যৌথ প্রদর্শনী : একসঙ্গে আশি জন

জাহিদ মুস্তাফা

আমাদের সমাজে সুপ্রচলিত একটি প্রবাদবাক্য হচ্ছে – ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। সাজু আর্ট গ্যালারির স্বত্বাধিকারী রমিজ আহমেদ চৌধুরী সাজুর ক্ষেত্রে এ-মিলটি হুবহু দেখতে পেয়েছেন বর্ষীয়ান শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। ১৯৭৩ সালে সাজু শুরু করেছিলেন চিত্রকর্মের ফ্রেমের ব্যবসা ও গ্যালারি। গত চল্লিশ বছরে এটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত আর্ট গ্যালারি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যেটি বিরতিহীন গতিতে এগিয়ে চলেছে। সাজু নানা কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের চারুশিল্পাঙ্গনে। এর অন্যতম একটি দিক হচ্ছে – সেই সত্তরের দশক থেকে আজ অবধি আমরা দেখছি – তরুণ, নবীন এমনকি শিক্ষার্থীশিল্পীদের চিত্রকর্ম তিনি সংগ্রহ করে একদিকে তাঁদের উৎসাহিত করছেন, অন্যদিকে তুলনামূলক কমমূল্যে চিত্রকর্ম বিক্রি করে তিনি শিল্প-সংগ্রাহক তৈরি করে চলেছেন। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

এই প্রক্রিয়ারই অন্যতম এক উদ্যোগ সাজু আর্ট গ্যালারির গ্র্যান্ড গ্রুপ আর্ট এক্সিবিশন। দেশের খ্যাতনামা প্রবীণ ও নবীন শিল্পীদের শিল্পকর্মের সমন্বয়ে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে এ-প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। ১৯ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যায় এ-প্রদর্শনীর ৩৯তম আসরের সূচনা হলো। মাসব্যাপী আয়োজিত এ-প্রদর্শনী চলবে আগামী ২০ মে পর্যন্ত।

চারপাশের প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমাজ নিয়েই আমাদের জীবনপ্রবাহ। শিল্পীর যাপিত জীবনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংবেদনশীল নানা অনুষঙ্গের যোগে তাঁর চিত্রপট হয়ে ওঠে বাঙ্ময়, সজীব ও সুন্দর। সমাজবাস্তবতার কঠিন কিছু দিকও উন্মোচিত হয় কোনো কোনো শিল্পীর প্রকাশে। সব মিলিয়ে সবল বাংলাদেশের চলমান শিল্পাঙ্গনের একটা অবয়ব আমরা পেয়ে যাই সাজু আর্ট গ্যালারির এ-প্রদর্শনীতে।

এবারের আয়োজনে আশিজন শিল্পীর শতাধিক শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। এতে আমাদের পথিকৃৎ শিল্পীদের মধ্যে কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ ও এসএম সুলতানের চিত্রকর্ম আছে, যা এ-প্রদর্শনীর মান বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া প্রথম প্রজন্মের গুণী শিল্পীদের চিত্রকর্ম এ-প্রদর্শনীর অন্যতম সম্পদ। এতে আছে শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, শামসুল ইসলাম নিজামী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আবু তাহের, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবীসহ খ্যাতনাম শিল্পীদের কাজ। আবার তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী মনিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ মহসীন, আনোয়ারুল হক পেয়ারু, হামিদুজ্জামান খান, আবদুস শাকুর, মাহমুদুল হক, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, বীরেন সোম, আবদুল মান্নান, শহিদ কবীর, ফরিদা জামান এবং তাঁদের সমসাময়িক শিল্পীদের চিত্রকর্ম এখানে স্থান পেয়েছে।

কামরুল হাসানের (১৯২১-৮৮) উডকাট প্রিন্ট কাজটির শিরোনাম – ‘ববসর’। দুটি মহিষ জলমগ্ন। যেন গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে মহিষেরা আশ্রয় নিয়েছে জলের শীতলে। ১৯৭৭ সালের প্রিন্ট। কাজটির অঙ্কন-ধরন লোকজ ও আধুনিক। চিরায়ত লোকায়ত একটি বিষয়কে আধুনিক বিন্যাসে ও গঠনে তুলে ধরেছেন শিল্পী। এটির আকার ২২ গুণিতক ৮১ সেন্টিমিটার।

পথিকৃৎ শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের (১৯২২-২০১২) ২০০২ সালে আঁকা ‘ইমেজ অব নেচার’ এই প্রদর্শনীর একটি মূল্যবান কাজ। ক্রেয়ন ও চারকোলে শিল্পী গাছের ফর্ম ও আলোছায়া নিয়ে খেলেছেন। সাদাকালোয় অসংখ্য কাজ করেছেন তিনি – এর অনেকগুলোই শিল্পীর সার্থক সৃজন। ছাপচিত্রে তাঁর দক্ষতা এতই পরাক্রান্ত যে, সামান্য বর্ণে অনেক সার্থক শিল্প সৃজন করা সম্ভব হয়েছে তাঁর হাতে। এ-কাজটি তারই আরেকটি প্রকাশ।

এস এম সুলতানের (১৯২৩-৯৪) একটি বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’। এই চিত্রকর্ম ক্যানভাসে তেলরঙে আঁকা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী-আয়োজিত ১৯৭৮ সালে তাঁর একক প্রদর্শনীতে স্থানপ্রাপ্ত ওই চিত্রকর্মের অনুরূপ কয়েকটি ড্রয়িং করেছিলেন শিল্পী সুলতান। ১৯৯২ সালে আঁকা ড্রয়িংটি এ-প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। পেশিবহুল বলবান কৃষক বৃক্ষরোপণ করছেন, তার পেছনে জলের ঘড়া নিয়ে উড়ে এসেছে তিনটি শিশু দেবদূত।

কবি শামসুর রাহমানের লেখা কবিতার পাশে শিল্পী আমিনুল ইসলামের (১৯৩১-২০১১) ড্রয়িং স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। কাগজটির চারপাশ পুড়িয়ে একটি নকশায় বেঁধে আঁকা জায়গায় কালি-কলমে আধুনিক গঠনে ড্রয়িং করেছেন আমিনুল। দিয়াশলাই বাক্সের খন্ডিত অংশ দিয়ে কালি টেনে নানারকম রেখা তৈরি করেছেন শিল্পী। কাজটি ১৯৯৪ সালে আঁকা। সৈয়দ জাহাঙ্গীর এঁকেছেন জেলেদের মাছধরা। ক্যানভাসে আক্রিলিক রঙে ২০১১ সালের কাজ। নীল আবহের জল ও আকাশের সঙ্গে কমলা মাটির বর্ণপ্রলেপ আকর্ষণীয় হয়েছে। শামসুল ইসলাম নিজামীর আঁকা ১৯৮৪ সালের চিত্রকর্ম ‘ক্যালিগ্রাফি’ প্রদর্শিত হচ্ছে। ক্যানভাসে তেলরঙে ও ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকে আঁকা মা ও শিশুর ছবি এঁকেছেন শিল্পী আবু তাহের। এটি ২০০৯ সালের কাজ। আনোয়ারুল হক এঁকেছেন প্রাচীন প্রতীক। ২০০১ সালে কাগজে মিশ্রমাধ্যমে আঁকা। ক্যানভাসে তেলরঙে কম্পোজিশন এঁকেছেন মোহাম্মদ মহসিন।

‘রেখার গান’ শিরোনামে নকশাধর্মী ছবি এঁকেছেন শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী। বাংলার আকাশ ও নিসর্গের বর্ণ আলিম্পনের ওপর জ্যামিতিক ফর্ম ও রেখার পরিমিত সমাবেশ ঘটেছে শিল্পীর চিত্রপটে। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা কাজটি ২০১১ সালের।

শিল্পী রফিকুন নবী চুয়াল্লিশ বছর শিক্ষকতা করে অবসর নিয়ে এখন নিয়মিত ছবি আঁকছেন। সাম্প্রতিক কাজ নিয়ে তাঁর একটি একক চিত্রপ্রদর্শনী হলো ঢাকা আর্ট সেন্টারে। আলোচিত ও সমাদৃত এ-প্রদর্শনী শিল্পীর সমগ্র জীবনের এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। সাজুর গ্র্যান্ড প্রদর্শনীতে রফিকুন নবীর চিত্রকর্মের শিরোনাম ‘স্মৃতি থেকে’। কাগজে জলরঙে আঁকা ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একতলা বাড়ির দরোজায় এক তরুণী সাদা ছাগশিশু কোলে বসে আছে। পাশেই মা-ছাগল সেদিকে তাকিয়ে আছে ব্যগ্র হয়ে। সহজ-সরল কাজটি শিল্পীর জলরং ব্যবহারের দক্ষতায় অসাধারণ হয়ে উঠেছে।

প্রদর্শনীতে শিল্পী মনিরুল ইসলামের দুটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। এর একটি কাগজে তেলরঙে আঁকা। ২০১৩ সালে আঁকা চিত্রকর্মটির শিরোনাম ‘অ্যা অ্যারোমা এন এল এয়ার’। আরেকটি ছাপচিত্র এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট মাধ্যমের, শিরোনাম ‘ইকো স্ক্রিম’। মাহমুদুল হক এঁকেছেন ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে ‘শিরোনামহীন’। মাটির ঘর বসতির মতো করে গ্রে রঙে আঁকা। বীরেন সোম এঁকেছেন হলুদ নিসর্গ। হলুদাভ চিত্রপটের একেবারে নিচের দিকে ভবনের সারিসদৃশ ফর্ম। সহজ-সুন্দর সুললিত কাজ, নয়ন জুড়ায়। রেজাউল করিম এঁকেছেন বিমূর্ত রীতিতে ‘প্রিসেপশন-২’। বর্ণপ্রলেপ ও আলোছায়ার খেলায় জমে উঠেছে তা। মোটা ভাঙা-ভাঙা রেখায় ‘বস্তির রানী’ এঁকেছেন শহিদ কবীর। ভেজা চুল ঝাড়ার দৃশ্য। ফুলেল বাগানের বর্ণিল সিম্ফনি এঁকেছেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। ‘কম্পোজিশন অব লাইফ’ এঁকেছেন শিল্পী সৈয়দ এনায়েত হোসেন। আসমা কিবরিয়া এঁকেছেন বাংলার রূপ-রস-রং নিংড়ানো ছবি। শিরোনাম ‘কার্নিভাল অব লাইট’। হামিদুজ্জামান খান কৃতী ভাস্কর এদেশের। তিনি ছবি আঁকায়ও বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করে আসছেন। তিনি এঁকেছেন মুখাবয়ব। নকশা-করা মুখের লম্বাটে রূপ ক্যানভাসের একেবারে কেন্দ্রস্থলে তুলে ধরেছেন শিল্পী। শিল্পী আবদুস শাকুর শাহও অবয়ব এঁকেছেন তাঁর স্বকীয় চিত্র-প্রকরণে। চিত্রপটের কেন্দ্রস্থলে লোকায়ত অঙ্কনে নারী অবয়ব। চারপাশে নানা নকশা ও বর্ণপ্রলেপ কাজকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। রূপসী বাংলার ছবি এঁকেছেন শিল্পী আবদুল মান্নান।

গত শতকের সত্তরের দশকের শিল্পী আবদুস সাত্তার, আলমগীর হক, ফরিদা জামান, সাধনা ইসলাম, নাঈমা হক, রনজিৎ দাস, মোহাম্মদ ইউনুস, জামাল আহমেদ, অলকেশ ঘোষ, নিসার হোসেন, শেখ আফজাল, আহমেদ সামসুদ্দোহা, রোকেয়া সুলতানা, কামাল কবির, সৈয়দ হাসান মাহমুদ, তাজউদ্দিন, জালাল উদ্দিন, সৈয়দ ইকবাল, আবদুস সালাম প্রমুখ।

আবদুস সাত্তার প্রাচ্য রীতিতে এঁকেছেন এক তরুণী অবয়ব। আলমগীর হক এঁকেছেন ‘ফর্ম ও রঙের বিষয়’। এটি ১৯৯৫ সালের কাজ; এচিং মাধ্যমের ছাপচিত্র। ফরিদা জামান এঁকেছেন ‘বেদনা ও জল’ ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে নীল জলাধারের দিকে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষমাণ তিনটি বক। অথচ মাছশূন্য জলাধার। অলকেশ ঘোষ এঁকেছেন জলরঙে পানাম নগর। সামসুদ্দোহা এঁকেছেন ‘সুন্দরবন’। যেন এক স্বপ্নময় জগৎ সেটি। রনজিৎ দাস এঁকেছেন এক নারী অবয়ব। তার কাঁধে বসে আছে শান্তির সাদা পায়রা। শেখ আফজাল এঁকেছেন গ্রাম্যবধূর মাছকাটার দৃশ্য। নিসার হোসেন এঁকেছেন ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক রঙে ‘বাগানে হত্যাকারী’।

প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন আশির দশকের শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য, ইফতেখারউদ্দিন, খালিদ মাহমুদ মিঠু, কনক চাঁপা চাকমা, মনিরুজ্জামান, মোখলেসুর রহমান, মুকুল মুকসুদ্দিন রানা, জাহিদ মুস্তাফা, সমীরণ চৌধুরী, গুলশান হোসেন, মোহাম্মদ ইকবাল, বিদ্যুৎ জ্যোতি সেন শর্মা, রফি হক, ওয়াদুদ কফিল, লায়লা শারমিন, গৌতম চক্রবর্তী, মাকসুদা ইকবাল নীপা প্রমুখ। নববই ও শূন্য দশকের অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন – আনিসুজ্জামান, অনুকূল চন্দ্র মজুমদার, শাহজাহান আহমেদ বিকাশ, নগরবাসী বর্মণ, তরিকত ইসলাম, জহির উদ্দিন, আবদুল আজিজ, রোখসানা সাঈদা পপি, ফারুক আহমেদ, ফারহানা ফেরদৌসী, মলয় বালা, সুমনা হক, শহিদুল ইসলাম, নিজামী প্রমুখ।

বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজের প্রমোশনের জন্য এ-প্রদর্শনী সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ-আয়োজনে লাভবান হন শিল্পী ও গ্যালারি দুই-ই।