রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

চুয়াল্লিশ

বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে। নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে আমার কোনো ক্লান্তি লাগে না। আমার রেবা মামি বলতেন, ‘জয়ন্তীর পায়ের নিচে সরিষা দেওয়া আছে। ও স্থির থাকতে পারে না।’ কথাটা মিথ্যা নয়। ঘুরতে আমার মজা লাগে। নতুন জায়গা যেমন আমাকে টানে, তেমনি নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতেও আমার ভালো লাগে। তাই বেড়ানোর কোনো সুযোগই আমি হাতছাড়া করিনি।

একবার অজয় রায় বিহারের পাটনায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) একটি সেমিনারে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে আমাকে সঙ্গে যেতে বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হই। পাটনার ব্যাপারে আমার আগে থেকেই আগ্রহ ছিল। কারণ গৌরী মাসির বাবা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তাঁর কাছে পাটনার অনেক গল্প শুনেছি। তাছাড়া বিহার গেলে নালন্দা এবং রাজগির দেখা যাবে – সেটা ছিল একটি বাড়তি আকর্ষণ। গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিধন্য নালন্দা দেখার আগ্রহ ছিল আমার প্রবল। যা হোক, অজয় রায়ের সঙ্গে আমার পাটনা ভ্রমণ ছিল আনন্দময় এবং শিক্ষণীয়।

পাটনায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি মোটামুটি মানের হোটেলে। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ওয়াশরুমে শাওয়ার, গরম জল সবকিছুরই ব্যবস্থা ছিল। তবে কমোডের কাছে দেয়ালে মাটি লাগানো। অমন পরিষ্কার রুমের দেয়ালে মাটি কেন? আমার মনে ঘটকা লাগায় অজয় রায়কে প্রশ্ন করি। তিনি বললেন, বিহারের মানুষ টয়লেট শেষে জল ব্যবহারের পর মাটিতে হাত ঘষে অভ্যস্ত। হোটেলের আধুনিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেও আগের অভ্যাসের কারণেই হয়তো মাটি রেখেছে, ইচ্ছা করলে কেউ ব্যবহার করতে পারে। মানুষ সহজে অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না।

বিহারের মানুষের মধ্যে রক্ষণশীলতা একটু বেশি বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। আমরা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে সেটা ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি। অনেকেই জানতে চেয়েছে, আমরা কলকাতা থেকে গিয়েছি কি না! কারণ বিহারের নারীরা সাধারণত হোটেলে খেতে যায় না। পাটনায় বেশ কিছু বাঙালির সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কিছু বিষয়ে বিহারের মিল আছে। বিহারের জমিও বাংলাদেশের মতো উর্বর। ভালো ফসল হয়। তবে গরিব মানুষের সংখ্যা বেশি। জোতদাররা যথেষ্ট প্রভাবশালী। তারাই সমাজ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। মুসলিম পরিবারগুলির মধ্যে গরিব তুলনামূলক বেশি বলেও আমার সাধারণ পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে। একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিয়ের রীতিও অনেকটা আমাদের মতোই।

পাটনা থেকে আমরা নালন্দা মহাবিহার প্রত্নস্থলে গিয়েছি। নানা কারণে নালন্দার স্মৃতি আমার মনে দাগ কেটে আছে। বিহারের পাটনা থেকে ৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নালন্দা মহাবিহার একসময় ছিল ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখন এটি একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। নালন্দা মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ থেকেই পর্যটকরা নিয়মিত ভিড় করেন। সম্ভবত বখতিয়ার খিলজি ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে নালন্দা মহাবিহার ধ্বংস করেছিলেন।

ভারতের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত নালন্দা মহাবিহারের বিকাশ ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায়। গুপ্ত যুগের উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কারণে খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে এক আলোকিত অবস্থা তৈরি হয়েছিল। সে সময় পূর্ব ভারতে পাল শাসনকালে বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ছিল ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

খ্যাতির শিখরে থাকাকালে নালন্দায় ভারত ছাড়াও চীন, তিব্বত, কোরিয়া ও মধ্য এশিয়ার পণ্ডিত এবং ছাত্ররা পড়াশোনা ও অধ্যাপনা করতে আসতেন।

নালন্দা মহাবিহার সম্পর্কে জানা যায় মূলত হিউয়েন সাং, ই ৎসিং প্রমুখ তীর্থযাত্রী ভিক্ষুদের ভ্রমণকাহিনি থেকে। তাঁরা সপ্তম শতাব্দীতে নালন্দায় এসেছিলেন। ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ মনে করেন, নালন্দার ইতিহাস হলো মহাযান বৌদ্ধধর্মেরই ইতিহাস। হিউয়েন সাং তাঁর লেখায় নালন্দার অবদান হিসেবে যেসব পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করেছেন, তাঁদের অনেকেই মহাযান দর্শনের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নালন্দায় সব ছাত্রই মহাযান এবং বৌদ্ধধর্মের আঠারোটি সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থাদি অধ্যয়ন করতেন। সেই সঙ্গে বেদ, ন্যায়শাস্ত্র, সংস্কৃত ব্যাকরণ, ভেষজবিদ্যা এবং সাংখ্য দর্শনও তাঁদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আনুমানিক ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে মুসলমান বাহিনী নালন্দা লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে। তবে এই ঘটনার কিছুকাল পরেও নালন্দা অস্থায়ীভাবে চালু থাকলেও ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয় এবং বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ ১৯১৫ সালে প্রাথমিকভাবে এখানে খননকাজ শুরু করে। ১২ হেক্টর জমিতে সুবিন্যস্ত ১১টি মঠ ও ইটের তৈরি ছয়টি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে প্রচুর ভাস্কর্য, মুদ্রা, সিলমোহর ও শিলালিপিও পাওয়া গেছে। এগুলি এখন নালন্দা পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বুদ্ধের বেশ কিছু মূর্তি রয়েছে।

নালন্দা মহাবিহার চত্বরের স্থাপনাগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তিন নম্বর মন্দিরটি। একাধিক সিঁড়ি এই মন্দিরটির শীর্ষদেশ পর্যন্ত উঠে গেছে। প্রথমদিকে মন্দিরটি ছিল একটি ক্ষুদ্রকায় স্থাপনা। পরে ধীরে ধীরে এর আকার বৃদ্ধি পায়। পাঁচ নম্বর মন্দিরটি সবচেয়ে বেশি মনোগ্রাহী এবং অধিক সুরক্ষিত। এই মন্দিরটির চারকোণে চারটি স্তম্ভ আছে। এগুলির মধ্যে তিনটি বহির্মুখী। সিঁড়ির ধারের স্তম্ভগুলো গুপ্তযুগীয় শিল্পকলায় সমৃদ্ধ অসাধারণ প্যানেলসজ্জিত। এই প্যানেলগুলিতে নানারকম স্টাকো মূর্তি খোদিত রয়েছে। এই মূর্তিগুলিতে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণ, জাতক কাহিনির দৃশ্যাবলি, শিব, পার্বতী, কার্তিক, গজলক্ষ্মী প্রমুখ ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী, বাদ্যরত কিন্নর, মকরদের বিভিন্ন রূপ এবং নরনারীর মৈথুনচিত্র দেখা যায়।

ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া এবং জাপানে অনুসৃত মহাযানসহ বৌদ্ধধর্মের অন্য শাখাগুলি নালন্দা মহাবিহারেই বিকাশলাভ করেছিল।

নালন্দায় না গেলে মানব সভ্যতার ইতিহাসের একটি সমৃদ্ধ অধ্যায় সম্পর্কে এত কিছু হয়তো জানতে পারতাম না। আমি নালন্দা মহাবিহার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি তা হয়তো নয়। তবে সেখানে যা কিছু দেখেছি তা আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আজ থেকে এক হাজার বছর আগেও মানুষের সৃজনপ্রতিভা কতটা শক্তিশালী ছিল তার পরিচয় বহন করছে পুরনো ধ্বংসাবশেষগুলি।

এখানে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে দু-একটি তথ্য উল্লেখ না করলেই নয়। যতদূর জেনেছি, সেখানে ছাত্রদের জন্য থাকার ঘর, জলের জন্য কুয়ো, রান্নার ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি ছাত্রাবাসের বাইরে ছিল একটি করে বৌদ্ধমন্দির। প্রতিদিন অধ্যয়নের শুরু এবং শেষে ছাত্রদের পূজা করতে হতো। ছাত্রাবাসে প্রত্যেক ছাত্র এবং শিক্ষকের নিজস্ব ঘরের ব্যবস্থা ছিল। একই ঘরে একের বেশি ছাত্রকে থাকতে হতো না। তবে রান্নাবান্না এবং নিজেদের অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাত্রদের নিজেদেরই করতে হতো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সে-যুগে অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ইচ্ছে করলেই সেখানে পড়াশোনার সুযোগ পাওয়া যেত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশদ্বারে যে দ্বাররক্ষী ছিলেন, বাইরে থেকে আসা ছাত্রদের প্রথমে তাঁর কাছে পরীক্ষা দিতে হতো। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি মিলত। এ থেকেই বোঝা যায়, নালন্দায় জ্ঞানচর্চা কতটা কঠিন ছিল।

বহু বছর পরে ভারত সরকার নালন্দায় ২০১৪ সাল থেকে আবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করেছে।

এরপর আমরা গিয়েছি রাজগির। রাজগিরও একটি পর্যটনকেন্দ্র। নালন্দার কাছাকাছি। রাজগিরের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের একটি হলো ‘বিশ্বশান্তি স্তূপ’। এটা গৃধ্রকূট পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ে ওঠার জন্য চলে রোপওয়ে। রোপওয়েতে একটায় একজনই চড়তে পারে। এগুলি চলার পথে কখনো থামে না। তবে রোপওয়েতে ওঠার জন্য বড় লাইন থাকে। নতুন অভিজ্ঞতার জন্য একশ টাকার টিকেট কেটে আমি রোপওয়েতে পাহাড়ের ওপর ঘুরে এসেছি।

এখানে আরেকটি দেখার মতো জায়গা হলো ‘শতধারা কুণ্ড’ বা উষ্ণ প্রস্রবণ। মাটির অনেকটা নিচ থেকে সরাসরি উঠে আসে বলে এই জল বেশ গরম হয়। তবে কৃত্রিম উপায়ে জল গরম করা হয় বলেও কেউ কেউ মনে করেন। উষ্ণ প্রস্রবণে স্নান করলে পুণ্য অর্জনের ধারণাও প্রচলিত আছে। জলের বেগ খুবই কম। তারপরও অনেকেই এখানে স্নান করেন। অজয় রায় আগ্রহ না দেখালেও আমি স্নানবঞ্চিত থাকিনি।

জৈন মিউজিয়াম রাজগিরে আরেকটি দেখার মতো স্থান। ২০ টাকা টিকেট কেটে মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকতে হয়। মিউজিয়ামটি খুব সুন্দর। মহাবীরসহ জৈন বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনের নানা ঘটনা মডেলের মাধ্যমে দেখানো হয়। বিহারের ইতিহাস গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে জৈন ধর্মগুরু মহাবীরের জন্যও বিখ্যাত।

রাজগিরের ‘জাপানি মন্দির’ও আমার ভালো লেগেছে। মন্দিরে একটি বড় বুদ্ধমূর্তি আছে। এখানে উপাসনার সময় জাপানি সুরে কিছু একটি বাজনা শুনেছিলাম। নালন্দা এবং রাজগিরে বেড়াতে গিয়ে ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সঙ্গী হতে পেরে আমার ভালো লেগেছে। এখনো চোখে ভাসে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানীমূর্তি। তাঁর জ্ঞানসাধনার কথাও মনে গভীরভাবে দাগ কেটে আছে। মানুষ একদিন হিংসা-বিদ্বেষের চর্চা ভুলে শান্তির পথের সমবেতযাত্রী হবে, সে আশাতেই প্রহর গুনি।

পঁয়তাল্লিশ

অজন্তা-ইলোরার নাম শোনেননি এমন ভ্রমণ-আগ্রহী মানুষ কম আছেন বলেই আমার বিশ্বাস। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রসিদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অজন্তা-ইলোরা যাওয়ার ইচ্ছে সেই কবে থেকে। এই দুটি জায়গা সম্পর্কে অনেকের মুখে শুনেছি, বইয়ে পড়েছি অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্রের চমৎকারিত্ব নিয়ে; কিন্তু চোখে দেখা হয়ে উঠছিল না। কেন যে ব্যাটে-বলে মেলেনি, তা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। কারণ বছর কয়েক আগে আমাদের পারিবারিক বন্ধু-সুহৃদ সিলেটের সুকুমার দেবরায়ের পরিবারের সঙ্গে আমার ইতিহাস-বিখ্যাত অজন্তা এবং ইলোরা ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের রাজ্য মহারাষ্ট্র। এই মহারাষ্ট্রেই পৃথিবী বিখ্যাত অজন্তা-ইলোরা গুহা, যার অনিন্দ্যসুন্দর ভাস্কর্য মুগ্ধ করে রেখেছে কত মানুষকে।

ঢাকা থেকে কলকাতা, তারপর বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) হয়ে আওরঙ্গাবাদ পৌঁছেছিলাম। আওরঙ্গাবাদ শহরের ১০২ কিলোমিটার উত্তরে অজন্তা এবং তার ২৯ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ইলোরা গুহা অবস্থিত। গুহা দুটির মধ্যেকার দূরত্ব ১০৮ কিলোমিটার। স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণ ইত্যাদির কারণে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও অজন্তা-ইলোরার নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, প্রাচীনকালে আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণের ফলে এই এলাকা গঠিত হয়েছিল। পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন শিলার প্রাচুর্য সহজেই নজরে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী গ্রানাইট পাথর। অজন্তা ও ইলোরা এই শক্তিশালী মজবুত পাথর কেটে নির্মিত হওয়ায় হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে। এই দুই গুহা শিল্পকর্মের অসাধারণ এবং দৃষ্টিনন্দন শৈলীর জন্য পৃথিবীবিখ্যাত। মানুষের শিল্প-সভ্যতা বিকাশের নিদর্শন হিসেবে এগুলি দেখার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ এই স্থান দুটিতে ভিড় করেন। অজন্তা-ইলোরা বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে।

অজন্তার গুহাগুলি একদিক থেকে দেখলে অশ্বখুরাকৃতির মতো মনে হয়। অজন্তাতে মোট ছাব্বিশটা গুহা রয়েছে। পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে কেটে গুহাগুলি বানানো হয়েছে। এরপর এর দেয়ালগুলিতে কোথাও খোদাই করে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে গুহার দেয়ালে প্রাকৃতিক রং দিয়ে করা পেইন্টিং। বেশিরভাগ পেইন্টিংই জাতকের গল্প।

অজন্তার গুহাগুলি গৌতম বুদ্ধের প্রতি উৎসর্গীকৃত। এগুলি গভীর খাড়া গিরিখাতের গায়ে পাথর কেটে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। এখানে রয়েছে মোট ৩০টি গুহা। ধারণা করা হয়, গুহাগুলি খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় ৭০০ অব্দের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। গুহাগুলির সামনে রয়েছে বারান্দা। বারান্দার ওপরে রয়েছে ছাদ। আর ছাদকে ধরে রাখার জন্য আছে স্তম্ভ।

অজন্তার গুহাচিত্রের জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তা পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের গুহাচিত্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নিপুণতার সঙ্গে এমন নিখুঁতভাবে গুহাচিত্রগুলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা দেখলে বিস্ময়ের সীমা থাকে না। পাহাড় কেটে কীভাবে এই মন্দিরগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল তা আজো স্থাপত্যজ্ঞানের অবাক করা বিষয়।

এক নম্বর গুহাই অজন্তার সবচেয়ে সংরক্ষিত গুহা। এটি পূর্ব কোণে অবস্থিত। এক নম্বর গুহা অতি মনোহর চিত্রকলার জন্য প্রসিদ্ধ। গুহার সামনের দেয়ালে গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানা দৃশ্য খোদাই করা আছে। এই গুহার দেয়ালে আঁকা চিত্রগুলি ভারতের প্রাচীন চিত্রকলার সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত নিদর্শনগুলির অন্যতম।

এক নম্বর গুহার পাশে অবস্থিত দুই নম্বর গুহা অজন্তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গুহাগুলির একটি। এখানে দর্শনার্থীরা গুহার দেয়ালে, স্তম্ভে এবং সিলিংয়ে আঁকা ছবি দেখতে যান। এখানে নাগরাজ এবং তাঁর অনুসারীদের ভাস্কর্যও রয়েছে। অজন্তার গুহাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় বিহার চতুর্থ গুহাতে অবস্থিত, তবে এটা অসম্পূর্ণ। এখানে যেসব চিত্র দেখা যায় তার মধ্যে আছে উড়ন্ত অপ্সরা, জাতক, গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানা বিষয়, গাছপালা, রমণে নিরত নারী-পুরুষ এবং পাগলা হাতি থেকে পলায়নপর জনতা।

অজন্তার গুহাগুলির মধ্যে ১৬ নম্বর গুহাকে অজন্তার ‘স্বাগত দ্বার’ বলা হয়। কারণ এর ঠিক সামনে পাথরে তৈরি দুটি হাতি দর্শনার্থীদের স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এখানকার একটি বিখ্যাত চিত্রকলার নাম ‘রাজকুমারীর মৃত্যু’। গৌতম বুদ্ধের সৎভাই নন্দের স্ত্রী ‘সুন্দরী’ যখন শুনলেন তাঁর স্বামী সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তিনি দেহত্যাগ করেন। অজন্তার সব গুহাতেই অসাধারণ সব চিত্রকলা রয়েছে যা দর্শনার্থীদের নিয়ে যাবে সুদূর অতীতে, তাঁরা মানসচোখে দেখবেন, একদল মানুষ তাঁদের হাতুড়ি, গাইতি আর ছেনি দিয়ে কী অপূর্ব দক্ষতায় সৃষ্টি করে চলেছেন অমূল্য সব চিত্র।

 অজন্তার গুহা দেখা খানিকটা কষ্টকর। কারণ অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হয়। আর বেশ উঁচু উঁচু খাড়া সিঁড়ি। যে গুহাগুলিতে গৌতম বুদ্ধের মূর্তি আছে সেখানে জুতো খুলে ঢুকতে হয়।  দু-একটি গুহা বন্ধ দেখেছি । আবার অসমাপ্ত গুহাও রয়েছে যেখানে শুধু গর্ত করে গুহা তৈরি করা হয়েছে কিন্তু আর কোনো কিছু তৈরি করা হয়নি।

অজন্তার গুহাগুলি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একবার যেতে কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগে; ফিরতে আরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এবার গুহা যে যতটা সময় নিয়ে দেখবে তার ততোটাই সময় লাগবে। আমরা ঘণ্টা চারেক ছিলাম অজন্তা গুহাগুলিতে। গুহার সামনে একটা পাহাড়ে সুন্দর ঝরনা দেখা যায়।

অজন্তার তুলনায় ইলোরা অনেকটা সমতলে, হাঁটার কষ্ট কিছুটা কম। টিকেট কেটে গেটের ভেতরে ঢুকলেই একটা বড় জায়গা জুড়ে বাগান করা রয়েছে। বাগান দেখতে দেখতেই বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ১৬ নম্বর গুহার সামনে পৌঁছে গেলাম। এটির দেয়ালের ভাস্কর্য অসাধারণ। এটির নাম গ্রেট কৈলাস টেম্পল। এটির নির্মাণের কৌশল, নিপুণতা এবং পরিশ্রম অবাক করে দেওয়ার মতো। এগুলি দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, এটি আদৌ মানুষে তৈরি করেছে, নাকি কোনো মহাজাগতিক শক্তি এটি করেছে? ইলোরার গুহাগুলি হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ভাস্কর্যের সমাহার।

১৬ নম্বর গুহার পর ডানদিকে পাশাপাশি গুহাগুলি ১ নম্বর পর্যন্ত রয়েছে, কোনোটা হিন্দুদের তৈরি, তাতে দেবদেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে, আবার কোনোটা বৌদ্ধদের তাতে ভগবান বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে, আর বাকিগুলি জৈন ধর্মের। এখানে হিন্দু ধর্মের ১৭টি, বৌদ্ধ ধর্মের ১২টি এবং জৈন ধর্মের পাঁচটি মন্দির রয়েছে। সব ধর্মের উপাসনালয়ের সহাবস্থান তখনকার ভারতবর্ষের ধর্মীয় সম্প্রীতির পরিচয়বাহী।

ইলোরার গুহামন্দিরগুলি চরনন্দীর পাথুরে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। চতুর্থ থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে কালাচুরি, চালুক্য ও রাষ্ট্রকূট রাজবংশের শাসনামলে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল গুহাগুলি। এখানে আছে খোদাই করা বহুতল বাসভবন, মন্দির এবং রান্নাঘর। বৌদ্ধ ধর্মের গুহাগুলির মূল উপজীব্য বুদ্ধমূর্তি, বোধিসত্ত্ব আর অপ্সরা। এর মধ্যে পাঁচ নম্বর গুহাটি সবচেয়ে বড়। হিন্দু গুহাগুলির মুখ্য উপজীব্য শিব। নানা ভাস্কর্যে নানান দৃশ্যে মহাদেব শিবকে দেখা যায় এখানে। কখনো তিনি দৈত্য বধ করছেন, আবার কখনো নৃত্যরত।

শিলা কেটে তৈরি ইলোরার গুহাগুলিতে অসাধারণ সব ভাস্কর্য  দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। ত্রয়োদশ শতকে প্রথমবার এবং পরে মোগল শাসক আওরঙ্গজেবের রোষানলে ইলোরার মন্দিরগুলি অনেকখানি ধ্বংস হলেও এখন পর্যন্ত যা অবশিষ্ট আছে তা-ই দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।

কৈলাস মন্দির থেকে ৩৫০ মিটার দূরে চৌদ্দ নম্বর গুহা অবস্থিত, এটা রাবণের সভাগৃহ হিসেবে পরিচিত। এখানে বৃহৎ স্তম্ভ দিয়ে সজ্জিত সভাগৃহ, একটি মণ্ডপ, একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। প্রবেশপথে আছে দেবী গঙ্গার মূর্তি। কৈলাস মন্দির থেকে ৫০০ মিটার দূরে দশ নম্বর গুহাটি বিশ্বকর্মা গুহা নামে পরিচিত। এটি বৌদ্ধ গুহাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি ছুতার-কা-ঝুপড়ি নামেও পরিচিত। কারণ স্থানীয় ছুতার সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তিকে বিশ্বকর্মা হিসেবে পূজা দেয়। তিনি সমস্ত শিল্পের স্রষ্টা হিসেবে হিন্দুদের কাছে পূজনীয়। পাথর কেটে এই গুহার দুপাশে অসাধারণ সব কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একেবারে মাথায় এগারো ফুট উঁচু গৌতম বুদ্ধের নিখুঁত মূর্তিটি স্থাপিত।

কৈলাস মন্দির থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরে ৩২ নম্বর গুহাটি অবস্থিত। এটি একটি জৈন গুহা। জৈন গুহাগুলির মধ্যে এটি সবচেয়ে সুন্দর ও বড়। এই গুহাটি মহাবীর এবং অন্য জৈন ধর্মগুরুদের উৎসর্গ করে নির্মিত।

ইলোরা দেখা শেষে একটি রেস্টুরেন্টে আমরা ফুলকো রুটি এবং নিরামিষ তরকারি দিয়ে দুপুরের আহার শেষ করেছিলাম। ভ্রমণপিপাসু কত মানুষের পায়ের ছাপ যে অজন্তা-ইলোরায় পড়েছে তার হিসাব সম্ভবত কারো কাছেই নেই। অজন্তা-ইলোরা দেখা আমার জীবনের অতি স্মরণীয় ঘটনা। কত শত বছর আগে মানুষের অসম্ভব সৃজনশীল কীর্তি দেখে বিস্ময়ে এবং গর্বে বুক ভরে ওঠে। মানুষ কত সাধনা করে যে সভ্যতা নির্মাণ করেছে, সেই সভ্যতা নাশের জন্যও এখন কিছু মানুষের উন্মাদনা দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়।

এই যাত্রাতে আমরা ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় ছোট্ট রাজ্য ‘গোয়া’ দেখার সাধ পূরণ করেছিলাম। গোয়া আরব সাগরের পাশে অবস্থিত। উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে বিভক্ত গোয়া এক সময় পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে, ১৯৬১ সালে গোয়া ভারতের অন্তর্গত হয়। গোয়ায় আছে অনেকগুলি সমুদ্রসৈকত। আছে ঝরনা, সবুজ পাহাড়, নদী, প্রাচীন গুহা, পুরনো গির্জা ও মন্দির, দৃষ্টিনন্দন নারকেল গাছের সারি, স্বচ্ছ জলের ফোয়ারা – এই সবকিছুই পর্যটকদের আকর্ষণ করে। গোয়া মূলত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত হলেও, সেখানে আনন্দ-আয়োজনের কোনো কমতি নেই। গোয়া অনেকের কাছে ভারতের বুকে এক টুকরো ইউরোপীয় গ্রামের মতো মনে হয়। মূলত উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলগুলিই বেশি সুন্দর ও মনোরম। দক্ষিণাঞ্চলও সুন্দর কিন্তু ওদিকে প্রশাসনিক অবকাঠামো বেশি।

আসলে পুরো গোয়া রাজ্যটাই ভীষণ সুন্দর। দেখার মতো অনেক কিছু আছে। প্রাচীন আমলের অনেক পর্তুগিজ দুর্গ, ডাচদের গড়া একটি লাইটহাউস, পুরনো জেলখানাসহ অনেক দর্শনীয় জিনিস আছে। পুরনো চার্চ এবং মন্দিরগুলি বেশ নান্দনিক।

গোয়ার হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলি ভালো। সাধারণভাবে থাকা-খাওয়ার রিসোর্ট ও হোটেল আছে। খাবারের মানও ভালো। রাস্তার পাশের দোকানের খাবারও মানসম্পন্ন। একজনের জন্য খাবারের অর্ডার দিয়ে সে খাবার দুজনে আরামসে খাওয়া যায়। ঝটপট কোনো খাবার পাওয়া যায় না। ২০-৩০ মিনিট অপেক্ষা করে খাবার খেতে হয়। বাসি খাবার পরিবেশন করা হয় না। কম খরচে পাওয়া যায় ভেজ থালি, যাতে থাকে দুটো সবজি, এক প্রকার ডাল, টক দই, দুই পিস রুটি, স্টিম রাইস এবং দুই পিস পাঁপড়। নন-ভেজ থালিও পাওয়া যায়, যাতে বাড়তি থাকে মাটন অথবা চিকেন। একেবারে সস্তায় নুডলস খেয়েও পেট ভরানো যায়।  গোয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘পাও-ভাজি’ সকালের নাস্তার জন্য বিখ্যাত। এটা আসলে সেঁকা বন রুটি আর ছানার ডাল, সঙ্গে একটি পুরুষ্টু মরিচ ভাজা। দুধ চাতে থাকে গোলাপ জল মেশানো। হায়দরাবাদী ও কাশ্মিরি বিরিয়ানিও পাওয়া যায়। গোয়াকে কেউ কেউ খাবার এবং পানীয়ের রাজ্যও বলে থাকেন।

গোয়া খুবই নিরিবিলি ও নিরাপদ ভ্রমণের জায়গা। ওখানকার মানুষের মধ্যে ধর্ম-গোত্র-বর্ণের নানা ভেদ থাকলেও তারা খুব সহনশীল এবং অমায়িক। কারো কাছে কোনো ব্যাপারে সাহায্য চাইলে পাওয়া যায়। শতভাগ মানুষই আন্তরিক। মেয়েদের দেখে কেউ টিজ করে না। গোয়াতে খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে বার বেশি হলেও মদ খেয়ে কেউ মাতলামি করে না। গোয়ার বাসিন্দাদের শতকরা দশ ভাগও মদ খায় না বলে শুনেছি। পর্যটকের ব্যাপারে তারা সহনশীল, কারণ এটাই তাদের প্রধান আয়। তবে উদ্দাম সংস্কৃতি তাদের পছন্দের নয়। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা এবং গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ নেই। ফলে চলাফেরা খুব আরামদায়ক। ছবির মতো সুন্দর গোয়া আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে।

ছেচল্লিশ

বাঙালির আড্ডা নিয়ে চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকের নতুন কাব্যরীতির সূচনাকারী কবি হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনি প্রবন্ধ, গল্প, নাটক এবং অনুবাদ ছাড়াও সম্পাদক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর জন্ম বাংলাদেশে ১৯০৮ সালের ৩০শে নভেম্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। পরে কলকাতায় স্থায়ী হয়ে ১৯৭৪ সালের ১৮ই মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী প্রতিভা বসুও লেখক হিসেবে সুখ্যাতি পেয়েছেন।

বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘আড্ডা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ছেলেবেলায় গুরুজনেরা আশঙ্কা করেছিলেন যে আড্ডায় আমার সর্বনাশ হবে, এখন দেখছি ওতে আমার সর্বলাভ হলো। তাই শুধু উপাসক হয়ে আমার তৃপ্তি নেই, পুরোহিত হয়ে তার মহিমা প্রচার করতে বসেছি।’ বুদ্ধদেব বসুকে আরো একটু উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি লিখছেন : ‘আড্ডা জিনিসটা সর্বভারতীয়, কিন্তু বাংলাদেশের সজল বাতাসেই তার পূর্ণবিকাশ। আমাদের ঋতুগুলি যেমন কবিতা জাগায়, তেমনি আড্ডাও জমায়। আমাদের চৈত্রসন্ধ্যা, বর্ষার সন্ধ্যা, শরতের জ্যোৎস্না-ঢালা রাত্রি, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল – সবই আড্ডার নীরব ঘণ্টা বাজিয়ে যায়, কেউ শুনতে পায়, কেউ পায় না। যে-সব দেশে শীত-গ্রীষ্ম দুই অতি তীব্র, বা বছরের ছ-মাস জুড়েই শীতকাল রাজত্ব করে, সেগুলো আড্ডার পক্ষে ঠিক অনুকূল নয়। বাংলার কমনীয় আবহাওয়ায় যেমন গাছপালার ঘনতা, তেমনি আড্ডার উচ্ছ্বাসও স্বাভাবিক। ছেলেবেলা থেকে এই আড্ডার প্রেমে মজে আছি।’

হঠাৎ করে আড্ডার প্রসঙ্গ কেন মনে হলো, সে প্রশ্ন কেউ করতেই পারেন। আমার জীবনের এই শেষপ্রান্তে এসে নানা বিষয় হঠাৎ হঠাৎই মনের কোণে উঁকি মারে। সংসারে আমাদের তেমন সচ্ছলতা হয়তো ছিল না, কিন্তু প্রাণ ভরা ছিল উচ্ছ্বাস, আনন্দ করার উপলক্ষ পেতে সমস্যা হতো না। পরিবার, পরিবেশ, পরিচিত মানুষজন – সবকিছু যেন আমাদের প্রাণের আবেগের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল। অজয় রায়ের  মতো একজন রুচিবান, চিন্তাশীল, উদার এবং পরিবর্তনকামী মানুষের সঙ্গে সংসার পেতে আমি ব্যক্তিগতভাবে কত যে সমৃদ্ধ হয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। এটা আসলে বয়ান করার চেয়ে বেশি উপলব্ধি করার বিষয়। এখন অজয় রায় নেই। ছেলেমেয়েরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে। আমার একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। কথা বলার মতো তেমন লোকও নেই। আসলে পৃথিবীতে লোকসংখ্যা বাড়লেও কমছে মানুষের সংখ্যা। অন্যকে বোঝার মতো প্রকৃত মানুষ এখন কমে গেছে। এখন স্বার্থবুদ্ধি আমাদের এতোই তাড়িত করে যে হৃদয়বৃত্তি তার কাছে কেবলই হার মানে।

অজয় রায় রাজনীতির মানুষ ছিলেন। সাম্য চিন্তার মানুষ ছিলেন। নিজের সুখের চিন্তার চেয়ে অনেকের সুখ-শান্তির বিষয়ে বেশি ভাবতেন। ভোগে নয়, ত্যাগের আদর্শে পথ চলেছেন। তাঁকে বাইরে থেকে দেখে মনে হতো তিনি বুঝি অতি কাঠখোট্টা একজন গুরুগম্ভীর মানুষ। কিন্তু যাঁরা তাঁর সঙ্গে মিশেছেন, তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন, তাঁরা জানেন, তিনি আসলে ছিলেন একজন অহমিকাশূন্য সহজ-সরল মানুষ। তিনি ছিলেন মানুষের সঙ্গপ্রিয়। যাঁদের সঙ্গে মত-পথের মিল হতো তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে, কথা বলতে পছন্দ করতেন। সহজ কথায় তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন আড্ডাপ্রিয় মানুষ। তবে এটা ঠিক, জীবনের শেষদিকে এসে তিনি কথা বলার মতো লোকের অভাব বোধ করতেন। তাই কলকাতা যাওয়ার জন্য তাঁর মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। সেখানে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা ভাবতেন, চিন্তা করতেন কিছুটা খোলা মনে তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। তাঁদের মধ্যে প্রগতির ধারার রাজনীতিবিদ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন লেখক-গবেষক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিককর্মী। তিনি নিজে পড়াশোনা, লেখালেখি করতেন, তাই এমন গুণের মানুষদের প্রতিও ছিল তাঁর স্বাভাবিক দুর্বলতা।

অজয় রায়ের জীবনসঙ্গী হওয়ার কারণে কত মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, কত জনের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি, তাঁদের কথা ভেবে, মনে করে এখন আমি নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করি।

অজয় রায় কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করার পর নিষ্ক্রিয় জীবন কাটাননি। তিনি প্রগতির ধারায় একটি উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্য

আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। বাম ধারার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দিনের পর দিন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এক হয়ে চলার জন্য এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করেছেন। মনজুরুল আহসান খান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, রাশেদ খান মেনন, কাজী আরিফ আহমেদ, হাসানুল হক ইনু, শরীফ গোলাম আম্বিয়া, ফজলে হোসেন বাদশা, নাজমুল হক প্রধানসহ কত জনের সঙ্গে যে তাঁকে কথা বলতে, আলোচনা চালিয়ে যেতে দেখেছি। আমাদের বাসায়ও অনেক সময় তাঁরা আসতেন, কথা বলতেন, মতবিনিময় করতেন। দেশে একটি জনসমর্থনপুষ্ট বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে সফল না হওয়ার দুঃখ তাঁর মধ্যে ছিল।

আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও অজয় রায়ের পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। কয়েকটি বিশেষ রাজনৈতিক সংকটের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে অজয় রায় তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন, তাঁকে সতর্কতার সঙ্গে পথ চলার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, তেজ, দৃঢ়তা ও কৌশলের প্রশংসা করতেন অজয় রায়।

আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে অজয় রায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ আশরাফ আমাদের বাসায়ও একাধিকবার এসেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁরা কথা বলেছেন। অজয় রায়কে সৈয়দ আশরাফ রাজনৈতিক ‘গুরু’ বলে মানতেন। কিশোরগঞ্জের মানুষ হওয়ায় ছাত্রজীবন থেকেই তিনি অজয় রায়ের সম্পর্কে জানতেন। বাম-প্রগতিশীলদের ব্যাপারে সৈয়দ আশরাফের একটি বিশেষ দুর্বলতা ছিল। একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময় তিনি লন্ডনে ছিলেন। ওই মর্মান্তিক ঘটনার খবর শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লন্ডনে একটি মিছিল করার উদ্যোগ নিয়ে তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবিদারদের কাউকে তিনি কাছে পাননি। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ধারার জনাপঞ্চাশেক মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে মিছিলে শামিল হয়েছিলেন।

সৈয়দ আশরাফ এটাও স্মরণ করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কিশোরগঞ্জ শহরে ১৫ই আগস্টেই প্রথম যে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল সেটাও বাম-প্রগতিশীলদের উদ্যোগে। বঙ্গবন্ধুর সময় কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহসহ অন্যদের সঙ্গে যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া ছিল এখন আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টির সেটা নেই। এতে দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না।

তবে সময়কে যেমন থামিয়ে রাখা যায় না, রাজনীতিরও বুঝি বাঁকবদল ঘটেই থাকা। এক অবস্থায় সব সময় থাকে না। চলমানতা রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হওয়ায় রাজনীতিতে শত্রু-মিত্রও তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো নয়।

এখন রাজনীতিতে একমত হওয়ার চেয়ে ভিন্ন মতের প্রবাহ বেশি। আড্ডার যে মেজাজ আগে ছিল, এখন আর তা অবশিষ্ট আছে কি না প্রশ্ন সেটাই। এখন পরনিন্দা-পরচর্চা ছাড়া আর যেন আড্ডা জমে না। ঐক্য গড়ে নয়, বিভেদেই এখন আনন্দ বেশি।

আবারো ফিরে যাই বুদ্ধদেব বসুর কাছে। এই যে আজ কথা বলার মতো মানুষের অভাব বোধ করছি আমরা তার কারণ কি? আড্ডা কি কোনো বারোয়ারি বিষয় যে ইচ্ছে হলেই জমানো যায়? না, বুদ্ধদেব বসু বলছেন : ‘তাই বলে এমন নয় যে এলোমেলোভাবেই আড্ডা গড়ে ওঠে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে তার পিছনে কোনো একজনের প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রখর রচনাশক্তি চাই। অনেকগুলি শর্ত পূরণ হলে তবে কতিপয় ব্যক্তির সমাবেশ হয়ে ওঠে।’

আড্ডা গড়ার জন্য তেমন ‘প্রখর রচনাশক্তি’-সম্পন্ন মানুষেরই যে এখন আকাল চলছে। (চলবে)