যামিনী রায় ও বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্য

অনুবাদ : আখতার হোসেন খান

[সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘যামিনী রয় অ্যান্ড দি ট্রাডিশন অব পেইন্টিং ইন বেঙ্গল’ নামে ইংরেজি প্রবন্ধটি লেখা ১৯৩৯ সালে। এর প্রথম প্রকাশ ১৯৪৩ সালে লংম্যান্স মিসসেলানিতে সংক্ষিপ্তাকারে। সুধীন দত্তের মৃত্যুর দশ বছর পরে পুরো প্রবন্ধটির স্থান হয় এডওয়ার্ড শিলস-সম্পাদিত ১৯৭০ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী-সংবলিত দ্য ওয়ার্ল্ড অব টোয়াইলাইট গ্রন্থে। প্রবন্ধটি বিষয়জ্ঞানে ভরপুর ও তাৎপর্যমণ্ডিত। যামিনী রায়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্যকেই টেনে আনেননি, একই সঙ্গে উপমহাদেশ তথা পৃথিবীর চিত্রকলার সর্বশেষ বিবর্তন সম্পর্কেও পাঠককে জানিয়েছেন। এটি বাদেও যামিনী রায় ও অতুল বসুর কাজের ওপর লেখা তাঁর আরো দুটি প্রবন্ধ ২০১০ সালে সুকান্ত চৌধুরীর সম্পাদনায় (অমিয় দেবের ভূমিকা-সংবলিত) দি আর্ট অফ দি ইনটেলেক্ট গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুধীন দত্ত-প্রতিষ্ঠিত পরিচয় পত্রিকার অষ্টম বর্ষের কয়েকটি সংখ্যার প্রচ্ছদ যামিনী রায়ের চিত্রভিত্তিক।

সুধীন দত্তের বাক্যগঠন, তা ইংরেজি বা বাংলা যা-ই হোক না কেন, একটা বিশেষ স্টাইলের। বাংলা ভাষার আর কোনো লেখক এই ধরনের গদ্য লেখেননি। তাঁর ইংরেজি আত্মজীবনীর সম্পাদক এডওয়ার্ড শিলস এই শৈলীকে ‘এন্টিথেটিকাল’ বা ‘বিরোধাত্মক’/‘প্রতিপ্রত্যয়ী’ আখ্যা দিয়েছেন আর অমিয় দেব মনে করেন তা সুধীন দত্তের উদারনৈতিকতার প্রকর্ষ। কোনো কোনো বাক্য শতাধিক শব্দেরও অধিক আর বেশির ভাগই ‘এন্টিথেটিকাল’ গড়নের। তাঁর লেখা আক্ষরিক ভাষান্তরের প্রয়াসে মূলানুকরণ অবশ্যকরণীয়। মূলকে হুবহু অনুসরণে পাঠকষ্ট অনিবার্য, কিন্তু তা হতে পারে সুধীন দত্তের মতো লেখকের শৈলীর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানানো; আর ভেঙে-ভেঙে করলে তা হবে সুখপাঠ্য। সুধীন দত্তের অনুসরণে এই অনুবাদে ‘মডেল’কে ‘প্রতিমান’ লেখা হয়েছে; শিল্পকলায় বহুপরিচিত শব্দ ‘ফর্মে’র অর্থে ‘রূপকল্প’ ব্যবহার করেছি; আর প্রায়ই ইংরেজি ‘আর্ট’ শব্দটি সরাসরি প্রযুক্ত হয়েছে। – অনুবাদক]

প্রাচীন প্রাজ্ঞেরা প্রকীর্তন করতেন, বাস্তবতা এক স্বতঃবিরোধ; এবং ইতিহাসের চক্রচর প্রক্রিয়া আমাদের এমন এক দ্বন্দ্বে ফিরিয়ে এনেছে যা নিজেকে ‘বৈজ্ঞানিক’ দাবি করে বটে, কিন্তু আসলে যৌক্তিক বৈপরীত্যের অতীন্দ্রিয় ঐক্যে বিশ্বাসী। তবু আজো সভ্যজগতের সর্বত্র স্বরূপত্বের সূত্র রাজকীয় দীপ্তিতে বিদ্যমান; এবং কোনো ব্যতিক্রমী অনুমান একঘরে করতে মধ্যযুগে যে-অবসর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে অন্তহীন বাদানুবাদ প্ররোচিত করতো, তা যেহেতু আমাদের নেই, নিরর্থক পুনরাবৃত্তি বাদে অন্য কোনো উক্তি তাই আমাদের কাছে স্ববিরোধী ঠেকে। এভাবেই আমাদের বোধে সত্য আর মামুলি কথা সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে; এবং অতিসরলীকরণের শ্রম-সাশ্রয়ী কৌশল দুনিয়াজোড়া এখন এতোটা সুলভ হয়েছে যে স্বতঃপ্রমাণ ভারতীয় বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গি-সংবলিত যামিনী রায়ের চিত্রকর্মের মুখোমুখি হলে আমরা শুনে চমকে উঠি যে, শিল্পী অভিজাত ইউরোপীয় শৈলীর প্রতিকৃতিকার হিসেবেই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। উপরন্তু, এ-ধরনের বিস্ময় সব সময়ে অজ্ঞতা বা সারল্য থেকে আসে না; আমাদের যে-কয়জন হাতেগোনা সমর্থ চিত্র-সমালোচক আছেন, তাঁরাও একই ধরনের লোকরঞ্জক ভ্রান্তিতে পা মাড়ান; এবং তাঁরা না জানলে বানিয়ে ফেলেন, আর জানলে তাঁরা নিষ্ক্রিয় নির্বোধের তন্মাত্রবাদ বা ‘মোনাডিজম’ জিইয়ে রাখতে এই ব্যক্তিটির জীবনবৃত্তান্ত বিকৃত করেন।

এসবের অর্থ কোনোক্রমেই সমন্বয়বাদ বা ‘ইক্লেকটিসিজমে’র পক্ষে সোজা বা বাঁকা প্রচার নয়। সত্য বলতে, এ-কথা ভাবতে আমি আতঙ্কিতই হই যে সেরা পণ্ডিতদের সঙ্গে আমি একমত নই যে ভারতবর্ষীয় আর্ট বা চিত্রকলা গ্রিক, চীনা ও পারস্য প্রভাবের তুলনাহীন সংশ্লেষ; বরঞ্চ, আমি আমাদের অট্টালিকা, মূর্তি আর ভিত্তিচিত্রে বা ফ্রেস্কোতে দেখি কলার বদলে কারুকর্ম, যা আছে লাঙল আর চাকায়, আর যারা সব জায়গায় একই আকারের হলেও যথাসম্ভব বিভিন্ন আদিবাসভূমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জন্মেছিল। সে যাই হোক, আমি এ-কথা মেনে নেওয়ার পক্ষে কোনো কারণ পাই না যে দ্বিমাত্রিক কর্ম হিসেবে চিত্রশিল্পের কল্পনা চীন থেকেই ভারতবর্ষে আসে বা ফেরে আর চিত্রকৌশল পুরাণপ্রসিদ্ধ ইরানেরই উত্তরাধিকার। পক্ষান্তরে, আমাদের ভাস্কর্যের মধ্যে ইলোরাই স্বতন্ত্ররূপী; অন্যেরা সব সময়ে স্থাপত্যের অভিমুখী; আর এতদসত্ত্বেও, মহাবল্লীপুরমের উদ্গত সব শিল্পকর্ম বা রিলিফের কথাই ধরা যাক, তারা স্থাপত্যবিদ্যার পটভূমি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ার আভাস আনে বটে, তবু এই সুনিশ্চিত উপসংহারের দিকে যেতেই হয় যে, সমন্বিত আলেখ্যবোধ অঙ্কনকলার জ্ঞান নিবারণ করে না, এবং এই দুই দক্ষতা অতিঅবশ্যই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে প্রযুক্ত হয়ে আসছিল বলেই ভারহুতের সীমানাপ্রাচীরের বা রেলিংয়ের মতো আদি নমুনায়ও তাদের অত্যন্ত সফল ব্যবহার মেলে।

এতদসত্ত্বেও ব্যক্তির মতো সংস্কৃতিও একটির থেকে অন্যটি ভিন্ন; এবং যদি এটা সত্যও হয় যে মানুষের উদ্ভাবনের যোগফল কম-বেশি সব যুগে সব জলবায়ুতেই সমান, তবু তাদের সংগতি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আলাদা, আর সব সম্ভাবনা কোথাও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়ও না। তাই মায়া সভ্যতা খিলান আবিষ্কার করে তা ছেড়ে দেয়, কেননা ওই দায় ছাড়াই তাদের স্থাপত্য-অনুপ্রেরণা আরো লাভজনক কাজে খাটানোর পথ পায়; এবং হিন্দু যদিবা শুরুতেই চিত্রকৌশলের উপাদান বা মূলতত্ত্ব আয়ত্তে আনে, যে-কারণেই হোক, তাকে সে ততোটা সামনে এগিয়ে নেয়নি যতটা পরে লিওনার্দো নিয়েছিলেন। বৈদিক যুগেই সে জটিল বেদি বানাতে জ্যামিতিক নকশার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়; পরে তারা যখন তার ধর্মের স্বাভাবিক বিবর্তনে বাদ পড়ে, তার আধ্যাত্মিক জগৎ হতেও তারা উধাও হয় বটে, তবে তার আগে সাক্ষাৎ জ্যামিতিতেই তাদের প্রতীকী বৈশিষ্ট্য অনুদান হিসেবে দিয়ে যায়। জীবন সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ে ছিল অতীন্দ্রিয়বাদী; এবং নিজ আদর্শের প্রত্যাশামতো সে করতে পারুক বা না পারুক, এটা ভুলতে তার দেরি হয়নি যে, প্রতীকের মূল্য ততক্ষণই, যতক্ষণ তারা বিকল্প হিসেবে থাকে। অথবা এমনও হতে পারে যে, তার সমাজ ছিল আজ আমাদেরটি যেমন, তার চেয়ে বেশি অখণ্ড; এবং যে-গোষ্ঠীর সে অপরিহার্য অংশ, তা ছিল এমন ঘনঠাসা যে সবচেয়ে হালকা বিমূর্ত ভাবনাও যোগাযোগের বাধা হতো না, কেননা তখনো দুনিয়া সামষ্টিক আর প্রাতিস্বিকভাবে ভাগ হয়নি। একখণ্ড আনুভূমিক পাথরের ওপর দাঁড় করানো এক টুকরা খাড়া শিলা সবার জন্য একই ধরনের আবেগপ্রবণ তাৎপর্য তৈরি করত; এবং বলবান রাজার দরবারে মহাকাব্যের আবৃত্তি তুচ্ছ প্রজাদেরও সমানভাবে হৃদয়ভরে কাঁদাত।

এ-ধরনের সমাজ আজ হোক, কাল হোক, অসার কলাসিদ্ধিকে নিঃসংশয় নিরুদ্যম করে, আর তা নিশ্চিতভাবেই প্রয়োগবাদ হতে দূরকল্পনাভিত্তিতে গিয়ে ঠেকে; ফলে এর আর্ট বস্তুমুখিনতা ছেড়ে ভাবব্যঞ্জক হয়ে পড়ে : এর সব চিন্তাবিষ্টতা কালে কালে প্রকাশভঙ্গি থেকে রূপকল্পে বদলাতে বাধ্য। কেননা সীমিত অর্থে প্রকাশভঙ্গি সে-সামাজিক উথালপাথালের উপকরণ, যা সতর্ক শিল্পীকে বোধের বিশ্বকে এমন নিখুঁত নকলে বাধ্য করে যাতে প্রথাসিদ্ধির বাইরেও যোগাযোগ সম্ভব হয়, আর অন্যদিকে রূপকল্পের জন্য প্রয়োজন পরিপূরক ব্যক্তিসত্তার মধ্যে এমন এক উঁচু পর্যায়ের বৌদ্ধিক মতৈক্য, যার ফলে তাঁরা অনুভূতির মধ্যস্থতা বা সাদৃশ্যের সৃষ্টিতে সূচিত দেহতত্ত্ববিধিতে না যেয়ে একজন অন্যজনকে অভিপ্রায় জানাতে পারেন। অন্য কথায়, আর্ট যদিও সর্বত্রই দুর্বোধ্য, আঁটোসাঁটো গোষ্ঠীতে তা অবিচ্ছেদ্য বৃত্তি, মজাদার বিলাস বা সমাজবিরোধী স্বয়ম্ভরতা নয়; এবং এ-পরিবেশে সকল মানুষ শিল্পী না হলেও শিল্প এখানে এক জৈব প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় অংশ বলে এর অবয়ব আর লক্ষ্য সম্পর্কে এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে সবাই প্রলুব্ধ হয়। ফলে এই দাঁড়ায় যে, আমাদের সব শহর আর গ্রামের প্রায় প্রত্যেক অল্পবয়সী মেয়েকে অঙ্কনবিদ্যা শিখতে হতো; তা এজন্য নয় যে পরে তাকে ওই দক্ষতা দিয়ে অংকনকলাবিদ হিসেবে পয়সা কামাতে হবে, বরঞ্চ এজন্য যে আমাদের অগণিত ভোজে আর পার্বণে সিঁদুরের গুঁড়ো, তেঁতুল ভর্তা, আর শিমপাতার রসে, প্রাসাদ হোক, পর্ণকুটির হোক, সব ধরনের মেঝেয় অনাড়ম্বর রঙে ও খড়িমাটির ছকে মানানসই আলপনা আঁকতে হতো, এবং যেহেতু এসব অঙ্কন ছিল নৈমিত্তিক, সার্বত্রিক ও বাধ্যতামূলক, তাদের তাই প্রায় কারুকর্মের আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ফেলা হয়, যাতে দক্ষতার সবচেয়ে কম ব্যবহারে আর সময়ের সর্বোচ্চ মিতব্যয়ে এসবকে বারবার তৈরি করা যায়।

তবে এতে তাদের প্রতীকিত্ব হারাত না; এবং প্রত্যেকে যেমন এসব মৌসুমি উৎসবে উৎসাহভরে অংশ নিত, তেমনি কারো বুঝতে সামান্য কষ্ট হতো না যে বিন্দু-আকৃতি ফোঁটার বিন্যাসের মধ্যে কিছু বড়ো প্রলেপে তালগাছের ঝোপ বোঝায়, আর তাতে স্মৃতিতে আসে ভাদ্র মাস, যখন ওই ফলটা পাকে। ব্যক্তিগত অনুভূতি বা বিশিষ্ট অনুষঙ্গের বন্ধনমুক্ত নির্ভুল বারোমেসে কল্পচিত্রের পরম্পরা প্রত্যাবর্তী পটভূমিকায় বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নিয়ে সারাক্ষণ হাজির থাকত; এবং সেজন্য চিত্রকর শুধুই যে তাঁর দ্রষ্টাদের অবিশ্বাস স্থগিত রাখার প্ররোচনায় আপাত-সত্য তৈরি ঘৃণা করতেন, তা-ই নয়, একই সঙ্গে ছাড়া-ছাড়া সমাজে আবশ্যিকভাবে প্রকৃতিবাদের প্রয়োজনের অধীন নির্ভেজাল নান্দনিক বিবেচনায়ও মন লাগাতে পারতেন। তিনি জানতেন, যে-সামবায়িক আবেগ এখন তাঁকে কাজে ঠেলছে, সঠিক মুহূর্তে তাঁর তৈরি আঁধারই তার ধারক হয়ে দাঁড়াবে; এবং তাই তিনি দেহতত্ত্ববিদ্যার অনুশাসনের ভীতি ছাড়াই তাঁর রেখার ছন্দ তৈরির জন্য মুক্ত হলেন, আলো আর ছায়ার জরুরি প্রয়োজন ভুলে গিয়ে রং-ব্যবহারে তিনি একটা বিশুদ্ধ চিত্রলেখা তৈরির অনুমতি পেলেন, মানুষী উদ্ভাবনপটুতার সীমানা খোঁজা তথা দশ মাথা আর হাজার চোখের মূর্তি বানানোর কল্পনায় তিনি উদ্বুদ্ধ হলেন। যদি তাঁর চিন্তার সুফল কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনীন প্রতিক্রিয়ার শুভসূচনা করে থাকে, তবে তা-ই যথেষ্ট বিবেচিত হতো; এবং তাই মানুষের মতোন দেখতে এমন মুখে বাধ্যতামূলক লালের জায়গায় সবুজ প্রয়োগের স্বাধীনতাও তাঁর এলো।

প্রকৃতিবাদী পরম্পরায় কোনো চিত্রশিল্পীর পক্ষে তুলনীয় মুক্তি যেমন কখনো সম্ভব নয়, তেমনি এ-ধরনের শৃঙ্খলা তাঁর ওপর কখনো চাপিয়েও দেওয়া হয় না; এবং তাঁর প্রতিমান সবসময়ে তাঁর হাতের গতিময়তা সীমিত রাখে বটে, তবু ‘সুবর্ণ খণ্ডে’ বা ‘গোল্ডেন সেকশনে’ দৃঢ়ীভূত বিশ্বাস নিয়ে ফিরতে তিনি কালেভদ্রেই স্থানিক পরিসর ও রঙের চিত্রকৌশলের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি নেন। আমি আগে যা বলেছি, তার পুনর্বয়ানে বলা যায় তিনি প্রত্যক্ষের দাস আর তা তাঁর বোধের ওপর নির্ভর করে তাঁকে এদের পেছনের দেহতাত্ত্বিক সূত্রের গবেষণায় নামায়; এবং কায়িক বা সম্ভবত গেস্টাল্ট সূত্রনির্ভর বাস্তবতা তাঁকে এড়ায়, যদিও তা তাঁর আচারনিষ্ঠ সহকর্মীর ক্ষেত্রে ঘটা বিরল। গেস্টাল্ট সূত্র আবার ঘটনাচক্রজাত, বিশাল তত্ত্ব থেকে নিরূপণযোগ্য যুক্তিনির্ভর প্রতীতি নয়; তারা সেই শ্রেণির উপপ্রমেয় যার বৈধতা শুধু বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতিতে বারে-বারে প্রয়োগ করে যাচাই করা সম্ভব; এবং তাই ‘সিগনিফিক্যান্ট ফর্মে’ এর (বিশুদ্ধ রূপকল্পের বা নান্দনিক রূপকল্পের) শিল্পীর হাতে ‘সুবর্ণ খণ্ডে’র বা ‘গোল্ডেন সেকশনে’র পুনরাবিষ্কারে এমন এক প্রশিক্ষণের ইঙ্গিত আসে যা সেই প্রতিকৃতিকারের প্রশিক্ষণের চেয়েও অনেক বেশি বহুমুখী, যিনি, প্রতিভাধর হলে, তাঁর প্রতিমানের স্বভাবীভঙ্গি পালটে তাঁর চিত্রকে অতিমাত্রায় আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন, আর অন্যদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর এমন এক ধাঁচ বা প্যাটার্ন বের করতে হয় যাতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সমস্ত বিষয়ের জায়গা হয় তথা এমন এক সম্পর্ক বানাতে হয় যাতে সত্য থেকে স্বপ্ন পর্যন্ত সমস্ত কিছু আঁটে। তাই বিস্ময়কর নয় যে বিমূর্তকলাকে বিশ্বস্ত অনুকরণের সব সূত্র রপ্ত করেই শুরু করতে হয়। কিন্তু এ-জাতীয় শিক্ষার জন্য দরকার এক চালু সমাজব্যবস্থা, যা বৃত্তিগত ঝোঁকের জায়গায় সৃষ্টির পরম কারণের পথ খোঁজে; এবং তাদের পূর্বসূরিদের উলটো পথে হেঁটে ব্রিটিশরা যেহেতু ভারতবর্ষে এসেছিল এদেশকে সর্বস্বান্ত করতে, বসবাসের জন্য নয়, তাদের সাংস্কৃতিক ঔদাসীন্যে তথা ক্ষেত্রবিশেষে হস্তক্ষেপে আমাদের অপরিহার্য ঐক্য ক্ষতবিক্ষত হয়, আর তাতে ঘটে এই অনিবার্য পরিণতি যে শোষিত জনগণ শঙ্কায় তাঁদের জাতিগত সংহতির অদৈশিক ভিত্তি ভুলে বসে তাঁদের ভাবসত্তায় এমনসব বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ শুরু করেন যা স্পষ্টতই সংকীর্ণ।

একটু বেশি দীর্ঘ হলেও এসব প্রাথমিক বিবেচনা যামিনী রায়ের শিল্পকর্মকে বোঝার জন্য অপরিহার্য আর তাই আমি তাদের সংক্ষিপ্ত বা স্থগিত করব না, যদিও আমার সন্দেহ নেই, যখন প্রথম যৌবনে তিনি পেশা হিসেবে চিত্রকর্মকে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ হন, এসব তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি। পক্ষান্তরে তিনি যখন জন্ম নেন, সে-সময়ের মধ্যে সমাজের এন্ট্রোপি বা বিশৃঙ্খলা এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল যে নিঃসঙ্গ শিল্পীর রোমান্টিক বোধশক্তি তাঁর জন্মপূর্ব উৎকর্ষকে উঁচিয়ে ধরবে, এটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়; এবং পীড়াদায়ক আত্মসংস্কারের বিলম্বিত স্বীকৃতির পরে তিনি নিজেকে এমন এক প্রারম্ভিক অতিকথায় অলংকৃত দেখেন যা এই দাবি তোলে যে গ্রাম্য নিঃসঙ্গতায় বিস্মৃতিপ্রবণ পূজারিদের হাতে বাংলার লোকশিল্পে দীক্ষা নিয়ে তিনি প্রাচীন রহস্য পুনরুুুদ্ধারে দৃঢ়সংকল্প প্রকৃতির এক বাক্বিমুখ শিশুরূপেই তাচ্ছিল্যে-ভরা মহানগরে আসেন। কিন্তু, হায়, সত্য রূপকথার চেয়ে বেশি অদ্ভুতই শুধু নয়, তা সীমাহীনভাবে আরো জটিল; এবং তাঁর বয়সের অধিকাংশ মানুষের মতো – যামিনী রায় সবেমাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সী –    তিনি জীবন শুরু করেন সজ্ঞান অবিশ্বাসী হিসেবে, তথা অক্ষম অভ্যাস ও অধোপতিত পৃষ্ঠপোষকদের হাতে পড়ে এদেশের সব শৈল্পিক ক্রিয়া চূড়ান্তভাবে যে-অনুদ্ভাবনী ও অস্বতঃস্ফূর্ত কারুনৈপুণ্যের একঘেয়েমিতে পরিণত হয়েছিল, তার বিরুুুদ্ধে বিদ্রোহী হন। আমি আরো নিশ্চিত যে, সমৃদ্ধির শীর্ষে দাঁড়ানো তথা আসন্ন উপনিপাতের ছায়ার গ্রাসমুক্ত ইউরোপের দীপ্তিতে তাঁর সমকালীনদের মতোন তাঁর চোখও ধাঁধিয়ে যায়; এবং আমি যেমন অন্তত অর্ধ-বিশ্বাস করি যে সকল মহৎ শিল্পীর মধ্যেই মাতৃএষণার সামান্য আলামত আছে, তেমনি এই দুঃসাহসী আঁচ করতে চাই যে তাঁর পিতা, যিনি পল্লির পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাসী স্বদেশি প্রথা প্রচার ও পালনের জন্য সরকারি পদ হতে ইস্তফা দিয়েছিলেন, তিনিও তাঁর পুত্রের এই যৌবনদীপ্ত স্বপক্ষত্যাগের জন্য অনেকটা দায়ী।

উপরন্তু আদিম অরণ্যের আঁটুনিতে বাস করে যে-সামান্যসংখ্যক আদিবাসী গোত্র আজ পর্যন্ত আমাদের পুরনো সভ্যতার চাতুরী এড়াতে পেরেছে, তাদের মধ্যে বাদে, এদেশে কখনো লোকশিল্প ছিল না; এবং যে-ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক বস্তুনিরপেক্ষতায় সমমাত্রার অখণ্ড মনোনিবেশ আমাদের সব শিল্পীর কাছ থেকে আশা করা কঠিন, তবু যাঁরা মোগল আমলের শুরুতেই ওই আদর্শ হতে সরে আসেন, তাঁরা দরবারি চিত্রকর, যাঁদের শূন্যগর্ভ রাজপুত্রেরা স্মৃতিরক্ষক বানান আর অকেজো অমাত্যরা অলংকরণের উপযোগী অশ্লীলতায় বাধ্য করেন। আদি উৎসাহ অবশ্য আমাদের লোকপ্রিয় আর্টে সযত্নে রক্ষিত হয়; তা ইতোমধ্যেই কয়েক শতক আগে বৌদ্ধ মানবিকতার প্রভাবে ইহজাগতিকতার পথে হাঁটে বটে, কিন্তু কখনো হারিয়ে যায়নি, যদিও তখনো এমন কোনো দেগা (Degas) আসেননি যিনি এই তত্ত্ব বাতলাবেন যে, রূপকল্পকে কখনো অঙ্কনবিদ্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়, কেননা শেষোক্ত খুব বেশি হলে প্রথমটিকে বোঝার উপায়। এই পার্থক্য কখনো লোকজ কলায় ধরা পড়ে না; তা সাধারণত এমনই বাছবিচারহীন যে অন্তর্দৃষ্টি আর অঙ্কনকলার মধ্যের ফারাক তা বোঝে না; এবং রূপকল্প যেহেতু শুধুই বস্তুতে দৃষ্টিগোচর ও তার সঙ্গে ছাড়া চোখে পড়ে না, লোকবিজ্ঞানের অনগ্রসরতার কারণে, অনেক দূরে থেকে দেখে, লোকশিল্পীরা বস্তুর অস্পষ্ট সীমারেখাকে মোটা অভঙ্গুর অণুরেখায় প্রথাসিদ্ধ রীতির অনুগামী করে অন্তরে এই বিশ্বাস ধারণ করেন যে, তাঁরা চিরদিনের জন্য রূপকল্পকে খাঁচায় পুরতে যাচ্ছেন।

আদিম সংস্কৃতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ রীতির ধারণার এই স্থানবিন্যাস মোটেই অপ্রাপনীয় নয়; এবং তুলনামূলক নৃতত্ত্ববিদ্যার ছাত্রেরা অনেক আগে থেকেই জানেন যে, জ্যোতিষশাস্ত্র গোড়াতেই মানবজাতির প্রধান আগ্রহ হয়ে দাঁড়ায় এজন্য যে, নক্ষত্রের সাহায্যে ঋতুগত পরিবর্তন বস্তুতই বলা যেত আর সেজন্য নক্ষত্রকে সব ধরনের ভৌতিক গুণ দিয়ে রাঙানো ছিল স্বাভাবিক। তবে আমাদের লোকজ কলায় এ-ধরনের কঠোর যুক্তির কোনোই স্থান নেই। আমরা যখন কাদামাটির মূর্তি বানানো আর চিত্রকর্ম শুরু করি, তার আগেই বছর-বছরের দুর্বিপাক আর হতাশায় আমাদের নিশ্চয়তাবোধ খুইয়েছিল; এবং যখন আমরা ফুলদানি রং করা আর জপমালা গাঁথার পর্যায় পার হই, আমাদের কাছ থেকে এই বেদনাদায়ক স্বীকৃতি আদায় করা হয় যে, দৃশ্যমান বস্তুর কোনো সাবলীল রূপরেখা নেই, এর পার্শ্ববর্তী বস্তু এর ওপর চড়াও হয়ে দেহরেখা ধ্বংস করে আর যদি আমরা বস্তুকে খণ্ডে খণ্ডে বিবেচনা না করে একে সর্বব্যাপক বা সহঘটিত দৃষ্টিতে দেখি, এই বাগড়া আরো বাড়ে। তখন দেখা যেত আবছা সাদা-কালো ছবি বা হাফটোনের মধ্য হতে শুধু সবচেয়ে বেশি বৈপরীত্যের বৈশিষ্ট্যই চোখে আসছে; আর তাতে পরস্পরসংযুক্ত পিণ্ডের ও পৃষ্ঠতলের বিশৃঙ্খল সমাহারে অখণ্ড বস্তু ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, আর সেখানে আলো আর ছায়া সমান গুরুত্বপূর্ণ তথা শূন্যের মাধুর্য সারবত্তার চেয়েও বেশি; এবং কেউ প্রকৃতিবাদে আকৃষ্ট কি না, তাতে কিছুই এসে-যেত না, ওই পৌনঃপুন্যের তারতম্যকরণ বিবেচনায় নিতেই হতো।

বরঞ্চ তৃতীয় মাত্রা এড়িয়ে চলতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ শিল্পীর ক্ষেত্রে এই বাধা আরো বাড়ে; এবং তিনি যেহেতু ঐতিহ্যের তাড়নায় রঙের স্পষ্টতা ও সম্পৃক্তিকে তাদের সংশ্লেষণ আর বর্ণসংগতি বা সিম্ফনির অধীন করেন, তাই তাঁকে বাধ্য হয়েই প্রান্তরেখাকে পাক খাওয়াতে ও মোচড়াতে হয় আর এতে তা রূপ নেয় পরিসরে, যা আঁধার ও উজ্জ্বল ছোপে বস্তুর ওপর অবৈধ অনুপ্রবেশ না করলেও কমপক্ষে পটভূমিকে, হয় সজ্ঞানে, নয় স্বজ্ঞাবলে, অর্জিত ছন্দের সুকঠিন সূত্রে একে অন্যের সঙ্গে নিকট-সংযুক্ত অসম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বেষ্টনীতে ভাগ-ভাগ করে ফেলে। এজন্য আমাদের ‘জনপ্রিয়’ শিল্পীরা মধ্য এশীয় যাযাবর, যাদের হাতের কাজ সোভিয়েত পুরাতাত্ত্বিকরা সম্প্রতি বরফ-ঢাকা সাইবেরীয় পর্বতমালায় আবিষ্কার করেছেন, তাদের চেয়ে বেশি করে ইতালিয়ান প্রাক-রেনেসাঁস চিত্রকরদের – এমনকি জোত্তোর (Giotto) – সঙ্গে তুলনীয়; এবং বিশেষ করে বাংলার নিজস্ব আর্টে পরিসরের জন্য অনুভূতি এতো দীর্ঘকাল আধিপত্য বজায় রাখে যে ব্রিটিশদের আসার সঙ্গে-সঙ্গে ইউরোপীয় প্রভাব এখানে তৈরি সংবর্ধনা পায় আর চন্দননগর ও কালীঘাটের পট বানানো চলতেই থাকে। ওই সময়ে ওই দুই ঐতিহ্যের মধ্যে কোনো দ্বৈরথ ছিল না, যা ছিল তা মন-বির ফারাক। অথবা এটা হয়তো দুই বৈপরীত্যের মিলনের আরেক দৃষ্টান্ত, যেখানে এক জায়গায় বাহ্য প্রতীক চিত্রকে পরিসরের মূল ভাণ্ডার ধরা হতো, আর আরেক ক্ষেত্রে এ-সম্মান পেত পটভূমি। সে যাই হোক, বাঙালি চিত্রকর প্রতীচ্যের সঙ্গে সংস্পর্শে আসার অনেক আগেই নিয়মিতভাবে স্থানিক গভীরতা জানিয়ে আসছিলেন; এবং এটা উল্লেখ করা কৌতুকপ্রদ যে মধ্যবর্তী ছোপে না গিয়ে প্রতিকূল ও পরিপূরক রংকে সরাসরি প্রয়োগ করে তিনি সেই ফলাফল পান, যা ইম্প্রেশনিস্টরা প্রায় একইভাবে সম্পূর্ণ স্বকীয়তার সঙ্গে প্রায় একশ বছর পরেই অর্জন করেন।

তাই যামিনী রায়ের কর্মজীবনে দিক পরিবর্তনে আমাদের প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, আমরা একে যুক্তিবহ বিবর্তনের মর্যাদা না দিয়ে পারি না; এবং যদিবা তাঁর বিস্ময়কর সংগতি শুধু সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই চোখে পড়ে থাকে, যে-লক্ষ্যের দিকে তিনি যাচ্ছিলেন, তা অবশ্যই অনেক আগে থেকেই ঠিক করা হয়ে থাকবে। প্রশ্ন ওঠা উচিত অন্য সকলকে বাদ দিয়ে কেন হুইসলার (Whistlor) তাঁর ওপর এতোটা আছর করলেন। বাইরে থেকে দেখলে এমনটা হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কেননা এক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সেই অবাধ্য তথা নির্বোধ যুবকদের একজন যিনি ছন্নছাড়া আতিশয্যের মোহে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে অনেক দেরিতে আবিষ্কার করেন যে, এই প্রতিষ্ঠান মমির মতোই মৃত, এতোটাই মৃত যে সমকালীন ইউরোপীয় আর্ট এখানে অপরিচিত আর মিলেস (Millais), লেটন (Leighton) আর পয়েন্টারের (Poynter) নিচু মানের অনুকৃতি এখানে সম্মানিত ক্লাসিকের মর্যাদা পায়। উপরন্তু থিওসপিস্টদের কল্যাণে ভারত হঠাৎ করেই তার অতীন্দ্রিয় অতীত নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে; আর এই আবিষ্কার এতোটাই বিপর্যয় ঘটায় যে এতে আমাদের যে-স্বল্পসংখ্যক প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী ছিলেন, তাঁরাও গ্রন্থনা-রচনাকৌশল বা কম্পোজিশন ও নকশাঙ্কন ছেড়ে অনুমানসিদ্ধ জাপানি জন্মের লোপাটে-জলরং ধরেন। আমাদের শাসকেরাও তখন প্রাক-যুদ্ধ-মার্কা অস্পষ্ট উদারতাবাদ ঝুলিয়ে বেড়াচ্ছিলেন; এবং মিন্টো-মোরলি সংস্কারের কারণে সিনহাকে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়ে চক্ষুলজ্জার কারণে তাঁরা আর আর্ট স্কুলে প্রাচ্য ‘চিত্রবিদ্যা’র অনুপ্রবেশ ঠেকাননি। এটা নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক নীতির সঠিক দৃষ্টান্ত; কিন্তু আর্টের শিক্ষায় এর মোট বা নিট ফল এই দাঁড়ায় যে এতে ওই পবিত্র প্রাঙ্গণ, যেখানে আগে কখনো নগ্ন প্রতিমানকে স্বাগত জানানো হয়নি, সেখান থেকে সব ফিগার বা প্রতীকচিত্র নির্বাসনে যায়, আর ড্রইং ক্লাসে, যেখানে নকশাঙ্কন ছাড়া আর সবই শেখানো হতো, সেখানে বিস্তৃত ধ্যানের হাতে সজাগ পর্যবেক্ষণের নিবর্তন ঘটে।

আর তখনই শুরু হতো সিভিল সার্ভিস আর সামরিক বাহিনীর শ্রোতাদের জন্য গালভরা সব বক্তৃতা; এবং এর পরে বসত লোকে-ঠাসা প্রদর্শনী, যেখানে প্রাদেশিক সত্রাপ আর তাঁদের নাছোড়বান্দা তালুকদারেরা বাছবিচার না করেই গোলাপি আর গাঢ় নীলের সদয় ক্লান্তিকর পুরু প্রলেপে আঁকা অবক্ষয়ী মোগল, অধঃপতিত রাজপুত আর অকেজো অজন্তার অনুকারী নির্লিপ্ত সব জলরংকে জাতে তুলতেন। ইউরোপীয় শুদ্ধত্বে অভ্যস্ত যামিনী রায়ের চোখে ওই ছবিগুলোর বেশির ভাগই অপটু বিকৃতিকারীর আফিম-স্বপ্নের মতো মনে হয়ে থাকবে; এবং তিনি খুঁজেও বের করতে পারেননি আলোকচিত্রের প্রমাণসিদ্ধির দুলের সঙ্গে মধ্যাকর্ষণের সূত্র লংঘনকারী ভূতের অদৃশ্য কানের সম্পর্ক কী। তাঁকে বলা হয়েছিল এক নির্বোধ কাক একবার আঙুরের ছবিতে ঠোঁট ঠুকরিয়ে আসল তৃষ্ণা মেটাতে পারেনি; এবং তিনি ভেবে বিস্মিত হন কেন পীনোন্মত পয়োধরা-ক্ষীণকটি-নিতম্বিনীদের মানুষী পায়ে শোভাবর্ধক ঢেউয়ের ওপর দিয়ে হাঁটার ভাঁজহীন অপিচ সুসজ্জিত স্বচ্ছচিত্র তাঁকে কামনায় নয়, ঘৃণায় ঠেলে দেয়। কিন্তু তাঁর অগ্রজ ও নিকটতম সমকালীনদের বৈষয়িক সাফল্য এতোটাই প্রকাণ্ড ছিল যে তিনি তাচ্ছিল্যে ভরা বিচ্ছিন্নতায় থাকতে পারেননি। যত যাই হোক, তিনি চিত্রাঙ্কনকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন; এবং যেহেতু তাঁর হাতে অপচয় করার মতো পৈতৃক তালুক বা ভরসা করার মতো আত্মীয়স্বজন ছিল না, তাই ক্যানভাস বিক্রি করা ছাড়া তাঁর পথও ছিল না, আর ওইসব ক্যানভাস তিনি সর্বসাকল্যে যেসব ছবি এতোটা ঘৃণা করতেন, তখন পর্যন্ত তাদের মতোই নকলপ্রবণ ছিল।   

তিনি যে-ওস্তাদদের নকল করতেন, তাঁদের কুলক্রম মোগল বা রাজপুতদের মতো যে বিলুপ্ত হয়নি, তা কোনোই ফারাক তৈরি  করেনি। উপরন্তু এতেও কিছু এসে-যায়নি যে আধুনিক ইউরোপীয় আর্টেই প্রাচ্য-ঐতিহ্য এখনো বেঁচে আছে ও সৃষ্টিশীল, তা এমনসব সৃষ্টিকর্মের প্রেরণা জোগাতে সমর্থ যাদের সপক্ষত্যাগ ছাড়াই রেনেসাঁসের গৌরবগাথার সঙ্গে তুলনা করা যায়। গুরুত্বের কথা এই যে ইউরোপীয় আর্ট কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, বরঞ্চ এক প্রাচীন বৃক্ষের শাখা, যা বিদেশি মাটিতে লাগানো যেত না বটে, কিন্তু পরিপুষ্ট ফলের সম্ভাবনা আনতো। উদাহরণস্বরূপ, পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পীর প্রধান প্রকাশমাধ্যম তেলরং ভারতবর্ষে তৈরি হতো না, আর এ নিয়ে আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়; ভারতবর্ষীয় আবহাওয়ার নির্দয়তায় বছরের বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে কাজ করা ছিল দুষ্কর; আমাদের নর-নারীরা এমনসব ম্যাড়মেড়ে পোশাক পরতেন যে তাঁদের বাস্তবানুগভাবে সাধারণ বেশে চিত্রিত করা যেত না। উপরন্তু আমাদের মনোচাঞ্চল্যের উদ্দীপনা ছিল সহজদৃষ্ট; আমাদের জীবনের ছন্দ এতোটা কাটা-কাটা নয় যে তাকে বেপরোয়া তুলির আঁচড়ে পালটানো যাবে; আমাদের ঘরবাড়ি ছিল ন্যাড়া; যে-আবহাওয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচিতি, তা ঝোড়ো; তথা শতকের পরে শতক ধরে সামাজিক ও রাজনৈতিক দমনে ব্যক্তি পরিণত হয় নৈর্ব্যক্তিকে। এই আবহে ইউরোপীয়ের বন্যক্ষমতা মানানসই হয়নি; একে চিত্রিত করার চেষ্টা বড়জোর এক ধরনের ভণিতা; এবং যে-শিল্পী নিজেকে গুরুত্বের সঙ্গে নেবে, সে দীর্ঘকাল এই ভূমিকায় তৃপ্তি পাবে না।

দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, তার্কিকেরা যেমনটা চান, নেতিবাচক আর ইতিবাচক জ্ঞানের মধ্যের পথ ঠিক তেমন সোজা নয়; এবং যদিবা যামিনী রায় শুরু থেকেই ভারতবর্ষীয় আর্ট কী দিয়ে তৈরি নয়, সে-ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন, এর অক্ষয় সারাৎসার বের করতে তাঁর পনেরো বছরের তীব্র মনোকষ্ট ও ক্লেশ সইতে হয়। কিন্তু শুরুতেই তাঁর ছিল সেই গুরু যাঁর পদ্ধতি তিনি বাণিজ্যিক মুখচিত্রে বা পোর্ট্রেটে ব্যবহার করে আসছিলেন, এবং যদিবা হুইসলারের প্রতি তাঁর আসক্তিকে আজ অপক্ব মনেও হয়, তা এই বিদেশিকে তাঁকে দুটো জিনিস শেখানো হতে নিবৃত্ত করেনি যে, চিত্রকলা থেকে চিত্রালঙ্করণ ততোটাই আলাদা, যতটা তা নৈমিত্তিককে অঙ্কনশৈলীর অধীনস্ত করে, আর কবিতা যদি ভাব নয়, শব্দ দিয়েই তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিমানের চাহিদা নির্বিশেষে চিত্রের পুরোটাই রেখা আর রঙের সৃষ্ট এক সুসঙ্গত সম্পূর্ণতা। অবশ্য সন্দেহ থাকে একে প্রায়ই প্রয়োগ করার ক্ষমতা ছাড়াই যে-মেজাজ থেকে হুইসলার এ-তত্ত্ব বানিয়েছিলেন, তাঁর চিত্রকলায় আপাত দৃশ্যমান সেই ক্ষীণবলতার সঙ্গে তা সম্পর্কিত আর সে-দুর্বলতায় যামিনী রায় এমনকি তাঁর কৈশোরেও ভোগেননি। একই সঙ্গে এও মানতে হয়, গৌণ পুঙ্খানুপঙ্খ আর দেশজ উপকরণে যে-চিত্তবিক্ষেপ ঘটে, তাঁর কাছে তা সবসময়েই চূড়ান্ত ফলাফলকে নস্যাৎকারী ঠেকতো।

যাই হোক না কেন, যে-ব্যক্তি রংকে অঙ্কনের মৌল উপাদান হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন, শেষ পর্যন্ত তার কুলপরিচয় ভুলতে বাধ্য ও তাকে আলোর ধারক-বাহক হিসেবে বিবেচনা না করে মোজাইকের অসংখ্য খণ্ড হিসেবে ভাবেন। এমন মনোভাবে তিনি যদি তখন সেজানকে (Ceznne) জানতেন, হয়তোবা সমপ্রকৃতির সাহস পেতেন; এবং ওই ফরাসির দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সম্ভবত আরো আগে মাত্রাতিরিক্ত নমনীয়তা ছেড়ে এমন ব্যাপকতর সামঞ্জস্য খুঁজতেন যাতে আলো তাঁর পাওনা পায়, আর শারীরবৃত্তি ও আবরণ তাদের বস্তুগত পার্থক্য মিটিয়ে পরিশেষে সমপরিমাণে প্রতিফলনকামী হয়। কিন্তু তখনো তা হওয়ার নয়। তাঁকে যাত্রার শুরুতে ফিরতে হয় আর তার পরেই তিনি একাধিক ইউরোপীয় গুরুর সঙ্গে তাঁর আকস্মিক-আপতিক কুটুম্বিতা দেখতে পান। আর ইতোমধ্যে ভারতবর্ষীয় আর্টের রহস্য নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়, আর ছিল ঐতিহ্যানুগত হয়েও কতটা গতানুগতিকতা ও নকলনবিশির আওতামুক্ত থাকা যাবে তথা কোথায় বাতিকগ্রস্তকে জাতিভ্রষ্ট বা প্রায় দেশজাধিকারচ্যুত করে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়, সে-সমস্যা নির্ধারণ। মোটের ওপর মানবিক উদ্ভাবন হয়তো নিছক আরেক কল্পকথা; মানুষের কার্যপ্রণালির মুখ্য ধমনী বুঝিবা প্রত্নপ্রস্তর যুগেই স্থির হয়ে গিয়েছিল; এবং সজ্ঞান ব্যক্তি সর্বোচ্চ ততোটুকুই মৌলিকতার অনুমোদন পায়, যা সম্ভবত সুদূর অতীতে অসামর্থ্যরে ভ্রান্ত ধারণায় প্রত্যাখ্যাত শৈলীর পুনরাবিষ্কারেই সীমিত।

কিন্তু আমি প্রত্যাশায় আছি। তাৎক্ষণিকভাবে সমকালীনদের ভুলচুক এড়ানো কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল; আর অঙ্কনের দার্ঢ্য ও দৃষ্টির শুদ্ধতা বিসর্জন না দিয়ে তথা কুশ্রী চিত্রকৌশলই সুশ্রী কান্তিবিদ্যা তথা যুক্তিবিমুখতা কদর্যের বিরোধালংকার বা প্রতিপ্রত্যয়, এ-বিশ্বাস না করে বাজারের চাহিদা মেটানো যায় কি না, সেজন্য এক সৎপ্রচেষ্টা চালানো অবশ্যজরুরি হয়ে পড়ে। জনগণ রস চাইছিল। এটা তাঁরা পেতোও। কিন্তু তাঁদের এ-শিক্ষার দরকার ছিল যে জিনিসটা মৃত সম্রাট আর পৌরাণিক অক্ষয়দের একচেটিয়া অধিকার নয়। তাঁদের সতর্ক করা প্রয়োজন ছিল যে, চিত্রকর্ম নানান রঙের জোড়াতালির কাঁথা নয়, বরঞ্চ সমরূপ বস্তুর চিত্রবিচিত্র সৃষ্টি বা ট্যাপেস্ট্রি, এবং তাঁদের এও জানা দরকার ছিল যে, দেশি রঙের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রশংসনীয় সদ্গুণ বটে, তবে তাতে অবশ্যই আলোর সমমাত্রিক-সুসমঞ্জস ক্রমবিকাশকে প্রতিস্থাপন করতে নিষ্প্রাণ মসৃণ রঙের নিয়মসুদ্ধ পদ্ধতিকরণের দ্বারা অর্জিত কল্পনার ঐক্য বাদ পড়বে না। বিষয় হিসেবে ছিল, জীবিতদের সৌন্দর্য ও গৌরব কিংবা সৌকর্য ও অনুভূতির অভাবহীন প্রাত্যহিক জীবনের বিশাল দুনিয়া; এবং যিনি চোখ মেলাতে পারতেন, তাঁর জন্য মায়ের কাছে শিশু প্রার্থনা শিখছে, মাথাল-পরা কৃষক গনগনে মাঠের মধ্য দিয়ে ষাঁড়-টানা লাঙল নিয়ে যাচ্ছে, কালো মেয়ে চকচকে চুলে লাল ফুল বাঁধতে প্রতিফলক নদীর ওপর ঝুঁকছে, এ-দৃশ্য দেখার চেয়ে অন্য কী-ই বা বেশি হৃদয়গ্রাহী হতে পারে?

 যদি চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু থেকে তার কুলনির্ণয় নির্ধারিত হয়ে থাকে, এই ছিল ভারতবর্ষীয় আর্টের বরিষ্ঠ নমুনা। উপরন্তু ছবিগুলো থেকে এমন এক শিল্পী প্রকাশ পেতেন যিনি তাঁর মাধ্যমের ওস্তাদ, নিজ চোখ, হাত ও মন সম্পর্কে নিশ্চিত, যাঁর রংদা নিতে থাকে শুধুই লাল, নীল, হলুদ, কালো ও কদাচিৎ সাদা, এবং তবু যা সবচেয়ে মুক্তহস্ত রঞ্জনকুশলীরও স্বপ্নের অতীত রূপদানে সমর্থ। এ-ছবিগুলোর প্রতি আমার একমাত্র সমালোচনা এই যে, এগুলোর রচয়িতা যদিবা নিঃসন্দেহে এক প্রতিভা, তবু স্বল্পস্থায়ী সাদৃশ্যের পরও সে-মহৎ ধারার দলভুক্ত নন, যা থেকে রেনোয়ার (Renoir) উৎপত্তি, আর যিনি রাফায়েলের (Raphael) মতোই বৌদ্ধিক বৈশিষ্ট্য না হারিয়েও ভাবপ্রবণ হতে পারেন এবং এমনকি চৈত্রিক মূল্য জলাঞ্জলি না দিয়েও সারস্বত গুণ ধারণ করেন। সন্দেহাতীত সংযমের পরেও এই সময়ের চিত্র ক্যানভাসগুলো এতোটাই ছবির মতোন যে তাদের সর্বোচ্চ মানে মাপা যেত না; এবং সহজাতভাবে এই ভয় হতো যে, শিল্পী তাঁর প্রান্তরেখায় আরো দার্ঢ্য যোগ না করলে আর তাঁর ত্বক-পেশির কৌশলে আমাদের স্পৃশ্য চাহিদায় আরো কম আবেদন না করলে তিনি নিঃসন্দেহে অভূমিষ্ঠ স্থানীয় অ্যাকাডেমির প্রথম সভাপতি হবেন। বাইরের বিষয়ের এই আন্তঃকক্ষ অনুশীলন অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে সংগঠিত হলেও প্রকৃতত্ত্বে বা বাস্তবতায় ঘাটতিতে ভরা। তারা আদৌ চিত্রালঙ্করণ নয়; কিন্তু তাদের অর্থ অসীম, যদিও তাৎপর্য নেই বললেই চলে; এবং তা তাদের চিরদিনের জন্য ভারতবর্ষীয় আর্টের প্রকৃত উদাহরণ হতে বিচ্ছিন্ন করে, তথা ইতিহাস এড়াতে না পেরে, কল্পকথা বানায় এবং দিনকার দৃশ্যকে স্থান ও কাল অতিক্রমী আলংকারিক প্রেষণা তৈরি করে মানুষী দুর্বলতাকে বিমূর্ত রূপকল্পে পালটায়।

যামিনী রায়কে যা এ-মুহূর্তে নিষ্ক্রিয়তা হতে বাঁচিয়েছে তা তাঁর সংযমবোধ। ইতোমধ্যেই প্রাগুক্ত পর্যায়ে পৌঁছার আগে তিনি মেনে নিয়েছিলেন বিয়োগান্ত নাটকে গৌরবভরা প্রবক্তার যতটা দরকার, চিত্রকলায় তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন নেই; তিনি বুঝেছিলেন প্রস্তুত রঙের অতিরিক্তে লাভ নেই, ক্ষতিই, এবং এখন চীনাদের অভিভাবকত্বে তিনি শিখতে শুরু করেন সূক্ষ্ম কোণের চতুরালি ছাড়াই দূরত্ব-জ্ঞাপন সম্ভব, চিত্রকৌশলের প্রয়োজনে খাটো করে আঁকাই রূপকল্পকে দৃঢ়তা দেওয়ার একমাত্র উপায় নয়, প্রতিমান থেকে না বানিয়েও মুখের প্রকাশ সম্ভব। তাঁর রঙের ডালা আরো ছোট হয়ে এলো, আরো লালের সামান্য ছোঁয়া মিশিয়ে কপোল জীবন্ত করা বা কালো দিয়ে কেশ বা শাড়ির আঁচল সজীব করতে ধূসর প্রাধান্য পেতেই থাকে; এবং তাই অন্তত রঙের বিবেচনায় এই পরবর্তীকালীন ক্যানভাসগুলো কোরোর (Corot) স্যুভেনির দ্য ইতালি ও মানের (Manet) অলিম্পিয়ার পর্যায়ে পড়ে। তবে অবশ্যই উল্লেখ করা দরকার, এখানে প্রত্যক্ষ প্রভাবের কোনো প্রশ্ন নেই, বরঞ্চ এটা একই ধরনের অনুসন্ধান থেকে জাত সমরূপ আবিষ্কারের আরেক দৃষ্টান্ত; এবং অন্য কিছুর মধ্যে তা-ই মানে ও যামিনী রায়ের সাদৃশ্য বাড়িয়ে থাকবে; তাঁরা দুজনেই খুঁটিনাটি সামলাতে সমর্থ হলেও মনোযোগ-বিকর্ষী সবিস্তার বর্ণনায় সাধারণভাবে ত্যক্ত হয়ে এক চিরস্থায়ী সংগতি তৈরির জন্য তাদের কঠোর হাতে সহজবোধ্য করেন।

তথাপি শিল্পী তৃপ্ত হননি। অন্য যে-কোনো সময়ের চেয়ে ভারতবর্ষীয় আর্ট বাহ্যত সুদূরেই রয়ে গেল; যদিও আরো অনেক পরেই তিনি ‘ম্যাডোনার কোলে সন্তান’ আর তিন ম্যারিকে নিয়ে দু-একটি ত্রয়ী এঁকে দেখান যে, বিষয় বা চিত্রাচার, এ-দুটির কোনোটিই ছবির জাতীয়তা নির্ধারণ করে না, যেমনটা করে থাকে বিশেষ ধরনের দিব্যদৃষ্টি দ্বারা সৃষ্ট চিত্রকৌশল –    যদিবা এটাও অনেক পরের ব্যাপার, তবু তাঁকে তখনো মানতে হয় যে শুদ্ধিকরণকে তার চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে যেতে হবে আর সব উটকো সমর্থনকে ন্যূনকল্পে নামালেই তাঁর বক্তব্য পূর্বসূরিদের সঙ্গে সমতার দাবিদার হতে পারবে। তখন পর্যন্ত একমাত্র করণীয় ছিল নমনীয়তা বিসর্জন না দিয়ে রঙের রকমফেরে সমতলের প্রতিস্থাপনে শুধুই রেখা নিয়ে কতদূর যাওয়া যায়, তা দেখা। তিনি ছিলেন আগাগোড়া যুক্তিপ্রবণ – সম্ভবত একটু বেশিই যুক্তিপ্রবণ; এবং এখন যেহেতু তিনি পরিসর থেকে প্রত্যাহার করে ফেলেছিলেন, তাই সময়ের জালে জড়িয়ে

থাকার কোনো কারণ রইল না। যেহেতু প্রধান রঙের ক্ষেত্রে শিল্পীর মুখ্য চিন্তা ছিল বহর নিয়ে, তাই ধূসরকে সরে যেতে হলো; এবং এর ব্যতিক্রমে এমনকি ছোপকে নিষ্প্রয়োজন বিবেচনায় কালোর ক্রমপরিবর্তিত আভার সঙ্গে গাঢ় জীবন্ত রেখা ব্যবহারে এলো।

এবং তখন, তাঁর প্রগতিশীল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সন্ত্রস্ত হয়ে তাঁর কট্টরতম সমর্থকেরা বিদায় নেওয়ার পরে একদিন তাঁর স্মৃতি হতে বিস্মৃতির কুয়াশা কাটল, আর তাঁর মনে পড়ল চারণ পিতার কর্তৃত্বে কাটানো কৈশোরে প্রতিমান হতে তাঁর ইচ্ছা পূরণের জন্য তাঁকে গ্রামের ঠাকুর-মিস্ত্রির কাছে পাঠানো হয়েছিল আর সেখানে তাঁকে যে-কেতাদুরস্ত রীতির হাত আঁকার কাজ দেওয়া হয়েছিল, তা বস্তুত কোনো পরিবর্তন ছাড়াই তিনি এখন যে-বিমূর্ত প্রতীকচিত্র বানাচ্ছেন, তাতে খাপ খায়। এর পরে দেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর কুটুম্বিতা নিয়ে আর প্রশ্ন ওঠেনি; এবং যদি তিনি তাঁর সম্মান নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে নতুন ক্ষেত্র জয়ের পথে যান, এটা অংশত এই কারণে যে বাঙালি আর্টের দুই সহজলভ্য দৃষ্টান্ত – কালীঘাটের পট আর বিষ্ণুপুরের পাটাকে তিনি জাতিগত শুদ্ধতার উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। প্রথমটিকে তাঁর কাছে ইউরোপের সুস্পষ্ট চিহ্নযুক্ত মনে হয়; এর প্রথাসিদ্ধ রীতির প্রকৃতিবাদ দৃশ্যত ওই উৎস থেকেই আসা; আর পরেরটি বাহ্যত স্থানীয় মূলের হলেও টলমলে রাজসভার ঠমক বয়ে বেড়াতো, তথা সেখানে শৃঙ্খলার চেয়ে ইন্দ্রিয়সুখই অঙ্কনকলার পেছনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যাই হোক, দুটির মধ্যে বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যই বেশি খাঁটি; এবং এর অসার অলংকার ছেঁকে নিলে যা থাকে, তাই পরবর্তী বছরগুলোয় তাঁকে জীবনের সেরা কিছু দেয়ালচিত্র আঁকতে উৎসাহ জোগায় : বিষয়ে এরা কখনো পৌরাণিক, অভিপ্রায়ে কখনো সত্যনিষ্ঠ, গোপিনীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, কিন্তু কাউকে বাদ রেখে নয়।

একই সঙ্গে রং ফিরে আসে পুরো গৌরবে – ঘন সবুজ আর ইন্ডিয়ান লাল, সোনালি হলুদ আর ম্যান্ডারিন নীল, গাঢ় বাদামি আর আইভরি বা হস্তীদন্তভস্মজাত কালো, এমনকি বনকপোত ধূসর আর ‘ওল্ড রোজ’ বা গোলাপ ভস্ম, কিন্তু এর কোনোটিই একটি আরেকটিতে বিলীন হতো না বা বাস্তব দুনিয়ার প্রাকৃতিক রঙের সদৃশ হওয়ার সুযোগ পেত না। এদের সবাইকে সমানভাবে প্রয়োগ করা হতো, সামান্যতম সন্দেহ বা সম্ভবত প্রকৃতত্ত্বের ছায়ামাত্রও যাতে না থাকে, সেজন্য সাক্ষাৎ তুলির আঁচড়ও সযত্নে লোপাট করা হতো; এবং এভাবেই দেখা যেতো টকটকে কমলা-লাল আকাশের পটভূমিতে হেলান-দেওয়া নীল গাছ আর অনুপস্থিত দেবতাদের জন্য সাদা পাতা আর কালো ফুল হাতে নিয়ে ভাস্কর্যের ভঙ্গিতে বসে-থাকা বা দাঁড়ানো সব প্রাণবন্ত মেয়ে; অথবা অনন্ত কুঁড়েঘরের দ্বিমাত্রিক কাঞ্ছিতে যেন মহাজাগতিক নৃত্যে ‘ব্লু বয়’১০, যার পায়ের আর হাতের অলক্তবর্ণ বনকপোতের মতো ধুসর দেয়ালে চ্যাপটা হয়ে থাকা হিমালয়ের দেবদারুর তারা-ঝলমলে বাদামির ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু রঙের এই অবাস্তবতাই এদেরকে এতোটা অদ্ভুতভাবে ভারতবর্ষীয় বানায়নি; গুণ আর সন্নিবেশ থেকেই তা যেমন আসে, তেমনি এজন্যও যে বিশ বছর তেল আর জলরং ব্যবহার করে যামিনী রায় হঠাৎ মাধ্যম হিসেবে তাদের জায়গায় নিয়ে আসেন টেম্পেরা১১, আর এই নতুন রং শুধু তাঁর বিশেষ প্রতিভার জুতসই-ই নয়, একই সঙ্গে ভারতবর্ষীয় আবহাওয়ার অনমনীয়তা সওয়ার সবচেয়ে উপযোগী। উপরন্তু, টেম্পেরা স্থানীয়ভাবে সুলভ দ্রব্য আর এতোই সস্তা যে এর অপচয়ী ব্যবহারের অনুমোদন ছিল; এবং ক্যানভাস, কাপড়, কাগজ আর কাঠে সমান দক্ষতা আর স্থায়িত্ব নিয়ে একে লাগানো যেতো।

এ-সত্ত্বেও আরেকবার থেমে যাওয়া ছিল অসম্ভব; তখন পর্যন্ত তিনি এই সন্তুষ্টি পাননি যে তিনি বাঙালি চিত্রকলার মূলসূত্র খুঁজে পেয়েছেন; এবং বিরূপ জলবায়ু ওই আর্টের পুরনো নমুনার বেশির ভাগটা ধ্বংস করে ফেলার কারণে যামিনী রায়, যেখানে সমদুর্ভাগ্য ঘটেনি সেই সাহিত্যে বাঙালি আত্মার বহিঃপ্রকাশ তল্লাশে নামেন। পণ্ডিতদের সঙ্গে তিনি একমত হন যে, বৈষ্ণববাদ ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিতে বাংলার বিশেষ অবদান; এবং প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বৈষ্ণব সাহিত্যের দু-এক পাতা পড়া তাঁর অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। আর এভাবে তিনি হঠাৎ এমন এক গল্প পড়েন যা ভারতবর্ষীয় আর্ট কী, সে-সম্পর্কিত তাঁর জীবনব্যাপী সমস্যাই শুধু নয়, সাধারণভাবে আর্ট কী, বাহ্যত তাঁরও সমাধান নিয়ে আসে। গল্পে ছিল, চৈতন্য ভক্তিবাদে এমন কুশলী হয়েছিলেন যে, তাঁর সামনে কৃষ্ণ নাম বললে তিনি নিমেষে পুলকের মূর্ছায় পৌঁছাতেন। ভক্তেরা তাই প্রভুকে এমন আগ্রহভরা পাহারায় রাখতে মনস্থ করেন যে একবার এক নবীন কবি সন্তের খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে এক দীর্ঘ ভক্তিমূলক কবিতা উপহার দিতে নবদ্বীপের লম্বা পথ মাড়ান, কিন্তু তিনি তাঁর সাক্ষাৎ পাননি। শেষে, ধৈর্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি মুখ্য শিষ্য স্বরূপ দামোদরকে তা শুনতে রাজি করান। কিন্তু উৎসর্গমূলক চতুষ্পদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বরূপ দামোদর উপস্থিত বিমুগ্ধ সমাবেশকে এই বলে ঝাঁকুনি দেন যে, বস্তুটি কাকের বিষ্ঠার মতোই বীভৎস, কেননা রচয়িতা শুরুতেই নশ্বর নবীর সঙ্গে বিশ্বপ্রভু জগন্নাথের তুলনা টেনে নন্দনতত্ত্বের প্রথম সূত্র, যেখানে বাস্তব আর অবাস্তব তথা প্রাকৃত আর অতিপ্রাকৃতের মধ্যে বিভ্রান্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা লঙ্ঘন করে অমার্জনীয় পাপাচার করেছেন।

হিতোপদেশ পরিষ্কার : আমাদের ঐতিহ্য আর্টে বস্তুনিষ্ঠ দুনিয়ার প্রবেশ বন্ধ করেনি; এতে শুধু এই চাওয়া হয়েছে যে, সত্য ও গল্প ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নিজ নিজ গুণে উপস্থাপিত হবে। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় পার্থক্য কে নিরূপণ করবেন? নিশ্চিতভাবেই এটা সেই সভ্য সাবালক নন যিনি শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে  প্রকৃতি হতে পরিশীলন ও বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে কার্যত তাঁর বোধ হারিয়ে ফেলেছেন; কিন্তু এটা সেই গুহামানব যিনি আলতামিরায় আঁকতেন, সেই বর্বর যিনি নিউগিনিতে কাঠ খোদাই করেন, সেই তিন বছরের শিশু যিনি মানব রূপকে চারটি আলো-ছড়ানো রেখাসহ দুটি অসম অণ্ডের মতোন দেখেন। অবশ্য এ-ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা কোনো আধুনিক মানুষের পক্ষে সম্ভবত সাত বছর বয়সের পরে অর্জন করা সম্ভব নয়। তবু, বাংলার দূরবর্তী সব জেলায় এখনো এমন সব শিল্পী আছেন যাঁরা শঠতা ছাড়াই তাঁদের ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা জানাতে পারেন, যাঁরা আমরা যেমন ভুলেছি, তেমন ভোলেননি যে শুধু দূরে থেকেই বস্তুর পুরোটা দেখা সম্ভব, আর দূরত্ব বর্তুলকে সমতলে পরিণত করে তথা ঘনক বা কিউবকে সমান-চ্যাপ্টা বানায়। দ্রষ্টা সামর্থ্যমতো সঙ্গে যা আছে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন টুকরো-টুকেেরা ফরমায় ধীরে ধীরে তা ঠেসে-গুঁজে দেন। প্রত্যেক সত্যনিষ্ঠ চিত্রীর তাই সম্ভব হলেই ইঙ্গিত দেওয়া উচিত ছবির কতটা তাঁর নিজের সম্পদ আর কতটার জন্য তিনি বাইরে ঋণী। অশিক্ষিত শিল্পী এটা করতেন তিনি যাঁকে শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে অপছন্দের লোকের চেয়ে বড় বানিয়ে যদিও তিনি দুজনকেই চোখে দেখতেন প্রায় সমান; এবং আকার বদলাতে গিয়ে তিনি যদি বাহ্য প্রত্যক্ষ রূপও না বদলাতেন, তিনি তাঁর চোখের কাছে অবিশ্বস্ত হতেন না।

এর বিকল্প ছিল যে-নিকট দৃষ্টি সব কিছুকে বর্গ ও সমতলের অসংগঠিত সমষ্টিতে নিয়ে ঠেকায়, তার চর্চা করা; এবং যেহেতু যামিনী রায় ইউরোপীয় প্রযুক্তির স্বর্ণ যুগে জন্ম নেওয়া কিউবিস্টের মতো নির্বস্তুকের বা ‘থিংসে’র সঙ্গে নৈকট্য দাবি করতে পারতেন না, তাঁকে সেই দূরদৃষ্টির আশ্রয় নিতে হতো, যা বর্তমানের পশ্চিমাদের অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন কল্পচিত্র বা ভিশনের চেয়ে কোনো অংশেই কম সত্যনিষ্ঠ নয়। কেননা আদিম চিত্রকরের বিনয় আর নম্রতা কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়; এর প্রমাণ মিলত যখন কোনো অশিক্ষিত মক্কেল তাঁকে ধর্মগাথা আঁকার দায়িত্ব দিতেন আর তাঁকে এমন বাস্তবকে মানতে হতো যার প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল প্রগাঢ়, কিন্তু যাতে তাঁর কোনো প্রত্যয়জাত জ্ঞান ছিল না। সমস্যার প্রতি তাই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সহজাতভাবে প্রাজ্ঞ রাজপুত্রদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকর্ষপ্রাপ্ত তাঁর শহরবাসী সহোদরদের ঐতিহ্যগত অভ্যাসের মতোই; শুধু এই মূলগত পার্থক্যটা সেখানে ছিল যে যেখানে শহুরেরা এই সংশয় ধারণ করতেন যে, সকল বাস্তবই নিছক এমন এক ধরনের চালু রীতি যা দিয়ে অবাস্তবকে অতিরিক্ত ব্যঞ্জনার জন্য পালটানো ও প্রমিত করা সম্ভব, সেখানে বিশ্বাসের বলে গ্রাম্যেরা ভাবতেন বোধের বিশ্ব হতে অতিপ্রাকৃত কম নয়, বরঞ্চ আরো বেশি নিখাদ, আর এ-কারণে বৃক্ষকে বামন বানিয়ে ও বীরেদের বাড়িয়ে তুলে নিগূঢ় মুদ্রা নিষ্প্রয়োজন করতে দিনকার মূল্যবোধে পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তাই এই ছবিগুলো বোধসম্পন্ন অল্পসংখ্যককে আনন্দ দিতে তৈরি সৃষ্টিছাড়া পরীক্ষা নয়, বরঞ্চ বিস্ময়করভাবে পুরো গোত্রের অচেতন প্রাণবন্ততা নিয়ে জীবন্ত (‘অচেতন’ শব্দটি য়ুং-এর অনুসরণে, ফ্রয়েডকে নয়); এবং সেজন্যই তাদের সম্ভবত কৃষ্ণের চেয়ে রামের জীবনকাহিনিতে বেশি প্রয়োগ করা যায়, কেননা প্রথম জনের কামুকতা ধ্রুপদী ধাঁচেরই বেশি উপযোগী।

রুশোর সময় থেকে আদিমদের সদ্গুণে অদম্য আস্থা চঞ্চল রোমান্টিকের দুর্মর বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে; এবং যামিনী রায়, যিনি যদিবা কখনো আত্মপ্রসাদ ও অসীম দুঃখ সইবার অক্ষমতার প্রত্যয়ী নন, তথাপি ভারতীয় জীবনের ঐতিহ্যময় রেওয়াজগুলো যেখানে দ্রুতই জটিলভাবে বেসুরো হয়ে উঠছিল, সেই শহরের প্রতি তিনি ছিলেন অনেকটাই আস্থাহীন, তথা প্রকৃতই এমন এক বৈরাগ্যমতবিশ্বাসী যিনি পলায়নবাদিতার আখ্যা এড়াতে অসমর্থ। কিন্তু প্রাগুক্ত ঘরানায় তাঁর চিত্রকর্মের প্রথম প্রদর্শনীতে তাঁর ছবিতে সমকালীনতার অনুপস্থিতি বা দৃশ্যের তারতম্যের অভাব, এর কোনোটাই তাঁর সহযোগী চিত্রকরদের মধ্যে তৈরি আতঙ্ক বা বিদ্রূপের কারণ নয়। সে-পর্যন্ত তাঁদের উৎসাহ না পেলেও তিনি গণপ্রদর্শনীর আয়োজকদের কাছ থেকে সাধারণভাবে অনুগ্রহ পেয়ে আসছিলেন, আর তা শুধু এই কারণেই নয় যে সর্বজনীন বন্ধ্যত্বের মধ্যে তিনিই ছিলেন উল্লেখ্যভাবে উর্বরা, বরঞ্চ এজন্যও যে, তাঁর শৈলীই এমন ছিল যে, তাঁরা ঠিক জানতেন না কেন, সাধারণ অনুমোদন না পেলেও তা সবসময়ে সীমিতসংখ্যক উৎসাহীকে বিস্মিত করে। যেমন করেই হোক, এঁরাই ধর্তব্যের মধ্যে পড়তেন। কেননা আমি আগে যেমন বলেছি, ব্রিটিশেরা আমাদের সমাজকে এমনভাবে ওলটপালট করে ফেলেন যে শিল্পীরা তাঁদের সংশিষ্ট সম্প্রদায় হতে বঞ্চিত হয়ে তাঁদের উপযোগবাদী কর্ম পুরোপুরি ছেড়ে দেন ও এই আশায় বহিরাগত বা সেকেলে সব ঢং নকল করা শুরু করেন যে এসব হয়তো কিছু টাকাওয়ালা সংগ্রাহকের অর্জনপ্রয়াসী প্রবৃত্তিকে আকর্ষণ করবে। অবশেষে উন্নাসিকদের শোধ দেওয়ার আর একই সময়ে যামিনী রায়কে নামানোরও সুযোগ এলো। এখন সুনিশ্চিতই বলা গেল যে, তিনি আর প্রতীচ্য চিত্রকলার সেরা অনুকারক বা ভারতীয় আর্টের অকাট্ট অনুব্যবসায়ী নন, বাস্তবে বিদ্যমান চাষিদের কাছ থেকে চুরির কাজে নিযুক্ত এক নকলবাজ।

এর বেশির ভাগটা নিশ্চিতভাবেই তাঁর নিন্দুকদের সজ্ঞান মনে ছিল না; এবং যখন তাঁর প্রাক্তন শিক্ষকদের একজন আত্মসংযম হারিয়ে তীর-ধনুক খেলছে, এমন একদল সাঁওতাল বালককে নিয়ে আঁকা তাঁর এক সুচারু চিত্রকর্ম সম্পর্কে এই মন্তব্য করেন যে, এমনকি কোনো অর্ধচেতন শিশুও একে আরো উন্নত রূপ দিতে পারবে; ওই শিক্ষক খুব সম্ভব প্রকৃতই সামাজিক শোভনতাহীন হয়ে পড়ে থাকবেন, কেননা তাঁর নিজের কাজ যেমন দেখিয়েছে, তিনি চিত্রকর্ম বিষয়ে যৌক্তিক চিন্তায় অসমর্থ ও এর ইতিহাস সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ আর দেশের সঙ্গে যোগাযোগ এতোটাই হারিয়েছিলেন যে তিনি জানতেন না জীবন্ত ঐতিহ্য এখনো কোথায় মেলে। তবু পিতৃপূজার বদ্ধ সংস্কার তাঁর পুঁজিপাট্টা বাড়িয়ে তোলে; এবং এই স্বতঃপ্রমাণ সাফল্য তাঁর বক্তব্যকে জোরালো করে, তথা তার ফল হয় এই যে, নিরপেক্ষ ও অযোগ্য সমালোচকেরা এই ভাবা শুরু করেন যে, তাঁরা যামিনী রায়কে পটকৌশলের সেরা সাধক রূপে প্রশংসা করে ও এটা ছেড়ে দেওয়াকে তাঁর পড়ন্ত ক্ষমতার কারণ হিসেবে দেখিয়ে তাঁরা তাঁদের দায়িত্বের চেয়ে বেশি করে ফেলেছেন। সন্দেহ নেই যে, তিনি ওই ঐতিহ্য ছেড়ে দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি তা করেন ঐতিহ্যের অন্তর্নিহিত উন্নয়নসংশ্লিষ্ট সূত্রানুযায়ী যাতে এর সুযোগ আরো বড় হয় আর ঐতিহ্য-প্রতিষ্ঠার সময় যেমনটি ছিল, তার চেয়েও বেশি জটিল জীবনকে এর আওতায় আনা যায়; এবং তাঁর বিচারকেরা কলা ও পুরাতত্ত্বের পার্থক্য বুঝলে আরো অনুধাবন করতে পারতেন যে, আমাদের ঐতিহ্যে প্রাতিস্বিক উদ্যোগের গুরুত্ব কখনো উপেক্ষা করা হয়নি আর এতে সংগীত অন্যসব শিল্পের প্রতিরূপক হিসেবে বিবেচ্য এই আবশ্যিক অর্থ নিয়ে যে চিত্রশিল্পী তাঁর নিজ অতিপ্রয়োজনীয় উপাদানে সীমিত থাকলেও উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে মৌলিক হতে অনুমোদিত, বা এমনকি বাধ্য, যাতে করে স্থায়ী আবেগের কাঠামোতে অনুভবের নতুন নতুন যৌগ তৈরি করা যায়।  

সে যাই হোক, এ-ধরনের একটা গণঅগ্রাহ্যের পরে আর লোকজনের সামনে উপস্থিতিতে ফায়দা ছিল না; এবং তাঁর ছোট ভাড়া-বাসায় তিনি সময়ে সময়ে যেসব ব্যক্তিগত প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন, সেখানে বন্ধু আর দরদিদের টানা যেতো বটে, কিন্তু অর্থাভাব এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, প্রায়ই পারিবারিক আলমারি হতে ধুতি-শাড়ি দিয়ে ক্যানভাসের কাজ চলতো আর রাতের খাবার নিয়মিতভাবে বাদ দিয়ে রঙের পয়সা জমাতে হতো। অবশ্যই নব্য ধনীরা তখনো তাঁদের পূর্বপুরুষদের কুৎসিত প্রতিকৃতিতে চিরভাস্বর করে রাখতে চাইতেন; এবং যেহেতু তাঁর আগের খ্যাতির ছিটেফোঁটা অব্যাহতভাবে গায়ে লেগে ছিল, তাঁদের তাই এখনো তাঁকে কাজে লাগানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতো। কিন্তু যে-প্রতিভায় তিনি আর বিশ্বাস করতেন না, তা দেখিয়ে তাঁদের কাছ থেকে দরকারের চেয়ে বেশি অর্থ খসানো তিনি অসৎ বিবেচনা করতেন; এবং তা না করে তিনি নিজের একান্তে আশ্রয় নেন, তাঁর জীবনযাপন সবচেয়ে কম প্রয়োজনে নেমে আসে, প্রতি টুকরা কাগজও তিনি বাঁচাতে থাকেন যাতে এগুলো পরের ছবির কাজে লাগানো যায়, আর তা তিনি ক্বচিৎ-কদাচিৎ দয়াদাক্ষিণ্যে-ভরাদের কাছে বেচতেন। এরই মধ্যে, তাঁর নতুন কলাকৌশলের পরিধি বাড়াতে তিনি পরিশ্রম করতেই থাকেন; এর মধ্যে তিনি শিল্পায়িত শহরকে ঢোকাতে চাননি, কেননা একে তিনি স্বভাবতই ঘৃণা করতেন; বরঞ্চ তিনি ইংরেজবিহীন ভারতের বস্তুগত বাস্তবতাই বুঝতে চাইলেন।

কেননা তিনি এই সমালোচনার সত্যতা অস্বীকার করতে পারতেন না যে, উত্তরকালে রূপকল্পের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতার প্রতিই তাঁর উদ্বেগ বড় হয়ে দাঁড়ায়; এবং এর দ্বারা তিনি তাৎপর্যময় হয়ে উঠলেও একই সময়ে নিরর্থক হয়ে পড়ার বিপদে পড়েন। তাঁর সাম্প্রতিক কিছু শিল্পকর্মের সংকীর্ণতার সমাধান যেমন, তেমনি এদের বিমূর্ত আবেদন রক্ষা করেও দুরূহ চারিত্র্য দূর করা এখন আবশ্যিক কর্তব্য হয়ে পড়ে। অন্য   কথায়, মৃত রীতি নিয়ে খেলার এটা সময় ছিল না; তাঁর বিচ্ছিন্নতার পরিপ্রেক্ষিত তাঁকেই জোগান দিতে হতো। অন্যথায়, তিনি তাঁর সমকালীন ইউরোপীয় চিত্রকরদের সেই ভুল এড়াতে পারতেন না যাঁরা আনুষ্ঠানিক আর একান্তের পার্থক্য না বুঝতে পেরে তাঁদের মহত্তর বিশ্লেষণী ক্ষমতার কারণে বাহ্য জগৎকে যে-ধাঁধার খেলায় পরিণত করেন, তা সমাধান করার ভার তাঁরা ছেড়ে দিতেন দ্রষ্টাদের ওপর। পটভূমিতে তৃতীয় মাত্রার ইঙ্গিতসহ আনুভূমিকভাবে উপস্থাপিত নানান রঙের মিশ্রণকে আর যাই হোক  মনুষ্য-আকৃতি দেওয়া যেত না, যদি না দ্রষ্টার চিত্রকলায় এমন বিশিষ্ট জ্ঞান থাকে যে, তিনি যেদিকেই তাকাবেন শুধুই রঙিন পৃষ্ঠতল দেখবেন। বাকি আমাদের জন্য বস্তু রং আর একই সঙ্গে মানসিক ভাবানুষঙ্গের ভাণ্ডার, যার কিছুটা আবার নিয়ামনের সাদৃশ্যের কারণে যথেষ্ট সর্বজনীন বলেই বিষয়মুখী বিবেচিত হয়; এবং তাই দ্রষ্টব্য অভিজ্ঞতা থেকে তাদের অনুপস্থিতি নিশ্চিতভাবেই এমন এক অদ্ভুতত্ব, যা অবশ্যদমনীয়; অন্যথায় এক বিপর্যয়ী অধ্যাত্মবাদের জন্ম অবশ্যম্ভাবী।

তাছাড়া, পরিচয়যোগ্যতা রূপকল্পের শত্রু নয়, বরঞ্চ তা বিশেষকে ততটাই সর্বগ্রাহ্যতা দেয়, যতটা তা প্রত্যেকের কাছে নিজ সত্তায় তার অপরিচয়যোগ্য সমধর্মী হতে ভিন্ন হিসেবে পরিচিতি পায়; এবং অন্তত মনুষ্য বিষয়ে এই পরিচয়যোগ্যতার সারাৎসার ব্যক্তির সেই অবয়ব, আকৃতি বা রঙে নয়, যার সব কিছুই তার সঙ্গে তার পর্যবেক্ষকের দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল, এমনকি তার মুখের বৈশিষ্ট্য ও বহিঃপ্রকাশেও নয়, কেননা তাও পরিবর্তনীয় এবং দূর থেকে চোখে পড়ে না, কিন্তু তার হদিস মেলে তার অঙ্গভঙ্গিতে, যা একবার পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃতির দরজা খোলে। অবশ্য, সচলতার সঙ্গে, তারাও ছিল প্রতারক, কেননা এদের আবার প্রায়ই ভ্রান্ত প্রেক্ষণের ভয় ছিল, আর,  ফলে, এর শেষ হতো ভুল পরিচয় প্রতিষ্ঠায়। তবু, সংঘটনের পরিবেশে নির্বিকার থাকায় তাদের শুধুই মূল উৎস ছাড়া সবসময়ে রং আর আকৃতির ব্যত্যয় হিসেবে বিচ্ছিন্নতায় বিবেচনা করা যেত। সুতরাং, যে-চিত্রকর বর্ণনার অবিচ্ছিন্নতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁর জন্য ইশারা, ব্যক্তির রূপকল্পের সঙ্গে না হোক, অন্তত তিনি যে-প্রতিভূর শিষ্য, তার সঙ্গে একাকার হয়ে যেত; এবং যেহেতু যামিনী রায়ের বর্তমান সমস্যা ছিল যেসব সাধারণত্ব ঘটনার হেতু, তাকে মূর্ত করা, ক্রোচেসুলভ (Croce) অভিজ্ঞতার কোনো অধিবিদ্যক উপস্থাপনা নয় যা জন্মের মুহূর্তেই অপরিবর্তনীয়ভাবে আত্মবিজ্ঞাপিত, তাই তিনি পরবর্তী বছর দুয়েক নিজেকে এমনসব ছবি নিয়ে ব্যস্ত রাখেন, যা সব তথ্যকাহিনি এড়িয়ে নিঃসন্দেহে সত্যনিষ্ঠ। তিনি বাহ্যত এ-কাজটা সম্পন্ন করেন উত্তর-প্রতীকীবাদের ঘটকালিতে প্রকৃতিবাদের সাথে অভিব্যক্তিবাদ মিশিয়ে। কেননা, এটা করতে তাঁকে কার্যত বাস্তব মুখের সঙ্গে খাপ-খাওয়াতে প্রথাগত প্রান্তরেখা সামান্যই পালটাতে হয়; এবং তবু স্পষ্ট প্রতীকের সাহায্যে যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি জটিল ছন্দোময় রীতির দিকে চোখ রেখে বিশিষ্ট ভঙ্গি দিয়ে চিত্রিত করে তিনি মানবমূর্তির বয়স ও পেশা, শ্রেণি ও ধর্ম দেখাতে সমর্থ হন।

হাতে জপমালা গণনারত ত্রিমূর্তি বিধবা, একতারা-বাজনারত পঞ্চ বাউল, ভোজ-উৎসবে সমবেত ঐকতানিক জনতা, মুসলমানের নামাজ বা মহিলাদের মন্দিরে যাওয়া, মায়ের কোলে শিশু বা মহিমামণ্ডিত পিতৃকুল – এমন এক বাংলার চিত্ররূপ যা এমনকি ব্রিটিশেরা পর্যন্ত ধ্বংস করতে পারেনি; এবং, উপরন্তু, এরা এমন এক চিত্রীকে জানিয়ে যেত যিনি নিজেকে সুখপ্রেরণা থেকে মুক্ত করে ফেলেছিলেন; আর এসব ছবির বক্ররেখা আসলেই এমন অনাড়ম্বর, তথা রঙের নীল, হলুদ আর বেগুনি প্রকৃতই এমন অজাঁকালো! তবু এরা এক অদ্ভুত উপায়ে অলাভজনক হয়ে দাঁড়ায়; তারা এমন এক অতিপ্রাচুর্যের আভাস দিত যা শিল্পী কখনো চাননি; এবং যদিও দেহভঙ্গি পরম হয়ে দেখা দিত, সকল অভিব্যক্তি এদের মধ্যে রূপান্তরিত হয়নি; দৃষ্টিবিভ্রাট ঘটিয়ে আর রূপগত ঐক্য খাটো করে যত্রতত্র তারা থেকেই যাচ্ছিল, আর ফলে এমনসব প্রশ্ন ওঠে যে মুখচিত্র বা পোর্ট্রেট হিসেবে এদের লঘুত্ব শিল্পীর অক্ষমতার কারণে কি না। আরো সরলীকরণের চেষ্টা তাই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল, দেখা দরকার হলো অঙ্গভঙ্গিই একা জাতিরূপ ঠিক করে, এমনকি এর ইতিহাস লিখে রেখে, বৈশিষ্ট্যহীন বস্তুপিণ্ডে জীবন বায়ু ঢোকায় না; এবং এ-কাজে যামিনী রায় এর আগে তাঁর হাতে নেওয়া অন্য কোনো লক্ষ্যের চেয়ে কম সফল হননি।

লাল সূর্যের ওপর তেকোনাভাবে রাখা তিনটি সাদা বর্তুলাকার ক্ষেত্রসহ এক হেলানো সবুজ উপবৃত্ত সর্বস্বান্ত দৃষ্টিহীনতার পরিপূর্ণ বিষাদ রসের দ্যোতক, আর অন্যদিকে ভিন্নভাবে বাঁকানো একই ধরনের রূপরেখা এক তেজী মধ্যবয়সের গর্ব ও পূর্ণতার ইঙ্গিত দিত। চোখের ভ্রু আর নাকের খাড়ির গোটাকয়েক দাগওয়ালা চিত্র কোনোই সন্দেহ রাখত না যে, এটা এক কৃষকের আবক্ষ রূপ; কিন্তু লাল, হলুদ আর সাদার বর্ণে বর্ণে সাজানো ছোপ এক নির্লজ্জ ছিনালকে মনে করাত। নিশ্চিতই এসব ছিল বস্তুনিরপেক্ষতা বা অ্যাব্স্ট্রাকশন, কিন্তু এমন বস্তুনিরপেক্ষতা যা তার শক্ত ভিত ভোলেনি, আর তাই তা সাম্প্রতিক শব্দার্থতাত্ত্বিকদের সমালোচনায় পড়েনি যাঁরা ইউরোপের বস্তুনিরপেক্ষতার সঙ্গে বেশি পরিচিতির কারণে অবশ্যম্ভাবীরূপে মনে করতেন যে, বস্তুনিরপেক্ষতার একমাত্র প্রয়োজন সকল ধরনের সংজ্ঞা থেকে রহিত হয়ে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর উপমায় যাওয়া। ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্য সব সময়ে এ-জাতীয় আকারহীনতার বিরুদ্ধে : অন্যদিকে, তা এও বলে এসেছে যে সংবেদনে অনুভূত এমনকি মূর্তও এমন অপর্যাপ্তভাবে শাণিত যে সক্রিয় ধীশক্তির পুরস্কারস্বরূপ প্রাক্-নির্ধারিত পরিসীমার মধ্যে দ্ব্যর্থহীন রূপকল্প তৈরিতেও তা অসমর্থ। আর তাই পরিষ্কার গুণের প্রতিভূ দেবতার রূপায়িত বিগ্রহ বহু চেহারার তথা ধ্যানে কদাচ নির্ধারণযোগ্য মানুষের চেয়ে সীমাহীনভাবে বেশি নিখুঁত; এবং সেজন্যই যামিনী রায়ের এই ছবিগুলো, যারা অচিত্রিত কিছুকে সামান্যতম ছাড় না দিয়েও এমন কড়া নাটকীয়, মানবিকতায় এমন সমৃদ্ধ আর চারিত্র্যের প্রতি অন্তর্দৃষ্টিতে ভরপুর।  

একই সময়ে তিনি প্রতিকৃতি-অংকনে নতুন কৌশল তৈরি করছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এমনকি তিনি যখন রেখা আর আয়তনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে বেশি আচ্ছন্ন, সে-সময়েও তিনি বস্তুমুখীন পদ্ধতি পুরোপুরি ছাড়েননি। কিন্তু, সম্ভবত ভুল ধারণার বশেই, তিনি মনে করতেন যে, ইউরোপীয় বিশ্রুতদের পেরোনো তো দূরের কথা, তিনি কোনোদিন হয়তো তাঁদের বিশেষ উৎকর্ষের ধারেকাছেও যেতে পারবেন না। তাই তিনি তাঁর বস্তুনিষ্ঠ কাজকে পরম বিমূর্তনের ভিত্তি রচনাকারী এক অনুশীলন মনে করতেন। তিনি যে বিনয়ের কারণেই এই ভুল হিসাব তৈরি করেছেন, তা তাঁর প্রদর্শিত সব ক্যানভাসেই ফুটে উঠছিল; এবং রবিবাসরীয় প্রার্থনার সাজে বা সানডে বেস্টে দুই প্রাদেশিক গেঁয়ো মাতৃকার অসার সকালে গির্জা-যাত্রা বা এক আদিবাসী মাতার হেমন্তের উপল আকাশের নিচে উচ্ছ্বসিত সন্তান-সোহাগ, যাই হোক না কেন, চিত্রিত বিষয়টি যে কী, তাতে কিছুই এসে-যেত না, নকশাঙ্কনে দক্ষতা, চিত্রনৈপুণ্যে রঙের নৈশ্চিত্য, অভিব্যক্তি ও অবাধ পরিসরের ব্যবহারে মুনশিয়ানা এমন এক আজন্ম চিত্রকরের চিহ্নদায়ক যিনি যেকোনো দেশেই বিশিষ্ট হয়ে রইতেন। উপরন্তু, এতে এমন এক ঋজুতা ও রচনাবৈদগ্ধ্যের প্রকাশ পেত, যার সবটাই যামিনী রায়ের নিজস্ব।

এসব সত্ত্বেও শব্দটির কোনো অর্থেই তারা প্রতিকৃতি নয়; এবং এটা প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায় রইল যে বর্ণনার এই স্বল্পতা সত্ত্বেও ছবি আঁকা সম্ভব কি না। সন্দেহ নেই এটা সম্ভব ছিল; এবং কমলা ও জলপাই পটভূমিতে, তাঁর তৈরি গিরিমাটি বা ঘোর গৈরিক, সাদা ও কালো বর্ণের মধ্যবয়সী বাঙালি রমণীর পরীক্ষামূলক ছবি, যা অনেক আগে তিনি চীনাদের কাছ থেকে শিখেছিলেন, তার সরল সম্প্রসারণের জ্যান্ত উপমার পুনর্নির্মাণ বইকি। অন্যদিকে, যাই হোক, এখানেও তিনি রঙের রকমফের বা ক্রমরূপান্তর বাদ দিতেন এবং ছবির বর্ণসমন্বয় নষ্ট না করে রঞ্জকের আকস্মিক পরিবর্তনে বিভিন্ন সমতলের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতেন; এবং এমনকি তিনি যেহেতু তাঁর পরম বিমূর্ত রেখাচিত্রেও, ছবির গুণাগুণ সামান্যতম না বদলিয়েও, তাঁর দ্রষ্টাদের পরামর্শের সুযোগ নিতে ছাড়েননি, তিনি বৈকল্যজাত চারিত্র্যসম্পন্ন তাঁর এক প্রতিমানকে একই সঙ্গে মুসোলিনি ও মোদিলিয়ানি মনে করিয়ে দেয় এমন নীল উর্দির দার্ঢ্য দিয়ে সাজান। কিন্তু সাফল্য সত্ত্বেও এসব প্রতিকৃতির চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল হলুদ পটভূমির ওপর চড়ানো এক কালো মাথা, যেখানে দেহতত্ত্ববিদ্যা আর চিত্রলেখা বা ডিজাইন এমন এক সংমিশ্রণে পৌঁছায় যা বস্তুনিষ্ঠ শিল্পকলার মূল্যবোধ আর রীতির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে যায়নি আর যা প্রায় কিউবিস্টধর্মীই হতে পারত ও তথাপি শিল্পীর মনঃস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টির জন্য জায়গা রাখত।

অবশ্য আয়তনিক আকৃতির জন্য এই উদ্বেগ যামিনী রায়ের ঢংয়ে নতুন যাত্রার সূচক নয়; এবং, আমি আগে যা বলেছি, তাঁর এমনকি সর্বাপেক্ষা রৈখিক বা লিনিয়ার পর্যায়েও তিনি রেখান্যাস বা কন্টুুরকে আনুষ্ঠানিক পৃষ্ঠের সীমানা মনে করতেন। যাই হোক, অতিসম্প্রতি পর্যন্ত এসব পৃষ্ঠতল বা সারফেস সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বহিরাগত, চোখ বাহ্যসীমা থেকে অন্তঃসীমার প্রধানসব বৈশিষ্ট্য, যেমন, নাক আর মুখের দিকে এগোত; এবং যেখানে এ-ধরনের দৃষ্টিনন্দন প্রতিবন্ধক ছিল না, যেমন পুরুষের কবন্ধে, সত্য বটে, বিষয়ের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ন না করে তিনি আবার বাহ্যসীমার দিকে আসতে চাইতেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও চারিত্র্যের প্রতি পুরো সুবিচার করতে ব্যর্থ হতেন। কিন্তু এখন হঠাৎ, সম্ভবত প্রতিকৃতি আঁকার জরুরি প্রয়োজনে, তিনি বুঝতে পারলেন এ-ধরনের চিত্রাচার যথেষ্ট নয়; এবং ছবির সংখ্যাতীত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের আন্তঃসম্পর্র্ক নিয়ে ভিতর থেকে কাজ শুরু করে ক্রমান্বয়ে বহির্মুখে এলেন। উপরন্তু, রেখার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ এরই মধ্যে এমন নিশ্চিত হয়ে ওঠে যে এই যান্ত্রিক মাধ্যম নিয়ে তিনি আর সৃষ্টিশীলতার অনুভূতি পেতেন না; এবং যেহেতু এ-সময়ের মধ্যেই তিনি কিছুটা লাভের মুখ দেখায় বছরে এমন দু-একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন, তাই চিত্রকর্ম পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া না পর্যন্ত অথবা একে নিছক আর্থিক লাভালাভের একটি উৎস মনে না করা পর্যন্ত তাঁর জন্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে আসে তিনটি কীর্তিস্তম্ভতুল্য সৃষ্টি, যাদের শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘জনৈক কৃষক’, ‘জনৈক বাউল’ ও ‘প্রার্থনা’, যাতে এমনকি ইশারাকেও নিষ্প্রয়োজন ভাবা হয়, মনুষ্যদেহের ডেলা ও পৃষ্ঠতলের নিছক পুনঃআয়োজনই আকৃতির ধরন নির্ধারণে ও তাদের নাটকীয় প্রচণ্ডতা দানে যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ায়।

এ-মুহূর্তে সেই পাঠকের কাছ থেকে সম্ভাব্য সমালোচনা প্রত্যাশা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যিনি সম্ভবত জিজ্ঞাসা করবেন ভারতীয় আর্টের পেছনের সূত্র বের করতে কেন এতো সময় ও শক্তি ব্যয় করা হয়েছে, কেননা শেষ পর্যন্ত তো মানতেই হতো এটা তার প্রতীচ্য প্রতিপক্ষের চেয়ে ভিন্ন শুধু নামেই; এবং আর্ট তো সর্বোপরি বিশ্বজনীন, ওই পুরনো ছেঁদো গালভরা বুলির  পুনরাবৃত্তিই  এর  উত্তর  হবে  না। প্রকৃতপক্ষে, তা নয়; বরঞ্চ, অন্যদের সঙ্গে এর আপাত সাদৃশ্য যাই হোক না কেন, এটা এজন্যই বিশ্বজনীন যে, আমাদের শব্দভাণ্ডারে প্রত্যেক কাজের অন্তর্নিহিত দ্যোতনাবোধক যথেষ্ট শব্দ নেই; এবং তাই যদি পর্যাপ্তসংখ্যক নামবাচক বিশেষ্যের অভাব আমাদের ভারতবর্ষ ও ইউরোপের আর্টের পার্থক্য ভুলতে বাধ্য করে, একই কারণ আমাদের জার্মান ও বাংলার মতো দুটি ভিন্ন ভাষার সাদৃশ্য দেখতে সাহায্য করা উচিত, কেননা দুটিই ইন্দো-জার্মানিক গোষ্ঠীভুক্ত। তা সত্ত্বেও প্রত্যেক সংস্কৃতির তার পাশের অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে বৈশিষ্ট্য ও অমিল মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়ে বাঙালি আত্মাকে ভারতবর্ষীয় আত্মা থেকে আলাদা করে দেখতে হবে; এবং আরো ভালো শব্দের অভাবে কথাটি এভাবে বলা যায় যে বাঙালি অন্য প্রত্যেক ভারতবর্ষীয়ের চেয়ে বেশি বস্তুবাদী ও প্রয়োগমুখী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। কোনো দৈবাতে বাংলা ভারতবর্ষে পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার প্রথম বিতরণ কেন্দ্র হয়নি; এবং যদিও ওই সহজাত সৌসাদৃশ্য বাঙালিকে প্রতারক স্বাচ্ছন্দ্যে ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি আত্মস্থ করতে সাহায্য করেছিল কি না, সে-বিবেচনা আমাদের বিপথে নিয়ে যেতে পারে, তবু এটা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, অতীন্দ্রিয় হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে শেষ বড় বিদ্রোহ হয়েছিল এই প্রদেশেই, যেখানে এমনকি চৈতন্যের আগেও ঘোষণা করা হয়েছিল সবার ওপরে মানুষ সত্য।

অন্য কথায়, বাঙালি স্বাভাবিকভাবেই জীবনকে অতীন্দ্রিয়তার অবস্থান থেকে না দেখে সর্বব্যাপিতা থেকে দেখেছে; এবং এর ফলে হিন্দু উপাস্যমণ্ডলীর দেবতারা মানুষে পরিণত হন, যেমন শিব বনেন যুবতী স্ত্রী-প্রভাবিত আমুদে পেটুকে আর রাম হন এমন এক অবিপজ্জনক অকৃত্রিম গ্রাম্যে, যিনি ঘটনাক্রমে সাহসী কাজ করেন। গ্রাফিক আর্টে বা চিত্রলৈখিক কলায় এই ঝোঁক আকস্মিক উপাদানমুক্ত বস্তুনিষ্ঠায় প্রকাশ পায়; এবং যেসব পল্লি শিল্পীর চাক্ষুষ দুনিয়ার স্পষ্ট ভাষায় অদৃশ্য নিয়ে চিত্রাচারের কথা আমি আগেই বলেছি, তা বাদে এমনকি পাহাড়পুর আর মহাস্থানগড়ে আবিষ্কৃত সুপ্রচুর অলংকৃত ফলকেও যে-ভাবাদর্শ, সে-রচনা রীতির সূত্র যতটা তথাকথিত ‘সিডলেস’ বা নির্বীজ ধ্যানে না হয়ে থাকে, বরঞ্চ প্রকৃতির কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণে, ততোটাই অদ্ভুতভাবে সেজান-সদৃশ্য। আমি এর দ্বারা যা বোঝাতে চাচ্ছি তা হলো, ষষ্ঠ শতাব্দীর এই টেরাকোটা পাখি ও পশুকে যে-পাপড়িস্তবক ও বৃত্তাংশ বানিয়ে ছেড়েছিল, মানবদম্পতিকে যে-লতাপাতা-ফুলের অলংকরণে পরিণত করেছিল, তা আত্মপরীক্ষারত শিল্পীরা ওপর থেকে চাপিয়ে দেননি, বরঞ্চ বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পাওয়া, আর তা তুলনীয় সেজানের বর্তুল, শঙ্কু ও গোলকের সঙ্গে যেগুলোকে তিনি পরে এমন এক অভূতপূর্ব আয়োজনে সমন্বিত করেন যা তাঁর জৈব কল্পনাশক্তির সঙ্গে খাপ খায় আর এভাবে আর্ট ও প্রকৃতির মধ্যেকার পার্থক্যকরণের আলেকজান্ডার১২-প্রস্তাবিত পরীক্ষা পেরোয়।

সম্ভবত, সামবায়িক অচৈতন্যের অস্তিত্ব আসলেই আছে। সম্ভবত প্রেরণা মনোস্তাত্ত্বিকেরা যত কম বলে আমাদের বিশ্বাস করাতে চান, ঠিক ততোটা কম নয়। সম্ভবত, পূর্বপুরুষদের অনুকৃতি আমরা যতটা মানতে প্রস্তুত তার চেয়ে অনেক বেশিহারে আসে। কেননা, অন্যথায় কীভাবে পাহাড়পুরের টালির ধারণা আর যামিনী রায়ের বক আর সারস, হাঁস আর ধনেশ, ঘোড়া আর হাতি, বিড়াল আর সিংহ, এমনকি খেলনার পুতুল, যাদের মধ্যে পণ্ডিতেরা মিশরের প্রভাব খুঁজতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু যা আসলে উত্তরকালে মহাস্থান প্রতিমূর্তির অনুবর্তন, তাদের মিল ব্যাখ্যা করা যাবে? শুধু এই জ্যামিতিক রচনাশৈলীই নয়, তাঁর সাম্প্রতিকতম চিত্রকর্মেও সাঁওতাল নাচের যে-ছন্দোময়তা নিয়ে তিনি পরীক্ষা করেন, তা যত না পিকাসোর ষাঁড়ের লড়াইকে প্রতীকে পরিণত করার দুর্বোধ্যতা ও বিশৃঙ্খলার মতো, তার চেয়ে বেশি তুলনীয়, সম্ভবত, খ্রিষ্টের জন্মের দু-শতাব্দী আগের হর-পার্বতীর মহাস্থান রিলিফ বা উচ্চাবচতার উৎকৃষ্ট ঐকতানের সঙ্গে; অথবা আরো ভালোভাবে বলতে হয়, সেসব সৃষ্টিতে যেখানে এক বুভুক্ষু ব্যক্তি সাজানো নকশার সঙ্গে অসংগত না হয়ে খাঁটি পাঁজরার হাড় আর শিরদাঁড়া দেখাতে পারে, গোখরা একই সময়ে ভয়ংকর আর অলংকারশোভিত হতে পারে, মজাদার বানর আর জেদি বন্য শুয়োর, জীবনপ্রতিম মুখাবয়ব আর সত্যনিষ্ঠ প্রাণীদেহ, অপ্রতিসম সমতল আর কৌণিক রেখা মিলে ধ্রুপদী ভাস্কর্যের লালিত্যময় কাঠামোর চেয়ে বেশি তৃপ্তিদায়ক মিশ্রণ উপহার দিতে পারে।   

অন্যদিকে, যামিনী রায় কখনো কোনো একক স্কুলের সেবাদাস নন; এবং, তিনি যতই তাঁর পূর্বপুরুষদের পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কনের প্রয়াস পান না কেন, এই চেষ্টার সজ্ঞানতাই তাঁকে তাঁদের থেকে আলাদা করেছে। কেননা, তাঁরা যেমন তাঁদের সবচেয়ে স্বাভাবিক বা হাতের সবচেয়ে কাছের ঢংয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে চাইতেন, যামিনী রায়ের আসল সমস্যা ছিল এমন এক শৈলী খোঁজা যা সম্পূর্ণ সত্যবাদিতায় পুরোপুরি যোগাযোগ ছেড়ে ভনিতার মধ্যস্থতার প্রয়োজনহীন অভিন্ন লোকঐতিহ্যের ওপর বেশি করে নির্ভর করে। অন্য কথায়, যামিনী রায়ের বিকাশক্রমে এমনও সময় এসেছে যখন তিনি দৃশ্যত চিত্রাঙ্কন থেকে সরে দাঁড়িয়ে প্রায় নিছক নিরীক্ষাবাদী হয়ে গেছেন; এবং, তাঁর সবচেয়ে অনুকরণপ্রবণ মেজাজেও তিনি মানে (Manet), যিনি অলিম্পিয়ার মোটিফ বা গুণাগুণের জন্য বারবার তিতিয়ানের ভিনাসে ফিরে গেছেন, তাঁর চেয়ে বড় নকলবাজ ছিলেন না। এ-অবস্থায়, তাঁকে আমাদের ‘জনপ্রিয়’ শিল্পীদের সবচেয়ে শেষ প্রতিভূ ভাবা উদ্ভট; এবং যদিবা তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ তাঁদেরকে মাতিস (Matisse), যাঁর শৈল্পিক প্রেরণার বিশুদ্ধতার তাঁরা সদৃশ, তাঁর সাথে তুলনা করতে আমাকে বাধ্য করে, তথাপি যিনি ওই একই বিশুদ্ধতাকে নিজ ধীশক্তি দিয়ে আরো পরিমার্জিত করেন, সেই পিকাসোই (Picasso) বর্তমান দিনের কলাকারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যামিনী রায়ের মতোন।

সে যাই হোক, যামিনী রায়ের মধ্যে নিরীক্ষাধর্মী উৎসাহ সমভাবে শক্ত; এবং তিনিও বিষয় বেছে নেন আর তার পরে বিষয়বস্তু ভেঙে, পালটিয়ে ও সংস্কার করে ভাষ্যের পরে ভাষ্য তৈরি করেন, এ যেন অল্প কয়েক মাসে এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি। তা সত্ত্বেও এই গোষ্ঠীগত সাদৃশ্যের পেছনে ছোটায় কারো তেমন লাভ হবে না; এবং, যদি এটা সত্যি হয় যে মিথ্যা কিছু উপমা তৈরি না করলে সমালোচনার উদ্দেশ্য হার মানে, আমি টিএস এলিয়টের সেই বিখ্যাত বক্তব্য উলটো করে দৃঢ়তার সঙ্গে বলি, আমি যেহেতু যামিনী রায়কে একজন বড় শিল্পী মনে করি, তিনি আমাকে এক লম্বা তালিকার অনেক পূর্বসূরির কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু, রোয়ার (Rouault) সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য সুস্পষ্ট; তিনি দেরাঁকে (Derain) সবসময়ে স্মরণে আনেন; এবং পরের দিকে তিনি যেভাবে তুলি আর রং ব্যবহার করেছেন, আর পুরুষ মুখাবয়বের যে-ধরনের প্রতি তিনি বেশি আকৃষ্ট হন, তাঁকে কিছুটা গুণগতভাবে ভিন্ন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন বিপ্রতীপ ভ্যান গঘের (Von Gagh) শ্রেণিভুক্ত মনে হয়। এতদসত্ত্বেও, এসবই দৈবাৎ সাদৃশ্য, যার উৎপত্তি পরিণতিজাত নয়, কারণের সাযুজ্য থেকে; এবং যামিনী রায় শুধু এমন এক শহরেই সারাটা জীবন কাটান যেখানে সমকালীন ইউরোপীয় আর্টের প্রায় কোনো নমুনাই আসে না, কিন্তু এমনকি, প্রত্যেক ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর অজ্ঞতা এমন প্রকাণ্ড যে এখন পশ্চিমে চালু যে-কোনো নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে ভাসাভাসা পরিচিতিলাভও তাঁর সম্ভব নয়।

আমি যামিনী রায়কে চিত্রকরদের কোনো সম্ভাব্য আধিপত্যপরম্পরায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করব না, কিন্তু তাঁর ব্যাপারে আমার একমাত্র আপত্তির এক ব্যক্তিগত টীকা লিখেই শেষ করব। কষ্টকর জীবনের মধ্য দিয়ে তিনি যে বিরতিহীন ক্রমবিবর্তন দেখিয়েছেন, তা সত্ত্বেও তিনি এখনো সেই অভিজাত বাঁধা, যা তাঁকে সমকালীন দৃশ্যপট থেকে আলাদা করে, তা ভাঙতে পারেননি; এবং সন্দেহ করি তাঁর এই দূরবর্তিতা যতটা না বাছাইয়ের, তার চেয়ে বেশি পশ্চাদ্গতির প্রতি অন্তর্নিহিত ঝোঁক থেকে আগত, আর এর দার্শনিক বহিঃপ্রকাশ সঞ্জীবনী স্বপ্নে পরিপুষ্টিত অন্ধ গান্ধীবাদে। সম্ভবত এ-ই তাঁর ছবির বিষয়বস্তুর পছন্দ স্থির করে; এবং অভিরুচি অনুযায়ী তিনি দৃশ্যত ইচ্ছার পরম কর্ম দ্বারা নৈরাজ্য থেকে শৃঙ্খলা তৈরি না করে প্রকাশ্য ছন্দোময় বিষয় খোঁজেন। তা না হলে কেন তিনি নৃত্যরত সাঁওতালদের মহিমা দ্বারা আকৃষ্ট হন, কিন্তু যখন তাঁরা মাতাল উচ্ছৃঙ্খল, তখন তিনি বীতস্পৃহ, অনাদি কৃষকে আকৃষ্ট আর শিল্পশ্রমিকে আতঙ্কিত, অথবা প্রার্থনারত মুসলিমদের গীতিময়তায় অভিভূত, কিন্তু তাঁদের ধ্বংসাত্মক উন্মত্ততায় বিতৃষ্ণ? এখন তিনি যে শৈলীর ধারক, তা এতটা সমন্বয়সক্ষম যে তাতে যে-কোনো বিষয় সামলে উঠতে পারে; এবং যদি তিনি তাঁর সমবেদনাকে আরেকটু বাড়াতে পারতেন, তবে কীর্তন শোভাযাত্রার বাড়াবাড়ির চেয়ে সংগঠিত শিল্পশ্রমিকদের বিক্ষোভ তাঁকে আরো কম কষ্ট দেবে।

উপরন্তু, বিকাশসাধন শিল্পীর জন্য অবশ্যম্ভাবী যোগ্যতা নয়। বিশেষ করে, ধ্রুপদী যুগে মহৎ চিত্রকরেরা দীর্ঘ জীবনেও সমান মাপের উৎকর্ষ বজায় রেখেছেন ; এবং, যদি, যামিনী রায়, তাঁর সব ঐতিহ্যানুরাগ সত্ত্বেও, ত্রুটিহীনতার তাড়ায় পর্ব থেকে পর্বে যেতে প্ররোচিত হন, তা এই কারণে যে তাঁর বিষয় নির্বাচন যা বোঝাতে চায়, তার মন-মেজাজের প্রশান্তি তার চেয়ে কম। অবশ্যই, আত্মিক অস্থিরতা জয়ই সব অধিক্ষেত্রের লক্ষ্য; কিন্তু অস্থিরতা সত্ত্বেও স্থিরতার ভাব দেখানো বিপজ্জনক অবদমনের, এমনকি অবচেতন অসততারও, সুনিশ্চিত চিহ্ন। মোটের ওপর, এতদিনে আমাদের শহরের হাঙ্গামা আমাদের মৃত্তিকায় ততটাই গেড়ে বসেছে যতটা নির্বাক আমাদের সমভূমি আর প্রতাপে ভরা আমাদের পর্বতমালা; এবং যেহেতু যামিনী রায়ের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য জনগণের পরিচয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা, তাঁরা যখন পূর্বনির্ধারিত পথেই, তখন তাঁদেরকে ছেড়ে যাওয়া তাঁর অবশ্যই ঠিক হবে না। আমার চিন্তাজগতের সকল মানুষের মধ্যে তিনিই তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার ও তাঁদের আকাঙ্ক্ষাকে আকৃতি দিতে পারার যোগ্যতা রাখেন; এবং আমি নিশ্চিত তিনি তাঁর কাজ শেষ করতে পারলে তাঁদের হতাশ করবেন না। যা দাঁড়াল, আমার জানা শিল্পীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি তৃপ্তিদায়ক : আমরা দুজনে একই ইতিহাসের ধারক এবং আমাদের ভবিষ্যৎও অভিন্ন।

১৯৩৯

কৃতজ্ঞতা

এই ভাষান্তরের কাজে প্রথম খসড়ার পরে থেকেই ইংরেজি সাহিত্যের প্রাক্তন ছাত্র ও সার্থক অনুবাদক মেজবাহ উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনায় উপকৃত হয়েছি। শিল্পী ও লেখক আবুল মনসুরও আলোচনায় সময় দিয়ে কৃতার্থ করেছেন। দুজনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা অসীম।

টীকা : বর্তমান কালে সব বিষয়ই, শিল্পীদের পরিচয়-বৃত্তান্তসহ,  শ্রমসাশ্রয়ী ওয়েবসাইটে প্রাপ্য বিধায় এর বাইরে চলাফেরার দরকার নেই। শুধু সুধীন দত্ত প্রসঙ্গ অনিবার্য বিধায় অল্পকটি টীকা অনুলিখিত হলো :

১। স্বতঃবিরোধ (Antinomy) : তর্কবিদ্যা ও দর্শনের জরুরি প্রত্যয় অ্যান্টিনোমি বা স্বতঃবিরোধ। আধুনিক যুগের আলোচনায় এনেছেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। কান্টের মতে, চার ধরনের অ্যান্টিনোমি রয়েছে, যারা সংযুক্ত এই সব ধারণার সঙ্গে : যথা –    ‘(১) স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের সীমাবদ্ধতা; (২) ভিন্ন ভিন্ন পরমাণুর সমন্বয়ে সমগ্র গঠিত; (যদিও আসলে এমন কিছুই নেই); (৩) বৈশ্বিক কার্যকারণের সঙ্গে মুক্ত বা স্বাধীন সঙ্কল্পের সমস্যা; (৪) প্রয়োজনীয় সত্তার অস্তিত্ব।’ কার্ল মার্কস্ও ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ‘অ্যান্টিনোমি’র কথা এনেছেন। সুধীন দত্ত তাঁর অসমাপ্ত ইংরেজি আত্মজীবনী দ্য ওয়ার্ল্ড অব টোয়াইলাইটে ‘অ্যান্টিনোমি’ ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও তাঁর বাংলা গদ্যে স্বতঃবিরোধ বহু-ব্যবহৃত। অভিধানে অ্যান্টিনোমি অর্থে ‘বিরোধাভাস’ শব্দটিও আছে। (সূত্র : অন্তর্জাল)

বার্ট্রান্ড রাসেলও অ্যান্টিনোমি সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যথা – ‘কান্ট চার ধরনের স্বতঃবিরোধের উল্লেখ করেছেন, যার প্রতিটিতেই প্রত্যয় ও প্রতিপ্রত্যয় রয়েছে : প্রথমত, প্রত্যয় বলছে : পৃথিবীর একটা শুরু আছে সময়ের/ কালের বিবেচনায়; তেমনি ক্ষেত্র/ স্থান বিবেচনায়ও তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রতিপ্রত্যয় বলছে : পৃথিবীর সময়ের হিসাবে কোনোই শুরু নেই; এর স্থাননির্ভর কোনো সীমাবদ্ধতাও নেই; সময় ও স্থান/ ক্ষেত্র, এই দু-বিবেচনাতেই পৃথিবী অন্তহীন। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি যৌগিক পদার্থ একই সঙ্গে বিভিন্ন অংশের সমষ্টি এবং তা নয়ও।

তৃতীয়ত, দু-ধরনের কার্যকারণ রয়েছে : একটা প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী; অন্যটি স্বাধীনতার; এর প্রতিপ্রত্যয় বলছে, শুধুই প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী কার্যকারণ সম্ভব। এবং চতুর্থত, প্রয়োজনীয় সার্বভৌম সত্তার (ঈশ্বরের) অস্তিত্ব আছে এবং নেইও। রাসেল আরো বলছেন, হেগেল কান্টের এই তত্ত্বাবলি দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হন। তাঁর দ্বান্দ্বিকতা কান্টের স্বতঃবিরোধ থেকেই শুরু হয়।’

২। রূপকল্প : এই ভাষান্তরের সর্বত্র ‘ফর্ম’ (Form) অর্থে ‘রূপকল্প’ ব্যবহার করা হয়েছে আবু সয়ীদ আইয়ুবের অনুকরণে। ‘ফর্ম’কে ‘রূপ’ লিখেছেন হাসনাত আবদুল হাই। অভিধানে ‘ফর্মে’র অনেক প্রতিশব্দ লভ্য, যা ক্ষেত্রমতো ব্যবহার্য। সুধীন দত্তের কুলায় ও কালপুরুষ গ্রন্থের ‘অদ্বৈতের অত্যাচার’ প্রবন্ধটিতে রূপজ্ঞ, রূপ, রূপসৃষ্টি, রূপবর্ণনা প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দৃশ্যমান। সুধীন দত্ত স্বগত গদ্য গ্রন্থের ‘উইণ্ড্যাম লুইস ও এজ্রা পাউণ্ড’ প্রবন্ধে Pattern-এর বাংলা করেছেন ‘রূপকল্প’। এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শেক্সপিয়র ও তলস্তয় সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে এক প্রবন্ধে ‘ফর্ম’ অর্থে ‘রূপকল্প’ ব্যবহার করেছেন।

৩। ‘সুবর্ণ খণ্ড’ বা ‘গোল্ডেন সেকশন’ : হার্বার্ট রিড বলছেন : ‘গ্রিক দর্শনের প্রথম থেকেই মানুষ আর্টে জ্যামিতিক সূত্র খুঁজেছে, কেননা আর্ট বা তার সঙ্গে শনাক্তকৃত বা অভিন্নচিহ্নিত সৌন্দর্য যদি সামঞ্জস্য হয়ে থাকে, আর তা যদি অনুপাতসিদ্ধ হয়, এটা মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে এই অনুপাত সুনির্দিষ্ট বা

স্থিরকৃত। এই জ্যামিতিক সূত্রই ‘গোল্ডেন সেকশন’ বা ‘সুবর্ণ খণ্ড’। শত শত বছর ধরে ‘গোল্ডেন সেকশন’কে আর্টের রহস্যের চাবিকাঠি বা সমাধানসূত্র বিবেচনা করা হয়েছে; এর প্রয়োগ সর্বব্যাপী; শুধু আর্টেই নয়, প্রকৃতিজগতেও এর একটা ধর্মীয় ভক্তি বা শ্রদ্ধাবোধ জুটে গেছে।’

৪। গেস্টাল্ট সূত্র : মূল কথা – যে-কোনো কিছুর পুরোটা তার অংশসমূহের যোগফল থেকে বড়। অন্যকথায়, সম্পূর্ণের বৈশিষ্ট্য অংশসমূহের বিচ্ছিন্নতায় নিরূপণযোগ্য নয়। সুধীন দত্ত লিখছেন : গেস্টাল্ট সূত্র এমন উপপ্রমেয় যার বৈধতা শুধু অপসারী পরিস্থিতিতে বারে বারে প্রয়োগ করে যাচাই করা সম্ভব। মানুষের চক্ষু কীভাবে দ্রষ্টব্য বিষয় অনুধাবন করে, তার বর্ণনা এই সূত্রে মিলবে। বিশ শতকের শুরু হতেই সাদৃশ্য, নৈকট্য, সুরূপকল্প, অবসান, সমনিয়তি ও ধারাবাহিকতা এই ছয়টি ধারণা গেস্টাল্ট সূত্রজাত। জার্মান গেস্টাল্ট শব্দটির পরিভাষা দুর্র্লভ; বলা যায়, কোনো বস্তু কীভাবে রাখা হয়েছে বা একত্রিত হয়েছে, তা-ই।

৫। ‘সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম’ : ক্লাইভ বেল এই প্রত্যয়ের উদ্গাতা। রজার ফ্রাই এর সমর্থক। ক্লাইভ বেল বলছেন : ‘আর্টে যা কিছু নান্দনিক আবেগ জাগায়, এক হিসেবে তা-ই সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম [গূঢ়ার্থব্যঞ্জক, সংকেতগর্ভ বা অর্থব্যঞ্জক রূপকল্প]। মহৎ সব শিল্গকর্মে একটি জিনিসই সর্বজনীন আর তা-ই সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম। এ সবকিছুতেই রেখা আর রং এক বিশেষ ভঙ্গিতে সংযুক্ত হয়েছে, বিশেষ বিশেষ রূপকল্প আর রূপকল্পের অনুষঙ্গ, আমাদের নান্দনিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। রেখা আর রঙের এসব অনুষঙ্গ ও সংযুক্তি, এই নান্দনিকভাবে গতিময় রূপকল্পকেই আমি সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম [গূঢ়ার্থব্যঞ্জক বা সংকেতগর্ভ বা অর্থব্যঞ্জক রূপকল্প] আখ্যা দিই; এবং দৃশ্যকলার সর্বত্র এই একটি বৈশিষ্ট্য বা গুণ বা সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম [গূঢ়ার্থব্যঞ্জক বা সংকেতগর্ভ বা অর্থব্যঞ্জক রূপকল্প] বিদ্যমান।’ হাসনাত আবদুল হাই সিগনিফিক্যান্ট ফর্মের বাংলা লিখেছেন ‘তাৎপর্যময় রূপ’। হাই এই প্রত্যয়ের পক্ষে। অন্যদিকে, নীরদ চৌধুরী সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম তত্ত্বকে পাত্তাই দেননি। কিন্তু নীরদ চৌধুরী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাবলির ওপর লিখতে গিয়ে ‘বিশুদ্ধ দৃশ্য’ ও ‘আখ্যানমূলক দৃশ্য’ নামে চিত্রকলায় যে-দুটি জিনিসের সন্ধান পাচ্ছেন, তার প্রথমটি, ‘বিশুদ্ধ দৃশ্য’, কি সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম থেকে খুব দূরের? বাংলায় ‘নান্দনিক রূপকল্প’ও ব্যবহৃত হতে পারে। ক্লাইভ বেল কি গণিতের ‘সিগনিফিক্যান্ট ফিগার’ থেকে ‘সিগনিফিক্যান্ট ফর্মে’ পৌঁছেছিলেন, এ-কথা উঠতে পারে। সুধীন দত্ত তাঁর অসমাপ্ত ইংরেজি আত্মজীবনীর প্রথম অনুচ্ছেদেই ‘সিগনিফিক্যান্ট ফিগার’ কথাটি ব্যবহার করেছেন । ‘সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম’সহ ওপরের তিনটি প্রত্যয়কেই সুধীন দত্ত চিত্রকলার জন্য আবশ্যক ভেবেছেন।

৬। অ্যান্ট্রোপি/ বিশৃঙ্খলা : শব্দটি মূলত তাপগতিবিদ্যা বা থার্মোডিনামিক্সের। পদার্থবিজ্ঞানের এই শব্দটি মহবিশ্বের ‘আণবিক বিশৃঙ্খলা’র পরিমাপক। সুধীন দত্ত এখানে সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্য ব্যবহার করেছেন। তাঁর বাংলা গদ্যের একাধিক জায়গায় তিনি শব্দটির ব্যবহারে প্রসন্নতা দেখিয়েছেন।

৭।  শ্রীরমেশ বসু-লিখিত ‘বংলার প্রাচীন চিত্র ও পট’ প্রবন্ধে (বঙ্গীয় শিল্প পরিচয়, ২০০৪, পশ্চিমবঙ্গ সরকার) : ‘খুব অদ্ভুত মনে হলেও একথা স্বীকার করতেই হবে যে, আধুনিক শিল্পের কোনও কোনও অতি-আধুনিক পদ্ধতি ভারতীয় শিল্পীরা আগে থেকেই আঁচতে পেরেছিল। শ্রীযুক্ত অজিত ঘোষের সংগ্রহে পটুয়াদের আঁকা এমন কতকগুলি আশ্চর্য রকমের ছবি আছে যা থেকে বুঝতে পাারা যায় আধুনিক শিল্পে Cubism বা Impressionism আসবার একশ’ বছর বা তারও আগে আমাদের দেশে ওই ধরনের ছবি আঁকা হয়েছে।’ (পৃ ২৫২)

প্রাগুক্ত : শ্রী অমূল্য গোপাল সেন-লিখিত ‘বংলার পট’ প্রবন্ধে : ‘এ বিষয়ে আমার মনে হয় – তথাকথিত প্রগতিশীল শিল্পীদের এ ধরনের শিল্পসৃষ্টি পাশ্চাত্যে নূতন জিনিস বটে, কিন্তু এদেশের লোকের কাছে বোধ হয় তা অতি প্রাচীন।’ (পৃ ২৪০) সুধীন দত্তও সময়-বিচারে ওই একশ বছরের কথাই বলেছেন।

৮। হুইসলার : জেমস অ্যাবোট ম্যাকনেইল হুইসলার (১৮৩৪-১৯০৩) ব্রিটেনে জীবন-কাটানো মার্কিনি শিল্পী। পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট যুগের অন্যতম অগ্রনায়ক। নন্দনতত্ত্বের আন্দোলনে ‘আর্টের জন্যই আর্ট’ বক্তব্যের দৃঢ় সমর্থক; ইঙ্গ-জাপানি স্টাইলের প্রবর্তক। সুধীন দত্ত যামিনী রায়ের হুইসলার-ভক্তিতে বিস্মিত।

৯। ‘ওল্ড রোজ’কে ‘অ্যাশেজ অফ রোজ’ও বলা হয়। বাংলায় ‘গোলাপ ভস্ম’ ব্যবহৃত হতে পারে।

১০। ‘দি ব্লু বয়’ : ইংরেজ শিল্পী টমাস গেইন্সবরার আঁকা পূর্ণদৈর্ঘ্য তেলচিত্র। ‘ব্লু বয়’ নামেই জগৎজোড়া খ্যাত। সময়কাল : ১৭৭০। এখন এর অবস্থান ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ম্যারিনোর হান্টিংটন লাইব্রেরিতে। সুধীন দত্তে শব্দটির ব্যবহার প্রতীকী।

১১। টেম্পেরা : অভিধানের সংজ্ঞা : ‘এক ধরনের অঙ্কনপদ্ধতি যাতে রঙের মিহিগুঁড়ো ডিমের সাদা অংশ বা পাতলা আঠা-জাতীয় পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়া হয়।’ সুধীন দত্ত টেম্পেরা ব্যবহারকে যামিনী রায়ের জীবনে যুগান্তকারী মনে করেন। সুধীন দত্তের মরণোত্তর প্রকাশিত দ্য ওয়ার্ল্ড অব টোয়াইলাইট গ্রন্থে ব্যবহৃত যামিনী রায়ের তিনটি চিত্রকর্মই টেম্পেরা মাধ্যমে।

১২। স্যামুয়েল অ্যালেকজান্ডা (১৮৫৯-১৯৩৮) : অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম-নেওয়া ব্রিটিশ অধ্যাপক-দার্শনিক। কোনো অক্সব্রিজ কলেজের তিনিই প্রথম ইহুদি ‘ফেলো’। সুধীন দত্তের কুলায় ও কালপুরুষ গ্রন্থের ‘অদ্বৈতের অত্যাচার’ প্রবন্ধটি মূলত অধ্যাপক অ্যালেকজান্ডারের বিউটি অ্যান্ড আদার ফর্মস অব ভ্যালু বইটি নিয়ে লেখা ।

টীকার উৎস গ্রন্থপঞ্জি

১. অমিয় দেব : দুই তিরিশে অক্টোবর-নভেম্বর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বুদ্ধদেব বসু, এবং মুশায়েরা, কলকাতা ২০১২।

২. আবু সয়ীদ আইয়ুব : আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১১ (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৮)।

৩. আবুল মনসুর : শিল্পকথা শিল্পীকথা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৬।

৪. এডওয়ার্ড শিল্স : সুধীন দত্তের অসমাপ্ত আত্মজীবনী দ্য ওয়ার্ল্ড অব টোয়াইলাইটের ভূমিকা, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭০।

৫. ক্লাইভ বেল : Art Capricorn Books, New York ১৯৫৮ (প্রথম প্রকাশ ১৯১৩)।

৬. নীরদচন্দ্র চৌধুরী : নির্বাচিত প্রবন্ধ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., কলকাতা, ২০১৫ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯৭) ।

৭. পরিচয় সুধীন্দ্রনাথ শতবর্ষ সংখ্যা, কলকাতা, ২০০১।

৮. পশ্চিমবঙ্গ সরকার (লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র) : বঙ্গীয় শিল্প পরিচয়, কলকাতা, ২০০৪।

৯. বার্ট্রান্ড রাসেল : History of Western Philosophy, Routledge, London ১৯৯৬, (প্রথম প্রকাশ ১৯৪৬)।

১০. রজার ফ্রাই : Vision & Design, Penguin Books Ltd. ১৯৪০ (প্রথম প্রকাশ ১৯২০)।

১১. শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ : পরিচয়ের আড্ডা, কে পি বাগচী এ্যাণ্ড কোম্পানী, কলকাতা, ১৯৯০।

১২. সিরাজুল ইলাম চৌধুরী : প্রবন্ধ – ‘শিল্প-সাহিত্যে মার্ক্সবাদ ও শ্রেণী-বাস্তবতা’, নতুন দিগন্ত, অষ্টাদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, ২০২০।

১৩. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : প্রবন্ধসংগ্রহ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ফাউন্ডেশন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ১৩৯০ সন।

১৪. হার্বার্ট রিড : Meaning of Art, Penguin Books Ltd. ১৯৫৯ (প্রথম প্রকাশ ১৯৩১)।

১৫. হাসনাত আবদুল হাই : শিল্পকলার নান্দনিকতা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯।