রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

চৌত্রিশ

আমার দ্বিতীয় দফায় বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হয় ২০০০ সালের দিকে। আমাদের বড় মেয়ে তখন জার্মানিতে চাকরি করে। তখন আর দুই জার্মানি নেই। সমাজতন্ত্রের পতনের পর বার্লিন দেয়াল ভেঙে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানি তখন এক হয়ে গেছে। জার্মানির পূর্ব অংশ ছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীন। পূর্ব জার্মানির রাজধানী ছিল বার্লিন। অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি ছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। পশ্চিমের রাজধানী ছিল বন। আমাদের মেয়ে অনিন্দিতার চাকরিস্থল ছিল বনে। আমি আর অজয় রায় মেয়ের অতিথি হয়েই জার্মানি গিয়েছিলাম। তবে আমাদের সফর বন শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আমরা আশেপাশের কয়েকটি দেশও ঘুরেছি। আমেরিকা থেকে আমাদের ছেলে জয় এসে সফরসঙ্গী হয়েছিল। জার্মানি থেকে সড়কপথে আমরা বেলজিয়াম, হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস) এবং ফ্রান্সে গিয়েছি। সব দেশেই আমরা বেশ আনন্দঘন সময় কাটিয়েছি। সব দেশেই আমি রাস্তায় মানুষের তুলনায় গাড়ি যেন বেশি দেখেছি। ওই দেশগুলি আমাদের মতো ঘনবসতির নয়। বাড়িঘরও একটু দূরে দূরে। দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা কম। জার্মানিতে অবস্থানকালে আমরা বার্লিনেও গিয়েছি। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন  আমাদের পূর্বপরিচিত সুনীল দাশগুপ্ত, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। অজয় রায়ের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। তিনি বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় জার্মান প্রবাসী সুনীলদা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বিশেষ সম্মাননাও দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে ৯০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। বার্লিনে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সুনীলদা ও তাঁর জার্মান স্ত্রী বারবারার আতিথ্য গ্রহণ করতে হয়েছে। বার্লিনের দর্শনীয় সব জায়গাই তিনি আমাদের ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন।

বন থেকে কলোন শহরেও আমরা গিয়েছি। বন শহরটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইউরোপের দীর্ঘতম ও গুরুত্বপূর্ণ রাইন নদী। মনোরম সৌন্দর্যের রাইন নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ হাজার ৩২০ কিলোমিটার। রাইনের পাড়ে আমরা বেশ কিছু স্নিগ্ধ সময় কাটিয়েছি। আবার বার্লিন শহরও স্প্রি নদীর তীরে অবস্থিত। রাইন নদীর পাড়ে ছবির মতো শহর বনে আমরা গিয়েছিলাম সামারে। ফুল-ফলের সমাহার দেখেছি তখন।

জার্মানিতে আমরা বিখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ কার্ল মার্কসের বাড়িও দেখতে গিয়েছি। ১৮১৮ সালের ৫ই মে মার্কস জার্মানির ট্রিয়ের শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।  মার্কসের পুরো নাম কার্ল হাইনরিশ মার্কস। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে আছে তিন খণ্ডে রচিত পুঁজি এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গপলসের সঙ্গে যৌথভাবে রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার। তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছিল। কার্ল মার্কসের জন্মস্থানে গিয়ে অজয় রায় খুশি হয়েছিলেন।

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ভ্রমণের স্মৃতি আমি ভুলতে পারবো না। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, লুভর (le Louvre) জাদুঘর, সাধু জ্যাকের মিনার, ক্যাথেড্রাল গির্জার ছবি কখনো স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়। ফ্রান্সের সর্বাধিক পরিচিত প্রতীক হলো আইফেল টাওয়ার। গুস্তাভো আইফেল নির্মিত ১ হাজার ৫০ ফুট উচ্চতার পৃথিবীর উচ্চতম এই টাওয়ারটি দেখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী প্যারিসে ভিড় করেন।

লুভর জাদুঘর প্যারিসের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এই শিল্পকলা জাদুঘরে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত হাজার হাজার শিল্পকর্ম সংগৃহীত রয়েছে। এই জাদুঘরে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থীর সমাগম হয়। কয়েক কোটি মানুষ প্রতিবছর প্যারিস যান লুভর জাদুঘরের টানে। লুভর প্রাসাদে অবস্থিত এই জাদুঘরটি আসলে দুর্গ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। তারপর এটা ফরাসি রাজাদের বাসভবন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। বহুবার ভবনটি সম্প্রসারণ করে বর্তমান অবস্থায় আনা হয়েছে। রাজপ্রাসাদ সরিয়ে নেওয়া হলে এটাকে রাজকীয় সংগ্রহশালার একটি প্রদর্শনীকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ফরাসি জাতির কাছে থাকা সর্বোৎকৃষ্ট শিল্পকর্মগুলি লুভরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে।

বর্তমানে লুভর জাদুঘর পৃথিবীর বৃহত্তম আর্ট গ্যালারি বা ছবির সংগ্রহশালা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এখানে আছে প্রাচীন মিশরীয় শিল্পকর্ম, নিকটপ্রাচ্যের শিল্পবস্তু, গ্রিক শিল্পকলা, রোমান শিল্পবস্তু, ইসলামী শিল্পকলা, ভাস্কর্য, আলংকারিক শিল্পকলা, চিত্রকর্ম, ছাপশিল্প ইত্যাদি। সব সংগ্রহ একদিনে ঘুরে দেখা সম্ভব হয় না।

১৯৯৭ সালের ৩০শে আগস্ট প্যারিসে একটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন প্রিন্সেস ডায়ানা এবং তাঁর প্রেমিক হিসেবে পরিচিত মিশরীয় ব্যবসায়ী ডোডি-আল-ফায়াদ। মাত্র ২০ বছর বয়সে ব্রিটিশ রাজপরিবারে বধূ হয়ে যেমন ডায়ানা আলোচিত হয়েছিলেন, তেমনি প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বিচ্ছেদও ছিল বড় আলোচনার বিষয়। প্যারিসে অবস্থানকালে ডায়ানার দুর্ঘটনাস্থলটিও আমরা দেখেছি।

ফরাসি দেশের পারফিউমের সুখ্যাতি জগৎজোড়া। ফ্রান্স নিয়ে কথা উঠলে তার সুগন্ধিকে দূরে রাখা যায় না। ফ্রান্স থেকে নানা ব্র্যান্ডের সুগন্ধি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে। শ্যানেল, ক্লোয়ি, ল আর্টিসান গার্লেইন, ডিয়ো ব্র্যান্ডের পারফিউমের নাম আমাদের দেশেরও অনেকের জানা। আমি এক শিশি শ্যানেল কিনেছিলাম। কারণ বিখ্যাত মার্কিন অভিনেত্রী, মডেল, গায়িকা মেরিলিন মনরোকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি রাতে কী পরে ঘুমান?’ মনরো উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেন? শ্যানেল নাম্বার ফাইভ!’

প্যারিসে আমি নানা রকম স্ন্যাকস বেশ মজা করে খেয়েছি। ফরাসিদের আমার খুব ভোজনরসিক বলেই মনে হয়েছে। সন্ধ্যা থেকেই তারা খাওয়া শুরু করে। এক ধরনের বনরুটি আমার খুব পছন্দের ছিল। খুব সুস্বাদু। তাছাড়া প্যাটিস, পেস্ট্রি, বিস্কুটও সুস্বাদু হয়। ফরাসি ওয়াইনও নাকি দারুণ। সেটার স্বাদ গ্রহণ থেকে অবশ্য নিজেকে বঞ্চিত রেখেছি। 

সুকুমারবৃত্তি, আভিজাত্য, সংস্কৃতি – সবকিছু মিলে প্যারিস এক অন্যরকম ভালো লাগার শহর। ফরাসি দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে আমার ছেলেমেয়েরা আমাদের আনন্দ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ভ্রমণ অজয় রায়েরও ভালো লেগেছিল। তাঁর মধ্যে উচ্ছ্বসিত ভাব আমি লক্ষ করেছি।

উত্তর-পূর্ব ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস গিয়েও আমাদের খুব ভালো লেগেছিল। নেদারল্যান্ডস আমাদের কাছে হল্যান্ড নামেই বেশি পরিচিত। নেদারল্যান্ডস কথার আক্ষরিক অর্থ ‘নিম্নভূমি’। দেশটির বেশিরভাগ ভূখণ্ডই সমুদ্র-সমতলের নিচে অবস্থিত। ইউরোপের এই দেশটিতেই জনঘনত্ব বেশি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪১৫ জনের বাস। দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উচ্চ। নেদারল্যান্ডস একটি উদার জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। সমস্ত নাগরিককে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা এবং পরিবহন সুবিধাসহ আরো বহু ধরনের সামাজিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

অল্প সময় থাকলেও নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডে বেড়ানো আমার কাছে একটি বড় পাওয়া।

ইউরোপের ক্ষুদ্রতম দেশগুলির একটি বেলজিয়াম। বেলজিয়ামকে ইউরোপের সর্বাধিক নগরায়িত দেশ বলা হয়। শতকরা ৯৭ ভাগ লোকের বাস নগরে। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশন, ন্যাটো এবং বিশ্ব শুল্ক সংস্থার সদর দফতর অবস্থিত। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নতুন ভবনও এই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেশি সময় থাকতে না পারলেও বেলজিয়াম আমার ভালো লেগেছে।

লুক্সেমবার্গও ঘুরে আসা হয়েছে একই যাত্রায়। ইউরোপের সবচেয়ে ছোট রাষ্ট্র। আয়তন ৯৯৮.৬ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা সাকল্যে ছয় লাখের মতো। তবু একটি স্বাধীন দেশ বলে কথা। রাজধানীর নামও লুক্সেমবার্গ (সিটি)। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের  হিসাবে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ লুক্সেমবার্গ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে বাস কিংবা ট্রেনে লুক্সেমবার্গ যাওয়া যায়। লুক্সেমবার্গকে ব্যাংক আর দুর্গের শহর বলা হয়। এই ছোট্ট দেশটিতে প্রায় ১৫০টি ব্যাংক আছে বলে শুনেছি। ছোট-বড় মিলিয়ে দুর্গ বা প্রাসাদের সংখ্যাও শতাধিক। দেখার মতো স্থান ত্রি টাওয়ার্স, সেন্ট মাইকেল, নটর ডেম চার্চ এবং জাতীয় জাদুঘর। উইলিয়াম স্কয়ার বলে একটি স্থানে রাস্তায় সাপ্তাহিক বাজার বসে। হেঁটেই দেখা যায় দেশটি। গোলাপি রঙের বাড়িগুলি দেখতে ভালো লাগে। লুক্সেমবার্গের সৌন্দর্য উপভোগ্য।

জার্মানিতে মেয়ের বাসায় থেকে আমরা অন্যসব জায়গায় গিয়েছি আবার ফিরে এসেছি। সময়টা বেশ কেটেছে।

জার্মানি থেকে আমি আমার ছেলের সঙ্গে আমেরিকা যাই। কিন্তু অজয় রায় দেশে ফিরে আসেন। তাঁর আর বাইরে থাকতে ভালো লাগছিল না। সম্ভবত কিছু কাজও ছিল। আমার ছেলে অমিতাভ তখন পারডু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি করছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পারডু বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেশ কয়েকজন নোবেল বিজয়ী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বিশাল এলাকাজুড়ে ক্যাম্পাস। বিভিন্ন দেশ থেকে বৃত্তি নিয়ে অনেকে পারডুতে পড়তে যান। অমিতাভও ছিল একজন বৃত্তিধারী শিক্ষার্থী। প্রচুর ভারতীয় শিক্ষার্থীও সেখানে ছিল। এটা শিকাগো শহরের কাছাকাছি হওয়ায় আমি শিকাগোতেও গিয়েছি।

শিকাগোতে ১৮৯৩ সালে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকান্দ এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে অনেকের মন জয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন তখন এক তরুণ সন্ন্যাসী। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো ভাষণ শুরু করেছিলেন ‘আমার প্রিয় আমেরিকার ভাই ও বোনেরা’ সম্বোধন করে। তারপর  বলেছিলেন – ‘আমরা শুধু সব ধর্মের প্রতি সহনশীল, তা-ই নয়। আমাদের কাছে সমস্ত ধর্মই সমান সত্যি। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের, সমস্ত জাতির তাড়া খাওয়া মানুষ, শরণাগত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে যে জাতি, আমি সেই জাতির একজন বলে গৌরববোধ করি।’

স্বামীজি বলেছিলেন, ‘সংকীর্ণ ভাবনাই আমাদের মধ্যে এত ঝগড়াঝাটির কারণ। আমি একজন হিন্দু – আমি আমার ছোট্ট কুয়োর মধ্যে বসে আছি আর সেটাকেই গোটা পৃথিবী ভাবছি। খ্রিস্টান ধর্মে যিনি বিশ্বাসী, তিনি তাঁর ছোট্ট কুয়োয় আর সেটাকেই গোটা দুনিয়া মনে করছেন।’…

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সাধারণ ঐক্যের ভিত্তি ঠিক কোন জায়গায়, তা নিয়ে অনেক বলা-কওয়া হয়ে গেছে। এই কথাটা বলা জরুরি মনে করি, কেউ যদি মনে করে একটা নির্দিষ্ট ধর্ম জিতে যাবে, আর বাকি সব ধর্ম খতম হয়ে যাবে আর সেই ভাবে ঐক্য আসবে, তবে তাকে একটা কথাই বলার – এই আশা বাস্তবে মোটেও ফলবে না। প্রত্যেককে অন্যের ধর্মের সারটুকু নিতে হবে, অন্য ধর্মের প্রতি মর্যাদা দিতে হবে। আবার নিজের ধর্মের নিজস্বতাকেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। পবিত্রতা, ঔদার্য – এগুলো কোনো বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের সম্পত্তি নয়। সব ধর্মসম্প্রদায়ই যুগে-যুগে খুব উঁচু চরিত্রের মানুষের জন্ম দিয়েছে।’…

শিকাগোতে গিয়ে আমার স্বামী বিবেকানন্দের কথা মনে হয়েছে। তিনি যে-মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছিলেন, সেই মঞ্চটিও দেখে এসেছি। জ্ঞানালোকিত এই বাঙালি সন্তান তাঁর ভাবধারায় পৃথিবীর অনেক মানুষকে প্রবলভাবে আলেড়িত করেছেন। তিনি রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা।

পঁয়ত্রিশ

নতুন জায়গা দেখা এবং নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই কোথাও যাওয়ার সুযোগ সাধারণত আমি হাতছাড়া করি না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাইরে অন্য যে-কোনো দেশে যাওয়ার সুযোগের সদ্ব্যবহার আমি করেছি। ইউরোপ, আমেরিকা ঘোরা হয়েছে ছেলেমেয়ের কল্যাণে। ওরা বাইরে না থাকলে, ভালো চাকরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হলে এবং আমাকে নিয়ে না গেলে কি আর এতো জায়গা দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হতো! ছেলেমেয়েদের জন্য আমি কম কষ্ট করিনি, ওরাও কষ্ট করেছে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। একসময়ের সম্মিলিত কষ্ট, পরে কিছুটা স্বস্তির কারণ হয়েছে সবার জন্যই।

আমি লেখক নই, তাই ভ্রমণবৃত্তান্ত আকর্ষণীয় করে লিখতে পারবো না। তাছাড়া অনেক কিছু এখন মনেও নেই। আগে যদি লেখার বিষয়টি মাথায় থাকতো, তাহলে হয়তো খুঁটিনাটি সব বিষয়ের নোট রাখা যেতো। সেসব তো আর রাখা হয়নি। তাই ভুলো মন যতটুকু স্মৃতি ধরে রেখেছে তা-ই এখন সসংকোচে প্রকাশ করছি।

শিকাগো শহর আমার ভালো লাগার কারণ স্বামী বিবেকানন্দ, সেটা বলেছি। ইউরোপ-আমেরিকার রাস্তাঘাট বেশ প্রশস্ত। যানচলাচলে বেশি সমস্যা হয় না। অনেক জায়গায় আবার জনবসতিও কম, কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তবে শিকাগো আমার কাছে ব্যস্ত শহর বলেই মনে হয়েছে। রাস্তাঘাটে দীর্ঘসময় ট্রাফিক জ্যামও দেখেছি। সেটা এখন কমেছে, না বেড়েছে, তা জানি না।

আমার ছোট মেয়ে অদিতি রায় থাকে ফ্লোরিডায়। এটাও একটি জনবহুল রাজ্য। আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ফ্লোরিডা ২২তম বৃহৎ। আটলান্টিক সাগরতীরে মিয়ামিতেও আমাকে নিয়ে গিয়েছে অদিতি। মিয়ামি এবং ডেটোনা বিচেও আমি গিয়েছি এবং আনন্দময় সময় কাটিয়েছি।

তবে আমার জন্য সেরা ঘটনা ছিল ডিজনিল্যান্ড দেখা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই বিনোদন কেন্দ্রটি না দেখলে এর গুরুত্ব বোঝা কঠিন। এখানে আছে বেশ কয়েকটি থিম পার্ক। আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা ইত্যাদি অঞ্চলের জঙ্গলের মতো বন্য পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ডে। যাঁরা সভ্যতার কোলাহল ভুলে কিছুক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশে হারিয়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই অ্যাডভেঞ্চারল্যান্ড।

আবার ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মতো করে এক কাল্পনিক জগৎ তৈরি হয়েছে টুমরোল্যান্ডে। এখানকার অসাধারণ সব রাইড সবাইকে মুহূর্তেই নিয়ে যায় যেন বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের জগতে।

ডিজনিল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় থিম পার্ক হলো ফ্যান্টাসিল্যান্ড। জাদুবাস্তবতার এক অপূর্ব মিশেলে তৈরি করা হয়েছে ফ্যান্টাসিল্যান্ড। এখানে আছে বিশাল আকারের একটি সিø­পিং বিউটি ক্যাসল এবং একটি ফ্যান্টাসি ভিলেজ।

১৯৫৫ সালের ১৭ই জুলাই যখন ডিজনিল্যান্ড উদ্বোধন করা হয়, তখনকার চেয়ে পরে এর পরিসর যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা ও উপকরণ। এই একবিংশ শতাব্দীতেও ডিজনিল্যান্ড তার সম্মোহনী ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে।

ডিজনিল্যান্ডের পরিকল্পনাকারী ও রূপকার ওয়াল্ট ডিজনি বলেছিলেন, ‘ডিজনিল্যান্ড নির্মাণ কখনোই শেষ হবে না।’ বাস্তবেও তাই হচ্ছে। ১৬০ একর ভূমি নিয়ে যে পার্ক শুরু হয়েছিল এখন তা ৫১০ একর ভূমি জুড়ে বিস্তৃত। এর ভেতরে রয়েছে ২ হাজার ২২৪টি কক্ষের তিনটি বিশাল হোটেল এবং একটি শপিং কমপ্লেক্স। রিসোর্টের ভেতরে বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্রে প্রায় ২০ হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত অভিনয় করেন।   পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ থিম পার্ক ডিজনিল্যান্ডে না গেলে মানুষের সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের বিরল কীর্তি অদেখাই থেকে যেতো।

এমন একটি অ্যামিউজমেন্ট পার্কের চিন্তা ওয়াল্ট ডিজনির মাথায় এসেছিল কীভাবে? একদিন তিনি গ্রিফিথ পার্কের একটি বেঞ্চে বসেছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে সেসময় সেই পার্কের মেরি-গো-রাউন্ড ক্যারোজেলে চড়ে হই-হুল্লোড় করছিল। ডিজনি তখন ভাবলেন, যদি পার্কগুলিতে বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে সবার জন্য পর্যাপ্ত আনন্দের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে কতই না ভালো হতো। তিনি একটি পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করলেন, যেখানে পরিবারের সবার উপযোগী বিভিন্ন রাইড থাকবে, বিভিন্ন কার্টুন চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবেও সাক্ষাৎ করে সবাই আনন্দঘন সময় কাটাতে পারবে। ওয়াল্ট ডিজনির চিন্তা ও পরিকল্পনার ফসল স্বপ্নরাজ্য ডিজনিল্যান্ড।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ (ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)-এর সদর দফতর দেখার সুযোগও আমার হয়েছিল। ছোট মেয়ে অদিতি এবং তাঁর বরের কল্যাণে আমি নাসা দেখতে পেরেছি। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি মানুষের চাঁদে যাওয়ার সাফল্যের কারণে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে। মহাকাশ নিয়ে গবেষণার প্রতিষ্ঠান নাসা। গত শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে চন্দ্রাভিযান প্রথমে ব্যর্থ হলেও ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই চাঁদে পা রাখার গৌরব অর্জন করেন মার্কিন নভোচারী এবং বৈমানিক নিল আর্মস্ট্রং। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এডইউন অলড্রিন। তাঁরা প্রায় আড়াই ঘণ্টা চন্দ্রপৃষ্ঠে ছিলেন। নিল আর্মস্ট্রং সেখানে লিখে আসেন : ‘এটি একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানব জাতির জন্য এক বিশাল অগ্রযাত্রা।’ প্রথম চন্দ্রবিজয়ী আর্মস্ট্রং ১৯৬৯ সালের ২৭শে অক্টোবর অল্প সময়ের জন্য ঢাকায় যাত্রাবিরতি করেছিলেন। তখন এ -খবর আমাদের পুলকিত করেছিল। সেই চন্দ্রজয়ী বীরের স্মৃতিবাহী নাসায় যেতে পেরে আমি পরম তৃপ্তি বোধ করেছিলাম। নাসার সামনে রকেট পার্কে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকৃতির রকেট দেখে আমার মানুষের সক্ষমতার বিশালতার কথাই মনে হয়েছে।

নাসার মিউজিয়ামে সংরক্ষিত সব উপকরণ দেখে দর্শনার্থীরা কেবল স্মৃতিকাতর হন না, বিজ্ঞানমনস্কও হয়ে ওঠেন। চাঁদ থেকে আনা মাটিও মূল ভবনে সংরক্ষিত আছে। ৩৮০ কোটি বছরের পুরনো মাটি দেখার ভাগ্য কতজনের হয়!

আমেরিকা থেকে আমি দিন কয়েকের জন্য কানাডাও ঘুরে এসেছি। উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশে অবস্থিত কানাডার রাজধানী অটোয়া হলেও বৃহত্তর শহর টরন্টো। কানাডায় বেশ কিছু বাঙালির সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়েছিল। কানাডার কয়েকটি অনিন্দ্যসুন্দর দর্শনীয় স্থান আমি ঘুরেছি। এর একটি হলো কানাডিয়ান সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কুইবেক শহর। অতি প্রাচীন এই শহরে লা সিটাডেলি দুর্গ, সতেরো শতকের ঘরবাড়ি, গির্জা এবং আরো অনেক আকর্ষণীয় জায়গা আছে। এছাড়া বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হানিমুন স্পট হিসেবে পরিচিত লেক সুইসেও আমি গিয়েছি।

কানাডা থেকেই গিয়েছিলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে। উত্তর আমেরিকার নায়াগ্রা নদীর ওপর এই জলপ্রপাত আমেরিকা ও কানাডার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে নায়াগ্রা জলপ্রপাত পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। অবস্থানগত কারণে আমেরিকা থেকে জলপ্রপাতটি পেছন থেকে দেখতে হয়। আর কানাডাতে সরাসরি সামনে থেকে দেখা যায়। মূলত তিনটি ঝরা থেকে প্রবলবেগে জলধারার নেমে আসা দেখতে অতি চমৎকার। এর সৌন্দর্য যে কাউকে অভিভূত না করে পারে না। যে-শব্দ থেকে ‘নায়াগ্রা’ নামের উৎপত্তি তার বাংলা অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি। প্রতি সেকেন্ডে কয়েক লাখ ঘনমিটার পানি পতিত হয়। বিশেষ গেটের সাহায্যে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। প্রকৃতির এক অসাধারণ বিস্ময় এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত। ডিজনিল্যান্ড মানুষের তৈরি বিস্ময় আর নায়াগ্রা প্রকৃতির তৈরি বিস্ময়। পৃথিবীর সব আশ্চর্যের কয়েকটি প্রকৃতিদত্ত, কয়েকটি মনুষ্যসৃষ্ট।

নায়াগ্রার বোটানিক্যাল গার্ডেনও দেখার মতো চমৎকার স্থান। ৪৫ প্রজাতির প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো দেখে চোখ জুড়াবে নায়াগ্রার বাটারফ্লাই কনজারভেটরি পার্কে গেলে। মোহনীয় এসব দৃশ্য দেখার সুযোগ আমি হাতছাড়া করিনি।

ছত্রিশ

আমি ঢাকায় আসার পর স্কুল-কলেজের সহপাঠীদের

বাইরে একটি বন্ধু গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। নানা সূত্রে আমাদের পরিচয় এবং সখ্য গড়ে উঠেছে। এই বন্ধু গ্রুপে আমরা ১৩-১৪ জন বেশ একাট্টা ছিলাম। এখন সবার সঙ্গে হয়তো

নিয়মিত যোগাযোগ নেই, কেউ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, কেউ সন্তানের সঙ্গে দেশের বাইরে আছে, কেউ বা বয়সের ভারে আগের মতো সচল নেই। তবে যোগাযোগের তারটি একেবারে ছিঁড়ে যায়নি। আমরা ২৫ বছর আমাদের বন্ধুত্ব অটুট রাখতে পেরেছি এবং বন্ধুত্বের ২৫ বছর পূর্তি উদ্যাপনও করেছি। ২৫ বছর একমত  একপথ হয়ে চলা কম কথা নয় মোটেও! 

আমাদের নৈকট্যের ভিত্তি ছিল পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাস। আমাদের এই বন্ধু গ্রুপের মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা ছিল না, ধর্মীয় গোঁড়ামিও ছিল না। আমরা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়েও নিজেদের মধ্যে কখনো আলোচনা বা বিতর্ক করিনি। রাজনীতি মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে বলেই আমরা সচেতনভাবে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলতাম। স্বামীদের উদার সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি বলেই আমাদের এই বন্ধু-ঐক্য দৃঢ় হয়েছে এবং একসঙ্গে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া, এর বাড়ি ওর বাড়ি ঘুরে খাওয়া-দাওয়া করা, দলবেঁধে নাটক বা সিনেমা দেখার মতো কাজগুলি আমরা

করতে পেরেছি। একসঙ্গে মিলিত হওয়ার কত উপলক্ষই না আমরা খুঁজে বের করেছি। দেশের ভেতর সব দর্শনীয় স্থান

যেমন আমরা ঘুরেছি, তেমনি দেশের বাইরেও গিয়েছি বারকয়েক।

কারা ছিল এই বন্ধুবৃত্তে? বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমি, নার্গিস সুলতানা, শবনম, জরিফা, নাজনীন, লেখা  ঘোষ,  কৃষ্ণা দত্ত, নেলী আপা, ডেইজি, পান্না এবং সেলিনা। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কলেজের শিক্ষক, সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে এবং গৃহবধূও ছিল। বেশির ভাগেরই পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল। অর্থবিত্তের দিক থেকে আমিই হয়তো পিছিয়েপড়া ছিলাম। কিন্তু বিত্তবৈভব নিয়ে গরিমা বা অহংকার করার মতো কেউ আমাদের এই বন্ধুবৃত্তে ছিল না। কারো কারো গাড়ি থাকায় আমাদের ঘোরাঘুরিতে খুব সমস্যা হতো না। জরিফার স্বামী রোড অ্যান্ড হাইওয়ের প্রকৌশলী হওয়ায় ঢাকার বাইরে বেড়াতে গিয়ে গেস্ট হাউজ পেতেও কখনো সমস্যা হয়নি।

কত মজার কাণ্ডই না আমরা করেছি। তারেক মাসুদ পরিচালিত মাটির ময়না চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে আমাদের ব্ল্যাকে টিকিট কাটতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কী কারণে যেন একজন উপস্থিত না হওয়ায় একটি টিকিট বেশি হয়। ওই টিকিটটিও আমরা ব্ল্যাকেই বেশি দামে বিক্রি করি। তাতে যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল তা দিয়ে চানাচুর-কোক খেয়ে আমরা আনন্দে মেতে ছিলাম।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের ছেলে অভিষেক এবং ঐশ্বরিয়া রাইয়ের বিয়ের সময় আমরা করেছিলাম আরেক কাণ্ড। ওই বিয়েতে আমাদের কারোই উপস্থিত থাকার কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। তাই বলে আমরা তো আনন্দবঞ্চিত থাকতে পারি না। নার্গিস বললো, আমরা এখানেই অভিষেক-ঐশ্বরিয়ার ডামি বিয়ের আয়োজন করবো। খাওয়া-দাওয়া আনন্দফুর্তি সব করবো। কীভাবে? গায়ে হলুদ, আইবুড়ো ভাত, আশীর্বাদ এবং বিয়ের মক অনুষ্ঠান হবে। একেকজনকে একেক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমার ভাগে পড়লো আশীর্বাদ অনুষ্ঠান আয়োজনের। কয়দিন এ নিয়ে আমাদের সে কি ছেলেমানুষি মাতামাতি। অথচ আমরা সবাই তখন পরিণত বয়সে পৌঁছেছি। আনন্দ করার জন্য আসলে বয়স লাগে না, লাগে মন। আমরা বন্ধুরা সবাই ছিলাম অত্যন্ত প্রাণবন্ত।

আমাদের আনন্দ-বিনোদনের কয়েকটি ছিল নিয়মিত উপলক্ষ। যেমন পহেলা বৈশাখ, ঈদ, দুর্গাপূজা, শীতে পিকনিক, পৌষে পিঠাপুলি ইত্যাদি। এছাড়া পূর্ণিমার চাঁদ দেখার জন্য আমরা আশুলিয়াতেও একাধিকবার গিয়েছি। বিশেষ করে শারদীয় পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদ দেখার লোভে কারো কারো বাড়ির পুরুষ কর্তারাও উপস্থিত হতেন। নার্গিসের স্বামী বেশ রোমান্টিক মানুষ ছিলেন। তিনি দু-একবার জোছনা দেখার সাথি হয়েছেন।

পহেলা বৈশাখে সবাই লাল শাড়ি পরে রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানে যাওয়া আমাদের রুটিন কাজ ছিল। তেমন কারো সঙ্গে দেখা হলে দই-চিড়া-চমচমেরও ব্যবস্থা হতো। না হলে আমার বাসায় হতো আড্ডা এবং খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। পহেলা বৈশাখে তিতা ডাল, টক ডাল, ভাজাভুজিসহ বাঙালিয়ানা খাবারের জন্য আমার কাছে সবাই বায়না ধরতো। দুর্গাপূজার সময়ও নাড়ু-মোয়ার আয়োজন আমাকেই করতে হতো।

অজয় রায় বাসায় থাকলেও আমাদের হাসি-হুল্লোড় কমতো না। সবাই তাঁকে সমীহ করতো। বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি কোনো অজুহাত বের করে বাসা থেকে বাইরে চলে যেতেন।

লেখা ঘোষের রান্না ছিল আমাদের সবার খুব পছন্দের। তাই তাঁর বাড়িতে খাওয়ার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। তিনিও আমাদের খাওয়াতে কার্পণ্য করতেন না। তাঁর স্বামী বড় ব্যবসায়ী। আর যে মাছ কিংবা মাংস থাক না কেন, আমার পছন্দের চিতল মাছের ব্যবস্থা লেখাদি রাখতেনই। অন্যদের বাড়িতেও এমন আয়োজন হতো। শুধু কি বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাওয়া-দাওয়াই হতো? না, অবশ্যই তা নয়। গান হতো, এমন কি কেউ কেউ নাচেও অংশ নিত। কখনো কখনো কাগজে লিখে তা হাতে ধরিয়ে পারফর্ম করতে বলা হতো। আমার হাতে যদি ‘নাচ’ লেখা কাগজ পড়তো তাহলে আমাকে কোমর দোলাতেই হতো। আমাদের এমন নির্মল আনন্দ আয়োজনে স্বামীরা কখনো বাদ সাধেননি।

হিমালয় থেকে সুন্দরবন – হ্যাঁ, হিমালয়ে না হলেও হিমালয়ের পাদদেশ তেঁতুলিয়া থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত কত জায়গায় যে আমরা বন্ধুরা মিলে গিয়েছি। ‘উঠলো বাই তো কটক যাই’-এর মতো আমরা সময় পেলেই বেরিয়ে পড়েছি নতুন কোনো জায়গার সন্ধানে। রূপসা নদীর ধারে জুটের খানদানি গেস্ট হাউজে রাত কাটিয়ে লঞ্চযোগে সুন্দরবন দেখার আয়োজন করেছিলেন নার্গিস সুলতানার ব্যাংক কর্মকর্তা বর। তাঁর ব্যাংক থেকে চিংড়ি ঘেরের জন্য এক ব্যক্তি ঋণ নিয়েছিলেন। তাঁকেই বলা হয়েছিল আমাদের সুন্দরবন দেখিয়ে আনতে। ওই চিংড়ি ঘেরের মালিক সানন্দে শুধু রাজিই হননি, আমাদের ভ্রমণ যাতে নির্বিঘ্ন হয়, তার সব ব্যবস্থাই করে দিয়েছিলেন। আমরা জনাকয়েক নারী যাবো সুন্দরবন, নৌপথে তখন জলদস্যু বা ডাকাতের ভয় ছিল, তাই আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে লঞ্চে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গানম্যান অর্থাৎ নিরাপত্তারক্ষী দেওয়া হয়েছিল। সুন্দরবন দেখে ফেরার পথে প্রবল স্রোতের কারণে রাতের বেলা লঞ্চ এগোতে পারছিল না বলে তীরঘেঁষে এক জায়গায় নোঙর করা হয়েছিল। আমরা যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ নিরাপত্তারক্ষীদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙলে শুনলাম যে, নৌকা নিয়ে কিছু জলদস্যু আমাদের লঞ্চে ডাকাতি করতে এসে নিরাপত্তারক্ষীদের বাধার মুখে পালিয়ে যায়। নিরাপত্তারক্ষীরা ডাকাতদের উদ্দেশ করে বলেছিল, লঞ্চের কাছে এলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেওয়া হবে। প্রাণের মায়া কার না আছে! ডাকাতেরা ভেগেছিল। পরদিন আমরা ভালোয় ভালোয় খুলনা ফিরে ঘের মালিকের নিজের চাষের বড় বড় চিংড়ি এবং অন্য উপাদেয় খাবার খেয়ে ঢাকার পথে যাত্রা করেছিলাম।

জরিফার দেবর ছিলেন সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে থাকাকালে আমরা গিয়েছিলাম কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান। চট্টগ্রাম শহরের বাটালি হিলে সেনাবাহিনীর গেস্ট হাউজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। বাটালি হিল চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। এর চূড়া থেকে বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম শহরের বড় অংশ দেখা যায়। ওখান থেকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এবং রাঙামাটি ও বান্দরবান গিয়ে চমৎকার সময় কাটিয়েছি আমরা নারীবাহিনী। কক্সবাজার সৈকতের বর্ণনা আমি আর নতুন করে কী দেবো। রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু, শুভলং ঝরনা, রাজবন বিহার এবং সাজেকে গিয়ে আমরা চোখ ভরে দেখেছি অন্য এক বাংলাদেশকে। বান্দরবানের নীলগিরি পাহাড়ে উঠেও কী কম আনন্দ পেয়েছি। বাংলাদেশের সর্বউঁচুতে নীলগিরি পাহাড় একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।

কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিজড়ানো শিলাইদহে আমরা গিয়েছি। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত অনেকবার এসেছেন। মূলত জমিদারি দেখাশোনার কাজে এলেও শিলাইদহে বসেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক কবিতা লিখেছেন। গীতাঞ্জলির অনুবাদও শিলাইদহে বসেই শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে শিলাইদহে এসেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীর মতো ব্যক্তিরা। কুঠিবাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে পদ্মা নদী। নদীপথে বোটে চড়েই রবীন্দ্রনাথ আসতেন এখানে। তবে পদ্মা এখন আর প্রমত্তা নেই। এখন শিলাইদহে গিয়ে পদ্মার ঢেউ দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখা বা সান্নিধ্য লাভের সুযোগ আমাদের ছিল না। কিন্তু কুঠিবাড়িতে গিয়ে আমরা যেন রবীন্দ্রসান্নিধ্যেই কিছুটা সময় কাটিয়ে ধন্য হয়েছি।

বাংলাদেশের ইতিহাসপ্রসিদ্ধ জায়গাগুলিতে আমাদের পদচিহ্ন রাখার চেষ্টা করেছি। রাজশাহী এবং নাটোরে গিয়ে আমরা দেখে এসেছি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর এবং উত্তরা গণভবন। রাজশাহী শহরের হেতেম খাঁ নামক স্থানে প্রত্ন সংগ্রহে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর নামে পরিচিত। নাটোর শহর থেকে সামান্য দূরে উত্তরা গণভবন অবস্থিত। এটা আসলে ছিল দিঘাপাতিয়ার মহারাজের বাসস্থান। মোগল ও পাশ্চাত্য রীতির সংমিশ্রণে কারুকার্যময় নান্দনিক এই ভবনটিকে ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গণভবন নামকরণ করে মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকও এখানে করেছিলেন। প্রাসাদোপম এই ভবনের পেছনে ফোয়ারাসহ একটি সুন্দর বাগান আছে।

আমরা দিনাজপুরের বিখ্যাত কান্তজির মন্দির এবং রামসাগরও দেখেছি। আগের দিনের রাজারা যে কত রকম কীর্তি রেখে গেছেন তা এখনো আমরা দেখতে পাই ঘর থেকে দুই পা বেরোলেই। এসব স্থাপনা একদিকে যেমন আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করে, অন্যদিকে তেমনি মনও ভরায়, চোখও জুড়ায়।

কান্তনগর মন্দিরটি কান্তজিউ বা কান্তজির মন্দির হিসেবেই পরিচিত। দিনাজপুর শহর থেকে পঞ্চগড় যাওয়ার পথে হাইওয়ে থেকে একটু ভেতরে এই মন্দিরটি হিন্দু ধর্মের কান্ত বা কৃষ্ণের মন্দির হিসেবে তৈরি করেন রাজা প্রাণনাথ রায় এবং তাঁর দত্তকপুত্র রাজা রামনাথ রায়। ১৭২২ সালে রাজা প্রাণনাথ নির্মাণকাজ শুরু করলেও শেষ করার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এর নির্মাণকাজ শেষ করেন রাজা রামনাথ ১৭৫২ সালে। মন্দিরের বাইরে পুরো দেয়ালজুড়ে লেখা রয়েছে রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি। প্রায় ১৫ হাজার টেরাকোটা টালির এই মন্দিরের নির্মাণশৈলী এখনো সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেন। আমরা বান্ধবীরাও মুগ্ধ চোখে এই মন্দির ঘুরে দেখেছি।

রামসাগর দিনাজপুর শহরের কাছে তাজপুর গ্রামে খনন করা একটি বড় দিঘি। দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ রায় একবার প্রচণ্ড খরা দেখা দেওয়ায় প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণের জন্য পলাশির যুদ্ধের আগে এই দিঘিটি খনন করেন বলে জানা যায়। এই দিঘি নিয়ে কিছু লোককথাও প্রচলিত আছে। ১৫ লাখ শ্রমিক এই দিঘির খননকাজ শেষ করার পরও নাকি জল উঠছিল না। তখন রাজা নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নরবলির ব্যবস্থা করেছিলেন। যা হোক রামসাগর এখন জাতীয় উদ্যান হিসেবে স্বীকৃত একটি পর্যটন কেন্দ্র।

আমাদের ভ্রমণতালিকা থেকে বাদ যায়নি রংপুরও। নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে। আমরা রোকেয়ার জন্মভূমি দেখাকে একটি কর্তব্যই বিবেচনা করেছি। তাছাড়া রংপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের তাজহাট রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়িও আমরা পরিদর্শন করেছি। মহারাজা গোপাল লাল রায়ের উদ্যোগে ২১০ ফুটের মতো প্রশস্ত এবং চারতলার সমান উঁচু তাজহাট জমিদারবাড়িটি বানাতে নাকি ১০ বছর সময় লেগেছিল। দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পের ব্যবহার হয়েছে এই প্রাসাদ নির্মাণে। প্রাসাদ চত্বরে আছে বিশাল মাঠ, গাছের সারি এবং দুটি বড় পুকুর।

বগুড়ার মহাস্থানগড়েও আমরা গিয়েছি। মহাস্থানগড় একটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ স্থান। একসময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে, আড়াই হাজার বছর আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে ওঠার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ আছে। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ডনগর নামেও পরিচিত ছিল। প্রাচীরঘেরা এই নগরীর ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে গেলে এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।

আমরা ঢাকার আশেপাশে প্রায় সব জায়গায়ই ঘুরেছি। আমাদের এই বন্ধুবাহিনী ২৫ বছরে অনেক কাহিনির সঙ্গে জড়িয়েছি। সব কথা, সব দেখা মনেও নেই। আজ জীবনের এই শেষ ভাগে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হয় :

যাহা কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,

সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।

দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,

দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।

যা পাইনি তাও থাক, যা পেয়েছি তাও,

তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও।