মেগাসিটি ঢাকার ভালো-মন্দ

নজরুল ইসলাম

ঢাকা অবিরত পরিবর্তনশীল এক শহর, আর এ-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে, গতি পেয়েছে ১৯৭২-এর পর থেকে, আরো বেগবান হয়েছে আশির দশক থেকে। গতি থামার কোনো কারণ দেখা যায় না, ভবিষ্যতে হয়তো বেগ কিছুটা কমতে পারে।

ঢাকার পরিবর্তনশীলতা এর জনসংখ্যায়, অর্থনৈতিক শক্তিতে, সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে, রাজনৈতিক কাঠামো ও পরিচালন পদ্ধতিতে। পরিবর্তনশীলতা এর ভৌগোলিক পরিসরে। ক্রমাগত এই পরিসর বেড়ে চলেছে। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে। বাড়ছে ওপরের দিকেও। এশিয়ার অন্যান্য মেগাসিটির তুলনায় ঢাকার আকাশমুখী পরিবর্তন অতটা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। সর্বোচ্চ ভবন এখনো চলিস্নশ তলার নিচে। সাংহাই, হংকং, সিঙ্গাপুর বাদই দিলাম, ব্যাংকক, জাকার্তা, কুয়ালালামপুর এমনকি মুম্বাই আকাশের দিকে তাদের লম্বা গ্রীবা বাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে ঢাকার যাত্রাও সেরকমই হবে সম্ভবত। আবার পাতালেও যাবে হয়তো কিছুটা। ইতোমধ্যে এক, দুই বা তিন ফ্লোর পর্যন্ত গেছে, ভবনের। পাতালরেল হবে হয়তো পরে। জাপানের নাগোয়া কিংবা অন্যান্য শহরে কিংবা কোরিয়ার সিওল শহরের কেন্দ্রে যেমন পাতাল শপিং আর্কেড রয়েছে তেমনটি হতে পারে ঢাকাতেও। কিছুটা ইঙ্গিত তো পাই গুলিস্তানের পাতাল পারাপারে।

মোদ্দা কথা, ঢাকা শহরের পরিবর্তনশীলতা খুবই দৃশ্যমান। নতুন-নতুন এলাকা গড়ে উঠছে, আবার পুরনো ঢাকাও দ্রম্নত ভেঙে নতুন করা হচ্ছে। এখনো ব্যক্তিগত মালিকানায় এক তলা, দোতলা ভেঙে বহুতল ভবন হচ্ছে, ভবিষ্যতে হয়তো হবে বৃহৎ বাণিজ্যিক উদ্যোগে, একেকটি বস্নক পুনর্নির্মাণ করে। আসলে এ-কাজটি সরকারি উদ্যোগেও হতে পারত, যেমন হয়েছে সিঙ্গাপুর শহরে। রাজউক বা সাবেক ডিআইটির এমনতর পরিকল্পনা ছিল ‘আরবান রিনিওয়াল’ ধারণায়। কিন্তু সে-পথে এগোয়নি রাজউক, অতএব যা কিছু নবায়ন হচ্ছে, তা মূলত ব্যক্তি খাতেই।

ঢাকার নানাবিধ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি বা ‘ড্রাইভিং ফোর্স’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় একাধিক শক্তিকে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি অবশ্যই অন্যতম (১৯৪৭-এর আড়াই লাখ মানুষের ঢাকা ১৯৭১-এ হয়েছিল ৯ লাখ মানুষের ঢাকা, ২০১৫ সালে একই পরিমাণ এলাকায় ৯০ লাখ মানুষের বসবাস, বৃহত্তর ঢাকা বা রাজউকের ঢাকা তো এক কোটি ৭০ লাখ মানুষের শহর)। ছিল প্রাদেশিক রাজধানী, ১৯৭১ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। বর্তমানে বিশ্বের নবম জনবহুল মেগাসিটি।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির আবার নানা কারণ, অবশ্য গ্রামত্যাগী মানুষের ঢাকামুখী অভিগমনই প্রধান, যার পেছনে আবার কাজ করে গ্রাম ও শহরের মাঝে সুযোগ ও সম্ভাবনার পার্থক্য, গ্রামীণ পশ্চাৎপদতা ও নানা ধরনের

প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঢাকার বিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি গত চার দশকে এই শহরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি। বাংলাদেশের জাতীয় আয় যেমন বেড়েছে, রাজধানী ঢাকার মোট আয় ও সম্পদও বেড়েছে নানাভাবে এবং আরো উচ্চহারে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১৯৭২ সালে ছিল সম্ভবত সর্বোচ্চ ১২০ ডলার, বর্তমানে ১৪০০ ডলারের ওপর। রাজধানী ঢাকার মাথাপিছু আয় অন্যূন ১৫ হাজার ডলার অর্থাৎ অনেক উন্নত দেশের মাথাপিছু আয়ের মতো। শিল্পায়ন, বিশেষত রফতানিমুখী পোশাক খাতের প্রসার, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভাব, কালো টাকার দৌরাত্ম্য, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, নির্মাণ, বিনোদন প্রভৃতি খাতের সম্প্রসারণ, সব কিছুরই অবদান রয়েছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে। প্রকৌশল, স্থাপত্য, প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগের ভূমিকা তো রয়েছেই রাজধানীর উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়।

হাজার বছরের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ শহর ঢাকার পরিচয় নানা সময়ে ছিল নানা রকমের। মোগল আমলে ঢাকা ছিল ‘বাহান্ন বাজার আর তেপ্পান্ন গলির শহর’, ‘বাগ বাগিচা’ আর ‘মসজিদের শহর’, ‘নদী আর খালের শহর’ (‘ভেনিস অব দ্য ইস্ট’), ব্রিটিশ আমলেও সুন্দর ছিমছাম বৃক্ষ-শোভিত রমনা-নীলক্ষেত ইত্যাদির এক ‘রোমান্টিক শহর’ (ব্র্যাডলি বার্ট), পাকিস্তান আমলে ‘মশার শহর’, আর ‘আন্দোলনের শহর’ (‘ভাষা আন্দোলন’, গণতান্ত্রিক বা ভোটের আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন, গণআন্দোলন, সবশেষে মুক্তির আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ), স্বাধীনতা-পরবর্তী ঢাকারও নানা পরিচয়, ‘রিকশার শহর’, ‘বস্তির শহর’, ‘শত নাগরিক সমস্যার শহর’, ‘জনজট, জলজট, যানজটের শহর’, ‘ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার শহর’, ‘নৈরাজ্যের শহর’, ‘অ্যাডোলোসেন্ট শহর’ (ক্যাথরিন মাসুদের দেওয়া শিরোনাম)। নৃ-বিজ্ঞানী নির্মল কুমার বসু কলকাতার পরিচয় দিয়েছিলেন ‘প্রি-ম্যাচিউর মেট্রোপলিস’ (অপরিণত মহানগর) বলে, তাঁর অনুসরণে আমরা ঢাকাকে বলতেই পারি ‘প্রি-ম্যাচিউর মেগাসিটি’ বা ‘অপরিপক্ব মেগাসিটি’ বলে। আমার কাছে মনে হয় মহানগর ঢাকা একটি ‘স্যুররিয়েল’ বা পরাবাস্তব শহর। এখানে এমন কিছু ব্যবস্থা বা পরিবেশ ও প্রক্রিয়া রয়েছে যার ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। এখানে বিত্তের বৈষম্য দিন-দিন বাড়ছেই, আবার অতি-উচ্চবিত্ত ও একেবারে বিত্তহীনের সহ-অবস্থান অটুট রয়েছে, শ্রেণি বা বিত্তভিত্তিক গোষ্ঠী দ্বন্দ-সংঘাত এখনো দৃশ্যমান নয়, হয়তো ভেতরে-ভেতরে হিংসা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ দানা বাঁধছে, বিস্ফোরণ হতেই পারে কখনো। ঢাকার বর্তমান বাস্তবতা এদেশের তরুণ শিল্পীসমাজকে উত্তর-আধুনিক শিল্প-সৃষ্টিতে উৎসাহিত করে। স্থাপত্যশিল্পেও নানা ধারার সমাবেশ দেখা যাচ্ছে, উত্তর-আধুনিক আঙ্গিকেরও। পাশাপাশি বিশাল বস্তি (কড়াইল) বাস্তবতা বিরাজমান। ‘অ্যাবসার্ড সিচুয়েশন’। লন্ডনভিত্তিক ‘ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’-এর শহর বাসযোগ্যতার মানদ– কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরকে চিহ্নিত করা হয়েছে বিশ্বের সর্বনিম্ন (দ্বিতীয় বা তৃতীয়) মানের শহর হিসেবে। তাদের যেসব সূচক, তাতে অবশ্যই ঢাকা বসবাসের চরম অযোগ্য শহর। কিন্তু এমন কিছু সূচক বিবেচনায় আনাই যেত, যাতে করে ঢাকাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় শহর মনে হবে, খুবই বসবাসযোগ্য মনে হবে। এর একটি হলো, কোনো-কোনো ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের ‘ইনফরমাল’ বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দক্ষতার বিষয়টি। আমি উদাহরণ হিসেবে প্রায়ই উল্লেখ করি, ঢাকায় বিয়ের মৌসুমে বিয়েবাড়িতে খাবার পরিবেশনের দক্ষতার বিষয়টি। রাজধানীতে তখন শুক্রবার-শনিবার একসঙ্গে শত-শত বিয়ের অনুষ্ঠানে সব মিলিয়ে হাজার-হাজার এমনকি লাখ লোকের জন্য প্রায় একই সময়ে (সাধারণত রাত সাড়ে আটটার মধ্যে) সব টেবিলে প্রত্যেক অতিথির সামনে গরম বিরিয়ানি বা পোলাও-মাংস পরিবেশন করা হয়। কি আশ্চর্য দক্ষতা! সেই ভোজ গ্রহণে কেউ অসুস্থ হয়েছেন শুনিনি। ‘ইনফরমাল’ খাতের দক্ষতার আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কাঁচাবাজারের কথাও বলা যায়। হাজারো যানজট সত্ত্বেও সকাল নটার আগেই শহরের কয়েকশো কাঁচাবাজারে তাজা শাকসবজি দোকানে সাজানো হয়ে যায়। মাছ, মাংস আসতেও খুব একটা দেরি হয় না।

দ্বিতীয় একটি সুন্দর উদাহরণ ঢাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মধ্যপ্রাচ্যের কথা বাদই দিলাম, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের বড়-বড় শহরে যে-ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসাত্মক সংঘাত ও হত্যাকা–র খবর মাঝেমাঝেই আমরা পাই সেরকম কিছু স্বাধীন বাংলার রাজধানী ঢাকায় দেখি না। ইদানীং কিছু ধর্মান্ধ জঙ্গি-তৎপরতা ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উদার শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানকে কিছুটা কালিমালিপ্ত করেছে বটে। এরকম ঘটনা ও বিশেষ গোষ্ঠীর অপকর্ম আপামর জনগোষ্ঠী মোটেও সমর্থন করে না। অচিরেই আপন শাক্তিতে এ-ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা থেকে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আনায় সমর্থ হচ্ছে। গণজাগরণ মঞ্চের তেজস্বী ভূমিকা ঢাকার এক নতুন উদ্দীপনা।

ঢাকা শহরের তৃতীয় প্রশংসার বিষয়টি হলো ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিচয়। বস্ত্তত ঢাকা পরিপূর্ণভাবে

একটি ‘সাংস্কৃতিক শহর’। আমি বেশ কয়েক বছর আগে আমার একটি রচনায় ঢাকার এই পরিচয়টির কথা উল্লেখ করেছিলাম (ইদানীং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদসহ আরো কেউ-কেউ এরকমটি করছেন)। মূলত ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিচয়, এটি ‘বাঙালি সংস্কৃতির’ একটি মেগাসিটি। বাংলা ও বাঙালির নানান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সমাহার এই শহরে। এরকম একভাষী মহানগর বা মেগাসিটি বিশ্বে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া সত্যি ভার। অবশ্য ক্রমাগত বাঙালির বাংলা ভাষা, বিশেষত শিক্ষিত বাঙালির মৌখিক ভাষা, ‘বাংলিশ’ মতো, অপভাষায় রূপান্তরিত হচ্ছে। বাঙালির অপর এক মেগাসিটি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা; তবে সেটি আর এখন ঢাকার মতো এত বেশি ‘বাঙালি শহর’ নয়, অবাঙালি জনগোষ্ঠী ও অবাঙালি সংস্কৃতি সেখানে বেশ প্রাধান্য বিস্তার করছে, ঢাকার তুলনায়।

ঢাকা শহরে বাঙালি সংস্কৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত অবশ্যই বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন। গত চার দশকে নববর্ষ উদ্যাপন রমনার বটমূল থেকে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। বলা যায় সারা দেশময়। এত ব্যাপক আকারে সংগীত, (এমনকি নৃত্যকলাও), কবিতা আবৃত্তি, বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদির প্রচলন ও জনপ্রিয়তা, ঢাকার এক অসাধারণ রূপ তুলে ধরে। একই ঘটনা ঘটে একুশে ফেব্রম্নয়ারি উদ্যাপন উপলক্ষে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, বিশেষ করে দুই ঈদ, দুর্গাপূজা, জন্মাষ্টমী, বুদ্ধের জন্মতিথি, খ্রিষ্টীয় বড়দিন, এ সবকিছুই ঢাকার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ। তখন আদিবাসীদের

সংস্কৃতি চর্চাও হচ্ছে ঢাকা শহরে। সংগীতচর্চায় রবীন্দ্র, নজরুল, লালন বা আধুনিক পপ, যাই হোক, ব্যাপকতা পেয়েছে। বিগত কয়েক দশকে এমনকি উচ্চাঙ্গসংগীতের পাঁচ দিনব্যাপী সম্মেলন হচ্ছে। নাটক জনপ্রিয় হয়েছে, নাটকপাড়া হয়েছিল, এখন শিল্পকলায় নাট্যমঞ্চ হচ্ছে। চিত্রশিল্পের কথা বলতেই হয়। এত নিম্ন-আয়ের দেশ, মধ্য-আয়ের স্তরে পা রাখার আগেই, চিত্রকলার অসাধারণ প্রসার ঘটেছে এই শহরে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চিত্রশালা বা আর্ট গ্যালারি চিত্রপ্রদর্শনী করছে। মাঝেমাঝে পাঁচ-সাতটি প্রদর্শনী একইসঙ্গে আয়োজিত হচ্ছে। ১৯৮১ সাল থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী, যেখানে ত্রিশ থেকে চলিস্নশটি দেশ অংশগ্রহণ করে থাকে। এটির উদ্যোক্তা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী। পাশাপাশি কয়েক বছর থেকে ‘ঢাকা আর্ট সামিট’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ব্যক্তি-উদ্যোগে।

সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়, বিশেষ করে সাহিত্যচর্চায়, ঢাকার পরিচয় প্রশংসনীয়। একুশকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী মেলার অতুলনীয় দৃষ্টান্ত বিশ্বের কম মেগাসিটিতেই পাওয়া যাবে। প্রায় তিন দশক ধরে ফেব্রম্নয়ারির শুরুতে দুদিনব্যাপী কবিতা সম্মেলন হচ্ছে। অধুনা ‘হে ফেস্টিভাল’ বা, ‘ঢাকা লিটারারি ফেস্টিভাল’ জাতীয়-আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা প্রসারে ঢাকার ক্রমবিকাশ ও বর্তমান অবস্থান উল্লেখযোগ্য। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অর্ধশতকের বেশি। গুণের বড়াই করা যাবে না, কিন্তু সংখ্যাবিচারে এই তথ্য তৃপ্তিদায়ক।

খেলাধুলাও সংস্কৃতির অঙ্গ। অন্তত ক্রিকেটে বাংলাদেশ বিশ্বের মাঠে নিজের সম্মানজনক অবস্থান করে নিয়েছে। ক্রিকেটের অন্যতম মঞ্চ এখন ঢাকা শহর। রাজধানী ঢাকায় এখন নানা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খাবার-দাবারের আকর্ষণীয় রেসেত্মারাঁ-সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে।

সব মিলিয়ে ঢাকা এখন একটি চমৎকার সাংস্কৃতিক শহর। বাঙালিত্ব এই সংস্কৃতির মূল পরিচয়, তবে বিশ্বায়নের এই যুগে ক্রমাগত ঢাকা সমকালীন ও আধুনিকতার গুণে গুণান্বিত হচ্ছে। বলাবাহুল্য পৌনে দুই কোটি মানুষের এই শহরে, বিশেষ করে যার অধিকাংশ মানুষ গ্রাম থেকে অভিবাসিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী, গণসংস্কৃতির নানা উপাদান প্রাধান্য রাখে। আধুনিক নাগরিক

সংস্কৃতির একটা প্রধান ধারা অবশ্যই উদার সেক্যুলার চিন্তা-চেতনার অধিকারী, তারা সাধারণত নগর জনগোষ্ঠীর আরেকটি বড় অংশ অধিকতর ধর্মাশ্রয়ী বা রক্ষণশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে বেশ দূরত্বে অবস্থান করে, দুদলের সাংস্কৃতিক বিচরণ ক্ষেত্রও অনেকটা ভিন্ন। একদল

মসজিদ-আশ্রয়ী, অন্যদল হয়তো নাট্যশালা বা সংগীতানুষ্ঠানমুখী। বিত্ত-শ্রেণি অনুযায়ী সংস্কৃতিচর্চাও ভিন্ন প্রকৃতির। গুলশান আর পাশের কড়াইলের সংস্কৃতিতে যোজন-যোজন দূরত্ব।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সংস্কৃতি বিকাশের একটি শর্ত বটে। এক্ষেত্রে ঢাকার অর্জন প্রশ্নবিদ্ধ। তবে এ-বছর মেয়র নির্বাচন প্রায় নির্বাসিত গণতন্ত্রকে কিছুটা হলেও ফিরিয়ে এনেছে। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুজন নবনির্বাচিত মেয়র জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নগরের বাসযোগ্যতা বাড়ানোর আন্তরিক চেষ্টা চালাচ্ছেন। বেশকিছু সাফল্য ইতোমধ্যে পেয়েছেন, বিশেষ করে ব্যাপকভাবে সৌন্দর্যহানিকর কদর্য বিলবোর্ডগুলো সরাতে পেরেছেন। কিন্তু তাদের পাশাপাশি দুই সিটি করপোরেশনের ৯২ জন (নির্বাচিত) কাউন্সিলরের সেরকম কার্যতৎপরতা চোখে পড়ছে না। তারা যতটা না জনসেবক তার চেয়ে বেশি আত্মসেবক বা দল তোষণকারী।

সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিচালনায় অবশ্য বিভিন্ন মাত্রার স্থানিক পরিসর (বা ‘স্পেস’) প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ঢাকার জন্য গর্বের কিছু জায়গা থাকলেও ব্যাপক অর্থে মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। রমনার সাংস্কৃতিকবলয় খুব স্বচ্ছন্দে গড়ে উঠছে না। বেশিরভাগ এলাকায়ই কোনো উন্নত সাংস্কৃতিক স্পেস নেই। এমনকি ছোটদের খেলার মাঠও নয়। বিশাল উত্তরা মডেল টাউনে একটি সিভিক সেন্টার নেই। পাবলিক লাইব্রেরি নেই। সিনেমা হল পর্যন্ত নেই, থিয়েটার তো দূরের কথা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও স্বাধীনতা-স্তম্ভ শহরের

সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছে। শাহবাগ থেকে টিএসসি, বাংলা একাডেমি ও দোয়েল চত্বর হয়ে কার্জন হল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঢাকার সাংস্কৃতিক পরিসর হিসেবে কার্যকর দীর্ঘকাল ধরে। অবশ্য প্রস্তাবিত মেট্রোরেলের রুট ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে নির্মিত হলে গোটা এলাকার সাংস্কৃতিক পরিবেশ একেবারে ভিন্নমাত্রায় রূপান্তর হয়ে যাবে, এবং তা খুব একটা কাঙিক্ষত হবে মনে হয় না। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ বা লালনের চেয়ে যোগাযোগ-উন্নয়নের বাস্তবতা অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। এরকমটি ভাবাই যায়, মেট্রোরেলের রুট পরিকল্পনার সময় ক্যাম্পাসের বা বাংলা একাডেমির সাংস্কৃতিক পরিসরের বিষয়টি আলোচিতই হয়নি, শ্রদ্ধাভাজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণও সমস্যাটি নিয়ে ভাবেননি। অতিসম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক মেট্রোরেল রুট নিয়ে যে-অভিযোগ তুলেছেন, তা হয়তো খুব একটা গুরুত্ব পাবে না, তাদের দাবির যৌক্তিকতা থাকলেও আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় – ক্রমান্বয়ে ঢাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত পরিসর, এমনকি অনুষ্ঠান-ক্ষেত্রগুলোও ব্যক্তিগত মালিকানায় চলে যাচ্ছে। স্বার্থ অবশ্যই বাণিজ্যিক।

একটি শহরের বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রশংসনীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়, পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ও শহরের মর্যাদা বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু একইসঙ্গে সম্পদ ও বিত্তের বৈষম্য শহরের সার্বিক সামাজিক সৌন্দর্য নষ্ট করে। শহর উন্নয়নের কথা বলার সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কথা ভুলে থাকি। এমনকি শহরের দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো (স্ট্রাকচার) পস্ন্যান প্রস্ত্তত করার সময়ও এমনটি ঘটে। মেগাসিটি ঢাকার জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি যে ২০১৬-২০৩৫ সালের জন্য ২০ সাল মেয়াদি স্ট্রাকচার পস্ন্যানের খসড়া প্রকাশ করেছে, তাতেও আর্থ-সামাজিক কাঠামোর বাস্তবতাকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। মহানগরের অন্যূন এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যে দরিদ্র ও বস্তিবাসী, অতি নিম্নমানের বা একেবারে মানহীন জীবনযাপন করে, তাদের জন্য আগেও যেমন খুব একটা দৃষ্টি দেওয়া হয়নি, নতুন পরিকল্পনাতেও তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়নি। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের কোল ঘেঁষেই যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বস্তি কড়াইলের অবস্থান এবং সেখানকার ৯৪ একর জমিতে এক লাখেরও বেশি মানুষের  বসবাস, তাদের ভবিষ্যৎ একেবারেই অনিশ্চিত, মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে তাদের বসবাস। এই বস্তি নিয়ে প্রচুর সামাজিক গবেষণা হয়েছে, শৈল্পিক ফটোগ্রাফি হয়েছে, সেই আলোকচিত্রের বই ছাপা হয়েছে, প্রভাবশালী কূটনীতিক ও শিল্পরসিকদের জন্য সেসব ছবির ঘরোয়া প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু এই বস্তির মানুষদের জন্য কোনো মানবিক পুনর্বাসন বা বস্তি-উন্নয়ন পরিকল্পনার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শুধু কড়াইল বস্তিই নয়, আরো অসংখ্য বস্তি রয়েছে ঢাকায় এবং সেগুলোতে বাস করে আরো লাখ-লাখ মানুষ। তাদের কথাও ভাবতে হবে নগর-নেতৃত্ব ও নগর-পরিকল্পনাবিদদের। গবেষকদের পাশাপাশি খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেন কিংবা প্রভাবশালী সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বস্তিবাসীদের স্বার্থরক্ষায় বারবার উদ্যোগ নিলেও বস্তিবাসীর পক্ষে সংসদে আইন পাশ হয় না, বস্তির উন্নয়নে কর্মসূচিও গৃহীত হয় না।

যে-কোনো শহরের বাসযোগ্যতার অন্যতম প্রধান শর্ত সে-শহরের পরিবহন বা চলাচলে দক্ষতা। এদিক থেকে ঢাকা মহানগরের মান যে-কোনো বিচারেই অত্যন্ত নিম্ন-পর্যায়ের। সম্প্রতি পরিবহন খাতের উন্নয়নের জন্য নানা রকম পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু কোনো কিছুই খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। নগর পরিবহন খাতে চরম ব্যর্থতার পেছনে প্রধান কারণের মধ্যে রয়েছে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ পর্যায়ের উন্নয়ন রূপরেখার অসম্পূর্ণতা, রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব, বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্তদের অদক্ষতা, নিষ্ঠা ও সততার অভাব। অপ্রয়োজনীয় অথবা কম অগ্রাধিকারের মেগা-প্রকল্প গ্রহণে উৎসাহ ও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে যেমন আর্থিক ক্ষতি, তেমনি হচ্ছে জনদুর্ভোগ। উদাহরণস্বরূপ মগবাজার ফ্লাইওভার বাস্তবায়নে জটিলতা ও ব্যয় বৃদ্ধি, মেট্রোরেল রুট পরিকল্পনায় অদূরদর্শিতা, এমনকি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হাতিরঝিল প্রকল্পেও পয়ঃদূষণ সমস্যার কথা বলা যায়।

শহরের বসবাসযোগ্যতার বিশেষ আরেক শর্ত, পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন। এক্ষেত্রে ঢাকা মহানগরীর পরিস্থিতি ভয়াবহরকম সংকটময়। এ-নিয়ে আন্দোলন চালিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), নগর গবেষণা কেন্দ্র, পস্ন্যানার্স ইনস্টিটিউট, স্থপতি ইনস্টিটিউট ইত্যাদি সংস্থা। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহানও বাংলাদেশের পরিবেশ-সংকট নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, তিনটি পরিবেশ সমস্যা দেশের জন্য খুব বড় চ্যালেঞ্জ। তিনটি সমস্যাই ঢাকাকেন্দ্রিক। প্রথম সমস্যাটি হলো চরম দূষণ সৃষ্টিকারী হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তরবিষয়ক, দ্বিতীয় সমস্যা বুড়িগঙ্গা নদীর পানির মারাত্মক দূষণ ও তৃতীয় সমস্যা ঢাকার অভ্যন্তর ও চারপাশের নদী, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাট করে অবৈধ আবাসন ও অন্যান্য বাস্ত্ত-উন্নয়ন। বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে উপলব্ধি করা যাবে যে, সাংস্কৃতিক পরিসর অবস্থান হোক, বৈষম্য দূরীকরণ কিংবা বস্তি-উন্নয়ন কর্মসূচি হোক অথবা পরিবেশ সংরক্ষণ সমস্যা মোকাবিলার বিষয় হোক, ঘুরেফিরে সমস্যার মূলে পাওয়া যাবে প্রকৃত অর্থের সুশাসনের অভাব। নগর-পরিকল্পনায় সরকারের সদিচ্ছা, দক্ষতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, ব্যাপকভাবে নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, উন্নয়নের জন্য আর্থিক সম্পদ সংগ্রহ করা ও মানবসম্পদ সমৃদ্ধ করা এবং নগর-উন্নয়নসংশিস্নষ্ট সব সংস্থার মধ্যে অর্থপূর্ণ সমন্বয় সাধন করা, ইত্যাকার বিষয় সবই সুশাসনের শর্ত। সব কিছুর ওপর অবশ্য প্রয়োজন আদর্শ নগর-নেতৃত্বের। এই নেতৃত্ব একক ব্যক্তিরই হতে হবে এমন নয়। একটি পর্ষদেরও হতে পারে।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, বর্তমানের পৌনে দুই কোটি মানুষের মেগাসিটি ঢাকা ২০৩৫ সালের মধ্যেই ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের শহর হবে এবং বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালে এই সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির এক দানবীয় আকার ধারণ করবে। মেগাসিটি ঢাকার ভবিষ্যৎ ভালো-মন্দের চিন্তা মাথায় রাখতে হবে সবারই।