প্রায় একশ বছর হয়ে এলো রজনীকান্ত সেনের দেহাবসান হয়েছে। তাঁর জীবৎকাল (১৮৬৫-১৯১০) মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বিস্তৃত। বয়সের
বিবেচনায় তিনি পরিণত জীবনে উপনীত হতে পারেননি, যদিও তাঁর কাছ থেকে আমরা পরিণত সংগীতরাগ পেয়েছি বেশ কিছু। সমকাল রজনীকান্তকে সমাদৃত করেছে, অবহেলা পেয়েছেন তিনি উত্তরকালে, আজকাল তো রজনীকান্তের গান গাইতে প্রায় শোনাই যায় না। অথচ এমন হবার তো কথা নয়। বর্তমানে বাঙালিত্ব নিয়ে যখন সন্ধানীবৃত্তি জাগছে এবং বিশ্বজুড়ে বঙ্গসংস্কৃতির এলাকা বিস্তৃত হচ্ছে, তখন রজনীকান্ত সম্পর্কে কৌতূহল তো জাগবারই কথা। কেননা তাঁর পরিণত রচনার সর্বপ্রধান গুণ হচ্ছে বাঙালিত্ব। বাংলার স্বভাব- সংগীতকে তিনি ধরে দিয়েছেন গানে। পঞ্চ প্রধান বাঙালি সংগীত রচয়িতার কথা যদি ওঠে, তাহলে বলতে হয় যে, জরনীকান্তর রচনায়ই বাংলা নাগরিক সংগীতের একেবারে নির্ভেজাল বাঙালিত্বের রূপটি ফুটে উঠেছে, বাঙালিত্ব সেখানে নির্ভেজাল হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
—
রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুল প্রসাদ ও নজরুল এই যে চার প্রধান বাঙালি সংগীত রচয়িতা কবি, রজনীকান্তকে নিয়ে পাঁচ, এঁদের মধ্যে রজনীকান্তই একেবারে লৌকিক স্তরে চলে আসা রাগসংগীতের রূপটিকে ধারণ করেছিলেন। অন্যেরা হিন্দুস্তানি উৎসের সঙ্গে নিয়ত যোগাযোগরক্ষার মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছেন। ফলে রজনীকান্তের গানের মধ্যে রাগসংগীত নিয়ে কাজ করার লোকায়ত ধারাটিকে যেমন অমলিনভাবে পাওয়া যায়,
অন্যদের রচনায় তেমন পাওয়া যায় না। এ বিষয়টি রজনীকান্ত সেনের সংগীত রচনার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্যটি অনুধাবনের জন্যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
এবার পেছন ফেরা যাক। বাংলা গানের মূল যে প্রবাহ, যেটিকে আমরা নাগরিক সংগীতপ্রবাহ হিসেবে অভিহিত করছি, তার সূচনা একেবারে বাংলা গানের উষালগ্ন থেকেই। চর্যাগীতি দিয়েই প্রারম্ভ। চর্যার গায়কী রূপটি কেমন ছিল সে সম্পর্কে যে বিবরণ নানা আলোচনা গ্রন্থে পাওয়া যায়, তা থেকে সঠিক কিছু বুঝে ওঠা যায় না। একটা অনুমান করা যায় মাত্র। সে অনুমান ঠিকও হতে পারে, ঠিক নাও হতে পারে। গায়কী যেমনই হোক চর্যায় যে সব রাগ ব্যবহৃত হয়েছিল সে সব রাগের অনেকই পরবর্তীকালে এবং কিছু এখনো পর্যন্ত বাংলা গানে ব্যবহৃত হচ্ছে। গীতগোবিন্দ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাগসমূহ সম্পর্কেও আমরা এমন কথা বলতে পারি চর্যাগীতি, গীতগোবিন্দ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের গানগুলোর শ্রোতৃসমাজ ছিল সীমিত। কিন্তু তা হলেও চারশ সাড়ে চারশ বছরে গানে ব্যবহৃত জনপ্রিয় রাগসমূহ সভাগৃহ বা মন্দিরপ্রাঙ্গণের আসর ছাড়িয়ে লোকসমাজে প্রবেশাধিকার লাভ করতে শুরু করে। পদাবলি কীর্তনে এসে ঘটনাটি অন্যরকম চেহারা নেয়। চৈতন্যের নবধর্ম প্রচারের আবেগে ও উচ্ছ্বাসে কীর্তনে সাধারণ মানুষেরও গলা মেলাবার সুযোগ ঘটে। এই সুযোগে পূর্বপ্রচলিত কিছু রাগের সঙ্গে নতুন কিছু রাগরূপেও জনসমাজে স্থান করে নেয়। ব্যাপারটা শুধু রাগের সঙ্গে নয়, রূপবঙ্গ বা কণ্ঠের সঙ্গেও যুক্ত। অর্থাৎ অতি প্রচলনের ফলে জনপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে রাগরূপসমূহই যে জনমানসে স্থান করে নিল তা নয়,
সংগীতরূপসমূহও, যেমন চর্যা, ধ্রুবপদ বা ছন্দপ্রবন্ধ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রবন্ধাবলি সরলিকৃত হয়ে সর্বসাধারণের বোধগম্য ও আয়ত্তাধীন হয়ে উঠতে থাকে। এর কিছুটা অতি সহজ সরল হয়ে লোকগীতির সঙ্গে মিশে যায়, কিছুটা রাগসংগীতের আধারেই জনমানসে থেকে যায়।
পদাবলি কীর্তনের প্রথাবদ্ধ গায়কীর যখন সূচনা ঘটল প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই বাংলা গানের সঙ্গে ধ্রুপদ ও ধ্রুপদেতর সংগীতের যোগাযোগের পথটি অত্যন্ত প্রশস্ত হয়ে উঠল। বড়ু চ-ীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কিছু পদ দেখলে মনে হয় যে, চর্যা ও ধ্রুপদ সংগীতের প্রভাবে বাংলায় কিছু কিছু আঞ্চলিক প্রবন্ধও রচিত হচ্ছিল। এই সব আঞ্চলিক প্রবন্ধ রচনার উদ্যম সমকালে বা কিঞ্চিৎ পরবর্তীতে কিছু কিছু লৌকিক পদাবলির সূচনাকে সম্ভব করে থাকবে। তবে এসব প্রয়াসের মাধ্যমে রাগসংগীতের একটা সহজ সরল রূপ সম্পর্কে এক ধরনের জনচৈতন্য গড়ে উঠছিল, এ বিষয়টিই অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
চৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৩) তিরোধানের পঞ্চাশ বছর পরে নরোত্তম ঠাকুর (১৫৩১- ১৫৮৭) যখন গরানহাটি কীর্তনের গোড়াপত্তন করলেন তখন এর সঙ্গে তিনি ধ্রুপদ সংগীতকে যুক্ত করলেন। বৃন্দাবনে তিনি ধ্রুপদ সংগীতে প্রশিক্ষা পেয়েছিলেন। সেই থেকে পদাবলি কীর্তনকে কেন্দ্র করে ধ্রুপদ সংগীতের একটি জনগেয় সহজ সরল রূপ বাংলা অঞ্চলে উদ্ভাসিত হলো। শুধু কীর্তনকে কেন্দ্র করে নয়, কীর্তন বহির্ভূত সংগীতেও এই ধরনের ধ্রুপদ গানের প্রভাব পড়ে৷ শুধু শীলিত সংগীত বলে নয়, লোকসংগীতে বিশেষ করে বাউলে ও বিচ্ছেদী শ্রেণির গানে ধ্রুপদীয় সুররেখার ছায়াপাত ঘটে। অষ্টাদশ শতকের শেষদিক পর্যন্ত বাংলায় পদাবলি ‘কীর্তনের বিকাশ অব্যাহত থাকে। এই সময়ে হিন্দুস্তানি সংগীতে প্রশিক্ষিত অনেক কীর্তনীয়া কীর্তনসংগীত রচনায় মনোনিবেশ করেন। শুরুতে ধ্রুপদ সংগীতের পটভূমিতে কীর্তনের গায়নরূপ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নরোত্তম, পরবর্তীকালে খেয়ালও কীর্তনের সংগীতরূপে স্থান করে নেয়, তবে সৃজনশীলভাবে। সৃজনশীলভাবে বলতে বোঝানো হচ্ছে, ধ্রুপদ-খেয়ালের মূল যে হিন্দুস্তানি রূপ তার অটুট অনুসরণে নয়, কীর্তনের বাতাবরণে, কীর্তনের সুররেখা রচনার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে।
উনিশ শতকের প্রথমদিকে প্রত্যক্ষভাবে হিন্দুস্তানি রাগসংগীত বাংলা নাগরিক সংগীতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এবং হিন্দুস্তানি রূপবঙ্গ নির্মাণের নিয়ম ও উপস্থাপনের কৌশলসমূহ বাংলা নাগরিক সংগীতের নিয়ামক হয়ে ওঠে। নিধু বাবু বাংলা নাগরিক সংগীতের এই হিন্দুস্তানি রীতি প্রভাবিত রূপটির ভিত্তি স্থাপন করেন। এখন যেভাবে নিধু বাবুর টপ্পা গাওয়া হচ্ছে অবিকল সেভাবেই নিধু বাবু তা গাইতেন কি-না তা বলা শক্ত। আমার ধারণা যে, নিধু বাবুর গায়কী এমন নেহাৎ ছকে বাঁধা ছিল না। তিনি যেহেতু গোলাম নবীর পরম্পরা থেকেই টপ্পা শিখেছিলেন সেজন্যে তাঁর গায়কী আরো একটু কারুবহুল হওয়াই স্বাভাবিক। তবে কালক্রমে যা হয়, নিধু বাবুর গানকে কেন্দ্র করে বাংলা টপ্পার এক ধরনের ছকবদ্ধ গায়কী গড়ে ওঠে; লয়ে কিঞ্চিৎ ঢিমে, চালে ঈষৎ ভারি, মৃদু গমক, গিটকিরি ও কম্পন মিশ্রিত তানযুক্ত। খেয়াল ও ঠুংরির বেলায়ও এমন পর্যবেক্ষণ যথার্থ বলে মনে হয় যে, বাংলা গানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাঙালি গায়কের কণ্ঠধৃত হয়ে ওদের চালচলতিও অনেক সহজ হয়ে আসে।
এখানে ঐতিহাসিক বিবেচনায় বা বাংলায় নাগরিক সংগীতের বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতটি বিবেচনায় এনে বলা যায় যে, হিন্দুস্তানি প্রভাবে পুষ্ট বাংলা নাগরিক গানের বিস্তারের দুটি ধারা, একটি ধারা যথাসম্ভব হিন্দুস্তানি কারু ও কৌশলবহুল ধারাকে অবলম্বন করে বাংলা গানের বেড়ে ওঠা, আরেকটি ধারা হচ্ছে কারু ও কৌশল অবহুল একটি গায়কী ধারাকে অবলম্বন করে বাংলা গানের বেড়ে ওঠা। প্রথম ধারাটি গড়ে উঠেছিল প্রধানত কলকাতাকে কেন্দ্র করে, ক্রমে বাংলার অন্যান্য নগরেও এই ধারার বিস্তার ঘটে। নগর থেকে গ্রামেও ধারাটির বিস্তার ঘটে। এই ক্রমবিস্তারের পটভূমিকায়ই দ্বিতীয় ধারার বিকাশ ঘটে।
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত, অর্থাৎ পদাবলি কীর্তনের যুগ শেষ হয়ে আসার পূর্ব পর্যন্ত বাংলা গানের মূল ধারায় রাগ ও রাগসংগীতের যে মিশে যাওয়া, সে কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে যাত্রা। কৃষ্ণযাত্রার যে নানা প্রকারভেদ, সেসব গীতিনাট্য বৈ নয়। এবং যাত্রার অধিকাংশ গানই রচিত হয়েছে নানা জনপ্রিয় রাগে। যাত্রা কলকাতার মতো বড়ো শহরে অভিনীত হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত সমাদর পেয়েছে গ্রামীণ মানুষের কাছ থেকে। যাত্রায় ধ্রুপদ প্রভাবিত গান পাওয়া গেছে, খেয়াল প্রভাবিত গান পাওয়া গেছে এবং কীর্তনে- ধ্রুপদে ও খেয়ালে-কীর্তনে মেশামেশি করে গান পাওয়া গেছে। ফলে হয়েছে কি, এইসব দরবারি ঢঙের বন্দিশগুলো তাদের দরবারি স্বভাব হারিয়ে একেবারে বাংলা গান হয়ে বাঙালির অন্তরে স্থান করে নিয়েছে।
উনিশ শতক শুরু হলো টপ্পা দিয়ে। দেবতার গান ও মানুষের গান বলে দুটি পৃথক ধরনের গীতধারা গড়ে উঠল বাংলা নাগরিক গানকে কেন্দ্র করে। এই পার্থক্যটুকু রইল বিষয়ের বিবেচনায়, কিন্তু সংগীতের বিবেচনায় কোনো পার্থক্য রইল না। বাঙালি নিজের উদ্যোগে, নিজের মনের ভাবটুকু প্রকাশ করার জন্যে যে সংগীতরূপের আশ্রয় নিল, তা হচ্ছে রাগসংগীতের অদরবারিরূপ। এখানে কারুবাহুল্য, কৌশলবাহুল্য স্থান পেল না। স্থান পেল আবেগ প্রকাশের উপযোগী সরল সুরের রেখা, রূপবঙ্গকে সহজ করে নেবার প্রকাশ। এ বিষয়টি চমৎকারভাবে লক্ষ করা যায় ব্রহ্মসংগীতে। ব্রহ্মসংগীতের মূল ধারাটুকুই রাগসংগীতানুগ। এখানে ধ্রুপদ, খেয়াল ও টপ্পার সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত যেসব গান টিকে আছে এবং যাদের গায়নরূপের প্রামাণ্য স্বরলেখন পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় যে, সুরের অতি সহজ ও মধুর চলনকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। হিন্দুস্তানি ভাবাদর্শপুষ্ট অলঙ্করণ বাহুল্যকে নয়। হিন্দুস্তানি ভজন গানের আদর্শে ব্রহ্মসংগীত রচনা করা হয়েছে। তবে ভজনের সুরের কাঠামোটিকেই গ্রহণ করা হয়েছে, কোনো ধরনের কণ্ঠকর্মের মজাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়নি।
কিন্তু হিন্দুস্তানি সংগীতাদর্শ বাংলা গানের এইভাবে বেড়ে ওঠার স্বভাবকে কখনো নিষ্কণ্টক হতে দেয়নি। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর দিল্লির দরবার থেকে পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কলাবতগণ ভাগ্যান্বেষণে ভারতের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। এঁদের কেউ কেউ বাংলায় আসেন ও কয়েকটি রাজদরবারে আশ্রয় লাভ করেন। সে থেকেই বাংলায় হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চার প্রত্যক্ষ সূত্রপাত। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতার অভ্যুদয় ঘটলে সেখানে নবসংগঠিত বণিক সমাজকে কেন্দ্র করে বিপুলসংখ্যক হিন্দুস্তানি সংগীতগুণী সাদর আশ্রয় লাভ করেন। সে-সময়ে থেকে কলকাতা হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চার অগ্রগণ্য কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করে। এদিকে ১৮৫৭ সালে অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে ইংরেজরা সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে যোগসাজশ আছে সন্দেহে গ্রেফতার করে এক বছর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে বন্দি করে রাখলে এবং মাসিক এক লক্ষ টাকা বৃত্তি দিয়ে ১৮৫৮ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে মেটেবুরুজে নির্বাসিত করলে তিনি লক্ষ্মৌর বিখ্যাত সংগীত দরবার মেটেবুরুজে স্থানান্তর করেন। এর ফলে ঐতিহাসিকভাবে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, দিল্লি ও লক্ষ্মৌর সংগীত দরবার ভেঙে গেলে কলকাতাই হয়ে ওঠে হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীতে ভারতবিখ্যাত গুণীবৃন্দ ব্যতিরেকে নৃত্যপটিয়সী বাইজিদের অভাবিত সমারোহ ঘটে কলকাতায়। কলকাতাকে কেন্দ্র করে সারা বাংলা হিন্দুস্তানি সংগীতের প্রত্যক্ষ চর্চার পরিম-লে চলে আসে। হিন্দুস্তানি সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা, চর্চা ও সমঝদারি বিশিষ্ট রুচির পরিচায়ক হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে বাংলা নাগরিক গান ও হিন্দুস্তানি গানের উপস্থাপনা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। অর্থাৎ সে গানও বহুল পরিমাণে কারু ও কৌশলময় হয়ে ওঠে। পূর্বে উল্লিখিত বাংলা নাগরিক সংগীতের যে দুটি ধারা, এদের মধ্যে যে ধারাটি বাংলা লোকস্বভাবের সঙ্গে নীরবে নিভৃতে আপনার আসনটি রচনা করছিল, তা এই হিন্দুস্তানি সংগীতের আয়োজন-বাহুল্যের মধ্যেও আপন বিকাশ অক্ষুণ্ণ রাখে। এদিকে ঊনবিংশ শতকে এসে বাঙালির যে সর্বতোমুখী আত্মপরিচয় সন্ধানের ও আত্মপ্রতিষ্ঠা রচনার প্রচেষ্টা চলে তা থেকে সংগীতও বাদ যায়নি। সত্য বটে সে-সময়ে সংগীত বিষয়ে যাঁরা উৎসাহ দেখিয়েছিলেন, কি গবেষকরূপে, কি পৃষ্ঠপোষকরূপে, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দুস্তানি দরবারি পদ্ধতির অনুরাগী, তবে সুদীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিক লোক প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে রাগ ও রাগসংগীত প্রবন্ধের যে একটি বাংলা সংস্করণ দাঁড়ায় সে বিষয়েও অনেকে অবহিত ও অভিনিবিষ্ট ছিলেন। যেমন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনিশ শতকে বাঙালির যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে এবং হিন্দুস্তানি গানের সমান্তরালে বাংলা গানকে দাঁড় করাবার যে একটি প্রচেষ্টা
দেখা দেয়, তিনি ছিলেন তার কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হিন্দুস্তানি সংগীতে কৃতবিদ্য ছিলেন, পাশ্চাত্য সংগীতেও তাঁর দখল ছিল ভালো। আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি হয়েও সমাজনেতা তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতি প্রিয় ধ্রুপদীয় সংগীতেই নিজেকে তিনি আবদ্ধ রাখেননি। আবার ধ্রুপদ যখন রচনা করেছেন তখনো তিনি এর উপস্থাপনকলায় হিন্দুস্তানি রূপটিকে আঁকড়ে থাকেননি, এর একটি বাংলা সংস্করণ দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন এবং তাতে সাফল্য লাভ করেছেন। জোতিরিন্দ্রনাথ, যিনি পিতৃগৃহে সমাগত ভারতবিখ্যাত গুণীদের তালিমে সংগীতজীবন গঠন করেছিলেন এবং আত্মীয়- পরিজন ও বন্ধুদের কল্যাণে অতি উচ্চমানে হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চার পরিম-লে বাস করতেন, তিনি কোথা থেকে পেলেন এই বাঙালিত্বের প্রেরণা, কেন গেলেন তিনি সংগীতে বাঙালির জন্যে নতুন এক পথসন্ধানে? উত্তরটা সম্ভবত এমনি যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘর্ষে দেশে যখন নতুন একটি বোধ জাগছিল, যার নাম স্বাদেশিকতা, সেই বোধটি সংগীতেও জাগছিল, তাকে বলা যেতে পারে সাংগীতিক স্বাদেশিকতা। এই স্বাদেশিক প্রেরণা থেকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ হিন্দি গান ভেঙে বাংলা গান রচনার একটি নতুন রীতি প্রবর্তন করেন। এই প্রেরণা থেকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাঙালির সংগীতবোধকে পরিপুষ্ট করার লক্ষ্যে বিস্ময়কর সব কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য দুটি বিদ্রোহী সমাজ যে উপাসনার ধ্রুপদীয় সংগীতরীতি পরিহার করে লোকায়ত সংগীতের প্রতি মনোনিবেশ করে সে বিষয়েও তিনি কৌতূহলী ও সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন।
তবে কথা হচ্ছে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এই যে একটি প্রকা- ব্যাপার, অর্থাৎ রাগ ও রাগসংগীত প্রবন্ধের বঙ্গীয়করণ, এটি ঘটে নিভৃতে, যেন লোকচক্ষুর অন্তরালে স্বতোৎসারিত বেগে, সৃজনশীল প্রয়াসসমূহকে নিজের মতো করে নেবার যে প্রচ- শক্তি বাঙালির অন্তরে থাকে, তারই প্রভাবে। এই লোকপ্রিয় প্রবণতার সঙ্গে অতিনাগর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ
যোগাযোগ থাকার কথা নয়। তিনি হিন্দুস্তানি সংগীতকলার বঙ্গীয়করণের বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন এবং তাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন উনিশ শতকীয় জাগরণের ভাবালোক থেকে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শতকরা একশ ভাগ এমন মন্তব্য করা যায় না। ত্রিশ বছর বয়সে শিলাইদহে এসে বাউল কবিদের সঙ্গে পরিচয় ঘটলে তাঁর সাক্ষাৎ সাংগীতিক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে
পালটাতে শুরু করে। পরিণত জীবনে তিনি বাউলে- কীর্তনে-ধ্রুপদে- খেয়ালে – টপ্পায় মিলিয়ে এমন এক সংগীতরীতি নির্মাণ করেছিলেন যা একান্তই তাঁর, যা একান্তই বাংলার ও বাঙালির। পদাবলি কীর্তনের পর বাঙালির সৃজনশীল প্রতিভা এমন বাঙালিত্বের আধারে উপস্থাপিত হয়নি। কিন্তু এর পরেও কথা থাকে যে, ধ্রুপদ-খেয়ালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে-যোগাযোগ তা তিনি রক্ষা করেছেন হিন্দুস্তানি উৎসের সঙ্গে নিয়ত সংযোগ রেখে চলার মাধ্যমে। একথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন অনেকবার অনেক উপলক্ষে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ও হিন্দুস্তানি সংগীতে প্রশিক্ষিত ছিলেন, তাঁর সংগীত রচনার কৌশলটিও ছিল হিন্দুস্তানি রূপবঙ্গের প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত অনুসরণে নির্মিত। বাউল-কীর্তন তিনি ব্যবহার করেছেন বটে, তবে তাঁর কম্পোজিশনের যে মূল স্বভাব তার সঙ্গে হিন্দুস্তানি গীতভঙ্গির সাদৃশ্য বেশি। অতুল প্রসাদ বসবাস করতেন বাংলা থেকে দূরে হিন্দুস্তানি সংগীতের বিশিষ্ট কেন্দ্র লক্ষ্মৌয়ে। লঘু রাগসংগীতের রসের তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ মর্মগ্রাহী। গজল ও ঠুংরিতো তিনি তাঁর গানে ব্যবহার করেছেনই, খেয়ালের যে ভঙ্গিটি তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর স্বরূপটি ছিল লঘু। বাউল-কীর্তনের ব্যবহার তাঁর গানে আছে বটে এবং তা যে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টান্তানুসারী সে শুনলেই বোঝা যায়। কিন্তু অতুল প্রসাদের সংগীত রচনার মূল স্বভাবটি যে লঘু রাগসংগীতের উপাদানে গড়া এবং এর গায়কীর বৈশিষ্ট্যটি যে লক্ষ্মৌর আবহাওয়ায় লালিত সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। আর পঞ্চপ্রধানের কনিষ্ঠতম কাজী নজরুল যে হিন্দুস্তানি রাগসংগীতে ষোলোআনা অনুপ্রাণিত ছিলেন সে বিষয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।
ব্যতিক্রম ছিলেন রজনীকান্ত। গান তিনি রচনা করেছেন রাগসংগীতের অঙ্গেই। কিন্তু হিন্দুস্তানি উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তিনি অগ্রসর হননি। রাগসংগীতের যে একটি লোকায়ত রূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শত শত বছরের চর্চার ভেতর দিয়ে, রজনীকান্তের যোগ ছিল সেই ব্যাপারটির সঙ্গে। রূপবঙ্গ নিয়ে, সুরের চাল-চলন নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়নি মোটেই, রাগসংগীতের যে বহমান বাংলা রূপ, নিজেকে তিনি যুক্ত করেছিলেন সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে। ফলে কোনো তত্ত্বকে সামনে রেখে, সেই তত্ত্বের অনুসরণে নিজের রচনাকে বাংলা গানের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করতে হয়নি। রবীন্দ্রনাথকে এ-কাজটি করতে হয়েছিল। সংগীত রচয়িতা হিসেবে জীবন শুরু করার মুহূর্তেই রবীন্দ্রনাথকে স্থির করতে হয়েছিল তিনি কোন পথে এগোবেন, হিন্দুস্তানি সংগীত রচনার কণ্ঠকর্ম মর্মরিত পথে যাবেন, নাকি পদাবলি কীর্তনের দৃষ্টান্তে বাণীর ব্যঞ্জনাকে তীব্র করে তোলার উপযোগী সংগীত রচনা করবেন। ব্রাহ্মসংগীতের দৃষ্টান্তে,জ্যোতিরিন্দ্রনাথের প্রেরণায় ও
নিজের বিবেচনা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ স্থির করলেন যে, তিনি বাংলা গানের মূল স্বভাবকে অবলম্বন করে এগোবেন, সুরবিহারকে তিনি অতি প্রশস্ত পথ দিয়ে নেবেন না, সুর ও বাণীর সংগতিপূর্ণ মিলনে গড়ে উঠবে তাঁর গানের প্রকৃষ্টরূপ। রবীন্দ্রনাথকে এমন ভাবতে হয়েছিল ও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়েছিল। তাঁর পিতৃগৃহ ছিল হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র, তাঁদের আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত জনেরা ছিলেন হিন্দুস্তানি সংগীতের রসগ্রাহী। ফলে শৈশবাবধি রবীন্দ্রনাথ গান বিষয়টিকে যেভাবে শুনে আসছেন, নিজে যখন রচয়িতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন, তখন সেভাবে এগোলেন না। তাঁর মধ্যে কাজ করল বাঙালিত্ব। তিনি স্থির করে নিলেন যে, হিন্দুস্তানি সুর- বাহুল্যের পথে তিনি এগোবেন না, এগোবেন আবৃত্তিভঙ্গিম গায়কী রচনার পথে, যার সাহায্যে সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে বাণীর আবেদনকে মূর্ত করে তোলা যায়। রজনীকান্তকে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে, কোনো তত্ত্বকে সামনে রেখে এগোতে হয়নি। রাগসংগীতের বাঙালিত্বের স্বভাবকে তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে, চারপাশ থেকে তিনি তাকে আহরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। রজনীকান্তের পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন কবি ও সংগীত রচয়িতা। একান্নবর্তী যে বৃহৎ পরিবারে তিনি বাস করতেন, তাতেও সংগীতচর্চার একটি প্রগাঢ় পরিবেশ ছিল। পরিবেশটি হিন্দুস্তানি সংগীতচর্চার নয়, একেবারেই বাংলা গানচর্চার, ভক্তিসংগীত ছিল সেখানকার প্রধান গেয় বিষয়। রজনীকান্ত জন্মগত সংগীত-প্রতিভা নিয়ে – আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং রাগসংগীত সহজ ভাবে, সহজ চালে যেভাবে বাংলা গানের সঙ্গে মিশে বাংলার গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল তাকেই তিনি ধারণ ও উপস্থাপন করেছিলেন। রজনীকান্ত খেয়াল অঙ্গে অনেক গান রচনা করেছেন। কিছু গান আছে টপ্পাঅঙ্গে, কিছু গানে খেয়াল ও টপ্পায় মিশেল আছে। গভীরভাবে কান পাতলে বোঝা যাবে তাঁর খেয়াল, টপ্পা বা টপ্পা- খেয়াল রচনার সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ সেন ও রবীন্দ্রনাথের রচনার পার্থক্য আছে, নজরুলের তো আছেই। দ্বিজেন্দ্রলাল বা অতুল প্রসাদের রচনা হিন্দুস্তানি আদর্শেরই অনুসারী, তবে সুরবিহারের ঢং সংযত ও নমিত, অলঙ্করণের প্রক্রিয়ায় অনেক নি¤œকণ্ঠ। সংগীত রচয়িতা হিসেবে এঁদের ব্যক্তিগত রুচির বিবেচনা আছে, তবে সে বিবেচনা হিন্দুস্তানিত্বকে অতিক্রম করে না। রবীন্দ্রনাথ, তিনি নিজে যেমন জানিয়েছেন, হিন্দুস্তানিত্বের সীমার ভেতরে থেকেই, এমন একটি সংগীতরীতি গড়ে তুলেছিলেন যা একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত। মীড়ে গড়া সুরের রেখা অধিকাংশ সময়ই সরল, আন্দোলিত যদি কখনো হয়তো-বা কম্পনে বা গিটকিরিতে, তার ভঙ্গিটিও এতোই সুমিত যে, বোঝাই যায় প্রক্রিয়াটি রবীন্দ্রভাবনাপ্রসূত। রজনীকান্ত নিজে কিছুই করেননি। কথাটা এভাবে বললে কেমন জানি শোনায় তবু এভাবে বলাই ভালো, বহমান সাংগীতিক বাঙালিত্বকে তিনি ধারণ করেছেন এবং এর উদ্বেল প্রকাশকে উপস্থাপন করেছেন মাত্র। এখানে ‘মাত্র’ কথাটি ব্যবহার করে উপস্থাপনাকে খাটো করা হচ্ছে না, একেবারে মৃত্তিকালগ্ন বাঙালিত্বের প্রকাশ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রজনীকান্ত সুকণ্ঠ হয়েই জন্মেছিলেন, কণ্ঠশীলন করেছিলেন অতি সামান্যই এবং তা ভালোই হয়েছিল স্বভাব-বাঙালিত্বকে ধরে রাখার জন্যে।
রজনীকান্তের সংগীতরচনার মধ্যে খেয়াল অঙ্গকে যদি শনাক্ত করা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, সে একেবারে বাংলা খেয়াল। ‘বাণী’ কাব্যের অদ্যাবধি জনপ্রিয় ‘নির্ভর’ শিরোনামে প্রকাশিত রজনীকান্তের গানের প্রথম চরণটি হচ্ছে ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো’। এ গানের রাগ ভৈরবী, তাল জলদ একতাল। আজকাল দাদরাই বাজানো হয়। কি দেখি আমরা এই গানের সুর রূপে। স্থানীয় অন্তরার যে রূপবঙ্গ, তাতেই শুধু হিন্দুস্তানি খেয়ালের স্ট্যান্ডার্ডকে অনুসরণ করা হয়েছে। সুরের যে চলন, তার স্বভাবে হিন্দুস্তানিত্ব মোটেই নেই, একেবারে বাঙালির গান। সুরের রেখা একেবারে সরল, ভৈরবীতে যা হওয়া স্বাভাবিক, কোমল, মধুর, বিনম্র ও বিনত। আর রজনীকান্তের যা স্বভাব, ঈশ্বরের চরণাশ্রিত হয়ে থাকা, সেই শরণাগতিও প্রকাশ পেয়েছে উত্তালরূপে। এই গানটিকে আমরা একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। এর যে সুর রূপ তাই হচ্ছে হিন্দুস্তানি সংগীতের বাঙালিত্ব গ্রহণের উদাহরণ। এই সরল সহজ নিরাভরণ সুর রেখার উত্থানে পতনে বাঙালির সর্বাপেক্ষা প্রিয় রাগ ভৈরবীতে শত শত গান রচিত হয়েছে, এর মধ্যে ভক্তিগীতিই সমধিক। ভৈরবীর এই একান্ত বাঙালি রূপটি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল বা অতুল প্রসাদের রচনায় নেই। তাঁরা হিন্দুস্তানি ভৈরবীকে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছেন, রজনীকান্ত বাংলা ভৈরবীকে যেমন পেয়েছেন তেমন করেই প্রকাশ করেছেন, তাঁর প্রাণকে যেহেতু স্পর্শ করে এসেছে, সেখানকার উত্তাপে একটু তপ্ত হয়েছে, এই যা। ‘বাণী’ কাব্যেই ‘করুণাময়’ শিরোনামে একটি গান আছে : আমি অকৃতী অধম বলেওতো কিছু কম করে মোরে দাওনি। বেহাগ রাগে একতালে, বর্তমানে দাদরায় গাওয়া হয়, গ্রথিত গানটিতে বাংলায় বেহাগ রাগের জনপ্রিয় ব্যবহারের দৃষ্টান্তটি খুঁজে পাওয়া যায়। ‘প্রার্থনা’ শিরোনামে বারোয়া রাগে ও ঠুংরি তালে গ্রথিত যে গানটি : ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়, সেও সংগীতের বিবেচনায় একেবারে বাংলা গান। ‘তোমারি’ শিরোনামে মিশ্র আলাইয়া রাগে কেওড়া তালে রচিত ‘বাণী’ কাব্যের যে আরেকটি গান ‘তোমারি দেওয়া প্রাণ তোমারি দেওয়া দুঃখ’, সেটি সম্পর্কেও এমনি মন্তব্য করা যায়। অর্থাৎ খেয়ালের একটি লোকপ্রিয় রূপকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এমনিভাবে রজনীকান্ত সেনের অনেক গানের দৃষ্টান্ত তুলে একথাটি বলা সম্ভব যে, তিনি চারপাশ থেকে রাগসংগীতের একান্ত বাংলা রূপটি আহরণ করে তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে খেয়ালে। রজনীকান্ত খেয়ালের রূপবঙ্গেই প্রগাঢ়ভাবে আকৃষ্ট ছিলেন। হিন্দুস্তানি খেয়াল যখন বাংলায় অঞ্চলীকৃত হয়েছে তখন তার একটা জাতখোয়ানো দশা ঘটেছে, জাত মারা যায়নি। রজনীকান্তের রচনায় এবং বললে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না, একমাত্র তাঁর রচনায় খেয়ালের এই বাংলা রূপটি যথার্থভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। শুনলে মনে হয় কোথাও টপ্পার ছোঁয়া লেগেছে। তা লাগতেই পারে এবং তার ফলে খেয়ালের সংগীত সংগঠন পেলব হয়ে এসেছে। সামনে এসে পড়ার যে বাহারি ধাক্কা সেটি নেই, নানা অলঙ্কারে বিভূষণের উদ্বেগ নেই, একেবারে প্রাণের গভীর থেকে উৎসরিত সরল- সহজ সংগীত। কৌশল নেই, শুধু ভাব, শুধুই ভাবের আবেশ বয়ে চলেছে সুরের রেখাটি ধরে, উজাড় করে চলা যাকে বলে, তেমনি করে। একে দরবারি সংগীতের লোকজন্ম বলা যেতে পারে। রজনীকান্ত এই ধারার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা।
একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা ভালো। চেন্নাই, কর্ণাটক, অন্ধ্র ও কেরালা বাদে ভারতবর্ষের অবশিষ্ট অঞ্চলসমূহ হিন্দুস্তানি সংগীতের করতলগত। এর মধ্যে বাংলা ও মহারাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোথাও আঞ্চলিক ভাষায় হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থনা হয়নি। মহারাষ্ট্রে মারাঠি গান অবলম্বনে হিন্দুস্তানি রূপবঙ্গের বিপুল অনুকরণ ঘটেছে, তবে সে কা-টি ঘটেছে যত না সৃজনশীলভাবে তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ভাষাই শুধু মারাঠি, সংগীত হিন্দুস্তানি। একমাত্র বাংলাই হিন্দুস্তানি সংগীতের দুটি সমান্তরাল রূপের বিকাশ লক্ষ করা যায়। বাঙালি সংগীত রচয়িতারা বাংলা ও হিন্দিতে হিন্দুস্তানি সংগীত উৎসের যথাযথ অনুসরণে গান রচনা করেছেন, আবার সৃজনশীলভাবেও এ সংগীতরীতিকে গ্রহণ করেছেন। সৃজনশীলভাবে হিন্দুস্তানি সংগীতের প্রয়োগ ব্যাপক ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত হয়ে তা একেবারে লোকস্তরে পৌঁছে গেছে। এমনটি অন্য কোথাও ঘটেনি। রাজস্থানের লোকসংগীতে খেয়াল বলে এক ধরনের গান আছে। সংগীতে আনদ্ধযন্ত্র হিসেবে ঢোলক বাজানো হয়। অবাক করা কা- যে, লোকশিল্পীরাও রাজস্থানি ভাষায় হিন্দুস্তানি খেয়াল উপস্থাপিত করেন। বাংলায় একেবারে বাংলা খেয়ালের ধারা রচিত হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে বা তার কিছু পরে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী বা জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ যে রাগপ্রধান গান গেয়েছেন তার সংগীত মোটেই বাংলার নয়। বাংলা গানের প্রধান যে বৈশিষ্ট্যে বাণীর ব্যঞ্জনাকে তীব্র করে তোলা, তা কোথায় উধাও হয়ে গেছে সুরের সুতীব্র উচ্ছ্বাসে। সে বাংলা ভাষার আলগা বন্ধনে পুরোপুরি হিন্দুস্তানি খেয়াল, সংক্ষিপ্ত রূপে, এই যা। কিন্তু আবহমানভাবে হিন্দুস্তানি সংগীতে যে বঙ্গীয়করণ ঘটেছে তাতে বাংলা গানের মৌলিক সরল সহজ আত্মনিবেদননিষ্ঠ মেজাজটি বজায় থেকেছে, সে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরি যাই হোক। এখানেই বাংলার বৈশিষ্ট্য, বাঙালির গৌরব। রজনীকান্ত তাঁর রচনায় রাগসংগীতের এই সৃজনশীল বাঙালিত্বের বৈশিষ্ট্যটি চমৎকারভাবে উপস্থাপিত করেছেন। যে কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ, অতুল প্রসাদ বা দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে এই জায়গায় তাঁকে পৃথক করে বিবেচনা করা যায়। পার্থক্যের সীমারেখাটি মোটা দাগের নয় মোটেই, পার্থক্য যে আছে সেটি অনুধাবন করলেই রজনীকান্তের সংগীত রচনার মৌল স্বভাবটি বুঝে ওঠা সম্ভব।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.