যে -সবুজ প্রকৃতিকে খুব বেশি ভালোবাসতেন হাসান সাহেব, যে-বনফুল আর পাখি তাঁকে বলত অনেক আশ্চর্য রূপকথা, যে-সাদাকালো মেঘের দল তাঁর কাছে ছিল প্রকৃতির এক বিস্ময়কর বিমূর্ত ক্যানভাস; আজ সবই যেন মনে হচ্ছে অতি ক্লান্তিকর। মসিত্মষ্কের প্রতিটি কোষ ক্লান্ত, চেতনার নদী থেমে গেছে, জমাটস্তব্ধ ইউরেনিয়ামের মতো স্থবির ও ভারি হয়ে আছে তাঁর মন; এই মন নিয়ে আর হাঁটতে পারছেন না তিনি।
হাসান সাহেব নিউমার্কেটে একা একা ঘুরছিলেন, তিনি ইচ্ছা করেই দু-সপ্তাহের ছুটি নিয়েছেন অফিস থেকে। এই ছাপ্পান্ন বছর বয়সে সব অবসাদ যেন তাঁর শরীরের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়েছে; অন্তহীন কালো মেঘ যেন তাঁর মনের আকাশে স্থির হয়ে আছে। কিছুই তাঁর ভালো লাগে না। অথচ মাত্র ছমাস আগেও তিনি ছিলেন অন্য মানুষ। সবার কাছেই তিনি কাজপাগল, অ্যানার্জিটিক মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন। অথচ ইদানীং অফিসে কাজ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, তিনি যেন গুলিয়ে ফেলছেন সবকিছু, মনে হচ্ছে সব কাজ বন্ধ করে আকাশ দেখাই ভালো। মতিঝিলে একটি আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করছেন প্রায় সাতাশ বছর ধরে। খুব বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া একদিনও অফিস কামাই করেননি। এই অফিসে তিনি ঢুকেছিলেন একজন কেরানি হিসেবে। আপন কর্মদক্ষতায় তিনি এখন এই প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ পরিচালক। এই শহরের অনেক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয়; আর পত্রিকা ও বেতার-টেলিভিশনের লোকদের সঙ্গে তাঁর আছে বিশেষ খাতির। প্রায়ই তিনি বিশিষ্ট সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে আড্ডা দেন, চা খাওয়ান, যাওয়ার সময় তারা স্বেচ্ছায় অফিসের কোনো প্রেস রিলিজ পকেটে করে নিয়ে যান। বাস্তবিক এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ পরিচালক হাসান শফিকের দক্ষতার কারণে প্রতিষ্ঠানের নাম ও কর্মতৎপরতার খবর দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সেই উচ্ছল-প্রাণবন্ত মানুষটি ছমাস ধরে নিজের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করছেন। কারণটা কি শারীরিক না মানসিক?
পারিবারিক জীবনে তিনি উদার ও শান্তিপ্রিয়। স্ত্রীর হাতেই সংসারের সব দায়িত্ব। স্ত্রী নাজমা হাসান দেশের একজন বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পী, মেয়ে সুস্মিতাও মায়ের পথ অনুসরণ করে কোনো এক ওস্তাদের কাছে ক্লাসিক্যাল গানের তালিম নিচ্ছে। এই রাগ-রাগিণীর গান বড় প্রিয় হাসান শফিকের, প্রায়ই রাতে সিডিতে যখন তিনি বহু পুরনো ওস্তাদ করিম খান বা আমীর খানের কণ্ঠে ভৈরবী, ইমনকল্যাণ কিংবা আশাবরী রাগ শোনেন, তখন তিনি অন্য এক পৃথিবীর বাসিন্দা। তখন সুন্দরী স্ত্রী ও স্নেহময়ী কন্যা কাউকেই মনে থাকে না। এমনই এক সংস্কৃতিমনা ও রুচিশীল ভদ্রলোক হাসান শফিকের মন বিকল হয়ে যাচ্ছে ছমাস ধরে। এর কারণ কী? ড. আবু তাহের? তাহের তাঁর পরম বন্ধু ও শুভাকাঙক্ষী। হাসান জানেন নাজমার প্রতি একটু আলাদা ধরনের দরদ কিংবা টান আছে তাহেরের; কিন্তু এতে দোষের কী আছে? নাজমার অনেক গুণ, উচ্চাঙ্গসংগীতের গুণীশিল্পী, সেই সঙ্গে যথেষ্ট সুন্দরী। তাঁর এত বড় শিল্পী হওয়ার পেছনে হাসান সাহেবের অবদান অনেকখানি; সেই পাবনা শহরের সাধুপাড়া থেকে তরুণী নাজমাকে বিয়ে করে এনেছিলেন তিনি, তখন নাজমার শরীর ও মনে ছিল মফস্বলের সরল লাবণ্য, তিনি তাঁকে অনেক ঘষে-মেজে বৈদগ্ধ্য দান করেছেন। তখন নাজমা কেবল ম্যাট্রিক পাশ করেছে এবং হারমোনিয়াম বাজিয়ে কেবল রবীন্দ্রসংগীত ও আধুনিক গান গাইতেন। সেদিনের নাজমার সঙ্গে এখনকার নাজমার অনেক তফাৎ। এখন নাজমা যেন কোনো অচিন রাগিণীর ঘুম ভাঙাতে গভীর সাধনায় ডুবে থাকে প্রতিমুহূর্তে। স্ত্রীর দুটি উচ্চাঙ্গসংগীতের সিডি বেরিয়েছে ‘পিন্টু গ্রম্নপের’ পৃষ্ঠপোষকতায়। ‘পিন্টু গ্রম্নপের’ মালিক আলী আহমদ পিন্টু। এ-দেশের সংগীত ও চিত্রকলার একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। তিনি নিজে কয়েকবার সস্ত্রীক এসেছেন হাসান সাহেবের বাসায়। নাজমার কণ্ঠে কোনো ঠুংরি বা খেয়াল কাছে বসে শুনেছেন। এমন গুণী ও সুন্দরী নাজমাকেও ইদানীং কখনো কখনো হাসান সাহেবের মনে হয় ভীষণ অচেনা। আর মেয়ে সুস্মিতাকেও মনে হচ্ছে যেন সে তাঁর নিজের মেয়ে নয়। তাঁর হঠাৎ মনে হয়েছে, ড. আবু তাহেরের সঙ্গে সুস্মিতার চেহারার কোথায় যেন মিল আছে।
ছমাস আগে অফিসে বসে কয়েকটা ফাইল দেখছিলেন হাসান সাহেব। তাঁর সামনে বসে ছিল তাঁরই বিভাগের সহকারী পরিচালক খালেদ হোসেন। খালেদ দুবছর ধরে এ-অফিসে কাজ করছে। অফিসে প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়। সেদিন ফাইল নিয়ে যাওয়ার সময় খালেদ বলল, ‘স্যার আগামী মাসে কক্সবাজারে উপজাতীয় হস্তশিল্পের মেলা হবে আমাদের উদ্যোগে। তখন আপনার সঙ্গে আমি যেতে চাই।’
হাসান অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘ঠিক আছে চেষ্টা করব আপনাকে সঙ্গে নিতে।’ আসলে উপজাতীয় হস্তশিল্পের ওই মেলার কথা তাঁর একেবারেই মনে ছিল না। তিনি কিছুদিন ধরে এক জটিল বিষণ্ণতায় ডুবে আছেন, আসলে সঠিক কী ভাবছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। হঠাৎ তাঁর মনে হলো, তাঁর এই সহকর্মীটির নাম মনে পড়ছে না। কী যেন নাম, তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না নামটি। এবার নিজের এই অসামর্থ্য ঢাকতে একটু সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন হাসান সাহেব। তিনি তাঁর সহকর্মীকে ডাকলেন, ‘এই যে শুনুন।’
খালেদ একটু আশ্চর্য হয়ে পেছন ফিরল। বলল, ‘স্যার, আমাকে ডাকছেন?’
‘হ্যাঁ আপনাকেই। একটু বসুন।’ হাসান বললেন।
খালেদ একটু কৌতূহল নিয়ে হাসানের সামনে গিয়ে বসল।
হাসান একটু খুক করে কাশলেন, তারপর বললেন, ‘আপনার বাবা-মা বেঁচে আছেন?’ খালেদ বলল, ‘জি, আলস্নাহর রহমতে দুজনেই বেঁচে আছেন।’ এবার হাসান বললেন, ‘আপনার সম্পূর্ণ নাম কী?’ খালেদ এবার রীতিমতো বিস্মিত হলো, বলল, ‘আমার নাম খালেদ হোসেন।’ হাসান বললেন, ‘তাই নাকি? আমার ধারণা ছিল, ‘আপনার নাম খালেদ খান। ঠিক আছে যান।’
খালেদ ফাইল নিয়ে তাঁর নিজের ঘরে ফিরে গেল। তার মনে হলো, স্যার হয়তো কোনো ব্যক্তিগত সমস্যায় ভুগছেন। তাই এমন অন্যমনস্ক। কিন্তু হাসান শফিক সেদিন থেকেই বুঝতে পারছিলেন, কোথায় যেন মনের মধ্যে এক গভীর জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। মনের মধ্যে মিটমিট জ্বলছে যে-স্মৃতির চেতনা তা যেন ক্রমেই ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে যাচ্ছে। হাসান সেদিন বাসায় ফিরে দেখলেন, তাহের বাসায় আগে থেকেই হাজির। হাসানের সব বন্ধুই নাজমাকে ‘ভাবি’ বলে ডাকেন, শুধু তাহের তাঁকে সরাসরি ‘নামজা’ বলে ডাকেন আর ‘তুমি’ বলেন। এ-নিয়ে হাসানের কোনো অভিযোগ ছিল না। তিনি প্রগতিশীল উদারপন্থী মানুষ, তাহেরের আচরণের ব্যাপারে যেখানে নাজমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই, সেখানে তাঁর আপত্তি থাকবে কেন! আসলে তাহের তাঁকে যেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করেন, তার স্ত্রী নাজমাকেও হয়তো তেমনই বন্ধু মনে করেন। এছাড়া নাজমার জন্য তাহেরের মনে একটা ‘সফট কর্নার, আছে – এ-ব্যাপারটা হাসান অনেকদিন আগেই অনুভব করেছেন।
তাহের বললেন, ‘তোমার জন্য বসে থেকে অনেক দেরি হয়ে গেল। আজ আমাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সেতারের প্রোগ্রাম আছে। ইন্ডিয়া থেকে একজন ভালো ওস্তাদ এসেছেন।’
হাসান খুব ক্লান্তবোধ করছিলেন, বললেন, ‘আজ আমি কোথাও যাব না। তুমি বরং নাজমা আর সুস্মিতাকে নিয়ে যাও।’
নাজমা আর সুস্মিতা আগে থেকে সেজেগুঁজে বসে আছে, সুস্মিতা মায়ের মতোই সুন্দর হয়েছে। তাহেরের গাড়িতে বসে ওরা দুজন চলে গেল গণসংস্কৃতি কেন্দ্রে। ড. আবু তাহের নিজ উদ্যোগে ধানম–তে ‘গণসংস্কৃতি কেন্দ্র’ নামে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন, এই কেন্দ্রের প্রধান উদ্দেশ্য, সংগীত ও চিত্রকলাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অডিটরিয়ামে প্রায়ই উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠান কিংবা চিত্রকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাহের বছরে দু-তিনবার সেমিনার কিংবা ব্যক্তিগত সফরে দেশের বাইরে যান। এ-দেশের গানের ভুবনে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবী, সংগীত বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনার কিংবা অনুষ্ঠানে তিনি একজন অপরিহার্য বক্তা।
সে-রাতে টেলিভিশন দেখতেও হাসানের ভালো লাগছিল না। এক গভীর ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি সোফায় বসে উপন্যাস পড়তে শুরু করলেন; তারপর অর্ধঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকলেন। বেশ রাতে তিনি নিচে গাড়ির শব্দ শুনতে পেলেন; দোতলার জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলেন, গাড়ি থেকে নামছে তাহের, নাজমা ও সুস্মিতা। সে-রাতে নাজমা ও সুস্মিতার সঙ্গে সামান্য কথা বলার পর হাসানের মনে হলো, সুস্মিতার চেহারার সঙ্গে তাহেরের চেহারার বেশ মিল আছে। হাসান চিমত্মা করে দেখলেন, গত চবিবশ বছর ধরে তাঁর বিয়ে হয়েছে এবং গত চবিবশ বছর ধরে তাহের তাঁদের পরিবারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁদের পরিবারের অনেক বিপদের দিনে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন ড. আবু তাহের। তাঁর কাছে হাসান যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। এভাবে আলো-আঁধারে দিন কেটে যায়। প্রতিদিন সূর্য উঠে পূর্ব আকাশে, হাসান যথারীতি অফিসে আসেন। সন্ধ্যায় ঘরে এসে দেখেন, নাজমা ও সুস্মিতা তানপুরা বাজিয়ে রেওয়াজ করছে; সুরের সাধনায় ওদের চোখ বুজে আছে কোনো এক অচিন রূপসাগরে ডুব দিয়ে। কাজের মেয়েকে চা বানাতে বলে হাসান সোফায় বসে নিজের ব্যক্তিগত বিষণ্ণতায় ডুবে যান। এভাবেই দিন চলে যায়। তার এই বিস্মৃতির প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছিল; কাজের মেয়ে তসলিমাকে তিনি কখনো ডাকেন রহিমা, কখনো ডাকেন সখিনা। হাসানের নিজেরও মনে হচ্ছিল বিস্মৃতির এই ভয়াবহ ব্যাপারটা নিয়ে কোনো ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করতে। নাজমার কাছেও ব্যাপারটি যেন একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, সে তাহেরের সঙ্গে আলাপ করল ব্যাপারটি নিয়ে। তাহের বললেন, ‘আমার পরিচিত একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন, প্রফেসর নূরুল আমিন, চলো তাঁর কাছে যাই।’ যথারীতি দু-তিনদিন পরে হাসানকে সঙ্গে নিয়ে তাহের ও নাজমা গেল উত্তরায় প্রফেসর নূরুল আমিনের চেম্বারে। ডাক্তার রোগীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে ও তাকে পরীক্ষা করে তাহেরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইটস অ্যা কেস অব অ্যালঝেইমার। নিকটজনের সহযোগিতা ও ভালোবাসাই এ-রোগের প্রধান ওষুধ।’ প্রফেসর আমিন দু-একটা ভিটামিনের ওষুধ লিখে দিলেন এবং রোগীকে সবসময় ব্যস্তরাখার পরামর্শ দিলেন। তাহের বাইরে এসে বললেন, ‘হাসান খুব গান ভালোবাসত। এখন থেকে ও আমাদের গানের অনুষ্ঠানে কোনো দায়িত্ব পালন করবে।’ রাতে চিকিৎসকের চেম্বার থেকে তাহের যখন নাজমা আর হাসানকে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিলেন, তখন নাজমা বলল, ‘আই অ্যাম রিয়েলি গ্রেটফুল টু ইউ তাহের।’ তাহের বললেন, ‘কিসের গ্রেটফুল? এতো আমার দায়িত্ব।’
এরপর ঠিক হলো সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বড় বড় উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে হাসান খাবার পরিবেশনের ব্যাপারটি তদারক করবেন। ইতিপূর্বে ঢাকার সংগীতপ্রেমী বিত্তবানদের স্ত্রীরা পালাক্রমে এ- দায়িত্বটি পালন করতেন। তাহের ব্যবস্থা করলেন, অনুষ্ঠানের খাবার যেখান থেকেই আসুক না কেন, তা পরিবেশনের তদারকের দায়িত্বে থাকবেন হাসান। সাধারণত কোনো কোনো উচ্চাঙ্গসংগীতের আসর চলে সারারাত। এসব অনুষ্ঠানে মাঝরাতে আমন্ত্রিত অতিথিদের হালকা খাবার ও চা পরিবেশন করা হয়। এবারের অনুষ্ঠানের আগে হাসানকে ভালোভাবে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হলো। নাজমা বলল, ‘তুমি কিন্তু অনুষ্ঠানে সবসময় হাসিমুখে থাকবে। মুখ গম্ভীর করে থাকবে না। আর ওয়েটার যাতে সবাইকে নাশতা ও চা দেয় সে-ব্যাপারটা খেয়াল রাখবে। এছাড়া সব অতিথির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবে।’
তাহের বললেন, ‘আরে হাসানকে এগুলো শিখাতে হবে না। হি ইজ ভেরি স্মার্ট গাই।’
সে-রাতে অনুষ্ঠান শুরু হলো। নাজমার সঙ্গে যথারীতি এসেছে সুস্মিতা। হাসান হাসিমুখে থাকতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন। তারপর তার মনে হলো, অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হবে। তিনি দাঁড়িয়ে কয়েকজন অতিথিকে বললেন, ‘ভাই, আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন তো?’ অতিথিরা কেউ কেউ তার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন, তারপর ঘাড় নেড়ে ভালো থাকার ইঙ্গিত করলেন। কেউবা হাসানের কথা শুনে হাসলেন। একপর্যায়ে সংগীত পরিবেশন করল নাজমা। সবাই মুগ্ধ হয়ে তাঁর গান শুনছিলেন। নাজমা সরচিত চারটি বন্দিশ গেয়ে শোনাল। তবলায় ছিলেন দীন মোহাম্মদ এবং হারমোনিয়ামে তুষার দাস। নাজমার গাওয়া শেষ গানটি ছিল লখনউ চালের ঠুংরি, দ্রম্নত একতালে। দ্রম্নত একতালের ঠুংরি আজকাল বিশেষ শোনা যায় না। ইদানীং স্মৃতিবিভ্রম হলেও গানের সুর হাসানের মনের সাগরে এখনো ঢেউ জাগায়। তিনি তন্ময় হয়ে শুনছিলেন নাজমার কণ্ঠ থেকে ভেসে আসা রাগ-রাগিণী। হাসান রাগ-রাগিণীকে ভালোবাসেন এর অর্থ খুব একটা না বুঝেই; তাই তিনি সংগীতের একজন প্রকৃত সমঝদার। উপস্থিত অতিথিদের অনেকেই বাহবা কিংবা মারহাবা বলছিলেন ঘাড় নেড়ে। কিন্তু হাসান নীরবে শুনছিলেন তাঁর স্ত্রীর গান। তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল পাবনার সাধুপাড়ার ষোড়শী নাজমার কথা। সেই নাজমার সঙ্গে কি আজকের এই নাজমার কোনো মিল আছে? তিনি এর চেয়ে বেশি আর ভাবতে পারলেন না। সবকিছুই তাঁর কাছে কেমন ধূসর ও বিষণ্ণ মনে হলো। একপর্যায়ে নাজমার গান শেষ হলো। এখন মধ্যরাতের বিরতি।
ওয়েটার অতিথিদের মধ্যে খাবার পরিবেশন শুরু করল। হাসানের মনে হলো, খাবার পরিবেশনের তদারকের দায়িত্ব তাঁর। তিনি ঘুরে ঘুরে সবাইকে বলতে লাগলেন, ‘ভাই, আপনারা ভালো আছেন তো?’ হাসান সাহেব এভাবে কথা বলার সময় বিনয়ে বিগলিত হয়ে হাসছিলেন। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি দেখে অনেকেই হাসছিলেন। তিনি তবু সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছিলেন। অতিথিদের কেউ কেউ তাঁকে চিনতেন নাজমার স্বামী হিসেবে। এবার তাঁরা অবাক হয়ে হাসানের দিকে তাকালেন। ব্যাপারটা লক্ষ করে নাজমার খুব খারাপ লাগছিল। সে বারবার ভাবছিল, তাহেরের কথা শুনে এভাবে হাসানকে এখানে আনা ঠিক হয়নি। নাজমা তাহেরকে কাছে ডেকে খুব মৃদুকণ্ঠে ব্যাপারটা বলল। সেইসঙ্গে বলল, গাড়িতে করে হাসানকে বাসায় পাঠিয়ে দিতে।
পরদিন নাজমা বুঝতে পারল, হাসানের সমস্যা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। তার মনে হলো, লোকটা কি আসলে বদ্ধপাগল হয়ে যাচ্ছে? তখন কি একসঙ্গে থাকা সম্ভব হবে? কিন্তু হাসানের সঙ্গে কথা বলে তেমন ভয়ংকর কিছু মনে হলো না। হাসান স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিলেন। এবার নাজমার মনে হলো, এ-সমস্যাটা হয়তো কোনো সাময়িক বিষণ্ণতা, অচিরেই ঠিক হয়ে যাবে। সেদিনও যথারীতি অফিসে কাজে গেলেন হাসান সাহেব। সহকর্মী খালেদ তাঁকে পরামর্শ দিল, ‘স্যার, আপনি অনেকদিন ছুটি নেননি। আপনার অনেক ছুটি জমা আছে। দু-সপ্তাহের ছুটি নিন। আর কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসুন।’
খালেদের পরামর্শ তাঁর কাছে ভালো লাগল। ছুটি নেওয়ার পর নিজেকে কেমন মুক্ত-স্বাধীন মনে হলো। তিনি ছুটির প্রথম দিন সকালে নাশতা করে বেড়াতে বের হলেন। প্রথমে নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরলেন। তাঁর যৌবনের অনেক দুপুর-বিকেল তিনি এসব বইয়ের দোকানে ঘুরে সময় কাটিয়েছেন। এরপর তিনি রিকশা নিয়ে গেলেন প্রেসক্লাবে। জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি একসময় নিয়মিত প্রেসক্লাবে যেতেন। তবে মাঝখানে দু-তিন বছর তাঁর সেখানে যাওয়া হয়নি। আজ প্রেসক্লাবে গেলে অনেক পরিচিত সাংবাদিক এগিয়ে এলেন কথা বলতে।
সব টেবিলে মোটামুটি একই ধরনের আলোচনা, বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনে মহাজোটের বিপুল জয়ের পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন এবং ফিলিসিত্মনের গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নারী ও শিশুদের প্রাণহানি। নিজের দেশের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে হাসান সাহেবের তেমন কৌতূহল নেই। তাঁর মনে হয়, এসব নির্বাচনে কেবল শাসকশ্রেণির ভাগ্যই বদলায়, অসহায় সাধারণ মানুষের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয় না, তারা চিরকাল অন্ধকারেই থেকে যায়। তাঁর কেবল গভীরভাবে মনে হতে লাগল, গাজায় বেসামরিক মানুষদের লক্ষ করে ইসরায়েলি ট্যাংক ও বিমান হামলার কথা। হাসানের মনে হলো, সেই কৈশোরে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তিনি বলে আসছেন, ফিলিসিত্মনি সাধারণ মানুষদের ওপর ইসরায়েলিদের বর্বর হামলা সম্পর্কে। জাতিসংঘ কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান দু-তিনটি রাষ্ট্র এ-ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব। প্রতিদিনই সেখানে অসংখ্য নারী, শিশু ও বৃদ্ধ প্রাণ হারাচ্ছে। হাসান ভাবলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে গাজায় যে-হত্যাযজ্ঞ চলছে তার কি কোনো বিচার হবে না? কেমন যেন গভীর দুঃখের অতল জলে নিমজ্জিত হলেন তিনি।
হাসান প্রেসক্লাবে যে-টেবিলে বসেছিলেন, সেখানে তাঁর পাশে বসেছিলেন তরুণ সাংবাদিক ওমর ফারুক। ওমর ঢাকার মর্নিং সান পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার। বেশ সাহসী সাংবাদিক, ইরাকে মার্কিন অভিযানের সময় বাগদাদ থেকে খবর পাঠিয়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তরুণ সাংবাদিকের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হাসান, তাঁর এখন আর যৌবন নেই। তরুণ বয়সে ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, পরে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির মহাবিজয়ের দিন তাঁর সঙ্গী যোদ্ধাদের সঙ্গে এ-শহরে ফিরে এসেছিলেন। সে-দিনটি ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। সাংবাদিক ওমর ফারুকের কথায় তিনি পুরনো স্মৃতির জগৎ থেকে বর্তমানে ফিরে এলেন। ওমর বলছেন, ‘গাজায় বেসামরিক প্যালেস্টাইনিদের ওপর দিনের পর দিন ইসরায়েলি বাহিনী যে-হামলা চালাচ্ছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে একটি জঘন্য অপরাধ হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে।’
হাসান মনোযোগ দিয়ে তরুণ সাংবাদিকের বক্তব্য শুনলেন। তাঁর মনে হলো, ওমরের কথায় যুক্তি আছে। হাসান বললেন, ‘শুধুমাত্র স্বাধীনতাকামী প্যালেস্টাইনিদের দমিয়ে রাখার জন্য এ-হামলা চালানো হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে অন্যায়। সাধারণ প্যালেস্টাইনি জনগণ কোনো অপরাধ করেনি। তাঁদের হত্যা করা জঘন্য অপরাধ।’
ওমর বললেন, ‘প্যালেস্টাইনিদের প্রতিরোধযুদ্ধের খবর সংগ্রহের জন্য আমাদের পত্রিকার পক্ষ থেকে জর্দান যাচ্ছি। হাসান ভাই, আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ইনশালস্নাহ আগামী মাসে রওনা হব।’
হাসান খুব খুশি হলেন ওমরের ওপর। বললেন, ‘আপনি একটা ভালো কাজ করছেন।’ তিনি সাংবাদিক ওমরের কাছ থেকে তাঁর কার্ড চেয়ে নিলেন। এরপর বাসায় ফিরে দেখলেন, বাসার সামনে ড. আবু তাহেরের গাড়ি। যথারীতি দরজা খুলে দিল কাজের মেয়ে। হাসান দেখলেন, ড্রয়িংরুমে সুস্মিতা বসে আছে। টেলিভিশনে বিবিসির খবর দেখছে। যুদ্ধবিধ্বস্তপ্যালেস্টাইনের বিভিন্ন দৃশ্য দেখানো হচ্ছে। হাসান টিভির পর্দায় গাজার একটি হাসপাতালের কিছু নিষ্পাপ শিশু ও নারীকে দেখতে পেলেন। এদের কারো হাত কিংবা পা নেই; কারো বা দুটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত প্যালেস্টাইনি মায়ের লাশের পাশে অসহায় শিশু কাঁদছে। আগুনে সবার শরীর পুড়ে গেছে। হাসান ভেতরের ঘরে যেতে উদ্যত হলেন। সুস্মিতা বলল, ‘বাবা তুমি বসো। তাহের আংকেল ঘরের মধ্যে মায়ের সঙ্গে একটি জরুরি ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছেন। কাউকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করেছেন।’ হাসান সাহেব মেয়ের সামনে খুব অসহায়বোধ করলেন। তিনি টেলিভিশনে খবর দেখতে দেখতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে পৃথিবীর চারপাশে সব শুভবুদ্ধি, কল্যাণ এবং আশাবাদ নিভে যাচ্ছে। আর অন্ধকার বিষণ্ণতায় ঢেকে গেছে পৃথিবী। হাসান তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাহেরের কথা ভাবলেন। সবসময় হাসিমুখ। তাহেরকে তিনি কোনোদিন এতটুকু অবিশ্বাস করেননি, আজো করতে পারছেন না। হঠাৎ হাসানের মনে হলো, ড. আবু তাহেরের সঙ্গে কোথায় যেন আমেরিকার মিল আছে। ওরা মুখে বলছে, প্যালেস্টাইনি জনগণের জন্য শান্তি ও কল্যাণ চায়। অথচ ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়ে সমগ্র প্যালেস্টাইন ধ্বংস করছে, অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। আমেরিকা এর এতটুকু প্রতিবাদ করছে না, নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। আসলে আমেরিকার লক্ষ্য, ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষা ও মধ্যপ্রাচ্যে তেলখনির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। আর ড. আবু তাহেরের লক্ষ্য কী?
এরপর হাসান আর কী যেন ভাবতে চাইলেন। কিন্তু ভাবতে পারলেন না, গভীর ক্লান্তি তাঁর মসিত্মষ্কের কোষে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে চলে গেল কিছুটা সময়। তিনি নাজমা ও তাহেরের উচ্ছল কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। ওরা ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে আসছে। হাসানকে দেখে ওরা এতটুকু চমকাল না। শুধু ওর ঘাড়ে হাত রেখে তাহের বললেন, ‘কী ফ্রেন্ড, কেমন আছো? আজ কোথায় ঘুরলে?’ নাজমা তাঁর বহু পুরনো স্বামীর দিকে সামান্য তাকিয়ে পুনরায় হাসিমুখে তাহেরের দিকে তাকাল। তারপর তাহেরকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
হাসান তেমনই আছেন – মহাপৃথিবীর মহাদুঃখ তাঁর বুকে গভীর হয়ে জমে আছে; ব্যক্তিজীবনের আলো-অন্ধকার তাঁর কাছে তেমন গ্রাহ্য নয়। শুধু স্মৃতিভ্রম আর বিষণ্ণতা ছাড়া তাঁর আর কোনো সমস্যা নেই। এই বাড়ি ও তাঁর যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে আছে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা। হাসানের নিজের জন্য আছে ব্যাংকের একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে মাত্র সাড়ে চার লাখ টাকা। এ তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট। এই অ্যাকাউন্টের কথা তাঁর স্ত্রী কিংবা কন্যা জানে না। হাসান সাহেবের হঠাৎ মনে হলো, যুদ্ধে মারাত্মকভাবে জখম ফিরিসিত্মনের নিরপরাধ মানুষদের কথা। তাঁর মনে হলো, সেখানকার অসহায় নারী ও শিশুদের জন্য তাঁর কিছু করা দরকার। সেই সঙ্গে মনে হলো, সাংবাদিক ওমর ফারুকের কথা।
পরদিন আবার বেড়াতে বের হলেন হাসান সাহেব। সঙ্গে নিলেন তার চেকবই ও পাসপোর্ট। এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি এক বছর আগে থাইল্যান্ডে অফিসের কাজে গিয়েছিলেন। পাসপোর্টের মেয়াদ আছে আরো দু-বছর। হাসান মতিঝিলে একটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে চার লাখ টাকা তুললেন। টাকা পকেটে নিয়ে আশপাশে তাকালেন। কিন্তু তাঁর এতটুকু ভয় হলো না। মনে হলো, প্রতিটি মানুষ বিষণ্ণ বেদনায় নিশ্চুপ হয়ে আছে। সময়ের নিষ্পেষণে সবাই অসহায়। এই অসহায় মানুষকে বাঁচাবে কে? ধীরে ধীরে প্রেসক্লাবে হেঁটে এলেন হাসান। দেখলেন সাংবাদিক ওমর ফারুক বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল আড্ডায় নিমগ্ন। ইশারায় তাঁকে ডেকে নিয়ে এলেন প্রেসক্লাবের ডিজিটরস রুমে। সেখানে কেউ নেই, একটা ফাঁকা টেবিলে দুজনে বসলেন।
হাসান বললেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে ট্যুরিস্ট হিসেবে জর্দান যাব। পরে সেখান থেকে প্যালেস্টাইনের গাজায় ঢোকার চেষ্টা করব। ওখানকার অসহায় নারী ও শিশুদের জন্য কিছু একটা করতে চেষ্টা করব।’
ওমর ফারুক অবাক বিস্ময়ে হাসানের দিকে তাকালেন, ‘কিন্তু বাসায় আপনার স্ত্রী ও মেয়ে কি আপনার এ-ইচ্ছার কথা জানে? তাছাড়া বর্তমান যুদ্ধাবস্থায় আপনি প্যালেস্টাইনে কিছুতেই যেতে পারবেন না। লুকিয়ে সেখানে ঢুকলেও তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। যে-কোনো সময় প্রাণ হারাতে পারেন। তবে জর্দান থেকে আপনি প্যালেস্টাইনিদের জন্য কিছু সাহায্য পাঠাতে পারবেন।’
হাসান বললেন, ‘আমার ইচ্ছাটা একান্ত ব্যক্তিগত। তা আমার স্ত্রী ও কন্যা না জানলেও চলবে। আমি না থাকলেও ওদের কোনো অসুবিধা হবে না। বরং ওরা অনেক বেশি ভালো থাকবে। ওদের প্রতি আমার যতটুকু দায়িত্ব, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি করেছি। আপাতত পৃথিবীর মহাদুঃসময়ে প্যালেস্টাইনের অসহায় নারী ও শিশুদের জন্য কিছু করতে চাই। এ-পৃথিবীর একজন অতিতুচ্ছ মানুষ হিসেবে এ-আমার দায়িত্ব। শুধু আপনি আমার জর্দান যাওয়ার ভিসা ও পেস্ননের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিন। আর একটা ছোট্ট অনুরোধ, বিষয়টি কোনোদিন কাউকে বলবেন না।’
ওমর ফারুক আবেগে বিস্ময়ে হাসানের হাত চেপে ধরলেন, তার মনে হলো অনেক সময় বাস্তবতা রূপকথাকেও হার মানায়। তিনি হাসানের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় অর্থ গ্রহণ করলেন।
এরপর সাংবাদিক ওমর ফারুকের চেষ্টায় একজন ট্যুরিস্ট হিসেবে হাসানের জর্দানে যাওয়ার ভিসা পেতে কিংবা পেস্ননের টিকিট পেতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি। পেস্ননে প্রথমে যেতে হবে দুবাই, পরে দুবাই থেকে অন্য পেস্ননে জর্দানের আম্মান। সব ব্যবস্থাই সুচারুভাবে করেছেন ওমর ফারুক। হাসানের অনুরোধে ব্যাপারটা তিনি কারো কাছে ফাঁস করেননি। হাসানের মনে হলো, স্মৃতিভ্রম ও বিষণ্ণতা ছাড়া তাঁর আর কোনো সমস্যা নেই। তাঁর এই মুহূর্তের একটিই লক্ষেক্ষ্যর কথা মনের মধ্যে সুতীব্রভাবে গেঁথে আছে আর তা হলো প্যালেস্টাইনের নিরপরাধ অসহায় মানুষ। এদের মধ্য দিয়েই তিনি পৃথিবীর বিপন্ন মানবতার সেবা করতে চান। হাসান তাঁর এই অভিযাত্রার কথা বাড়িতে কাউকে বলেননি। নাজমাকে শুধু বলেছেন, তিনি অনেকদিন পর বরিশালে তাঁর এক পুরনো বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছেন। ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। ওরা যেন তাঁর জন্য দুশ্চিমত্মা না করে।
দেখতে দেখতে হাসান সাহেবের যাত্রার দিন চলে এলো। সেদিন সকালে তাঁর মনে হলো, তিনি যেন তাঁর তারম্নণ্য ফিরে পেয়েছেন। এই তারম্নণ্যকে সম্বল করে তিনি একাত্তরে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেদিন তিনি অসহায় বাঙালির পক্ষে লড়াই করেছিলেন। আজ তিনি যাচ্ছেন অসহায় প্যালেস্টাইনিদের পাশে দাঁড়াতে। হাসানের মনে হলো, সব গস্নানি ও বেদনা তাঁর জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। আজ তিনি এক সংকীর্ণ ক্ষুদ্র জীবন থেকে মহাজীবনের দিকে যাত্রা করবেন। সকাল দশটায় তিনি একটি সাধারণ ব্যাগ কাঁধে প্রেসক্লাবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন সাংবাদিক ওমর ফারম্নক। দুজন একটা হলুদ ক্যাবে চেপে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হলেন। হাসানের মনে হলো, অতিবিষণ্ণ ও গস্নানিময় জীবন থেকে তাঁর এ-অভিযাত্রা বিশ্বমানবতার পক্ষে লড়াইয়ের জন্য।