রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

পঁচিশ

দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতি সামাল নেওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে রাখার জন্য বঙ্গবন্ধু চিন্তাভাবনা করতে থাকেন বলে শোনা যেতে থাকে। ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করার সিদ্ধান্ত ছিল তখনকার সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সংসদীয় সরকারব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় যাওয়াটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে একটি বড় মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা।

দেশে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে একটি মাত্র দল – বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল – গঠনের ফলে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক আবহ তৈরি হয়। বাকশাল গঠনের পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও তখন অনেকেই দলবেঁধে বাকশালে যোগ দিতে থাকে। বাইরে বাইরে বাকশাল নিয়ে যতটা উচ্ছ্বাস ছিল, ভেতরে ভেতরে ততটাই ছিল অস্বস্তি। এমন প্রচারণাও ছিল যে, কমিউনিস্ট পার্টির পরামর্শ শুনেই বঙ্গবন্ধু বাকশাল ব্যবস্থা করেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সুসম্পর্কের কারণেই হয়তো ওই ধরনের প্রচারণা চালু হয়েছিল; কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তেমন ছিল না।

অজয় রায়ের কাছে আমি কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত বা অবস্থানের কথা যেটা শুনেছিলাম, সেটা ছিল এই রকম : বঙ্গবন্ধু সাময়িক সময়ের জন্য একদলীয় ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টির মতামত জানতে চাইলে পার্টির পক্ষ থেকে ভিন্ন মতের কথাই জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশে একদলীয় ব্যবস্থা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না মনে করেই কমিউনিস্ট পার্টি একদল করার বিরুদ্ধে ছিল। একদল করার চিন্তা ও সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত অবস্থান। তিনি কারো পরামর্শ বা প্রভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। তিনি কথা বলতেন অনেকের সঙ্গে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতেন নিজের মতো করে। তাঁর মতো বড় মাপের একজন নেতা কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা প্রভাবিত বা প্ররোচিত হয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন – এটা যাঁরা মনে করেন তাঁরা আসলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন।

তবে এটা ঠিক যে, কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান না নিয়ে তার সঙ্গে চলার নীতি নিয়েছিল। বাকশালের গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদের ঠাঁই হয়েছিল। পার্টির অন্য কোনো নেতা, এমনকি মণি সিংহের নামও কেন্দ্রীয় কমিটিতে না থাকায় দলের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছিল। কমিটিতে আওয়ামী লীগের একক প্রাধান্য ছিল। রাজনীতিবিদ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তি, এমনকি সামরিক বাহিনীরও প্রতিনিধিত্ব ছিল বাকশালে।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি সফল হলে দেশের পরিস্থিতি কেমন হতো, সমাজতন্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে কতটুকু অগ্রসর হওয়া যেত, সাধারণ মানুষের জীবনে তার সুফল কতটুকু পৌঁছত, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা এখন অর্থহীন। এটা বলা যায় যে, আঁতুরঘরেই বাকশালের অপমৃত্যু হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ওইদিন সকাল ৯টায় জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণের কর্মসূচি ছিল। অজয় রায়ের একটি অধিবেশনে প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সেজন্যে আগের রাতে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে বেশ দেরি করে ঘুমিয়ে ছিলেন। তিনি সাধারণত খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। ১৫ আগস্ট আমি তার আগে উঠে ছেলে জয়কে খাওয়াচ্ছিলাম। ও খেতে চাইছিল না দেখে আমি রেডিও চালু করে দিয়েছিলাম।

হঠাৎ আমার কানে আসে সেই পিলে চমকানো ঘোষণা : আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। পুরো কথা আর আমি শুনতে পাই না। আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। ছেলেকে খাওয়ানো বাদ দিয়ে আমি অজয় রায়কে ডেকে তুলে রেডিওর ঘোষণার কথা বলি। তিনি প্রথমে বলেন। ধুর, এটা পাকিস্তানি রেডিওর অপপ্রচার; কিন্তু বাংলাদেশ বেতার থেকে ওই ঘোষণা প্রচার হচ্ছে শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। তাঁর বুঝতে বাকি থাকে না কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে।

তিনি একটু ধাতস্থ হয়ে বলেন, দেশে ক্যু হয়েছে। পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় বোঝা যাচ্ছে না। তবে তাঁর বাড়িতে থাকা নিরাপদ হবে না মনে করে দ্রুত বাড়ির বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিছু টাকা এবং সামান্য জামাকাপড় নিয়ে তিনি ঘর ছাড়তে উদ্যোগ নেন। আমাদের সঙ্গে থাকা একতার সাংবাদিক মঞ্জুভাইও আর ওই বাসায় থাকা নিরাপদ বোধ করলেন না। তিনিও অন্য কোথাও আশ্রয়ের আশায় চলে গেলেন।

আমি কী করব তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এর মধ্যে আমাদের বাড়ির মালিক জাহানারা বেগম সব শুনে মোটেও বিচলিত না হয়ে বললেন, আরে কিছুই হবে না। আপনারা খামোখা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন; কিন্তু আমার উদ্বেগ না কমে বাড়তে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে – এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া না হয়ে পারে না। আমি ছোট বাচ্চাকে নিয়ে অসহায় বোধ করতে থাকি।

আমার মনে হয়, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে আমার ময়মনসিংহ চলে যাওয়া উচিত। ঢাকার চেয়ে ময়মনসিংহ আমার বেশি পরিচিত। তাছাড়া সেখানে আমার মা-বাবাসহ অন্য আত্মীয়রা আছেন। আছে আমার মেয়েও। আমি ময়মনসিংহ যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করি। তখন আমার বাসায় এসে উপস্থিত হন টাঙ্গাইলের কমিউনিস্ট নেতা শক্তিপদ ঘোষ। তিনি কোনো কারণে ঢাকা এসেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে খবরাখবর জানতে আমাদের বাসায় আসেন। আমি তাঁকে অনুরোধ করি আমাকে ময়মনসিংহে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। তিনি সম্মত হন। বাসা একেবারে খালি না করে জেঠিমাকে রেখে আমি জয়কে কোলে নিয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হই; কিন্তু বায়তুল মোকাররমের কাছাকাছি গিয়ে ট্যাংকের মুখোমুখি পড়ি। ট্যাংক দেখে ভয় পেয়ে শক্তিপদ ঘোষ আমাকে ফেলেই দ্রুত কোথাও সরে পড়েন। আমি আমার কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ ফেলে দিয়ে জয়কে বুকে আঁকড়ে ধরে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতর আশ্রয় নিই। ভয়ে আরো অনেকে মসজিদের ভেতর ঢুকেছেন। আমাকে সন্ত্রস্ত দেখে একজন ইমাম এগিয়ে এসে ভরসা দিয়ে বললেন, মাগো এখানে কোনো ভয় নেই। তবে নিরাপত্তার জন্য তুমি তোমার হাতের শাখা খুলে লুকিয়ে রাখো। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমার শাখা ভেঙে যায়। মসজিদের ভেতর কিছুক্ষণ থেকে আমি শান্তিনগরে আমার পরিচিত জোছনা সূত্রধরের বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেখানে গিয়ে দেখা হয় পার্টির প্রবীণ ও তাত্ত্বিক নেতা অনিল মুখার্জির সঙ্গে। তাঁকে দেখে আমার ছেলে জয় ‘অনিল মামা’ বলে চিৎকার করে ওঠে। অনিলদা যে-বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে আমার বেশি সময় থাকা ঠিক হবে না মনে করে আমাকে কেউ ময়মনসিংহে পৌঁছে দিতে পারে কি না ভাবতে থাকি। হঠাৎ মনে হয় বুলবুলের কথা। বুলবুল তখন উত্তরা ব্যাংকে চাকরি করতো। ওর বাড়িও ময়মনসিংহ। পার্টি করতো। সে জোছনারও পরিচিত। পরদিন বুলবুলই আমাকে ময়মনসিংহে পৌঁছে দিয়ে আসে। পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু না নিয়েই মায়ের কাছে গিয়ে একটু স্বস্তি পেলাম।

ছাব্বিশ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করায় দেশের মধ্যে যে-রকম প্রতিক্রিয়া হবে বলে আশা করেছিলাম, বাস্তবে তা না হওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। যে-নেতার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিতই হয়তো হতো না, সেই নেতাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো এবং সবাই কেমন তা নীরবে মেনে নিল। ভাগ্যিস সেসময় তাঁর দুই মেয়ে – শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা – দেশের বাইরে ছিলেন, তাই তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একাধিকবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে; কিন্তু সফল হতে পারেনি। তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি সামরিক শাসক আইয়ুব খান। উল্টো ঊনসত্তরের প্রবল গণঅভ্যুত্থানে শেখ মুজিব মুক্ত হয়ে আসেন এবং আইয়ুবকেই ক্ষমতা ছাড়তে হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করে বিচারের প্রহসন করে তাঁকে হত্যার চিন্তা সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের ছিল। তাঁর জন্য জেলের ভেতর কবরও খোঁড়া হয়েছিল; কিন্তু সে-আয়োজনও ব্যর্থ হয়। তাঁকে মুক্তিদিয়ে স্বদেশে ফিরে আসার সুযোগ দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা।

কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, তাঁকে হত্যা করা হলো তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। অথচ নির্মম সত্য এটাই যে, বাঙালি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত বুলেটেই তাঁর বুক ঝাঁঝরা হয়েছে। তাঁর মৃতদেহ যখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল তখন ক্ষমতা দখল করেছে তাঁরই সহচর বিশ্বাসঘাতক খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে চরম কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছেন।

আমার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশে বড় ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলন হবে। খুনিদের জীবন অনিরাপদ হয়ে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর ভক্ত-সমর্থকরা বুকের রক্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ শোধ করবেন; কিন্তু আমি হতাশ হয়ে লক্ষ করলাম, সবাই এতো বড় অন্যায় মেনে নিল! দেশে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটল না!

ময়মনসিংহে গিয়ে মায়ের কাছে পৌঁছে যে-স্বস্তি অনুভব করেছিলাম তা স্থায়ী হলো না। কারণ নানা দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করলো। প্রথমত অজয় রায়কে নিয়ে চিন্তা। তিনি কোথায়, কীভাবে আছেন, তা জানতে পারছিলাম না। দ্বিতীয়ত চাকরির চিন্তা। অফিস থেকে ছুটি না নিয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে ঢাকা ছেড়েছি। চাকরিটা না থাকলে আমাকে সংসার চালাতে বড় সমস্যায় পড়তে হবে ভেবে আমি ময়মনসিংহ থেকে আমার অফিসের বসকে টেলিফোন করলাম। সবকিছু শুনে তিনি আমাকে দেরি না করে তাড়াতাড়ি ঢাকা ফেরার পরামর্শ দিলেন। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও সবকিছুই স্বাভাবিক আছে।

আমি ঢাকা ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। এটা বুঝলাম যে, বাইরের পরিস্থিতি যত স্বাভাবিকই হোক না কেন, আমার স্বামীর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সহজ হবে না। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নতুন সরকারের সম্পর্ক যে ভালো হবে না, সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। তাই আমি একা ঢাকা না ফিরে আমার ভাই বিজনকেও সঙ্গে নিয়ে এলাম। মনে মনে ভাবলাম, আমাকে শক্ত হতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। এমন একজনকে জেনেবুঝে স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছি যাঁর জীবন-সংগ্রামের ধারা আলাদা। সংসার করলেও তিনি যে কার্যত সংসারবিবাগীর জীবন যাপন করবেন, সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। যে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে নতুন স্বাধীন দেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তাতেও ছেদ পড়ল জাতির পিতাকে হত্যার ফলে।

ঢাকায় ফিরে মালিবাগ মোড়ের ভাড়াবাসায় উঠলেও ওই বাসাটি খুব নিরাপদ মনে হলো না। আমি চাকরিতে যোগ দিলাম। আমার ভাই নতুন বাসা খুঁজতে শুরু করল। সিদ্ধেশ্বরীতে একটি বাসা পেয়েও গেলাম। অজয় রায় বা আমার নামে না নিয়ে আমার ভাই বিজনের নামেই বাসাটি ভাড়া নেওয়া হলো। এর মধ্যে অজয় রায়ের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ হয়েছে। তিনি পার্টির অন্য বড় নেতাদের মতো আত্মগোপনে থাকতেন। তবে একেবারে বাইরে চলাচল করতেন না, তেমন নয়। সিদ্ধেশ্বরীতে নতুন বাসা নেওয়ার পর তিনি মাঝে মাঝে এসে রাতেও থাকতেন। আবার অন্য বাসায়ও রাত কাটাতেন। আস্তে আস্তে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে বাসায় মিটিং করা শুরু করলেন। মানিকভাইসহ (সাইফউদ্দীন আহমদ মানিক) দু-একজন বাসায় আসতেন। তাঁদের কথাবার্তা যতটুকু কানে আসত তা থেকে মনে হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগ যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে একটি বড় কর্মসূচি নিতে যাচ্ছে। ৪ নভেম্বর সেই কর্মসূচি পালনের দিন ঠিক হয়। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি। তাঁকে হত্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৮ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় আবার খোলে। ২০ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিনে প্রতিবাদী ছাত্র সমাবেশ থেকে ৪ নভেম্বর শোক দিবস পালন ও বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র মোশতাকের ওপর সওয়ার হয়ে ছড়ি ঘোরাতে থাকে। এর মধ্যে ২ নভেম্বর সেনাবাহিনীর ভেতরে কিছু অস্থিরতা দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনী প্রধান করা হয় জিয়াউর রহমানকে। শুনতে পারছিলাম যে, জিয়ার সঙ্গে খুনিদের একটা যোগসাজশ ছিল। খুনিদের প্রতি জিয়া সহানুভূতিশীল ছিলেন বলেই জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে তাঁকে সেনাপ্রধান করা হয়; কিন্তু খুনিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ ছিল। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া না হলেও অস্বস্তি ছিল। ৩ নভেম্বর জানা যায় যে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ হয়েছে এবং জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ করে গৃহবন্দি করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর কমান্ড গ্রহণ করেছেন বলে শোনা যায়।

৪ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশ হয়। মূলত ছাত্র ইউনিয়নই ছাত্রলীগের সহযোগিতায় ওই সমাবেশের আয়োজন করেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি নেপথ্যে থেকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেকেও এই উদ্যোগের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন বলে পরে আমি জেনেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর বড় একটি প্রতিকৃতি নিয়ে বিশাল শোক মিছিল ৩২ নম্বরে গিয়ে সমবেত হয়। সেখানে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন বলেও শুনেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার এই প্রথম আনুষ্ঠানিক নিন্দা-প্রতিবাদের ঘটনাটি ছিল স্বস্তি ও আনন্দের। কিন্তু এই আনন্দ স্থায়ী হয় না। জানা যায়, ৩ নভেম্বর জেলখানায় সংঘটিত হয়েছে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। জেলে আটক চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদলের কয়েকজন গিয়ে হত্যা করে। এই ভয়াবহ খবর জানতে পেরে মানুষের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক চরম আকার ধারণ করে। দেশে কী হচ্ছে, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা বুঝতে না পেরে সবার মধ্যেই তৈরি হয় একটি অসহায় বোধ।

সেনাবাহিনীপ্রধানের দায়িত্ব নিলেও খালেদ মোশাররফ আসলে কী করতে চাইছিলেন, সেটা কারো কাছেই স্পষ্ট ছিল না। নানা গুজব ছড়ানো হয়। একটি গুমোট অবস্থা তৈরি হয়। খোন্দকার মোশতাকের ভাগ্যবিপর্যয়ের বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হয়। ৬ নভেম্বর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।

খালেদ মোশাররফ তাঁর অবস্থান সংহত করার আগেই পাল্টা অভ্যুত্থান হয়। জাসদের কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ভেতরে সিপাহীদের সংগঠিত করে খালেদ মোশাররফকে ‘রুশ-ভারতের দালাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে এক উন্মত্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। খালেদ মোশাররফের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় সবকিছু। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয় আর খালেদ মোশাররফকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে দেশে কার্যত একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। জিয়াউর রহমানই বাস্তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশত্যাগের সুযোগ করে দেওয়া হয়।

এসব ডামাডোলের কারণে অজয় রায় আবার তাঁর আস্তানা বদল করেন। তিনি আমাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় থাকা নিরাপদ বোধ করেন না। কারণ এই বাসায় রাজনীতির লোকদের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছিল। বাসার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চলছে বলে আমারও মনে হচ্ছিল। অফিসে আসা-যাওয়ার পথে অপরিচিত মুখ ধারেকাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। যদিও অজয় রায় নিয়মিত ওই বাসায় থাকতেন না, তবু আমার মনে হয়, আবার নতুন ঠিকানায় যাওয়াটাই হবে ভালো। মনের মধ্যে সারাক্ষণ অস্বস্তি নিয়ে বসবাস করা কঠিন। তাই আবার বাসা খোঁজার কাজ শুরু করে আমার ভাই বিজন। তখনো ঢাকা শহরে বাড়িভাড়া পাওয়া খুব কঠিন ছিল না। এবার বাসা পাওয়া যায় ওয়ারী এলাকায়, র‌্যাংকিন স্ট্রিটে।

ওয়ারী ছিল একসময় ঢাকার অভিজাত এলাকা। আমরা র‌্যাংকিন স্ট্রিটের দুই বেডরুম ও ড্রয়িং-ডাইনিং মিলিয়ে দোতলার একটি ছিমছাম বাসায় উঠি। এবার পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের পরিবারের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা হয় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এবং জয়ধ্বনি সাপ্তাহিকের সাবেক সম্পাদক অজয় দাশগুপ্তের। বরিশালের গৈলার বিখ্যাত একটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য অজয় দাশগুপ্ত আমাদের সঙ্গে বছরখানেক ছিলেন। তিনি এখন একজন বিখ্যাত সাংবাদিক।

গত শতকের সত্তর দশকের শেষ দিকে ঢাকা শহর যানজট এবং দূষণমুক্ত ছিল। রাস্তাঘাটে চলাচল খুব অনিরাপদ ছিল না। তখন পর্যন্ত মেয়েরা খুব বেশি সংখ্যায় চাকরিতে যোগ না দিলেও আমরা যারা অফিসে যেতাম, আমরা কখনো সেভাবে মেয়ে বলে খারাপ অবস্থার মুখে পড়িনি। তখন তো আমার বয়সও কম ছিল। দেখতে-শুনতেও মোটামুটি সুন্দরীই ছিলাম। কিন্তু রাস্তায় কেউ আমাকে দেখে টিটকারি বা কটূক্তি করেছে বলে মনে পড়ে না। আমরা পুরুষ সহকর্মীদের কাছে সব সময় সৌজন্যমূলক আচরণই পেয়েছি। কেউ কখনো খারাপ মন্তব্য করেছে বলে কানে আসেনি।

একদিন অফিসের কাজে মিরপুর গিয়েছিলাম। তখন আমাদের কাছাকাছি হলে রিকশায়, আর দূরের পথ হলে বেশির ভাগ বাসে যাতায়াত করতে হতো। স্কুটারেও কখনো কখনো অফিসের কাজে যাইনি তা নয়। মিরপুরের কাজ শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে যায়। ফেরার জন্য কোনো যানবাহনই পাচ্ছিলাম না। রোদের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেও ভালো লাগছিল না। হঠাৎ লক্ষ করি এক ভদ্রলোক মোটরসাইকেল স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আমি অসংকোচে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম তার গন্তব্য কোথায়। ভদ্রলোক বললেন, তিনি মতিঝিল যাবেন। অগ্রণী ব্যাংকে চাকরি করেন। আমি মতিঝিলে যাওয়ার জন্য কোনো বাহন পাচ্ছি না বলে আমাকে তাঁর সঙ্গী করা যায় কি না জিজ্ঞেস করতেই তিনি সানন্দে রাজি হলেন। আমি তাঁর পেছনে বসে পড়লাম। মতিঝিল পৌঁছে তিনি আমাকে বললেন, দিদি আপনাকে স্যালুট জানাই। আমি আপনার পরিচিত নাহওয়া সত্ত্বেও আমার মোটরসাইকেলের পেছনে আসার প্রস্তাব দেওয়ায় আমি মুগ্ধ। আমাদের দেশের মেয়েরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে বলেই নানা সমস্যায় পড়ে। মেয়েদের সবারই আপনার মতো সাহসী হওয়া উচিত।

আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম এবং তাঁর সৌজন্যবোধের প্রশংসা করলাম। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছিল। তাঁর নাম খলিলুর রহমান। অগ্রণী ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ছিলেন। প্রসঙ্গত, আরেক দিনের আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমি এবং হাসনা বানু মহিলা পরিষদের কাজে কোথাও যাচ্ছিলাম। হাসনা আপা ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসে চাকরি করতেন আর মহিলা পরিষদের কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আমরা যে-বাসে যাচ্ছিলাম সেটাও ছিল মহিলা বাস, অর্থাৎ যাত্রীদের সবাই মহিলা। ফার্মগেটের কাছাকাছি গিয়ে বাসের স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। তখন বাসের চালক এবং কন্ডাক্টর বলতে থাকেন, যাত্রী তো সব মহিলা, এখন স্টার্ট নেওয়ার জন্য বাস ঠেলবে কে?

হাসনা আপা সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আমাকেও উঠতে বললেন। আমরা নিচে নেমে বাস ঠেলতে লাগলে কন্ডাক্টর থতমত খেয়ে যান। কয়েকজন পথচারী এসেও বাসটি ঠেলতে সহযোগিতা করেন। বাসচালক এবং কন্ডাক্টর পরে আমাদের সাহসের প্রশংসা করেছিলেন।

আমরা যারা মহিলা পরিষদের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, আমরা আত্মবিশ্বাস এবং সাহস নিয়ে চলার শিক্ষা পেয়েছি। পুরুষ এবং নারীকে আলাদা চোখে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখার চেষ্টাই আমরা সবসময় করেছি। নারী হিসেবে বাইরে যেতে বা অফিস কলিগদের সঙ্গে কথা বলতে, মেলামেশা করতে আমি অন্তত সংকোচে বিহ্বল হয়ে পড়িনি কখনো। মহিলা পরিষদের সভানেত্রী কবি সুফিয়া কামালের জীবন থেকেই আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি। একা মানুষ, দুর্বল মানুষ। সংগঠিত মানুষ, শক্তিমান মানুষ। আসলে কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে একদিকে যেমন নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয় না, অন্যদিকে মনে শক্তিও আসে। আমরা একা নই, আমাদের আরো সঙ্গী আছে – এটা খুবই সাহস জাগানিয়া বিষয়।

চাকরি করার কারণে আমি পার্টির কাজে খুব সক্রিয় না হলেও অজয় রায়ের কারণে আমাকে কিছু না কিছু রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতেই হতো। বিশেষ করে তিনি আত্মগোপনে থাকলে। কিছু মজার ঘটনারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। একবার অজয় রায় আত্মগোপনে ছিলেন শাজাহান মৃধা বেণুর বাসায়। বেণুভাই তখন বিয়ে করেননি। তাঁর মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে আমাকে দেখা করাতে নিয়ে যেতেন তাঁদের বাড়িতে। বেণুভাইয়ের মা আমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার যে বিয়ে হয়েছে তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাছাড়া পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শাঁখা ভাঙার পর আমি আর শাঁখাও পরিনি। কপালেও সিঁদুর সেভাবে দিতাম না। ছোট্ট একটি লাল টিপ পরতাম। ফলে অপরিচিত কেউ আমার ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বুঝতে পারতেন না। প্রথমদিন কিছু না বললেও দ্বিতীয়দিন বেণুভাইয়ের মা তাঁকে বলেন, এই মাইয়ার লগে তোর কতদিনের খাতির। মাইয়াডারে আমারও পছন্দ হইছে। তুই বিয়ার দিন-তারিখ ঠিক কর।

বেণুভাই তাঁর সরল-সহজ মায়ের ভুল ভেঙে দিয়ে বলেন, তুমি কাকে নিয়ে কী বলছ? উনি তো দুই সন্তানের জননী। আর আমাদের ঘরে যিনি অতিথি হয়ে আছেন, তিনি হলেন এই সুন্দরী দিদির স্বামী।

বেণুভাইয়ের মা মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, হায় আল্লাহ, আমি কী ভুলই না বুঝছি।

সাতাশ

সে-সময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আমার অফিসের কাছাকাছি ছিল ভারতীয় দূতাবাস-পরিচালিত একটি খুব ভালো পাঠাগার। পাঠাগারটিতে নানা ধরনের বই এবং পত্রপত্রিকা পড়ার সুযোগ ছিল। আমিও মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে পত্রপত্রিকা পড়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দুর্গাদাস ভট্টাচার্যের স্ত্রী ওই পাঠাগারে চাকরি করতেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় কখনো কখনো গল্পগুজবেও অংশ নিয়েছি। তখন ভারতীয় দূতাবাস ছিল ধানমণ্ডির দুই নম্বর রোডে। দূতাবাসের বিপরীত দিকেই ছিল ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে নিয়মিত ভালো ভালো সিনেমা দেখানো হতো। আমি পাঠাগারে আসা-যাওয়া করায় সিনেমা দেখার টিকিট পেতাম। অনেককেই আমি তখন টিকিট বিলিয়েছি।

বাণিজ্যিক এলাকা হলেও তখন মতিঝিলে এতো মানুষের আনাগোনা ছিল না। এখন যেমন চলাচল করতে গেলে মানুষের গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে, তখন এমন ছিল না। আমাকে আমার কাজের জন্য প্রায়ই মতিঝিলে যেতে হতো। মতিঝিল গেলে আমি পূর্বাণী হোটেলে ঢুঁ মারতে ভুল করতাম না। পূর্বাণীতে আমি স্টাফদের গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স করিয়েছিলাম। পূর্বাণীর প্রধান হিসাব কর্মকর্তা নুরুল ইসলামভাই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে আমাদের পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ। তিনি ন্যাপ করতেন। আমি সরাসরি তাঁর রুমে চলে যেতাম। তিনি আপ্যায়নের ত্রুটি রাখতেন না। আমারও ছিল পূর্বাণীর চিকেন প্যাটিস এবং কফির প্রতি দারুণ লোভ। পয়সা দিয়ে পূর্বাণীর চিকেন প্যাটিস ও কফি খাওয়ার অবস্থা আমার ছিল না। তাই ঘুরেফিরে নুরুল ইসলামভাইয়ের রুমে গিয়ে তাঁকে আপ্যায়ন করার সুযোগ করে দিতাম।

পূর্বাণীতে আমার পরিচিত আরো একজন ছিলেন। তিনি জরিনা খালা। জরিনা খালা শ্রমিক ইউনিয়নের নেত্রী ছিলেন। তাই পূর্বাণী হোটেলে তাঁরও বেশ প্রভাব ছিল। তিনিও সুযোগ পেলে আমাকে আপ্যায়িত করতেন। আর আমি যে পূর্বাণীর চিকেন প্যাটিস ও কফি পছন্দ করি – সেটাও জরিনা খালার জানা ছিল।

তখন মানুষে মানুষে অন্যরকম সৌহার্দ্য ছিল। কেউ কাউকে খুশি করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইতো না। আর এক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ হলে তো কথাই নেই। পরিচিত কেউ কোনো বিপদে বা সমস্যায় পড়লে তার পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে না কাউকে পাওয়া যেতো। মানুষ মানুষকে বিশ্বাসও করতো।

একদিন আমি আমার কাজে অগ্রণী ব্যাংকে যাবো শুনে আমার সহকর্মী অফিসের ৫০ হাজার টাকা জমা দেওয়ার জন্য দেন। আমি টাকাটা নিয়ে গিয়ে কাউন্টারে জমা দিয়ে ম্যানেজার খলিল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই; কিন্তু ভুলবশত আমার ব্যাগটি কাউন্টারে ফেলে যাই। ফিরে এসে ব্যাগটি আর পাই না। কেউ নিয়ে সটকে পড়েছে। ব্যাগে টাকা-পয়সা ছিল সামান্য। তবে আমার অফিসের জরুরি প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র ছিল এবং চাবিও ছিল। তাছাড়া ব্যাগটিও ছিল আমার খুব পছন্দের। অজয় রায় দেশের বাইরে থেকে ব্যাগটি এনে দিয়েছিলেন।

ব্যাগ খোয়া যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমার মন খারাপ হয়েছিল। খলিল সাহেবসহ ব্যাংকের স্টাফরাও বিষয়টিতে বিব্রত হয়েছিলেন; কিন্তু কী আর করা! চোর তো আর কারো মন খারাপের তোয়াক্কা করে না। ব্যাংক থেকে বের হয়ে সামনের হকারদের আমি আমার ব্যাগ হারানোর কথাটি বললাম। কেউ ব্যাগ নিয়ে কাউকে যেতে দেখেছে কি না, তা-ও জানতে চাইলাম। কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারল না। তবে ওদের ভাবসাব দেখে মনে হলো, ওরা বিষয়টি দেখবে। পরদিন ব্যাংক থেকে আমার অফিসে ফোন করে জানানো হলো, আমার চুরি যাওয়া ব্যাগ পাওয়া না গেলেও একটি টোপলায় কেউ কাগজপত্র ও চাবির গোছা রেখে গেছে। দরকারি জিনিসগুলো ফিরে পাওয়ায় আমি খুশি হয়েছিলাম। ব্যাগ তো কেনা যাবে; কিন্তু কাগজগুলো আমি কোথায় পেতাম?

ওয়ারী এলাকায় গিয়ে আমরা বেশ কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। র‌্যাংকিন স্ট্রিট এবং ওয়ারীতে কাছাকাছি তখন থাকতেন বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য, আওয়ামী লীগ নেতা কোরবান আলী (পরে তিনি অবশ্য এরশাদের দলে যোগ দিয়েছিলেন), সুধাংশু শেখর হালদার, প্রবীণ সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত, বিচারপতি গৌর গোপাল সাহা, বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালিদ এবং আমাদের অতিঘনিষ্ঠ মতিউর রহমান এবং মালেকা বেগম। মতিভাই এবং মালেকা আপার বাসায় তখন পার্টির নেতা অনিল মুখার্জিও থাকতেন। ওয়ারী এলাকায় আমাদের পরিচয় ঘটে ব্যবসায়ী আর এন দত্তের সঙ্গে। তিনি সরাসরি রাজনীতি করতেন না। তবে নানা সমাজকর্মে জড়িত ছিলেন এবং একপর্যায়ে আমাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।

র‌্যাংকিন স্ট্রিটের বাসায় যাওয়ার পর আমার তৃতীয় সন্তান আগমনের বার্তা পাই। সন্তান আগমনের আগে আগে আমি আবার ময়মনসিংহ চলে যাই আমার মায়ের কাছে। আবার সেই ডা. জোবায়েদ হোসেন এবং রওশন আরার তত্ত্বাবধানে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৯৭৭ সালের ৬ জুন আমার তৃতীয় সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে। এবারো কন্যাসন্তান। দুই মাস ময়মনসিংহে থেকে তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আমি ঢাকা চলে আসি।

ততোদিনে দেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান নিজের অবস্থান সংহত করে নিয়েছেন। বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে জিয়া নিজেই প্রেসিডেন্টের গদি দখল করেছেন। আস্তে আস্তে রাজনীতির ওপর থেকেও বাধানিষেধ তুলে নেওয়া হচ্ছে। তবে পুরো গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসে না।

রাজনীতি থেকে আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলেও ঘরের মধ্যে সার্বক্ষণিক রাজনীতির মানুষ থাকায় রাজনীতির ঝড়ঝাপটা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা সম্ভব হয় না। তারপরও আমার প্রধান কাজ হয় সংসার এবং সন্তানদের রক্ষা করে সামনে এগোনো। ওয়ারী এলাকায় আমি একটি নতুন পরিবেশ পাই। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি তাঁদের নিকট সান্নিধ্য পাওয়ায় জীবনের অনেক কিছু খুব সহজভাবে নিতে শিখেছি।

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা -/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ – কবিগুরুর এই বাণী আমার অবলম্বন হয়ে ওঠে।

আটাশ

বলধা গার্ডেনের জন্যও ওয়ারী এলাকার খ্যাতি ছিল। প্রচুর দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদের জন্য বলধা গার্ডেনের ব্যাপক খ্যাতি। গাজীপুর জেলার বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী বাগানবাড়ি হিসেবে বলধা গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০৯ সালে। মূলত নানা রকম ফুল ও উদ্ভিদের মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে ওঠা এই উদ্যান দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরাও দেখতে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলধা গার্ডেন পরিদর্শন করেছেন। তিনি বহু বিদেশি ফুলের বাংলা নামকরণ করেছিলেন।

তখনকার ঢাকার উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এ-স্থান। এখানে নিয়মিত গানবাজনার আসর বসতো। প্রায় সাড়ে তিন একর জমি নিয়ে এই সুন্দর উদ্যানটি এখন বন ও পরিবেশ অধিদফতর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আটশো প্রজাতির ১৮ হাজার উদ্ভিদসমৃদ্ধ এই উদ্যান শিক্ষার্থী এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। আমি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনেকদিন বলধা গার্ডেনে বেড়াতে গিয়েছি।

আমি পরে শুনেছি, বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. নন্দী দেশ ছাড়ার আগে ওয়ারী এলাকাতেই থাকতেন। তাঁর দুই মেয়ে ইন্দিরা এবং মন্দিরা একসময় ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতিপরিচিত নাম ছিল। নাচ, গান, অভিনয়ে পারদর্শী ইন্দিরা এবং মন্দিরা দেখতেও সুন্দরী ছিলেন।

দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী সবিতারঞ্জন পাল, এস আর পাল নামেই যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন, তিনিও ছিলেন ওয়ারী এলাকার বাসিন্দা। এস আর পালের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক পরিচিতি এবং যোগাযোগ ছিল।

তবে বিভিন্ন কারণে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি। একসময় তিনি বাম রাজনীতি করতেন। অজয় রায়ের সঙ্গে তিনি একসঙ্গে জেলও খেটেছেন। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গার জমিদার পরিবারের সন্তান দেবেশ ভট্টাচার্য ম্যাট্রিক পাশের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন কলকাতায়। প্রথমে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও পরে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেছিলেন।

আইন পাশ করে চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে ময়মনসিংহে আইন ব্যবসা শুরু করলেও পরে ঢাকা এসে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যশস্বী হয়ে ওঠেন। দেবেশ ভট্টাচার্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে হাইকোর্টে এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের বয়স কমিয়ে দিলে দেবেশ ভট্টাচার্যকে অবসরে যেতে হয়। তাঁর অবসরজীবনও ছিল কর্মময়। একদিকে তিনি আইনজীবীদের পরামর্শ দিতেন, অন্যদিকে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামাজিক দায়িত্বপালন করতেন।

বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্ষণশীল অংশের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি হিন্দু আইন সংশোধনের জন্য নিরলস কাজ করেছেন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। আইনের খসড়া তৈরিতে তিনি বিচারপতি কে এম সোবহান এবং আইনবিদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সহযোগিতায় বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।

তিনি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ গঠনে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণআদালতেরও বিচারক ছিলেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর অবস্থান ছিল সবসময় স্পষ্ট। তিনি যেমন ছিলেন জ্ঞানী মানুষ, তেমনি সাহসী। সম্পত্তিবিষয়ক আইনে তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বিচারক হিসেবে তাঁর লেখা কিছু রায় সাংবিধানিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে আছে। তার স্ত্রী চিত্রা ভট্টাচার্যও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সদাসক্রিয় ছিলেন। চিত্রা ভট্টাচার্য মহিলা পরিষদ করতেন। ১৯৯৬ সালে তাঁকে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি নির্বাচিত করা হয়েছিল।

আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি তাঁদের স্নেহ পেয়েছি। এই পরিবারের সঙ্গে কেবল ওয়ারী এলাকাতে থাকার সময়ই নয়, এখনো পারিবারিক যোগাযোগ আছে। দেবেশ ভট্টাচার্য এবং চিত্রা ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়েছে। আমিও স্বামীহারা হয়েছি। কিন্তু তাঁদের সন্তান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, দীপেন ভট্টাচার্য এখনো আমার খোঁজখবর নিতে ভুল করে না। মনে দাগ কেটে আছে দেবপ্রিয়র একটি কথা। অজয় রায়ের মৃত্যুর পর আমাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দেবপ্রিয় বলেছিল, ‘আপনি হলেন স্বামীহারা আর আমি দ্বিতীয়বার পিতৃহারা হলাম।’ এমনই গভীর আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্ক।

বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের বাসায় আমাদের নিয়মিত আড্ডার কথাও মনে থাকবে চিরদিন। কী আনন্দের সময়ই না আমরা কাটিয়েছি। মতিভাই, মালেকা আপা, সুধাংশু শেখর হালদার এবং তাঁর স্ত্রী এবং অজয় রায় ও আমি, কখনো কখনো আর এন দত্ত – আমরা গভীর রাত পর্যন্ত গল্পগুজব, খাওয়া-দাওয়া করেছি, সময় কাটিয়েছি। আমরা যে আলাদা আলাদা পরিবারের সদস্য সেটা কখনো মনে হয়নি। সবারই বাসা ছিল হাঁটাপথের দূরত্বে। রাত বারোটা-একটা হলেও আমরা যার যার বাসায় নির্ভয়ে পৌঁছে যেতাম।

আমার এটা ভাবতে ভালো লাগে যে, দেবেশ ভট্টাচার্যকে ভাইফোঁটা দেওয়ার সুযোগও আমার হয়েছে। আমি ওয়ারীতে যাওয়ার আগে প্রতিবছর দেবেশদাকে ভাইফোঁটা দিতেন মালেকা আপা। পরে আমি তাঁর সঙ্গী হই। ভাইফোঁটার দিন সকালে আমি এবং মালেকা আপা দেবেশদার বাসায় হাজির হতাম। দেবেশদা পরিপাটি হয়ে বসতেন। মালেকা আপা আর আমি তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দিতাম। আমাদের দুজনকে তিনি শাড়ি উপহার দিতেন। কখনো কখনো আমি তাঁর জন্য লুচি-তরকারি বানিয়ে নিতাম। তিনি বেশ মজা করে খেতেন।

মাঝে মাঝেই আমার বাসায় সন্ধ্যার দিকে অনিল মুখার্জি আসতেন। আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব ছিল। তারা অনিল মামাকে পেলে দারুণ উৎফুল্ল হয়ে উঠতো। অনিলদা ওদের নিয়ে গল্পে মেতে উঠতেন। বাচ্চাদের তিনি মজার গল্প বলতেন। তাঁর সঙ্গ বাচ্চাদের খুব প্রিয় ছিল। আগেই বলেছি, অনিলদা মতিভাই-মালেকা আপার বাসায় থাকতেন। তিনি বিয়ে করেননি। বয়স হয়েছিল। তাই একটি পরিবারের সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা সম্ভবত পার্টি থেকেই করা হয়েছিল। লারমিনি স্ট্রিটে মালেকা আপাদের বাড়িটিও ছিল প্রগতিশীলদের আড্ডা। তাঁর আত্মীয়স্বজনের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। একটি আলোকিত পরিবার তাঁদের।

অনিলদা খেতে পছন্দ করতেন। পরিমাণে কম খেতেন; কিন্তু খাবারের স্বাদ বেশ বুঝতেন। আমার রান্নার তারিফ করতেন। তাই বাসায় কোনোদিন ভালো কিছু আয়োজন হলে অজয় রায়কে বলতাম অনিলদাকে খবর দিতে। কাছাকাছি থাকতেন বলে ডাকলেই চলে আসতেন। আমার ছেলেমেয়ের টান তো ছিলই। আমরা তখন আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল ছিলাম না, তবে আত্মিকভাবে সমৃদ্ধ ছিলাম।

কত ভালো মানুষের সঙ্গে আমাদের জানাশোনা ছিল! কমিউনিস্ট নেতা মন্মথ দে-র কথা আগেই বলেছি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসার পর মন্মথদাকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছিল তাঁর ওপর। তাঁর একসময় কিডনির সমস্যা দেখা দেয়। ঢাকায় এসে পিজি হাসপাতালে তাঁকে কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হতো। দশ-বারো দিন হাসপাতালে থাকতে হতো। তিনি মাঝেমাঝে পোস্টকার্ডে আমাকে চিঠি লিখতেন। স্বাধীনতার পরপর জ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় আমার বাসায় রেখে তাঁকে সেবা-শুশ্রƒষা করার বিষয়টি হয়তো তাঁর স্মৃতিতে ছিল। তিনি হয়তো চাইতেন পিজিতে গিয়েও তাঁর একটু দেখাশোনা করি; কিন্তু তখন চাকরি এবং সংসার নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকতে হতো যে, হাসপাতালে গিয়ে রোগীর সেবাযত্ন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। এখন বিষয়টি মনে হলে কষ্ট পাই। মন্মথদাদের মতো মানুষ দেশের জন্য কেবল দিয়েই গেলেন। তাঁদের কথা এখন আর কেউ মনেও করে না।

ওয়ারীতে গিয়েই পরিচয় হয়েছিল খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন না। ব্যাংকার। কিন্তু প্রগতিমনা একজন সৎমানুষ তিনি। বিভিন্ন ব্যাংকে উঁচু পদে চাকরি করলেও অতি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। অজয় রায়ের মাধ্যমেই পরিচয়। তিনি আমাদের বাসায় আসতেন। আমরাও যেতাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্বও অত্যন্ত সততার সঙ্গে তিনি পালন করেছেন। অর্থনীতিবিদ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি আছে। তিনি যেমন অজয় রায়ের সঙ্গ পছন্দ করতেন, অজয় রায়ের পছন্দের তালিকায়ও তিনি ছিলেন। অবসরজীবনেও তিনি দেশের মঙ্গলচিন্তা করতেন। লেখালেখি করতেন। দেশের অন্যতম শিশু-কিশোর সংগঠন ‘কচিকাঁচার মেলা’র প্রধান হিসেবে দীর্ঘকাল সক্রিয় থেকেছেন।