যে-ভূমি দেশ ও সারাবিশ্বের

বদলে যাওয়া ভূমি

হারুন পাশা

অনিন্দ্য প্রকাশন l ঢাকা, ২০২১ l ৫০০ টাকা

হারুন পাশা অস্থির লেখক। দুই অর্থেই অস্থির, মানের দিক থেকে ওপরের দিকে তাঁর চোখ এবং এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একই বিষয়ে স্থির থাকার মানুষ তিনি নন। আবার যা লেখেন, তার কোনো একটা দিক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন না। অনেক দিকে তাঁর নজর এবং সার্বিক বিষয়ের প্রতি হাত বাড়ানো তাঁর অভ্যাস। যা নিয়ে লেখেন, তার চৌদ্দপুরুষের খবর, তথ্য, তত্ত্ব জেনে নেন এবং পাঠকদের জানান। লেখা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। সর্বশেষ উপন্যাস বদলে যাওয়া ভূমি হারুন পাশার এসব স্বতন্ত্র সত্তার স্বাক্ষর বহন করছে প্রতি পৃষ্ঠায়।

উপন্যাসটিতে লেখক কোন বদলের সন্ধান দিয়েছেন আর এই ভূমিই বা কোন ভূমি, সেটা জেনে নিলে, উপন্যাসটি লেখার উদ্দেশ্য এবং তা লেখার জন্য লেখকের প্রস্তুতির বিপুলতাকে ধরা যায়। করোনা অতিমারির এই সময়ে আমাদের সমাজ যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং যেসব অনাকাক্সিক্ষত ও অকল্পনীয় বদলের ভেতর দিয়ে মানুষ যাচ্ছে, সেসব বদলকে সামগ্রিকভাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় ধারণ করার চেষ্টা করেছেন হারুন পাশা। এখানে ভূমি মূলত বাংলাদেশ; কিন্তু সচেতন ও সংবেদনশীল এই লেখক তাঁর ভূমিকে বিস্তৃত করেছেন বিশ্বব্যাপী। সে-কারণেই এই উপন্যাস পাঠের পরে পাঠক নিশ্চিতভাবে আঁচ করতে পারবেন, একজন সৃজনশীল লেখকের এই ধরনের উপন্যাস লিখতে কী পরিমাণ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দরকার এবং কতটুকু অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর এরকম একটি উপন্যাস লেখা যায়।

পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, হারুন পাশা সচেতন, পরিকল্পিত এবং বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগে-প্রচেষ্টায় হয়ে ওঠা লেখক। এই শ্রেণির সৃজনশীল লেখকের সংখ্যা আমাদের এই ভূমিতে কম।

বদলে যাওয়া ভূমি উপন্যাসের ভাবনা করোনা অতিমারির সময়েরই ভাবনা। এই উপন্যাস লেখার যে প্রস্তুতি, তাও অতিমারির সময়ে চার দেয়ালে বন্দি কিংবা সীমিত আকারে গতিবিধিতে থাকার ফলে একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ লেখকের অফুরন্ত সময়ের সদ্ব্যবহারের ফসল।

উপন্যাসটি শুরু হয়েছে করোনা সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে, বাংলাদেশে কবে প্রথম শনাক্ত হয়েছে, কোন এলাকা প্রথম আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, চীনের কোথায়, কবে এর উৎপত্তি, কোন কোন দেশে প্রথম ছড়িয়ে পড়েছে ইত্যাদি। করোনা ভাইরাসের আগে বিভিন্ন সময়ে যেসব ভাইরাস পৃথিবীতে এসেছে, অতিমারি সৃষ্টি করেছে, তারও তথ্য এসেছে। একইসঙ্গে ধর্মীয় ব্যক্তিদের করোনা সংক্রান্ত উদ্ভট ব্যাখ্যা-বক্তব্য তীব্র ভাষায় হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসজুড়ে ধারাবাহিকভাবে এসেছে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব। করোনাকে ঘিরে বিশ্বব্যবস্থার বদল, বিশ্বরাজনীতির নতুন মোড় এবং নতুন মোড়লের আবির্ভাব ইত্যাদি বিষয় এড়িয়ে যাননি ঔপন্যাসিক। আমেরিকার একক আধিপত্যের জায়গায় চীনের একক আধিপত্য নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে  যাচ্ছে, সে-ব্যাপারে ঘুরেফিরে বলার চেষ্টা করেছে উপন্যাসের চরিত্র। একই সঙ্গে বিশ্বরাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি, ডকট্রিন বিশ্বের সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে বদলে দিয়েছে, কিংবা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে, যেমন মার্শাল প্ল্যান, সেসবও চরিত্রের কথোপকথনে উঠে এসেছে।

কী বদলেছে আমাদের এই সময়ে? মানুষের আজন্ম চর্চিত এবং  অভ্যস্ত  জীবনকাঠামো।  অকল্পনীয়ভাবে  ঘরে  আবদ্ধ  থাকার অসহনীয় অনিশ্চিত অবস্থায় টিকে আছে মানুষ এবং সেই টিকে থাকার পেছনে অনেক মানুষ জীবনের ঝুঁকি  নিয়ে   কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর, নীরবে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে। এরকম একশ্রেণির মানুষ আমাদের পুলিশ। সাধারণ পারসেপশনে পুলিশ নিয়ে যে-নেতিবাচকতা, তা যেন করোনাকাল উলটে দিয়েছে। অন্তত উপন্যাসের চরিত্র তা-ই মনে করে। আবার ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ কিছু মানুষ দেশের জন্য সেই মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে অতিমারির এই কালে যেসব সেবার উদ্যোগ নিচ্ছেন, নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, সেসব নিয়ে উচ্ছ্বসিত চরিত্র। তবে চরিত্রের প্রচণ্ড রাগ আমাদের কয়েক শ্রেণির ব্যবসায়ীর প্রতি, যারা এই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে সরকারের কোষাগার থেকে ইনসেনটিভ নিচ্ছেন। ভিক্ষাবৃত্তির এই যে বণিক মানসিকতা, তা নিয়ে চরিত্ররা উদ্বিগ্ন। আমাদের দেশের রাজনীতি এবং বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে থাকা রাজনীতিবিদদের নিয়ে কষ্টের শেষ নেই চরিত্রের। তাদের আচরণ ও কথাবার্তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে এই উপন্যাসে।

উপন্যাসটিতে লেখক বড্ড বেশি রিস্ক নিয়ে ফেলেছেন, নিরীক্ষা করেছেন ব্যাপকভিত্তিক। প্রথমত, বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন সমকালীন অতিপ্রচারিত বিষয় – করোনা মহামারি। অতিপরিচিত বর্তমান সময়ের এই অবস্থা, অবস্থান, তথ্যকে উপন্যাসের উপযুক্ত করে উপস্থাপন করা এবং মানুষকে সে-ব্যাপারে কনভিন্স করা – এ বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ তিনি নিয়েছেন এবং এটা তাঁর সাহসিকতার প্রকাশ। হারুন পাশা উপন্যাসের গল্প বলেছেন চরিত্রকে দিয়ে এবং নিজেও বলেছেন ‘সংযুক্তি’ অংশে। ঝুঁকি হারুন পাশা আরো নিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনেক তথ্য-উপাত্তকে উপস্থাপন করেছেন। আগেও অনেকে এটা করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তো জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প উপন্যাসে পুরো গোয়েন্দা রিপোর্ট তুলে দিয়েছিলেন। বিশ্বসাহিত্যে অনেক মাস্টার লেখক এই বিষয় সার্থকভাবে চর্চা করেছেন। তবে ফিকশনে এই কাজ মোটেই সহজ নয়। হারুন পাশা তাঁর সৃজনশীল কর্মজীবনের শুরুতেই সেই ঝুঁকিটা নিয়ে ফেলেছেন।

এই উপন্যাসের ভাষা? সেটা কিছুটা সাহিত্যের ভাষা, কিছুটা রিপোর্টিংয়ের, কিছুটা প্রাবন্ধিকের, কিছুটা ক্ষোভে ফেটে পড়া কোনো যুবকের, কিছুটা একজন নির্মোহ পাঠকের। উপন্যাসটিকে তাই কোনো সুনির্দিষ্ট প্রকরণের মধ্যে ফেলা খুবই মুশকিল।

তিস্তা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে হারুন পাশার লেখক হিসেবে আবির্ভাব। বড় বড় পুরস্কার জিতে নিয়েছে সে-উপন্যাস। তিস্তা মূলত তিস্তাপারের মানুষের গল্প। খুব কাছ থেকে দেখে তিস্তাপারের মানুষের জীবন আত্মস্থ করে উপন্যাসটি লিখেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় উপন্যাসের জন্য বেছে নিয়েছিলেন বেকার যুবকদের। সেই উপন্যাসের নাম চাকরিনামা। তৃতীয় উপন্যাস বদলে যাওয়া ভূমি। করোনাকালের বদলে যাওয়া আমাদের সমাজ, দেশ, পৃথিবীকে নিয়ে। তাঁর সব উপন্যাস আমাদের সাহিত্যিক এবং সাহিত্য-সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে। সে-কথা লিখেও জানিয়েছেন তাঁরা। এদিক থেকে হারুন পাশা একজন স্নেহধন্য, ভাগ্যবান লেখক।

লেখক হিসেবে একই জায়গায় আবদ্ধ থাকার মানুষ হারুন পাশা নন। বদলে যাওয়া ভূমিতে আরেকবার তার প্রমাণ দিয়েছেন। বয়সে তরুণ এই লেখক তাঁর বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রণয়-পরিণয়, মানব-মানবীর আবেগঘন সম্পর্ক ইত্যাদিতে উঁকি দিয়েছেন; কিন্তু আটকে পড়েননি। বারবার সিরিয়াস বিষয় বেছে নিয়েছেন উপন্যাসের জন্য। লেখক হিসেবে হারুন পাশা অন্য রকম। ঠিক চেনা সূত্রের মধ্যে যেন বাঁধা যায় না তাঁকে। প্রচলিত ধারার জনপ্রিয় লেখায় অভ্যস্ত পাঠক তাই তাঁর লেখা পড়তে গেলে শুরুতে স্বস্তি নাও পেতে পারেন। পাঠককে তাই তাঁর লেখা পড়ার সময় ভিন্নভাবে ভাবতে হবে, ভিন্নভাবে পড়তে হবে। বদলে যাওয়া ভূমি উপন্যাসটি কলেবরে একটু বড়ই। তবে এর পাঠ ক্লান্তিকর নয়। এ-উপন্যাসের পাঠ যেন অনেক জানার, বোঝার একটি ভ্রমণ। যে-কোনো পাঠক সেই ভ্রমণ করতে পারেন। আমি আশাবাদী, আপনার সময়টার সদ্ব্যবহার হবে।