মৃত্যুঘোর : আমাদের সব গোলমাল হয়ে গেল হাসনাতদা

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত ‘কেন?’ কবিতায় এই বাক্যগুলো লিখেছিলেন –

কেন অবেলায় যাবে? বেলা হোক, ছিন্ন করে যেও

সকল সম্পর্ক। যেন গাছ থেকে লতা গেছে ছিঁড়ে

একটি বিষণ্ন লোক থাকে যেন হাস্যময় ভীড়ে

কেন অবেলায় যাবে? বেলা হোক, ছিন্ন করে যেও

সকল সম্পর্ক।

এই কবির মতোই, তিন অভিন্নহৃদয় বন্ধু অবেলায় পরপর চলে গেলেন। প্রথমে কয়েক মাস, তারপর দিনের ব্যবধানে। এক বিষাদময় স্মৃতিবিধুর মৃত্যুঘোরে এখন আমরা অনেকেই যারপরনাই ধ্বস্ত হয়ে আছি; এবং আমাদের এই গোলমালের শুরু এক রবিবারের ভোরে, যশোর শহরে এই বিষ বিষ বছরের মে মাসের একত্রিশ তারিখ। যেদিন হাসনাতভাইয়ের এক অভিন্নহৃদয় মুক্তিযোদ্ধা, কমিউনিস্ট সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু, ইকবাল আনোয়ার ফারুক হঠাৎ আমাদের স্তম্ভিত করে চলে যান না-ফেরার দেশে।

এই মৃত্যু আবুল হাসনাতকে খুব ব্যথিত করেছিল। বন্ধুর এই চলে যাওয়া তিনি একদম মেনে নিতে পারেননি। এই অতিমারীর জর্জর অভিশপ্ত বছরটায় মৃত্যুসমারোহ তো লেগেই আছে। প্রতিটি প্রহরই যেন বিষপ্রহর। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী প্রাবন্ধিক শাহানা জামালী দীপ্তির কাছে জেনেছি ফারুকভাইয়ের মৃত্যুর পর হাসনাতদা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ উঠে বসে তিনি নাকি বলে উঠতেন ফারুক আমাদের সঙ্গে এটা করতে পারে না। কী করে ফারুক আমাদের সঙ্গে এটা করতে পারল। ফারুকভাইয়ের মৃত্যুর পর হাসনাতদা আর ফারুকের স্ত্রী দীপ্তিকে ফোন করতে পারেননি। মিনু বউদিকে দিয়ে মা, মেয়ের খোঁজ নিয়েছেন নিয়মমতো দু-একদিন বাদে বাদেই। হাসনাতদা অক্টোবরে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর…

তেইশে নভেম্বর রাত শেষের প্রহরের মৃত্যুবিধ্বস্ত আতঙ্কিত আমি এই মৃত্যুঘোরেই একটা স্বপ্ন দেখতে দেখতে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে যাবার জন্য ছটফট করছি। পয়লা নভেম্বর মধ্যাহ্নে বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেট মেলোডি ফ্লাওয়ার্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছি অস্থিরভাবে। নয়া উদ্যোগের পার্থবাবুর আসার কথা, আসছেন না তো? বড্ড দেরি করেন। পাশের দোকান ফ্লাওয়ার এজেন্ট থেকে বেরিয়ে দোকানি আমায় কিছু বললেন কি? অগ্রজের জন্য ফুল নেব না তা কি হয়? বার্ডস জু-তে পাখিরা কিচিরমিচির করছে। ওরা তো কিছু জানে না। পয়লা নভেম্বর পুরো ঢাকা শহরের সারস্বত সমাজ স্তম্ভ হয়ে আছে অপার বেদনায়। কিচিরমিচির পাখিরা তা জানে না। হৃদয়ই এখন রক্তাক্ত কাঁটাবন হয়ে আছে। কিন্তু শক্তিদা, না কোনো হাস্যময় ভিড় সত্যি নেই। সবাই বি-ষ-ণ্ন। হাসনাতদাকে শেষ দেখা হলো না, কী করে যাবো? এই আকুলতার মধ্যেই ফোনের বাজনায় ঘুম ভেঙে গেল। কবি মাহমুদ আল জামানের কথায় ‘বলিয়ে বাজনা।’ ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি ঘড়িতে আটটা বিয়াল্লিশ আমার ঢাকার বন্ধু ডা. রেখার ফোন (ডা. রোকিয়া খাতুন), পাষাণ কণ্ঠে তিনি বলেন – ‘পাইছেন তো? খবর দিচ্ছি তো।’ আমি বললাম, ‘কী খবর, মুনীরভাই তো ভালো আছেন?’ রেখা সেই গলাতেই বলেন, ‘মুনীর সোয়া সাতটায় চলে গেছে।’ আমি চিৎকার করে উঠি। ‘সে কী? এই সম্পাদক তো ভালো হয়ে উঠছিলেন।’

তিন সদাহাস্যময় প্রতিবাদী নিরহংকারী বন্ধুর পরপর যাত্রার দুঃসংবাদে অনন্ত বিষাদে চব্বিশে নভেম্বর আমি জেগে উঠি। কী হবে। এপারে বসে আমি এখন কী করব? যার জন্য স্বপ্নে অপেক্ষা করছিলাম, আমি ফোন করার আগেই, সেই পার্থবাবুর ফোন এলো। তিনি নতুন মৃত্যুসংবাদ আমি জানানোর আগেই পেয়ে গেছেন। সংবাদের প্রখ্যাত খন্দকার মুনীরুজ্জামানও এ-জগৎ সংসারকে টা-টা করে বন্ধুদের কাছে চলে গেছেন।

পার্থ বললেন, খবরটা আমাকে আমেরিকা থেকে দিঠি হাসনাত জানিয়েছেন। খন্দকার মুনীরুজ্জামান হাসপাতালে ভর্তি হবার কদিন আগে এক বন্ধুকে ফোন করে স্বভাবসুলভ রসিকতায় বলেছিলেন :

– ভাই, একটা সুখবর আছে। সেটা হলো করোনা আমাকেও ধরেছে।

আর পয়লা নভেম্বর রাতের দিকে ফুসফুস সংক্রমণ নিয়ে হাঁপাতে থাকা মুনীরুজ্জামান কী করে যেন হাসনাতভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ জেনে গিয়েছিলেন। খবরে প্রকাশ সেই সংবাদে এত বিপর্যস্ত বোধ করতে থাকেন মুনীরুজ্জামান যে, তাঁরও রক্তে অম্লজানের মাত্রা দ্রুত পড়ে যেতে শুরু করে।

আমার বিষাদ নিষ্কৃতির ভেষজ, অবলম্বন রবীন্দ্র গান এবং কবিতা। কলকাতায় এলে তিন বন্ধুর আড্ডার জায়গা রামগড়ের ফারুকভাইয়ের ফ্ল্যাট। সেখান থেকেই আমাদের কানুবাবু গতকাল ভাগ্যিস আমায় কবি মাহমুদ আল জামানের নির্বাচিত কবিতা এনে দিয়েছেন। আমাকে বেশ কয়েকটি বই, ছবি কলকাতায় উপহার দিলেও হাসনাতদা কখনো ভুলেও এ-বইটির কথা আমাকে বলেননি। এই বইটি হাতে নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে এই বিষাদ প্রহরে আমি  এক ছায়া-নির্জনতায় হারিয়ে যেতে থাকি। যেখানে এক প্রণয়ঋদ্ধ, বিষাদদীর্ণ অশ্রুসিক্ত জাদুবাস্তবতা আছে। কবি এ-বইয়ের প্রথম কবিতায় লিখছেন :

রোদ বৃষ্টি ঝড়ে

যাবতীয় না স্কন্ধে নিয়ে

ছুটে চলেছি

এক পথ থেকে অন্য পথে

মনে পড়ে ১৯৭২-এ কাম সেপ্টেম্বর শুনতে শুনতে

বন্ধুর ক্রূর হাসি, নারীর শোকস্তব্ধ ধূসর চোখ

বালির বাজনার দুঃখ নিয়ে হিমজলের মত প্রত্যাখ্যান।

আজ আর ধর্মযাজকের জামায়

কাফকার রোদ নেই

বোদলেয়ারের বিষাদ নেই

কেমন করে ডাকবে সে প্রভু যিশুকে?

‘উৎসমুখ’ কবিতায় এক অমোঘ আর্তি ফুটে উঠেছে কবির –

খুলে যাচ্ছে উৎসমুখ, খুলে যাচ্ছে

বন্ধ দরোজা

তুমি কি যাবে, তুমি কি নেবে?

দ্যাখো

তারস্বরে চেঁচাচ্ছে নদীর কাছে

আশা আর নৈরাশ্যে

দুলতে দুলতে একটি মানুষ যাচ্ছে উজানে

ব্যাকুলতায়

তার কণ্ঠ

অন্তিম ইচ্ছার মত আছড়ে পড়ছে।

খুলে যাচ্ছে উৎসমুখ, খুলে যাচ্ছে

বন্ধ দরোজা।

অথচ আমাদের উৎসমুখ, উদোম হাট করে খোলা আহ্বানের দরজা বন্ধ করে কবিই চলে গেলেন? অবশ্য তিনি তো যাবার আগে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন এই সত্য –

কোনো একদিন এই বোমার তাপ বিকিরণ থেকে জন্ম নেবে

নীল ফুল

কোনো একদিন কিংবদিন্তর দিনগুলো আবার কথা বলবে

…     …     …

বোমা যতই প্রাণঘাতী হোক

একদিন না একদিন

ফুলের রেণু হয়ে

শার্টের আস্তিন আর শাড়ির আঁচলে লগ্ন হয়ে থাকবে

কোনো একদিন

তিনি জীবনানন্দ দাশকে অনেকের মতোই খুঁজেছেন –

আর আমি

দীর্ঘ তিনদশক দরে খুঁজে বেড়াচ্ছি

জীবনানন্দ দাশকে

আহারিটোলায়, রাসবিহারী এভিনিউর ট্রাম লাইনে কখনো

পার্কে নিঃসঙ্গ মানুষের ভিড়ে

ভূমেন্দ্র গুহের হাতে হাত রেখো।

অনুভব করতে চেয়েছি শরীরের রক্ত সঞ্চালনের মধ্যে

                                                                      জীবনানন্দের

গভীর প্রশান্ত সুখের প্রত্যাখ্যান লেগে আছে কিনা

ট্রামের ঘর্ঘর বাজে বুকে। সবিতা হালদারের প্রেম বুকে নিয়ে

ঘন অরণ্যে ক্যাম্প দেখি, চন্দ্রালোকে নগ্ন নারীর নাচ দেখি

সর্বনাশপন্থী নারী কখন যে অবৈধ সঙ্গম তৃষ্ণায়

কাতর হয়ে ওঠে এও দেখি

জীবনানন্দের ঘেরাটোপে বন্দী

অন্তর্মুখী যুবকের আত্মলীনতা

ছায়া ফেলে আর বলে

কে না খোঁজে জীবনানন্দ দাশকে

কখনো কামুর অভিপ্রায়ে

কখনো কাফকার স্বরূপে।

এরপর আমি একদিন ১৬ আমীর আলী এভিনিউর সামনে দাঁড়াই। সবিতা হালদারের খোঁজ নেব কিনা ভাবি।

তারপর দু’পা পিছিয়ে আসি। না না ঐ কঠিন কাজ

গবেষকদের। যেমন কেউ সারাজীবন বনলতা সেনকে

খুঁজে চলেছেন। কেউ নীরাকে।

সবিতা হালদার-এ আসি। তাঁর কথা বেশ কিছু কবিতায়

এসেছে। মহার্ঘ্য সব লাইন। অনুপম ব্যঞ্জনা, অনন্য

ব্যাপ্তি! –

কেন যে প্রণয়ের স্পর্শে চুম্বন করিনি ঈশ্বর জানে

                                ট্রামের ঘর্ঘর বাজে

সর্বদা বুকে।

১৬ আমীর আলী এভিনিউ থেকে স্তব্ধ দুপুরে

যে পালক খসে পড়েছিল

সেদিনই নির্জনতম নারী শ্বাস-প্রশ্বাসে

ধূসরতার কথা বলেছিল

সবিতা হালদারের মতো

এমন শান্ত, এমন স্নিগ্ধশ্রী

দেখিনি কখনো।

অথচ

ফ্লাইওভারে উড়ে যাচ্ছে সব কিছু

খালাসিটোলা ফিরিঙ্গী যুবতী

স্তব্ধ অলিগলি

কলকাতার বুক; স্বপ্নের জৌলুস

শাড়ির খোলস

ভালোবাসার নিয়মকানুন ও শহরের নিজস্ব প্রকৃতি

আমি খুঁজে চলেছি সবিতা হালদারের স্তব্ধ স্মৃতি।

…     …     …

বিষাদ গাঢ় হওয়া এই স্মৃতি বিস্তৃতির কালো বারান্দায়

২৬ ডিসেম্বরের স্তব্ধ দুপুরে

মনে হলো

প্রেম বুকে বীজ কম্প অন্ধকার নিয়ে সবিতা হালদার এখনও

                                                                           বেঁচে আছে

(‘সবিতা হালদার’, পৃ ৭৮)

এ-কাব্যগ্রন্থে ‘সবিতা হালদার’ নামে দুটি কবিতা আছে। সবিতা হালদারের উল্লেখ আছে আরো দু-একটি কবিতায়। এই অনন্য কাব্যগ্রন্থের আমি কোনো আলোচনা করছি না। কাব্যগ্রন্থের আলোচনা করার স্পর্ধা এবং ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই। তবু এই অবশ্যপাঠ্য কাব্যগ্রন্থটির পাঠ আমাকে বিষাদমুক্ত ও তৃপ্ত করেছে এই কথাটুকুই শুধু আমি জানাতে চাইছি।

এতদিন এই সজ্জন অতিথিবৎসল স্নেহপরায়ণ অগ্রজকে হাসনাতভাই বলে এসেছি। এখন সশ্রদ্ধ নমস্কারে এই অতি বিদগ্ধ অথচ নিরহংকারী সুপণ্ডিত সম্পাদককে দাদা বলে নিরন্তর সম্বোধন না করে গেলে আমার অনিঃশেষ পাপ হবে। হাসনাতদার সঙ্গে কুড়ি বছরের বেশি পরিচয়। কালি ও কলমের সম্পাদককে আমি চিনি, শিল্প ও শিল্পী ত্রৈমাসিকের সম্পাদকেরও নাম আমি জানি অথচ দেখুন কি আহাম্মক আমি, কবি মাহমুদ আল জামানের ছদ্মবেশ আমি জানি না, বুঝতেই পারিনি? কবি মাহমুদ আল জামানকে না চেনার অপরাধের ক্ষমা হয় না। কিন্তু যিনি হেসে পরিহাস ছলে এ কিছুই না বলে এক কথায় ক্ষমা করে দিতেন তিনি এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে বহুদূরের এক গ্রহে। এ মাসের ২৪ তারিখ (নভেম্বর) থেকে আবার দলে মুনীরুজ্জামান যোগ দিয়েছেন। আর আমাদের এদিকে সব গোলমাল হয়ে গেল, সব গোলমাল হয়ে গেল।

প্রচ্ছদের ছবি

মাহমুদ আল জামান কবি ও সাংবাদিক। তিনি আবুল হাসনাত নামেও লেখালিখি করেন। পুরনো ঢাকায় আবুল হাসনাতের জন্ম  ১৯৪৫ সালের ১৭ই জুলাই। সম্পাদকের প্রকাশিক কাব্যগ্রন্থ জ্যোৎস্না দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়, ভুবন ডাঙার মেঘ নধর কালো বেড়াল। প্রবন্ধগ্রন্থ সতীনাথ, মানিক, রবিশঙ্কর অন্যান্যজয়নুল কামরুল সফিউদ্দীন অন্যান্য। শিশু-কিশোরদের নিয়ে রচিত গ্রন্থ : ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, টুকু সমুদ্রের গল্প, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে রানুর দুঃখ ভালোবাসা; কিশোরজীবনী জসীমউদ্দীন, চার্লি চ্যাপলিন সূর্য সেনকালি ও কলমের সম্পাদক, দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী দীর্ঘ চব্বিশ বছর ধরে কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পাদনা করে সাহিত্য সাময়িকীর নতুন রূপকল্প এবং উৎকর্ষ সূচক উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন। কালি ও কলমের ক্ষেত্রেও পত্রিকার মান, উৎকর্ষ নিয়ে আজীবন দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় রেখেছেন। লেখায় রেখায় কালি ও কলমের আভিজাত্য এবং খ্যাতি দুই বঙ্গেই সুবিদিত ছিল। একসময় কলকাতা থেকেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও অসামান্য লেখায় অলংকরণে সমৃদ্ধ কালি ও কলম প্রকাশিত হচ্ছিল। পত্রিকার মান সম্পর্কে সম্পাদকের সর্বদা সজাগ দৃষ্টি ছিল।

আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় কুড়ি বছরেরও কিছু বেশি। আমার অগ্রজ নিপাট সজ্জন মানুষটির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতেও দেরি হয়নি। আন্তর্জাতিক পরিচয় সম্পন্ন ও অনন্য এই সম্পাদককে প্রথম আলাপের সময় থেকেই খুব শ্রদ্ধার চোখে আমি দেখেছি। তাঁকে লেখা দিতে গিয়ে সম্ভ্রমে, ভয়ে দেরি করে ফেলেছি। তিনি হেসে সময়সীমা বিস্তৃত করেছেন। তবু আমার লেখা তিনি আগ্রহভরে বেশ কয়েকবার ছেপেছেন।

হাসনাতদা ষাটের দশকের বাম রাজনীতির একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

তাঁর শিল্প-সাহিত্যে দখল ছিল ঈর্ষণীয়। চিত্র-সংগ্রাহক হিসেবেও তিনি বেশ সম্ভ্রান্ত। আমরা সবাই জানি লেখক, শিল্পী মহলে তাঁর ছিল পরম শ্রদ্ধার আসন, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যা অটুট ছিল। তাঁর প্রয়াণের পরে সে-আসন শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় চিরস্থায়ী হয়ে উঠবে। আবুল হাসনাত কলকাতায় এলে কমিউনিস্ট পার্টির পুরনো মানুষদের খোঁজ করতেন। কলকাতা এবং শান্তিনিকেতন ছিল তাঁর খুব প্রিয় জায়গা। ষাট, সত্তর, আশির দশকে অনেকের মতো তিনিও সমাজতন্ত্রকেই মানবমুক্তির পথ বলে মনে করতেন।

তিনি অন্যের লেখা নিয়ে বলতেন, উপহার দিতেন। নিজের কথা একদম বলতেন না। আত্মবিমুখ, নিরহংকারী কিন্তু প্রতিবাদী তুখোড় প্রাজ্ঞ সম্পাদক। ফেব্রুয়ারিতে একুশে বইমেলায় থেকেও তাঁর হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে ২০২০-র হদিসও আমি পাইনি। হয়তো লেখক হিসেবে আমাকে অগ্রজ সম্পাদক পাত্তা দিলেও, তাঁর নিজের ব্যাপারে সুবিদিত অনীহা থেকেই তিনি তাঁর বইটির কথা আমায় ঘুণাক্ষরে জানতে দেননি, আমারও ফেরার তাড়া ছিল।

‘সত্যি কথা বলতে কি বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের ছাত্র-আন্দোলন যে-মহান পথ সৃষ্টি করেছিল মুক্তিযুদ্ধের, তা প্রত্যক্ষণ ও অংশগ্রহণ জীবনের এক উজ্জ্বল সম্পদ হয়ে আছে। এই মহান সংগ্রামের আমি যে এক অংশী ছিলাম, তা আমার কাছে পরম গৌরবের বিষয়।

তবে এ গর্বও ম্লান হয়ে যায় যখন দেখি মুক্তিযুদ্ধ সমাজে সিঁড়ি ভাঙার সোপান হয়ে ওঠে। বড় কষ্ট পাই তখন, বেদনায় হৃদয় চূর্ণ হয়।

ন্যায় ও নীতিবোধ আদর্শিক চেতনায় ছাপ ফেলেছে, সে জন্য মূল্য দিতে হয়েছে পারিবারিক ও সমাজজীবনে। এই ন্যায় ও ঔচিত্য বোধের কোনো অর্থ পাইনি অনেক সময়। তবু যে আদর্শিক চেতনা সঞ্চারিত হয়েছিল ধমনীতে তা থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করিনি। সর্বদা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার যে শিক্ষা পেয়েছিলাম ছাত্রজীবনে, তা থেকে সরে আসিনি কখনো। জীবন প্রবহমান। জীবনের পথে এখনও হেঁটে চলেছি। দেখা যাক, চলতে কোথায় গিয়ে তা শেষ হয়। পথের শেষ কোথায়? তবু আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ।’

হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজেতে আবুল হাসনাত লিখেছেন এইসব ব্যক্তিগত মূল্যবান স্মৃতির কথা। ‘আমার জীবন কোনো অর্থেই বর্ণময় নয়। সাধারণ ও আটপৌরে। তবে প্রত্যক্ষ করেছি এদেশের মানুষের সংগ্রাম ও বিজয়। এই বিজয় আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাঙালি সমাজকে স্বাজাত্যবোধে উদ্দীপিত করেছে। জাতীয় বিকাশ ও শিল্প সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রকে করে তুলেছে দীপিত।  এ যে কত বড় অভিজ্ঞতা তা বলে শেষ করা যায় না। পুরনো আর্টস বিল্ডিং-এর আমতলা, নতুন আর্টস বিল্ডিং-এর বটতলা আর মধুর ক্যান্টিন এক সময়ে প্রাণভোমরা হয়ে উঠেছিল। এখানেই অনন্য সাধারণ কিছু ছাত্র নেতাকে দেখেছিলাম, প্রত্যয়ে দীপ্ত; ধমনীতে ধারণ করেছিলেন তাঁরা সমাজ বদলানোর অনিঃশেষ শক্তি, যে কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা। জীবন ছিল সরল ও নিরাভরণ।’

আপনার জীবন অবশ্যই বর্ণময় হাসনাতদা। এ-মহাজীবন পথ চলা থামিয়ে অনন্তের পথে যাত্রা করলেও আপনি সারস্বত সমাজকে অনেক কিছুই দিয়ে গেলেন।

বাংলাদেশের বিদগ্ধ অভিনেতা, সফল মঞ্চ-পরিচালক, নাট্য প্রযোজক ও নির্মাতা রামেন্দু মজুমদার আপনার মহাপ্রয়াণে লিখেছেন ‘একজন শুদ্ধতম মানুষের প্রস্থান।’ তিনি লিখেছেন – ‘মাঝে মধ্যে চারদিকের পরিস্থিতি দেখে যখন হতাশ হয়ে পড়তাম, তখন বন্ধুবর মহিদুলকে বলতাম, ইচ্ছা করে হাসনাত হয়ে যাই। আবুল হাসনাত। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পাদক এবং আমার দেখা একজন শুদ্ধতম মানুষ। … জীবনে আমি দেশ-বিদেশে অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। কিন্তু হাসনাতের মতো একজন খাঁটি মানুষ আর দ্বিতীয় কাউকে দেখিনি। ‘নিভৃতচারী’ ও ‘নিরহংকারী’ শব্দ দুটো তাঁর চেয়ে আর কারো বেলায় বোধহয় বেশি প্রযোজ্য হতে পারে না। হাসনাত স্বভাবে ছিলেন নম্র, বিনয়ী ও লাজুক, নেপথ্যে থেকে সব কাজ করতেন, কিন্তু সামনে আসতে চাইতেন না।’

হাসনাতদার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে দু-তিনবার আমি খুব অপ্রস্তুত হয়েছি। মনে হতো লাইনটা হয়তো হঠাৎ যান্ত্রিক কারণে কেটে গেল। আমি আবার ঘুরিয়ে ফোন করে বলতাম, দাদা লাইনটা বোধহয় কেটে গেল। আসলে হঠাৎ ফোন রেখে দেওয়ার একটা নিজস্ব প্রথা তিনি রপ্ত করে নিয়েছিলেন, প্রখ্যাত সম্পাদকের সারাদিন আমার মতো কত লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়! ফোন রেখে দেওয়ার অননুকরণীয় শৈলীতেই বোধহয় সেদিন প্রত্যুষে তিনি এ-গ্রহের সঙ্গেও সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন। রেখে গেলেন অগণিত ভক্ত সমাজ, শিল্প-সংস্কৃতির এক আরাধ্য অবারিত সংযোগ সেতু। তাঁর মৃত্যুতে আশাকরি সেই পথ রুদ্ধ হবে না।

শক্তিদার কবিতায় ফিরি। অবেলায় আপনি, আপনার আগে ফারুকভাই ও পরে মুনীরভাই; তিন বন্ধু ছিন্ন করে চলে গেলেন সব সম্পর্ক! সত্যি এই পরপর মৃত্যু-আঘাতে আমাদের সম্বিত বৃক্ষ থেকে হৃদয় লতাটি গেছে ছিঁড়ে। আমরা সারস্বত সমাজের কর্মীরা আপনাদের চলে যাওয়ার পথে বিষণ্ন চেয়ে আছি। সম্পর্ক কী আর ছিন্ন করা যায়?

শুধু চরাচর ব্যাপ্ত আমাদের ব্যক্তিগত শোক সামলে নেওয়ার আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আপনিও ঠিক করলেন না হাসনাতদা। বন্ধু খন্দকার মুনীরুজ্জামানও না। আর ইকবাল আনোয়ার ফারুক একা একা কী দোষ করল! আমাদের সব গোলমাল হয়ে গেল হাসনাতদা।