বীথি চট্টোপাধ্যায়
এই লেখা লেখবার আগে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মাঝরাত। সুনীলদা চাঁদ আর চাঁদের আলোকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন। বলতেন, ‘মানুষ একদিন চাঁদেও হয়তো বেড়াতে যাবে, সেদিন আমি থাকবো না।’ সুনীলদা হয়তো এখন পৃথিবীতে নেই। কোথাও কি আছেন? গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোনো অণু-পরমাণু বা কণামাত্র হয়ে আছে তো? আমি যে বিশ্বসংসারে ঘুরছি-ফিরছি সেখানকার কোনো রূপে-অরূপে যেভাবেই হোক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থাকুন। যতই দূরে হোক থাকুন। নেই কথাটাকে অলীক করে দিন সুনীলদা।
তাঁর চাঁদে বেড়াতে যাওয়ার সাধটা অপূর্ণ থাকল। অবশ্য কী জানি, ২৩ অক্টোবরের পরে সে সাধ মিটেছে কিনা। পৃথিবীর মধ্যেও কিছু জায়গায় যাওয়া তাঁর বাকি থেকে গেছে। খুব টান ছিল তাঁর সেসব না-যাওয়া জায়গার ওপর। যেমন অ্যান্টার্কটিকা। বলতেন, ‘ইস নাবিক কিংবা বিজ্ঞানী হলে আমি ঠিক চেষ্টা-চরিত্র করে একবার অ্যান্টার্কটিকা ঘুরে আসতাম।’
কোনো বড় শিল্পী-লেখকের একটা না একটা স্ট্রং অবসেশন থাকে। যেটা তাঁকে দিয়ে আঁকায়, লেখায়। কারোর প্রেম ছাড়া চলে না, কারোর যৌনতা আবশ্যক, কেউ সত্যে অবিচল। তেমন সুনীলদা জীবনের শক্তি পেতেন ভ্রমণ থেকে। বাঁচার জন্যে, লেখার জন্যে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হবেই। বীরভূমের ক্ষয়ে আসা পাহাড়ের রেখার দিকে তাঁর গভীর আয়তচোখে চেয়ে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমেরিকার সাজানো বৈঠকখানা থেকে উঠে গিয়ে খোলা ডেকে বসতেন বারবার। বলতেন, ‘মাঝে মাঝে গাছপালা, নদী, জল, এসব না দেখলে হাঁসফাঁস করি। বাড়িঘর, কারখানা, দোকানপাট এগুলো তো মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে মানুষ তৈরি করেছে। কিন্তু গাছ, পশুপাখি এসব কোটি-কোটি বছর ধরে মানুষ দেখেছে। তাই মানুষের রক্তের ভেতর আছে ওদের দেখার, ওদের কাছে পাবার ইচ্ছে।’ এইসব বলতেন প্রায়ই।
ইউরোপ-আমেরিকা, শান্তিনিকেতনে, বাংলাদেশে বড়-বড় গাছ দেখলে অনেক সময় সুনীলদা সেসব গাছের গায়ে এমনভাবে হাত রাখতেন, এমনভাবে গাছের গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়াতেন, যেন গাছটা ওঁর বন্ধু। গাছটাকে তিনি খুব ভালোবাসেন এমন তাঁর ভাবভঙ্গি, এমন সহজ চোখমুখ।
অনেক মানুষকেও গাছই ভাবতেন বুঝি সুনীলদা। আমি একদিন সুনীলদাকে দেখেছিলাম বেলালদাকে জড়িয়ে ধরতে। ঠিক ওইভাবেই একটা গাছকেও একা একা… তবে সব মানুষ তো আর গাছেদের মতো নয়। একদিন সুনীলদাকে বলেছিলাম, আফ্রিকার কোনো চিড়িয়াখানায় ঢোকার মুখেই একটা প্রমাণ মাপের আয়না লাগানো আছে। চিড়িয়াখানার টিকিট কাটলে দর্শক প্রথমে সেই আয়নায় নিজেকে দেখতে পাবে। পরমুহূর্তে আয়নায় লেখা পড়বে – This is the cruel most animal of the world
শুনে সুনীলদা বলেছিলেন, ‘আমি ওই চিড়িয়াখানা দেখেছি। কিন্তু মানুষ মাত্রই ওরকম ক্রুয়েল হতে পারে না। মানুষই শুধু অন্যের জন্যে কত দুঃখ পায়। মানুষ অনেক খুনোখুনি করেছে। কিন্তু মানুষের মতো ক্ষমা করেছে আর ভালোবেসেছে কোন জন্তু-জানোয়ার?’
নিশ্চয়ই সুনীলদা-ই ঠিক। কিন্তু মানুষের বেশে কিছু ক্লীব থাকে আশেপাশে। সুনীলদার মতো মানুষ তাদেরও ‘ও কিছু না’ বলে এক টানে ক্ষমা করে দিতে পেরেছেন। সুনীলদা বলতেন, ‘শোনো, আমরা কোনো মানুষই খারাপ হয়ে জন্মায়নি কিন্তু কখনো-সখনো রেগেমেগে বুদ্ধিসুদ্ধি হারিয়ে ফেললে এমন কিছু গোলমাল পাকিয়ে বসি, আপাতদৃষ্টিতে তাকেই মনে হয় খুব খারাপ কাজ।’
কোনো খারাপ কাজ কখনো করেননি সুনীলদা। আমরা হাড়ে-হাড়ে তা জানি। তবু কেউ ভুল করে ফেললে তিনি কোনো অবিমৃশ্যকারীকে একঘরে করে দিতে চাননি।
আমি হয়তো কখনো কোনো ভুল অভিযোগ করেছি তাঁর কাছে। পরে হয়তো চোখ খুলে গেছে; নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। গেছি তাঁর কাছে স্যরি বলতে। তিনি আমার স্যরি-টরি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘এবার থেকে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু একটু ভেবে তারপর কথা বোলো। তবে ও কিছু না। নিজেদের চেনাশোনার সার্কেলে ওরকম হয়। লেক ক্লাবে যাবে নাকি তোমরা?’
তিন-চার মাস আগে একটা বেশ ঘোরালো পরিস্থিতি। অনেক ঝগড়া করছে। একজন সুনীলদাকে বলতেন, ‘দেখেছেন ও কীভাবে ঝগড়া করে।’ সঙ্গে সঙ্গে অপরজন বলল, ‘ও আমি ঝগড়া করি? ঝগড়া শুরু হলো কার জন্যে?’। সুনীলদা শুধু হেসে বললেন, ‘মনে রেখো জীবন সংক্ষিপ্ত।’
এমন কতই না কথা আছে তাঁকে নিয়ে। তাঁর হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হবে। পিয়ারলেস হাসপাতালের ঘরে তিনি আধশোওয়া। ঘণ্টাখানেক পরে তাঁকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হবে। ঘরভর্তি লোক। কেউ পুজোর ফুল এনেছেন, কারো হাতে মন্ত্রপূত জল, কেউ খুব সেজেছে, কারো আঁখি ছলছল। এই সময় সুনীলদার ইষৎ ক্ষ্যাপাটে এক ভক্ত, সুনীলদাকে বলল, ‘সুনীলদা, এক ঘণ্টা পর আপনার অপারেশন, যদিও হাঁটু অপারেশন এমন কিছু বিপজ্জনক নয়, তবু হাসপাতালের ব্যাপারে যদি আপনার আজ, ইয়ে মানে ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যায়, তাই আমার এখন আপনার কাছে একটা প্রশ্ন আছে।’
ঘরভর্তি লোক তখন প্রশ্নকারীর দিকে চমকে দেখছে। কারো চোখে দারুণ রাগ, কারো বিরক্তি। সুনীলদা বললেন, ‘বলো।’
সে বলল ‘আজ অপারেশন টেবিলে ওঠার আগে আপনি আমায় এমন কিছু বলে যান, যে-কথাটার আশ্রয়ে আমি সারাজীবন বাঁচতে পারি।’
সুনীলদা মুহূর্তে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ক্ষমা করো আর ভালোবাসো।’
যে-প্রশ্ন করেছিল, সে চোখ বুজে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.