যেমন দেখেছি

কানাই কুণ্ডু
এখন কবিতা লিখি। আমি, সমরেন্দ্র, তারাপদ, শংকর, আবুল কাশেম, দুর্গাদাস প্রমুখ। আড্ডা ছিল শুদ্ধসত্ব বসুর একক পত্রিকা দপ্তরে। মাঝে মাঝে প্রেমেনদা, গোপাল ভৌমিক আসতেন। কবি-সম্মেলন হতো তারাপদর সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজে। অথবা সমরেন্দ্রর চারুচন্দ্রে। কিংবা আমার আয়োজনে সুরেন্দ্রনাথের ক্যান্টিনে। এমনই এক কবি-সম্মেলনে এসেছিলেন সুনীল। সেটাই প্রথম আলাপ। এবং কফি হাউসের আড্ডায় আমন্ত্রণ। তখন কৃত্তিবাস পত্রিকার পরিকল্পনাই ছিল না।
তারপর হঠাৎ আমার অন্তর্ধান। টানা বছর বিশেক প্রায় সারাভারত পরিক্রমা। ফিরে এসে দেখি বন্ধুরা প্রায় সবাই খ্যাতিমান। ছিটেফোঁটা কবিতা লিখি। দেখা করতে দ্বিধা। তবু দেখা হলো। শক্তি বললেন, তোর ওই অভিজ্ঞতা পদ্যে হবে না। তুই গদ্য লেখ। প্রথম গদ্য ‘চক্রব্যুহ’ নামে একটি গল্প। ছাপা হয়েছিল কৃশানু পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায়। বিমলদা (কর) সেই বছরের শারদসংখ্যার শ্রেষ্ঠ গল্প বিবেচনায় পুনঃপ্রকাশ করলেন ইত্যাদি পত্রিকায়। তখনই সুনীলের উচ্ছ্বসিত ডাক। তখন থেকেই তাঁর কাছের মানুষদের আমি অন্যতম। কত সন্ধ্যা যে তাঁর সান্নিধ্যে মধ্যরাত্রি হয়েছে! মৃত্যুর দিন দশেক আগেও তাঁর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি।
হঠাৎ ২৩-এর ভোরে ফোন। প্রায় প্রতিবেশী আমি। দৌড়ে গেলাম। দেখলাম শুয়ে আছেন সম্রাটের মতো। প্রশান্ত মুখ। নিমীলিত চোখ। নিস্পন্দ শরীর। বিশ্ব পরিক্রমারত উৎসুক চোখ আর খুলবে না। ঝরনাপ্রবাহী শব্দস্রোত আচমকা রুদ্ধ হয়ে গেল। পড়ে থাকল প্রবহমানতার নানা চিহ্ন। সুনীল এখন বেদনাবিধুর স্মৃতি।
ফরিদপুরে মাইজপাড়ার শ্যামল ছায়ায় জন্ম ১৯৩৪-এর সেপ্টেম্বরে। সেখানে শৈশব। প্রাথমিক শিক্ষা। এই সবুজ মায়ার আদিগন্ত বিস্তার তাঁর স্মৃতিতে লালন করেছেন আজীবন। প্রসঙ্গ উঠলে বিহ্বল হতে দেখেছি। তিনি ভোলেননি আর্ত বলাইয়ের গলায় পানি ঢেলে দেওয়া আজু শেখকে। ভোলেননি প্রাইমারির মাস্টারমশাইকে, যিনি ভাঙা আলোয় বাড়ি ফেরার পথে সাইকেলের বেল বাজিয়ে গাইতেন রামপ্রসাদি গান। রাতে বৃষ্টি নামলে মাঠে ছুটে গিয়ে দুহাতে তুলে নাচা পরানের দাদামশাইকে। ওষুধের সরবরাহহীন হিঙ্গুল হেল্থ সেন্টারের অসহায় ডাক্তারবাবুকে। অথবা কেরোসিনের অভাবে অন্ধকার নিরন্ধ্র গ্রাম। এমনই অকিঞ্চিৎকর ছেঁড়া-ছেঁড়া ছবি তাঁর মনের গহনে গাঁথা।
তাঁর কবিতায় পাই : ‘নৌকোর গলুইতে পা ঝুলিয়ে বসার মতন প্রিয়/ বাল্যকাল ছেড়ে একদিন এসেছি কৈশোরে/ বাবার হাত শক্ত করে চেপে ধরে নিজের চোখের চেয়েও/ অনেক বড় চোখ মেলে/ পা দিয়েছিলাম এই শহরের বাঁধানো রাস্তায়…’। শ্যামবাজার টাউন স্কুলে ভর্তি হলেন। অচেনা শহর। অজানা মানুষ। তখন           স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষ। দেশবিভাগের বিপর্যয়ক্লিষ্ট বাংলা। অস্থির পরিবেশ। তপ্ত রাজনীতি। মানুষের পোশাক, ভাষা, আচরণ, জীবনযাপন বদলে যাচ্ছে দ্রুত। দিকহারা ছন্নছাড়া যুবসমাজ।
বাবা স্কুলমাস্টার। সামান্য মাইনে। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে টানাটানিতে বিপন্ন সংসার। সুনীল ছিটকে দাঁড়ালেন রাজপথে। সঙ্গে কয়েকজন দামাল বন্ধু। শুরু হলো বেপরোয়া জীবনযাপন। কিছুই অধরা থাকল না। যখন সবাই তাঁকে বলে উঠেছিল, ‘মা নিষাদ/ সেইক্ষণে সে ভেঙেছে তার নিজ হাতে গড়া ঈশ্বরের মুখ…’।
হঠাৎ বাবা চলে গেলেন। নিজের শিক্ষা, সংসার প্রতিপালনে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন। টিউশনি, বীমার দালালি, কেরানিগিরি ধরতে-ছাড়তে জনসেবক পত্রিকায় রোববারের পাতায় বিভাগীয় সম্পাদক। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ।
কবিবন্ধুদের উৎসাহে, দিলীপ গুপ্তর ভরসায় শুরু হলো কবিতাপত্র কৃত্তিবাস। সুনীল প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। শক্তি, সুনীল, তারাপদ, শরৎ, সমরেন্দ্রসহ লিখলেন সমর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, উৎপল বসু, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত প্রমুখ জ্যোতিষ্ক কবি। কৃত্তিবাস কবিতার ক্ষেত্রে নতুন যুগের উন্মেষ। সরল গদ্যধারায় রচিত কবিতায় মানুষ খুঁজে পেল প্রাণের ভাষা। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ কবির যুগাবসান ঘটল তারুণ্যের জোয়ারে।
মধ্যরাতে যখন কলকাতা শাসন করছেন চারজন যুবক, বোম্বাই ঘুরে কলকাতায় এলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ। সুনীল-শক্তির সঙ্গে আড্ডা জমাতে। তখন অ্যালেনের হাউলের অনুবাদ হয়েছে বাংলায়। একগাল দাড়ি, যিশুখ্রিষ্টের মতো। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। রবারের চটি। আস্তানা আমজাদিয়ার চিলেকোঠায়। তুখোড় আড্ডাবাজ। হাতে সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ক্যাডিশ। হুল্লোড় জমে গেল। নিমতলা, কেওড়াতলা, খালাসিটোলা, কফি হাউস, তারাপীঠে কেটে গেল কয়েকটা মুখর দিন।
এর কিছুকাল পরেই আমেরিকার আইয়োয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পল অ্যাঙ্গেলের আমন্ত্রণ। আন্তর্জাতিক কবি/ লেখকদের ওয়ার্কশপে যোগদান। আধুনিক ঝাঁঝালো শহর। ব্যস্ত মানুষ। আকাশছোঁয়া বাড়ি। নিরালা পথ-প্রান্তর। যা-ও দু-চারজনকে দেখা যায়,  অতিব্যস্ত। আড্ডা বোঝে না। ইংরেজি কাব্য-সাহিত্যে ঘটল প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। সারাদিন কাজ এবং মাঝে-মাঝে দেশে টাকা পাঠানো। কাজ শেষ হতেই দেশে ফেরার জন্যে ব্যস্ত সুনীল। কিন্তু কোন দেশ! চাকরি নেই। বেকারত্ব। অভাব-অনটনের দেশ। অ্যালেন, মার্গারেট এবং আরো কয়েকজন বিদেশের বন্ধু থেকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এখানে চাকরি, সমৃদ্ধি, সুস্থিত জীবন। মাসে-মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাও। আরামে থাকো। কিন্তু সুনীলের সেই বাঙালের গোঁ। ফিরব আমার ওই গরিব বাংলায়। লিখব বাংলা ভাষায়।
ফেরার আগে বন্ধু মার্গারেটের সঙ্গে প্যারিস দেখা। ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড। ইতালি, সুইৎজারল্যান্ড, মিশর ঘুরে নামলেন দমদম এয়ারপোর্টে। সম্বল পকেটের মাত্র দশটি টাকা।
আবার চাকরি খোঁজা। অর্থ-উপার্জনে নানা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। এমনকি টুকরো গদ্যও। কিছু খুচরো চাকরি। তখন আনন্দবাজারে আছেন সন্তোষকুমার ঘোষ। সুনীল-শক্তির কবিতা তাঁর নজরে এসেছে। তাঁর ডাকে অবশেষে আনন্দবাজারে যোগদান। এখানেই বাকি জীবন।
কবিতাই সুনীলের প্রথম প্রেম। কবিতার জন্য তিনি অমরত্ব ত্যাগ করতে রাজি। কবিতায় নিমগ্ন তিনি। একের পর এক কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ ঘটল। পাল্লা দিচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ক্রমে কবিতাজগতে শক্তি-সুনীল একই সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকল। কবিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত হলো শক্তি-সুনীলের যুগ। এই দুই কবির কবিতা প্রিয়তর হয়ে উঠল তরুণ প্রজন্মে। জনমানসে কবিতা গ্রাহ্য হতে থাকল। কথায় কথায় উচ্চারিত হয় এই দুই কবির কবিতার লাইন। প্রকাশিত হলো বরিষ্ঠ চিত্রশিল্পী নীরদ মজুমদার-চিত্রিত এই দুই কবির দীর্ঘ কবিতার যুগ্ম সংকলন সুন্দর রহস্যময়। শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে ভারতীয় জনমানসে বিস্তৃততর হলো কবিতার নবতর উপলব্ধি।
কিন্তু গদ্যই সুনীলের নিয়তি। গদ্যভাষাতেও তাঁর অনন্য প্রকাশ। টলটলে স্রোতের মতো স্বচ্ছ-সুললিত গদ্যশব্দে এক মধ্যবিত্ত যুবকের আত্মনিবেদন। মুগ্ধ হলো বাঙালি পাঠকসমাজ। বাড়তে থাকল তাঁর লেখার তাগিদ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন। প্রথম ছোটগল্প ‘বাঘ’। প্রথম উপন্যাস – না, আত্মপ্রকাশ নয়। অনেকেই ভুল করে বলেন, শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আত্মপ্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে এটি তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস যুবক যুবতীরা। প্রকাশিত হয় সম্ভবত তৎকালীন উত্তর তরঙ্গ পত্রিকায়। এরপর প্রায় বিরতিহীন বিরামহীন গদ্যরচনা। কিশোরদের জন্য প্রথম উপন্যাস ভয়ংকর সুন্দর। ‘সন্তু কাকাবাবু’ সিরিজ বর্তমান শারদসংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে আনন্দমেলায়। একাধারে স্বনামে, নীললোহিত, সনাতন পাঠক এবং নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে গদ্য প্রকাশের ধারাসার। ছোটগল্প, উপন্যাস, ব্যক্তিগত গদ্য, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি, কিশোর উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ Ñ সে এক বিপুলায়তন। শুধু গদ্যগ্রন্থের সংখ্যাই আড়াইশোর অধিক। লিখনক্ষমতা ছিল অভূতপূর্ব। সেই সময়ে দেশ পত্রিকার বিভাজিত অংশে ছিল তাঁর ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ। আমরা বা আমার মতো কিছু লেখক, তরুণ কবিদের কেউ, কোনো নবীন গল্পকার তাঁর টেবলের বিপরীতে। আমরা গল্প করছি। কথা বলছি। কেউ তাঁর প্রকাশিত নতুন গ্রন্থ উপহার দিচ্ছে। তিনি উলটোদিকে বসে সবার সঙ্গে কথা বলছেন। সবার কথা শুনছেন। কিন্তু কলম থেমে নেই। লিখে চলেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। আবার আড্ডাও দিচ্ছেন। এ এক ব্যতিক্রমী ক্ষমতা। বাড়িতেও নানা মানুষের সমাগম। কবি-লেখক বিদেশের বন্ধুবান্ধব। সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত। রোববারের সকাল। এই দিন তিনি কলম ধরতেন না। কোনো সন্ধ্যার পরেও না। সেটা তার আহ্নিকের সময়। শেষ দিন পর্যন্ত সিগারেট খেয়েছেন। পানপর্বের পরিমাণ কমলেও অব্যাহত। শেষ রাতেও পানীয় ছিল হাতে ধরা।
রোববারটা ছিল আড্ডার দিন। ঘর ভরে যেত কবি-লেখকদের ভিড়ে। অপরিচিতের সংখ্যাও কম ছিল না। প্রকৃত সাহিত্যপাগল। নানা সভা-সমিতি, কৃত্তিবাস-সম্পাদনা, নানা উদ্বোধনে যোগদান, অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব, চলচ্চিত্রের সংলাপ বিষয়ে পরামর্শ বা লেখা, সাহিত্য অকাদেমির সভাপতিত্ব, শিশুসাহিত্য আকাদেমির সভাপতিত্ব, ভারতের নানা রাজ্যের সাহিত্যানুষ্ঠান, ভারতীয় লেখকরূপে বিশ্বের নানা দেশে প্রতিনিধিত্বের কারণে উড়ে যাওয়া, হঠাৎ আবার কলকাতা শহরের শেরিফ। এরই মাঝে নিজের ওই বিপুলায়তন লেখালেখি। প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিমের মতো গবেষণাধর্মী উপন্যাস। এর পরেই অর্ধেক জীবন। অমানবিক ক্ষমতায় অক্লান্ত উৎসাহে তিনি সম্পন্ন করেছেন তাঁর কর্মব্যস্ততা।
ছোট-ছোট উদাহরণ তুলে ধরি। সেদিন আমার বাড়িতে গল্পচক্রের বিশেষ অধিবেশন। সুনীল প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। উপস্থিত থাকবেন কথা দিয়েছেন। সকাল ৯টায় বেরিয়েছেন অন্য এক অনুষ্ঠানে। দুপুরে পত্রিকা অফিস। সন্ধ্যায় বন্ধু জহর সরকারের (তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার) বাড়িতে সস্ত্রীক আমন্ত্রণ। আমরা অপেক্ষায়। অপেক্ষায় আছেন বিবিসির সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক। সন্ধ্যা উত্তীর্ণে তিনি এলেন স্বাতী বউদিসহ। গল্প শুনলেন। সব গল্প শ্রুতিমধুর ছিল না। তবু অসীম ধৈর্যে শুনলেন। আলোচনা করলেন। গল্পকারদের নির্দেশ দিলেন। অধিবেশন শেষে আমরা কয়েকজন ঘরোয়া আড্ডায়। গল্পে-কথায় পানে-গানে মধ্যরাত্রি। বউদি মাঝে-মাঝে সুনীলকে কিছু ইঙ্গিত করছেন। সে তখন নিজস্ব মুডে। আমি বউদিকে বলি, বাড়ির কাছেই আছেন। তাড়া কেন?
রাত্রি দুটোয় যে ওকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। সাড়ে তিনটেয় ফ্লাইট! টোকিয়োয় বিশ্বসাহিত্য সম্মেলন!
পরের ঘটনায় রবীন্দ্র সদন। সেদিন সেখানে ‘গল্পচক্রে’র গল্প উৎসবের অনুষ্ঠান। রোববার সকাল ৯টা। গাড়ির পেছনে ব্যাগেজ স্যুটকেস নিয়ে হাজির সুনীল। কী ব্যাপার! মৃদু হেসে জানালেন, গল্প পড়া শেষ করেই ছুটতে হবে এয়ারপোর্ট, প্লেন তো আমার জন্যে অপেক্ষা করবে না। দুবাই হয়ে নিউইয়র্ক।
রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, সমরেশ মজুমদার, দিব্যেন্দু পালিত, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায় প্রমুখের কাছে অনুষ্ঠান শেষের আগে চলে যাওয়ার জন্য অপরাধীর মতো ক্ষমা চেয়ে নিলেন। ‘আমার পায়ের তলায় সর্ষে/ আমি বাধ্য হয়ে ভ্রমণকারী।’
সন্তোষকুমার ঘোষের উপস্থিতিতে ‘গল্পচক্রে’র দায়িত্বভার নিয়েছিলেন চৌত্রিশ বছর আগে। প্রতি উৎসবে তাঁর উপস্থিতি ছিল অবধারিত। ‘গল্পচক্রে’র পাঠের আসর বসে পশ্চিম বাংলার নানা শহর-মফস্বলে। সেবার তিনিই প্রস্তাব দিলেন, চলো বনগাঁয় ‘পথের পাঁচালি’ আশ্রমে। ‘পথের পাঁচালি’ ছিল সুনীলের দ্বিতীয় স্বপ্ন। সহায়-সম্বলহীন প্রত্যন্ত মানুষের কাছে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াই উদ্দেশ্য। প্রায় একক শ্রম ও ঐকান্তিক ইচ্ছায় পরিচালিত হতো এই আশ্রম। ছিমছাম সবুজ লাবণ্যে ঘেরা কয়েক বিঘা জমি। মাঝখানে দোতলা বাড়ি। এই বাড়িতেই সম্মেলন-গৃহ, পাঠাগার, চিকিৎসাকেন্দ্র, বিদ্যায়তন। পাশে তাঁতঘর হস্তশিল্প কেন্দ্র। পেছনে সেগুনবীথি। চারপাশে ফলদায়ী গাছে ঘেরা সবুজ প্রান্তর। আমরা অর্থাৎ গল্পচক্রের পাঠকবর্গ দুপুরের ভূরিভোজ সেরে ঢালা ফরাসে গড়াগড়ি দিচ্ছি। কিন্তু সুনীল এবং বউদি তখন কমিটি-মিটিংয়ে। গ্রাম-গ্রামান্তরে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার টিম পাঠানো, কৃষি উন্নয়নের কাজে কৃষিবিজ্ঞানীর ব্যবস্থা, কৃষির সাহায্যে স্বল্প ঋণদান এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্ত ছেলেমেয়েদের হোস্টেলে রেখে শিক্ষার ভার নিতে শহরের মানুষকে আবেদন ইত্যাদি। আমরাও একটি দুস্থ বালিকার দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলাম।
মুক্তমনের মানুষ ছিলেন তিনি। পরনিন্দা বা ঈর্ষা ছিল না। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আমৃত্যু ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। ধর্মীয় সংস্কারের ঘোর বিরোধী। লিখেছেন, ‘ধর্ম জিনিসটা পৃথিবীর মধুরতম এবং নৃশংসতম গুজব।’ বলতেন, ধর্মীয় কারণে পৃথিবীতে মানবহত্যা সর্বাধিক। অথচ নিঃশব্দ পরোপকারী।
তখন বাংলায় কৌটোয় শিশুখাদ্য দুধের অভাব। এক পরিচিত বন্ধু কফি হাউসে শিশুর দুধের অভাবে নাজেহাল হওয়ার কথা সখেদে প্রকাশ করে। একজন বলে, একমাত্র সুনীলই পারে তোর সমস্যা লাঘব করতে। পরদিন সুনীলের কাছে গেলে একটা চিরকুট লিখে তাকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর এক স্টোরে পাঠান। শুধু তখনকার সমস্যার সমাধান নয়, প্রতিমাসে তার এক কৌটো দুধ বরাদ্দ হয়।
অন্য এক বন্ধু ছিলেন মাওবাদী। জেলে গিয়েছেন। নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি পরিবার থেকে নির্বাসিত। একমাত্র সন্তান মেধাবী। অসহায় মা। ছেলেটির পড়াশোনা চালানো অত্যন্ত প্রয়োজন। আমরা সুনীলকে জানালাম। ব্যবস্থা হয়ে গেল রামকৃষ্ণ মিশনে। সেই শিশু এখন সরকারি অফিসার।
রাধানাথের আকস্মিক মৃত্যুর পর পরিবারে ঘোর অনটন। সে ছিল অমিতব্যয়ী। ভাঁড়ার শূন্য। দুই মেয়ে নিয়ে অসহায় স্ত্রী মাধবী। কার কাছে যাব আমরা! সুনীলকে জানালাম। সুনীলের আবেদনে আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ টানা তিন-পাঁচ বছর তার মাইনের টাকা অনুদানের ব্যবস্থা করলেন।
সুনীলের ড্রাইভার ছিল রাম। আনন্দবাজারের গাড়ি, ড্রাইভার। তার অবসরকালের আগে রামকে বাড়ি করার টাকা দিয়েছিলেন সুনীল। হোম সেক্রেটারি কাম কেয়ারটেকার ধনঞ্জয়। ১৯৭৭ থেকে চিরসঙ্গী। তাকেও বাড়ি করে দিয়েছেন বালিগঞ্জ কানেক্টরে। বিয়েও দিয়েছেন বউদি আর সুনীল যৌথ তদারকিতে। ধনঞ্জয়ের মতো উৎপলও আশ্রয় নিয়েছিল এ-বাড়িতে। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তারও চাকরির ব্যবস্থা করেন সুনীল সরকারি দপ্তরে। টুকরো-টাকরা এমন কত সহায়তাদান যে নিঃশব্দে করেছেন, তা জানে কেবল উপকৃত মানুষটি।
তাঁর প্রিয় গ্রন্থ ছিল মহাভারত। প্রিয় গান ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গলায় : ‘ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ…’। প্রিয় বিষয় ছিল শান্তিনিকেতনের বাড়িতে শুয়ে-শুয়ে বই পড়া। প্রিয় শখ ভ্রমণ এবং আড্ডা। মনের মতো আড্ডা পেলে সময়ের হিসাব করতেন না। সেই উদ্দাম যৌবনের মতো টলতে-টলতে বাড়ি ফেরা। কখনো বলতেন, চল কানাই, রাজার মতো হাঁটি। মাঝে প্রায়ই বলতেন, আর পারছি না। এত লেখার চাপ। আমার নিজের লেখা কিছু হচ্ছে না।
মাঝে-মাঝে মনে হতো, এভাবে শারদসংখ্যায় তিনি কেন একই সঙ্গে দু-তিনটি উপন্যাস লেখায় রাজি হতেন। সে কী প্রাতিষ্ঠানিক দায়, নাকি মিডিয়া স্ট্যাটাসের হাতছানি! আড়াইশোর অধিক গদ্যগ্রন্থের মধ্যে বিস্ময়কর কিছু গল্প, আত্মপ্রকাশ, একা এবং কয়েকজন, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী, অর্জুন এবং প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম ছাড়া সিরিয়াস পাঠক কয়টি মনে রেখেছেন! তাঁর অর্ধেক জীবনও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
তবু তাঁর সময়কালে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আমেরিকায় সুস্থিত জীবনের আশ্বাস ছেড়ে, যে-ভাষার টানে ফিরে এলেন, সেই বাংলা ভাষাই ক্রমে তাঁর বাংলায় অনাদৃত অনীহায় দিশাহারা। খুব কষ্ট পেতেন তিনি। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠায় বারবার কলম ধরেছেন। রাজনৈতিক স্তর থেকে সাধারণ স্তরের মানুষের মনোযোগে আবেদন জানিয়েছেন। মঞ্চে-সভায় চিৎকার করেছেন। পথে নেমে আন্দোলন করেছেন। গভীর হতাশায় নীরবে পীড়িত হয়েছেন। সান্ত্বনা একটাই – ক্যালকাটার বদলে কলকাতা।
পুরস্কার-সংবর্ধনা খেতাব পেয়েছেন অনেক। তবু যেন মনে হয়, ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধি না দেওয়া শুধু ভুল নয়, অমেয় অপরাধ। সেরা বাঙালির শিরোপা প্রদানের অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি তো রবীন্দ্রনাথেরও অধিক গদ্যসাহিত্য রচনা করেছেন, আপনার কি মনে হয়, একশ বছর পরে আপনার লেখা কোনো পাঠক পড়বেন? সপ্রতিভ জবাব দিয়েছিলেন সুনীল, একশ বছর পরে বাংলাই কেউ পড়বে না।
আমরা কি সতর্ক আছি!
বাংলার প্রায় প্রতি ঘরে সুনীলের কোনো-না-কোনো গ্রন্থ আছে। পৃথিবীর নানা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে অনুবাদ। সত্যজিৎ রায়, বিপ্লব রায়চৌধুরী, তপন সিংহ, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ তাঁর উপন্যাসের চিত্ররূপ দিয়েছেন। ‘বুধসন্ধ্যায়’ অভিনীত হয়েছে তাঁর নাটক। অপরিসীম জনপ্রিয় মানুষ।
৭ অক্টোবর সকালে গিয়েছিলাম। দেখামাত্র সেই প্রিয় ডাক, এসো কানাই। একাই ছিলেন তখন। একটু যেন শীর্ণ। কেমন আছেন জানতে চাওয়া পছন্দ করতেন না। বসলাম মুখোমুখি। ধনঞ্জয় এসে জানতে চাইল, চা বা কফি। আমরা কথা শুরু করলাম। তবু যেন তাল কেটে যাচ্ছে। ভালো লাগছে না। আর পারছি না। আর লেখালেখি নয়। শান্তিনিকেতনে চলে যাব। দুমাস কেবল  শুয়ে-শুয়ে বই পড়ব।
কিন্তু এখনো তো অনেক বাকি। রামায়ণের লব-কুশকে নিয়ে উপন্যাস লেখা, বিবেকানন্দ-নিবেদিতা বিষয়ে উপন্যাস, অর্ধেক জীবনের পর বাকি জীবন।
এগুলো আমার নিজের লেখা। লিখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু –
অন্য দর্শনার্থীদের সমাগম শুরু হলো। কথা বন্ধ। আমি উঠে পড়লাম। তিনি বললেন, আবার এসো কানাই। যেটা তিনি কখনো বলেন না।
গেলাম, ২৩ অক্টোবরের ভোরে। তখন তিনি গভীর নিদ্রায়। কোনো কবি-সাহিত্যিকের শ্মশানযাত্রায় এতো মানুষ দেখেনি সুনীলের কলকাতা। কেবল কবি-সাহিত্যিক, মন্ত্রী-বিধায়ক, চিত্র-পরিচালক নন, সর্বস্তরের মানুষের বেসামাল ভিড়। কাছের মানুষটিকে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের তীব্র বাসনা। কিন্তু চোখের জলে বা ফুলের মালায় সুনীলকে পাওয়া যাবে না। মহাকাল আছে তাঁর অপেক্ষায়। তবু মনে হয়, ‘এতো ছোট হাতে কী করে ধরেছ বিশ্ব/ কী করে নিজেকে সাজালে আকাশী নীলে’!