দরজার সামনে ছায়া দেখে প্রাণ কেঁপে উঠল রেজাউরের।

আবার সেই উৎপাত!

আবার সেই মেয়েটি এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে।

এমনিতে রেজাউরের নিজের শারীরিক অস্তিত্ব নিয়ে বর্তমানে টানাটানি। এ-বাড়িতে সে আশ্রিত।

বা ঠিক আশ্রিত না হলেও সেই পর্যায়ে পড়ে।

তার ফুপাজানের ফ্ল্যাটের একটা ছোট্ট কামরায় বইপত্র টেনে এনেছে হোস্টেল থেকে। ভার্সিটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হল থেকে ছাত্রছাত্রীদের রাতারাতি উৎখাত করা হয়েছে। না করে কর্তৃপক্ষের কোনো উপায় ছিল না, কারণ দাবানলের মতো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল হল থেকে হলে। আর এই শহরে রেজাউরের এমন কেউ ছিল না যার কাছে নিজের বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে উপস্থিত হতে পারে।

বাধ্য হয়ে সে তার ফুপাজান মোখলেসুর রহমানের ফ্ল্যাটবাসায় এসে উঠেছে। ফ্ল্যাটটা বনানীতে। বেশ বড় ফ্ল্যাট। রেজাউর তার ফুপুমার মুখে শুনেছে, এটা নাকি তেত্রিশশো স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট। ফুপু অবশ্য রেজাউরের আপন নয়। তার আপন ফুপু গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে হঠাৎ মারা গেলে ফুপা আবার বিয়ে করেছেন।

ফুপুর ছেলেমেয়েরা সব অনেক আগেই বড় হয়ে গিয়েছিল। তারা এখন ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে। ফুপুর আকস্মিক মৃত্যু হলে তারা অনেকেই ঠিক সময়ে দেশে আসতে পারেনি।

ফুপুর মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় ফুপা আবার বিয়ে করেছেন। যতটা না শরীরের চাহিদায় তার চেয়ে বেশি একা থাকার ভয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেমেয়েদেরও এতে সায় ছিল। বুড়ো বাপকে দেশে একা ফেলে রাখার দায় এবং দায়িত্ব থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পেয়েছিল তারা।

রেজাউরের এই ফুপুর বয়স বেশি। তার আগের পক্ষের স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কী কারণে রেজাউর সেটা জানে না। নতুন ফুপুমার সব ভালো, শুধু বড় বেশি গম্ভীর। আর যখন কারো দিকে তাকিয়ে থাকেন তো তাকিয়েই থাকেন। এ-কারণেই কোনো স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয় কি না, রেজাউর জানে না বা বলতে পারে না।

রেজাউরের নিজস্ব সমস্যা অনেক। সে আর কাকে কী বলবে। গরিবঘরের ছেলে, টিউশনি করে অনেক কষ্টে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ চালায়। এখন হঠাৎ করে বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হল খালি করে দেওয়ার জন্যে সে বিপাকে পড়ে এই ফুপাজানের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। নইলে আপন ফুপু মারা গেলে ফুপাজান আর কে!

অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে রেজাউরের বড় কুণ্ঠা। নইলে যেসব বাড়িতে সে টিউশনি করে তাদের বাড়িতে অন্তত কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিতে পারত। বিপদকালে তারা হয়তো সাহায্য করতে পারত কিছুদিন। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে ফুপাজানকে মোবাইল করে তার অনুমতি নিয়ে বর্তমানে এ-বাসায়।

ফুপা একেবারে মাটির মানুষ। রেজাউরকে স্নেহ করেন। কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ দেখান না, হয়তো নতুন ফুপুর ভয়ে, অবশ্য রেজাউর সেটা জানে না।

কিন্তু রেজাউরের কপাল খারাপ। এখানে এসে দেখে এ-বাড়িতে মেহমান। বিদেশি মেহমান। ঠিক বিদেশি নয়, এককালে এরা সব এদেশেরই নাগরিক ছিল; কিন্তু বহু বছর ধরে বিদেশে বাস করতে করতে বিদেশিদের মতোই হয়ে গেছে। এরা নিজেদের ভেতরে ইংরেজিতে কথা বলে। খাওয়ার সময় কাঁটা চামচে ভাত খায়। কাঁচা মরিচ, বা শুকনো মরিচ বা গোল মরিচ তাদের কাছে হারাম।

যারা এসেছে তারা সব আমেরিকার বাসিন্দা। ওয়াশিংটনে থাকে। মহিলা এই নতুন ফুপুমার খালাতো বোন। খালাতো বোন তার দুটি সন্তান নিয়ে বেড়াতে এসেছেন দেশে। মেয়েটি এবার ও-লেভেল দেবে। আর ছেলেটি ক্লাস সিক্সের সমান্তরাল লেখাপড়া করে। ছেলেটির চোখে এই বয়সেই মোটা ফ্রেমের চশমা। কারো মুখের দিকে তাকানোর সময় সে ঘাড় কাত করে তাকায়।

প্রথমদিন খাবার টেবিলে রেজাউরকে দেখে ছেলেটি হঠাৎ ঘাড় কাত করে বলে উঠেছিল, হু আর ইউ?

প্রশ্ন শুনে উত্তর দেবে কী, রেজাউর লজ্জায় মরে যায়।

এমনিতে সে লাজুক প্রকৃতির ছেলে। ফুপাজান সেদিন খাবার টেবিলে ছিলেন না। তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ফুপুমাও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, কথা বলেন কম। তখন ফুপুমার বোনই তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, হি ইজ ওয়ান অফ ইয়োর ফুপা’স রিলেটিভ।

ইয়া? বাট আই হ্যাভন্ট সিন হিম বিফোর, বলে ছেলেটি টপ টপ করে দুটো ঝাল ছাড়া কাবাব কাঁটা চামচ দিয়ে নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে খেতে লাগল।

আর তাই দেখে ফিক করে হেসে উঠেছিল মেয়েটি। ছেলেটির বোন। তার নাম রাশনা। রাশনাও সকলের সঙ্গে খেতে বসেছিল টেবিলে। তার চেহারার দিকে তাকাতে তখন সাহস হয়নি রেজাউরের। কিন্তু অনুভবে বুঝতে পারছিল চেহারা যত না সুন্দর, তার চেয়ে সুন্দর হচ্ছে চেহারায় বুদ্ধিমত্তার ছাপ, বক্তব্যে বলিষ্ঠতা, অসংকোচ কথাবার্তা ও হাসি। বিদেশে বড় হলে কি মানুষ এরকম হয়? মনে মনে বিস্মিত হয়ে তখন ভেবেছিল রেজাউর। এবং খাবারের টেবিল থেকে পালানোর জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিল।

ফুপুর বোন সেই মহিলা, যার নাম বিলকিস হোসেন, তিনি কারুণ্যের সঙ্গে রেজাউরের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলেছিলেন, তুমি কী পড়ো?

রেজাউর বিনীতভাবে তার উত্তর দিয়েছিল। বলেছিল, সে বিএ অনার্স ফাইনাল ইয়ার।

সেকথা শুনে বিলকিস হোসেন বলে উঠেছিলেন, এরকম গণ্ডগোল তোমাদের ভার্সিটিতে প্রায়ই লেগে থাকে, তাই না?

উত্তরে রেজাউর ইতস্তত করে বলেছিল, না, ঠিক তা নয়।

তা নয় তো কি? বিলকিস হোসেন বলেছিলেন, হয় তোমরা ক্লাস বয়কট করো, অথবা বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়, এই তো দেখি অল রাউন্ড দ্য ইয়ার চলছে। তুমি মনে করো আমরা বিদেশে থাকি বলে কোনো খবর রাখিনে? খুব রাখি!

উত্তরে রেজাউর কিছু বলতে পারেনি। অপ্রতিভ হেসে চুপ করে গিয়েছিল।

যখন বিলকিস হোসেন তাকে এইসব কথা বলছিলেন তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি, যার নাম রাশনা, হঠাৎ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিল,  হোয়াই আর ইউ অ্যাকিউজিং হিম মাম? ইট ইজ নট হিজ ফল্ট।

হু নোজ? উত্তরে বলেছিলেন বিলকিস হোসেন।

তো সেইদিন থেকে শুরু। করুণাবশত হোক বা সহমর্মিতা দেখানোর জন্যে হোক, রাশনা সেদিন থেকে রেজাউরের পেছনে।

রেজাউর ফ্ল্যাটের সার্ভেন্ট কোয়ার্টার হিসেবে তৈরি করা ঘরটার ভেতরে আশ্রয় পেয়েছে, যেহেতু সার্ভেন্টরা আর ইদানীং ফ্ল্যাটে থাকে না, তারা শুধু দুটো কাজ করে বিদায় নেয়।

এই ঘরে থাকতে পেরেই রেজাউর মনে মনে মহাখুশি।

এরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, মোজায়েক শোভিত, দেয়াল আলমারি ও লাগোয়া বাথরুমসহ ক’টা ঘরে রেজাউর জীবনে থেকেছে? কোনোদিন নয়। তাদের মফস্বলে ক’টা বাসা এরকম সাজানো-গোছানো, এরকম পরিষ্কার টয়লেট? অন্তত রেজাউর ঢাকায় আসার আগে এরকম দেখে আসেনি। তার ওপর এই নির্জন, ছিমছাম পরিবেশ।

রেজাউর যখন বিছানায় বসে টেবিল ল্যাম্প জ¦ালিয়ে বই পড়ছে, কেউ তাকে বিরক্ত করার নেই। কোনো রুমমেট না, কোনো বড়ভাই ছোটভাই না, ঋণ শোধ  দেওয়ার জন্য কোনো তাগাদা না, কোনো পলিটিক্স না, রেষারেষি-বাগবিতণ্ডা না। ডাইনিং হলে খাবার নিয়ে কোনো হইচই না। একবারে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত জীবন।

রেজাউরের গোপন ইচ্ছে যতদিন সম্ভব ফুপাজানের এই বাসাটিতে কোনো প্রকারের সমস্যা সৃষ্টি না করে কিছুদিন, অন্তত ভার্সিটি না খোলা পর্যন্ত, কাটিয়ে যাওয়া।

বস্তুত এই বাসাটায় আশ্রয় পাওয়ার পর থেকে লেখাপড়ায় তার মনোযোগও বেড়ে গেছে।

কিন্তু রেজাউরের যে নিজস্ব একজন বিধাতা আছেন, তাঁর ইচ্ছে নয় রেজাউর এত শান্তিতে থাকুক। আর তারই কারণে হয়তো রাশনা রেজাউরের পিছে পিছে।

এতসব ভাবনার ভেতরেই রেজাউর তাকিয়ে দেখল রাশনা এখন দাঁড়িয়ে আছে তারই ঘরের চৌকাঠ ধরে। রাশনার পরনে খাটো ট্রউজার, যা হাঁটুর নিচে এসে নাই হয়ে গেছে। গায়ে হাত কাটা গেঞ্জি শার্ট। পায়ে দু-ফিতের চপ্পল। মাথার চুল শ্যাম্পু করা। রেজাউর গোপনে লক্ষ করে দেখেছে, রাশনার চুল সবসময় শ্যাম্পু করা। ঠোঁটে কোনো রং মাখে না রাশনা। স্বাভাবিক নিয়মেই যেন রাশনার ঠোঁট দুটো কালো জামের ভেতরটার মতো লাল হয়ে থাকে।

মে আই কাম ইন, রেজা?

রাশনা দরজার সামনে একটা বিশেষ ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে বলল।

সারাদিনের ভেতরে রেজাউরের কাছে এই সময়টা সবচেয়ে বিপজ্জনক।

এই সময় ফুপুমার ঝিমুনি আসে। এসময় ছেলেমেয়েকে ফ্ল্যাটে রেখে ফুপুমার বোন বিলকিস হোসেন গাড়ি নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাসায় যান বা শপিং করতে যান। দেশে এসে দামি কাপড় কিনে দর্জি দিয়ে একগাদা সালোয়ার-কামিজ করতে দিয়েছেন বিলকিস হোসেন। তিনি বা তার মতো মহিলারা আজকাল আর শাড়ি পরেন না। কারণ শাড়ি তাদের বয়স বাড়িয়ে দেয়। আবার ইউরোপ-আমেরিকায় সালোয়ার-কামিজ তৈরি করে বা কিনে পরাটা ভীষণ ব্যয়বহুল। তাই দেশে এসে বিলকিস হোসেনের মতো মহিলারা গাঁটভর্তি কাপড় কিনে মনের মতো করে পোশাক তৈরি করে নিয়ে যান। এতে কিছু খরচ কম হয়।

আজো বিলকিস হোসেন হয়তো এরকম কোনো একটা কাজে বেরিয়েছেন। বাসায় বোনকে রেখে গেছেন ছেলে রবিন আর মেয়ে রাশনার দিকে লক্ষ্য রাখতে, যদিও লক্ষ্য রাখার কিছু নেই, কারণ তারা দুজনেই যথেষ্ট স্বাবলম্বী।

কাজের মেয়ে এই সময় খুব ব্যস্ত থাকে। রবিন ফুপার লেখাপড়ার ঘরে ঢুকে কম্পিউটারে গেমস খেলে।

রেজাউরের ফুপুমা তার বেডরুমে বিছানায় বালিশ পিঠের নিচে দিয়ে ছাব্বিশ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনে সিরিয়ালগুলি দেখেন। এই সময়টা রেজাউরের কাছে বড় বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয়।

অবশ্য এই ভাবনাটা রেজাউরের নিজস্ব। এতে কারো কোনো ভাগ নেই।

কোনো পশ্চিম-পূর্ব নেই।

রাশনা তাকে রেজা ভাই বলে সম্বোধন করে না। অথচ তাকে বলা হয়েছে বা উপদেশ দেওয়া হয়েছে ভাই বলে ডাকতে। কিন্তু সে ডাকে না, যেমন তাকে আপা বলে ডাকে না রবিন। বড় বোনকে সে ডাকে নাম ধরে – রাশনা। বলে, রাশনা, হেই, লিসেন টু মি। আবার কখনো বা বলে, সিস, কুড ইউ প্লিজ হেল্প মি?

রেজাউর পরে আবিষ্কার করেছে, সিস মানে সিসটার, অর্থাৎ বোন। অর্থাৎ বোন আমাকে সাহায্য করতে পারো?

রেজাউরের কাছে এসব অদ্ভুত সব ব্যাপার-স্যাপার। বড় বোনকে আপা বলে ডাকে না। অথচ রেজাউরের মনে আছে একবার সে তার বড় বোন পারভীনকে নাম ধরে ডেকেছিল বলে মা খুন্তি দিয়ে তার ঠ্যাং ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছিলেন। কেন যে রাশনা তাকে রেজা ভাই বলে ডাকে না, সে জানে না। এতটুকু একটা কিশোরী মেয়ে এখনো ও-লেভেল দিয়ে সারতে পারেনি, এইবারই অবশ্য দেবে, তার এরকম একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব কীভাবে গড়ে উঠল যে, মুরুব্বিদের উপদেশ মানে না, সেটা রেজাউরের ধারণার বাইরে।

মে আই কাম ইন রেজা?

আবারো বলে উঠল রাশনা।

রেজাউর জানে, যতক্ষণ না সে মুখে বা ইশারায় রাশনাকে তার ঘরে আসতে বলবে, সে আসবে না।

– এসো, বাংলায় বলল রেজাউর।

পারতপক্ষে সে এদের কারো সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে না। রেজাউর জানে, তার ইংরেজি উচ্চারণ ভালো নয়।

অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকে দেয়ালের দিকে লাগানো এক চিলতে খাটের ওপর ধার ঘেঁষে বসল রাশনা। কারণ রেজাউর ঘরের সবেধন নীলমণি একটা মাত্র চেয়ার দখল করে বসে ছিল তখন।

বিছানায় বসে রাশনা আজ ঘরের চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, তোমার ঘরের দেওয়ালের রং ভালো না!

– ভালো না? কৌতুক করে বলল রেজাউর।

– না।

– কী রং হলে তুমি পছন্দ করতে? রেজাউর হেসে জিজ্ঞেস করল।

রাশনা তার কৌতুক বুঝতে না পেরে ঠোঁট সরু করে চারদিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ইট শুড বি হোয়াইট, অল হোয়াইট। অ্যান্ড ইউ নো হোয়াই?

রেজাউর জানত না হোয়াই, অর্থাৎ কেন তার ঘরের রং সাদা হতে হবে। অন্য কোনো রং কেন হবে না? সত্যি বলতে, সে তো কোনোদিন ঘরের রঙের দিকে খেয়ালই করে দেখেনি!

বর্তমানে যার থাকার অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি, সে ঘরের রঙের খেয়াল রাখবে কেন? যতসব ফজুল কথা!

রেজাউর তাই মাথা নেড়ে না জানালো।

রাশনা বলল, কারণ তোমার ঘর ছোট। একেবারে ছোট। সাদা ছাড়া যে কোনো রং এ-ঘরে দিলে ঘর ছোট লাগবে আরো। তাই সাদা রং। বুঝেছো?

উত্তরে বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল রেজাউর।

যেন বুঝেও তার কোনো লাভ আছে! এই ঘরে বা বাসায় সে একজন অনাহূতভাবে আশ্রিত। যে-কোনো সময়ে পোঁটলা গুছিয়ে তাকে হয়তো এখান থেকে চলে যেতে হবে।

রাশনা তার মনেন ভাব না বুঝে বলল, আমরা যখন আগামী মাসে চলে যাব, তখন তুমি গেস্টরুমে মুভ করবে, কেমন?

কথা শেষ করে মাথা কাত করে রেজাউরের মুখের দিকে তাকাল রাশনা।

তার চাহনি দেখে যেন বুকের ভেতরে কেঁপে উঠল রেজাউরের। হু-হু করে উঠল বুক। ভাবল, এই অবোধ মেয়েকে কে বোঝাবে যে, এই বাসাটায় সে আশ্রিত হয়ে আছে।

যে মুহূর্তে ভার্সিটি খুলবে তাকে ত্যাগ করতে হবে এই আশ্রয়।

রেজা তার কথা শুনে আলগা মাথা নাড়তে রাশনা বলল, তুমি কখনো তোমার মা-বাবার কথা আমাদের বলো না কেন?

উত্তরে রেজাউর হেসে বলল, কী বলব?

রেজাউরের হাসিটা মøান দেখাল।

কেন, কিছু বলার নেই? রাশনা যেন ভাবিত হয়ে বলল।

– আমার বাবা-মা গরিব রাশনা। তোমাদের মতো বড়লোক নই। আমরা একগাদা ভাইবোন। আমার বাবা সারা বছরই প্রায় অসুস্থ থাকেন।

– বড়লোক হলেই বুঝি শুধু

বাবা-মার কথা বলতে হয়?

রাশনা যেন অবাক হয়ে রেজাউরের মুখের দিকে তাকাল।

একথা শুনে লজ্জা পেল রেজাউর। এভাবে কথাটা বলা হয়তো ঠিক হলো না।

হোক তার বাবা-মা গরিব। হোক তার বাবা অসুস্থ। তাই বলে রেজাউর কি তাদের কম ভালোবাসে?

আর তারা ছাড়া রেজাউর কে?

ননসেন্স। মনে মনে বলল রেজাউর।

গালটা তার নিজের উদ্দেশে। কিন্তু মুখে জেদ ধরে রাখল সে।

রাশনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তা বইকি রাশনা। অর্থনৈতিক ব্যপারটা আমাদের দেশে ভীষণ জরুরি একটা বিষয়।

অর্থনৈতিক মানে কী? তার দিকে চোখের দৃষ্টি ফেলে বলে উঠল রাশনা।

ঠিকমতো শব্দটা উচ্চারণ করতেও পারল না সে।

এ এক ভালো জ¦ালা হয়েছে রেজাউরের ইদানীং। সব কথার ইংরেজি প্রতিশব্দ বলতে হয়। এ-শব্দটা না হয় সোজা, কিন্তু সব শব্দের প্রতিশব্দ তো রেজাউর নিজেও জানে না। তাছাড়া বাংলা অনেক শব্দের যে প্রতিশব্দ সেভাবে হয় না, সে-কথা মেয়েটিকে কে বোঝাবে?

পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার নিজস্ব একটা অহংকার আছে না? সব কি ছুঁতে পারা যায়? অভিমানের কি প্রতিশব্দ সেভাবে হয়?

অনেকক্ষণ আবোল-তাবোল বকে রাশনা আজ ঘর ছাড়ল। সে ঘর ছেড়ে গেলে ঘরের মধ্যে মৃদু একটি সুগন্ধ যেন আবিষ্ট করে রাখল রেজাউরকে। গন্ধটা যেন ঘুরতে লাগল বাতাসে। ঘরময় ঘুরে ঘুরে গন্ধটা যেন নৃত্য করতে লাগল। রেজাউরের কল্পনা যেন পাখা মেলে দিলো চারদিকে। 

একসময় গন্ধটা মিলিয়ে গেল। বাতাসে স্থির একটা বিষাদ যেন ছবির মতো ঝুলে থাকল রেজাউরের চোখের সামনে। রেজাউর তখন কী করে?

কোথায় যায়?

সে অস্থির হয়ে ঘর বন্ধ করে বেরিয়ে গেল বাইরে।

ভাবল, এখন তাকে হাঁটতে হবে। মাইল মাইল পথ হাঁটতে হবে।

সে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ দিয়ে হাঁটতে লাগল আর ভাবতে লাগল। সমস্ত রাস্তা জুড়ে এত যে গাড়ি, হর্ন এবং চলন্ত মানুষেরা তাকে কেউ এখন যেন বিরক্ত করতে পারল না। অন্য সময় যা হয়ে থাকে। এখন সে নিজের ভেতরে নিজেই যেন নিমগ্ন হয়ে গেল। এই নিমগ্নতার যেন কোনো সীমা নেই।

সীমাহীন শূন্যতার ভেতরে যেন এই নিমগ্নতার পরিসমাপ্তি।

দুই

ক’দিন বাদে রাতে খাবার টেবিলে বসে রেজাউর টের পেল ঘরের আবহাওয়া বেশ টানটান। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে হয়তো কিছু একটা নিয়ে বচসা হয়েছিল। এরকম প্রায় হয়, রেজাউর দেখেছে। এরা কখনো সহজে একটা বিষয়ে যেন একমত হতে পারে না। এমনকি সামান্য আবহাওয়া নিয়েও নয়।

সেদিন সারাদিন বাইরে ছিল সে। বিকেলে টিউশনি সেরে, ডাস-এ বসে দলছুট কিছু বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ফুপাজানের বাসায় ফিরেছে। রেজাউরের অধিকাংশ বন্ধু বর্তমানে ঢাকার বাইরে। দু-চারজন শুধু ঢাকায়।

গোপীবাগে তার বন্ধুর বাড়ি। বাসে করে বনানীতে ফিরে আসতে তার সময় লেগেছে।

রেজাউর ভেবেছিল, ফুপার বাসায় ফিরে এসে দেখবে সকলের খাওয়া-দাওয়া সারা হয়ে গিয়েছে। সে-ই বুঝি শুধু বাকি আছে। একলা খেতেই রেজাউরের ইচ্ছে। বাসার অচেনা বা অনাত্মীয় মানুষদের সঙ্গে বসে খেতে তার অস্বস্তি লাগে।

কিন্তু রেজাউরের মনোবাসনা পূর্ণ হলো না।

বাসায় ফিরে দেখল সকলে বসে আছে খাবার টেবিলে। অর্থাৎ ডিনার করা চলছে। ফুপু খাবার টেবিলের মাথায় বসেছিলেন। রেজাউর লক্ষ করেছে ফুপা  সাধারণত বাসায় না থাকলে ফুপু খাবার টেবিলের মাথায় বসেন। আজ ফুপা বাসায় ছিলেন না। সুতরাং ফুপু টেবিলের মাথায় বসে ছিলেন।

রেজাউরকে বাসায় ফিরতে দেখে ফুপু এমন একটা ভঙ্গি করলেন হাতের যার অর্থ, রেজাউর তাদের সঙ্গে খেতে বসতে পারে।

রেজাউর আর কী করে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে টেবিলে এসে বসল।

বসেই দেখল রাশনা ঠিক তার উল্টোদিকে বসে আছে। রাশনার ডান পাশে রবিন।

রেজাউরের দিকে ভাতের ডিশ সরিয়ে দিয়ে বিলকিস হোসেন বলে উঠলেন, তুমি কি রোজ এরকম রাত করে বাড়ি ফেরো?

উত্তরে রেজাউর মাথা চুলকে বলল, না, ঠিক রোজ নয়, তবে আজ আমার টিউশনি ছিল। সপ্তাহে তিনদিন আমার টিউশনি থাকে। টিউশনি করে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ফিরলাম।

কথাটা বলার সময় রেজাউরের ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করে, এত রাত করে তারা খেতে বসেছে কেন? সাধারণত রাত আটটা, সাড়ে আটটার ভেতরেই এ-বাসার খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়।

তারপর রাত সাড়ে ন’টা, দশটা বা এগারোটা পর্যন্ত গল্প হয়; টিভির সিরিয়ালগুলি দেখা চলে, নানারকমের মন্তব্য প্রদান করা হয় নায়ক-নায়িকাদের অভিনয় নিয়ে। এরপর ঘুমোতে যায় সকলে।

এ-বাসায় অতিথি হওয়ার পর থেকেই এরকম দেখছে রেজাউর।

রাশনা অবশ্য সিরিয়াল দেখে না। এসব বেঙ্গলি সিরিয়াল তার কাছে বোরিং। সিরিয়ালের বিষয়গুলি নাকি ‘উলি’ আর ‘ভোলাটাইল’, রাশনার এই মত। সে তাই খাওয়ার পরে সাধারণত তার ঘরে চলে যায়। তারপর ইয়ারফোন লাগিয়ে আইপডে গান শোনে অথবা মোবাইলে এসএমএস করে স্টেটসের বন্ধুদের তার বর্তমান ভাবনার অংশীদার করে। রাশনার এসএমএসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘লুকিং ফরোয়ার্ড টু গোয়িং ব্যাক হোম।’ অথবা ‘আই অ্যাম বোরড টু ডেথ। প্লিজ, প্রে ফর মি।’

বাংলাদেশে জন্ম হলেও রাশনার কাছে হোম হচ্ছে ওয়াশিংটন। সেখানেই তার যাবতীয় বন্ধুবান্ধব ও নিরিবিলি ছিমছাম পরিবেশ। যেন এখানে আসার আগে সে তার উঠতি বয়সের আবেগটুকুও জমা রেখে এসেছে সেখানে। বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করলে তার বয়সী মেয়েদের জন্য এটাই স্বাভাবিক।

রেজাউর ভাতে হাত দিয়ে মাংসের বাটি টেনে দেখল পাত্রে মাংস নেই। শুধু ঝোল পড়ে আছে। নীরবে কিছু ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে সে খেতে শুরু করল। আর সেটা লক্ষ করে ফুপু কাজের মেয়েকে ডেকে আরো মাংস আনতে বললেন।

কাজের মেয়ে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত উল্টে বলল, মাংস আর নাইক্যা। খালুজানের মাংস তুইল্যা রাখছি, ওইখান থেইক্যা আনুম?

না, না, না বলে সজোরে মাথা নাড়ল রেজাউর। আমার এতেই হয়ে যাবে, বলল সে।

কথা শেষ হতে মহাউৎসাহে সে ভাজি আর ডালের পাত্র টেনে নিল কাছে।

ফুপু বললেন, আমরা ভেবেছিলাম তুমি বুঝি বাইরে থেকে খেয়ে আসবে।

উত্তরে রেজাউর চুপ করে থাকল।

ভাবল, বাইরে থেকে কীভাবে সে খেয়ে আসবে? বাইরে তার খাওয়ার জায়গা কোথায়? অবশ্য রেস্টুরেন্ট আছে, কিন্তু মাসের শেষে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না।

হাউ মেনি স্টুডেন্টস ডু ইউ কোচ?

রবিন তার চশমা পরা বড় বড় চোখ তুলে এবার জিজ্ঞেস করল।

সে টেবিলের উল্টোদিকে বসে রেজাউরের ভাত খাওয়া দেখছিল।

মাত্র দুজন। উত্তরে বলল রেজাউর।

বিলকিস হোসেন এ-কথা শুনে হঠাৎ বলে উঠলেন, কত পাও মাসে ছাত্র পড়িয়ে?

প্রশ্ন শুনে গাল লাল হয়ে উঠল রেজাউরের। খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

রাশনা রেজাউরের অবস্থা দেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। বলল,  হোয়াই ডু ইউ আস্ক প্রাইভেট কোয়েশ্চেন টু পিপ্ল, মাম?

মেয়ের কথায় একটু যেন অপ্রতিভ হয়ে বিলকিস হোসেন বলে উঠলেন, এতে মাইন্ড করার কী আছে, রাশনা? আমরা ওর নিজের লোক। আমাদের কাছে বলতে ওর অসুবিধে কী?

– বাট উই আর নট হিজ নিজের লোক, মাম!

রাশনা গোঁ ধরে বলল।

– একথা কেন বলছ, রাশনা? এবার রাশনার খালা টেবিলের ও-প্রান্ত থেকে বলে উঠলেন।

বস্তুত তার এই বোনের মেয়েটির চালচলন, কথাবার্তা তার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। যত দেখছেন, ততই মনে মনে বিরক্ত হচ্ছেন। শুধু বোনের মেয়ে বলেই রাশনার এরকম ব্যবহার সহ্য করছেন। তাছাড়া কারণে-অকারণে রেজাউরের ঘরে ঢোকাও তিনি ঠিক পছন্দ করতে পারছেন না।

বিলকিস হোসেন এখনো ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। তবে সপ্তাহ দুয়েকের ভেতরেই ওরা আবার ফিরে যাবে আমেরিকায়। উটকো কোনো কিছু বলে বোনকে অস্থির করতে চান না তিনি।

উত্তরে রাশনা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যখন স্কুলের বন্ধের সময় ম্যাকডোনান্ডে কাজ করতাম, তখন যদি তোমার বন্ধুরা কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করত, আমি সপ্তাহে কত ডলার উপার্জন করি, সে-কথা শুনে আমার খুব রাগ ধরত, মাম্। এরকম প্রশ্ন শুধু বেঙ্গলিরা করে, আর কেউ না। আমি যা-ই উপার্জন করি না কেন, অন্য মানুষকে কেন বলব? আমার একটা প্রাইভেসি আছে না, মাম?

রাশনার কথা শুনে এবার বিরক্ত হলেন বিলকিস হোসেন। বললেন, কী কথায় কী কথা! আমি কি তাকে অপমান করার জন্যে প্রশ্নটা করেছি?

উত্তরে রাশনা বলল, না তো?

– না, না, রাশনা, তুমি আন্টিকে ভুল বুঝেছ। মধ্যস্থতা করার জন্য বলে উঠল রেজাউর।

ততক্ষণে তার খাওয়ার বারোটা বেজে গেছে।

বিলকিস হোসেন হঠাৎ মেয়ের ওপর রেগে গেলেন। বললেন, দেখ রাশনা, তোমাকে বাঙালিদের চালচলন বুঝতে হবে। এজন্য তোমাকে দেশে আনা। বাঙালিরা এত সেনসিটিভ মানুষ নয় যে আমি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করি সে ছাত্র পড়িয়ে মাসে কত উপার্জন করে, তাতে সে মাইন্ড করবে। বরং যা সে উপার্জন করে, একটু কম করেই বলবে। এজন্য যে, যাতে অন্য মানুষেরা তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। অপরের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য আমাদের দেশের মানুষ নিজেদের একটু খাটো করতে দ্বিধা করে না, রাশনা। – আমি কী বলছি, তুমি বুঝতে পারছ?

কিছুটা ইংরেজিতে কিছুটা বাংলায় বিলকিস হোসেন কথাটা বললেন।

মায়ের কথা শুনে যেন হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল রাশনা। যেন মা কী বলছেন সে বুঝতে পারছে না।

একটু পরে যেন ধাতস্থ হয়ে রাশনা ইংরেজিতে বলে উঠল, তাহলে আমরা যে OP Visa পেয়ে এদেশ থেকে আমেরিকায় গিয়েছি, এ-কথা তুমি ওয়াশিংটনের বাঙালিদের কাছে লুকাও কেন,  মাম?

– কী বললে? বিলকিস হোসেন এবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

রাগে তার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে, বুঝতে পারল রেজাউর। আর বুঝে তারও গলা শুকিয়ে এলো। হায়, হায়, এরপর কী হবে? রেজাউর এবার টেবিল ছেড়ে পালাবে কী করে?

কিন্তু রাশনা তার দিকে ভ্রুক্ষেপও যেন করল না। সে বলে চলল, বললাম, আমরাও যে OP Visa-য় আমেরিকা গিয়েছি, একথা তুমি আর আব্বু ওখানকার বাঙালিদের কাছে লুকাও কেন? কেন সবাইকে বলো যে আব্বু আমেরিকা থেকে চাকরির অফার পেয়ে এই দেশ থেকে চলে গেছে? তা তো আমরা যাইনি, মাম? যতসব ইল্লিটারেট মানুষজন OP Visa-য় এখান থেকে আমেরিকায় গেছে, তাই আব্বু বলে এসব কথা কাউকে না বলতে। কিন্তু এটা তো সত্যি কথা না, মাম। টোটাল লাই।

ঘরের ভেতরে যেন বোমা ফেলল রাশনা।

রেজাউর হঠাৎ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে দৌড় মারল তার নিজের ঘরে। একটু আগে ভাত খেতে বসে যেন লজ্জায়, অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার।

নিজের ঘরে এসে একভাবে ঘামতে লাগল রেজাউর। খুব জোরে ফ্যান চালিয়ে দিলো।

এ মেয়ে তো দেখি সাংঘাতিক, মনে মনে ভাবল। এবং কেন জানি বিলকিস হোসেনের জন্যই মন খারাপ লাগতে লাগল তার।

এ যে দেখি অ্যাটম বোম্ব! রাশনার কথাও ভাবল সে। তার ভয় হতে লাগল এবার মনে। রেজাউরের না এখন কোনো বিপদ হয়।

হয়তো কালই তার ফুপু বলবেন, ‘এখানে তো অসুবিধে হচ্ছে রেজাউর, দেখ যদি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে নিতে পার।’

তখন তো ছাড়তে হবে এই আস্তানা। তখন কি দেশে চলে যাবে রেজাউর? তাই যাবে সে। এভাবে বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে হয় না। মায়ের স্নেহের জন্যে মন টানছে তার এখন।

রেজাউর বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আপন মনে ভাবতে থাকে।

ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে।

তিন

দিন পনেরো বাদে রেজাউর বসেছিল তার ঘরে। সময়টা সন্ধে। একটু পরে উঠে বাইরে যাবে। বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটবে। তার পরনে এখন জিনসের ট্রাউজার। গায়ে হাতকাটা কালো গেঞ্জি। পায়ে নীল কেডস্। আজকাল শুক্র-শনি অফিস বন্ধ থাকে বলে এই দুদিন কামাল আতাতুর্কের রাস্তায় ভিড় কম থাকে। এ সময়টা হাঁটতে তার ভালোই লাগে।

কিছুদিন ধরে রেজাউর তার মনের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা টের পাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ জটিল। কাউকে বোঝানো মুশকিল। বন্ধুদের তো বলাই যাবে না। সুতরাং রেজাউর তার দেশে ফিরে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছিল। সেখানে তার বাবা-মা ও ভাইবোনেরা আছে। অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসার ভাণ্ডার হাতে নিয়ে ওরা রেজাউরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে। ওদের সঙ্গে কিছুদিন সময় কাটিয়ে আসতে পারলে হয়তো রেজাউরের ভালো লাগত। কারণ ভার্সিটি আবার খুলে যাওয়ার কোনো নিশানা সে বর্তমানে দেখতে পাচ্ছে না।

কিন্তু রেজাউরের একটা মন দেশে ফিরতে চাইলেও আরেকটা মন বলে উঠছিল, না। কেন, না?

রেজাউরের তো এখন ভার্সিটি বন্ধ। শুধু সপ্তাহের তিনটে দিন সে দুজন ছাত্রছাত্রীকে অংক শেখায়।

অংকে বরাবর মাথা ভালো রেজাউরের। অংকেই সে অনার্স নিয়ে পড়ছে।

রেজাউরের ঘরটা একেবারে রান্নাঘরের লাগোয়া বলে এ-ঘরে গরম বেশি। তাছাড়া সচরাচর এদিকে বড় কেউ একটা আসে না। আর আসার দরকারও নেই। রেজাউর তাই প্রায় সময় তার ঘরের দরজা খোলা রাখে। নইলে ঘরে ফ্যান চললেও ঘরটা গুমোট লাগে।

রেজাউরের বিক্ষিপ্ত সব ভাবনার ভেতরেই খোলা দরজার গায়ে টোকা পড়ল।

মনে মনে যেন এরকমের একটি শব্দের অপেক্ষা করছিল রেজাউর।

কিন্তু অপেক্ষাটা ছিল এত গোপন যে রেজাউর নিজেও তা টের পায়নি!

চোখ তুলে তাকাল রেজাউর। দেখল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাশনা।

আজ সে পরেছে বেগুনি সালোয়ার-কামিজ। গাঢ় বেগুনি রঙের সালোয়ার-কামিজে রাশনার উজ্জ্বল শ্যামল চেহারাটা যেন একেবারে সতেজ একটা বোগেনভিলার মতো লকলক করছে বাতাসে।

দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল রেজাউর। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! আবার তাকিয়ে দেখল সে রাশনাকে। মাথার চুল পেছনে ঝুঁটি করে বাঁধা। গলায় পুঁতির হার। হাতে একটা কাঠের বালা। পায়ে সাদা ভোমা কেডস।

দামি সালোয়ার-কামিজের নিচে কেডস। দেখে নিজের অজান্তেই যেন রেজাউরের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।

রেজাউরকে হাসতে দেখে হাসল রাশনাও। হেসে বলল, দুবাইতে তিন-চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। হাঁটতে হবে অনেক।

সত্যি এত বুদ্ধিমতী রাশনা, ভাবল রেজাউর। মানুষের চোখ দেখে মেয়েটা বুঝে যায় অনেক কিছু। হঠাৎ যেন মনটা কেমন করে উঠল রেজাউরের। খারাপ লাগল ভেতরটা। এ কীসের মন খারাপ  সে জানে না।

তৃতীয় বিশে^র একজন যুবকের প্রতিদিন একশ এক কারণে মন খারাপ হয়। দিনের ভেতরে কতবার করে যে মন খারাপ হয়!

এরকম মন খারাপের কারণ জানার জন্য কোনোদিন চেষ্টাও করেনি রেজাউর।

রাশনা রেজাউরের চেহারা যেন মন দিয়ে দেখতে দেখতে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল, ঘরে এলো না।

রেজাউর হঠাৎ কোমল স্বরে বলে উঠল, ঘরে এসো, রাশনা।

উত্তরে রাশনা বলল, না।

কেন? অবাক হয়ে বলে উঠল রেজাউর। দেখা করতে এসে আবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কেন?

মনে মনে ভাবল সে।

রেজাউরের প্রশ্নের উত্তরে একটু যেন ভাবল রাশনা। তারপর বলল, আজ তো আমরা চলে যাচ্ছি।

– আমি তা জানি রাশনা।

উৎফুল্ল হয়ে বলার চেষ্টা করল রেজাউর। কিন্তু বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল। এ কীসের বিষণ্নতা এখন রেজাউরকে আচ্ছন্ন করছে? রেজাউর ভাবল।

– তাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। বলল রাশনা।

– বেশ । খুশি হলাম। খুব খুশি হলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে গলায় আনন্দিত স্বর ফুটিয়ে বলল রেজাউর।

– আমরা এতদিন তোমাকে খুব অ্যানয় করেছি।

রাশনা একটু থেমে থেমে বলে উঠল এবার।

– না, না, রাশনা, আমি মোটেই বিরক্ত বোধ করিনি। অপ্রতিভ হয়ে বলে উঠল রেজাউর।

– আমার মা তোমাকে অনেক ব্যাড ল্যাঙ্গুয়েজে বকা দিয়েছে।

শুনে যেন ব্যাকুল হয়ে উঠল রেজাউর। তাড়াহুড়ো করে বলল, ছিঃ, ছিঃ, রাশনা এসব তুমি কী বলছ? উনি আমার মুরুব্বি। মুরুব্বিরা কিছু বললে আমরা কিছু মনে করি না।

– হোয়াট ইজ মুরুব্বি? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল রাশনা।

– মুরুব্বির ইংরেজি হলো, গার্ডিয়ান।

বলল রেজাউর। হঠাৎ করে মাথায় তার যে ইংরেজি শব্দ এলো সেটাই বলল। হয়তো ‘সিনিয়র’ বললেও চলতো। কিন্তু শব্দটা সে মুহূর্তে তার মাথায় এলো না।

– বাট শি ইজ নট ইয়োর গার্ডিয়ান! বিস্মিত হয়ে বলে উঠল রাশনা।

রেজাউর তাড়াহুড়ো করে বলল, ওঃ রাশনা, সেরকম গার্ডিয়ান নয়। এখানে এর অর্থ হলো সিনিয়র। আমরা সবসময় সিনিয়রদের সম্মান করি।

– ও … ও! উত্তরে বলল রাশনা।

শব্দটা উচ্চারণ করে হঠাৎ রাশনা ঘরে ঢুকে বলল, আমি যাওয়ার সময় তোমার কাছ থেকে একটা জিনিস চাই, দেবে?

– কী জিনিস, রাশনা? কথাটা বলার সময় বুকে কেঁপে উঠল রেজাউরের।

এ-দস্যি মেয়ে এখন রেজাউরের কাছে কী চেয়ে বসে কে জানে!

– যাওয়ার আগে আমি তোমাকে একটা কিস করতে চাই, দেবে?

রাশনার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল রেজাউর।

কিন্তু সে কিছু বলার আগেই রাশনা এগিয়ে এলো তার কাছে। আরো কাছে। আরো। সুডৌল দু-বাহু দিয়ে সে জড়িয়ে ধরল রেজাউরের গলা। তার শরীরের সুগন্ধি যেন জড়িয়ে গেল রেজাউরের শরীরে। লিপস্টিকহীন জাম রঙের মতো লাল ঠোঁট দুটো তুলে ধরল সে রেজাউরের দিকে। সমস্ত মুখ তার প্রসাধনহীন। শুধু হালকা একটা পাউডার পাফ বুলানো মুখে। তবু কত যে সুন্দর! কত যে অপূর্ব! কত যে সুষমামণ্ডিত প্রাক-যুবতী একটি শরীর।

আর সেই শরীরের ভেতরে কত যে মানবিক একটি মন।

রেজাউরের হাত ওপরে উঠে এলো। কম্পিত শরীরে সে জড়িয়ে ধরল রাশনাকে। তার গালে গাল ঠেকিয়ে সৌরভ নিল শরীরের। তারপর মুখ নিচু করে চুম্বন করল সে রাশনাকে। প্রথমে ছোট ছোট চুম্বন। পরে দীর্ঘ এবং নিবিড়।

তার বুকে নিঃশব্দে যেন লেপ্টে থাকল রাশনা। হঠাৎ করে ফুঁপিয়ে উঠল সে।

রেজাউর ফিসফিস করে বলল, কাঁদো কেন, মেয়ে?

– আমি খুব লোনলি রেজা, আমি খুব লোনলি। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল রাশনা।

– আমিও খুব লোনলি রাশনা, আমিও খুব লোনলি রাশ। বলতে গিয়ে গলা ভেঙে গেল রেজাউরের।

রেজাউরের মুখে রাশ উচ্চারিত হতে শুনে তার বুক থেকে মুখ তুলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা গলায় রাশনা বলল, তুমি লোনলি কেন? তুমি কাউকে ভালোবাসো না?

– না। উত্তরে বলল রেজাউর।

– সত্যি বলছো? রাশনা তার চোখের ভেতরে দৃষ্টি নিবব্ধ করে বলল।

– সত্যি, সত্যি। বলে উঠল রেজাউর।

– তুমি কি তাহলে আমাকে ভালোবাসবে?

অবোধ একটি মেয়ের মতো রাশনা উৎসুক হয়ে রেজাউরের মুখের দিকে তাকাল।

এ-প্রশ্নের কী উত্তর দেবে রেজাউর? কী উত্তর সে দিতে পারে? কী উত্তর দেওয়ার সাধ্য রেজাউরের আছে?

সে কি রাশনার মতো ছেলেমানুষ?

এখন তো তার নিজের অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি।

কিছু আর বলল না রেজাউর। সজোরে রাশনাকে তার বুকে চেপে ধরল।