রবীন্দ্র-কবিতার ভাষান্তর মার্টিন কেম্পশেন

অনুবাদ : জয়কৃষ্ণ কয়াল

মে মাসের গোড়ায় রবীন্দ্র-অনুরাগীরা নিয়মমাফিক রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করবেন। তবে বড়মাপের সব জয়ন্তীর পাট চুকেবুকে গেছে। যেমন : রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মজয়ন্তী (২০১১), ইংরেজি গীতাঞ্জলির শতবর্ষ (২০১২) এবং কবির নোবেল পুরস্কারের শতবার্ষিকী (২০১৩)। বিশ্বজুড়ে আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার অনেকগুলোই ভারত সরকারের অর্থানুকূল্যে। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞদের ভাষণ আর নিবন্ধ জড়ো করে কমসে কম ডজনদুই সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যে-হারে রবীন্দ্র-রচনার পুনর্মুদ্রণ হয়েছে, তাতে প্রত্যেকেই আপ্লুত। মূল বাংলা থেকে তাঁর রচনার নতুন অনুবাদের সংখ্যাও বিস্তর। ইমরে বাঙ্ঘার সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদনায় আমার নিজের বইটা রবীন্দ্রনাথ টেগোর : ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব গ্লোবাল রিসেপশান, বর্তমান বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

রবীন্দ্র মরশুম উতরে গেছে রীতিমতো সাফল্যের সঙ্গে। এখন হিসাব-নিকাশের সময়, দেখা যেতে পারে বাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতার জার্মান অনুবাদক হিসেবে আমি কী পেলাম? এটাকেই তো আমি আমার মুখ্য কীর্তি হিসেবে দেখি!

রবীন্দ্রনাথের রচনার জার্মান অনুবাদ শুরু হয়েছিল ইংরেজি অনুবাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। লন্ডন থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলি বেরোয় ১৯১২ সালে, তারপরই বেরিয়েছিল জার্মান গীতাঞ্জলি ১৯১৪ সালে। তা সত্ত্বেও এ-দুটো অনুবাদ প্রয়াসের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ব্রিটেনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাদের উপনিবেশ ভূখণ্ডের কবি, সেই উপনিবেশের মানুষের ভাষাকে সাহিত্যরূপ দিয়ে তিনি সফল হয়েছেন। জার্মানিতে বা জার্মান অনুবাদের পেছনে কিন্তু এরকম কোনো ভাবগত বা রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল না। জার্মানির বিচারে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ উপনিবেশের মানুষের সঙ্গে আলাপচারী কোনো ঔপনিবেশিক কবি ছিলেন না। অতীন্দ্রিয়বাদী, রহস্যসন্ধানী পাশ্চাত্যের কাছে তিনি বরং ছিলেন মরমিয়া প্রাচ্যভূমির কণ্ঠস্বর।

তাঁকে দেখা হয়েছিল জার্মানির ভারত-ভাবনার প্রেক্ষাপটে। এর সূচনা উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, জার্মান রোমান্টিসিজমের উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে এবং যুগপৎ তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। জার্মান রোমান্টিকতা ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করেছিল দর্শন আর প্রজ্ঞার দেশ হিসেবে। বিশ শতকের শুরুতে জার্মানির আমজনতা তাই রবীন্দ্রনাথকে নিছক কবি হিসেবে দেখেনি, দেখেছিল ভারতীয় দর্শন আর প্রজ্ঞার প্রবক্তা হিসেবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, সংবেদী জার্মান জনগণ রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিল তাদের রোমান্টিক সহযাত্রী হিসেবে, তারা তাঁর রোমান্টিকতাকে তাঁকে বোঝার চাবিকাঠি ভেবেছিল, তাঁর মূল্যায়নের চাবিকাঠি মনে করেছিল।

বাংলা থেকে রবীন্দ্র-রচনার ইংরেজি অনুবাদ আর তাঁর রচনার জার্মান অনুবাদ দুটো তাই আলাদা ব্যাপার। ইঙ্গ-স্যাক্সন ভূখণ্ডে রবীন্দ্রনাথ খ্যাতনামা কবি, তার কারণ তিনি ইংরেজিতে লেখেন এবং ইংরেজিতে লেখা বইয়ের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক আলোচনার অংশ। তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে কমনওয়েলথ সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে দেখা যেতে পারে।

জার্মানিতে কিন্তু এ-ধরনের প্রেক্ষাপট ছিল না। তার ওপর এখনকার জার্মানিতে রোমান্টিকতার ছাঁচটাকেই খানিকটা সন্দেহের চোখে দেখা হয়, হিটলারের তৃতীয় রাইখের সময় বিপথগামী আবেগের আতিশয্য দেখার পর থেকে। মরমিয়া কবি রবীন্দ্রনাথ এখনো সজীব জার্মানির বয়স্ক মানুষজনের স্মৃতিতে। তাঁদের মা-বাবারা তাঁদেরকে তাঁর রচনা পড়তে বলেছিলেন। ওইসব মা-বাবা দেখেছেন বিশ শতকের তিনের দশকে ভারতীয় এই কবিকে ঘিরে জার্মানির উদ্দীপনা। বাংলা থেকে কবির রচনা অনুবাদ করে তাই তাঁর নতুন, আরো যথার্থ আর অকৃত্রিম কোনো ভাবমূর্তি নির্মাণের কাজটা দুরূহ করে তুলেছে সমকালীন সাংস্কৃতিক প্রাসঙ্গিকতার এই খামতি।

তাঁর পুনরাবিষ্কারের সপক্ষে একমাত্র সংগত দাবি এই যে, তিনি বিশ্বসাহিত্যের একজন ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইংরেজি থেকে এ-পর্যন্ত জার্মানে যেসব অনুবাদ হয়েছে তা এই দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। তাই জার্মানিতে তা প্রতিষ্ঠা ও প্রমাণ করতে হবে ভাষাগতভাবে শুদ্ধ এবং সাহিত্যগুণে সন্তোষজনক বাংলা-মূল নতুন অনুবাদের মাধ্যমে। গত পঁচিশ বছর ধরে এ-কাজটাই আমি করছি। আমার অনুবাদে বাংলা থেকে জার্মানে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

সমস্ত অনুবাদ করেছি আমি শান্তিনিকেতনে বসে, এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। ১৯৮০ সাল থেকে আমি শান্তিনিকেতনকে বলি আমার ভারতের ঘরবাড়ি। আমার কাছে পরিষ্কার ছিল যে, কেবল এখানে বসেই এ-কাজটা আমি করতে পারি, বাইরে কোথাও থেকে নয়, জার্মানি থেকে তো নয়ই। শান্তিনিকেতনে সেই পরিবেশ আছে, আছে আবেগ আর আচরণের সেই সামাজিক আবহ, সেই প্রকৃতি আর তার কণ্ঠস্বর, যা আমাকে বহু কবিতা ও গান অনুবাদের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে সেগুলো আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে, তারপর তার অন্তর্নিহিত বোধ আর অনুভূতির পুনর্নির্মাণে সাহায্য করেছে। এছাড়া কবির কোনো কবিতা বা গানের অর্থস্তর বোঝার জন্য, তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়ার ব্যাপারে দরকার হলে শান্তিনিকেতনে আমি বিশেষজ্ঞদের সাহায্য পেতে পারি।

এখানে একদিকে আমি সম্মানজনক একটা রবীন্দ্র-ফেলোশিপের সুবিধা পাচ্ছি, কিন্তু অন্যদিকে জার্মান অনুবাদক হিসেবে একাকী আর নিঃসঙ্গ। শান্তিনিকেতনে কেউ আমার অনুবাদ বোঝেন না বা তার মূল্যায়নের কেউ নেই। পশ্চিমবঙ্গে তাই আমার না আছে কোনো বিশেষজ্ঞের প্রশস্তি, না কোনো সমালোচনা। বিদগ্ধজনরা জানেন না যে, আমি একের পর এক কবিতা অনুবাদ করে চলেছি। এ-কাজে আমি যে দিব্যসুখ পেয়ে থাকি, বিদগ্ধজনরা কেউ তার শরিক হতে পারেন না। তেমনি আবার অনুবাদ নিয়ে যখন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হই, যাকে আমি বলি ‘অনুবাদের কাঁটা’, তখন কেউ আমাকে স্বস্তি দিতেও পারেন না।

আমার অনুবাদ দুর্ভোগের খুঁটিনাটি খুব সংক্ষেপে পেশ করা যেতে পারে। বাংলায় ডেফিনিট বা ইনডেফিনিট আর্টিকল (definite or indefinite article) বাদ দিলে কিছু যায়-আসে না। কিছু কিছু সর্বনামের ক্ষেত্রেও তাই, ক্রিয়াপদের ব্যবহার দিয়ে তা বোঝানো যায়। গৌণ ক্রিয়া (auxiliary verb) জুড়ে নেওয়া যায় মূল ক্রিয়ার সঙ্গে। বাংলা ভাষাটা তাতে ধারালো, টানটান আর অধিকাংশ সময় অল্প দু-একটি শব্দে বিস্ময়করভাবে ধ্বনিময় ভাষ্যের মতো লাগে। জার্মানে কিন্তু এর উলটো। ‘গেলে হতো’ কথাটা দুটো শব্দে অনুবাদের চেষ্টা করে দেখুন। ইংরেজিতে এবং জার্মানেও, একটা অপ্রধান বাক্যাংশ (subordinate clause) আর পুরো একটা বাক্য লাগবে। জার্মান ভাষায় বাকসুমিতির এই বৈভব নেই। বাংলা কবিতার একটা চরণ অনুবাদ করতে হরহামেশা দুটো ছত্র লেগে যায়। রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে জার্মান কবিতায় রূপ দিতে গেলে তাই তাঁর কাব্যবিভূতি আর অর্থের নিক্তি মাপের মধ্যে কিছুটা সুবেদী সমঝোতা মেনে নেওয়া আবশ্যিক হয়ে পড়ে।

নতুন কোনো কবিতা সৃজনের দাবি অনুবাদকের কাছে চায় যে, তিনি প্রথমে ওই বাংলা কবিতার সমস্ত উপাদান ভেঙে অর্থ, ছন্দ ও মেজাজের একটা ‘সমাহার’ (mass) তৈরি করবেন। তারপর একই উপকরণ দিয়ে একটা জার্মান কবিতা পুনর্নির্মাণ করবেন। অনুবাদকের মনে প্রতিটি চরণের, প্রতিটি বাক্যের অত্বর এই বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া দরকার। কাজটা যদি স্বচ্ছন্দে এগোয়, অর্থাৎ আমার মনটা যদি স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের মনের সঙ্গে পুরোপুরি একই তারে বাঁধা পড়ে, তাহলে কবিতা অনুবাদের চেয়ে বেশি পরিতৃপ্তির, তুরীয় নেশার কাজ আর কিছু নেই। এ-ব্যাপারটাকেই আমি বলেছি দিব্যসুখ, এই দিব্যসুখই উপভোগ করেন একজন অনুবাদক।

দুঃখের ব্যাপার হলো, অনুবাদ কখনো শেষ হয় না। কবিতা হয়তো শেষ হয়, হয়তো সম্পূর্ণ হয়, কিন্তু কবিতার অনুবাদের বেলায় তা হয় না। অনুবাদটিকে একই সঙ্গে বিশ্বস্ত হতে হয় তার নিজের কাছে, একটা জার্মান কবিতা হিসেবে, আবার তাকে বিশ্বস্ত থাকতে হয় মূল বাংলা কবিতার কাছে। এ কোনো সূক্ষ্ম সুতোর ওপর দিয়ে চলা, ডানে-বাঁয়ে যে-কোনো দিকে যে-কোনো সময় আমি কাত হয়ে পড়তে পারি এবং অনেক সময় তা নিজেরই অগোচরে।

বিশেষ ঝুঁকির কাজ হলো অন্ত্যমিল কবিতার অনুবাদ। বাংলায় অন্ত্যমিলের ছন্দ অল্প কয়েকটা, তাই মিলের কাজটা সহজেই হয়ে যায়। কিন্তু জার্মান ভাষায় তা সংখ্যায় অনেক আর নানা ধরনের। তাই সেখানে অন্ত্যমিলের দাবি আরো বেশি। এক সময় জার্মান কবিতার দস্তুর ছিল অন্ত্যমিল, আধুনিক কবিতায় তার চল থাকলেও ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদে আমি অন্ত্যমিল পুরোপুরি বাদ দিতে পারিনি। যেমন, অন্ত্যমিল ছাড়া শিশু কাব্যের কোনো কবিতা অনুবাদের মানে হলো ওই কবিতার মজা, ঠাট্টা, শিশুপনা সবকিছু পুরোপুরি ছেঁটে দেওয়া। এমনকি গীতাঞ্জলির অনেক কবিতাও অন্ত্যমিলে যতটা উপভোগ্য, অন্ত্যমিল ছাড়া সেগুলোর স্বাদ ও প্রভাব অর্ধেক হয়ে যায়। তার মানে, মিলের ব্যাপারটা অনুবাদ-প্রচেষ্টার অংশ করে নিতে হচ্ছে। এটা গুরুতর ঝুঁকির কাজ। মিলটা দিতে হবে স্বাভাবিক আর সাবলীলভাবে, বাক্যের গঠনে জটিলতা তৈরি না করে। আবার তা কোনোভাবে খেলো করা যাবে না, তাহলে কবিতা খালি শব্দের কারকিত হয়ে যাবে। মেলানোর গরজে শব্দচয়নের স্বাধীনতা তাই খর্ব হয় যথেষ্ট পরিমাণে। তাতে কবিতার কাব্য-বৈভব আর অর্থের যথার্থতার মধ্যে আরো বেশি সমঝোতা দরকার হয়ে পড়ে।

কবিতা অনুবাদকের কাজটাকে আমি দেখি একটা বিশেষ প্রবণতা হিসেবে। এ-কাজে কৃতী হতে গেলে অনুবাদকের নিজেকে খানিকটা কবি হতে হবে। বাংলা কবিতার উপকরণ দিয়ে আর একটা নতুন আর স্বয়ংসম্পূর্ণ জার্মান প্রতিরূপ তৈরি করতে হলে, অন্তত অনুবাদের সময়, তাকে কবি হয়ে উঠতে হবে। আমি তো প্রায়ই কবিতা এবং তার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অসাধারণ সংযোগ অনুভব করি। এসব মুহূর্তে আমি সতর্ক থাকি যে, রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ মানে কবির কল্পনা আর তাঁর আত্মিক অস্তিত্বের সঙ্গে বেশি নিবিড়ভাবে, বেশি অন্তরঙ্গভাবে আলাপ করছি, আমি নিছক তাঁর কবিতা পড়ছি না। কেবল পাঠক নয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদক আমি, এই বোধে প্রায়শই যন্ত্রণামধুর আনন্দ অনুভব করি।

অনুবাদের কাজ শেষ হয়েছে। এখন সময় দেবো আমার নিজের লেখালেখিতে। পরিষ্কার যে, সেগুলোও শান্তিনিকেতনের গুরুদেবের দর্শন আর কবিদৃষ্টিতে সমাচ্ছন্ন। যেভাবেই হোক, আমার লেখালেখি আমার অনুবাদ ক্রিয়ার অনুসারী হয়ে গেছে। সেগুলো রবীন্দ্রনাথের ধারণাজগৎ আর মনোলোকের সমকালীন ভাষ্য, একালের জার্মান সমাজের জন্যে।