলকাতা-৭১ জাতীয় পুরস্কারসহ আরো দুটি পুরস্কার পেয়েছিল। ছবিটি রমরমিয়ে চলেছিল। ছবিটির ভেতর অন্য এক শক্তি যেন লুকিয়ে ছিল। ১৯৭৩ সালে পদাতিক মুক্তি পায়। সেই ছবিতেও রাজনৈতিক কাহিনিই মূল উপজীব্য। এক রাজনৈতিক যুবকের পলাতক জীবনকাহিনিই ফুটে উঠেছিল। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য হিসেবে
জাতীয় পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়। পরের ছবি ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় – কোরাস। ছবিটি ছিল ভারতীয় ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে। বলা যায়, এটি একটি সাহসী লড়াকু ছবি তাঁর। ছবিটি জাতীয় পুরস্কার, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে রৌপ্য পদকসহ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে ফিপ্রেরেসি (Fipresci) পুরস্কার পায়। ১৯৭৬ সালে মৃগয়া হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয় মুন্সি প্রেমচাঁদের গল্প নিয়ে। এক সাঁওতালি যুবক ও ইংরেজ বয়স্ক আমলার বন্ধুত্ব আর দুজনের শখ শিকার করা নিয়ে মূল গল্প। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা সাঁওতালি যুবকের ফাঁসি এবং তার বিরুদ্ধে সেই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া সব মিলিয়ে এক টানটান গল্পে ভরা ছবি। মিঠুন চক্রবর্তীর এটাই প্রথম ছবি, অর্থাৎ এই ছবির মধ্য দিয়েই তাঁর চলচ্চিত্রজগতে প্রবেশ। মিঠুন চক্রবর্তী শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পান এবং ছবিটি জাতীয় পুরস্কারে মনোনীত হয় শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র হিসেবে। ১৯৭৭ সালে তামিল ভাষায় চিত্রিত হয় ওকা উড়ি কথা। তামিল ভাষায় নির্মিত এ-ছবির বাজার মন্দ ছিল না। জাতীয় পুরস্কারসহ কার্লো ভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসব এবং ওকার্বেজ চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয় ছবিটি।
১৯৮০ সালে মুক্তি পায় পরশুরাম এবং একদিন প্রতিদিন। ভালোই সাড়া ফেলেছিল দর্শকমহলে। দুটি ছবিই জাতীয় পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছিল। এছাড়া পরশুরাম রৌপ্য পুরস্কার পায় মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে। ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় আকালের সন্ধানে, চালচিত্র ও খারিজ। চালচিত্র ছাড়া বাকি দুটি ছবি জাতীয় পুরস্কারসহ আরো অনেক বিদেশি পুরস্কার আনে। ১৯৮৩ সালে খ-হর অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছিল দেশ-বিদেশ থেকে। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম গাইডে বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প ‘তেলেনাপোতা’ নিয়ে এই ছবি নির্মিত হয়। সাবানা আজমি ও নাসিরউদ্দীন শাহসহ গীতা সেনের দুর্দান্ত অভিনয় খ-হরে আলাদা এক মাত্রা যোগ করেছিল। সব মিলিয়ে খুব শক্তিশালী এক ছবি, এ-কথা স্বয়ং মৃণাল সেন অনেকবার বলেছিলেন। খ-হরের পর তিন বছর বিরতি। তারপর ১৯৮৬ সালে ভেনেসিস হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়। এরপর ১৯৮৯ সালে একদিন আচানক মুক্তি পায়। রমাপদ চৌধুরীর গল্প নিয়ে তৈরি এটিও হিন্দি ভাষায় নির্মিত এবং জাতীয় পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে মহাপৃথিবী এবং ১৯৯৪ সালে অন্তরীণ। ডিম্পল কাবাডিয়া ও অঞ্জন দত্তকে নিয়ে খুব সাধারণভাবে নির্মিত। একজন পুরুষ ও একজন রমণীর দারুণ মানবীয় এক গল্প নিয়ে ছবিটি তৈরি। তেমন বাজার না পেলেও দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছিল ছবিটি। জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ বাংলা কাহিনিচিত্র হিসেবে। মাঝে দীর্ঘ বিরতির পর আমার ভুবন নামে তাঁর শেষ ছবি নির্মিত হয় প্রায় আট বছর বিরতির পর। যদিও দেড় বা দু-বছরের বিরতি দিয়ে তিনি ছবি করতেন; কিন্তু কেন সাত বছর বিরতি দিলেন, সেটি মৃণাল সেনের কাছে ছিল অজানা। তবে সাত বছর নতুন ভাবনা তাঁকে নতুন করে ভাবিয়েছিল। আফসার আমেদের উপন্যাস নিয়ে আমার ভুবন তৈরি হয়েছিল। নন্দিতা দাস, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও কৌশিক সেন অভিনয় করেছিলেন তাঁর নির্মিত শেষ ছবিতে। এ ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে নন্দিতা দাস কায়রো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
তিনি শেষ ছবির মধ্য দিয়ে বলে গিয়েছিলেন, পৃথিবীজুড়ে ভাঙাগড়া, ভিন্ন ভিন্ন খেলা, তবু মানুষ বেঁচে থাকে মমত্বে, ভালোবাসায় ও সহমর্মিতায়। চারটি তথ্যচিত্রসহ দূরদর্শন-চিত্র ও অনেকগুলো দূরদর্শন-ধারাবাহিক তিনি ছবির পাশাপাশি নির্মাণ করে গেছেন।
১৪ মে ১৯২৩ থেকে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ এই দীর্ঘ সময় তাঁর পথচলা ছিল পৃথিবীতে। ফরিদপুর থেকে কলকাতায় গিয়ে থিতু হওয়া, জীবনসঙ্গী গীতা সেনের সঙ্গে প্রেম, বন্ধুত্ব, ঘরবাঁধা – সে এক দারুণ গল্প, অনেকটা তাঁর ছবির মতোই। ১৯৮১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ ও ২০০৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদা সাহেব ফালকে তাঁর জীবনে অন্য এক মাত্রা যোগ করেছে, যা ইতিহাস হয়ে থাকবে চিরদিন। চলচ্চিত্র-নির্মাতার বাইরে আরো কিছু পরিচয় তাঁর জীবনকে ঢেকে রেখেছিল অন্যভাবে। তাঁর লেখালেখি ও রাজনৈতিক জীবন সবসময় মানবিকতার এক গল্প বুনে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের জন্য। ১৯৯৭-২০০৩ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ থেকে অনেক অন্ধকার গ্রামে মানুষের জন্য বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে আলোকিত করেছিলেন। খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। আর দশটা মানুষের মতোই ছিল তাঁর প্রতিদিনের জীবন ও গেরস্তপনা। তাই তিনি মৃত্যুর আগেই বলে গিয়েছিলেন তাঁর খুব সাধারণভাবে চলে যাওয়ার পথনির্দেশনা। তাঁর মৃতদেহ যেন কোথাও না রেখে সরকারি-বেসরকারিভাবে ফুলের মালা দেওয়া না হয়। নীরবে যেন তিনি চলে যেতে পারেন এই পৃথিবী থেকে। সত্যি, তাঁর মৃত্যু ও চলে যাওয়া সেভাবেই হয়েছিল।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলে গিয়েছিলেন – ‘ভালো-মন্দের রাস্তা ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত ছবির রাজ্যেই থেকে গেলাম। স্থির মেনে নিলাম যে, ছবির জগতে বিরাট ঝড় ও ভূমিকম্পের পরও আমি আশার অতীত নিয়ে আর ভাবব না আর বেঁচে থাকব হাজার মান-অপমানের বোধ নিয়ে। কালক্রমে চড়াই-উতরাই ডিঙিয়ে এমন এক সমতলে এসে দাঁড়ালাম যখন বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, আমাকে আর পেছনের দিকে তাকাতে হবে না।’
সত্যি তাই, তাঁর ছবিগুলো দর্শকের কাছে রয়ে যাবে অনেক অনেক দিন নৈশালোকে স্বল্পালোকিত পথের দৃশ্য হয়ে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.