রূপে তোমায় ভোলাবো না

সৈয়দ আনওয়ারুল হাফিজ

 

ডাক্তার শহীদ তাঁর চশমার ওপর দিয়ে একবার চেয়ে বললো, ‘চাচা আপনাকে আজ আসতে বলেছিলাম। কিন্তু আপনার বায়োপসি রিপোর্টটা তো এখনো পাইনি। আচ্ছা দাঁড়ান, আমি টেলিফোন করে দেখছি ওটা কোথায় আটকে আছে।’

টেলিফোন করতে করতে টেবিলের উলটো দিকে সুফীর দিকে চেয়ে আবার বললো, ‘এরা যে কেন ওদের কথা রাখতে পারে না বুঝি না।… পেয়েছেন? নামটা দেখেছেন, হ্যাঁ, নাম সুফী হাসান। ফাইনাল ডায়াগনোসিসটা পড়ে শোনান।’

টেলিফোনের ওপার থেকে অল্প অল্প কথা কিছু শোনা যাচ্ছিল। সুফী শুনতে চেষ্টা করলো কিন্তু কিছু বুঝতে পারলো না।

‘বলেন কী!’ বললো ডাক্তার সাহেব শেষে। ওঁর মুখটা মনে হলো একটু অন্ধকার হয়ে এলো। একটু আগে তাঁর চাচার সঙ্গে যখন কথা বলছিলো হাসিমুখে, সে হাসি মিলিয়ে গেল। একটুক্ষণ চুপ করে থাকলো। টেলিফোনটা আস্তে নামিয়ে রাখলো।

তারপর বললো, ‘চাচা, খবরটা তো ভালো না। বায়োপসিতে দেখা গেছে মেলানোমা। আপনার গালের অাঁচিল থেকে যেটা কেটে নিয়েছিলো আর গলার গ্ল্যান্ড থেকে যেটা নিয়েছিলো দুটোতেই দেখাচ্ছে ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা।’

চাচা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘মেলানোমা তো শুনেছি খুব খারাপ ধরনের ক্যান্সার। এটা হলে তার ব্যবস্থাটা কী হবে?’

ডাক্তার বললো, ‘এসব নিয়ে এখনই চিন্তা করবেন না। আমি ফাইনাল রিপোর্টটা এখনো চোখে দেখিনি। এ তো শুধু টেলিফোনের আলাপ। আর আপনি তো বলছেন আপনার বিশেষ শারীরিক কোনো কষ্ট নেই, তাই না… অবশ্য মেলানোমা কখনো কখনো অনেকদিন ধরে এক জায়গাতেই থাকে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আপনার গলার গ্ল্যান্ডে এটা ছড়িয়ে গেছে।’

‘কিন্তু ফাইনাল রিপোর্টটা হাতে না আসা পর্যন্ত ঠিক করে কিছু বলা উচিত নয়। আপনাকে শুধু শুধু চিন্তায় ফেলে দিলাম। অবশ্য আপনাকে ভালো করে চিনি বলেই এ-কথা বললাম। আমি জানি আপনি লুকোচুরি পছন্দ করেন না।’

চাচা সোজা কথায় চলে এলো এবার। স্থিরদৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললো, ‘কতোদিন আয়ু আছে আর বলো তো।’

‘যদি এই টেলিফোনে বলা রিপোর্টটা সত্যিও হয়, তবু আপনার কথার জবাব কেউ ঠিকমতো দিতে পারবেন না। আল্লাহ ছাড়া। আমি যদি বলি ছয় মাস তখন আপনি দুবছর পরে সুস্থ শরীরে এসে আমাকে বলবেন, কী হে ডাক্তার, তুমি ভালো আছো তো? আর যদি বলি আপনি পাঁচ বছর অন্তত বাঁচবেন, তখন ছয় মাস পরে আপনি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আমাকে বলবেন, তোমরা কিছুই জানো না। তাই এখনই আপনাকে কিছু আর বলবো না। আরো দেখি আগে। পরীক্ষা আরো কিছু করতে হবে। তবে আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না, আপনি বিশেষ রকম অসুস্থ। আমি এই টেস্টগুলো লিখে দিচ্ছি। আজকেই করে ফেলুন। তারপর তিন-চারদিন পর রিপোর্ট নিয়ে আসুন, তখন আলাপ হবে। ততোদিনে বায়োপসি রিপোর্টও এসে যাবে।’

চিন্তিত মনে সুফী ফিরে এলো বাড়িতে। আসলে তার চিন্তা বেশি হচ্ছিল কয়েকদিন আগে একটা ই-মেইল পেয়েছিলো কাঠমান্ডু থেকে মিত্রার কাছ থেকে। মিত্রা শুধু লিখেছিলো, ‘Tomake dekhte chai, shiggir kore aaste parbe kina janio’।

জবাব দেওয়া হয়নি এই কদিন। কারণ বায়োপসি রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আজ ডাক্তার বলে দিলো সে-রিপোর্ট।

বাড়ি এসে দেখলো, আর একটা চিঠি অপেক্ষা করছে। নেপালি এমবাসি থেকে এসেছে। মি. ছেত্রী পাঠিয়েছেন। সঙ্গে আর একটা খামে মিত্রার চিঠি। ছেত্রী সাহেব লিখেছেন, ‘মিত্রা চিঠি পাঠিয়েছে আমাদের ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগে। এ রকম সে আগে কোনোদিন করেনি। জানাবেন চিঠিটা পেলেন কিনা। আর যদি কোনো কিছুর দরকার হয় বলবেন।’ নেপালি এমবাসির মি. ছেত্রী মিত্রার বিশেষ বন্ধু। সেই সূত্রেই সুফীর সঙ্গে আলাপ।

মিত্রা লিখেছে ছোট্ট একটা চিঠি, ‘তোমাকে কতোদিন দেখিনি। এসো যতো তাড়াতাড়ি পারো। প্রায় সারাজীবন তুমি আমাকে ঘিরে রেখেছো কিন্তু এবার তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে চাই, তুমি সত্যি কিনা।  ই-মেইলে আমি বেশি কিছু লিখতে চাইনি। এ-চিঠিতেও এর বেশি কিছু লেখা সম্ভব নয়। তুমি এসো, তারপর কথা হবে। আসলে কথাটা বেশি না। তবে বলতে অনেকক্ষণ লাগবে। এটুকু বলতে পারি, খুব ব্যথা শরীরের চাইতে মনজুড়ে। যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম। তুমি না এলে আমার এ-ব্যথা ভালো হবে না। আসবে তো? তবে একটা কথা বলতে পারি – আমার চিবুকের তিলের জন্য কাউকে বোখারা আর সমরখন্দ দিতে হবে না।’

সুফী ভাবতে লাগলো এ কী রকম চিঠি? মিত্রার নিশ্চয়ই কোনো খারাপ রকম বিপদ হয়েছে। তা নইলে মিত্রার মতো দৃঢ়চিত্ত মেয়ে            এ-রকম চিঠি লিখবে কেন?

মনে পড়ে গেল মিত্রার সেই মুখ। মিত্রা নিজেকে কখনোই সুন্দরী বলে ভাবতে পারেনি। কিন্তু সুফীর প্রথম থেকেই মনে হয়েছিলো ওর মুখটা আলাদা এক রকম সুশ্রী। আর এখন সেই ছবিটা আবার ভেসে এলো। মিত্রা গ্লাসভর্তি ‘লিমবু পানি’ ঢেলে ফেলে দিচ্ছে লনের সুন্দর ঘাসের ওপর। মুখটা থমথমে। অথচ পাঁচ মিনিট আগেও যখন ছবিটা সে তুলেছিলো তার রোলিফ্লেক্স ক্যামেরায় নোবেল লরিয়েট পল ডিরাকের সঙ্গে, তখন মিত্রা এতো খুশি হয়েছিলো যে গালভরা হাসিতে ওর চোখ দুটো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিলো। সুফী ওকে ক্ষ্যাপাতো এই নিয়ে। বেশি খুশি হয়ে মিত্রা যখন হাসে তখন সে দুনিয়ার কিছু দেখতে পায় না। ওর নিজের বাঁকা চোখ নিয়ে মিত্রার মনে একটা দুঃখ ছিলো বরাবর।

নিজের সমস্যার কথা সুফী ভুলে গেল আপাতত।

প্রায় সত্তরের কাছাকাছি এখন সুফীর বয়স। মিত্রার সঙ্গে প্রথম দেখা সেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। তারপর কয়েক বছর পরপর ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে এখানে, সেখানে। কিন্তু কোনোদিন এ-রকম চিঠি লেখেনি আগে।

 

দুই

সেই পঁয়তাল্লিশ বছর আগে যখন দেখা হলো ট্রেনে, তখন তো তরুণ বয়স দুজনেরই।

সুফীর মনে পড়ে গেল সেসব কথা। যেন এই তো সেদিনের কথা। এখনো সব খুঁটিনাটি মনে আছে। ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরিয়েছে সবে। কেমিস্ট্রিতে অনার্স করছিলো কিন্তু এক বছর পর ছেড়ে দিলো। কারণ তার তখন লেখালেখির দিকেই ঝোঁক বেশি। বাড়ির কেউ রাজি না স্বাভাবিকভাবেই। ছাত্র ভালো ছিলো। লেগে থাকলে বিদেশ থেকে ডক্টরেট করা প্রায় ধরাবাঁধা। তারপর অনেক রাস্তা খোলা। কিন্তু তার জেদ লেখালেখি করবে – এই লেখালেখি করে কী করে পেট চালাবে? তাই যোগ দিলো জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টে। ভালোই রেজাল্ট হলো। খবরের কাগজে সাব-এডিটর হিসেবে শুরু করলো। সম্পাদক সাহেব প্রথম থেকেই সন্দিহান ছিলেন, এ-ছেলে শখের বশে সাংবাদিক হতে এসেছে। কাজের ধাক্কা আর বাস্তবের ঠেলায় বেশিদিন টিকবে বলে মনে হয় না। ইংরেজিটা ভালোই লিখত কিন্তু বাংলায় ঝোঁক বেশি। দুটো কবিতার বই ইতিমধ্যে বেরিয়েছে। কাজের মধ্যে সিনসিয়ারিটি ছিলো। কাজ শেখার আগ্রহ ছিলো। সম্পাদক সাহেব তাই সুযোগ দিলেন আর নিজের পাখার তলায় রাখলেন। বোধহয় ছেলেটা ভালো। তবে কদিন টেকে দেখা যাক।

১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর। সে-বছর ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের অধিবেশন হচ্ছে বোম্বেতে। সুফীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কংগ্রেস কভার করতে বোম্বে যেতে রাজি আছো কিনা? কারণ কয়েক বছর তো কেমিস্ট্রি পড়েছো এবং একজন উঠতি সাংবাদিকের জন্য ভালো অভিজ্ঞতা হবে। মনে হয় তোমার জন্য কাজটা ঠিক জুতসই হবে।’

একলাই যেতে হবে তাঁকে এবং কংগ্রেসের খবর-টবর জোগাড় করে ঠিকমতো কপি পাঠাতে হবে। ইংরেজি আর বাংলা – দুটো ভাষাতেই। বিজ্ঞান বিভাগের দিকটা যিনি আগে দেখতেন তিনি আশা করছিলেন তাঁকেই পাঠানো হবে। কিন্তু সম্পাদক সাহেব পাঠাতে চান সুফীকে। তিনি একটু মনোক্ষুণ্ণ হলেও মত দিতে হলো।

এডিটর সাহেব আরো বললেন, ‘তুমি তো বোম্বে যাওনি কখনো, তাই না? ও-ধারে কিন্তু অনেক কিছু দেখার আছে। কংগ্রেস চলবে চারদিন। তারপর তুমি আরো তিনদিন ছুটি নাও। ভালো করে            দেখে-শুনে আসো জায়গাটা। আর আমাদের স্টাফ ক্যামেরাটা নিয়ে যেও। ছবিটবি তুলো ইচ্ছেমতো।’

এডিটর সাহেব মনে হয় খুশিই আছেন সুফীর কাজে। হবেন না কেন, সুফী কাজ করে মন দিয়ে। আর বাংলা ও ইংরেজিতে ভালোই দখল আছে।

১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে ঢাকা থেকে রেলের টিকিট কিনে সোজা ভারতের সব জায়গায় ট্রেনে যাওয়া যেতো। সুফী ঠিক করলো ট্রেনেই যাবে পুরোটা পথ। ট্রেনে যাওয়ার অনেক মজা। আর সস্তা তো বটেই। বয়স তখন কাঁচা। ট্রেনে রাত কাটানো কোনো কষ্টই নয়।

হাওড়া স্টেশনে গিয়ে পৌঁছতে একটু দেরিই হয়ে গেল। বোম্বের ট্রেন ছাড়ে ছাড়ে। কুলিকে নিয়ে প্রায় দৌড়ে ট্রেন ধরতে হলো। হাঁপাতে হাঁপাতে কামরায় উঠে দেখলো, বসার জায়গা নেই বললেই চলে। কেউ কেউ আবার মালপত্র বেঞ্চের ওপর রেখে দিয়েছে। নিজের সুটকেসটা কোনো রকমে মেঝেতে রেখে সে দাঁড়িয়েই ছিলো। শেষ দিকে দৌড়াতে হয়েছিলো ট্রেন ধরতে। তাই তখনো একটু হাঁপাচ্ছিল আর অসহায়ের মতো তাকাচ্ছিল এদিক-ওদিক।

‘আপনি কদ্দূর যাবেন?’ মিষ্টি একটা গলার স্বর শুনে সুফী তাকালো পাশের দিকে। একটি অল্পবয়সী মেয়ে জিজ্ঞেস করছে, ‘আপনি কোথায় যাবেন?’

সুফী আশা করেনি এই বিদেশে কেউ তাঁকে এরকম প্রশ্ন করবে। উত্তর কঠিন নয়, কিন্তু প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সে একটু আশ্চর্য হলো। বললো, ‘আমি বোম্বে যাচ্ছি।’

মেয়েটির মুখ অবাঙালির মতো কিন্তু কথা বলছে পরিষ্কার বাংলায়। বাংলাদেশের পাহাড়ি মেয়ে নাকি? এখানে এলো কেমন করে?

‘এ রকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোম্বে যাবেন? এই ট্রেন দুরাত্তিরের পরে পৌঁছুবে বোম্বে। তাহলে বসুন এখানে।’ মেয়েটি তার জন্য একটু সরে বসে জায়গা করে দিলো।

সুফী সন্তর্পণে মেয়েটির পাশে বসলো। চেষ্টা করতে লাগলো যাতে ছোঁয়া না লাগে।

মেয়েটির হলুদ-ফর্সা চেহারা। কিন্তু ওর বাঁকা চোখদুটো অজান্তেই আকর্ষণ করে। মনে হয়, যেন জন্ম থেকেই কাজলমাখা। মাথার কালো চুল টানটান করে পেছনে একটা খোঁপায় বাঁধা। কোনো পার্টিং নেই। ফর্সা মুখের জন্য চুল আরো কালো লাগছে। চিবুকের বাঁ দিকে একটা ছোট তিল। মুখের ত্বক প্রায় স্বচ্ছ। চিবুকের তিলটা যেন আরো জ্বলজ্বল করছে। সবমিলিয়ে ওকে কি সুন্দর বলা যায়?

বাঙালির অনভ্যস্ত চোখে বোধহয় সুন্দর লাগবে না। সুফীর অজান্তে একটা ছোট্ট হাসির রেখা দেখা দিলো তার ঠোঁটে। চিবুকের ওই তিলটার জন্য কি বোখারা আর সমরখন্দ বিলিয়ে দেওয়া যায়? হাসিটা মিলিয়ে যাওয়ার আগে একটা সম্পূর্ণ অবান্তর কথা মনে হলো সুফীর – ভাগ্যিস আমার নাম সুফী, হাফিজ নয়।

‘আপনি একটু আরাম করে বসুন, অতো জড়োসড়ো হয়ে বসেছেন কেন? আমরা সবাই একই পথের যাত্রী।’

‘ও আপনিও বোম্বে যাচ্ছেন নাকি? বেশ ভালোই তাহলে। দুদিন এই ছোট কামরায় আমাদের সময় কাটাতে হবে। পরিচয় হয়ে ভালোই হলো।’

একটু চুপ থেকে মেয়েটি এবার বললো, ‘আপনি কি কলকাতায় থাকেন, না বোম্বেতে?’

‘না, আমি থাকি ঢাকায়, পূর্ব পাকিস্তানে। যাচ্ছি ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের বোম্বে কনফারেন্সে।’

‘আপনি বোম্বে কংগ্রেসে যাচ্ছেন, আমিও তো তাই।’ মেয়েটি সামনের একজন মাঝবয়সী লোকের দিকে দেখিয়ে বললো, ‘আমি আর আমার মাস্টার মশাই ড. অবনী গুপ্ত আমরা দুজনে যাচ্ছি। আমরা ফিজিক্সের। আপনার কোন সাবজেক্ট?’

‘আমি সায়েন্টিস্ট হিসেবে যাচ্ছি না। আসলে আমি একজন জার্নালিস্ট। আমি আমার কাগজের জন্য কংগ্রেসটা কভার করতে যাচ্ছি – জার্নালিস্ট হিসেবে।’

মাঝবয়সী ভদ্রলোক সামনের বেঞ্চে বসে খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলেন। চলন্ত ট্রেনের শব্দের মধ্যে বোধহয় ওঁদের দুজনের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন না। মেয়েটি এবার তাঁর দিকে ফিরে জোরেই বললো, ‘স্যার, ইনিও বোম্বে যাচ্ছেন সায়েন্স কংগ্রেসে। তবে উনি জার্নালিস্ট আর ঢাকার মানুষ। ঢাকার খবরের কাগজের জন্য ইভেন্ট কভার করবেন।’

ভদ্রলোক মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। কামরার আরো অনেকে ওদের দিকে তাকালো। তারা বুঝতে পেরেছে, এরা তিনজন বোধহয় একদলের মানুষ।

মেয়েটির কথা শুনে ভদ্রলোকের মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে গেল, ‘আপনি ঢাকার মানুষ? আমিও তো তাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি।’

সুফী বললো, ‘আমিও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আপনি কবে ওখানে পড়েছেন?’

‘আমি অবশ্য পড়েছি সেই তিরিশের দশকে। ফিজিক্স ছিলো আমার সাবজেক্ট। আমি সাক্ষাৎ সত্যেন বোসের ছাত্র। উনিই আমাকে লেকচারারের পদে নিয়েছিলেন। তারপর দেশ ভাগ হলো। সত্যেন বোস কলকাতা চলে এলেন। তো উনি আমাকেও নিয়ে এলেন।… আপনি সেগুনবাগিচা চেনেন? টিকাটুলী চেনেন?’

‘নিশ্চয়ই। আমি তো কাছেই থাকি – শান্তিনগরে।’

‘শান্তিনগরের কথা আমিও শুনতাম। কিন্তু ওদিকে বেশি যেতাম না। ওদিকটা তখনো গ্রামের মতো ছিলো। এখন শুনেছি অনেক ডেভেলপ করেছে।’

‘তা ঠিকই’ – বললো সুফী।

‘ঢাকায় আবার যাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়, কিন্তু হয়ে ওঠে না। তবে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো। হাজার হোক আমার দেশের মানুষ। আমার নাম অবনী গুপ্ত। আর ও হচ্ছে আমার ছাত্রী সংঘমিত্রা নোরবু। শিগগিরই হয়তো ড. নোরবু হবে?’

‘আমার নাম সুফী হাসান।’

এবার সংঘমিত্রা বললো, ‘বাঃ বেশ মজা! আপনি ঢাকা মানে পাকিস্তানের মানুষ। আমার মাস্টার মশাই এখন ভারতের লোক। আর আমি হচ্ছি নেপালের। আমরা তিনজন তিন দেশের মানুষ। মাস্টার মশাই হিন্দু, আপনি মুসলমান আর আমি বৌদ্ধ। আমাদের দেখা হলো এই ট্রেনের কামরায়। কথা বলছি বাংলায়। আর সবাই যাচ্ছি বোম্বের সায়েন্স কংগ্রেসে। লম্বা সময় কাটাতে হবে এই ছোট্ট জায়গায়। অতএব আর যাই করি মিলেমিশে থাকতে হবে। তার মানে নো পলিটিক্স। নো ঝগড়াঝাঁটি। সবকিছু নিয়ে কথা বলা যাবে কিন্তু পলিটিক্স নয়।’

ট্রেন তখনো খুব জোরে চলতে শুরু করেনি। একটা স্টেশন পার হচ্ছিল। ড. গুপ্ত জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘লিলুয়া। আসলে হাওড়ার পরে দেরি হলো সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেন বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। খেয়াল করোনি?’

তাঁর ছাত্রী বললো, ‘এতোক্ষণে মাত্র লিলুয়া। আমার তো অলরেডি চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেল। ব্যান্ডেলের আগে তো ট্রেন দাঁড়াবে না। ওখানে একটু চা খেতেই হবে।’

‘চিন্তা নেই, আমার কাছে কফি আছে ফ্লাস্কে। নিশ্চয়ই এখনো গরম আছে। আর এই ফ্লাস্কে ধরেও তিন কাপ। আমার কাছে এক্সট্রা কাপও আছে দুটো।’

আবদারের সুরে সংঘমিত্রা বললো, ‘শুধুই কফি খাবো? অবশ্য আমি কয়েকটা মোমো নিয়ে এসেছি সঙ্গে। মোমো খেয়েছেন কখনো? নেপালের প্রিয় খাবার। অবশ্য জানি না আপনাদের কেমন লাগবে।’

সুফী চট করে বললো, ‘আমার সঙ্গে আছে ঢাকার একটা প্রসিদ্ধ খাবার জিনিস। জানি না আপনাদের কেমন লাগবে সেটা। ওটার নাম বাখরখানি।’

‘বলেন কী, বাখরখানি? পুরোনো ঢাকার নাকি?’

মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ড. গুপ্তের, ‘কতোদিন খাইনি বাখরখানি। আমার তো জিভে জল এসে যাচ্ছে।’

ড. গুপ্ত তাঁর বড় সুটকেসটা বেঞ্চের তলা থেকে টেনে বের করলেন। একটা খবরের কাগজ বিছিয়ে বললেন, ‘এটার ওপর সব খাবার জিনিসগুলো রাখা যাক।’

ততোক্ষণে অন্য যাত্রীরাও তাদের মালপত্র গুছিয়ে রাখছে। তাতে জায়গা একটু হয়েছে সকলের জন্য।

সংঘমিত্রা একটু নড়েচড়ে বসলো। সুফীকে বললো, ‘আপনি একটু কাছে সরে এসে আরাম করে বসুন তো। নইলে আমাদের পার্টিটা জমবে না। আফটার অল একটা আন্তর্জাতিক পার্টি আমাদের। আর মেন্যুটাও আন্তর্জাতিক।’

এমনি করে আলাপ শুরু। একটা ট্রেনের ছোট কামরার মধ্যে কয়েক ঘণ্টা আগেও যারা মোটামুটি অচেনা ছিলো তাদের মধ্যে নানা রকম সামাজিক বাধা আর তফাৎ থাকা সত্ত্বেও কোথায় একটা যোগসূত্র খোঁজার জন্য যেন সবাই উদগ্রীব হয়ে থাকে। যাত্রার শেষে বিদায় দেওয়ার পরে হয়তো আর কোনোদিন যোগাযোগ থাকবে না। তবুও এই কয়েক ঘণ্টায় একে অন্যকে নিজেদের জীবনের কিছু কথা, অনেক সময় প্রায় গোপনীয় বিষয়, তাও বলে ফেলে। ট্রেনে যারা লম্বা সফর করে এ-রকম অভিজ্ঞতা বোধহয় অনেকেরই হয়েছে।

মোমো জিনিসটা কী রকম খাদ্য – সংঘমিত্রা বিশদ বর্ণনা করলো। মুরগির মাংসের মোমো, নিজ হাতে রান্না করেছে সে । সুফী বলতে যাচ্ছিল বাখরখানি কীভাবে তৈরি করা হয়।

ড. গুপ্ত ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে লাগলেন, মোগল আমলে বাখর বা বাকের নামে কোন একজন খাদ্যবাগীশ ঢাকায় এটা বানানো শুরু করেন এবং লোকজন এতো পছন্দ করতে লাগলো যে, তার নামেই এর নাম হলো বাখরের খাবার বা বাখরখানি। আর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাদ্য এই বাখরখানি শুধু ঢাকার সাধারণ লোকদের ভেতরেই নয়, ঢাকার নবাবও এটাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এই ট্রাডিশন এখনো চলছে। যদিও পূর্বেকার বনেদি জিনিস ভেজালের পাল্লায় পড়ে বিকৃত অবস্থাতেও এখনো টিকে আছে। ড. গুপ্ত বাখরখানির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে লাগলেন। সুফী প্রশংসা করতে লাগলো মোমোর। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিই মোমো একটা উৎকৃষ্ট খাদ্যবস্ত্ত। সংঘমিত্রা বারবার বলছিলো, ‘কী মজার কফি!’

খাওয়া-দাওয়া শেষে সুফী বললো, ‘আমি যদি জানতাম, বাখরখানি এ রকম সমাদর পাবে তাহলে আরো নিয়ে আসতাম।’

ড. গুপ্ত বললেন, ‘তোমাদের বউদি মজার কফি বানাতে পারে সত্যিই। একেবারে খাঁটি দুধে এই মাইশোরের কফি জ্বাল দিতে হয়। অবশ্য বাজারের গুঁড়ো কফি দিয়ে নয়, স্পেশাল দোকান থেকে কিনে বাড়িতে কফি বিনস গ্রাইন্ডারে গুঁড়ো করে তবে পারকোলেট করতে হয়। একেবারে টাটকা প্রাউন্ড কফি আর বাজারের গুঁড়ো কফির স্বাদ একেবারে আলাদা। তোমাদের বউদি দক্ষিণের মেয়ে জানো না বোধহয়।’

সংঘমিত্রা বললো, ‘আমি তো ভাবিনি, এই মোমো সবাই মিলে খাবো। আমি তো শুধু আমার জন্য এনেছিলাম। তাই সবার ভাগে কম পড়ে গেলো। অবশ্য সবাই মিলে খেতে অন্যরকম আনন্দ।’

ড. গুপ্ত তাঁর বড় সুটকেসটা আবার বেঞ্চের তলায় ঠেলে দিলেন। আরাম করে পা তুলে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আর কোন কোন স্টেশন পার হচ্ছে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। তাঁর উলটোদিকে ওরা দুজন বসে। ওদের বয়স কাছাকাছি। সুফীর তখন পঁচিশ। সংঘমিত্রা বোধহয় কয়েক বছরের ছোট হবে। সে সুফীকে আস্তে আস্তে বলতে লাগলো, সে কেমন করে কলকাতায় এলো। তার বাবা আসলে তিববতের লোক। ধর্মে বৌদ্ধ কিন্তু খুব ধার্মিক ছিলেন না। চল্লিশের দশকে যখন চীনে কুয়োমিনটাং আর কমিউনিস্টদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তার কিছু ঢেউ তিববতেও এসে লাগছে। তিববত তো আসলে চীনেরই অঙ্গরাজ্য। তিববতের তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম তাঁর বাবার খুব পছন্দের নয়। তাঁর মন ছিলো অনেক উদার।

তিববতে তখন মধ্যযুগীয় প্রায় ক্রীতদাসের প্রথায় সামাজিক ব্যবস্থা চালু আছে। সনাতন তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের আওতায় থেকে সাধারণ মানুষেরা ঝিম মেরে রয়েছে বহু বছর ধরে।

সংঘমিত্রার বাবার ব্যুৎপত্তি ছিলো দর্শনশাস্ত্রে। নিজেই শিক্ষিত করেছেন নিজেকে। দালাই লামার তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম তাঁকে আকর্ষণ করে না। বুদ্ধের উদার মানসিকতার অনুগামী তিনি। তাই লাসায় তিনি খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। তাছাড়া লাসায় বা তিববতে তখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। বহির্বিশ্ব তাঁকে টানছে।

এসব নানান অনিশ্চয়তার কারণে তিনি বেশিদিন তিববতে টিকতে পারলেন না। আসল বৌদ্ধ ধর্ম যদি বুঝতে হয় তাহলে বুদ্ধের যেখানে জন্ম সেখানেই যাওয়া উচিত। তার মানে নেপালে। সেদেশে যাওয়ার পথ দুর্গম। হিমালয়টাকে পার হতে হবে। প্রায় প্রাণ হাতে করে আরো কজন লোকের সঙ্গে তিনি পাড়ি দিলেন সে-পথে। তখন তিনি যুবক আর একা। কোনো পিছুটান ছিলো না। তাই এটা সম্ভব হয়েছিলো। প্রথম কয়েক বছর ছিলেন মুসতাংয়ে। নেপালের উত্তরে চীনের ঘেঁষাঘেঁষি একটা ছোট্ট প্রায় স্বাধীন প্রদেশ আছে, যেখানে নেপালিদের চাইতে তিববতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরই নাম মুসতাং। হিমালয়ের উঁচু-উঁচু শিখর আর উপত্যকায় ঘেরা বলে প্রাকৃতিক দৃশ্য অত্যন্ত মনোরম। কিন্তু তাঁর আকর্ষণ অন্যদিকে। এখানে মন টিকলো না বেশিদিন। অনেক ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত রাজধানী কাঠমান্ডুতে এসে আস্তানা গাড়লেন।

 

তিন

কথার ফাঁকে ফাঁকে সুফী তাকাচ্ছিল সংঘমিত্রার দিকে যতোটা সম্ভব অভদ্রতা এড়িয়ে। এই প্রথম সে একটা মেয়ের এতো কাছে বসে এতক্ষণ ধরে কথা শুনছে। এ-রকম অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি। ও ঠিক করতে পারছে না মেয়েটি সুন্দর কি না? ওর চোখ দুটো স্বভাবতই একটু বাঁকা, সমতল ভূমির মেয়েদের মতো নয়। অতো বিস্ফারিতও না। ওপরের চোখের পাতায় ভাঁজটা প্রায় দেখা যায় না। হাসলে চোখের মণিটা প্রায় লুকিয়ে যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে চোখ দুটো এতো সুন্দর কেন? এ রকম জন্ম-কাজল পরানো চোখ সে কি আগে কোনোদিন দেখেছে? নিজের দেশের মেয়েদের চোখ এ-রকম নয় এবং হয়তো সৌন্দর্যের মাপকাঠির বিচারে সংঘমিত্রা বেশি নম্বর পাবে না। নাকটাও চাপা। ওদেশের সকলেই তো এ-রকম। কিন্তু মুখের গড়নটা সবসুদ্ধ বেশ মনকাড়া। আর ও যখন বাখরখানি দিয়ে মোমো খাচ্ছিল তখনই লক্ষ করেছে ওর লম্বা ফর্সা আঙুলগুলো। কিন্তু সব মিলিয়ে সৌন্দর্যের মাপকাঠির বিচারে সুফীর কেন এ রকম পক্ষপাতিত্ব করতে ইচ্ছে করছে? মনে মনে ওকে অনেক নম্বর দিয়ে খুশি লাগলো।

মেয়েটি মনে হয় বেশিই কথা বলে। আর সুফী ঠিক উলটো। বেশ চুপচাপ, বিশেষ করে নতুন লোকের সামনে। মাঝে মাঝে খুঁজেই পায় না কী কথা বলবে। এ-রকম একটা নতুন পরিচিত মেয়ের সামনে তার মুখ একদম বন্ধ।

সংঘমিত্রা বলতে লাগলো, ‘বাবা আমাকে প্রথমে বোর্ডিং স্কুলে পাঠালেন দার্জিলিংয়ে। আমার তখন সাত বছর বয়স। আমার রুমমেট ছিলো কলকাতার এক বাঙালি মেয়ে। ওকে আমি টেবিল টেনিসে হারিয়ে দিতাম বলেই বোধহয় আমার সঙ্গে খুব বনতো না তার। তবে সেই থেকে আমি বাংলা বলতে শিখলাম। পরে একটু বড় হয়ে এলাম শান্তিনিকেতনে। বাবার খুব ভালো ধারণা ছিলো এখানকার পড়াশোনার ধরনে। বাবা বলতেন, রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন বটে তবুও ওখানে যাঁরা পড়ান তাঁরা এখনো কবির মুক্তচিন্তা আর তারই ভেতরে আনন্দ খোঁজার ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন। তখন অবশ্য আমার বেশি ঝোঁক ছিলো ব্যাডমিন্টন খেলায়। পড়াশোনায় অতো মন ছিলো না। আপনি এসব খেলেন, না সবসময় ভালো ছেলেদের মতো পড়ার বইতে নাক ডুবিয়ে থাকেন?’

সংঘমিত্রা একটু হাসলো। ভালো করেই হাসলো। কুঁচকে গেল তার পাতলা ঠোঁট দুটো। একটু ফাঁক হলো। আর দাঁতগুলো এতো সাদা আর সুন্দর! টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে তাকে সুন্দর মানাতো বলে মনে হলো সুফীর। কোনো মেয়ে আগে ওর সঙ্গে এতো সহজ অথচ আন্তরিকভাবে কখনো আলাপ করেনি।

একটু পরে মেয়েটি উঠে গেল টয়লেটে। সুফী লক্ষ করলো ওর সুঠাম শরীর। নিশ্চয় বেশি খেলাধুলা করে বলেই এ-রকম ঋজু আর সহজ সোজাসাপ্টা ভঙ্গি। মেয়েটির মনটাও নিশ্চয়ই খুব সরল হবে। লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছে। তার সঙ্গে সবুজ ওড়না। সব মিলিয়ে সুফীর মনেও একটা সহজ ভাব আসতে লাগলো। একটা অজানা-অচেনা মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে যে সংকোচ প্রথমে আসে, সেটা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।

সংঘমিত্রা বললো, ‘আপনি কিছু বলছেন না, আমিই খালি কথা বলছি নিজের সম্বন্ধে। এবার আপনি বলুন। আপনার জীবনটা কি বেশ বর্ণিল নয়? কতো জায়গায় গেছেন, কতো পড়াশোনা করেছেন, কতো কিছু দেখেছেন এই এতো অল্পদিনের ভেতর আপনি?’

‘আমি শুধু সারাজীবনে ঢাকাতেই কাটিয়েছি। একবার খুব ছোটবেলায় কলকাতায় গিয়েছিলাম। তখন ভারতে যাওয়ার জন্য ভিসা লাগতো না। তাই বিদেশ বলে মনে হয়নি। আর কিছুই মনে নেই সেই শহরের। আমার জীবনে বিশেষ কোনো বৈচিত্র্য নেই। আমি প্রথম কেমিস্ট্রি পড়লাম ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু শেষ না করেই তারপর ছেড়ে দিলাম। পরে জার্নালিজমে এমএ করলাম। ছোটবেলা থেকেই লিখবার অভ্যাস ছিলো বাংলায়। তাই পাশ করেই যোগ দিলাম খবরের কাগজে, জার্নালিস্ট হবো বলে। তা নইলে খাওয়া জুটবে না। বাংলাতেই লিখি বেশি দেশ-বিদেশের খবর। বন্যা, ঝড়, আগুনলাগা, সড়ক দুর্ঘটনা, পুলিশের অত্যাচার – এইসব আর কি। সাক্ষাৎকারের জন্য রাজনৈতিক লোকদের কাছে ধরনা দিই। মাঝে মাঝে ইংরেজিতেও লিখতে হয়। সেই রকম দায়িত্ব নিয়েই যাচ্ছি বোম্বে। দুটো খবরের কাগজের প্রতিনিধি হয়ে আপনাদের কংগ্রেসের অধিবেশনে।’

বলতে বলতে খড়গপুর স্টেশন এসে গেল। ড. গুপ্ত জানালার কাছে বসে ছিলেন। বললেন, ‘প্ল্যাটফরমে মিহিদানা বিক্রি হচ্ছে। যদিও বর্ধমানই হচ্ছে ও জিনিসের জন্য বিখ্যাত। তবুও খড়গপুরের দূরত্ব খুব বেশি নয় ওখান থেকে। গাড়ি থামলে আমি কিনে আনবো সবার জন্য।’

‘না না, আপনি কেন যাবেন কষ্ট করে, আমিই যাবো’ বললো সুফী।

সুফী কিনলো আধা কেজি মিহিদানা। কমলালেবুও বিক্রি হচ্ছিল। আধডজন লেবুও নিলো। দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ফিরে চললো নিজের কামরার দিকে। প্ল্যাটফরমটা কি লম্বা খড়গপুরের!

এসে দেখে কামরার দরজায় তালা দেওয়া। খোলা যাচ্ছে না। আর কামরার ভেতরেও কেউ নেই, একদম খালি। অবাক হয়ে            এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। একজন গার্ডগোছের লোক যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। সুফীকে অসহায়ের মতো দেখে সে দরজার ওপর দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো।

দরজার ওপরে চক দিয়ে লেখা আছে ‘দিস ক্যারেজ ইজ সিক’।

এ রকম অভিজ্ঞতা সুফীর জীবনে প্রথম। ট্রেনের কামরা কী করে অসুস্থ হলো?

বোকার মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এমন সময় দেখলো কয়েক কামরা পর অন্য একটি কামরার জানালা দিয়ে হাত নাড়ছে সংঘমিত্রা, ‘এদিকে, এখানে আসেন।’ সুফী দুহাত ভর্তি খাবার নিয়ে দ্রুত হেঁটে চললো নতুন কামরার দিকে।

সংঘমিত্রা বলতে লাগলো, ‘এ রকম ব্যাপার জীবনে শুনিনি। আপনি চলে যাওয়ার পরই এক রেলওয়ে গার্ড এসে আমাদের বললো, এই কামরা আলাদা করে রাখা হবে। কারণ এটা ‘সিক’। আপনাদের জন্য নতুন একটা কামরা লাগানো হয়েছে সামনে। সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যান সেখানে। তাই করলাম। আপনার মালপত্রও নিয়ে এসেছি। আর এরপর তো রাত হবে, শুতে হবে। তাই আপনার জন্য এখানে চাদর বিছিয়ে দিয়েছি, যাতে আর কেউ এখানে জায়গা দখল করতে না পারে।’

নতুন কামরাটা আগেরটার চাইতে সুন্দর, আর এর জায়গাও বেশি।

‘ভালোই হলো। অনেক ধন্যবাদ’, বললো সুফী।

সংঘমিত্রা বলতে লাগলো, ‘আপনি যখন মিহিদানা কিনতে গেছিলেন তখন আরো দুটো ব্যাপার হয়েছে। এখানে রাত্রের খাবারের অর্ডার দেওয়া যায়। আমরা ডাল-ভাত, মাছ আর সবজির অর্ডার করেছি তিনজনের জন্য। আপনাকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। যদি অন্য কিছু খেতে চান তার ব্যবস্থা হয়তো করা যেতে পারে। তা নইলে আমরা যা বলেছি তাই চললে কোনো প্রবলেম নেই। আমার তো মনে হয় এই মিহিদানা ডিনারের পর খেলেই হয়। আপনি তো আবার বুদ্ধি করে কমলালেবু নিয়ে এসেছেন। এখনকার মতো এই কমলালেবুগুলো খেলে আমার চলে যাবে। আপনাদের চলবে কি?’

‘আরেকটা কী ব্যাপার যেন আমার অবর্তমানে হলো?’ জিজ্ঞেস করলো সুফী।

‘হ্যাঁ, ওটা স্যার বুঝিয়ে বললে বোধহয় ভালো হবে।’

ড. গুপ্ত বললেন, ‘আমরা রাত্রের দিকে নাগপুর পৌঁছাবো। নাগপুরে যদি নেমে যাই তাহলে আমরা সেখান থেকে কাল দিনের বেলা অজন্তা আর ইলোরা দেখতে যেতে পারি। বেশিদূরে না। ট্যাক্সি নিতে হবে। শুনেছি রাস্তাঘাট নাকি ভালোই ওখানে। শুধু এক রাত্রি আমাদের নাগপুরে কোনো হোটেলে থাকতে হবে। আর যদি ধীরে-সুস্থে সব দেখতে চাই তাহলে দুরাত থাকলে আশেপাশের অনেক জায়গা যেমন আওরঙ্গাবাদ দুর্গও দেখা যেতে পারে। গার্ড বললো, ট্রেনের যে টিকিট আছে আমাদের এই টিকিটেই চলবে। শুধু বাড়তি খরচ হোটেল আর যানবাহনের। কী বলেন, আপনি রাজি?’

একটু চিন্তা করে সুফী বললো, ‘ব্যাপারটা তো বেশ লোভনীয় ঠেকছে। অজন্তা-ইলোরার ছবি দেখেছি। চাক্ষুষ দেখতে পাবো কোনোদিন ভাবিনি। তবে আমরা ঠিক সময়মতো বোম্বে পৌঁছতে পারবো তো? আমি প্রথম দিনের উদ্বোধনী মিস করতে চাই না। আমার কাগজের জন্য কপি পাঠাতে হবে।’

ড. গুপ্ত বললেন, ‘হ্যাঁ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাদেরও থাকতে হবে। অবশ্য সেটা হয়ে যাবে যদি ট্রেনের টাইম ঠিক থাকে। আগে এই ট্রেন লাইনের নাম ছিলো বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে, সংক্ষেপে বিএনআর। দুষ্টু লোকে বলতো, এর মানে বি নেভার রেগুলার। তখনকার দিনে প্রায় লেট থাকতো। এখন অবশ্য সবগুলো রেল একসঙ্গে করে ইন্টার্ন রেলওয়ে বলে। তাই মনে হয় নতুন নামের মান রাখতে পাংচুয়ালিটি বজায় রাখতে চেষ্টা করবে।’

সুফী ওদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তাহলে এক যাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? অজন্তা ইলোরা দেখার সুযোগ যখন এসেছে তখন আর ছাড়ছি না।’

ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। সন্ধ্যা হচ্ছে। ড. গুপ্ত বললেন, ‘জানো তো খড়গপুর জংশনের প্ল্যাটফরম প্রায় মাইলখানেক লম্বা। পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা প্ল্যাটফরম এটি। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে এর নাম আছে।’

পরের স্টেশনে খাবার-দাবার এলো। পরে মিহিদানার সদ্ব্যবহারও হলো। ড. গুপ্ত ওপরের বাংকে উঠে গেলেন শোবার জন্য। একটু শীত-শীত করছিলো। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তায় কলকাতায় শীতের মাত্রা বেশি ছিলো না। কিন্তু মধ্যভারতের দিকে এসে রাতে বেশ শীত করতে লাগলো।

সংঘমিত্রা বললো, ‘আপনি গায়ে দেওয়ার জন্য কিছু এনেছেন? চাদর বা ওরকম কিছু?’

সুফী বললো, ‘এই শীতে আমার সোয়েটারই যথেষ্ট হবে। বেশি শীত তো নয় এখানে।’

‘না, হবে না। এই নিন, আমি একটা চাদর দিচ্ছি আপনাকে। এটা গায়ে দেবেন।’

সংঘমিত্রা হাত বাড়িয়ে চাদরটা দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ বাইরে বিকট শব্দ। কারণ তখন ট্রেনটা একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কামরার আলো জ্বালানোর দরকার হয়নি। বাইরে তখনো আলো। সুড়ঙ্গে ঢুকতেই ট্রেনের কামরাটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল।

‘আই মাম্মি’ ভয়ের একটা মৃদু চিৎকার করে উঠলো সংঘমিত্রা। সুফীর হাতটা ধরে অজান্তেই নিজের দিকে একটু টানলো আর ওর কাঁধটা ধরে বেশ জোরে সুফীকে অাঁকড়ে ধরে থাকলো। যতোক্ষণ ট্রেনটা টানেল পার না হলো আর দিনের আলো ফিরে না আসা পর্যন্ত সংঘমিত্রা সুফীর হাতটা ছাড়লো না। তারপর একটু সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বললো, ‘কিছু মনে করবেন না। এ রকম হঠাৎ অন্ধকারকে আমার ভীষণ ভয় করে। তখন কী যে করি ঠিক থাকে না।’

সূর্য অস্ত যাচ্ছে তখন। একটু পরেই অন্ধকার হবে। সুফী উঠে গিয়ে কামরার আলোর সুইচ টিপে দিলো। সংঘমিত্রাকে বললো, ‘যাক এবার আর ভয় করবে না তো?’

সংঘমিত্রা ওর ছোট ব্যাগটা হাতড়ে আর একটা চাদর বের করলো। টকটকে লাল আর সুন্দর দেখতে। ‘এটা আমার দিদি দিয়েছে। আমি গায়ে দেব রাত্রে।’

ওরা দুজন দুটো বেঞ্চে আরাম করে শুয়ে পড়লো। অন্য প্যাসেঞ্জাররাও শোবার বন্দোবস্ত করছে।

 

চার

একটা হিন্দুস্তানি পরিবার ওপাশে। বাবা-মায়ের সঙ্গে একটা বছর দশেকের মেয়ে।

মেয়েটির মাকে সংঘমিত্রা জিজ্ঞেস করলো, ‘রাত্রে রাধা গায়ে দেবে কি? বেশ ঠান্ডা পড়তে পারে কিন্তু।’

মা ওকে বললো হিন্দিতে, ‘আপ শোঁচিয়ে মাত। উও মেরে পাশ শোয়ে গি। ঠান্ডা নাহি লাগে গা। ধানইয়াবাদ।’

সুফী বুঝলো সংঘমিত্রা এর মধ্যেই ওদের সঙ্গে আলাপ করে নিয়েছে। তার কেনা একটা কমলালেবুও রাধার হাতে।

সুফী বললো, ‘আপনি ঘুমিয়ে পড়লে আমি আলো নিবিয়ে দেব। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

‘না, এমন অন্ধকারে আমি ভয় পাই না। তবে হঠাৎ যদি কখনো অন্ধকার হয়ে যায় তখন মাঝে মাঝে ভয় লাগে। এটা আমার ছোটবেলার একটা বদভ্যাস বা ফোবিয়া আর কি। এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’

সুফীর ঘুমিয়ে পড়তে দেরি হলো না। কে যে কামরার আলো নিভিয়ে দিলো ওর মনে থাকার কথা নয়।

রাতে ড. গুপ্ত জাগিয়ে দিলেন, ‘ওঠো নাগপুর এসে যাচ্ছে। আমাদের নামতে হবে।’

সব গুছিয়ে নিতে নিতে স্টেশন এসে পড়লো। ওরা নামছে। অন্যরা সব ঘুমুচ্ছে তখন। হঠাৎ সুফী তাকালো সংঘমিত্রার দিকে। ও সালোয়ার-কামিজ ঠিক করছিলো তখন। দেখলো ওর লাল ওড়নাটা পাশের বেঞ্চের ছোট মেয়ের গায়ে বিছানো।

‘ওটা আপনার না?’

‘হ্যাঁ, রাধার গায়ে চাদর ছিলো না দেখে আমারটা ওর গায়ে দিয়েছিলাম।’

‘বাইরে তো বেশ ঠান্ডা। আপনি বরং আমাকে যেটা দিয়েছিলেন সেটা নিন। রাধার চাদরটা কি নিতে পারবেন? ও তো ঘুমুচ্ছে এখনো।’

‘আমার সোয়েটার আছে, চলে যাবে। আপনাকে যেটা দিয়েছি সেটা ফেরত দিয়ে বেশি বেশি সিভালরি দেখাতে হবে না।’ ধমকের সুরে বললো সংঘমিত্রা।

স্টেশনের কাছের হোটেলে দুটো রুম পাওয়া গেল। একটা ডবল রুমে ড. গুপ্ত আর সুফী থাকবে। আর অন্য ঘরে সংঘমিত্রা। চার-পাঁচ ঘণ্টা একটু ঘুমুতে বা বিশ্রাম নিতে পারবে।

হোটেল থেকেই ট্যাক্সি ঠিক করে দিলো সারাদিন ওদের সঙ্গে থাকবে। অজন্তা, ইলোরা আর আওরঙ্গাবাদ দেখিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফেরত আসবে। তারপর রাতটা হোটেলে কাটিয়ে সকালে আবার বোম্বের ট্রেন ধরতে হবে।

হোটেলের খাটে শুয়েই সুফীর চোখে ঘুম এসে যাচ্ছিল। আলো নিবিয়ে দুজনেই শুয়ে পড়লেন। কিন্তু ড. গুপ্তের চোখে ঘুম নেই। তিনি সুফীর সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন অন্ধকারের মধ্যেই নিজের খাটে শুয়ে।

‘আমরা ঢাকায় থাকতাম টিকাটুলীতে। সেগুনবাগিচার কথা মনে আছে। সেখানে যেতাম আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিলো একটা খুব বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। এপ্রিল-মে মাসে সে গাছে ফুল হতো এমন যেন সেখানে আগুন লেগেছে। সে গাছটা কি এখনো আছে? আমরা সিনেমা দেখতে যেতাম সদরঘাটে লায়ন সিনেমা হলে। সেটাও কি আছে? আর একটা নতুন হল হচ্ছিল তখন বাড়ির কাছেই। নাম ‘অভিসার’। কিন্তু ওখানে কখনো যাইনি। আপনি আজ বাখরখানি খাওয়ালেন। সেটা খেয়েই পুরনো দিনের স্মৃতি ভিড় করে এলো।’

সুফী হুঁ-হুঁ করে গেল। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল ড. গুপ্তের ছাত্রী সংঘমিত্রা সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে। কিন্তু সুফী কিছু জিজ্ঞেস করার আগে বলতে লাগলেন তিনি, ‘আবার ঢাকায় যেতে ইচ্ছে করে। আবার করেও না। শুনেছি অনেক কিছু বদলে গেছে। আগের দেখা শহরকে কি চিনতে পারবো? বেশি বদলে গেলে চিনতে না পারলে আবার হয়তো খারাপ লাগবে।’

সুফী লক্ষ করলো ড. গুপ্তর কণ্ঠস্বর যেন বেশ উঁচু গ্রামে বাঁধা। ট্রেনে যখন তিনি কথা বলছিলেন তখনই সে খেয়াল করেছিলো তিনি বেশ জোরে কথা বলেন। তখন সুফী ভেবেছিলো যে, ট্রেনের চলার আওয়াজের জন্য তিনি বোধহয় অতো জোরে জোরে কথা বলছিলেন। কিন্তু এখন দেখলো এই নিঝুম রাতেও তিনি প্রায় চেঁচিয়ে কথা বলছেন। তারা দুজন একটা ছোট ঘরে পাশাপাশি দুটো খাটে শুয়ে আছেন। সেখানে এতো জোরে কথা বলার কোনো দরকার নেই। বুঝলো, এটা নিশ্চয়ই তাঁর বহুদিনের অভ্যাস। প্রথম-প্রথম এ-রকম উঁচু গলার কথা শুনতে একটু অস্বস্তি লাগে বইকি।

তিনি একটু চুপ করে আবার বলতে লাগলেন, ‘আমি তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট বের হতে কয়েক মাস দেরি। পড়াশোনার চাপ নেই। হাতে কোনো কাজ নেই। সেগুনবাগিচায় মাঝে মাঝে বুদ্ধদেবের ওখানে আড্ডা দিতে যেতাম। হঠাৎ একদিন শুনলাম, পাশের খালি বাড়িতে একজন নতুন ভাড়াটে এসেছেন। তিনি মুসলিম লীগের পলিটিক্স করেন। ওই বাড়ির এক ছোট মেয়ে লাল ফ্রক পরে বেণি দুলিয়ে স্কুলে যেত। কী জানি কেন মজা লাগতো দেখে। রোজ মেয়েটাকে আয়ার হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখার জন্য সকাল থেকে জানালার পাশে বসে থাকতাম। ওর নাম নিয়ে একটু অসুবিধায় পড়েছিলাম। আয়াটা ডাকতো, ‘ও টুকু চলে এসো আর দেরি না।’ আবার কখনো ডাকতো, ‘টুকরা, দুষ্টুমি করো না কিন্তু!’ আমি ভাবতাম ‘টুকরা’ – এ কেমন নাম? পরে শুনেছিলাম ওর নানির বাড়ি পশ্চিম দেশে। তিনি নাতনির নাম দিয়েছিলেন ‘জিগারকা টুকরা’। আয়া অতো বড় নাম ধরে ডাকতে পারতো না। তাই বলতো শুধু ‘টুকরা’ এবং পরে ‘টুকু’। ওর মা ডাকতো ‘বুড়ি’ নামে।

টুকরাদের বাড়ির সামনের জায়গাটা বাঁধানো ছিলো। একদিন দেখলাম মেয়েটা পায়ের জুতোর সঙ্গে চাকা লাগিয়ে কী সুন্দর গড়গড়িয়ে ঘুরছে। আমি ওদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখছিলাম। কোনোদিন দেখিনি এ রকম জিনিস। টুকরা আমাকে দেখে হঠাৎ বললো, ‘তুমি রোলার স্কেটস ট্রাই করে দেখতে চাও?’ ওই প্রথম আমি দেখলাম রোলার স্কেটস। ‘জুতো পরে আসতে হবে কিন্তু। স্যান্ডেল পরলে চলবে না।’ জুতো পরে এলাম। স্কেটস দুটো আমার জুতোর তলায় লাগিয়ে আমি চেষ্টা করলাম ওর মতো তরতরিয়ে হাঁটতে। কিন্তু ব্যালেন্স হারিয়ে দড়াম করে পড়লাম। টুকরার কী হাসি! পরে আর কোনোদিন চেষ্টা করিনি। …কতো বড় হয়েছে এখন মেয়েটা দেখতে ইচ্ছে করে।’

সুফী কথার খেই ফিরিয়ে বললো, ‘হোটেলের লেপটা খুব পরিষ্কার ঠেকছে না। কতো লোক যে এটা গায়ে দিয়েছে সারাবছর। ওরা ভালো করে ধুয়েছে কিনা কে জানে! আমি বরং সংঘমিত্রার দেওয়া এই চাদরটা গায়ে দিয়ে শোব। কয়েক ঘণ্টারই তো ব্যাপার।’

‘হ্যাঁ, তাই করো। মেয়েটার মন খুব নরম আমি জানি। নিজের সুন্দর চাদরটা কেমন এক অজানা-অচেনা মেয়েকে অনায়াসে দিয়ে দিলো।’

তারপর একটু চুপ করে আবার বলতে লাগলেন, ‘আমিই ওকে নিয়ে এসেছিলাম শান্তিনিকেতন থেকে। ও বিশ্বভারতী থেকে আইএসসি দিয়েছিলো। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলো পরীক্ষায়। আমি মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনে যেতাম তখন। আগেই তো বলেছি আমার শিক্ষক ছিলেন সত্যেন বোস। সাতচল্লিশের পর আমরা কলকাতা চলে এলাম। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে তিনি জয়েন করলেন। আমাকেও নিলেন নিজের সঙ্গে। আর তিনি ছিলেন মেঘনাদ সাহার সহপাঠী। একসঙ্গে দুজনেই কিছুদিন কাজ করলেন কিন্তু কেন জানি দুজনে কিছুদিন পর ফিজিক্স ছেড়ে অন্যদিকে বেশি মনোযোগ দিতে লাগলেন। মেঘনাদ ভাবলেন, দেশের জন্য কিছু করবেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন দেশে বিজ্ঞানমুখী করতে হবে। তা নইলে দেশের সত্যিকার উন্নতি করা সম্ভব হবে না। তার জন্য দেশের সরকারকে এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাজনীতি হচ্ছে সরকারের কাছে যাওয়ার একমাত্র পথ। রাজনীতির বাইরে থেকে সরকারকে এসব ব্যাপারে বোঝানো বড়ই দুরূহ কাজ হবে। মেঘনাদ সাহা তাই হলেন বহির্মুখী। আর সত্যেন বোস হলেন অন্তর্মুখী। তিনি ছিলেন থিওরিটিক্যাল ফিজিসিস্ট। আর চিরজীবন ফিজিক্সের পরই তাঁর জীবনে ছিলো সংগীতের স্থান। তিনি অনেক সময় ব্যয় করতে লাগলেন গানের জগতে। ছুটিছাটা পেলেই তিনি ছুটতেন শান্তিনিকেতনে। সমমনা বহু লোকের সান্নিধ্যে তাঁর সময়টা ভালোই কাটতো। পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য হয়ে গেলেন শেষ পর্যন্ত। আমি যখনকার কথা বলছি তখনো তিনি কলকাতায়। বিশ্বভারতীতে গেছি একবার ওঁদের সমাবর্তন উৎসবে। সংঘমিত্রার ফিজিক্সের প্রফেসর আমাকে বললেন মেয়েটার কথা। অংকে মাথা খুব ভালো। পার্টিকল ফিজিক্স পড়তে চায় ভবিষ্যতে। বুঝলেন কিনা, কবছর আগে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। এসব তরুণ ছাত্র তখন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে নানা রকম রোমান্টিক চিন্তা করছে। আইনস্টাইন, ওপেনহাইমার, সিভি রমন আর কৃষ্ণান – তাঁরা ওদের হিরো। মেয়েটা পরীক্ষায় ভালো করেছে। ফিজিক্স আর অংকে তো বিশেষ করে ভালো। ওর শিক্ষক মেয়েটাকে রিকমেন্ড করছেন। সত্যেন বোস যদি একটু বলে দেন তার বন্ধু মেঘনাদকে তাহলে ওকে আমাদের ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। তবে ও তো ভারতীয় নয়, নেপালের মেয়ে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে একটা বিদেশি মেয়েকে সুযোগ দেওয়া যায় কীভাবে? মেঘনাদ সাহাকে বলতে তিনি সেটার ব্যবস্থা করলেন। বিশেষ করে তার আগ্রহ দেখে। বিধান রায় তখন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে বলা হলো কিন্তু তিনি জানালেন নাগরিকত্ব প্রদেশের ব্যাপার নয়। ওটা দিল্লির দায়িত্ব। বিধান রায়ের অবাধ যাতায়াত ছিলো নেহরুর কাছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি রাজি হন, তাহলে আর বাধা কী?’

সুফী বললো, ‘একটা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রীকে ভর্তি করার জন্য আপনারা এতো কাঠখড় পোড়ালেন?’

‘আসলে কি জানো, মেয়েটাকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছিলো। বিশেষ করে মেঘনাদ সাহার। আর মেয়েটাও জেদ ধরে বসেছিলো যে, সায়েন্স কলেজে ভর্তি হতে না পারলে সে আর কোথাও পড়তে যাবে না। সে ভর্তি হলো শেষ পর্যন্ত। আর তারপর আমাদের সে মোটেও ডিসাপয়েন্ট করেনি।

মেঘনাদ সাহার প্রিয় ছাত্রী সে। তিনি তাকে তাঁর সাইক্লোট্রন প্রজেক্টে নিয়ে নিলেন। ভারতে প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরি হয়েছিলো মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে এই কলকাতার সায়েন্স কলেজে। বার্কলিতে লরেন্সের তৈরি করা সাইক্লোট্রনের চাইতে অনেক ছোট এই সাইক্লোট্রন। কিন্তু সেটাও আর কেউ তখনো করতে পারেনি এদেশে।’

‘আপনিও ছিলেন নাকি এই প্রজেক্টে? যদিও এ-ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছু বুঝি না। কিন্তু জানতে চাই সাংবাদিক হিসেবে। বোধহয় কিছু জানা থাকলে কাজে লাগতে পারে।’

‘আমরা যে সায়েন্স কংগ্রেসে যাচ্ছি সেখানে এই বিষয় নিয়েই একটা পেপার পড়বো। আমার সঙ্গে এই পেপারের কো-অথার হচ্ছে সংঘমিত্রা নোরবু। আমাদের দেশে এতো অল্প বয়সে খুব কমই বৈজ্ঞানিক আছে যে সাইক্লোট্রন সম্বন্ধে এতোটা জানে। একেবারে হাতেনাতে শিখেছে ব্যাপারটা। বহু কষ্ট আর অধ্যবসায়ের ফল এটা। আর ওর ডক্টরেটের থিসিস এটার ওপরেই। এ-বছরই ওর ডক্টরেট হয়ে যেতে পারে। অবশ্য ওকে আরো একটু কষ্ট করে থিসিসের বইটা লিখতে হবে তার আগে।’

 

পাঁচ

সকালবেলা হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে যাওয়ার জন্য ওরা দুজনে তৈরি। ড. গুপ্ত বললেন, ‘সংঘমিত্রার দরজায় একবার টোকা দাও তো। দেখি ও রেডি কিনা!’

সুফী তা-ই করলো। কিন্তু কোনো জবাব নেই। মনে হয় ও আগে উঠেই খেতে চলে গেছে। ডাইনিং রুমে ঢুকেও কিন্তু সংঘমিত্রাকে দেখতে পেলো না। ওরা দুজন একটা টেবিলে বসে পড়লো।

ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিতে যাচ্ছে এমন সময় সংঘমিত্রা হাসিমুখে ঢুকলো ডাইনিং রুমে। বললো, ‘দেখেন দেখি এই চাদরটা কেমন হয়েছে? সামনের দোকান থেকে কিনলাম। সস্তাই হলো। এটা কটনের কিন্তু দেখতে ঠিক আমার ওই চাদরটা যেটা ট্রেনে ওই মেয়ের গায়ে রেখে এসেছি। রং সম্বন্ধে কিছু খারাপ বলতে পারবেন না। লাল আমার সবসময় পছন্দ। যেটা ফেলে এসেছি সেটা পশমের ছিলো। তাই বেশ গরম। আর কাঠমান্ডুর জন্যে ওটা ঠিক ছিলো। আর বোম্বেতে নাকি বেশি ঠান্ডা পড়ে না। তাই এই চাদরটাই বোধহয় ভালো হবে।’ হাসিমুখে ও বলেই চলেছে নিজে নিজে। বোঝাই যাচ্ছে খুব খুশি হয়েছে ও চাদরটা কিনে।

শেষ পর্যন্ত সুফী বলতে চেষ্টা করলো, ‘আমাকে যেটা দিয়েছেন সেটা নিয়ে নিলেই হতো। আমার জন্য এ-রকম একটা এখান থেকে কিনে নিতাম।’

ভ্রূ তুলে সংঘমিত্রা এবার বললো, ‘এই লাল চাদর আপনি গায়ে দেবেন? আপনি একদম কী যেন! এই রং কি পুরুষদের মানায়?’

‘এই লাল চাদরটা বদলে অন্য রঙের একটা পছন্দমতো চাদর এখনই দোকানে গিয়ে নেওয়া যায়, চলুন না।’ বললো সুফী।

সংঘমিত্রা গম্ভীর হয়ে বললো, ‘আপনি তো দেখছি মহাঝামেলার লোক। যে-চাদরটা আপনাকে দিয়েছি আর কোনো কথা না বলে সেটা নিজের কাছে রেখে দিন। ওটাতে আপনাকে মানায় বেশ ভালো। আমার খিদে পেয়েছে। আপনারা কিছু অর্ডার দিয়েছেন?’

অজন্তায় ওরা যখন পৌঁছলো তখন প্রায় দুপুর। দূর থেকে দেখতে পেলো দুই পাহাড়ের মাঝে একটা ক্যানিয়নের মতো। তার গভীরে একটা ছোট্ট নদীর আভাস। ওয়াগোরা নদী। চতুর্দিকে সবুজের জঙ্গল। দূর থেকে অজন্তার গুহাগুলোর মুখ অল্প-অল্প দেখা যায়। জঙ্গলে প্রায় ঢেকেই রেখেছে। গুহাগুলোর কাছে দেখলো বেশ ভিড় জমে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে গাইডের জন্য। একটু পরে গাইড এসে একটা ভূমিকা দিলেন অজন্তা সম্বন্ধে।

এদেশে পাহাড় কেটে কিংবা গুহার ভেতর ছবি এঁকে বুদ্ধের জীবনী বা তাঁর বাণীগুলো মূর্ত করা পুরাকালে একটা রেওয়াজ ছিলো। খ্রিষ্টপূর্ব দুই শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টাব্দ ছয় শতাব্দী পর্যন্ত অজন্তার বিভিন্ন রাজার আমলে এই পুরাকীর্তি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু তারপর কোনো কারণে এগুলোর কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় দেড় হাজার বছর অজন্তার কথা লোকে ভুলে যায়। ধীরে ধীরে জঙ্গলে আবৃত হয়ে যায় এই সুন্দর গুহাগুলো। তারপর এরা শুধু বন্যপ্রাণী আর বাদুড়ের               আস্তানা হয়ে যায়।

বহু বছর পর ১৮১৯ সালের ১৯ এপ্রিল জন স্মিথ নামক বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে এক ইংরেজ অফিসার অজন্তাকে পুনরাবিষ্কার করেন। তিনি বাঘশিকারি ছিলেন। বাঘের খোঁজে এসব দুর্গম জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ এই গুহাগুলো দেখতে পান। এখন যেটা নয় নম্বর গুহা তার দেয়ালে তিনি নিজের নাম আর তারিখও খোদাই করে লিখে গিয়েছিলেন। অস্পষ্ট সেই স্বাক্ষর এখনো দেখা যায়। এখন অবশ্য অজন্তার দেয়ালে কোনো কিছু লেখা একেবারে নিষিদ্ধ। যদি কেউ করেন তবে তাকে এই ওপর থেকে বহু নিচে ওয়াগোরা নদীতে ফেলে দেওয়া হবে।’ হাসতে হাসতে বললেন গাইড। বললেন, ‘কতোগুলো গুহা বেশ অন্ধকার। একটু সাবধানে চলবেন কিন্তু।’

এরপর গাইড একের পর এক গুহায় নিয়ে গিয়ে বোঝাতে লাগলেন এদের ইতিহাস, ভাস্কর্য আর ম্যুরালের তাৎপর্য ইত্যাদি। প্রথমে এগুলো ছিলো চৈত্য বিহার অর্থাৎ বৌদ্ধভিক্ষুদের থাকার জায়গা। পরে ভাস্কর্য আর ম্যুরালের শুরু। শতবাহন রাজাদের সময়ে এগুলো শুরু হয়। পরে অন্য রাজারাও বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজ্যের শিল্পীদের দিয়ে এখানে কাজ করিয়েছেন। নিজেদের ধন ও উপাদান দিয়ে নানা রকম সাহায্য করেছেন। মাঝে মাঝে কাজে যতি পড়েছে। যখন তারা যুদ্ধবিগ্রহে বা অন্য রকম বিপত্তিতে জড়িয়ে পড়তেন। আবার অনেক বছর পর যখন হয়তো শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন অন্য শিল্পীরা এসে আবার কাজ শুরু করেছেন।

গুহাগুলোর সামনের দিকটায় দিনের আলো আছে কিন্তু ভেতর দিকে একটু-একটু অন্ধকার। ভেতরে জায়গাও কম। তাই ভিড়টা সেখানে একটু বেশি ঠেকছে।

সুফী বললো, ‘ড. গুপ্তকে তো দেখছি না। তিনি বোধহয় ভিড়ের ঠেলায় আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন।’

সংঘমিত্রা বললো, ‘তাই তো। তাঁকে দেখছি না। চিন্তার কথা। সবাইকে একসঙ্গে হোটেলে ফিরতে হবে কিন্তু। আচ্ছা আপনি আমার হাত ধরবেন? তা নইলে আমরা দুজনেও হয়তো আলাদা হয়ে যেতে পারি। আমার এতো ভিড় ভালো লাগছে না। আর ভেতরে গরমটাও বেশি।’

সুফী তার ডান হাতের মুঠোর ভেতরে সংঘমিত্রার বাঁ হাতটা ধরলো। মাথার পিছন দিকটায় সুফী একটা শিরশিরানি অনুভব করলো। একটা সুখ-জাগানিয়া অনুভূতি। একজন অচেনা মেয়ের হাত সে কখনো ধরেনি। বিশেষ করে এ-রকম একটা একান্ত পরিবেশে।

সংঘমিত্রা ফিসফিস করে বললো, ‘আপনি বোধহয় কখনো কোনো মেয়ের হাত ধরেননি, বুঝতে পারছি। মুঠোর মধ্যে আমার হাত না ধরে আমার আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে আপনার আঙুল দিয়ে ধরে থাকুন।’

তাদের গাইড কী বলছে ওর কানে তখন ওগুলো ঢুকছিলো না। জাতকের যেসব গল্প তিনি বলছিলেন সেসব শোনার মতো ওর মনের অবস্থা তখন নেই। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে গুহা থেকে ওরা বেরিয়ে এলো। বাইরে তখন আলো। গুহার ভেতরের অন্ধকার ভাবটা কেটে গেছে। বাইরে জায়গা বেশি। তাই ঠেলাঠেলি নেই।

সংঘমিত্রা বললো, ‘এবার তাহলে আমার হাতটা ছেড়ে দিন। খোলা জায়গায় হারিয়ে যাবো বলে মনে হয় না।’ কিন্তু সুফী কথাটা শুনলেও সংঘমিত্রা যে তার হাতটা এবার ছেড়ে দিতে বলছে সেটা ওর কানে ঢুকলেও মাথায় ঢুকলো না। কয়েক মুহূর্তের জন্য ও হাতটা ছেড়ে দিতে ভুলে গেছে। সংঘমিত্রা একটু হেসে বললো, ‘ঠিক আছে, আমার হাতটা ধরেই থাকুন। আমারও ভালো লাগছে।’ সুফী লজ্জা পেয়ে হাতটা ছেড়ে দিলো।

ওদের সামনেই একজন বুড়ো ভদ্রলোক আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন। হঠাৎ মনে হলো তাঁর পা উঁচুনিচু মেঝের কিছু একটাতে হোঁচট খেলো। অমনি তিনি সেই পাথরের মেঝেতে পড়ে গেলেন। কেউ কিছু করার আগেই সংঘমিত্রা মেঝেতে বসে পড়লো লোকটার পাশে। কাঁধে হাত দিয়ে বললো, ‘আপকো চোট লাগা? দুখ পাঁয় আপ?’

লোকটা কিছু বলতে পারলো না প্রথমে। অমনি করে হঠাৎ পড়ে গিয়ে তিনি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর নিজের দুহাত দিয়ে হাঁটু দুটো চেপে ধরলেন। পাথরের মেঝেতে পড়ে গিয়ে তাঁর পা ছড়ে গেছে। চামড়া কেটে কিছু রক্ত বেরোতে শুরু করেছে। ততোক্ষণে আরো কয়েকজন সেখানে জড়ো হয়েছে। মনে হলো গাইডটি একাই একটু বেশি এগিয়ে গিয়েছিলেন। জটলা দেখে ফিরে এলেন। ব্যাপারটা বুঝে বললেন, ‘মেইন গেটের ওখানে ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা আছে। আমি খবর দিচ্ছি। চিন্তা করবেন না।’

সংঘমিত্রা বললো, ‘আমি নিজে ওখানে গিয়ে বলছি কিছু ব্যবস্থা করতে।’ গাইডকে বললো, ‘আপনার তো অনেক কাজ ভিজিটরদের নিয়ে। আপনি বরং এ-ধারে দেখুন। আমি যাচ্ছি গেটে।’

সবাই মিলে বুড়ো ভদ্রলোককে ধরে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো।

সংঘমিত্রা সুফীকে বললো, ‘আপনি থাকুন তাঁর সঙ্গে। আমি এক্ষুনি আসছি ফাস্ট এইড নিয়ে।’

সুফীর নিজেকে তখনো একটু অসহায় মনে হচ্ছিলো। কী করবে সে বুঝতে পারছিলো না। অথচ সংঘমিত্রা চটপট সব করণীয় কাজ করে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। সুফীর মনে একটা গর্বভরা আনন্দের ভাব এসে গেল সংঘমিত্রার কাজ দেখে। লোকটার পাশে সেও বসে পড়লো পাথরের ঠান্ডা মেঝেয়। গাইডও সংঘমিত্রার চটপটে কাজ দেখে প্রশংসার সুরে বললো, ‘বহুৎ স্মার্ট লাড়কি হ্যায়। অওর দিল মে বহুৎ দায়া ভি হ্যায়।’

গাইড লোকটা সুফীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপতো উনকে সাঁথ হ্যায় না?’

সুফীর মুখটা একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যদিও প্রশংসা সবটাই সংঘমিত্রার জন্য। কিন্তু একটু আগেই তো সে মেয়েটির হাত ধরেছিলো। ভাবতেই তার নিজের মনেও একটা গর্বের ভাব এসে গেল।

সংঘমিত্রা ফিরে এলো দুমিনিট পরেই। সঙ্গে এলেন দুজন লোক একটা স্ট্রেচার নিয়ে। ওরা ধরাধরি করে বুড়ো লোকটাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে ফিরে চললো। হাতটা তুলে বুড়ো ভদ্রলোক বললেন, ‘ভাগওয়ান আপকি ভালা কারে।’ কথাটা সংঘমিত্রার জন্য সেটা সবাই বুঝতে পারলো।

গাইড বললো, ‘আব চলিয়ে ইসকে বাদ আপলোকগো আঠারে নামবার কেভ দেখায়েঙ্গে। মেরা পসন্দ কা পেইন্টিং ইস কেভ মে হ্যায়।’

সুফীর মাথা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক গুহার ভেতর ঢুকছে। বুদ্ধের কতো রকম ছবি আর ভাস্কর্য দেখালো গাইড। কতো কথা বললো হিন্দিতে, মাঝে মাঝে ইংরেজিতে। কতকগুলো গুহার একটু ভেতরে ঢুকলেই অন্ধকার বেশ গাঢ় লাগে। দুপুরবেলার বাইরের আলো গুহার বেশি ভেতরে যেতে পারে না। গাইডের হাতে রয়েছে একটা স্পটলাইট। বিদ্যুতের লম্বা তার বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছিলো তাদের। মেঝেতে সাপের মতো তার ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি বলতে লাগলেন, ‘এই তার একটু বাঁচিয়ে সাবধানে চলবেন। তা নইলে হোঁচট খেয়ে পড়বেন। ইলেকট্রিক শকও লাগতে পারে কিন্তু।’

সংঘমিত্রা ওর পাশে পাশেই কিন্তু ওর হাত ধরা নেই সুফীর মুঠোয়। সেই ছোঁয়া থেকে সে এখনো মুক্ত হয়নি মনে হয় তার। একটু আগেই সেই নরম হাতটা ছিলো তার মুঠোয়। তখন সংঘমিত্রা কোনো রকম ভাবান্তর দেখায়নি। অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ করছিলো সে। গাইডের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করেছিলো। কিন্তু সুফী তখনো আচ্ছন্নের মতো হাঁটছিলো সংঘমিত্রার পাশে পাশে।

গাইড বলছিলো আঠার নম্বর গুহার ফ্রেসকো চিত্রের কথা। রাজকুমারী প্রসাধনে ব্যস্ত। তাঁর পরিচারিকা আয়না ধরে আছে যুবতী রাজকুমারীর মুখের সামনে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে সে ব্যস্ত। একটা ছোট ছেলে তাকিয়ে দেখছে রাজকুমারী আর তার পরিচারিকার দিকে ওপর দিকে মুখ করে। প্রাসাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা স্থিরচিত্র; কিন্তু বহু বছর পরও জীবন্ত লাগছে।

হঠাৎ গাইডের হাতে ধরা স্পটলাইট নিভে গেল। মুহূর্তে পুরো গুহাটা একেবারে নিশিছদ্র অন্ধকারে ডুবে গেল। সংঘমিত্রা আবার ‘আই মাম্মি’ বলে একটা চাপা ভয়ার্ত চিৎকার দিলো। সুফীকে জড়িয়ে ধরলো সে। এটা সুফী মোটেও ভাবতে পারেনি। তার আগের দিন ট্রেন যখন টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো আর এরকম হঠাৎ অন্ধকারে সংঘমিত্রার ভয়মিশ্রিত সেই ‘আই মাম্মি’ ডাক সে প্রায় ভুলে গেছিলো। কিন্তু এবার মেয়েটি আরো জোরে সুফীকে প্রায় জড়িয়ে ধরলো।

গাইড বললো, ‘সরি, ইলেকট্রিকের কানেকশন বোধহয় কোনোভাবে কেটে গেছে। তবে আলো আবার আসবে এখুনি। ভয় পাবেন না।’

মিনিটখানেক থাকলো অন্ধকার। সংঘমিত্রা ছাড়লো না সুফীকে যতোক্ষণ না আলো এলো। যদিও অন্ধকার ছিলো হয়তো মিনিটখানেক কিন্তু সংঘমিত্রার কাছে বোধহয় মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল। সুফীও সময়ের কোনো হিসেব রাখতে পারেনি। সংঘমিত্রা দুহাত দিয়ে ওকে প্রায় জাপটে ধরে আছে। ওর শরীরের স্পর্শ বুকের ছোঁয়ার আভাস সুফীকে বোবা করে দিয়েছে। একটা সান্ত্বনার কথাও সে বলতে পারলো না সংঘমিত্রাকে। তারপর হঠাৎ আবার আলো এসে গেল।

এবার গাইড বললো, ‘আপনারা ভয় পাবেন না। মাঝে মাঝে এ রকম হয়। হয়তো বিদ্যুতের তারটা কারো পায়ের তলায় পড়ে কানেকশনে ব্যাঘাত ঘটেছিলো। তবে একটা কথা ভেবে দেখুন – এই দিনদুপুরেই এ গুহার ভেতর কী রকম অন্ধকার। এ রকম অবস্থায় প্রায় দু-হাজার বছর আগে শিল্পীরা এতো সুন্দর রঙিন ছবিগুলো এঁকেছিলেন। আলো কোত্থেকে আসতো তখন? হয় তারা অনেক প্রদীপ বা মশাল ব্যবহার করতেন কিন্তু তাতে এ-রকম বন্ধ গুহার ভেতরে অনেক ধোঁয়া নিশ্চয় আটকে থাকতো। মাসের পর মাস সে ধোঁয়া একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করতো। অনেকে বলেন, বাইরের সূর্যের আলো অনেকগুলো আয়না দিয়ে প্রতিফলিত করে গুহার ভেতরে আনা হতো। এই আলোয় শিল্পীরা কাজ করতেন।’

সবাই আস্তে-আস্তে গুহা থেকে বাইরে চোখ ধাঁধানো দিনের আলোয় এলো। সংঘমিত্রা তখনো সুফীর কনুইয়ের কাছটা দুহাতে ধরে আছে। বললো, ‘সরি, আপনাকে চমকে দিয়েছিলাম বোধহয়। আগেই বলেছি, আমার হঠাৎ অন্ধকারকে ভীষণ ভয়।’

সুফী ওর কথায় কান না দিয়ে বললো, ‘আপনি মাকে মাম্মি বলে ডাকেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ তাই। আপনি মাকে কী বলে ডাকেন?’

‘আমি বলি আম্মা। তবে অনেকেই মা বলে আমাদের দেশে।’

‘আমাদেরও তাই। মা, আম্মা এ-রকম নামগুলো বোধহয় সব ভাষাতে একই। তবে আমি বলি মাম্মি।’

সুফী গম্ভীর সুরে বললো, ‘চলুন, সামনের ওই জঙ্গলে ঘেরা গুহায় যাই। সেখানে আরো অন্ধকার।’

‘কেন ওই গুহাটায় আরো কিছু আছে নাকি দেখার মতো?’

‘তা নেই। তবে আপনার ‘আই মাম্মি’ ডাকটা আবার শুনতে চাই।’

সংঘমিত্রা এবার দাঁড়িয়ে পড়লো। সুফীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে তর্জনী তুলে ওর দিকে চেয়ে বললো, ‘ভালো হবে না কিন্তু। একটা নিরীহ মেয়েকে একলা পেয়ে আপনি ভয় দেখাচ্ছেন।’

এমন সময় পেছন থেকে ড. গুপ্তের গলা শোনা গেল। বেশ বাজখাঁই গলা। ‘এই যে তোমরা এখানে। আমি তো ভাবছিলাম তোমরা হারিয়ে গেলে কেমন করে?’

‘যাক বাঁচলাম। আমরা তো চিন্তায় পড়েছিলাম আপনাকে হারিয়ে।’ বললো সংঘমিত্রা। তারপর সুফীর দিকে চেয়ে চুপে চুপে বললো, ‘বলে দেবো মাস্টার মশায়কে। আপনি আমাকে শুধু-শুধু ভয় দেখাচ্ছিলেন একটু আগে।’

‘আচ্ছা আর করবো না। যদি করি তাহলে না জানিয়েই করবো।’ ড. গুপ্তের দিকে ফিরে বললো, ‘আপনারা এখানে দাঁড়াবেন স্যার। আমি একটা ছবি তুলবো দুজনের।’

‘আপনার কাছে ক্যামেরা আছে? আমাদের ছবি তুলবেন জানলে কিন্তু পারফিউম মেখে আসতাম।’

ঠাট্টা গায়ে মাখলো না সুফী। বললো, ‘এই যে এখানে দাঁড়ালে প্রায় পুরো কেভগুলো ব্যাকগ্রাউন্ডে পাওয়া যাবে।’

‘হ্যাঁ, বেশ ভালো আসছে এখন। একটু অপেক্ষা করি। পেছনের লোকগুলো যদি একটু সরে যায় তাহলে কম্পোজিশনটা ভালোই হবে।’

সংঘমিত্রা মনে হয় ভালো মেজাজেই ছিলো। বললো, ‘বেশ তো। আমরা ছবিতে থাকবো তো, গুহা আর আমরা সবাই।’

সুফী বললো, ‘মুখ গোমড়া করে থাকলে কিন্তু বাদ দিয়ে দেব।’ ক্লিক করলো ক্যামেরা।

‘থ্যাংক ইউ’, ড. গুপ্ত বললেন, ‘এসো এবার তোমার ছবি তুলে দিই তোমার ক্যামেরায়।’

সুফী দাঁড়ালো সাতাশ নম্বর গুহার সামনে।

ড. গুপ্ত বললেন, ‘সংঘমিত্রা তুমিও দাঁড়াও ওর সঙ্গে।’ ছবি তোলার ঠিক আগে আবার বললেন, ‘সংঘমিত্রা বেশি বেশি পোজ দিও না। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো।’

ওরা দুজনেই হেসে ফেললো। ছবিও উঠলো।

ক্যামেরা উলটে-পালটে দেখলেন ড. গুপ্ত। বললেন, ‘বেশ ভালো ক্যামেরা শুনেছি তোমার এই রোলিফ্লেক্স। কতোদিন ব্যবহার করছো এই ক্যামেরা?’

‘এই প্রথম। রোলিফ্লেক্স আমি কোথায় পাবো? আসলে এটা আমার খবরের কাগজের সম্পত্তি। সাংবাদিক হিসেবে যাচ্ছি বিদেশে। তাই আমাকে দেওয়া হলো। লেখার সঙ্গে সঙ্গে ছবিও যদি তুলতে পারি তাহলে প্রতিবেদনটা আরো জীবন্ত হবে তাই।’

ড. গুপ্ত বললেন, ‘তোমাদের খিদে পাচেছ না? চলো ফেরার পথে ইলোরা আর আওরঙ্গাবাদ দেখবো। পথেই খেয়ে নেব। রাত্রে বোম্বে মেইলটা ধরতেই হবে। আওরঙ্গাবাদেই খেয়ে নেওয়া যাবে। বড় শহর। ভালো খাবারের জায়গা থাকবেই।’

‘হ্যাঁ, তবে তার আগে পথে কোথাও একটু চা-টা হয়ে গেলে ভালোই হবে।’

 

ছয়

ফেরার পথে আরো কয়েকটা ছবি তুললো সুফী। ইলোরার পাহাড় কেটে হাতির ছবি আর কিছু ভাস্কর্যের। কিন্তু অজন্তার পর ইলোরা ওর কাছে অতো ভালো লাগলো না – যদিও দুটোর সৌন্দর্য দুরকমের। অজন্তার হাতে অাঁকা রঙিন ছবিগুলো অনেক জীবন্ত। বুদ্ধের ছবি ছাড়াও তখনকার  সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এগুলোতে তুলে ধরার চেষ্টা আছে। ইলোরার পাথর কেটে লীলায়িত ভঙ্গিতে নর্তকীর মূর্ত ভাস্কর্যগুলো ঠিক তখনকার দিনের সাধারণ মানুষের জীবনধারার সঙ্গে খাপ খায় না। দেখতে সুন্দর কিন্তু আপন বোধ তাতে নেই।

সংঘমিত্রাও সায় দিলো সুফীর অভিমতে।

আওরঙ্গাবাদ পৌঁছে চা খেলো ওরা। রেস্টুরেন্ট একেবারে সদর রাস্তার ধারে। প্রচুর ধুলো উড়িয়ে কতো লরি দৌড়ুচ্ছে। প্রত্যেকবার সংঘমিত্রা সুফীকে মনে করিয়ে দিচ্ছে পিরিচ দিয়ে চায়ের কাপ ঢাকতে হবে। তা নইলে রাস্তার ধুলোবালি চায়ের সঙ্গে পেটে যাবে। এ-রকম অভিজ্ঞতা সুফীর কখনো হয়নি।

আওরঙ্গজেবের কেল্লা পাহাড়ের ওপর দেখতে খুব চমকদার। কিন্তু ওরা সিঁড়ি বেয়ে উঠলো না। সবাই বেশ ক্লান্ত তখন। শুধু ছবিই তুললো। হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাত্রে বোম্বে মেইল ধরতে কোনো অসুবিধা হলো না।

বেশ সকালে বোম্বে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছলো।

ড. গুপ্ত বললেন, ‘আমি চার্চ গেটের কাছে থাকার বন্দোবস্ত করেছি। বোম্বে ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর ড. শ্রীবাস্তব আমার বন্ধু। উনি আমাকে তার বাড়িতে থাকতে বলেছেন। তিনি আমার জন্য গাড়ি পাঠাবেন বলেছিলেন।’

সংঘমিত্রা ঠিক করেছিলো ওর মামা সম্পর্কের এক পরিচিত নেপালি পরিবারের সঙ্গে থাকবে। তারা ডাক্তার স্বামী-স্ত্রী। জে. জে. হাসপাতালের ক্যাম্পাসে তারা থাকেন। ঠিকানা আছে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সে চলে যেতে পারবে।

সুফীকে যেতে হবে মেরিন ড্রাইভের কাছের একটা হোটেলে। ওর এডিটরের সাংবাদিক বন্ধু পিটিআইতে আছেন। তিনিই এই হোটেল ঠিক করে দিয়েছেন। একটা পারসি পরিবার এই ছোট হোটেলটি চালায়। ওকেও ট্যাক্সি নিতে হবে।

ড. গুপ্ত আবার বললেন, ‘কাল সকালে আমাদের সায়েন্স কংগ্রেসের উদ্বোধনী হবে। টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল স্টাডিজ বিল্ডিংয়ে। জানো তো এটা কোথায়? কোলাবায়। তোমরা দুজন তো আগে কখনো বোম্বে আসোনি। যা হোক, আজ রেস্ট নাও। অন্তত আমি তো নেবো। আমার শরীরটা বেশ ভালো ঠেকছে না। গলা খুশখুশ করছে, জ্বর-জবর লাগছে। …আমি চলি। কাল দেখা হবে।’

ট্যাক্সিতে ওঠার আগে সংঘমিত্রা সুফীকে বললো, ‘আমার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা লিখে নিন। আমার মনে হয় বাড়ি গিয়ে স্নান করে খেয়ে নিয়ে একটা ঘুম দেবো। আপনি কী করবেন?’

‘আমারও তাই। বিকেলবেলার দিকে চাঙ্গা হয়ে যাবো আবার আশা করি।’

‘তাহলে চারটার দিকে দেখা করা যাক একবার। তারপর দুজনে মিলে শহরটাকে দেখা দরকার। কংগ্রেস একবার শুরু হয়ে গেলে হয়তো সময় পাবো না। আমি বলি কি, বোম্বে শহরের নামকরা দ্রষ্টব্য জায়গা হচ্ছে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া। চারটার দিকে চলে আসেন সেখানে। তারপর দেখা যাবে কী করতে পারি দুজনে মিলে।’

‘আমি গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া চিনি না। তবে ছবি দেখেছি। ট্যাক্সিকে বললে হয়তো ঠিকই নিয়ে যাবে। তবে ওখানে কোথায় আপনার দেখা পাবো?’

‘সেটা তো আমিও জিজ্ঞেস করতে পারি। তবে আপনাকে দেখলে আমি চিনতে পারবো।’

‘আপনি আমাকে চিনতে পারবেন তো? মাত্র দুদিন আমাকে দেখছেন। হয়তো ভুলেও যেতে পারেন, তাই না?’

‘তাহলে একটা কাজ করলে হয় না। আপনি নেপালের একটা ফ্ল্যাগ নিয়ে আসবেন।’

‘আপনি নেপালের ফ্ল্যাগ দেখেছেন? বলুন তো নেপালের ফ্ল্যাগের একটা বিশেষত্ব কী? পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ফ্ল্যাগে সেটা নেই।’

‘তা তো জানি না।’

‘নেপালের ফ্ল্যাগ পাঁচ কোনা। দেখলেই চেনা যাবে। কোনোদিন ভুলতে পারবেন না। আপনিও আপনার দেশের ফ্ল্যাগ আনবেন তো?’

‘ঝামেলায় পড়া গেল। কে জানতো বিদেশে গেলে নিজের দেশের ফ্ল্যাগ নিয়ে যাওয়া উচিত।’

‘আচ্ছা ফ্ল্যাগ যখন নেই, তখন আপনার ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে আসতে ভুলবেন না। আমি আপনাকে ঠিকই খুঁজে নেব। আর আমাকে যদি না দেখতে পান তাহলে খুব জোরে জোরে আমার নাম ধরে চেঁচাবেন। বোম্বে শহরে যেখানেই থাকি আপনার চিৎকার শুনতে পাই যাতে। তাহলে আপনাকে পুলিশে ধরার আগেই আমি ধরে              ফেলবো।’

‘বেশ তাহলে আজ বিকেল ৪টার দিকে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়াতে দেখা হবে।’

 

সাত

বিকাল ৪টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সুফী দেখলো হলুদ শাড়ি পরা মেয়েটা বাস থেকে নামলো। দেখে প্রথমেই সুফী ওকে চিনতে পারেনি। সংঘমিত্রাকে এ-রকম রূপে আগে কখনো দেখেনি। ট্রেনে দুরাত আর দিনে অজন্তা ইলোরার মাঝে একদিন ওকে দেখেছে। বেশ কাছে থেকে এখনকার দেখা আগের থেকে আলাদা। আর একটু কাছে হেঁটে এলো মেয়েটি। হলুদ শাড়িটায় খুব মানিয়েছে। হয়তো গোসল করেছে দিনে। বোধহয় একটু ঘুমিয়েছে। আরো কাছে এলে মনে হলো, এমন কিছু প্রসাধন করেনি কিন্তু তবু কী রকম একটা ভালো লাগা ভাব মেয়েটিকে ঘিরে রেখেছে। সংঘমিত্রাও সুফীকে দেখেছে।

হাত নাড়লো। বললো, ‘আরে আপনি দেখছি আমার আগেই এসে গেছেন। আমি ভাবছিলাম আপনাকে হারিয়ে দেবো। কিন্তু হলো না আর। আপনাকে আজ বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে কিন্তু। আপনার এই নীল চেক শার্টটা বেশ মানিয়েছে। স্নান করেছেন তো, আর দিনের বেলা একটু ঘুমিয়ে ছিলেন নিশ্চয়ই। তা নইলে এতো ফ্রেশ দেখাচ্ছে কেন?’ একনাগাড়ে বলে গেলো সংঘমিত্রা, ‘ট্রেনে আপনাকে দুদিন দেখেছি। তখন কিন্তু সর্বদা আপনাকে সবসময় ক্লান্ত লাগতো। এখনকার মতো না।’

সংঘমিত্রা একটা সবুজ টিপ পরেছে কপালে। কিন্তু হলুদ শাড়ি আর সবুজ টিপ, রংটা ঠিক যায় কি? আচ্ছা ব্লাউজটা সবুজ, সেজন্যেই সবুজ টিপ। রং দুটো যায় কিনা সেটা কে বিচার করবে? যে পরেছে তাকে সুন্দর লাগলেই তো হলো।

সংঘমিত্রা জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কতোক্ষণ আগে এসেছেন? আমার দেরি হয়ে গেল।’

‘দেরি কোথায়? ৪টার ঠিক আগেই তো পৌঁছেছেন। আমি ট্যাক্সি নিয়েছিলাম। কারণ জায়গাটা আগে তো দেখিনি। জানতাম না কতোক্ষণ লাগবে। ট্যাক্সিতে চট করে এসে গেলাম। প্রায় আধঘণ্টা আগে। তাই একলাই ঘুরেফিরে দেখছিলাম এই গেটওয়েটা। আর সমুদ্রের ধারের এই আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিলাম।’

‘আমি যেখানে উঠেছি – আমার মামা সম্পর্কের ডাক্তার, তাঁর ফ্ল্যাটে। তিনি বললেন, সবচেয়ে সস্তা আর তাড়াতাড়ি হবে প্রথমে জে. জে. হসপিটাল থেকে ট্রেন নিয়ে চার্চ গেটে যাওয়া। আর সেখান থেকে বারো নম্বর বাস সোজা এই গেটওয়ের কাছে আসে। সময় একটু বেশি নিলো। কিন্তু সত্যিই বেশ সস্তা। পাঁচ রুপির মতো পড়লো।’

সংঘমিত্রা এতক্ষণ হালকা গলায় কথা বলছিলো। হঠাৎ তার গলার স্বর বদলে গেল। সুফীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি এতো ঘন-ঘন আমার কপালের দিকে চাইছেন কেন? হলুদ শাড়ি আর সবুজ ব্লাউজের সঙ্গে সবুজ টিপ যায় না?’

আমতা আমতা করে সুফী জবাব দিলো, ‘তা কেন? বেশ লাগছে। খুব সুন্দর লাগছে।’

‘হলুদ চাঁপা ফুল যখন ফোটে গাছে তখন সবুজ পাতার সঙ্গে সুন্দর লাগে না? হলুদ করবীর সঙ্গে গাছের সবুজ পাতা দেখেননি? ব্রাজিলের পতাকা দেখেছেন? তাতে সবুজের সঙ্গে হলুদ আছে পাশাপাশি। এজন্যই তো ওদের কেউ ফুটবলে হারাতে পারে না। আর রংধনুতেও ঠিক সবুজের পাশে আছে হলুদ।’

‘আমি তো বললাম আপনাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। হলুদ আর সবুজ সত্যিই একটা মিষ্টি কম্বিনেশন। আপনার জন্য।’

‘ও শুধু আমার জন্য! এই যে এতোগুলো উদাহরণ দিলাম, তাতেও আপনার সন্দেহ গেল না? আরো উদাহরণ দিতে হবে? কাঁঠাল ভালো লাগে আপনার? কাঁঠালের রসের শরবত একেবারে হলুদ। তাতে কুচি কুচি করে সবুজ পেস্তা দিয়ে খেতে যা মজা। আমার মা বানাতেন। এখনো স্বাদ লেগে আছে জিভে। আমি কখনো পারলাম না অমন করে শরবত বানাতে।’ ওর গলাটা ধরে এলো একটু।

কিছুক্ষণ ওরা আর কথা বললো না। একটু পরে সংঘমিত্রা নিজেই বললো, ‘আমার বাবা-মা ছোটবেলায় মারা যান। যদিও আমি লেখাপড়ার জন্য বাড়ির বাইরেই থেকেছি অনেক বছর।’

সংঘমিত্রা আর কিছু বলতে চাইলো না তক্ষুনি। তাই সুফীও চুপ করে রইলো। ওরা দুজনে কিছুক্ষণ পাশাপাশি হাঁটলো সমুদ্রের ধারে। বেশ ভিড়। অনেক লোকজন হাঁটছিলো ওদের মতোই। ওরা হারিয়ে রইলো ওদের মাঝে।

সংঘমিত্রা বললো, ‘আপনার ক্যামেরা কোথায়? আনেননি?’

‘না, আনলাম না। ফিল্ম ফুরিয়ে গেছে। এখানে কোথায় ফিল্ম পাবো জানতাম না। তাই।’

রাস্তার ওপাশে একটা বড় প্রাসাদের মতো বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে সুফী জিজ্ঞেস করলো, ‘ওই বাড়িটা বেশ বড়। জানেন ওটা কী?’

সংঘমিত্রা বললো, ‘ওটা তো তাজমহল হোটেল। ছবিতে দেখেছি। চলুন না একবার এক্সপ্লোর করে দেখি।’

‘আমরা তো ওখানে থাকি না। আমাদের ওখানে ঢুকতে দেবে ওরা?’

‘দেবে না কেন? অবশ্য এমন ভাব দেখাতে হবে যেন আমরা ওখানে থাকি। না হয় হোটেলটা আমাদেরই সম্পত্তি। যেতে চান একবার? তাহলে যা বললাম, আমার সঙ্গে সঙ্গে চলুন। নিজের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন এ-রকম ভাব দেখাতে হবে। নার্ভাস হবেন না।’

বিকেলের ট্রাফিক জ্যাম আস্তে আস্তে বেশি হতে শুরু করেছে। সাবধানে রাস্তা পার হতে হলো। উর্দিপরা দারোয়ান দরজা খুলে দিলো। লবিতে ঢুকলো ওরা। এ-রকম রাজকীয় ব্যাপার সুফী জীবনে কখনো দেখেনি। কতো লোকজন। সবাই ফিটফাট। পোশাকে চলাফেরায় ওদের চাইতে অনেক স্মার্ট। আসছে-যাচ্ছে কিন্তু কেউ বোধহয় ওদের দিকে লক্ষ করছে না। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।

সংঘমিত্রা সুফীকে বললো, ‘আচ্ছা, আমার হাত ধরে থাকুন। ওরা যাতে মনে করে আমরা দুজন একসঙ্গে আছি। আমি বুঝতে পারছি আপনি এখনো বেশ সহজ হতে পারছেন না।… আচ্ছা ওই বড় দোকানের কাচের সামনে দেখুন তো – সুন্দর সুন্দর স্যুট আর শার্ট টাঙানো আছে। আর তার পাশের জানালায় আছে কতো সুন্দর শাড়ি পরা ম্যানিকিন। চলুন দেখা যাক আমাদের কোনটা পছন্দ হয়।’

সংঘমিত্রার আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে নিয়ে সুফীর সাহস অনেকটা ফিরে এলো। সেই কাপড়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো ওরা।

‘আচ্ছা এই চারকোল গ্রে স্যুটটা আপনার পছন্দ হয়? রং দেখে মনে হয় আরো অনেক বয়সের লোকের এটা মানাবে। আপনার জন্য হয়তো ওটা ঠিক নয়। দাম কতো দেখতে পাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ, লেখা আছে দেখছি বারো হাজার টাকা। মাত্র বারো হাজার! রংটা আরো একটু হালকা হলে আমি কিনেই ফেলতাম। দাম আর কী এমন, আমার ছয়মাসের বেতনের মতো হবে।’

‘চলুন, ওই শাড়িটা দেখি। মনে হচ্ছে মাইশোর সিল্কের তৈরি। দাম লেখা আছে পনেরো হাজার রুপি। আমারও রংটা পছন্দ নয়। একেবারে ক্যাটকেটে নীল। না, এদের খুবই রুচির অভাব। তাই না?’

হাত ধরাধরি করে ওরা দুজন সব দোকান দেখতে লাগলো কিন্তু কোনো জিনিসই ওদের পছন্দ হলো না। দাম নিয়ে যেন ওদের কোনো চিন্তাই নেই, শুধু দোকানিদের একদম সৌন্দর্যবোধ নেই। স্টাইল কাকে বলে তারা তা মোটেই জানে না। রুচি বিষয়টা কি টাকা দিয়ে কেনা যায়?

সংঘমিত্রার হাত ধরে বড়দের এ-রকম খেলায় বেশ মজাই লাগতে লাগলো সুফীর।

‘এই দোকানটা দেখা যাক, দেখুন কতো রকমারি গয়না। এই হীরার আংটিটা মোটামুটি ভালোই লাগছে। বলছে, হীরার ওজন দুই ক্যারাট। প্লাটিনাম দিয়ে তৈরি আংটিটা। দাম দশ লাখ রুপি। না, সবসুদ্ধ আমার পছন্দ নয়। হীরাটা মনে হচ্ছে একেবারে ক্লিয়ার না, ইনক্লুশন আছে ভেতরে। দুই লাখ রুপি কম করলে না হয় দেখা যেত। কিন্তু দরজার ওপর লেখা আছে ফিক্সড প্রাইস। অতএব এরা একজন ক্রেতা হারালো।’

এসব দোকান দেখতে দেখতে করিডোরের শেষ প্রান্তে চলে এলো ওরা। সেখানে একটা বইয়ের দোকান। বেশ বড় দোকান। প্রচুর বই কিন্তু খুব বেশি লোকজন নেই দোকানে।

সংঘমিত্রা বললো, ‘এবার আমার হাত ছেড়ে দিন। আমি নিজে নিজে একটু ঘুরে বেড়াতে চাই এই বইগুলোর মাঝে। দেখি কিছু পছন্দের পাওয়া যায় কিনা।’

ওরা দুজনে নিজের ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে লাগলো। একসঙ্গে, কিন্তু আলাদা আলাদা। এতক্ষণ দামি-দামি কাপড়, শাড়ি আর গয়নার দোকান দেখে-দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো দুজনেই।

ঘুরতে ঘুরতে সুফী একটা পছন্দের বই পেলো। রুমির কবিতার বই একটা। ইংরেজিতে অনুবাদ করা আর তার প্রিফেস লিখেছেন আনমারি শিম্মেল। ওটা কিনে নিয়ে সুফী খুঁজছিলো সংঘমিত্রাকে। পাশেই একদিকে গানের ক্যাসেট টেপগুলো। সংঘমিত্রা সেখানে নিবিষ্টচিত্তে ওগুলো দেখছে।

‘আপনার জন্য এই বইটা কিনলাম। রুমির বই। ভালো লাগবে হয়তো।’

সংঘমিত্রার চোখ দুটো বড়-বড় হয়ে গেলো। একটা স্মিত হাসির রেখা ওর দুই গালের পাশে খেলা করলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, ‘আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না, আপনি কী করে জানলেন রুমি আমার প্রিয় কবি? যদিও বেশি পড়িনি। সত্যি-সত্যি এটা আমার জন্য কিনেছেন? একটু আগেই ভাবছিলাম রুমির বই পেলে আমি কিনবোই।… ধন্যবাদ দিতে হবে নাকি?’

সংঘমিত্রা ততোক্ষণে বইটিকে বুকের ওপর দুহাত দিয়ে চেপে ধরে বললো, ‘এই হাজারো বইয়ের ভেতর আমি যে বইয়ের খোঁজ করছিলাম সেইটাই আপনি কেমন করে বেছে নিলেন?’

সুফী বললো, ‘আমি নিজেও কবিতা লিখি কিনা, বোধহয় সেজন্য। আমি ঠিকই বুঝেছিলাম আপনার ভালো লাগবে। তিনদিন ধরে আপনাকে দেখছি তো।’

‘আপনি কবিতা লেখেন? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি একজন কাঠখোট্টা সাংবাদিক। এখন দেখছি একজন ছুপে রুস্তম।’

সুফী বলেই ফেললো। নিজেকে আর আটকাতে পারলো না, ‘আমার তিনটি কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। আর একটা উপন্যাস।’

‘বলেন কী, আমি একজন পাবলিশড পোয়েট আর অথরের সঙ্গে কথা বলছি। আরো কিছু আছে যা আমাকে এখনো বলেননি?’

সুফী আবার বললো, ‘আমার একটা কবিতার বই আমাদের দেশের একটা বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে গত বছর।’

‘কনগ্র্যাচুলেশন! আপনি আমাকে রুমির বই দিলেন। আমি আপনাকে কী দেবো?… আপনি নিশ্চয়ই গান ভালোবাসেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত, তাই না? তাহলে আমি আপনাকে এই গানের ক্যাসেট দেবো। এখানে বাংলা গানের ক্যাসেট পাবো ভাবিনি। কিন্তু এই দেখুন, একটা রবীন্দ্রসংগীতের সংকলন পেলাম।’

‘ধন্যবাদ’ বলে সুফী ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখতে লাগলো।

‘রবীন্দ্রনাথ শীত নিয়ে বেশি গান লেখেননি। এর প্রথম দুটো গানই শীতের। আর আমরা এখানে শীতের ঋতুতেই এসেছি, যদিও ঠান্ডা বেশি নেই।’ বললো সংঘমিত্রা।

সুফী ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে গানগুলোর নামের ওপর একটু চোখ বুলালো। তারপর আস্তে-আস্তে গাইলো, ‘একি মায়া, লুকাও কায়া, জীর্ণ শীতের সাজে, আমার সয় না, সয় না সয় না যে। এটা আমার বিশেষ প্রিয় গান।’

সংঘমিত্রা বললো, ‘আমরা ঘরের ভেতরে আছি বলে হয়তো ঠান্ডা লাগছে না। বাইরে দেখছি প্রায় অন্ধকার হয়ে গেছে। বেরিয়ে দেখা যাক, আবহাওয়াটা কী রকম। হোটেলটা আর ভালো লাগছে না।’

‘ওদিকে দেখছি একটা রেস্টুরেন্টের মতো। আমার একটু চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। এই অভিজাত হোটেলে চায়ের দাম নিশ্চয়ই বেশি বেশি হবে। কী দরকার? বেরিয়েই দেখা যাক নিশ্চয়ই আমাদের মতো সাধারণ লোকের জন্য জুতসই কিছু পাওয়া যাবে।’

কাছেই একটা ছোট ক্যাফে পাওয়া গেল। তারা কয়েকটা            টেবিল-চেয়ার ফুটপাতে এনে রেখেছে। দু-একজন বসে আছে সেখানে। ওরাও বসলো। দুই কাপ চা আর গোলগাপ্পা অর্ডার দিলো। ওয়েটার বললো, একটু দেরি হবে গোলগাপ্পার অর্ডারে। কারণ একেবারে টাটকা তৈরি করা হবে।

গানের ক্যাসেটটা বের করলো সুফী। বললো, ‘এই দুটো শীতের গানের মধ্যে কোনটা আপনার বেশি ভালো লাগে।’

সংঘমিত্রা বললো, ‘আমার বেশি ভালো লাগে প্রথম গানটা। একি মায়া, লুকাও কায়া, জীর্ণ শীতের সাজে। কথাগুলো কী সুন্দর! মহারাজ তোমার ভান্ডারে কতো বৈভব। তবু তুমি ভিখিরির মতো সেজে আছো। সয় না সয় না সয় না প্রাণে। আর আমরা যতো অন্তঃসারশূন্য মানুষ, আমরা ভান করি আমাদের থলি উপচে পড়ছে ঐশ্বর্যের আতিশয্যে। আমাদের পা মাটিতে পড়ে না আমাদের জ্ঞানের গরিমায়। মহারাজ যখন নিজের কায়া দৈন্যের সাজে লুকিয়ে রাখতে ব্যস্ত, আমরা সেখানে নিজেদের ময়ূরপুচ্ছে সাজিয়ে জাহির করতে ব্যস্ত।’

সংঘমিত্রা গুনগুন করে লাইন কটা গাইলো, ‘একি মায়া, লুকাও কায়া, জীর্ণ শীতের সাজে আমার সয় না সয় না সয় না প্রাণে, কিছুতে সয় না যে…’।

সুফী বললো, ‘আপনি বেশ সুন্দর গান করেন তো!’

‘বাবা পাঠিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। আশা করেছিলেন আমি ভালো গান করবো। কিন্তু আমি বেছে নিলাম নিউক্লিয়ার ফিজিক্স।’

‘হ্যাঁ, ফিজিক্স পড়ুন কিন্তু গান ছাড়বেন না।… আমার কিন্তু পরের গানটাই বেশি ভালো লাগে – শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে। আপনার পছন্দের গানের মতো অতো গভীর মর্মার্থ হয়তো এটাতে নেই। নিতান্তই শীতের প্রকৃতির একটা বিবরণ। তবে আমার বড় ভালো লাগে শুনতে।’

এবার সংঘমিত্রা গাইলো, ‘শীতের হাওয়ার লাগলো নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।/ পাতাগুলি শির্শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে\’ তারপর সুফীর দিকে তাকিয়ে রইলো জিজ্ঞাসুভাবে।

সুফী বললো, ‘আপনি দ্বিতীয় লাইনটা যখন গাইলেন তখন আমার ঘাড়ের পেছনে আবার একটু একটু কী যেন শিরশিরিয়ে উঠলো।’

সংঘমিত্রা গুনগুন গান থামিয়ে সুফীর দিকে আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, ‘আপনি কি মেয়েটিকে ভালোবাসতেন?’

সুফী কিছু বলার আগেই বললো, ‘আপনার সঙ্গে মাত্র তিনদিন দেখা। এর মধ্যে এ-রকম একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা উচিত হয়নি, তাই না? তবে কেন এ-রকম প্রশ্ন করলাম জানেন?’

‘কেন?’

‘আপনি শুনতে চান?… আমি যখন গুনগুন করে গাইছিলাম, তখন আপনার চোখে ক্ষণিকের জন্য একটা হারিয়ে যাওয়া ভাব দেখেছিলাম। এটা একটা মেয়ের চোখকে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। তবে আপনার গায়ে শিরশিরানি যে তৈরি করতো তার কথা আপনি যদি চান বলতে পারেন নির্ভয়ে।’

একটু থেমে একটু ভেবে সুফী বললো, ‘আপনি জিজ্ঞেস করছেন আমি মেয়েটিকে ভালোবাসতাম কিনা? না, ভালোবাসতাম বলতে পারবো না। ভালো লাগতো। ওইটুকুই। হয়তো সময় আর সুযোগ পেলে আরো এগোতে পারতাম। কিন্তু সেটা আর হয়নি।’

‘কেন, আপনি পছন্দ করতেন মেয়েটিকে কিন্তু সেটা ওকে বলেননি কখনো? কোথায় দেখা হলো ওর সঙ্গে?’

‘আমাদের ক্লাসেই পড়তো মেয়েটি।’

সংঘমিত্রা জিজ্ঞেস করলো, ‘ক্লাসে তার পাশে বসেননি?’

‘ওরে বাববা! আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ছিলো বড় কঠিন ব্যবস্থা। মেয়েদের জন্য ছিলো আলাদা জায়গা। একেবারে সামনের বেঞ্চে। মেয়েরা সংখ্যায় ছিলো হয়তো আট-দশজন। আর আমরা ছেলেরা প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন। বোঝেন কী রকম কম্পিটিশন। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মেয়েরা বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রফেসর যখন ক্লাসে ঢুকবেন, তাঁর সঙ্গে মেয়েরাও ঢুকবে। আর লেকচারের শেষে প্রফেসরের সঙ্গে মেয়েরাও বেরিয়ে যাবে। এ-রকম মধ্যযুগীয় নিয়মে অন্য মেয়ের পাশে বসার সুযোগ কোথায়?’

‘এ তো একেবারে হৃদয়বিদারক ব্যবস্থা!’

‘অবশ্য দু-একজন ছেলেমেয়ে ক্লাসের বাইরে যে মেলামেশা করতো না, তা নয়। প্রেম-ট্রেমও করতো। বিশেষ করে যারা ডিবেটিং বা ড্রামা সোসাইটিতে যোগ দিতো তারা অবশ্য এতো কড়াকড়ির বাইরে ছিলো।’

‘আর আপনি আপনার মানসীকে দূর থেকে দেখেই হা-হুতাশ করতেন? কবিতা লিখতেন না?’

‘তা লিখেছি কয়েকটা। এই বয়সে প্রেমে পড়ে বাংলাদেশের সব ছেলেমেয়েরা কবিতা লেখে। আমিও লিখতাম। কয়েকটা কয়েক বছর পর পড়েছি, যেগুলো খাতায় রয়ে গিয়েছিলো। এ-রকম নিকৃষ্ট ধরনের কবিতা আমি লিখতাম ভেবে এখন লজ্জা লাগে। ওই নিচু মানের কবিতা কোনো কাগজেই ছাপাতে রাজি হয়নি। সেজন্য সম্পাদকদের আমি এখন ধন্যবাদই দিই।’

‘কী নাম ছিলো মেয়েটির?’

‘ওই দেখুন, নামটিও ভুলে গেছি। অবশ্য নামে কী এসে-যায়।’

‘চাইলে আমাকে মেয়েটার সম্বন্ধে আরো কিছু বলুন। শুনতে মজা লাগছে। নামটাই বলতে পারলেন না এখনো। আরো একটু চিন্তা করুন। নাম মনে রাখাটা খুব দরকার। কী করে যে বলেন নামে কী এসে-যায়?’

‘আচ্ছা মনে পড়েছে এবার। লামিয়া ছিলো মেয়েটার নাম। বাঙালি মেয়ের এ-রকম নাম কখনো শুনিনি। এটা একটা বিদেশি, তুর্কি কিংবা ফার্সি নাম। আর নামের মানেও জানি না। বড়োলোকের মেয়ে। আসতো-যেতো গাড়ি করে। আমাদের সঙ্গে কখনো ক্যান্টিনে খেতে যেতো না। ড্রাইভার বোধহয় বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতো আর নির্জনে বসে খেতো। কারোর দিকে ফিরেও তাকাতো না।’

‘একেবারে অ্যান্টিসোশ্যাল।’

‘তা ঠিকই বলেছেন। তবে দেখতে খুব সুন্দর ছিলো। আর অন্য ছেলেরাও ওর ব্যাপারে আমার মতো দূর থেকে হা-হুতাশ করতো।’

‘অন্যরাও কবিতা লিখতো নাকি?’

সুফী হেসে ফেললো। বললো, ‘হয়তো তাই। হয়তো আমার চাইতেও নিকৃষ্টমানের কবিতা। শীতের শেষে গোটা ক্লাস মিলে পিকনিকে যেতাম। যাওয়ার জায়গা ছিলো একটাই – মধুপুরের জঙ্গল। এখন অবশ্য আরো অনেক পিকনিক স্পট হয়েছে। ও-রকম লালমাটির দেশ পূর্ববঙ্গে আর কোথাও নেই। তাই এখানে আছে বিস্তীর্ণ শালবন। আর শীতের শেষে লাল পলাশ, শিমুল ফুটতো প্রচুর। আবহাওয়া আর পরিবেশ ওই বয়সে এতো রোমান্টিক মনে হতো। ওখানে খেলা হতো, হুল্লোড় হতো, গান হতো। রান্নাবান্না আর খাওয়া-দাওয়া তো হতোই। কিন্তু লামিয়া আর দু-একটা মেয়ের সঙ্গে বসে নিজেদের মধ্যেই গল্পগুজব করতো। শুধু গান যখন শুরু হলো, তখন লামিয়া অন্য কয়েকটা মেয়ের অনুরোধে নিজে একটা গান করলো। শীতের এই গানটা – শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে। কী অপূর্ব যে লাগছিলো তখন। ওর গলাটা যে অতো মিষ্টি তা আমি আগে কখনো ভাবিনি। যখন সুর করে গাইছিলো হারমোনিয়াম বাজিয়ে, পাতাগুলি শির্শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে। তখন আমার বুকের ভেতরেও কী রকম শিরশিরিয়ে উঠলো। আমি তখন কোথায় – মধুপুরের জঙ্গলে না আর কোথাও হারিয়ে গেছি। এর পরেও তো কতোবার এই গানটা শুনেছি। কিন্তু সেবারের মতো কখনো বুকের মাঝে শিরশিরানি অনুভব করিনি।’

যে দুজন লোক বাইরের চেয়ার-টেবিলে বসে ওদের মতো চা খাচ্ছিলো, তারাও কিছুক্ষণ আগে উঠে চলে গেছে। এখন ওরা দুজন শুধু বাইরে বসে আছে।

সংঘমিত্রা চারদিকে একটু চেয়ে নিচু গলায় গাইলো, ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।/ পাতাগুলি শির্শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’

তারপর সুফীর দিকে চেয়ে একটু হেসে বললো, ‘শিরশিরানি অনুভব করলেন একটুও? নাকি একদম না?’

‘না সে-রকম কোনো শিরশিরানি বোধ হলো না। দুঃখিত।’

‘দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আফটার অল আমার নাম তো লামিয়া না।’

সংঘমিত্রার প্রশ্নের ধরন দেখেই সুফী বুঝতে পারলো, ও একটু প্রচ্ছন্ন ঠাট্টা করছে। একটু লেগ পুলিং।

বললো, ‘না, ও-রকম কিছু প্রতিক্রিয়া তো হলো না। যদিও আপনি গান করেন অনেক সুন্দর। তবে পরিবেশটা এখানে সম্পূর্ণ অন্য রকমের। শীতকাল বটে কিন্তু ঠান্ডাও সে-রকম পড়েনি। আমলকী গাছ ধারেকাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। পিচের রাস্তা। সেখানে অনেক মোটরগাড়ি চলছে। শিরশিরানি অনুভব করার মতো সুযোগ একদম নেই। তবে এটাও বলা যায় যে, এখানে এই শহুরে পরিবেশে বসে রবীন্দ্রনাথও এ-রকম একটা গান লিখতে পারতেন বলে আমার মনে হয় না। আপনার গাইবার কোনো দোষ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আপনি লামিয়ার চাইতে অনেক সুন্দর গান করেন।’

‘কিন্তু জীবনের এই প্রথম শিরশিরানির শেষ হলো কী করে? না, এখনো হয়নি?’

‘খুব সোজা। আমাদের দেশে এ-রকম প্রায়ই হয়। বেশ কিছুদিন লামিয়া ক্লাসে এলো না। পরে শুনলাম বিয়ে হয়ে গেছে খুব বড়োলোক একজন ব্যবসায়ী বরের সঙ্গে। পড়াশোনায় ইতি। ব্যস, এখন যখন নো ভ্যাকেন্সি তখন অন্য আরো ছেলেদের মতোই আমিও অন্যদিকে মন দিলাম।’

‘তারপর দ্বিতীয় বা তৃতীয় শিরশিরানি কবে হলো?’

সুফী কিছু বলার আগেই সংঘমিত্রা নিজেই বললো, ‘আচ্ছা আজ থাক এই পর্যন্ত। আপনাকে আর বিব্রত করতে চাই না।’

সুফী বললো, ‘বেশ তো। তবে পরের অধ্যায়ে যাওয়ার আগে আপনার শিরশিরানির কথা শুনতে হবে। নিশ্চয়ই হয়েছে আপনার জীবনে। বলবেন কি?’

একটুখানি ভাবলো সংঘমিত্রা। তারপর বললো, ‘আমার ঘটনা অতো সুখদায়ক নয়। আপনি যেমন সহজে বললেন আপনার শিরশিরানির অভিজ্ঞতা আমারটা বলতে গেলে ভাবতে গেলেও বেশ কষ্ট হয়। আমার মনে হয় ছেলেরা যতো সহজে এ-রকম মনের কথাগুলো চটপট ভুলে যেতে পারে, মেয়েরা ততো সহজে মন থেকে এগুলো মুছে দিতে পারে না। তাদের মনের ক্ষত অনেক গভীরে চলে যায়। বিশেষ করে এ-রকম অভিজ্ঞতা যদি একতরফা হয় তাহলে তার স্মৃতিচারণা খুবই বেদনাদায়ক হতে পারে। তাই এ-মুহূর্তে আমি মনের ক্ষতটাকে শুধু শুধু খোঁচাতে চাই না। আপনি জানতে চেয়েছেন তবুও। তবে আমরা তো আরো কয়েক দিন এখানে থাকবো। আবার দেখা হবে। নিশ্চয়ই। আরো সুযোগ আসবে এসব কথা বলার। বলবো, সবই বলবো। শুধু আজ থাক। আজকের সুন্দর সন্ধ্যাটা আমি উপভোগ করতে চাই।… আচ্ছা আপনার বাড়ির কথা বলুন না? কে কে আছেন দেশে আপনার? ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার দিনগুলোর কথা। আর তারপর কী করে গেলেন খবরের কাগজে?’

 

আট

‘ইউনিভার্সিটিতে প্রথমে কেমিস্ট্রি পড়ছিলাম বাবা-মায়ের চাপে। মন ছিলো না পড়াশোনায়। বিএসসি পরীক্ষা দিলাম না। অথচ আমি ছাত্র ভালোই ছিলাম। আমার ঝোঁক তখন সাহিত্যে – কবিতা আর গল্প লেখা নিয়ে। সবই বাংলায়। কিন্তু এগুলো নিয়ে তো আমাদের দেশে অন্নসংস্থান সম্ভব নয়। তাই ঢুকে পড়লাম জার্নালিজম বিভাগে। আমি মনে-মনে আমার ভবিষ্যৎ পথ ঠিক করে ফেলেছি। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নিয়ে অন্তত কিছু রোজগার করতে পারবো। আর আমার লেখালেখির কাজও চালাতে পারবো। এই সাংবাদিকতা বেছে নেওয়ার ব্যাপারে আমাকে নৈতিক সাহায্য জুগিয়েছিলেন আমার ওয়াহাব চাচা। আবদুল ওয়াহাব প্রবীণ সাংবাদিক, আমার বাবার বন্ধু। দেশবিভাগের আগে কলকাতার স্টেটসম্যান কাগজে কাজ করতেন। ঢাকায় এসে স্টেটসম্যানের প্রতিনিধি ছিলেন। কোনো খবরের কাগজে নিয়মিত চাকরি করতেন না। একেবারে ফ্রি-ল্যান্সার ছিলেন। আমার আগ্রহের কথা শুনে তিনিই আমার বাবাকে রাজি করালেন এই লাইনে যেতে। বাবা-মা মনে খুব কষ্ট পেলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন, এ ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’

‘আপনার আর ভাইবোন নেই?’

‘হ্যাঁ, বড়বোন ডাক্তার আর ছোটভাই ইঞ্জিনিয়ার। দুজনেই বিবাহিত। আর ছোটবোনটা মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। আমাদের পরিবারের মধ্যে ওই শিখার সঙ্গেই আমার সবচাইতে বেশি বনে। আমার মনের কথাগুলো ওকেই বলা যায়। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সবচাইতে নিরাপদ পেশা। আমাদের পরিবারে আমিই একমাত্র কুলাঙ্গার। আমার বাবা-মা দুজনেই এখন অবসরপ্রাপ্ত। বাবা ছিলেন উকিল। আর মা স্কুলে পড়ানোতে ইস্তফা দিয়েছেন। আর এক কাপ চা খাবেন? সত্যি বলতে কি, আমার আজ এখান থেকে উঠে যাওয়ার ইচ্ছে করছে না। এসব কথা বলতে শুনতে ভালোই লাগছে।’

নতুন করে দুকাপ চা এলো।

সংঘমিত্রা বললো, ‘প্রথমে আমি ভাবছিলাম আপনার ভাবসাব দেখে যে আপনি খুব লাজুক মানুষ। জোর করে পেট থেকে কথা বের করতে হবে। কিন্তু এখন দেখছি আপনি অনেক সহজ হয়ে গেছেন। নিজে থেকেই কথা বলছেন। ভালোই।’

‘তাই নাকি? তবে একটা কথা বলি। আপনার নামটা কিন্তু বেশি ভারী। বেশ এনার্জি খরচ হয় সংঘমিত্রা পুরোটা উচ্চারণ করতে। এটাকে ছোট করে মিত্রা করলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?’

‘মোটেই না। তবে একটা শর্তে। মিত্রা বলে ডাকলে আমাকে আর আপনি বলা যাবে না। তুমি বলতে হবে। ঠিক আছে?’

‘বেশ তো। শর্তটা মানা খুব সহজ। তাহলে আমরা দুজনে বন্ধু। তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।’

সুফী হাত বাড়িয়ে দিলো। মিত্রাও হাসিমুখে হাত মেলালো।

মিত্রা বললো, ‘তুমি আমাকে আমার প্রিয় কবি রুমির কবিতার বই দিলে। আর তুমিও তো কবি। আমার অন্য প্রিয় সুফী কবি হলো হাফিজ। কিন্তু রুমি নামটা হাফিজের চেয়ে ছোট। আর কেমন একটা ঘরোয়া ভাব আছে এতে। তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে রুমি বলেই ডাকবো এখন থেকে। শুধু আমি না, সবাই তোমাকে রুমি বলবে।’

‘ঠিক আছে। তবে আমি রুমি হবো শুধু তোমার কাছে – অন্য কারোর কাছে নয়। কিন্তু এ যে অনেকটা শেষের কবিতার মতো হয়ে গেল। আমরা দুজনে দুজনার নাম বদলে দিলাম। এখন শেষটা শেষের কবিতার মতো না হলেই হলো।’

‘কেন? শেষের কবিতার শেষটা তোমার পছন্দ নয়? আমার তো মনে হয় গল্পের শেষটা আর অন্য কোনো রকম হলে কারুরই হয়তো ভালো লাগতো না। তোমারও না।’

‘হয়তো ঠিকই বলেছো। তবু শেষের কবিতার শেষ কথা – ‘হে বন্ধু বিদায়’ কথাটাতে যে একরকম ফাইনালিটির রেশ আছে, আমাদের বাস্তব জীবনে সেটা যেন কবিত্বের মোলায়েম ভাবটা বয়ে আনে না। বরং একটা কঠিন রূঢ় ধাক্কার মতো মনে হয়।’

‘আমি বলি কি – মাত্র চারদিন আমাদের দেখা হয়েছে। এরই মধ্যে শেষ বিদায়ের কথাটা কী হবে, কী হবে না ভেবে, আরো কতো কথা তার আগে থাকতে পারে সেগুলো ভাবলে অনেক ভালো লাগবে। আগামীকাল সকালের কথাই মনে করো। সকালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনীর বক্তৃতার পর শুরু হবে আমাদের প্রথম সায়েন্টিফিক সেশন। সেখানে সভাপতিত্ব করবেন পল ডিরাক। আমাদের পেপারটা পড়তে হবে।’

‘আচ্ছা, পল ডিরাকের নামটা যেভাবে তুমি করলে মনে হচ্ছে একজন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী তিনি। কিন্তু আমি তো কিছুই জানি না তাঁর সম্বন্ধে। একটু বলবে তাঁর সম্বন্ধে আমাকে? যাতে আমি আমার খবরের কাগজের জন্য লিখতে পারি।’

মিত্রার মুখে একটু দুষ্টু হাসি এসে গেল যেন। বললো, ‘আমি কেন বলবো? তুমি জানো না, সেটা তো তোমার দোষ। তুমি একজন জার্নালিস্ট। এসব খবর তোমারই খুঁজে পেতে বের করা উচিত। আমি কেন বলতে যাবো?’

‘মহামুশকিল। সময় কোথায় বইপত্র পড়ে সব খবর জানার। কাল সকালেই তো আমাকে লিখতে হবে।’

‘সে তোমার সমস্যা। আচ্ছা, তুমি দেখতে পাচ্ছো রাস্তার ওপাশে সমুদ্রের ধারে একটা ক্লাবঘরের মতো যেটা, সেখানে কতো রঙিন বাতি জ্বলছে এখন। বেশকিছু লোক অনেকে জোড়ায় জোড়ায় ওদিকেই যাচ্ছে। একটা উৎসব উৎসব ভাব।’

‘তোমার বুঝি যেতে ইচ্ছে করছে ওখানে?’

‘তা একটু যে করছে না তা বলতে পারি না।’

মিত্রা এবার সুফীর হাত ধরে বললো, ‘চলোই না। দেখা যাক কী ব্যাপার। তুমি নাচতে পারো?’

‘না, জীবনে কখনো চেষ্টা করিনি। এ-বয়সে শুরু করতে গেলে লোকে হাসবে।’

রাস্তার ওপাশে ক্লাবঘরটার মতো জায়গায় যে গানবাজনা শুরু হয়েছিলো কিছুক্ষণ আগে, অন্ধকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা আরো জমে উঠেছে। সমুদ্রের ধারে অনেক লাল, নীল আলোয় ঘেরা একটা উৎসবের সমাবেশ।

বিল চুকিয়ে সুফী বললো, ‘চলো ওদিকে একটু ঢুঁ মারি। ঢুকতে হয়তো পারবো না কিন্তু কৌতূহল হচ্ছে জানার জন্য ব্যাপারটা কী?’

রাস্তা পার হওয়ার জন্য ওরা দুজনে ফুটপাতের পাশে দাঁড়ালো। বেশ ট্রাফিক জ্যাম – অফিসফেরতা গাড়ির ভিড়। তাছাড়া সমুদ্রের ধারে বেড়ানোর জন্য দলে-দলে অনেকে বেরিয়েছে।

সুফী ভাবছিলো রাস্তাটা পার হবে কেমন করে। ও ইতস্তত করছিলো দেখে মিত্রা বললো, ‘আমার হাত ধরো। আমার সঙ্গে এসো। ওরা একজনকে চাপা দিতে পারে কিন্তু দুজনকে একসঙ্গে চাপা দেবে না। এসো।’

ওরা হাত ধরাধরি করে রাস্তা পার হলো।

 

নয়

ক্লাবঘরের গেটের বাইরে একটা বক্স অফিসের মতো ঘর। ওরা ঢোকার জন্য তৈরি হয়ে সেখানে দাঁড়াতেই একটা উর্দিপরা লোক জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনারা আমাদের মেম্বার? কার্ড এনেছেন?’

‘না, আমরা মেম্বার না। বিদেশ থেকে এসেছি।’

‘সরি, আমাদের অনুষ্ঠান শুধু মেম্বারদের জন্য।’

ওরা পাশে সরে দাঁড়ালো। আরো কয়েকজন ওদের পেছনে লাইন করে দাঁড়িয়ে গেছে।

একজন টাক মাথাওয়ালা বয়স্ক লোক সুফীর কাঁধে টোকা দিয়ে বললো, ‘এক্সকিউজ মি, আপনারা বিদেশ থেকে এসেছেন বললেন। আর আমাদের ক্লাবের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চান? কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?’

টাকওয়ালা ভদ্রলোকের বয়স ভালোই হয়েছে মনে হলো, প্রায় সত্তরের মতো। কিন্তু বেশ ঋজু কাঠামো শরীরের। মুখে আভিজাত্যের ছাপ। হাতে একটা ছোট ছড়ি। তাঁর সঙ্গে ভদ্রমহিলাও বেশ বয়স্ক। মাথায় কাঁচাপাকা চুল, স্লিম চেহারা। লাল শাড়ি পরা ভদ্রমহিলার হাবভাবে একটা নানি-দাদির ছাপ স্পষ্ট।

সুফী বললো, ‘আমি এসেছি ঢাকা থেকে। আর আমার বন্ধু নেপালের। আমরা বোম্বেতে এসেছি সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ দিতে। আজকেই আমাদের প্রথম দিন এ-শহরে।’

‘বেশ ভালোই হলো তাহলে। আপনারা দুজনেই বিদেশি। আপনারা যদি চান আপনাদের আমি এই ক্লাবের গেস্ট হিসেবে নিতে পারবো। শুনলেনই তো এ-ক্লাবের অনুষ্ঠানে অ-সভ্যরা ঢুকতে পারবেন না। আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন সায়েন্স কংগ্রেসে যোগ দিতে। অতএব আপনাদের নিমন্ত্রণ জানানো আমার কর্তব্য।’ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন তিনি।

ভদ্রলোকের এতো আন্তরিক ব্যবহার দেখে ওরা দুজন বেশ খুশি হলো। আর একটু সংকোচও লাগলো ওদের মনে। ওদের দুজনকে তিনি নিয়ে এলেন সেই অফিসের সামনে। বললেন, ‘মেহতা, আমি দুজন বিদেশি গেস্ট নিয়ে এসেছি। একজন ঢাকা থেকে আরেকজন কাঠমান্ডু থেকে। এঁদের কি গেস্ট বইতে সই করতে হবে?’

‘ওয়েলকাম ব্রিগেডিয়ার সাহেব। গুড ইভনিং। ওনারা যখন আপনার গেস্ট আর আজকের অনুষ্ঠানও যেহেতু আপনাদের তাই ওঁদের আর সই করতে হবে না। আপনাদের জন্য আমি হাই টেবিলে জায়গা করে দিচ্ছি।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘চলুন আমার সঙ্গে। আমরা আরাম করে বসি। তারপর আলাপ হবে।’

একটা আলাদা বড় টেবিলে তাঁরা বসলেন। সংঘমিত্রা ভদ্রমহিলার পাশে আর সুফী ব্রিগেডিয়ারের পাশে।

‘আমার নাম রমেশ মেহতা আর আমার স্ত্রী অরুণা। আমরা দুজনেই গুজরাটের মানুষ। আমি আর্মি থেকে কয়েক বছর আগে রিটায়ার করেছি। এখন আমি জেন্টলম্যান অ্যাট লেজার।’

অরুণা বললেন, ‘আমি হাউসওয়াইফ। তাই কোনোদিন রিটায়ার করবো না।’

ওরা দুজনে নিজেদের নাম আর কী তাদের কাজ তাও বললো – ‘কলকাতা থেকে আমরা ট্রেনে রওনা দিয়েছি। আর ট্রেনেই আমাদের দেখা। মাত্র চারদিন আগেও আমাদের অস্তিত্ব দুজনের কাছে একেবারেই অজানা ছিলো।’

ব্রিগেডিয়ার সাহেব আর অরুণা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার তো! জানো, আজ আমাদের পঁয়ত্রিশতম ম্যারেজ অ্যানিভারসারি। আমার সঙ্গে অরুণার দেখা হয়েছিলো পঁয়ত্রিশ বছর আগে ট্রেনে। আমি যাচ্ছিলাম ঢাকা থেকে শিলং। সিলেট পর্যন্ত ট্রেনে। তারপর গাড়িতে যেতে হবে ডাউকি হয়ে। আর অরুণা যাচ্ছিল কলকাতা থেকে শিলং ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে। এই ঢাকাতেই ট্রেনে ওকে প্রথম দেখলাম। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গেও আলাপ হলো।’

সুফী বললো, ‘আপনি চারদিনের বিবরণ প্রায় চারটি বাক্যেই শেষ করলেন। বুঝতেই পারছি এগুলো আপনার নিজস্ব ব্যাপার। তবে আপনাকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতে পারি আপনি ঢাকায় কী করে গেলেন। কী সূত্রে, অতো বছর আগে?’

‘আমি স্যান্ডহার্স্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন পেলাম ১৯২৬ সালে। তারপর ১৯২৭ সালে আমার পোস্টিং হলো ঢাকায় লেফটেন্যান্ট হিসেবে। আমি তখন তরুণ আর্মি অফিসার। বিয়ে করিনি। আমাকে থাকতে দেওয়া হলো ঢাকা ক্লাবে। তখন সেখানকার মেম্বার সবাই ব্রিটিশ বা অন্য ইউরোপিয়ান। আমার মতো কালো কেউ ছিলো না। একটা গুর্খা রেজিমেন্টের সঙ্গে আমি যুক্ত। আর একজন মেজর, ব্রিটিশ অবশ্যই। আমরা দুজন অফিসার।’

‘এতো বছর আগে ঢাকা কেমন ছিলো আমার ধারণাতেই নেই। শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।’

‘হ্যাঁ, ধীরে-সুস্থে বলছি। তার আগে বলো তোমরা কী পানীয় খাবে?’

অরুণা বললেন, ‘আমি নিজে এখানকার লিম্বু পানি সবসময় শখ করে খাই। জলজিরা দিয়ে লিম্বু পানিটা খুব ভালো বানায় এখানে। যদিও এটা গরমের পানীয়, তবু আমি সারাবছর ধরেই খাই।’

মিত্রা বললো, ‘আমিও তাই খাবো। যদিও আমরা একটু আগেই চা খেয়ে এসেছি। আর সুফীকে কোনো চয়েস দেব না। ওকেও লিম্বু পানি খেতে হবে।’

সুফী হাসলো শুধু। বললো, ‘তাই সই।’

অরুণা আবার বললেন, ‘অবশ্য রমেশ ওর বাঁধা ড্রিংক এখন খাবেন – বরফ দিয়ে হুইস্কি। তাই না?’

রমেশ বললেন, ‘যাক, পানীয়র ব্যাপার তো ঠিক হলো। একটু পরে যখন খিদেটা পাবে তখন আমাদের আরেকটা ডিসিশন নিতে হবে – ডিনারে কী খাবে? সে পরের কথা দেখা যাবে পরে।’

সুফীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি জিজ্ঞেস করছিলে তখনকার ঢাকা কেমন ছিলো? আমি ছিলাম ঢাকা ক্লাবে। একাই তো ছিলাম, ভালোই লাগতো। আমি তখন স্যান্ডহার্স্ট থেকে পাশ করা নতুন কমিশন নিয়ে এসেছি। নিজেকে একটা কেউকেটা বলেই মনে হতো। মনে করো স্যান্ডহার্স্টে থাকার সময় আমার বয়স তখন কুড়ি বাইশের মতো। আমাদের মাথায় সে-সময় ঢুকিয়ে দেওয়া হতো যে, আমরা শুধু ভারতের নয়, গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন সেরা মানুষ। আমাদের দায়িত্ব অনেক। সারাজীবন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে অনেক দায় আমাদের কাঁধে নিয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের নিচে যারা আছে তারা অনেক আশা নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের নিরাশ করলে চলবে না। এসব বড়-বড় কথা বারবার এমনভাবে বলা হতো যে, এগুলো আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে যেতো। এসব বিশ্বাস না করে উপায় ছিলো না। আমাদের চলাফেরায়, কথাবার্তায় আর খাকি উর্দিপরা চেহারায় এই এলিটিস্ট ভাবটা আপনাতেই ফুটে্উঠতো। আগেই বলেছি, আমার প্রথম পোস্টিং হলো ঢাকায়। গুর্খা রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে। বেশ আরামেই দিন কাটছিলো। তখন ঢাকা ক্লাবে একটা সুইমিংপুল ছিলো। যখন ব্যস্ততা কমে আসতো গরমের দিনে অনেকটা সময় তখন সুইমিংপুলের ধারেই কাটতো। ক্লাব আর রেজিমেন্টের বাইরে বিশেষ কাউকে চিনতাম না। দু-একজন সাদা চামড়ার লোক মাঝে মাঝে পুলে আসতো। কিন্তু বেশি আসতো ওদের ফ্যামিলির মেয়েরা – নানান বয়সের। ওদের মধ্যে একজন সাদা চামড়ার মেয়ে, কুড়ি বাইশ বছর হবে। তার সঙ্গে আমার ভালোই ভাব হয়ে গেল। এটা ওদের দৃষ্টি এড়ালো না। কানাঘুষা চলছিলো। তখন ক্লাব কর্তৃপক্ষ একটা নোটিশ টাঙালেন। কালো চামড়ার লোকেরা, সে যে-ই হোক না কেন, সুইমিংপুল ব্যবহার করতে পারবে না। আমি বুঝলাম ব্যাপারটা। কিন্তু আমি একেবারে আমল দিলাম না সেই নোটিশটার। আমি আগের মতোই সুইমিংপুলে যেতে থাকলাম। হাজার হোক আমি হিজ ম্যাজেস্টিজ আর্মির একজন অফিসার। কিন্তু সেই মেয়েটি আর এলো না সুইমিংপুলে। এটাই আমার ঢাকা ক্লাবে থাকার একটা দুঃখজনক ঘটনা কিন্তু একদিক থেকে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনাও বটে।’

লিম্বু পানি, হুইস্কি এলো। ওরা গ্লাস ঠোকাঠুকি করে হ্যাপি অ্যানিভারসারি বললো রমেশ আর অরুণাকে।

অরুণা বললেন, ‘তোমাদের আমি তুমি করে বলছি। কিছু মনে করো না। তোমাদের দুজনের বয়স যোগ করলে আমার বয়সের চাইতেও কম হবে নিশ্চয়ই।’

রমেশ বললেন, ‘আমি সেনাবাহিনী থেকে দুবছর আগে রিটায়ার করেছি। আর বোম্বেতেই থাকি এখন। আমরা নানা-নানি হয়েছি। আমার মেয়ে আর জামাই কয়েকদিনের জন্য পুনা গেছে। আমার জামাই ওখানকার ফিল্ম অ্যাকাডেমিতে কাজ করে। ওদের দশ বছরের মেয়েকে আমাদের কাছে রেখে গেছে। ওকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আমরা অল্প সময়ের জন্য এখানে এসেছি। তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগলো। বাইরে যখন তোমরা বললে ঢাকা আর নেপালের কথা, তখনই আমার কেমন জানি মনে হলো আমার প্রথম পোস্টিংয়ের কথা ঢাকাতে। আর নেপালে আমি বহুবার গিয়েছি। প্রথমদিকে গুর্খা সৈন্যদের রিক্রুটিংয়ের কাজে এবং পরে আমাদের পুরনো রেজিমেন্টের সঙ্গে যারা কাজ করেছে তাদের গ্রামের স্কুল আর হাসপাতালের জন্য। আমরা টাকা-পয়সা আর সময় দিয়ে অনেক কাজ করে চলেছি এখনো।’

মিত্রা এতক্ষণ বেশি কথা বলেনি। চুপচাপ শুনেই যাচ্ছিল। এবার হঠাৎ সে বললো, ‘আচ্ছা। আপনারা বলছিলেন আপনাদের প্রথম দেখা ট্রেনে। ঢাকা থেকে সিলেট যাচ্ছিলেন নাকি তখন। আপনাদের সেই প্রথম দেখার গল্প আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।’

সুফী মিত্রার দিকে তাকিয়ে একটু ধমকের সুরে বললো, ‘এই তুমি কী বলছো? ওঁদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের কম দেখা আমাদের। এরই মধ্যে তুমি এসব প্রাইভেট কথা শুনতে চাইলে ওঁরা কী মনে করবেন?’

মিত্রা বললো, ‘হ্যাঁ, একঘণ্টার কমই বটে আমাদের দেখা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে আমার খুব আপন মনে হচ্ছে ওঁদের।’

অরুণা হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। মিত্রাকে বকো না। ও ঠিকই বলেছে। তোমাদেরও আমার খুব আপন মনে হচ্ছে।… অবশ্য ভালো বলতে পারবে রমেশ।  ও গল্প বলতে ওস্তাদ। এতো রং চড়িয়ে সব বলবে যে, আমিও অবাক হয়ে শুনি মাঝে মাঝে। আমার সম্বন্ধেই বলছে কিন্তু আমি নিজেই ভাবছি যেন আরেকজনের ব্যাপারে কথাটা শুনছি।’

এমন সময় একজন কর্তাগোছের ভদ্রলোক এসে রমেশকে বললেন, ‘আচ্ছা তোমরা এখানে বসে আছো দেখছি। আমরা তোমাদের হন্যে হয়ে খুঁজছি। আজকের প্রোগ্রামটা কেমন করে সাজাবো বুঝতে পারছি না। তোমাদের খুব দরকার। আসতে হবে আমাদের সঙ্গে।’

ব্রিগেডিয়ার সাহেব ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সরি, তোমাদের একটু একলা রেখে যেতে হচ্ছে। তবে এক্ষুনি ফিরে আসছি।’

দুজন একা বসে থাকলো। তারপর সুফী বললো, ‘আচ্ছা, কাল সকালের প্রোগ্রামটা কখন কী হবে আমাকে বুঝিয়ে বলো তো। আমার প্রেস ইনফরমেশন চিঠিতে অনেক কিছু লেখা আছে। তাতে কোনটা বেশি দরকারি আর কোনটা ফালতু তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।’

মিত্রা হেসে বললো, ‘তুমি কি সবগুলো সেশনে যেতে চাও? তোমার কাগজের জন্য কী কী দরকার তা আমি ঠিক বলতে পারবো না। তবে আমি যে যে জায়গায় যেতে চাই তা তোমাকে বলতে পারি। উদ্বোধন হবে সকাল ৯টায়। এটা আমার জন্য এমন কিছু ইন্টারেস্টিং নয়। কিন্তু তবু মিস করতে পারবো না।’

‘আমাকে তো যেতেই হবে। খবরের কাগজের জন্য খুবই দরকার।’

‘কালকের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন হোমিভাভা।’

‘তিনি আবার কে?’

‘আরে তিনিই তো এই টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল স্টাডিজের ডিরেক্টর। ভদ্রলোক ইন্ডিয়ার এক নম্বর ফিজিসিস্ট। এই কংগ্রেসের বড় উদ্যোক্তা। আর চিফ গেস্ট হবেন পল ডিরাক।’

‘তাঁর কোনো বিশেষ পরিচয় আছে? আমাকে বলো না?’

‘তুমি কী রকম জার্নালিস্ট? পল ডিরাকের নাম শোনোনি? তোমাকে এখানে পাঠালো কেন তোমার খবরের কাগজ?’

সুফী একটু অসহায়ের মতো তাকালো মিত্রার দিকে। বললো, ‘এই প্রোগ্রামটার আমন্ত্রণপত্র এতো দেরি করে ঢাকায় পাঠালো যে কোনো খোঁজখবর নেওয়ার সময় পাইনি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে উদ্বোধনীতে আমার পাশে বসো। তখন আমি তোমাকে কিছু কিছু বলতে পারবো।’

‘আমি তোমার সঙ্গে বসতে পারবো কিনা জানি না। আমার প্রেস কার্ড আছে। আমাদের জন্য আলাদা বসার জায়গা থাকবে বোধহয়।’

‘ও তুমি বিশেষ জায়গায় বসতে চাও! আমার সঙ্গে বসলে তোমার মানহানি হবে। বেশ তুমি তাহলে নিজেই সব খবর জোগাড় করো। পল ডিরাককেও জিজ্ঞেস করতে পারো। বলবে, আপনার নাম আমি আমাদের খবরের কাগজে ছাপাবো। তখন আপনার নাম সবাই জেনে যাবে। আমি আপনাকে প্রসিদ্ধ করে দেবো।’ তারপর একটু থেমে বললো, ‘তিনি মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন ফিজিক্সে। তাঁর আগে এতো অল্প বয়সে কেউ নোবেল প্রাইজ পাননি। এটুকুই এখন তোমাকে বললাম। উদ্বোধন হবে ৯টায়। অনেক বক্তৃতা হবে। একেবারে বোরিং। চলবে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। তারপর কফি ব্রেক। ১১টা থেকে প্রথম সায়েন্টিফিক সেশন শুরু হবে। পল ডিরাক প্রিজাইড করবেন। প্রথম পেপারটাই আমাদের। ড. গুপ্ত পড়বেন। আমি কো-অথর। যদিও যে-কাজটা নিয়ে পেপার তার বেশির ভাগ আমিই করেছি।’

‘সেটা তো বেশ সম্মানের ব্যাপার। তোমাদের পেপারের একটা কপি আমাকে দেবে তো? যদিও কতোটা বুঝবো জানি না।’

‘দুপুর ১টায় লাঞ্চ। বেলা দুটো থেকে আবার আরেকটা সেশন। আমি ইন্টারেস্টেড না। আমি ফাঁকি দিতে চাই। কিন্তু পাঁচটা থেকে হবে গার্ডেন পার্টি। সেটা হবে বোম্বে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। গার্ডেন পার্টিটা বাদ দিতে চাই না। তোমাকেও আসতে হবে। এখানে ক্যামেরা নিয়ে আসতে ভুলো না কিন্তু। অনেক ছবি তোলার চান্স পাবে। অনেক সুন্দরী মহিলাও থাকবে। তোমার কাগজও পছন্দ করবে ছবিগুলো।

‘পল ডিরাকও আসবেন নিশ্চয়ই।’

‘যদি আসেন তাহলে যে করেই হোক তাঁর সঙ্গে আমার একটা ছবি তুলে দিও। আমি কলকাতা ফিরে গিয়ে সবাইকে দেখাতে পারবো। তখন সবাই হিংসা করবে আমাকে।

‘আচ্ছা তিনি নোবেল প্রাইজটা পেলেন কী কাজের জন্য?’

‘উঁহু, বলবো না এখন। তোমাকে নিজেই সব কিছু খুঁজে বের করতে হবে। আমার সঙ্গে সকালে তুমি বসবে না বলছো। নিজের প্রেস এনক্লোজারে বসবে। ঠিক আছে। তবে আমার সঙ্গে বসলে বলতাম তখন।’

‘বারে! আমি কি ইচ্ছে করে বসতে চাইছি না। তুমি তো বসবে ড. গুপ্তের সঙ্গে, যারা পেপার পড়বে তাঁদের জায়গায়। আমাকে সেখানে যেতে দেবে কেন? যদি দেয় তাহলে নিশ্চয়ই মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার প্রেস কার্ডটা লুকিয়ে তোমার সঙ্গে বসতে রাজি আছি।’

এবার মিত্রা একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, দেখা যাবে তখন কী হয়।’

ব্রিগেডিয়ার মেহতারা ফিরে এলেন একটু পরে। আরাম করে চেয়ারে বসে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন, ‘যাক এখনকার মতো কাজ হলো। ভালোই হলো। নিশ্চিন্তে বলতে পারবো সব এখন তোমাদের।’

হুইস্কির গ্লাসে হাত বুলোতে বুলোতে ব্রিগেডিয়ার মেহতা বলতে লাগলেন, ‘আগস্ট মাসে ভীষণ গরম পড়লো ঢাকায়। আমি ভাবলাম, এখানে কাজ তো খুব বেশি নেই এখন। কিছুদিন একটু শিলং বেড়িয়ে আসলে কেমন হয়? ছুটির জন্য আমার রেজিমেন্টাল কমান্ডারের কাছে ধরনা দিলাম। প্ল্যান ছিলো ঢাকা থেকে ট্রেনে যাবো সিলেট, তারপর সেখান থেকে গাড়ি করে ডাউকি হয়ে শিলং। পূর্ববাংলা আর আসাম তখন একই আর্মি কমান্ডে। বলা হলো দুসপ্তাহের জন্য আমি রেজিমেন্টের কাজেই শিলং যেতে পারি। তার জন্যে সবই আমার রেজিমেন্ট ব্যবস্থা করবে।

ঢাকায় ট্রেনে উঠেছি। তখনই অরুণা আর তার বাবা-মা উঠলেন আমারই কামরায়। ওই একটা ফার্স্ট ক্লাস কামরা ছিলো ট্রেনে। ঢাকা থেকে ইবিআর ট্রেন। তারপর আখাউড়ায় বদল করে এবিআর যাবে সিলেট।

আলাপ হলো ট্রেনে। অরুণারা থাকতো কলকাতায়। অরুণার বাবা পাটের মিলের ম্যানেজার সেখানে। নারায়ণগঞ্জে আসতে হতো মাঝে মাঝে পাটের ব্যবসার কাজে। এবার মেয়ে আর তার মা সবাই কাজের শেষে, আমার মতো গরমের অত্যাচারে একবার শিলং বেড়াবার ইচ্ছে।’

ব্রিগেডিয়ার সাহেব এই পর্যন্ত বলে একবার হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলেন। অরুণা মিটিমিটি হাসছেন।

ব্রিগেডিয়ার সাহেব আবার শুরু করলেন, ‘অরুণা যে তখন কী রকম সুন্দর ছিলো তা তোমরা ধারণা করতে পারবে না। আমি ভাবছি কী করে যে কথা বলি ওর সঙ্গে। কিন্তু আমি বসে আছি এ-পাশের বেঞ্চে। অরুণার বাবার সঙ্গে গল্প করছি। আর অরুণা উলটো দিকের বেঞ্চে বসেছে ওর মায়ের সঙ্গে। কলকাতায় ওরা থাকতেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে। আর অরুণার বাবার জুটমিল ছিলো হুগলী নদীর ওপারে হাওড়ার কাছে। নদী পার হতে হতো একটা পন্টুন ব্রিজের ওপর। সেটাও আবার খোলা হতো রোজ। নৌকারা যাতে নদীতে যাতায়াত করতে পারে। দু-এক ঘণ্টার জন্য মাত্র। তোমাদের এসব কথা বলছি কারণ এখন তো তোমরা বড় হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে চট করে নদী পেরিয়ে যাও। তখন ও-রকম ছিলো না। অরুণা পড়ে বেথুন কলেজে – কলকাতায়। জুটমিলের ম্যানেজারের জন্য আলাদা বিলাসবহুল বাড়ি ছিলো। কিন্তু মেয়ের কলেজের জন্য তাঁদের কলকাতায় থাকতে হচ্ছে।’

আবার তিনি থামলেন। এক চুমুক দিলেন গ্লাসে। এমন সময় দুজন ভদ্রমহিলা এসে ওদের কংগ্র্যাচুলেশন জানালেন। দুজনই অরুণার বয়সী। বললেন, ‘ব্রিগেডিয়ার সাহেব, আমরা অরুণাকে কিছুক্ষণ ধার নিচ্ছি। ওকে খুব দরকার। দু-একটা গানের রিহার্সাল দিতে হবে। কিছু মনে করবেন না। একটু পরেই ফিরিয়ে দেবো ওকে।’

অরুণা চলে গেলেন ওদের সঙ্গে। যাওয়ার সময় আস্তে করে বললেন, ‘তোমার গল্পে কিন্তু বেশি বেশি রং চড়িও না। আমি ফিরে এসে ওদের জিজ্ঞেস করবো তুমি সব ঠিক-ঠিক বলেছো কিনা।’

ব্রিগেডিয়ার সাহেব আবার শুরু করলেন, ‘আঃ আসল সময়েই নিয়ে গেল ওরা অরুণাকে!… আজকে অরুণা আমাকে বলেছিলো, আমার ইউনিফর্মটা পরতে আবার। আসলে রিটায়ার করেছি তো। এখন আর ইউনিফর্ম পরা হয় না। স্পেশাল পারমিশন নিতে হয় পুরোনো ইউনিফর্ম পরার জন্য। অরুণা বলতো সেসব দিনে যখন আমি একজন তরুণ আর্মি অফিসার, তখন ইউনিফর্ম পরলে আমাকে কতো স্মার্ট লাগতো।’

সুফী বললো, ‘আপনাকে এখনো খুবই অ্যাট্রাকটিভ লাগে। ইউনিফর্ম না পরলেও এই স্যুটে আপনাকে বেশ মানিয়েছে।’

তিনি নিজের পেটে একটু হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘দেখ এখনো কোনো ভুঁড়ি হয়নি। রোজ ব্যায়াম করি তো। একেবারে ফ্ল্যাট টামি। আচ্ছা, যা বলছিলাম। ট্রেনে অনেক কথা হচ্ছিল। যখন দেখলাম আমরা সবাই গুজরাটি তখন আমরা ইংরেজি ছেড়ে একেবারে গুজরাটি ভাষায় কেম ছো, সারু ছাই, ভুখ লাগিস – এসব বলতে লাগলাম।’

ক্ষিধের কথা উঠতেই অরুণার মা তাঁর টিফিন ক্যারিয়ারভর্তি রান্না করা খাবার বের করলেন। আমি ডাকলাম আমার ব্যাটম্যানকে পরের স্টেশনে। ওর কাছে আমার খাবার ছিলো। অরুণার মা ওকে প্রায় ধমক দিয়ে বিদায় করে দিলেন।

খাবার পর ওরা দুজন বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়লেন। শুধু অরুণা আর আমি এখন একটা ছোট কামরায়। কতোক্ষণ আর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা যায়। আমি মাঝে মাঝে অরুণার দিকে তাকাই। ওর বাবা-মা ঘুমে অচেতন। দেখি অরুণাও আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এরপরই সে আবার চোখ সরিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে মনে হলো ওর চোখে একটা দুষ্টু হাসি। কি মুশকিলে যে পড়লাম! ওই এক সেকেন্ডের চাউনির আঘাতেই আমি তখন ছটফট করছি। বুঝে দেখো আমি স্যান্ডহার্স্টের পাশ করা মিলিটারি অফিসার। শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য কী-কী অস্ত্র কেমন করে ব্যবহার করতে হয় সে-বিষয়ে বিশেষ পারদর্শিতা আমার রয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষা করার দায়িত্ব স্বয়ং সম্রাট পঞ্চম জর্জ আমার ঘাড়ে দিয়েছেন। তবু এই একটা অল্পবয়সী কলেজেপড়া মেয়ে আমাকে নিয়ে যে কী খেলা শুরু করে দিলো…?’

তাঁর কথা বলার ধরনে ওরা দুজনেই হেসে দিলো। ‘তোমরা হাসছো? কিন্তু আমার যে তখন কী অবস্থা একবার যদি বুঝতে? আমি বুঝতে পারছি অরুণা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু যেই আমি ওর দিকে দেখি, ও সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।’

সুফী একটু সুর করে গাইলো, ‘প্রাণ চায়, চক্ষু না চায়, মরি একি দুস্তর তোর লজ্জা।’

‘ওটা কী গান বলো তো। বেশ সুন্দর তো!’

মিত্রা বললো, ‘ওটা রবীন্দ্রনাথের একটা গান। আচ্ছা আমি ওটার হিন্দি ভার্সনটা শোনাচ্ছি আপনার জন্য। পংকজ মল্লিক গেয়েছেন। আমার তো অতো ভালো হবে না। তবে মানেটা বুঝতে পারবেন। শুরুটা হচ্ছে এই রকম – প্রাণ চাহে নায়ান না চাহে/ আরে তু কিউ ইঁউ শারমায়ে।’

‘তোমাদের রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই আমার মতো অবস্থায় পড়েছিলেন। কী যে যন্ত্রণা… আবার ভালোও লাগে। আচ্ছা, তোমরা দুজনে পরে মাইকে এ-গানটা সকলের সামনে গাইবে?’

‘না না। আমরা তো লোকের সামনে কখনো গান করিনি।’ ওরা বললো।

‘বুঝতে পারছি তোমরা সংকোচ করছো। ঠিক আছে পরে দেখা যাবে। অরুণা ফিরে আসুক।’

‘যাকগে, সিলেটে পৌঁছে একটু কথা বলার সুযোগ পেলাম। ওর বাবা-মা মালপত্র দেখতে ব্যস্ত। ওদের গাড়িতে সব ওঠানো হচ্ছে। আর আমার মিলিটারি গাড়িতে আমি একলা যাবো। ওর বাবা বলেছিলেন, শিলংয়ে তারা পাইনউড হোটেলে থাকবেন। আমি থাকবো আমার মিলিটারি ব্যারাকের রেস্টহাউসে। শিলং আমি আগেও এসেছিলাম একবার। সেখানে লাবানে আমার থাকার ব্যবস্থা। গাড়িতে ওঠার আগে অরুণাকে একটু খানিকের জন্য একলা পেলাম।

মরিয়া হয়ে ওকে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলাম না আগে। তবে এটুকুই এখন বলবো। পাইনউড হোটেলের কাছেই আছে ওয়ার্ড লেক। সেখানে আছে সুন্দর একটা কাঠের ব্রিজ। আগামীকাল বিকাল ৫টার দিকে যদি আপনি ওখানে থাকেন তাহলে আপনাকে একটা দরকারি কথা বলতে চাই। আপনি একলাই            আসবেন কিন্তু।’

মাথাটা নাড়িয়ে কোনো কথা না বলে অরুণা চলে গেল ওর          বাবা-মায়ের কাছে। কোনো ভাবান্তর দেখলাম না মেয়েটার চোখেমুখে। কোনো মেয়ে যদি আমাকে এ রকম একটা কথা বলতো আমি তো ভড়কে যেতাম।

অরুণা পরদিন ঠিকই ওয়ার্ড লেকের কাঠের ব্রিজের ওপর অপেক্ষা করছিলো ঠিক সময়ে। আমাকে দূর থেকে দেখে হাত নাড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো, ‘আমি কিন্তু আধঘণ্টা আগে এসে গেছি। ওয়ার্ড লেক যে এত কাছে তা তো জানতাম না। ভেবেছিলাম ট্যাক্সি নিতে হবে।… আমার বাবা-মা ৫টার সময় আসবেন। যা বলার তার আগেই বলে ফেলেন। ওঁরা এলে আর আপনার সঙ্গে থাকা যাবে না।’ বাববা, কী সাহস মেয়েটার! বাবা-মায়ের কাছে কী রকম লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকে, আর এখন কী রকম বেপরোয়া! ওর নীল রঙের শাড়ির প্রশংসা করবো, নাকি ওর সংকোচবিহীন ব্যবহারের। খোঁপায় আবার একটা বেলিফুলের মালা পরে এসেছে। আমি তো কুপোকাত হয়েই আছি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দেওয়ার দরকার কী? বেশি কিছু না বলে… বুঝতে পারছো ওয়ার্ড লেকের ওই কাঠের ব্রিজের ওপরেই আমি ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম।’

ও জবাব দিলো, ‘এসব কথা আমার বাবা-মাকে বলবেন।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি রাজি আছো?’ তার জবাবে সে কী বললো জানো? বললো, ‘আমি কি আপনার শত্রু? আপনার সঙ্গে কি যুদ্ধ করছি যে আমাকে সারেন্ডার করতে হবে?’ বিয়ের প্রস্তাবে কোনো মেয়ে                  এ-রকম জবাব দিয়েছে বলে আমি জানি না। এ-কথাটির যে কী মানে পঁয়ত্রিশ বছরেও আমি তা বুঝতে পারিনি। ওই যে তুমি গান করলে, ‘প্রাণ চাহে নায়ান না চাহে, আরে তু কিউ ইঁউ শারমায়ে’র গানের কথায় একই ভাব; কিন্তু অরুণার ভাষাটা অন্যরকম। যা হোক, ওর বাবা-মা সেনসিবল মানুষ। তাই বিয়ে হয়ে গেল। এখন থেকে এই পঁয়ত্রিশ বছর আগে। কিন্তু অরুণাকে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। মিষ্টি একটা হেঁয়ালি ভাব রয়েই গেল। কিন্তু অরুণা এখানে নেই বলে তোমাদের বলতে কোনো বাধা নেই। আমি একদিনের জন্যও অসুখী হইনি।’

এমন সময় অরুণা হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলেন। বললেন, ‘দেখো, আমাকে গেটে ডেকে পাঠিয়েছিলো একটু আগে। বাড়ি থেকে টেলিফোন এসেছিলো। ফ্ল্যাট থেকে আমাদের ডা. মিস্ত্রি ফোন করেছিলেন আমাদের জন্য। আমাদের আয়া তাঁকে ফোন করে ডেকে এনেছে। রানীর বেশ জ্বর হয়েছে। খুব মাথাব্যথা করছে, বমি হয়েছে। ডা. মিস্ত্রি বললেন, রানী বেশ অসুস্থ। পারলে আমাদের এক্ষুনি বাড়ি ফিরে আসা উচিত। ডা. মিস্ত্রিকে খুব চিন্তিত মনে হলো।’

ব্রিগেডিয়ার সাহেব প্রথমে কথাই বলতে পারছিলেন না। অরুণাই বললো ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে, ‘দশ বছরের আমাদের নাতনিকে আমাদের কাছে রেখে মেয়ে আর জামাই গেছে পুনাতে কদিনের জন্য। সব দায়িত্ব এখন আমাদের। আপনাদের মনে হচ্ছে আমরা একটু অসুবিধায় ফেললাম। কারণ তোমাদের এক্ষুনি নাতনির কাছে যেতে হবে।… ডা. মিস্ত্রি বলছিলেন, যদি মেনিনজাইটিস হয় তাহলে যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় ওকে হাসপাতালে নেওয়া উচিত। তিনি তাই সন্দেহ করছেন। আমরা কাফ প্যারেডে থাকি। বেশিদূর না এখান থেকে। আর জে. জে. হাসপাতাল আমাদের বাড়ি থেকে কাছেই।’

মিত্রা তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, ‘আমি কি আপনাদের জন্য কিছু করতে পারি? আমার মামা জে. জে. হাসপাতালেই কাজ করেন। পেডিয়াট্রিক্স ডিপার্টমেন্টের রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার। হাসপাতালে যদি নিতেই হয় তাহলে আমি আমার মামার সঙ্গে কথা বলতে পারি এক্ষুনি। আপনাদের গেটের অফিস থেকে টেলিফোন করতে পারি। হয়তো সব ব্যবস্থা একটু এগিয়ে নেওয়া যায়।’

মিত্রার কথা শুনে ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, ‘তুমি কথাটা ভালোই বলেছ।’

তাঁরা উঠে গেলেন বাইরের দিকে। অফিসে গিয়ে মেহতাকে বললেন, ‘আমরা দুঃখিত, আমাদের এ-রকমভাবে ফিরে যেতে হচ্ছে। ইমার্জেন্সি। তুমি অতিথিদের কাছে মাফ চেয়ে নিও আমাদের হয়ে। …আচ্ছা মিত্রা কথা বলুক ওর মামার সঙ্গে।’

মিত্রা টেলিফোন ধরলো। সব কথার পর ও অরুণাকে বললো, ‘আমার মামাও বলছেন মেনিনজাইটিস হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় হাসপাতালে নেওয়া উচিত। মামা বলছেন, তিনি আপনাদের ঠিকানায় অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিতে পারবেন। এই নিন, টেলিফোনে আপনাদের ঠিকানাটা বলে দিন।’

সুফী বললো, ‘কিছু যদি মনে না করেন, আমরা আপনাদের একলা ছেড়ে দিতে চাই না। আপনাদের এই বিপদে আমরাও আপনাদের পাশে থাকতে চাই। যদি কোনো কাজে লাগতে পারি।’

একটু আশ্বস্ত গলায় ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, ‘তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। তোমরা থাকলে ভালোই হয়। আমরা প্রাণে একটু সাহস পাবো। দু-ঘণ্টাও হয়নি তোমাদের সঙ্গে পরিচয়। এরই মধ্যে তোমাদের অনেক কাছের মনে হচ্ছে। আমার মেয়ে আর জামাই যখন এখানে নেই, তখন তোমরা হবে তাদের মতোই।’

ব্রিগেডিয়ার সাহেবের গাড়িতে করে ওরা বের হলো। দশ মিনিটের মধ্যেই কাফ প্যারেডের তাঁদের বাড়িতে পৌঁছলো। অ্যাম্বুলেন্স বাইরে অপেক্ষা করছিলো। স্ট্রেচারসহ অ্যাম্বুলেন্সের লোকদের নিয়ে তাঁরা লিফটে উঠে গেলেন। ওরা দুজন নিচেই থাকলো। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে তাঁরা ফিরে এলেন। মেয়েটা প্রায় অজ্ঞানের মতো ঝিম মেরে আছে।

মিত্রা বললো, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে হাসপাতালে যাবো। আমি তো ওখানেই থাকি।’

অরুণা বললো, ‘ঠিক আছে। তবে সুফীকে আমাদের গাড়ি ওর হোটেলে পৌঁছে দেবে। তারপর আমাদের জন্য হাসপাতালে                     চলে আসবে।… আমি আমার মেয়েকে সব বলেছি। ওরাও আগামীকাল এসে যাচ্ছে। ইস, তোমরা যদি না থাকতে আমরা একলা যে কী করতাম?’

অ্যাম্বুলেন্স রওনা হওয়ার আগে মিত্রা হাত নাড়িয়ে বললো, ‘কাল সকালে দেখা হবে সায়েন্স কংগ্রেসের উদ্বোধনীতে। দেরি করো না।’

 

দশ

সকালে যখন সুফী পৌঁছলো সায়েন্স কংগ্রেসের মিটিংয়ে তখন অনেক লোক এসে গেছে সেখানে। ভাগ্যিস ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলো। খোলা জায়গায় প্যান্ডেল বানিয়ে উদ্বোধনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভেবেছিলো অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু না, হয়নি। যা হয় আমাদের দেশে। ভাগ্যিস সময়ের ব্যাপারে আমরা এখনো অতো পাংচুয়াল হতে পারিনি।

সামনের দিকেই দেখা হয়ে গেল ড. গুপ্তের সঙ্গে। তাঁকে একটু কাহিল লাগছিলো দেখতে। সুফীকে দেখেই তিনি বললেন, ‘তুমি তো এসে পড়েছো কিন্তু সংঘমিত্রা কোথায়?’ তাঁর গলাটা একটু ধরা।

‘আমারও তো সেই একই প্রশ্ন।’

‘আচ্ছা, তুমি ভালো আছো? আমার অবস্থা কিন্তু অতোটা ভালো নয়। সেই যে অজন্তায় আমার একটু খারাপ লাগছিলো গতকাল থেকে সেটা আরো জাঁকিয়ে বসেছে। রাত্রে ভালোই জ্বর হয়েছিলো। গলায় ব্যথা, ঢোক গিলতে কষ্ট। আর স্বর শুনে বুঝতেই পারছো আমার গলায় ইনফেকশন হয়েছে। এখানে আসতে মোটেও ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু উপায় নেই। এই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমাদের পেপার পড়তে হবে। স্বয়ং পল ডিরাক সভাপতি। আমার গলার যা অবস্থা তাতে আমার পক্ষে পেপার পড়া অসম্ভব।’

সুফী বললো, ‘আপনার সঙ্গে সংঘমিত্রা তো কো-অথর তাই না? তাহলে ও তো পড়তে পারে।’

‘হ্যাঁ, ওকেই পড়তে হবে শেষ পর্যন্ত। তবে ও এখনো জানে না। কিন্তু ও কেন আসছে না এখনো?’

সুফী তাঁকে বললো অল্প কথায় কেমন করে গতরাতে ব্রিগেডিয়ারের নাতনিকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিলো। সেজন্যে হয়তো সংঘমিত্রার দেরি হতে পারে। তবে এসে যাবে।

হঠাৎ সুফীর মনে একটা বুদ্ধি এলো। গতকাল মিত্রা ওকে পল ডিরাকের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলেনি দুষ্টুমি করে। তাই সে ড. গুপ্তকে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি আমাকে পল ডিরাকের সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন। আমি বিশেষ কিছু জানি না কিন্তু আমার কাগজের জন্য কিছু একটা লিখতে হবে।’

‘পল ডিরাকের সম্বন্ধে অনেক কিছু বলার আছে। আমার গলার যে অবস্থা তাতে আমার পক্ষে কিছু বলতে চেষ্টা করা সম্ভব নয়। তবে আমার সঙ্গে একটা ছোট বই আছে। পল ডিরাকের জীবনী। পড়ে দেখো। কতোটা বুঝতে পারবে জানি না। তবে সবই ইন্টারেস্টিং। ডিরাক ইকোয়েশন, ফেরমি ডিরাক স্ট্যাটিসটিকস, অ্যান্টি ম্যাটার – এসব খুব সহজে লেখা আছে।’

তিনি তাঁর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বই বের করলেন। বলেছিলেন ছোট কিন্তু বইটি দেখে ছোট বলে মনে হলো না। বইটি একটু উলটেপালটে দেখে ওর মনটা খুশি হয়ে গেল। সুযোগ বুঝে মিত্রাকে তাক লাগিয়ে দেবে আজ ডিরাকের সম্বন্ধে কথা বলে।

সুফী অধৈর্যের মতো তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক কিন্তু মিত্রাকে দেখতে পাচ্ছে না। এদিকে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে নিজের নিজের জায়গায় বসার অনুরোধ করা হচ্ছে। সুফী নিজের জায়গার দিকে চললো। প্রেস রিপোর্টারদের জায়গা আলাদা।

ড. গুপ্ত বসলেন সামনের সারিতে আমন্ত্রিত অতিথিদের জায়গায়। তাঁর পাশে মিত্রার জন্য চেয়ার খালি রেখেছেন তিনি। এমন সময় দূরে গেটের কাছে দেখতে পেলো মিত্রাকে। হন্তদন্ত হয়ে সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে। ড. গুপ্তও দেখেছিলেন মিত্রাকে। সে সামনে এসে তাঁর পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। সুফী অনেক চেষ্টা করলো ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কিন্তু ভিড়ের মধ্যে ও যতোই হাত নাড়ুক, মিত্রার নজরে তা পড়লো না।

সুফী মনে মনে ছটফট করছে মিত্রার খবর জানার জন্য। মিটিংয়ের প্রেসিডেন্ট ড. হোমি ভাভা সবাইকে অভ্যর্থনা করে বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু সুফীর কানে বিশেষ কিছু ঢুকলো না। আরো অনেক বক্তৃতা হলো। সুফী দেখলো ওকে যে ফোল্ডার দেওয়া হয়েছিলো কংগ্রেসের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে, তাতে বক্তৃতাগুলোর কপি রয়েছে। অতএব বিশেষ কোনো নোট নেওয়ার দরকার নেই। হঠাৎ তার মনে হলো, তার হাতে একটা ক্যামেরা আছে। আর অন্য ক্যামেরাম্যানরা ছবি নেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে স্টেজের কাছে আর অতিথিদের কাছে আসা-যাওয়া করছে। সেও যখন প্রেসের কার্ডধারী একটু এদিক-ওদিক গিয়ে ছবি তুললে কেউ তাকে বাধা দেবে বলে মনে হয় না।

একটু সুযোগ পেয়ে সে মিত্রা আর ড. গুপ্তের কাছে গিয়ে ওদের একটা ছবি তুললো। মিত্রা ওকে দেখে হাসিমুখে বললো, ‘এই অভ্যর্থনা কমিটির বক্তৃতার পরই কফি ব্রেক। বাইরে এসো। কথা আছে।’ মাথা নাড়িয়ে সুফী নিজের সিটে ফিরে এলো।

এক কাপ কফি আর একটা পাকোড়া নিয়ে মিত্রা এগিয়ে এলো। বললো, ‘তুমি শুরু করো, আমি আসছি স্যারের সঙ্গে কথা বলে।’

ড. গুপ্ত তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। মিত্রা তাঁর হাত থেকে একটা কাগজ আর ছোট বাক্স নিলো। তারপর ফিরে এলো সুফীর কাছে।

‘কাল রাত্রে কী কান্ড হলো তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর এখনো বলা হয়নি।’

‘তোমার হাতে এগুলো কী? হাতে ধরে থাকলে কফি খাবে কী করে? আমাকে দাও না হয়।’

‘না, এগুলো অন্য কারোর হাতে দেওয়া যাবে না।’ বলে সে তার নিজের ব্যাগে যত্ন করে রাখলো। বললো, ‘দেখো না স্যার কী ঝামেলা বাধালেন। তাঁর গলায় ইনফেকশন হয়েছে। স্বর ভেঙে গেছে। আমাদের পেপারটা তাঁর পড়ার কথা। তিনিই তো সিনিয়র অথর। কিন্তু পারবেন না পড়তে। তাই সেটা আমাকেই পড়তে হবে। দেখো দেখি, হ্যাঁ প্র্যাকটিক্যাল কাজগুলো আমিই তাঁর উপদেশমতো করেছিলাম। কিন্তু এই রকম একটা বিরাট আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে আমি কোনোদিন কোনো পেপার পড়িনি। তাও আবার আমাদের সেশনের চেয়ারম্যান হবেন পল ডিরাক। আমার তো সেটা ভাবলেই হাত-পা পেটে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আমার বুক এখন থেকেই ঢিপঢিপ করছে।’

‘তুমি নিশ্চয়ই পারবে। প্রথম প্রথম একটু নার্ভাস লাগবে বটে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রেখো, এই মিটিংয়ে এতো লোকের ভেতরে তুমিই হয়তো সবচেয়ে বেশি জানো এ-ব্যাপারে। কী যেন তোমাদের পেপারের নাম – ‘ফ্রম সাইক্লোট্রন টু সিনক্রোট্রন’। তো আমি আমার কাগজের জন্য খুব ভালো একটা রিপোর্ট পাঠাবো তোমার প্রেজেন্টেশন নিয়ে। চিন্তা করো না।’

‘থ্যাংক ইউ, তোমার উৎসাহের জন্য।’

‘কী বলছিলে তুমি গত রাত্তিরের ঘটনা নিয়ে? তোমাদের যখন অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছিলাম, তখন ওই ছোট্ট মেয়ে রানীকে দেখে আমার বেশ খারাপ লাগছিলো। বেশ অসুস্থ লাগছিলো তাকে।’

‘তাই তো বলছি। আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম তখন আমার মামা ইমার্জেন্সিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রোগীকে চটপট দেখে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। বললেন, আর একটু দেরি করলে অবস্থা মারাত্মক হয়ে যেতে পারতো। সঙ্গে সঙ্গে ড্রিপ শুরু করলেন। ইন্ট্রাভেনাস পেনিসিলিন দিতে আরম্ভ করলেন। ওদিকে অক্সিজেন, আর মাথাব্যথা কমানোর জন্যও ওষুধ দিলেন। অরুণা আন্টি বুঝতে পারলেন তাঁর নাতনি গুরুতর অসুস্থ। তিনি রাত্রে হাসপাতালে থাকবেন। রমেশ আঙ্কেলকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’

‘তখন তুমি বললে তুমিও অরুণা আন্টির সঙ্গে সারারাত ওখানে রোগীর পাশে জেগে থাকবে, তাই না?’

‘তুমি কেমন করে জানলে আমি তাই বললাম তখন?’

‘তোমাকে এই কদিন দেখছি তো। এটাই আশা করা যায় তোমার কাছ থেকে।’

‘অরুণা আন্টি যে কী খুশি হলেন আমার কথা শুনে। তাঁর নিজের মেয়ে-জামাই কাছে নেই। আর রমেশ আঙ্কেল যতোই স্যান্ডহার্স্টের অফিসার হোন না কেন, এ-রকম ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কোনো কাজে লাগবেন না। প্রথমে অরুণা আন্টি আমাকেও থাকতে দিতে চাননি। কিন্তু আমি তাঁর কথা শুনিনি। আমরা অবশ্য রোগীর ব্যাপারে কিছু করতে পারিনি। ডাক্তার আর নার্স ওরাই সত্যি খুব যত্ন করে দেখাশোনা করলো। বিশেষ করে ওরা যখন বুঝলো সাক্ষাৎ আমার মামা, তাদের ডাক্তার, এই রোগীর ব্যাপারে নিজেই ইন্টারেস্টেড। আমরা দুজন রাত জেগে অনেক কথা বললাম। অরুণা আন্টি বারবার আমাকে বলতে লাগলেন, আমি না থাকলে তিনি নিজে এ-রকম অবস্থায় সব সামাল দিতে পারতেন না। তাঁরও তো বয়স হয়েছে। আমাকে কাছে পেয়ে অনেক সাহস পাচ্ছেন ইত্যাদি। …তারপর সুযোগ বুঝে তোমার কথাও জিজ্ঞেস করলেন। কতোদিনের পরিচয় আমাদের, আমার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক ইত্যাদি। মেয়েদের নিজেদের ভেতরে যেসব কথাবার্তা হয়, সেরকম আর কী।’

‘আমার সম্বন্ধে কী কী বললে তুমি?’

‘আঃ, ওসব বলা যাবে না তোমাকে। যা বলেছি তার সারাংশ হচ্ছে – আমরা দুজনে ভালো বন্ধু। আর কিছু নয়।’

‘আচ্ছা পল ডিরাক আজকের পরের সেশনে প্রেসিডেন্ট হবেন বলছো। আর তুমি তাঁর সামনে পেপার পড়বে। জানো ওর বয়স কতো হবে এখন। প্রায় ছেষট্টি হবে এ-বছর। কারণ তিনি জন্মেছিলেন ১৯০২ সালে। তিনি এখন কোথায় কাজ করছেন জানো তো? ফ্লোরিডার ট্যালাহাসিতে। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডায়।’

‘বাঃ, তুমি তো এই অল্প সময়ের ভেতর অনেক কিছু জেনে ফেলেছো।’

‘হ্যাঁ, তুমি গতকাল নিজে পল ডিরাক সম্বন্ধে কিছু বলতে চাওনি। তাই আমাকে নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়েছে সব খবর। আরো অনেক কিছু বলতে পারি।’

‘বেশ তো, বলো না। আমারও কিছু শেখা হবে।’

‘পলের বাবা ছিলেন সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা। কথা বলতেন ফরাসি ভাষায়। তিনি ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে এসে বসবাস শুরু করলেন। এই ব্রিস্টলেই পল ডিরাকের জন্ম। স্কুলেও পড়েছিলেন এখানে। প্রথমে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন। পরে ক্যামব্রিজে ম্যাথমেটিক্সে এমএ এবং পিএইচডি করলেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের কাজ করার জন্য। বলো দেখি কোন সালে তিনি নোবেল প্রাইজ পেলেন?’

‘ঠিক মনে পড়ছে না। তুমি জানো?’ বললো মিত্রা।

‘হ্যাঁ, ১৯৩৩ সালে।’

‘ঠিক বলেছো। তাঁর সঙ্গে সে-বছর আর কে ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন বলো তো?’

‘জানি না।’

‘এরউইন শ্রোডিংয়ার। অ্যাটমিক থিওরির নতুন রকম বিশ্লেষণ করার জন্য।

‘আরো কিছু বলতে চাও তাঁর সম্বন্ধে।’

‘এটা তো নিশ্চয়ই জানো যে, তিনিই প্রথম অ্যান্টিম্যাটার কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। ইলেকট্রনের অ্যান্টিম্যাটার পজিট্রনের অস্তিত্ব তিনি অঙ্ক কষে ১৯২৮ সালেই বলে দিয়েছিলেন। তারপর চার বছর পর আমেরিকায় কার্ল অ্যান্ডারসন ১৯৩২ সালে তাঁর ল্যাবরেটরিতে পজিট্রনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করলেন।

শুধু অ্যান্টিম্যাটার নয়, তিনিই প্রথম কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডিনামিক্স কথাটা ব্যবহার করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো মারগিট। ডিরাকের মতোই আর একজন বৈজ্ঞানিক উইগনারের বোন। বিয়ের পর মারগিটকে তিনি ডাকতেন মানসি নামে।… এই রকম কতো যে গল্প আছে – মজার মজার গল্প তাঁর সম্বন্ধে।’

মিত্রা এবার বললো, ‘আমার কফির কাপ খালি। আর এক কাপ দরকার। পাকোড়াটা বেশ ঝাল করেছে – মজার না? আচ্ছা আমাকে কিছু সময় নিতে হবে। এই পেপারটা আবার পড়ে তৈরি হতে হবে। কীভাবে বলবো, আর কোন কোন হাসির কথা কখন বলতে হবে। তা নইলে অডিয়েন্স মাঝপথেই আমার কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে। আর এই স্লাইডগুলো অপারেটরের কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে। স্লাইড দেখানোর সময় যাতে উলটোপালটা না হয়ে যায়।’

‘ভালো কথা। আমারও কিছু সময় দরকার। সকালে বেরিয়েছিলাম ক্যামেরার ফিল্ম কিনতে। কোডাক কোম্পানির দোকান আছে হর্নবি রোডে। কয়েক রোল কোডাকালার আর কোডাক্রোম ফিল্ম                   কেনার জন্য। কোডাকের দোকান বন্ধ। তাই পাশের একটা ছোট ডিসপেনসারি থেকে সাধারণ এই সাদাকালো ফিল্ম কিনলাম            এখনকার মতো।

ঘণ্টাখানেক সময় আছে যখন তখন আমি একটা দরকারি কাজ সেরে আসি। আমাকে আবার যেতে হবে সেই হর্নবি রোডে। কোডাকের দোকানে। এতক্ষণে নিশ্চয় দোকানটা খুলেছে। কালার ফিল্ম কিনবো – অনেক সুন্দর ছবি উঠবে কালারে। কোডাকালার আর কোডাক্রোম দুটোই কিনবো।’

‘তুমি যদি হর্নবি রোডে যেতে চাও তাহলে আনিটর গাড়ি আছে। ওটা নাও। মনে আছে গতকাল তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছিলো। সারারাত আমি ছিলাম আন্টির সঙ্গে হাসপাতালে। আজ সকালেই আমাকে এই মিটিংয়ে আসতে হবে শুনে বললেন, ওঁকে বাড়ি পৌঁছে গাড়িটা আমার জন্য দিয়ে দেবেন। বিকেলে ফেরত দিলেই চলবে। চলো আমি তোমাকে দেখাই গাড়িটা কোথায় পার্ক করা আছে।’

সুফীর মাথায় তখনো ঘুরছে পল ডিরাকের কথা। ড. গুপ্ত ডিরাকের জীবনীর ছোট বইটা দিয়েছিলেন তাকে পড়তে। সুফী মিত্রাকে কিছুতেই বলছিলো না সে-কথা। মিত্রার মুখ দেখে তার মজা লাগছিলো, যখন ডিরাক সম্বন্ধে অতো কথা অনর্গল সে বলে যাচ্ছিল। এবার সে বললো, ‘আমি কিন্তু ডিরাক ইকোয়েশনটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। অঙ্কে কোনোকালেই খুব ভালো ছিলাম না। আর এদিকে ডিরাক ফেরমি আর ওদিকে বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকের ব্যাপারটা। এটাও একটা হেঁয়ালির মতো।’

‘তুমি তো দেখছি একদিনেই ডিরাক সম্বন্ধে অথরিটি হয়ে গেছ। তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন? বরং আমাকেই বুঝিয়ে দিও ফেরমিওন আর বোসনের তফাৎটা।’ বলতে বলতে ওরা গাড়ির কাছে এসে পড়লো। মিত্রা ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বললো, ‘এই সাহেবকে হর্নবি রোডে নিয়ে যেতে হবে।’

ড্রাইভার বললো, ‘জি, ফিরোজ শাহ মেটা রোডে কোডাকের দোকান আমি চিনি।’

গাড়িতে ঢোকার আগে সুফী ডাকলো, ‘মিত্রা একটা কথা বলা হয়নি। শোনো।’

‘আবার কী? আমার হাতে সময় কম। বলো তাড়াতাড়ি।’

‘তোমাকে দারুণ সুন্দর লাগছে এই ক্রিম রঙের শাড়িতে।’

‘তাই বুঝি। সময় কম কিন্তু আরো দাঁড়াতে পারি যদি এ-রকম সুন্দর কথা বলো।’

‘খুব মিষ্টি লাগছে।’

‘শাড়িটা শ্রীনিকেতন থেকে কেনা। এন্ডির তৈরি। একটু ভারি। তবে এই শীতের জন্য আরাম।’

‘আর ওই অাঁচলের গ্রাম্য ডিজাইন সবসুদ্ধ তোমাকে বেশ মানিয়েছে।’

‘শান্তিনিকেতনের কাছেই সাঁওতাল পল্লী আছে। তাদের কুটিরের দেয়ালে এ-রকম কতো বিচিত্র নকশা আর ছবি ওরা অাঁকে। এগুলো থেকে নেওয়া ডিজাইন এই শাড়ির অাঁচলে রয়েছে।’

‘আর লাল ফুলটা তোমার চুলে পরেছো – ওর নাম কী? এরকম ফুল কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’

‘আমিও দেখিনি। জে. জে. হাসপাতালের গেটের কাছে বাগান। বেরোনোর সময় চোখে পড়লো ফুলটা। কেউ ছিলো না আশেপাশে। চট করে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে চুলে পরে নিলাম।’

‘কাউকে জিজ্ঞেস না করে ফুলটা নিলে – চুরি বলে সেটাকে। তাই না?’

‘পুলিশকে বলে দেবে না তো? তোমাকে সব সত্যি কথা বলা যাবে না দেখছি।’

‘আচ্ছা বিবেচনা করে দেখবো। কাল সকালে আমাকে থানায় যেতে হবে। আমি বিদেশি নাগরিক। থানায় দুদিনের ভেতরেই নিজেকে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে।’

‘আর যদি সুন্দর সুন্দর কথা না বলতে চাও তাহলে এবার চলি।’

এগারো

সুফী যখন ফিরে এলো তখন সায়েন্টিফিক সেশন প্রায় শুরু হতে যাচ্ছে। প্রায় সকলেই নিজের নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছে। মন্ডপে ঢুকেই সুফী দেখলো সামনের সারিতে বসে আছেন ড. গুপ্ত আর তার পাশে মিত্রা। ওর কাছ দিয়ে সুফী যাচ্ছিল তার নিজস্ব প্রেস বিভাগে। মিত্রা দেখেছিলো ওকে। ইশারায় বললো তার পাশের খালি চেয়ারটায় বসতে।

‘ফিল্ম কেনা হয়েছে?’

‘শুধু ফিল্ম না, একটা নতুন কোডাক ক্যামেরাও কিনে ফেললাম। আমার রোলিফ্লেক্সটা ঢাকায় গিয়ে অফিসে ফেরত দিতে হবে। তাই নতুন ক্যামেরাটা কিনলাম। পঁয়ত্রিশ মিলিমিটার ক্যামেরা এটা। একনাগাড়ে ছত্রিশটা ছবি তুলতে পারবো সেই রকম ফিল্ম কিনেছি।’ ক্যামেরাটা ওকে দেখালো।

মিত্রা বললো, ‘শুধু শুধু আরেকটা ক্যামেরা কিনলে?’

‘শুধু শুধু নয়। তোমার ছবি তুলবো বলে কিনলাম বুঝলে।’

তারপর সুফী ড. গুপ্তকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ডায়াসের ওপরে বিলেতি চেহারার ভদ্রলোক নিশ্চয়ই পল ডিরাক, তাই না? আর অন্যজন কে?’

ড. গুপ্ত বললেন, ‘তিনি হচ্ছেন ড. হোমি ভাভা। এই টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের ডিরেক্টর।’

‘আচ্ছা, তিনিই তাহলে হোমি ভাভা!’ বললো সুফী। তারপর মিত্রার দিকে ফিরে বললো, ‘ভাভা যখন ক্যামব্রিজে পড়তে গিয়েছিলেন তখন ডিরাক ছিলেন ওখানকার লুকেসিয়ান প্রফেসর। তাঁর ডাইরেক্ট ছাত্র ছিলেন ভাভা।’

মিত্রা একটু হেসে মাথাটা একটু হেলিয়ে বললো, ‘তুমি অনেক খবর জোগাড় করেছো দেখছি। কোথায় পেলে এতো খবর?’

মিত্রা ড. গুপ্ত আর সুফীর মাঝখানে বসেছিলো।

ড. গুপ্ত এবার সুফীকে তাঁর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন, ‘তোমাকে ডিরাক সম্বন্ধে যে-বইটা দিয়েছিলাম সেটা কিন্তু পড়া হয়ে গেলে ফেরত দিও। ওটা আমার খুব দরকার। আমাকে যদি খুঁজে না পাও তাহলে সংঘমিত্রাকে দিয়ে দিও।’

সুফী বললো, ‘আহা, এই তো আপনি ওটা বলে সব মাটি করে দিলেন। আমি সকাল থেকে সংঘমিত্রাকে ডিরাক সম্বন্ধে অনেক খবর দিয়ে কী রকম ইমপ্রেস করছিলাম। ও ভাবছিলো আমি কতো স্মার্ট। আর আপনি সব ফাঁস করে দিলেন।’

মিত্রা চুপিচুপি বললো, ‘থাক, আমাকে ইমপ্রেস করার আর চেষ্টা করো না। আমি জানি এমনিতেই তুমি বেশ স্মার্ট। আমার বুঝতে বাকি নেই যে তুমি সবসময় বোকা সেজে থাকো বটে কিন্তু তলে তলে বোঝো সবকিছু। তাই না স্যার, আমি ঠিক বলিনি?’

এবার মাইকে প্রফেসর ভাভার গলা শোনা গেল। ‘আমি এই ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের প্রথম সায়েন্টিফিক সেশন শুরু হচ্ছে এবার। প্রফেসর ডিরাককে পেয়ে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। তিনিই এই সেশনের চেয়ারম্যান। তাহলে আপনারা ভাবছেন আমি এখানে কী করছি। তিনি চেয়ারম্যান আর আমি এখানে থেকে তাঁকে সাহায্য করবো। তিনি যেটুকু দরকার ঠিক সেটুকুই বলেন। আমি যখন তাঁর ছাত্র ছিলাম প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে তখন থেকেই দেখছি তিনি বড়ই স্বল্পভাষী। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় আরো কথা কম বলেন। বুঝেছি এ গুণটা সকলের থাকে না। শেখাও মুশকিল। আমি অনেক চেষ্টা করার পরও শিখতে পারলাম না। এই তো দেখছেন কতো             অবান্তর কথা বলে ফেললাম। আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম আজকের প্রথম পেপার যাঁর এখানে পড়ার কথা ছিলো তাঁকে প্রকৃতিই আজ প্রায় নির্বাক করে দিয়েছে। আমার বন্ধু ড. গুপ্তের ল্যারিনজাইটিস হয়েছে। তাঁর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। তাই পেপারের কো-অথর সংঘমিত্রা নোরবু আজকে আপনাদের সামনে দাঁড়াবে। ওর বয়স মাত্র বাইশ। কিন্তু ড. গুপ্ত আমাকে আশ্বাস দিয়েছেন বয়সে নবীন হলেও মিস নোরবু বুদ্ধি আর উৎসাহের দিক থেকে অনেক প্রবীণকেও হার মানায়। আর একটা কথা, ড. গুপ্ত বলেছেন। মেয়েটি নাকি একটু বেশি কথা বলে আমার মতো। আসুন, সংঘমিত্রা নোরবু।’

 

বারো

অনেক হাততালির সংবর্ধনার সঙ্গে মিত্রা উঠে গেল মঞ্চে। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো মাইকটাকে মুখের সামনে ধরে নিয়ে। দর্শকদের দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। সুফীর মনে হলো তার দিকেও চাইলো একবার। সেই মুহূর্তে ওর কাছে ঠেকলো যেন ইলোরার পাথরে খোদা নর্তকীর ঋজু ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শিল্পী। ওস্তাদের শাস্ত্রীয়সংগীত শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। তারপরই ওড়িশি নাচটা শুরু হবে।

তারপর পাশের দিকে চেয়ারম্যান আর কো-চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘যে দুজন জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকের সামনে আজ আমার দাঁড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে তাঁরা আমার নমস্য।’ বলে সে হাত জোড় করে তাঁদের দিকে চেয়ে নমস্কার করলো। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলো সেইভাবে। শ্রোতারা আবার হাততালি দিলো।

তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে এবার বলতে শুরু করলো, ‘আর আপনাদের মাঝে রয়েছেন আমার শিক্ষক ড. গুপ্ত, যিনি আমার হাত ধরে না থাকলে শিক্ষার জগতে আমার হাঁটতে শেখার আগে অনেকবার হোঁচট খেতাম। অবশ্য একদিক দিয়ে আপনাদের সৌভাগ্য যে, তিনি আজ কথা বলতে পারছেন না। তাঁর বাজঁখাই গলার জন্য তিনি আমাদের ল্যাবরেটরিতে প্রসিদ্ধ। তিনি যদি এখানে আজ দাঁড়াতেন তাহলে তাঁর হয়তো এই মাইক দরকার হতো না। আর আপনাদের মাঝে আরেকজন আছেন যিনি আজ একটা নতুন ক্যামেরা কিনেছেন আমার ছবি তুলবেন বলে। একটা মেয়ের জন্য এর চাইতে বড় কমপ্লিমেন্ট আর কী হতে পারে! মাত্র দুঘণ্টা আগে আমি জানলাম যে, আমাকেই এই পেপারটা পড়তে হবে। দেখুন আমার হাত কাঁপছে।’ বলে টেবিলে রাখা একটা গ্লাসে পানি ঢেলে এক ঢোক খেল। তারপর আবার বলতে লাগলো, ‘যাক, গলাটা ভয়ে একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিলো।’

সুফী ভাবছিলো বিজ্ঞানের একটা আনুষ্ঠানিক সভায় মিত্রা যে             এ-রকম ঘরোয়াভাবে তার বক্তৃতা শুরু করলো তাতে তার শ্রোতারা বিরূপ হবে না তো? কিন্তু না, আবার অনেক হাততালি পড়লো। হাসির আওয়াজও পাওয়া গেলো।

এরপর শুরু হলো তার বক্তৃতা। যার বিশেষ কিছু সুফী বুঝলো না। সাইক্লোট্রন তৈরি করতে গিয়ে কী-কী অসুবিধায় পড়তে হয়েছিলো এবং বিদেশের কোনো সাহায্য না নিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত একটা সিনক্রোট্রন তৈরি করলো তারই বিশদ বিবরণ। মনে হলো শ্রোতারা ভালো করেই শুনলো আর বেশ কিছু প্রশ্নও এলো তাঁদের কাছ থেকে। আবার অনেক হাততালি।

সুফী বেশ কয়েকটা ছবি তুললো তার হাতের দুটো ক্যামেরা দিয়েই। প্রথম প্রথম সুফীর একটু সংকোচ লাগছিলো – সবাই কি তার দিকে তাকিয়ে আছে? মিত্রা বলেছে তার নতুন ক্যামেরা কেনার কথা। ওরা কি বুঝতে পারছে তার নতুন ক্যামেরা দেখে যে সে-ই এই ব্যক্তি। মিত্রাকে ভালো করে বকে দিতে হবে।

তার পরের পেপারগুলো সুফীর জন্য অতো বোধগম্য হলো না। মিত্রাও বেশি মনোযোগ দিতে পারছিলো না। আস্তে আস্তে ওকে বললো, ‘আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এতক্ষণ আমি শুধু নার্ভাস এনার্জি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম। গত রাতে একদম ঘুমোতে পারিনি। হাসপাতালে জেগেই ছিলাম। তারপর আবার এই পেপার পড়ার ঝামেলা।… এই সেশন শেষ হওয়ার পর লাঞ্চ আছে। কোনোমতে খেয়েই আমি বাসায় গিয়ে ঘুম দেবো।’

ড. গুপ্ত বললেন, ‘আমিও আর বসে থাকতে পারছি না। আমার খাবার রুচি একদম নেই। আমিও বাসায় ফিরবো। তোমরা দুজন খেয়ে নিও এখানে। আবারো বলছি, তোমার পেপার পড়াটা বেশ ভালো হয়েছে।’

খাবার প্লেট নিয়ে ওরা দুজন এক কোণে একটা টেবিলে বসলো।

সুফী বললো, ‘বিকেলে আমি আমার কাগজের জন্য কপিটা লিখে ফেলবো। তারপর ওটাকে টেলেক্স করে ঢাকায় পাঠাতে হবে। তার আগে বলো তো, ডিরাক যে কী একটা স্ট্যাটিসটিকসের কথা বলছিলেন। আমি তো কিছু বুঝলাম না।’

‘সোজা কথায় যতো সব অ্যাটমিক পার্টিকল আছে, পরমাণুর চেয়ে ক্ষুদ্র যে কণাগুলো যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন, ফোটন, গ্র্যাভিটন ইত্যাদি সবই ঘূর্ণায়মান। মানে তাদের একটা স্পিন আছে। এর জন্য তাদের একটা অ্যাঙ্গুলার মোমেনটাম বা কৌণিক ভরবেগ তৈরি হয়। এটা অঙ্ক দিয়ে মাপা যায়। যে-সংখ্যাটা পাওয়া যায় সেটা যদি পূর্ণ সংখ্যা হয় তাহলে তাকে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস বলে। আর যদি ভগ্নাংশ হয় তাহলে তাকে ডিরাক-ফেরমি স্ট্যাটিসটিকস বলে। বৈজ্ঞানিকরা ভাবছেন, এ দুটোকে ছোট করে বোসন আর ফেরমিওন বললে ভালো হয়। এই চারজন বৈজ্ঞানিকের মধ্যে আইনস্টাইন, ডিরাক আর ফেরমি নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। পাননি শুধু সত্যেন বোস। তাঁর নামে এই কণার নামকরণ করা হলো বোসন। ফলে তাঁর নামটা দুনিয়ার সব বৈজ্ঞানিক জানবেন। শুধু তাই নয়, স্কুল-কলেজের ছাত্ররা যারা ভবিষ্যতে ফিজিক্স পড়বে, তাদের পাঠ্যবইতে এই বোসন নামটা থেকে যাবে – নোবেল প্রাইজের চেয়ে এটাই বা কম কি?’

‘সত্যেন বোস ঢাকায় থাকতেই আইনস্টাইনকে চিঠিতে লিখেছিলেন তাঁর অঙ্কের কথাটা। এটাকেই বোস আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকস বলে। আমরা শুধু এটুকুই শুনেছিলাম। আজ এই কংগ্রেসে এসে আমিও অনেক কিছু শিখলাম। ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার হলো। যদিও তোমার বক্তৃতার এইসব দুরূহ ইকোয়েশন আর সংকেত চিহ্নগুলোর মাথামুন্ডু আমি কিছু বুঝলাম না। বুঝবোও না কোনোদিন।’

‘তুমিও যে দুরূহ কবিতাগুলো লেখো আমিও বোধহয় ওগুলো বিশেষ কিছু বুঝবো না। তবু কিন্তু কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগে।’

‘ডিরাক নাকি কবিতা একদম পছন্দ করতেন না। তিনি মনে করেন, একটা সহজ বিষয়কে কথার মারপ্যাঁচে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা যাতে সহজে বোধগম্য না হয় সেটাই হচ্ছে কবিতা। ওপেনহাইমার ওদিকে কবিতা পছন্দ করতেন। ডিরাক এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্কও করেছেন।’

‘সত্যিই বিচিত্র এ-রকম এক-একজন বরেণ্য মানুষের মন আর তাঁদের ভাবনা। সব ভেবেচিন্তে মনে হয়, তাহলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরও গতি হতে পারে ভবিষ্যতে।’

‘তার মানে এবার তুমি আমাকে রুমির যে বইটা দিয়েছো, সেটা পড়া শুরু করতে হবে?’

 

তেরো

বিকেলবেলা গার্ডেন পার্টি হবে বোম্বে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের বাগানে। শহরের বেশ ব্যস্ত এলাকায় এই বড় ক্যাম্পাসটা। স্যার কাওয়াসজী জাহাঙ্গীরের মূর্তি সামনেই। এই পার্সি, শিক্ষিত ব্যবসায়ী অনেক টাকাপয়সা দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে।

৫টার কিছু আগেই সুফী পৌঁছলো সেখানে। রাজাবাঈ টাওয়ারের বিরাট ঘড়িটায় সময় দেখে সুফী খুশিই হলো, বেশি দেরি হয়নি তাহলে। এখন মিত্রাকে খুঁজে বের করতে হবে।

অনেক মানুষ গার্ডেন পার্টিতে। একটু ফরমাল অনুষ্ঠান। নিমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই জাঁকজমক বেশভুষায় সেজেগুজে এসেছেন। বিশেষ করে মহিলারা। দেখেই মনে হয় শহরের প্রচুর সম্ভ্রান্ত আর ধনী লোক এখানে জড়ো হয়েছেন। অনেক অল্পবয়সী ছেলেমেয়েও এসেছে, যাদের দেখলেই বোঝা যায় ওরা এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র। সবাই আগন্তুক অতিথিদের দেখাশোনা করছে।

এতো লোকজনের ভিড়ে মিত্রাকে কী করে খুঁজে পাবে?              এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে – এমন সময় মনে হলো একটু দূরেই নীল শাড়ি পরা মেয়েটা একটা সাদা বিদেশি ছেলের সঙ্গে হাত-পা নেড়েচেড়ে কথা বলছে। ছেলেটি সাদা শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পরেছে। তার জুতোটাও সাদা। আরে, সে-ই তো মিত্রা। ওকে আজকে এতো সুন্দর লাগছে যে তাকে চেনাই যায় না। আর নীল শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে সে একটা নীল ফুল পরেছে তার শিথিল খোঁপায়। এত সুন্দর নীল ফুলটা! হঠাৎ দেখলো সেই বিদেশি ছেলেটা সেই নীল ফুলটার দিকে দেখিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করলো মিত্রাকে। মনে হলো যেন ছেলেটা বলছে, এটা কি সত্যিই একটা প্রাকৃতিক ফুল না কাগজের তৈরি। মিত্রা নিজের মাথাটা একটু ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে চেয়ে কিছু বললো। আর সেও ফুলটাকে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো।

একটা হিংসের রেশ কিছুক্ষণ সুফীর মনের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকলো। সে তখন ভাবছে দূর থেকেই এই দৃশ্য সে দেখতে থাকবে। নাকি তাড়াতাড়ি মিত্রার কাছে চলে যাবে।

মিত্রা অবশ্য ঠিক তখনই ওকে দেখে ফেলেছে। হাত নাড়লো সেখান থেকেই।

সুফী আসতেই বললো, ‘কী এত দেরি করলে যে? আমি আধঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেছি। আমি তো তোমার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ তারপর সেই বিদেশি ছেলেটার দিকে চেয়ে বললো, ‘এ হচ্ছে জন ড্যানিয়েল। আমেরিকা থেকে এসেছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমারই মতো পার্টিকল ফিজিক্সের ছাত্র – গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে কাজ করছে।… আর এ আমার বন্ধু সুফী। কিন্তু আমি ওকে রুমি বলে ডাকি।’

ওরা হাত মেলালো। জন ড্যানিয়েল বললো, ‘আপনিও কি ফিজিক্সের?’

‘না, আমি একজন সাংবাদিক। এই কংগ্রেস কভার করছি আমার কাগজের জন্য।’

‘বলেন কী, আপনি সাংবাদিক? আবার সঙ্গে ক্যামেরাও আছে? আমি সাংবাদিকদের একটু ভয় পাই। কখন কী যে কাগজে ছাপিয়ে দেবেন, তারপর আমার চাকরি নিয়েই টানাটানি।’

‘ও-রকম কেন বলছেন?’ জিজ্ঞেস করলো মিত্রা।

‘আমার প্রফেসর ম্যানহাটান প্রজেক্টে কাজ করেছিলেন। আণবিক বোমা আবিষ্কারে তাঁর অবদান ছিলো। কিন্তু তিনি এর জন্য মনোকষ্টে ভুগতেন। হাইড্রোজেন বোমার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একেবারে ওপেনহাইমারের সাগরেদ। কিন্তু একটা সায়েন্টিফিক মিটিংয়ের পর একজন সাংবাদিক তাঁর কথাগুলো না বুঝতে পেরে কাগজে লিখে দিলেন তিনি এবার মত বদলেছেন – এডওয়ার্ড টেলারের প্রশংসা করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে টেলারের প্রশংসা তিনি করেছিলেন ঠিকই কিন্তু টেলার যে হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করার পথ বলে দিলেন তার জন্য ইতিহাসে তিনি নিন্দিত ব্যক্তি হয়ে থাকবেন। এ-কথাটি সাংবাদিক বুঝলেন না। তার ফলে কী হলো? এই ভুল তথ্য কাগজে ফলাও করে লিখলেন। আর আমার প্রফেসর নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেলেন। এতদিন তিনি আণবিক বোমার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি। এবার এই সাংবাদিকের ভুল খবর ছাপার জন্য চটপট তাঁর ডাক পড়ে গেল স্টকহোম যাওয়ার জন্য। তাই সাংবাদিকদের থেকে আমি একটু দূরেই থাকতে চাই।’

জন ড্যানিয়েল চলে গেল। ওর পথের দিকে চেয়ে সুফী বললো, ‘আমেরিকানরা এতো অভদ্র হয় কেন বলো তো?’

মিত্রা বললো, ‘কী জানি, অভদ্র হয়তো নয়। মনে হয় এটাই ওদের সেন্স অব হিউমার।’

ঠোঁট উলটে সুফী বললো, ‘ছাই।’

‘আচ্ছা বেশ।… তবে কি জানো, ছেলেটার সঙ্গে আমার একটু বিশেষ দরকার আছে।’

‘কী দরকার?’

‘তুমি অমন করে তাকাচ্ছো কেন আমার দিকে? তোমার চোখে কি দেখছি? হিংসে! ঈর্ষা! কেন বলো তো? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে।… আচ্ছা থাক, এখন বলতে হবে না। আগে আমার কথা শোনো। আমার জন্যে ভালো খবর। আজ ড. হোমি ভাভা আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। পার্টিকল অ্যাকসেলারেটারের ওপর আমার পেপারটা তাঁর ভালো লেগেছিলো। তিনিও সে-রকম একটা অ্যাকসেলারেটর তৈরি করতে চান তাঁর সেন্টারে। তবে তিনি লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর বানাবেন। এতে তাঁর রিসার্চের সুবিধা হবে। আর এই ড্যানিয়েলের প্রফেসর মাইলখানেক লম্বা মাটির তলায় একটা টানেল খুঁড়ে এইরকম একটা যন্ত্র বসিয়ে কাজ শুরু করেছেন তাঁর স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সানফ্রানসিসকোর কাছে পালো আলটোতে রয়েছে এই স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি। খুব নামকরা। ড. ভাভাই বললেন এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে। কিছু প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করতে।’

‘বেশ তো একমাইল লম্বা টানেলের ভেতরে যন্ত্রপাতি বসিয়ে কীসব করবে সে ব্যাপারে কথা বললেই তো হয়। তোমার খোঁপায় কী ফুল পরেছো সেটা নিয়ে ওর এতো কৌতূহল কেন?’

‘ওই দেখো আমার খোঁপায় কী ফুল পরেছি তা নিয়ে অন্য কারোর যদি আগ্রহ থাকে তাহলে তোমার এতো আপত্তি কেন? তোমার আপত্তি শুধু একটা কারণে হতে পারে।’

সুফী কোনো জবাব দিলো না। একটু গোঁজ হয়ে রইলো। মিত্রা একটু মুখ টিপে হাসলো।

‘বুঝেছি বুঝেছি – আর বলতে হবে না। তোমার চোখমুখই বলে দিচ্ছে। কিন্তু জানো তো, বড় বড় মনীষী সব বলে গেছেন – হিংসা করা খুব খারাপ। বুদ্ধ বলেছেন, গান্ধী বলেছেন, হিংসা করা ভালো নয়। মানুষের বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়ে যায় হিংসার জন্য।’

সুফী তবুও চুপ।

মিত্রা ওর মুখের কাছে একটা আঙুল নাড়িয়ে সুর করে বললো, ‘তুমি ধরা পড়ে গেছো। ঠিক কিনা? এখন মাথা নাড়ালেও বিশ্বাস করবো না।’

এবার সুফী মুখ খুললো। একটু লজ্জা পেয়েছে বোধহয়। বললো, ‘এই নীল ফুলটার নাম কী তাহলে?’

‘এটা নীল অপরাজিতা। হসপিটালের গেটের কাছেই ফুটেছিলো। গতকাল থেকেই ফুলটার ওপর আমার লোভ ছিলো। ওই একটাই ছিলো গাছে। কিন্তু লোকজন ছিলো আশেপাশে, তাই ছিঁড়তে পারিনি। এই ফুলটা দেখেই আমি ঠিক করেছিলাম আজ এই গার্ডেন পার্টিতে আমার নীল শাড়ি পরতে হবে। আসার সময় দেখলাম একজন মালি ফুলগাছগুলোতে জল দিচ্ছে। আমি বললাম, ভাই সাহেব এই নীল ফুলটা আমায় দেবেন? একটা পার্টিতে যাচ্ছি। আমার বন্ধু থাকবে সেখানে। আমার এই নীল শাড়ির সঙ্গে ভালো মানাবে। আমার বন্ধুর নিশ্চয় ভালো লাগবে। মালিটা অল্প একটু হেসে ফুল ছিঁড়ে আমার হাতে দিলো। আমি খোঁপায় পরে নিলাম। আমাকে আর ফুল চুরির বদনাম দিতে পারবে না। এরপর মালিটা আমাকে কী বললো জানো?’

‘কী বললো?’

‘সেটা বললে আবার হিংসে হবে না তো? বললো, এই অপরাজিতা ফুলটা গাছে যতো সুন্দর লাগছিলো, তার চাইতে এখন বেশি সুন্দর লাগছে আমার খোঁপায়।’

তারপর তাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য আবার বললো, ‘তোমার চোখেমুখে এই হিংসার ভাবটা আগে কখনো দেখিনি।’

একটু আড়চোখে সুফীর দিকে তাকিয়ে আবার বললো, ‘তোমাকে কিন্তু খুব স্মার্ট লাগছে। তোমার হালকা নীল সাফারি স্যুটটা আমার শাড়ির সঙ্গে মানিয়েছে। তার ওপরে যখন এই হিংসা-হিংসা ভাব চেহারায় এসে যায় তখন তোমাকে খুব অ্যাট্রাকটিভ লাগে। তোমাকে কোনো মেয়ে এখন পর্যন্ত এই কথাটা বলেছে?’

সুফী এবার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো, ‘ড. ভাভা কি এবার তোমাকে ক্যালিফোর্নিয়া পাঠাতে চান? কবে?’

‘ঠিক তাই। তিনি বলেছেন, আমার ডক্টরেটের পর। এখানে এসে বছরখানেক একটা কোর্স করতে হবে। ইলেকট্রিক্যাল আর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিখতে। সম্পূর্ণ নতুন জিনিস আমার জন্য। কিন্তু আমেরিকায় যাওয়ার আগে এই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ না জানলে কিছুই এগোবে না।’

‘এ তো বেশ ভালো খবর তোমার জন্য।’

‘তা তো বটেই… তবে তুমি আবার হিংসা করছো না তো?’

‘না। চলো ওদিকে যাই। ওখানে দেখছি খাবারের জন্য লাইন লেগে গেছে। আমার খিদেও পেয়েছে।’

‘চলো’ বলে দুজন ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।

মিত্রা হঠাৎ খুব খুশির সঙ্গে বললো, ‘দেখো, ওখানে পল ডিরাককে দেখছি। আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছেন দেখতে পাচ্ছো।’

সুফীর কনুই ধরে চাপা গলায় বললো, ‘পল ডিরাকের সঙ্গে আমার একটা ছবি তুলে দেবে? একজন নোবেল লরিয়েটের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। আর এ তো আর কেউ নয়, একেবারে পল ডিরাক। এ-রকম সুযোগ আর জীবনে কখনো আসবে না।’

মিত্রা নির্ভয়ে এগিয়ে গেল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সুফী দেখলো, ডিরাক যাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাঁদের দিকে একটু হেসে সরে এলেন আলাদা হয়ে। সুফী পরপর দুটো ছবি তুললো ওদের দুজনের। ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকলো বোম্বে ইউনিভার্সিটির ঘড়িওয়ালা উঁচু রাজাবাঈ ক্লক টাওয়ার।

‘কখন দেখতে পাবো এ-ছবি?’ মিত্রা বারবার বলতে লাগলো, ‘আমার তর সইছে না।’

সুফী বললো, ‘আর তিন-চারটে এক্সপোজার বোধহয় রয়েছে।            এ-ফিল্মটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আজকেই এটা শেষ করে কালকে দোকানে দেবো প্রিন্ট করতে। স্পেশাল এক্সপ্রেস প্রিন্ট করার জন্য বেশি পয়সা দিতে হবে। তবে দোকানে আমি বলেছি, আমি সাংবাদিক। আমার জন্য স্পেশাল রেটে করে দেবে।’

 

চৌদ্দ

ওরা খাবারের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। লম্বা লাইন। মিত্রা বললো, ‘বসার টেবিলগুলো সব দখল হয়ে যাচ্ছে। আমি একটু আরাম করে চেয়ারে বসে খাবো। তুমি একটা কাজ করো না। বামদিকে একটা টেবিল দেখা যাচ্ছে। তুমি ওখানে গিয়ে বসে পড়ো। আমি দুই প্লেট খাবার নিয়ে আসছি।’

সুফী তা-ই করলো। চেয়ারে বসেই গার্ডেন পার্টির আরো দুটো ছবি তুললো।

দুহাতে দুটো খাবারভর্তি প্লেট নিয়ে এলো মিত্রা। বললো, ‘দেখো তো এর ভেতরে কোনোগুলো তোমার ফেভারিট। এই জিলিপিগুলো কিন্তু এখনো গরম আছে। ওখানেই ভাজছে। আর এগুলো দেখো সন্দেশের মতো দেখতে কিন্তু এরা বললো পেঁড়া।’

তারই একটা তুলে নিয়ে সুফী মুখে দিলো। বললো, ‘হ্যাঁ, মজাই তো লাগছে। কিছুটা কড়া পাকের সন্দেশের মতো।’ আরো একটা বড় কামড় দিলো মিষ্টিতে। তারপরই কাশতে লাগলো সুফী। কাশির দমকে প্রথমে সুফী কথাই বলতে পারলো না। তার চোখমুখ লাল হয়ে পড়েছে। কিন্তু কাশি থামছে না। সুফীর মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। ইশারায় দেখালো এক গ্লাস পানি খাওয়া দরকার।

মিত্রাও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। বললো, ‘তাই তো, আমি দুহাতে দুই প্লেট খাবার নিয়ে এসেছি। ওখানেই পাশে লিম্বু পানি দিচ্ছিল কিন্তু আমি আনতে পারিনি। আচ্ছা আমি যাচ্ছি পানি আনতে।’ মিত্রা প্রায় দৌড়ে চলে গেল। ওদিকে সুফী কাশছে তো কাশছেই।

বেশ কিছুক্ষণ পর মিত্রা ফিরে এলো দুহাতে দুগ্লাস লিম্বু পানি নিয়ে। তারপর টেবিলে রাখলো গ্লাস দুটো। ততক্ষণে সুফীর কাশি কিছুটা থেমে গেছে। কিন্তু মিত্রার মুখ গম্ভীর। একবার সুফীর দিকে অদ্ভুতভাবে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর তাকালো সুফীর হাতে ধরা অর্ধেক লিম্বু পানিভর্তি গ্লাসটির দিকে। আর কিছু না বলে মিত্রা তার হাত থেকে সেই গ্লাসটা প্রায় কেড়ে নিলো। তারপর গ্লাসটাকে আস্তে আস্তে উপুড় করলো। লিম্বু পানি লনের ঘাসের ওপর ধীরে ধীরে পড়তে লাগলো। প্রথমে সুফী একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ মিত্রার এরকম ব্যবহার দেখে। টেবিলেই পড়েছিলো ক্যামেরাটা। কেন জানি সুফী চট করে ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে মিত্রার ছবি তুললো। তখনো গ্লাসটা সম্পূর্ণ খালি হয়নি। শেষ এক্সপোজার। এবার ফিল্মটা প্রিন্টিংয়ের জন্য দেওয়া যাবে। তারপর মিত্রাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কেন অতখানি লিম্বু পানি নষ্ট করলে? আমি তো আস্তে আস্তে খাচ্ছিলাম। দেখো না আমার কাশি সেরে গেছে।’

মিত্রার চোখেমুখে তখনো রাগ, ঈর্ষা, কষ্ট আর হিংসা মেশানো ভাব লেগে রয়েছে।

কাটা-কাটা স্বরে বললো, ‘কেন ওই লিম্বু পানি ফেলে দিলাম জানো না? একশবার দেবো। কী ভেবেছো তুমি আমাকে? আমি দৌড়ে গেলাম তোমার কাশি থামানোর জন্য লিম্বু পানি আনতে। ওখানে লাইন ভেঙে লোকের গালাগাল শুনে এতো কষ্ট করে লিম্বু পানি আনলাম। আর আমি দূর থেকেই দেখলাম, সেই লাল শাড়ি পরা লম্বা বেণিদুলুনি মেয়েটার হাত থেকে তুমি লিম্বু পানির গ্লাসটা নিলে। মেয়েটা হেসে হেসে তোমার সঙ্গে কথা বললো। তারপর তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। আর তুমি কতো আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসিমুখে মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করলে। তা মেয়েটার নাম কী? টেলিফোন নাম্বার নিয়েছো?’ খালি গ্লাসটা এবার মিত্রা ঠক করে টেবিলে রাখলো। গ্লাসটা ভাঙলো না কেন কে জানে?

নিরুপায় ভাব নিয়ে এবার সুফী বলতে লাগলো, ‘আমি তো মোটেই মেয়েটাকে ডাকিনি। আমি তখন কাশির চোটে একেবারে কাহিল। ও এখানকার একজন ভলান্টিয়ার। ট্রে হাতে করে এখান দিয়ে যাচ্ছিল। আমার কাশির অবস্থা দেখে ও দাঁড়ালো। তারপর বললো, আপনি এই লিম্বু পানিটা আস্তে আস্তে খান। কাশিটা ভালো হবে হয়তো। আমার মনে হয় আপনার ভোকাল কর্ডে খাবারের টুকরো আটকে গেছে। ইসোফেগাসে না গিয়ে ল্যারিংকসের দিকে চলে গেছে। সেজন্য ল্যারিনজিয়াল স্প্যাজম হচ্ছে। কোনো কথা বলার চেষ্টা করবেন না এখন। কারণ কথা বলতে গেলে আরো কাশি হবে। আচ্ছা এবার আপনার পিঠে আস্তে করে দুটো কিল মারবো। দেখেন কেমন হয়। সত্যিই আমার কাশি বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিন্তু মেয়েটিকে ডাকিনি। ও নিজেই এলো। পরে বললো, ও এখানকার গ্র্যান্ট মেডিক্যাল কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। প্রায় ডাক্তার হয়ে গেছে। সে আরো বললো, ‘এতেও যদি না হতো, আপনার কাশি থামছে না বা আপনার শ্বাস আটকে যাচ্ছে, তাহলে আমাকে হাইমলিখ ম্যানুভার করতে হতো।’

আমি বললাম, ‘সেটা আবার কী?’

সে বললো, ‘আপনাকে এই চেয়ার থেকে নামিয়ে লনের ওপর শুইয়ে দিতাম। তারপর আপনার ওপর পেটে আমার এক হাত মুঠো করে, অন্য হাত দিয়ে তার ওপরে এতো জোরে চাপ দিতাম যে, আপনার লাংগসে যে হাওয়া জমে আছে সেগুলো দ্রুত গলা দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করতো। তখন আপনার গলায় যে জিনিসটা আটকে আছে, সেটা কাশির দমকে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসে আপনাকে সুস্থ করে দিতো। অবশ্য এই ম্যানুভারও ফেল করতে পারে। তখন আমার হাতে মাত্র দু-তিন মিনিট সময় আছে। এতক্ষণ আপনার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। আপনার লাংগসে অক্সিজেন যাচ্ছে না। আপনি নীল হয়ে যাচ্ছেন। এই দু-তিন মিনিটের ভেতর আমি যদি আপনার লাংগসে অক্সিজেন দিতে না পারি তাহলে আপনি মরে যাবেন।’

‘তাহলে আমাকে বাঁচাবেন কী করে?’

‘তাহলে ইমার্জেন্সি ট্রেকিওস্টমি করতে হবে। আপনার গলায় এই যে কণ্ঠার হাড় দেখছেন, আপনারা অ্যাডামস অ্যাপল বলেন, আমরা বলি থাইরয়েড কর্টিলেজ। আর তার নিচেই রয়েছে ক্রিকয়েড কার্টিলেজ। এ দুটোর মাঝে আছে ক্রিকো-থাইরয়েড মেমব্রেন। এই নরম মেমব্রেনে আমাকে একটা ফুটো করতে হবে যাতে এই ফুটোর ভেতর দিয়ে আপনি শ্বাস নিতে পারেন। আর আপনার প্রাণটা তখনকার মতো বেঁচে গেলো।’

‘এতোসব কাটাকাটি আপনি করবেন কীভাবে এই দুমিনিটের ভেতর?’

‘কেন এই যে আপনার টেবিলে গার্ডেন পার্টির সব মজার মজার জিনিস খাবার জন্য ছুরি, কাঁটাচামচ আছে না? এগুলোই ব্যবহার করতে হবে। এই ছুরিতে ভালো ধার নেই। প্রায় ভোঁতা। ধারালো ছুরি কোথায় পাবো এখানে? এই ভোঁতা ছুরি দিয়েই কাজ চালাতে হবে। ভয় পাবেন না। অক্সিজেনের অভাবে আপনি ততক্ষণে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আমি কী করছি না করছি, কী দিয়ে আপনার গলার চামড়ায় ইনসিশন দিচ্ছি, আপনি সেসব কিছু খেয়াল করতে পারবেন না। ব্যথা তো পাবেনই না। আপনি তখন মৃত্যুর দ্বারে। আমি সেই ভোঁতা ছুরি দিয়ে ফুটো করলাম মেমব্রেনটা। আর আপনি শ্বাস নিয়ে বেঁচে গেলেন। অবশ্য সেই ফুটোটা যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, তার জন্য এই কাঁটাচামচের হাতলটা তার ভেতরে একটুখানি ঢুকিয়ে রাখবো। আপনার প্রাণটা তো বেঁচে গেলো। তারপর যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় আপনাকে এই কাছের গ্র্যান্ট মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে বাকি সব বন্দোবস্ত করা যাবে।’

এবার প্রচ্ছন্ন একটু ব্যঙ্গের সুরে মিত্রা বললো, ‘ওই হবু ডাক্তারের নাম যে বললে না আমাকে? আর ওর টেলিফোন নাম্বার।’

‘না, ওর নামটা তো জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আর টেলিফোন নাম্বার? কী বলছো তুমি? এসবের তখন সময় ছিলো নাকি?’

‘ওকে একটু থ্যাংকস দিতে হবে না? টকটকে লাল শাড়ি আর বেণিটা কী লম্বা হাঁটুর নিচে চলে গেছে ওর। আর এতো খাটো টাইট চোলি পরেছে! পিঠটা প্রায় খোলা। কিডনিতে ঠান্ডা লাগার ভয় নেই মেয়েটার?’

এবার সুফী আবার ঠাট্টা করে বললো, ‘মেয়েটার মুখটা গোল টাইপের। দেখতে অবিকল গীতাবলির মতো।’

‘গীতাবলি কে? তোমার পুরোনো গার্লফ্রেন্ড নাকি?’

‘আরে না। সোহাগ রাত ছবিটা দেখোনি? গীতাবলি সে ছবিতে দারুণ অভিনয় করেছিলো।’

‘সে যাই হোক, আমার হাতের নাগালে পেলে ওর গলা টিপে দেব।’

এবার হাসিমুখে সুফী মিত্রার দিকে চেয়ে বললো, ‘এসব যতোই বলো না কেন, এবার তুমি ধরা পড়ে গেছো।’

তারপর মিত্রার মতো আঙুল নাড়িয়ে মিত্রার মুখের কাছে তর্জনীটা নাড়াতে নাড়াতে সুর করে বলতে লাগলো, ‘তুমি ধরা পড়ে গেছো। আমি বুঝে ফেলেছি। দুনিয়ার সবাই বুঝে ফেলেছে। এমনকি আমি তোমার মুখটা আমার ক্যামেরায় বন্দি করে রেখেছি। ভাগ্যিস শেষ এক্সপোজারটা রেখেছিলাম। একেবারে ডকুমেন্টারি প্রুফ। পালানোর উপায় নেই। এতোখানি লিম্বু পানি কী করে তুমি ঢেলে ফেলে দিলে।  আজকেই ফিল্মটা ডেভেলপ করতে দেবো। কালকেই পেয়ে যাবো স্পেশাল ডেলিভারিতে।’

তারপর চট করে ক্যামেরাটা খুলে এক্সপোজড ফিল্মের রোলটা বের করে একবার মিত্রার চোখের সামনে নাচিয়ে নিজের পকেটে রাখলো। সুফীর খুশি যেন আর ধরে না।

তারপর একটু চুপ থেকে মিত্রা বললো, ‘তুমি একদম বোকা। সবকিছু বুঝতে তোমার এতো দেরি লাগে কেন?’ ওর গলায় একটু লজ্জার আভাস। বললো, ‘একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে কিছুই বুঝতে পারো না।’

মিত্রা আবার বললো, ‘কালকেই প্রিন্টগুলো পাওয়া যাবে তো? পল ডিরাকের সঙ্গে আমার ছবিটা ভালো হবে নিশ্চয়ই। ওটা দেখতে আমার তর সইছে না।’

হঠাৎ ওরা দুজন চুপ করে গেল। দুজনে দুজনের কাছে ধরা পড়ে গেছে। একটা নিশ্চিন্ত প্রশান্তির ভাব ছেয়ে থাকলো দুজনের মাঝখানে। চতুর্দিকে কতো মানুষ – নানা বয়সের, নানা বেশভুষায়। কেউ বসে আছে, কেউ ছোটাছুটি করছে। একটা চাপা গুঞ্জন ঢেউয়ের মতো কখনো উঠছে উঁচুতে আবার কখনো যেন শোনা যাচ্ছে না। ওরা দুজনে এই ভিড়ের মধ্যে থেকেও একেবারে আলাদা হয়ে গেছে যেন হঠাৎ করে। এই মুহূর্তগুলো উপভোগে দুজনে এতো ব্যস্ত যে কথা বলাও তখন  অবান্তর, অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। প্রায় নিষিদ্ধ।

চতুর্দিকের তরল নিস্তব্ধতা ভেঙে মিত্রাই প্রথম কথা বললো, ‘এই জিলিপিটা খেয়ে দেখো। বেশ ভালো। এইমাত্র ভাজলো কিনা, টাটকা, বেশ মজা।’

মিত্রা নিজ হাতে সুফীর মুখে একটুকরো গোলাপি জিলিপি দিয়ে বললো, ‘আস্তে আস্তে খাও। আবার কাশি শুরু হয়ে গেলে কিন্তু আমার আনা লিম্বু পানি খেয়ে তোমার কাশি হয়তো থামবে না। তখন এতো লোকের ভিড়ে কেমন করে খুঁজে বের করবো সেই লাল শাড়ি বেণি দুলুনি হবু ডাক্তার মেয়েটাকে?’

জিলিপি চিবোতে চিবোতে সুফী বললো, ‘বেশিদূর যেতে হবে না। আমি যা দেখছি তুমি কি তা দেখতে পাচ্ছো? সামনে বাঁদিকে তাকাও একবার। ওই যে ছড়ি হাতে বুড়ো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে তার পরেই কিন্তু সে আছে।’

‘হ্যাঁ, তাই তো?’ কৌতুকভরা কণ্ঠে মিত্রা বললো, ‘বেশ হাত-পা নাড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে তোমার লাল শাড়ি বেণি দুলুনি মেয়ে?’

সুফী বললো, ‘হ্যাঁ। আর তোমার সাদা সার্ট, সাদা প্যান্ট পরা সাদা ছেলেটা কী করছে? সেই তো স্ট্যানফোর্ডের জন ড্যানিয়েল।’

‘দেখো দেখো, ছেলেটা এবার মেয়েটার বেণি ধরে যেন মেপে দেখতে চাইছে কতো লম্বা?’

‘হ্যাঁ। স্ট্যানফোর্ডে এক মাইল লম্বা সুড়ঙ্গ খুঁড়বে সে। বেণি বেশি লম্বা, নাকি সুড়ঙ্গ বেশি লম্বা – কে জানে? তাই হয়তো মেপে দেখছে।’

হাসিমুখে ওরা নিজেদের দিকে তাকালো।

মিত্রা বললো, ‘না, অন্যদের দেখে এরকম হাসিঠাট্টা করা ঠিক নয়।’

সুফী সায় দিয়ে বললো, ‘ঠিকই বলেছো। আমাদের দুজনকে দেখেও তো অন্যরা ওরকম কথাবার্তা বলতে পারে।… আচ্ছা তোমার প্লেটের কেক আর পাকোড়া শেষ করে দাও তাড়াতাড়ি। আমার আর এতো লোকের মাঝে থাকতে ইচ্ছে করছে না। কাউকে চিনি না। হঠাৎ বোরিং লাগছে।’

‘আমারও সে-রকম লাগছে। চলো আমরা বেরিয়ে যাই এখান থেকে। মাত্র সাড়ে ৫টা বাজে।’

‘কোথায় যাবে বলো?’

‘আমার একবার ইচ্ছে করছে অরুণা আন্টি আর ব্রিগেডিয়ার সাহেবের বাড়ি গিয়ে তাঁদের খবর নিয়ে আসি। আজ এখানে আসার আগে আমি আমার ডাক্তার মামাকে তাঁদের নাতনির খবর জিজ্ঞাসা করেছিলাম। রানী এখন বেশ সুস্থ হয়েছে। ডেঞ্জার কেটে গেছে। কিন্তু এখনো বাড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা হয়নি। অরুণা আন্টিদের খবরটা দেবো।’

‘তা ওখানে গেলে ভালোই হয়। তুমি তাঁদের ঠিকানাটা মনে রেখেছো তো?’

‘হ্যাঁ, কাফ প্যারেড। খুব বেশি দূর নয় এখান থেকে। ওখানে মেহেরদাদ নামে একটা বহুতল বাড়ি আছে। তারই এগারোতলায় তাঁদের ফ্ল্যাট। এখান থেকে একটা ট্যাক্সিতে গেলে বোধহয় মিনিট পনেরো-কুড়ির বেশি লাগবে না।’

‘চলো।’

 

পনেরো

বেল টিপতেই স্বয়ং অরুণাই দরজা খুললেন। ওদের দেখে বেশ হাসিমুখে বললেন, ‘আরে এসো এসো। তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে আরো ভালো লাগছে।’

তারপর অরুণা ব্রিগেডিয়ার সাহেবের দিকে চেয়ে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তিনিও খুশি হয়ে বললেন, ‘এসেছো বলে খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না। বসো বসো। কী খাবে বলো, চা নাকি কফি?’

মিত্রা বললো, ‘আমরা এইমাত্র আমাদের গার্ডেন পার্টি থেকে এসেছি। ওখানে অনেক খাওয়া হয়েছে। আর কিছু দরকার নেই।’

‘আরে তাই কি হয়? আমি অবশ্য তোমাদের হুইস্কি অফার করবো না।’ তিনি নিজের গ্লাসটা দেখিয়ে বললেন, ‘তোমাদের মুখ দেখেই মনে হচ্ছে এই জিনিসে তোমাদের অভ্যাস নেই।’

‘আন্টি, আমি কফি খেতে চাই। আর কিছু নয়। গার্ডেন পার্টিতে অনেক আজেবাজে স্ন্যাকস খেয়েছি।’

‘অবশ্য বেশি কিছু দিতেও পারবো না আজ। কিছু মনে করো না। আমাদের ঘণ্টাখানেক পরেই বেরোতে হবে। আজ একটা বন্ধুর বাড়িতে সন্ধ্যার নেমন্তন্ন আছে – পারেলে। বেশ দূর এখান থেকে। অবশ্য তাঁরাই গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। রাত্রে খাবো না বলে আজ আমার বাবুর্চিটাকেও ছুটি দিয়ে দিয়েছি। তবে আমার ড্রাইভার রয়েছে। আজ সন্ধ্যার জন্য তোমরা গাড়িটা রাখতে পারো। জগদীশ তোমাদের বোম্বে শহরটা দেখাতে পারবে।’

অরুণা তাদের জন্য কফি তৈরি করতে করতে রান্নাঘর থেকে বললেন, ‘বোম্বেতে দেখার মতো অনেক জায়গা আছে। তোমরা কি কিছু দেখতে পেরেছো?’

‘না আন্টি। প্রথম দিন গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া দেখেছিলাম। তারপর আর কিছু দেখার সময়ই পাইনি। কনফারেন্স নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। এইবার একটু সময় পাবো।’

‘মালাবার হিলস তো যাওনি, তাই না? ওখান থেকে মেরিন ড্রাইভ রাত্রিবেলা সুন্দর লাগে। লোকে বলে মুক্তার মালা। দেখলেই বুঝতে পারবে কেন এরকম বলে। আর কতো রকম মজার মজার খাবার জায়গা আছে। আমরা তোমাদের আজ রাত্রে খাওয়াতে পারলাম না কিন্তু আমি জগদীশকে বলে দেবো, তোমাদের যাতে কৈলাস পর্বতে নিয়ে যায়। তোমাদের ফুচকা বা থালি খেতে ভালো লাগে?’

সুফী বললো, ‘ফুচকা আমার প্রিয় খাবার কিন্তু থালি কী রকম জানি না।’

মিত্রা বললো, ‘তুমি কখনো থালি খাওনি? আমার গুজরাটি থালি খুব ভালো লাগে – একেবারে নিরামিষটা। আজকে খাব।’

সুফী চারদিকে চেয়ে চেয়ে ফ্ল্যাটটিকে দেখছিলো। মাঝখানে লম্বা মতন বসার ঘর। তার একপাশে মনে হয় একটা ঘর। অন্যপাশে আরেকটা ওরকম ঘর। আর একদিকে রান্নাঘর। বেশ কমপ্যাক্ট কিন্তু মনে হয় – বেশ জায়গা আছে সবদিকে।

সুফী বললো, ‘ওদিকে সমুদ্রের পানি দেখা যাচ্ছে। ওটা কি আরব সমুদ্র – যেমন দেখেছিলাম গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার ওখানে।’

‘না, এটা উলটো দিক। এটাও আরব সমুদ্র কিন্তু এখানে এটাকে বলা হয় ‘ব্যাক বে’। এই যে বাড়ি, এটাও দাঁড়িয়ে আছে ওই ‘ব্যাক বে’ থেকে রিক্লেম করা মাটির ওপর। এই পুরো অঞ্চলটাই ছিলো এই কয়েক বছর আগে ‘ব্যাক বে’র জলের তলায়। আসলে বোম্বের প্রায় চারদিকে সমুদ্র। কিন্তু এখানে জনসংখ্যার যা চাপ তাতে বোম্বের পক্ষে এতো মানুষের জায়গা করা দুরূহ। ‘ব্যাক বে’ যেহেতু অতো গভীর নয়, তাই সমুদ্রে পাথরের বাঁধ দিয়ে ঘিরে সেই জলটা পাম্প করে বাইরের সমুদ্রে সরিয়ে ডাঙা তৈরি করে এইসব বাড়িঘর তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। জানো বোধহয় অনেকটা এইরকম হল্যান্ডে অনেক জমি ওরা সমুদ্রের জল সরিয়ে রিক্লেম করে অনেক বছর আগেই প্রমাণ করেছে যে, এটা সম্ভব। আমরাও সেই একইরকম ইঞ্জিনিয়ারিং করে বোম্বের আয়তন বাড়িয়েছি।’

সুফী জিজ্ঞাসা করলো, ‘এই রকম নতুন ভূমি তৈরি করা এখনো চলছে?’

‘হ্যাঁ, তাই। কবে যে এটার শেষ হবে আমরা কেউ বলতে পারি না।’

‘এই অঞ্চলটায় বেশ বড় বড় সুন্দর বাড়িঘর দেখছি। বড় দামি দামি হোটেলও বোধহয় তৈরি হয়েছে। মনে হয় সচ্ছল লোকেরাই এখানে বাস করতে পারে।’

‘ঠিকই বলেছো। এখানে জমির দাম অসম্ভব রকম বেশি। আমাদের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটের কথাই ধরো না। দুটো ঘর মাত্র। এই বসার ঘর আর রান্নাঘর, দুটো বাথরুম। এটা কিনতেই আমার জীবনের সব সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। অবশ্য আমার মতো একজন আর্মি অফিসার, বাঁধা মাইনে, কতোই বা সঞ্চয় করতে পারে। তবুও অরুণা আর আমি এখন অনেকটা খুশি ও নিশ্চিন্ত আছি। এই ফল্যাটের দাম হু-হু করে বাড়তে থাকবে ভবিষ্যতে। কারণ পশ্চিম ভারতের যতো ব্যবসায়ী, ফিল্মস্টার আর ধনী লোক সবাই বোম্বেতে থাকতে চায়। আসুক, আসুক ওরা। আমার সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই।’

অরুণা কফি নিয়ে এলেন টেবিলে। বললেন, ‘নাও, যার যেমন ইচ্ছে কফি বানাও। দুধ আর চিনিও থাকলো। আচ্ছা এরপর জগদীশ মানে আমাদের ড্রাইভার তোমাদের গাড়ি করে নিয়ে যাবে শহর দেখাতে। এ শহরে কিন্তু মারাঠি লোক বেশি, যদিও আমরা গুজরাটিরা কম নই। গুজরাটিরা ব্যবসায় বেশ চৌকস। তাই তারা সাধারণত বেশি ধনী। মারাঠিরা অতো সচ্ছল নয়। কিন্তু তারা রাজনীতির দিক দিয়ে বেশ শক্তিশালী। অনেকদিন থেকে এই নিয়ে একটু টানাহেঁচড়া হচ্ছে – বোম্বে গুজরাট প্রদেশের অংশ হবে, নাকি মহারাষ্ট্র প্রদেশের অংশ হবে। আমাদের জগদীশ কিন্তু মারাঠি। আর ও বেশ রাজনীতি সচেতন। ড্রাইভার হলে কী হবে, ওর বেশ কিছু পড়াশোনা আছে। তার নিজস্ব অভিমতও আছে। ভালো কথাবার্তা বলতে পারে আর নিজের অভিমতগুলো জোর গলায় প্রচার করে। ও মনে হয় অনেকটা বামপন্থীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ওর এইসব অভিমত যা-ই হোক না কেন, এ-রকম লোকেরা সাধারণত সৎ হয়। আর দৈনন্দিন জীবনে ওদের ওপর নির্ভর করা যায়।’

তারপর ওরা সবাই চুপ করে কিছুক্ষণ কফি খেতে লাগলো।

অরুণা আবার বললেন, ‘আমি আজ দুপুরের পর আমার নাতনিকে হাসপাতালে দেখতে গেছিলাম। তোমার মামার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, এখন মেয়েটা আশঙ্কামুক্ত কিন্তু খুব দুর্বল। ওকে হাসপাতালে আরো কিছুদিন থাকতে হবে। আরো কিছু টেস্ট করতে হবে। বোধহয় পরের সপ্তাহে ছুটি পেতে পারে। তোমাদের যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো ভেবে পাচ্ছি না। কারণ সেদিন তোমরা আমাদের সঙ্গে থেকে চটপট হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেছিলে। আমরা তো ভয় আর চিন্তায় হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। তোমরা না থাকলে কী যে হতো! তোমার মামা হাসপাতালে রানীকে খুব যত্ন নিয়ে দেখাশোনা আর চিকিৎসা করেছেন। এখনো করে যাচ্ছেন।’

এইসব কথাবার্তায় সুফী আর মিত্রা দুজনেই একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য সুফী বললো, ‘আঙ্কেল সেদিন আপনি বলছিলেন, শিলংয়ে প্রস্তাব দেওয়ার পর চটপট আপনাদের বিয়ে হয়ে গেল। তো বিয়ের পর আপনারা কোথায় গেলেন?’

‘কোথায় আবার? ঢাকা থেকে একলা বেরিয়েছিলাম, ফিরে এলাম দুজনে মিলে। আগের মতো ঢাকা ক্লাবেই প্রথমে উঠলাম। কিন্তু সেটা ছিলো একটা সিঙ্গেল রুম – ছোট ঘর, ছোট খাট। আমার রেজিমেন্টের সিনিয়র অফিসার কর্নেল ওটিস নিজেই বললেন, এবার তো তোমাদের থাকার জন্য অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকায় তখন ভালো বাড়িঘর বেশি তৈরি হয়নি। তখন ১৯২৬ সাল। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। কলকাতা আবার ভারতের রাজধানী হলো। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। এক বছর পরেই চলে গেল দিল্লিতে। যে কয়েক বছর ঢাকা একটা প্রভিন্সের মর্যাদায় ছিলো তখন বেশ কিছু সরকারি বাড়ি তৈরি হয়েছিলো এই রমনায়। কিন্তু রাজধানী যখন ফেরত গেল কলকাতায় তখন ঢাকা অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেল। কিন্তু ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলো তখন আরেকটা জোয়ার এলো ঢাকায়। আমরা একটা সুন্দর থাকার জায়গা পেলাম মিন্টো রোডে। ভবনের ওপরতলায় ছিলেন জেলার ইংরেজ পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট বউ আর ছোট বাচ্চা নিয়ে। আমরা নিচের তলায়। বেশ বড় কম্পাউন্ড। আর চারদিকে আরো কয়েকটা সুন্দর বাড়ি – সবই সরকারি আমলাদের জন্য। ওপরতলার ইংরেজের সঙ্গে আমাদের বেশি সদ্ভাব ছিলো না। আমরা নেটিভ লোক কিন্তু আমাকে ঘাঁটাতে সাহস করতো না। কারণ স্যান্ডহার্স্টের পাশ করা মিলিটারি অফিসার আমি। আর আমার চাইতেও জাঁদরেল ছিলো অরুণা। আমি তো প্রতিদিন সকালেই সাধারণত চলে যেতাম তেজগাঁও আর কুর্মিটোলার দিকে আমাদের মিলিটারি ছাউনিতে। আমার ব্যাটম্যান ছিলো নেপালি। তাকে আমি নিজে ইটাহারি থেকে রিক্রুট করে এনেছিলাম। তাকে রেখে যেতাম নিচের তলা পাহারা দেওয়ার জন্য, যাতে অরুণার কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য। পরে বুঝেছিলাম যে, তার কোনো দরকার ছিলো না। অরুণা প্রথমে স্বভাবতই ছটফট করতো একলা একলা। খুব তো কাজ ছিলো না বাড়িতে ব্যস্ত থাকার মতো। কিছুদিন পরে আমি ওকে বন্দুক চালানো শেখালাম। একটা ডাবল ব্যারেল বারো বোরের পাখি মারার বন্দুক কিনে দিলাম। বেড়াবার জন্য তখন শুধু কয়েকটা বাজে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যেত। অরুণার পছন্দ ছিলো না ওটা। আমারও নয়। অরুণা একটা সাইকেল কিনলো। আর আমার ব্যাটম্যান গুরুংয়ের সাইকেল আগে থেকেই ছিলো। ওরা বেরোতো সাইকেলে করে শিকার করতে।’

অরুণা বললো, ‘ঢাকা যে কী সুন্দর ছিলো তখন। ছোট শহর। তার মধ্যে রমনা একটা বাগানের মতো। সাইকেল চালিয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই আমরা প্রায় জঙ্গলের মধ্যে চলে আসতাম। মনে আছে কাছে একটা জায়গা ছিলো। আগারগাঁও তার নাম। সেখানকার জঙ্গলে অনেক খরগোশ পাওয়া যেত। আর কুর্মিটোলা ছাড়িয়ে কিছুদূর এগোলেই লালমাটির দেশে পৌঁছে যেতাম। মার্চ-এপ্রিল মাসে তখন শিমুল আর পলাশ ফুল ফুটে থাকতো। বড় বড় গাছ, পাতা প্রায় নেই – শুধু লাল ফুল। তার কিছুদিন পর মাঝে মাঝে যখন শিমুল গাছের ফুলগুলো ফেটে হাওয়ায় তুলো ছড়িয়ে পড়তো তখন মেঠো রাস্তার পাশের মাঠ সব সাদা তুলোয় ঢেকে যেতো। আর এপ্রিল-মে মাসে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোয় লাল লাল ফুলের আগুন লাগতো। তখন মনে হতো, এই ছোট্ট শহরটার চেয়ে সুন্দর শহর আর কোথাও নেই। আমি তো কলকাতায় কলেজে পড়তাম কিন্তু তখন ঢাকা অনেক বেশি সুন্দর লাগতো। অবশ্য মনে রেখো তখন শুধু আমরা দুজন নতুন বিয়ে করে প্রথম সংসার পেতেছি।… বাবা-মা মাঝে মাঝে আসতেন কলকাতা থেকে, নারায়ণগঞ্জে তাঁর পাটের ব্যবসার কাজে। সেখানে নদীর তীরে তাঁদের জন্য ছিলো বিরাট একটা বাড়ি। ওখানে গিয়েও থেকেছি। কী ভালো লাগতো নদীতীরের বাড়িটা। নদীতে কতো নৌকা, ছোটবড় নানা রঙের পালতোলা নৌকা।’

কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে আবার বলতে লাগলেন, ‘ওখানে আমাদের পাশের বাড়িতে একজন অল্পবয়সী ইংরেজ ভদ্রমহিলা থাকতেন তার বাবার সঙ্গে। আলাপ হয়েছিলো। খুব ইন্টারেস্টিং ভদ্রমহিলা। তখন জানতাম যে, ভবিষ্যতে তিনি একজন প্রসিদ্ধ লেখক হবেন। তাঁর নাম রুমের গডেন। তাঁর দুটো উপন্যাসের গল্প নিয়ে তৈরি করা সিনেমা বহুদিন পর আমি দেখেছি। একটা হচ্ছে দি রিভার – ফরাসি ডিরেক্টর জাঁ রেনোয়া তৈরি করেছিলেন সেই ছবি। লেখিকার অভিজ্ঞতায় নদীর পাশে পাটকলের জীবন নিয়ে যে-গল্প সেটা ছবিতে দেখানো হয়েছে। অবশ্য নারায়ণগঞ্জের জীবন নিয়ে নয় বরং কলকাতার কাছে হুগলী নদীর পাশে পাটকলের যাপিত জীবন নিয়ে। আরো শুনেছি যে, সত্যজিৎ রায় এ-ছবিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান হিসেবেও কাজ করেছিলেন। আর অন্য ছবিটার নাম হচ্ছে ব্ল্যাক নার্সিসাস। নেপালের মতো একটা প্রায় স্বাধীন হিমালয়ের রাজ্য নিয়ে কাহিনি। একদিকে কতকগুলো ইংরেজ আমলা, সৈন্য। যিশুখ্রিষ্টের ধর্ম প্রচারণার জন্য বদ্ধপরিকর কিছু মহিলা, তারা সবাই থাকে এক কনভেন্টে। অন্যদিকে হিমালয়ের পাহাড়, তার গাছপালা, জঙ্গল, বৃষ্টি বাদল ভেজা আবহাওয়া। আর যে-বাড়িতে কনভেন্ট তার দেয়ালে দেয়ালে বহু শতাব্দী আগে অাঁকা সর্বাঙ্গে কামনায় ভেজানো নগ্নিকাদের ছবি। কারণ যে-বাড়িতে এই খ্রিষ্টান নানদের কনভেন্ট বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো সেটা ছিলো এই রাজ্যের পুরোনো এক রাজার প্রাসাদ। সাধারণ লোকেরা ইংরেজদের ওপরে খুশি ছিলো। কোনো বিরুদ্ধাচারণ করেনি। কিন্তু প্রকৃতি ও ইতিহাসের একটা অব্যক্ত বৈরিতার বিরুদ্ধে ইংরেজরা টিকতে পারলো না। হার মেনে ফিরে গেল ভারতের সমতল ভূমিতে নিজের রাজত্বে। দুটো ছবিই পঞ্চাশের দশকে তৈরি করা হয়েছিলো। জানি না তোমরা দেখেছো কিনা। না দেখে থাকলে, সুযোগ পেলে ছবিগুলো দেখে নিও।’

কফিতে চুমুক দিতে দিতে সুফী বললো, ‘আপনাদের এই এগারোতলার ওপর থেকে বোম্বে শহর দেখতে কেমন লাগে একটু ওই বারান্দায় গিয়ে দেখা যায়।’

‘হ্যাঁ চলো।’ আন্টি বললেন, ‘অবশ্য খুব বেশি দেখা যাবে না। কারণ যা সব উঁচু-উঁচু বাড়ি চতুর্দিকে তৈরি হচ্ছে, এখন যা দেখা যায় তাও আর কিছুদিন পর ঢাকা পড়ে যাবে।’

ওরা সবাই বারান্দায় এলো।

‘ওই যে ডানদিকে দেখছো সমুদ্রের ধারে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ওটা নারিমান পয়েন্ট। কয়েকটা উঁচু বাড়ি এখনো তৈরি হচ্ছে। জায়গাটা প্রাইম লোকেশন। অনেক দাম জমির ওখানে। ভারতের এবং বিদেশেরও অনেক বড় বড় কোম্পানি ওদের করপোরেট অফিস বানাচ্ছে সেখানে। এখনো দেখা যাচ্ছে দূরে মালাবার হিলস। এই রকম আরো বেশি উঁচু-উঁচু বাড়ি তৈরি হলে তাও আর কিছুদিন পর দেখা যাবে না।… আর বাঁদিকে সমুদ্রের শেষের দিকে দেখা যাচ্ছে কোলাবা। সেখানে একটা ক্লাব আছে। তোমাদের আঙ্কেলের কল্যাণে আমরা সেখানকার মেম্বার। মাঝে মাঝে আমরা সাঁতার কাটতে যাই সেখানে। সুইমিংপুল আছে। আর সমুদ্রেও সাঁতার কাটার ব্যবস্থা আছে। আমার তো সমুদ্রে সাঁতার কাটতেই বেশি ভালো লাগে।’

ব্রিগেডিয়ার মেহতা যোগ দিলেন, ‘তোমাদের কিন্তু ওখানে ঢুকতে দেবে না। কারণ তোমরা বিদেশি।’ তারপর একটু হেসে বললেন, ‘তোমরা দুজনে বিদেশি কিন্তু আমার ভেবে আশ্চর্য লাগে যে, তোমাদের দুজনের দেশের সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়ে গেছে। ঢাকায় আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম সংসার। কী রকম অদ্ভুত সুন্দর দিনগুলো আমরা কাটিয়েছি সেখানে। প্রায় চার যুগ আগে। এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে।… জানি না কেমন আছে সেই জায়গাগুলো?’

সুফী বললো, ‘একদম বদলে গেছে ঢাকা শহর। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, আমি কুড়ি বছর আগেও যা দেখেছি তাতেও শহরটা যেন আর চেনা যায় না। কংক্রিটের জঙ্গল হচ্ছে দিন দিন।’

ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের বোম্বের মতোই হবে বোধহয়।’ তারপর আবার বললেন, ‘আর নেপালের সঙ্গে আমার অন্যরকম যোগাযোগ। কতোবার গেছি ওদেশে। ব্রিটিশ আর্মিতে গুর্খা সৈন্যদের রিক্রুট করার জন্য নেপালের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে বেড়িয়েছি। তারপর নেপালের গুর্খা সৈন্যদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে ফিল্ড মার্শাল আলেকজান্ডার, পরে ওয়েভেলের সঙ্গে যখন উত্তর আফ্রিকায় যুদ্ধ করতে গেলাম তখন আমি আমার প্রিয় গুর্খা রেজিমেন্টকে নিয়ে গেলাম। আমরা সবুজ প্রকৃতির দেশের মানুষ। প্রথম প্রথম মরুভূমির শুকনো কাঠখোট্টা আবহাওয়াতে যুদ্ধ করতে অনেক অসুবিধা হতো। তাছাড়া রোমেল আর তার জার্মান আফ্রিকা কোরের চৌকস সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একটা ভীতি ছিলো। তবে এই গুর্খারা স্টেনগান বাদ দিয়ে শুধু তাদের কুকরি হাতে নিয়ে ‘আয়ো গোর্খালি’ হাঁক দিয়ে শত্রুর মেশিনগান অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেত। তখন আমরা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখতাম। বোধহয় ওদের দেখে ফিল্ড মার্শাল রোমেলও ভয় পেয়ে যেত।’

মিত্রা জিজ্ঞেস করলো, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আর নেপালে যাননি?’

‘নিশ্চয়ই। আমরা গুর্খা সৈন্যদের গ্রামে গ্রামে কয়েকটা স্কুল আর হাসপাতালও তৈরি করেছিলাম। এটা ছিলো আমার একটা দায়বদ্ধতা। কারণ এসব জায়গার বেশির ভাগ লোক ছিলো গরিব। তখনকার দিনে নেপালে ট্যুরিজম বলে প্রায় কিছুই ছিলো না। আর নেপালের রাজাও এদের দিকে বিশেষ নজর দিতেন না।’

‘নেপালের কোন জায়গায় আপনারা প্রথম স্কুল বা হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন?’ জিজ্ঞেস করলো মিত্রা।

‘প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম ইটাহারিতে।’

‘বলেন কি? আমরা ইটাহারিতে অনেকদিন ছিলাম। আমি অবশ্য খুব ছোট ছিলাম। বোধহয় আমার বয়স তিন-চার বছর হবে। আমার বিশেষ কিছু মনে নেই। আমি শুনেছি বাবা তখন ইটাহারির সরকারি স্কুলে মাস্টারি করতেন। আমার বড়বোন আমার চেয়ে প্রায় আট বছরের বড়, সেই স্কুলে পড়তো। ইটাহারির একটা ঘটনার কথা আমার খুব বেশি মনে পড়ে। ছোট ছিলাম বটে কিন্তু সে-ঘটনা চিন্তা করলে এখনো মনে একটা ভীষণ ধাক্কা লাগে। আমি নাকি সেখানে একটা শুকনো কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছিলাম। মায়ের কথা না শুনে বাড়ি থেকে বেশ দূরে খেলতে চলে গেছিলাম। সেই অন্ধকার কুয়োর মধ্যে আমি কতো ‘আই মাম্মি’ বলে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। আমার বড়বোন স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার কান্না শুনে লোকজন জড়ো করে আমাকে কুয়োর ভেতর থেকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেছিলো।’ তারপর সুফীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সেই থেকে বোধহয় হঠাৎ অন্ধকারকে আমার এতো ভয় – একটা ফোবিয়ার মতো হয়ে গেছে।’

সুফী এবার বললো, ‘আচ্ছা তাহলে অন্ধকারের ভয় আর ‘আই মাম্মি’র পেছনের ঘটনার উৎপত্তি এখানেই।’

তারপর একটু থেমে মিত্রা আবার বললো, ‘আমার অতো মনে নেই। তবে আমাকে পরে আমার মা-বাবা বলেছিলেন যে, আর্মির লোকেরা আমাকে সেই শুকনো কুয়োর তলা থেকে উদ্ধার করেছিলো। কারণ সাধারণ গ্রামের লোকদের সেই অন্ধকার কুয়োর ভেতরে নামার কোনো যন্ত্রপাতি বা সাজসরঞ্জাম বিশেষ ছিলো না। তাই তারা কাছের সৈন্যদের ছাউনিতে গিয়ে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলো।’

এতক্ষণ অরুণা আর ব্রিগেডিয়ার মিত্রার কথাগুলো সাধারণভাবে শুনছিলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার মেহতা শেষের দিকে হঠাৎ তাঁর চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। তারপর আস্তে আস্তে মিত্রাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো তো সে মিলিটারির মানুষ কী পরেছিলেন। তোমার মনে পড়ে সেই অন্ধকারের মধ্যে তিনি তোমাকে দেখতে পেলেন কীভাবে?’

‘না, তিনি কী ধরনের পোশাক পরেছিলেন ওই অন্ধকারের মধ্যে সেটা দেখতে পাইনি। তবে তাঁর মাথায় একটা টর্চলাইট বাঁধা ছিলো।’

‘তারপর তোমাকে কী বললেন তিনি।’

‘তিনি বললেন, কাঞ্চি তুমি ঠিক আছো তো?’

‘আর তুমি বললে, মালাই ধেরাই ভোখ লাগেকো ছা। যেটুকু নেপালি জানা ছিলো তাতে বুঝলাম তোমার খুব খিদে পেয়েছে। সেটা স্বাভাবিক, তুমি সেই অন্ধকার কুয়োতে না খেয়ে সারাদিন পড়ে আছো।’

‘হ্যাঁ, তিনি তখন পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে আমার হাতে দিলেন। চকোলেট পেয়ে আমার কান্না থেমে গেল। তারপর তিনি একটা দড়ি দিয়ে আমাকে তাঁর পিঠের সঙ্গে ভালো করে বাঁধলেন। ওপরে যাঁরা ছিলেন তাঁরা দড়ি ধরে টেনে টেনে আমাদের ওপরে ওঠাতে লাগলেন।’

‘তারপর মাঝপথে আবার তুমি কাঁদতে শুরু করলে কেন?’

‘আমার হাত থেকে আধ খাওয়া চকোলেট টানাটানির মধ্যে পড়ে গেল কুয়োর মধ্যে। আমি কাঁদতে লাগলাম আবার।’

তারপর ব্রিগেডিয়ার মেহতা অন্য সকলের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘মেয়েটি আমার পিঠে কিল মারছে – সে আবার কুয়োর নিচে ফিরে গিয়ে চকোলেট উদ্ধার করতে চায়। কিন্তু আমি ওর কান্নায় একেবারে কান না দিয়ে ওকে নিয়ে সাবধানে উপরে উঠে এলাম। বেশ কষ্ট হয়েছিলো আমার। কুয়ো যদিও খুব গভীর নয়, কিন্তু দেয়ালে অজস্র আগাছা জন্মেছে। অন্ধকারে নিচে কী আছে বোঝা যায় না একেবারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠে এলাম উপরে।… বেশ হাততালি পড়ছিলো। সবাই আমাকে বাহবা দিচ্ছিল। আর ওর মা এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না।… বহুদিন আগের কথা কিন্তু জীবনে একবারই আমি কাউকে কুয়োর মধ্য থেকে উদ্ধার করেছি। তাও নেপালের ইটাহারিতে। সব ঘটনার বিবরণ মিলে যাচ্ছে।’

মিত্রা হঠাৎ ওর চেয়ার ছেড়ে ব্রিগেডিয়ার মেহতার পায়ের কাছে বসে পড়লো। বললো, ‘আঙ্কেল আপনিই আমাকে সেই অন্ধকার কুয়োর তলা থেকে বাঁচিয়েছিলেন? আপনি সেদিন ওখানে না থাকলে আমি তো সেখানেই মরে পড়ে থাকতাম। আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছি না।’

‘সেদিন তো মাকে পেয়ে আমার কথা ভুলেই গেছিলে। এতোদিন পর আর কিছু বলার দরকার নেই।’ মিত্রার থুঁতনি ধরে তিনি একবার আদর করলেন। তারপর আবার বললেন, ‘সেদিনকার ওই ছোট্ট মেয়েটা যে আধখাওয়া পড়ে যাওয়া চকোলেটের দুঃখে কাঁদছিলো, সে আজ নামকরা নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট হতে যাচ্ছে।’

মিত্রা তার আঙ্কেলের পায়ের কাছে মেঝেতে বসেই রইলো। মনে হলো সে বেশ আরামেই আছে।

‘মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে প্রথমে সে কান্না থামালো। কিন্তু তারপরই আবার কাঁদতে লাগলো। কী ব্যাপার, না সে তার আধখাওয়া চকোলেট উদ্ধার করার জন্য আবার কুয়োর তলায় ফিরে যেতে চায়।… অনেক বুঝিয়ে বলতে হলো যে ওকে আবার একটা নতুন চকোলেট দেওয়া হবে পরের দিন। কারণ আমার কাছে আর চকোলেট ছিলো না তখন। পরদিন আমাকে ওখান থেকে চলে আসতে হয়েছিলো। ওকে আর নতুন চকোলেট দেওয়া হয়নি।’

‘আচ্ছা, ইটাহারি ছাড়া আপনারা নেপালের আর কোথাও এই স্কুল, ক্লিনিক এসব তৈরি করেছিলেন?’

‘হ্যাঁ, এরপর আমরা ঠিক করলাম নেপালের পাহাড়ের দিককার জায়গায় কোথাও এরকম কাজ করতে হবে। কারণ ইটাহারি তো ডুয়ার্সের মতো সমতল জায়গায়। তোমরা একে মাধেসী বলো এবং ইন্ডিয়ার সঙ্গে এসব জায়গার বেশ সম্পর্ক আছে। মোটামুটিভাবে বলা যায়, এই মাধেসীদের আর্থিক অবস্থা পাহাড়ি এলাকার চাইতে তুলনামূলকভাবে ভালো। উঁচু পাহাড়ি জায়গায় বেশি চাষবাস হয় না। জলের অভাব আছে। রাস্তাঘাটও তেমন সুবিধার নয়। বাইরের জগতের সঙ্গে আনাগোনা জানাশোনা অনেকটা সীমিত। তাই আমরা ঠিক করলাম, এবার লুকলাতে এরকম একটা প্রজেক্ট করবো – যেমন ইটাহারিতে ছিলো।’

মিত্রা বললো, ‘আমাদেরও ইটাহারিতে ভালো লাগছিলো না। বাবার স্কুলের চাকরিতে মন ছিলো না। আর সেই ডুয়ার্সের জঙ্গলে খুব মশা। আমাদের সকলের অসুখ-বিসুখ লেগেই ছিলো। তাই যখন ধূলিখেলে নতুন ইউনিভার্সিটি খুললো বাবা সেখানে দরখাস্ত করলেন চাকরির জন্য। চাকরি পাওয়ার খুব আশা ছিলো না। একজন স্কুলমাস্টারের জায়গা থেকে ইউনিভার্সিটির লেকচারার পদে যাওয়াটা রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু দর্শনশাস্ত্রের জগতে বাবার নাম ছিলো। তাঁর লেখা প্রবন্ধ ম্যাগাজিনে বেরোত। ডিপার্টমেন্টাল হেডও বাবাকে জানতেন। তাই চাকরিটা বাবা পেয়েই গেলেন। আমাদের সকলেরই পছন্দ ছিলো ধূলিখেলের শিক্ষিত পরিবেশ। আর কিছু কিছু পাহাড়ও ছিলো আশেপাশে – যদিও খুব উঁচু নয়। ওখানকার দৃশ্যটা চমৎকার।’

‘কাঠমান্ডু থেকে লুকলা যেতে সবচেয়ে সুবিধা ছিলো প্লেনে যাওয়া। রাস্তাঘাট খুব ভালো নয় ওদিকে। অবশ্য যারা অ্যাডভেঞ্চারাস তারা কয়েকদিন ট্রেকিং করে লুকলা যেত। কিন্তু প্লেন সার্ভিস ছিলো বেশ বিপজ্জনক। ছোট রানওয়ে, প্লেন ছোট ছোট। আর আবহাওয়া হঠাৎ হঠাৎ খারাপ হয়ে যেত। এখনো শুনি এই বিপদগুলো রয়েছে। কুয়াশাকেই সবচাইতে বেশি ভয়। তবু আমাদের প্রজেক্ট ভালোই চলছিলো।’

‘কী অদ্ভুত, আমরাও যেন আপনাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছিলাম। ধূলিখেল থেকেই বাবা-মা আমাকে পড়তে পাঠালেন দার্জিলিং। আমি নাকি ছোট বয়স থেকে পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। আমার বড়বোন সেদিক দিয়ে অনেকটা ঘরোয়া। পড়াশোনায় ওর অতো মন নেই। তাই সে বাড়িতেই থাকলো বাবা-মায়ের সঙ্গে। দার্জিলিং থেকে আমাকে পাঠানো হলো শান্তিনিকেতনে। বাবার বিশ্বভারতীর লেখাপড়ার ওপর খুব বিশ্বাস। তাই আমাকে ওখানে যেতে হলো। আর বড়বোনের বিয়ে হয়ে গেলো সতেরো বছর বয়সে। আমি ছুটিতে এসেছিলাম বেড়াতে। আমাকে বড়দিদির সংসারে রেখে আমার বাবা-মা ঠিক করলেন এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে যাবেন লুকলা থেকে। লুকলার পথে প্লেন কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেল। প্লেনের ধ্বংসাবশেষ আর তাঁদের লাশ পাওয়া গেল চারদিন পর।’

সুফী প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে মিত্রার কথাগুলো শুনছিলো। মিত্রার ছোটবেলাকার কথাগুলো আগে কোনোদিন শোনেনি। এর ভেতরে যে এতখানি দুঃখের কথা লুকিয়েছিলো ও কখনো আগে ভাবেওনি। তার ইচ্ছে হচ্ছিল মিত্রাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে তার কষ্টের ভার কমিয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে কষ্ট করে সামলে নিতে হলো। তবে অরুণা আন্টি পারলেন না। তিনিও মিত্রার পাশে মেঝেতে বসে ওর মাথাটা নিজের কাঁধে নিলেন। মিত্রা চোখ মুছলো।

একটু চুপ থেকে আবার বলতে লাগলো, ‘আমার আর বিশ্বভারতীতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না তখন। কী হবে ওখানে পড়াশোনা করে। তার চাইতে দিদির সংসারে থেকে তাঁদের সাহায্য করাই বেশি দরকারি। কিন্তু কিছুদিন পরেই বিশ্বভারতী থেকে চিঠি এলো – তাঁরা আমার সব ঘটনা জানার পর ঠিক করেছেন একটা স্পেশাল বৃত্তি দিয়ে আমার পড়াশোনা যাতে এগিয়ে যায় তার ব্যবস্থা করবেন। কারণ আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আমাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। আমাকে এক বছর ছুটি দেওয়া হবে এখানকার সব সাংসারিক সমস্যা সমাধানের জন্য। আমার দিদি আর তাঁর বর – তাঁদের সংসারেই থাকলাম। নেপালি ভাষায় আমরা ভগ্নিপতিকে ‘ভিনাজু’ বলি। কিন্তু আমি তাঁকে দাদা বলেই ডাকতাম। আমাদের কোনো ভাই তো ছিলো না। দুজনেই আমাকে উৎসাহ দিলেন আবার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। দিদির ফুটফুটে ছেলে হলো। দাদাও তাঁর ব্যবসা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর ছিলো একটা লোহালক্কড়ের দোকান। এসময় নেপালে অনেক ট্যুরিস্ট আসতে শুরু করলো। দাদা তার বন্ধুর সঙ্গে মিলে ট্যুরিস্টদের জন্য একটা এজেন্সি আর একটা দোকান খুললেন কাঠমান্ডুর কাছে থামেল নামের শহরতলিতে। ট্যুরিস্টদের বেশ ভিড় ছিলো সেখানে। ব্যবসায় উন্নতি হলো চটপট। তখন তাঁরা একটা বাসা নিলেন থামেলে। ধূলিখেল ছেড়ে যেতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিলো। ওখানে বাবা-মায়ের স্মৃতি তো ছিলোই আর ওখানকার আবহাওয়া সবদিক দিয়ে আমার কাছে শান্তিময় ছিলো। কিন্তু দিদিরা থামেলই পছন্দ করলেন বেশি। তারপর এক বছর পর আমি আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে গেলাম।’

মিত্রা থামলো।

ব্রিগেডিয়ার সাহেব বললেন, ‘আজকে আর বেশি সময় নেই। আজ সংঘমিত্রার কাহিনি শুনলাম। আর একদিন সুফীর কথা শুনতে হবে। তবে তোমরা যদি মালাবার হিল থেকে বোম্বের চেহারা দেখতে চাও, তাহলে আর দেরি করা চলবে না। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই সেখানে পৌঁছোতে হবে। চলো, আমি জগদীশকে বুঝিয়ে বলে দিচ্ছি কোথায় কোথায় দিয়ে যেতে হবে। বোম্বে শহরের দর্শনীয় জিনিসগুলো তোমাদের যদ্দূর পারে দেখিয়ে আনবে।’

 

ষোলো

জগদীশ ড্রাইভার বললো, ‘আপনাদের মালাবার হিলে হ্যাঙ্গিং গার্ডেনসে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্যার বলেছেন। আর সেখানে যেতে হলে অন্ধকার হওয়ার একটু আগে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়। পরে রাত্রে খাবার জন্যে ‘কৈলাস পর্বত’ রেস্টুরেন্ট। ফুচকা আর থালির জন্য খুব ভালো জায়গা। আপনাদের আর কিছু দেখার ইচ্ছে আছে আজকে?’

সুফী বললো, ‘একটা কাজ যদি করা যায় – আমার এক রোল ফিল্ম তৈরি আছে প্রিন্টিংয়ের জন্য। আগামীকালই চাই। আজ কি খুব দেরি হয়ে গেছে? কোডাকের দোকান হর্নবি রোডে – সেটা কখন বন্ধ হয়?’

‘এটা একটা চিন্তার কথা। এখন আবার অফিস ফেরতা রাশ আওয়ারের সময়। হর্নবি রোড নামটা এখন বদলে রাখা হয়েছে স্যার ফিরোজ শাহ মেটা রোড। সেখানে কোডাকের দোকানে পৌঁছতে হয়তো বেশি দেরিই হয়ে যাবে। তবে যেদিকে যাচ্ছি সেখানে একটা ফটোগ্রাফির দোকানে আজ রাত ৮টার মধ্যে পৌঁছতে পারবো। ওখানে ওরা কাজ ভালোই করে।’

‘তাহলে তাই করো’ বলে সুফী আর মিত্রা গাড়ির পেছনের সিটে আরাম করে হেলান দিয়ে বসলো।

‘ঠিক আছে, তাই করি। অবশ্য রাস্তায় দেখার যা যা আছে, আমি আপনাদের কিছু কিছু বলতে পারবো। বেশিরভাগ সময় আমি মেরিন ড্রাইভের সঙ্গেই যাবো।’

কাফ প্যারেডের বড় বড় বাড়ি, অফিস, হোটেল এসব পেরিয়ে গেল। তারপর বামদিকে ওরা দেখলো একটা খুব বড় বস্তির মতো। দেখেই বোঝা যায় খুব গরিবরা এখানে থাকে। চারপাশে এত ধনী লোকের বাড়িঘর আর পাশেই এই গরিব বস্তি। একটু বেমানান। খারাপ লাগে দেখতে।

জগদীশ বললো, ‘এরাই কিন্তু এই এলাকার আদি বাসিন্দা। এসব জায়গায় এতো সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই বস্তি এখানে ছিলো। গরিব মেছোদের পল্লী। এদেরকে এখান থেকে সরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ এখানকার জমির             বিস্তর দাম, বুঝতেই পারছেন। কিন্তু ওরা কিছুতেই এই জায়গা ছেড়ে উঠবে না। আর যাবেই-বা কোথায়? বোম্বে শহরে জায়গার এত দাম – কোনোদিকে বাড়ার জায়গা নেই। সমুদ্র ঘিরে রেখেছে সবদিকে, আর যা একটু খালি জায়গা আছে তাও আবার বাসের অযোগ্য। জলাভূমির মতো। একমাত্র ভরসা সেসব জায়গার জলাভূমি শুকিয়ে মাটি উদ্ধার করা।’

তারপর একটু থেমে জগদীশ আবার বললো, ‘বোম্বে শহরে বোধহয় তিন ভাগের এক ভাগ লোক থাকে এইরকম বাসযোগ্য নয় এমন ঝুপরিতে। কিংবা একেবারে খোলা আকাশের নিচে রাস্তার পাশে। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে লোকজন একটু-একটু করে এই শহরে রোজই আসছে। খুব শিগগিরই ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় শহর হয়ে যাবে বোম্বে।… আচ্ছা আপনাদের একটু ঘুরিয়ে নিয়ে যাই। সামনেই বামদিকে দেখবেন একটা সুন্দর চার্চ। আমার চক্ষুশূল এটা। এটার নাম আফগান চার্চ। গত শতাব্দীতে ইংরেজরা আফগানিস্তানে তিনবার আক্রমণ চালিয়েছিলো। ওদের ভয় ছিলো রাশিয়ার জার ইন্ডিয়া আক্রমণ করবে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে। আফগানদের বশ মানাতে পারেনি ব্রিটিশরা। ইন্ডিয়ায় যতো সহজে ওরা সব দখল করে ফেলেছিলো, ভেবেছিলো আফগানিস্তানেও সে-রকম করবে। কিন্তু তিনবারই যুদ্ধে হেরে ফিরতে হয়েছিলো ব্রিটিশদের। আর সেই আফগান যুদ্ধে যেসব ব্রিটিশ সৈন্য মারা গিয়েছিলো তাদের স্মৃতিরক্ষার জন্য এই গির্জা। আমি তো বুঝি না এখন স্বাধীন ভারতবর্ষে এ-রকম একটা গির্জা থাকার কী দরকার? কর্তৃপক্ষ খালি বলেন, ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য এসব দরকার। কী জানি?’

বড় রাস্তাগুলোতে এখন ভীষণ গাড়ির ভিড়। জগদীশ ছোট-ছোট রাস্তা দিয়ে ভিড় এড়িয়ে চলেছে। বললো, ‘ডানদিকে একটু দূরে আছে তাজমহল হোটেল আর গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া। আমরা ওদিকে যাবো না।’

মিত্রা বললো, ‘হ্যাঁ, আমরা ওদিকটা প্রথমদিনই দেখেছি। আর সামনেই তো দেখছি বোম্বে ইউনিভার্সিটি। আমরা তো আজ বিকেলে ওখানেই ছিলাম।’

আর একটু এগিয়ে গিয়ে জগদীশ বললো, ‘আপনারা ট্রেনেই এসেছিলেন তো। তার মানে আপনারা এই সামনের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনে নেমেছিলেন। ইংরেজদের বাহাদুরি দিতে হয় যে কতোদিন আগে ওরা এই স্টেশন বানিয়েছিলো। আর ট্রাফিক আগে থেকে বোধহয় দশগুণ বেড়েছে। তবুও বেশিরভাগ ট্রেনের জায়গা এখানে হয়ে যায়।’

গাড়ি এবার চলতে লাগলো আরো ছোট-ছোট রাস্তা দিয়ে।

জগদীশ বললো, ‘আপনাদের একটা মন্দির দেখাবো এবার। খুব একটা সুন্দর নয়। এটা মুম্বাদেবীর মন্দির। বোম্বের লোকে তাঁকে এখানকার স্পেশাল দেবী বলে মানে। অনেকে তাই এখন থেকে দাবি করছে, ভবিষ্যতে বোম্বে শহরের নাম বদলে মুম্বাই করতে হবে। দেখা যাক, এটা হয় কিনা।’

গাড়ি এবার গিয়ে পড়লো মেরিন ড্রাইভে। এখন স্পিড একটু বাড়লো। চওড়া রাস্তা সমুদ্রের ধার দিয়ে। বামদিকে সমুদ্র, ডানদিকে প্রায় একরকম স্টাইলে উঁচু বাড়িগুলো। দেখতে সত্যিই সুন্দর লাগে।

জগদীশ বললো, ‘বামদিকে দেখেন চৌপাটি বিচ। দেখছেন ওখানে কী ভিড়?’

সত্যিই অজস্র লোকজন সেখানে। সমুদ্রের ধারে বালুর বিচে প্রচুর ভিড়। ফেরিওয়ালারা কতোরকম জিনিস বিক্রি করছে। পুরো ফ্যামিলি এক-এক জায়গায় পিকনিক করছে। মনে হলো দু-একটা সভা-মিটিংও হচ্ছে। মোটকথা একটা আনন্দের পরিবেশ। তারপর রাস্তাটা সমুদ্রঘেঁষে বামদিকে মোড় নিলো। একটু উঁচু-নিচু রাস্তা এবার। জগদীশ বললো, ‘আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি হ্যাঙ্গিং গার্ডেনসে। আমি এবার আপনাদের এখানে নামিয়ে দিচ্ছি। সামনের রাস্তা দিয়ে আপনারা হেঁটে ওপরে উঠলেই একটা বাগানে পৌঁছবেন। দেখবেন একটা বাচ্চাদের পার্কের মতো, জুতোর মতো একটা বাড়ি। ঠিক সময়েই পৌঁছাবো। সূর্য অস্ত যাচ্ছে দেখুন। এখনো রাস্তার আলোগুলো জ্বলেনি। এখানে একটা সুবিধামতো বেঞ্চে বসে মেরিন ড্রাইভের দিকে তাকাবেন। যখন রাস্তার আলোগুলো হঠাৎ জ্বলে উঠবে তখন বুঝতে পারবেন কেন মেরিন ড্রাইভকে ‘মুক্তার মালা’ বা পার্ল নেকলেস বলা হয়। আচ্ছা আপনার ফিল্মের রোলটা দিন। আমি ওটা ফিল্মের দোকানে দিয়ে আসবো। আমি ঘণ্টাখানেক পর ফিরে আসবো। এক ঘণ্টা পর আপনারাও এখানে আসবেন। গাড়িটা এখানেই থাকবে।’

ওরা ঘুরেফিরে বাগানটা দেখলো। অনেক লোক পার্কে। সবাই মেরিন ড্রাইভের আলো জ্বলার অপেক্ষায়। কোনো বেঞ্চ খালি নেই। আরো অনেকের মতো শেষে ওরা ঘাসের ওপরেই বসে পড়লো। শেষ পর্যন্ত আলোগুলো যখন জ্বললো তখন প্রায় সবাই ‘আঃ উহ্, কী সুন্দর’ ইত্যাদি বলতে লাগলো।

মিত্রা সুফীর হাতটা ধরে বললো, ‘আজকের দিনটা আমার সবসময় মনে থাকবে। কতো কিছু ঘটে গেল আমার জীবনে। এখনো সবকিছু ভালো করে হিসাব করে উঠতে পারছি না। রুমি, তুমি কিছু বলছো না কেন?’

একটু চুপ করে থেকে সুফী মিত্রার হাতটা নিজের দুহাতে ধরে কানে কানে বললো, ‘এখানে এই পার্কে যতো লোকজন আছে সবাইকে আমার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে – For God’s sake hold your tongue and let me love .’

সুফীর গলায় একটা গাঢ় সিরিয়াস ভাব ছিলো। এটাকে হালকা করার জন্য মিত্রা বললো, ‘ও রকম কান্ড একদম করো না। এরা কেউ শেষের কবিতা পড়েনি। জন ডান তো দূরের কথা। তোমাকে পাগল ভেবে ওরা পুলিশও ডাকতে পারে।’

মিত্রা হালকাভাবে কথাটা বললো কিন্তু ওর স্বরে একটু লজ্জার আভাস ছিলো বোধহয়।

কিছুক্ষণ ওরা নিঃশব্দে কাটালো মেরিন ড্রাইভের আলোর মালার দিকে তাকিয়ে।

মিত্রা বললো আবার। ওর কথায় তখনো একটু লজ্জার রেশ, ‘তোমার মনে আছে বোম্বেতে আমাদের প্রথমদিনের কথা। গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার রেস্টুরেন্টে তোমার লেগপুলিং করছিলাম আমি। তোমার ক্লাসের মেয়ের শীতের গান শুনে তোমার কেমন শিরশিরানি হচ্ছিল। তুমি জিজ্ঞেস করলে আমার জীবনে ওরকম কখনো হয়েছিলো কিনা? আমি সেদিন প্রশ্নটার উত্তর দিইনি। পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আর একদিন আমার কথাটা বলবো, যেদিন সুযোগ ও সময়টা ঠিকমতো আসবে। আমার মনে হচ্ছে এখন সেই সময় এসেছে। আমাদের দুজনের মধ্যে কোনো লুকোচুরির আর দরকার নেই। সব মুক্তমনে বলা উচিত।’

 

সতেরো

আলো-অন্ধকারের মধ্যে মিত্রা তাকালো সুফীর দিকে। চোখমুখ দেখতে পেলো না কিন্তু হাতের আঙুলগুলো ঠিকই বুঝিয়ে দিলো যে, সে মুহূর্তের সামনে দুজনেই আজ উপস্থিত।

মিত্রা বলতে শুরু করলো, ‘আচ্ছা ওর নামটা না হয় না-ই বললাম। ও তো এখনো বেঁচে আছে। তাই নামটা গোপন থাকাই ভালো। তবে তুমি তাকে একটা নাম দিতে পারো।’

‘না, আমিও কোনো নাম দিতে চাই না। নামে আর কী আসে-যায়! তুমি ইচ্ছে করলে তৃতীয় পুরুষ একবচন ব্যবহার করতে পারো।’

‘আচ্ছা তাই। ছেলেটা আমার তিন বছর সিনিয়র ছিলো।            দেখতে-শুনতে বেশ, সপ্রতিভ আচরণ, আর শুনতাম খুব অবস্থাপন্ন পরিবারের একমাত্র ছেলে। ক্রিকেট খেলতো ভালো, লেখাপড়ায় অতো না। আর টেবিল টেনিসে আমি ওকে হারিয়ে দিতাম। আমার মনে হতো, এটা ও পছন্দ করতো না। তাই বলে কি আমি নিজে ইচ্ছে করে হেরে যাবো? লজ্জা লাগে ভাবতে, মাঝে মাঝে তাও ইচ্ছে হতো – যদি তাতে সে আমার দিকে একটু আগ্রহ দেখায়।’

‘এটা কি তুমি কোনোরকমে ওকে বুঝতে দিতে?’

‘কী জানি। আমি যে ওর দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকতাম, সেটা ও বুঝতে পারতো কিনা তাও বুঝতাম না। আমার অন্য মেয়েবন্ধুরা কেউ কেউ হয়তো বুঝতো। মাঝে মাঝে ছেলেটার সম্বন্ধে ওরাও আলোচনা করতো। করবে না কেন? ও-রকম প্রায় ছয় ফুট লম্বা, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, স্মার্ট ছেলে সব মেয়েকেই আকর্ষণ করতো। কিন্তু আবার কানাঘুষাও শোনা যেত। একাধিক মেয়েকে সে কাছে টেনে এনে আবার দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ওর কতকগুলো বদভ্যাস আছে। যার কারণে যে মেয়ে একবার ওকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে, সে ভবিষ্যতে ওর ছায়া মাড়াতে চাইতো না। এসব কথা আমার বন্ধুরা আমার জন্যই আমাকে লক্ষ্য করেই হয়তো বেশি করে বলতো। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য কিন্তু ওই বয়সে যা হয় – এই সাবধান বাণী আমি এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতাম। যা হোক, আমি ওর বেশি কাছে যেতে পারলাম না।’

সুফী জিজ্ঞেস করলো, ‘পড়াশোনার ব্যাঘাত হতো নাকি ওই ছেলেটার চিন্তায়?’

‘হ্যাঁ, প্রথম-প্রথম হতো বোধহয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় ভালোই তো করলাম। সে-ই বরং খারাপ করলো। ও যে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য আরো সত্যিকার সুন্দর মেয়েদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলো, তার জন্য এখন ওকে ধন্যবাদই দিতে চাই।… তারপর কলকাতায় সায়েন্স কলেজে ভর্তি হলাম। নতুন জীবনের দায়িত্ব আর পড়াশোনা নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে, ওর স্মৃতিটা বোধহয় কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো। ভালোই ছিলাম। তারপর গত বছর ভাবলাম, বসন্ত উৎসবে আবার শান্তিনিকেতনে গেলে কেমন হয়? কতো পুরনো শিক্ষক আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হবে। পুরনো সব জায়গাতে আবার ফিরে যাবো। তাই গেলাম। থাকার জায়গা আমার নতুন মাস্টারমশাই ড. অবনী গুপ্ত ঠিক করে দিলেন। তাঁর বোন থাকতেন প্রান্তিকে। ওদিকটা তখন সবে ডেভেলপ করছে। তাঁর ওখানে গিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। আর দুদিন পরে ড. গুপ্ত নিজেই                 শান্তিনিকেতনে যাচ্ছেন। অতএব।’

‘ওই বসন্ত উৎসবে বুঝি আবার দেখা হলো?’

‘ঠিক তাই। সে-ও এসেছে, দেখা হলো। এবার সে নিজে এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে কথা বললো। পরনে এবার গরদের পাঞ্জাবি আর পাজামা। অন্যরকম লাগলো দেখতে। আগের চেয়ে সুঠাম, স্বাস্থ্যবান। মাথার চুল আগের চেয়ে বেশি ঝাঁকড়া হয়েছে। কিছু-কিছু চুল সামনের কপালে এসে পড়ছে এবং হাত দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিতে হচ্ছে। কী যে হলো আমার তখন? পুরনো স্মৃতিগুলো হঠাৎ সামনে এসে পড়লো সবকিছু সরিয়ে দিয়ে। আমার দিকে আগে যে ফিরেও তাকাতো না, এখন নিজে থেকে ইন্টারেস্ট দেখিয়ে আমার সঙ্গে যেচে আলাপ করতে এসেছে। ইংরেজিতে যাকে বলে, সোয়েপ্ট অফ মাই ফিট – আমার তখন সেই অবস্থা। আমার মুখে আবির মাখিয়ে দিলো। সবাই তো তাই করছে। আমিও ওর মুখে আবির দিলাম। কিন্তু ও যখন আমাকে আবির মাখালো, তখন আমার মুখটা দুহাতে অনেকক্ষণ ধরে থাকলো।’

‘থাক, আর বেশি ডিটেইলে গিয়ে কাজ নেই।’ বললো সুফী। ‘তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি। তারপর কী হলো বলো?’

মিত্রা কিছুক্ষণ সুফীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘হিংসে করার কিছু নেই। আর একটু শুনলেই বুঝতে পারবে।… তারপর কিছুক্ষণ মামুলি কথাবার্তা, কোথায় উঠেছো, কে-কে এসেছে সঙ্গে, কদিন থাকবে। সবাই পুরনো বন্ধুবান্ধব মিলে একটা আড্ডার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়, এইসব। তারপর বললো, ও নিজে এসেছে একা কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে। উঠেছে রতনপল্লীর কাছে একটা হোটেলে। বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে ওঠেনি। কারণ হোটেলে থাকলে একটু স্বাধীনতা থাকে। যখন ইচ্ছে বের হওয়া যায়। অন্য কাউকে ডিস্টার্ব করার দরকার হয় না। আর নিজের গাড়ি যখন আছে তখন তো আরো স্বাধীন।

আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে একবার চোখ টিপলো। …এখন মনে হয়, এক-এক সময় আসে আমাদের জীবনে যখন তখনকার ঘটনার আবর্তে পড়ে সত্যিই বুদ্ধি লোপ পেয়ে যায়। তাই সে বললো, ‘এসো আজ রাত্রি ৯টার দিকে কাঁচঘরের ফাংশনে। তারপর আমরা একটা লং ড্রাইভে যাবো, কেমন?’

রাজি হয়ে গেলাম। ১০টার পরে ফাংশন শেষ হলো। আমাকে হাত ধরে ওর গাড়িতে ওঠালো। তারপর লং ড্রাইভে চালালো গাড়ি। সেই সাঁওতালপল্লী ছাড়িয়ে। খোয়াইরের বাঁধ ছাড়িয়ে গাড়ি চললো। একটু পরেই আমার মনের রোমান্টিক ভাব ছাপিয়ে একটু চিন্তা হতে শুরু করলো। শান্তিনিকেতনে বহু বছর আছি; কিন্তু এত রাত্রে এদিকপানে কখনো আসিনি। অন্ধকার রাস্তা, একেবারে নির্জন। আমি আড়ষ্ট হয়ে বসে আছি।

ও হেসে বললো, ‘ভয় করছে বুঝি? কিছু চিন্তা করো না। আমি এদিকটা বেশ ভালো করে চিনি। কতোবার এসেছি এসব জায়গায়।’

বললাম, ‘রাত্রে এ-রকম নির্জন জায়গায় আমার সত্যিই ভয় করছে। ফিরে যাওয়া উচিত।’

ও বললো, ‘তুমি দেখছি ভীষণ ভীতু মেয়ে। এর একটা বিহিত করা উচিত। আচ্ছা চলো, ফিরে যাই। যেখানে অনেক আলো আর লোকজন আছে। সেখানে গেলে তোমার এসব ইনহিবিশন লোপ পাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় যাবে তাহলে?’

ও বললো, ‘চলো বোলপুর স্টেশনে। ওখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই নিশ্চয়।’… আমি একটু আশ্বস্ত হলাম। আলো আর লোকজন সেখানে আছে ঠিকই। কিন্তু এতো রাত্রে ওখানে কী এমন আকর্ষণীয় বস্ত্ত থাকতে পারে জানি না। দেখা যাক।

স্টেশনে পৌঁছে বললো, ‘তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। আমার তো পেয়েছে। আর তেষ্টাও পেয়েছে বটে। চলো ওখানে একটা ভালো ব্যবস্থা আছে।’

ওয়েটিং রুমে ঢুকে সে আস্তে-আস্তে ডাক দিলো, ‘বাংকু, সব ঠিক আছে তো। যেরকম বলেছিলাম বিছানায় সেই বেড কভারটা ঠিক করে বিছিয়ে দিয়েছিস? রক্তকরবী ফুল রয়েছে টেবিলে? জানিস তো এ-রকম সময়ে রক্তকরবী আমার পছন্দ বেশি।’

ও গাড়ি থেকে একটা প্লাস্টিক ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। সেটা লোকটার হাতে দিয়ে বললো, ‘এটা রাখ এখন। একেবারে বিলিতি মাল আছে এতে। ঘরটা ভালো করে পরিষ্কার করে রেখেছিস তো? আগে আমাদের কিছু খেতে দে।’

স্টেশন মাস্টারের অফিসের লাগোয়া আর একটা ঘরে আমাকে নিয়ে ঢুকলো। বললো, ‘জায়গাটা নিরিবিলি। আমাদের কেউ বিরক্ত করবে না। এমনকি ট্রেন আসার পরও।’

ঘরটির একধারে একটা বিছানা সুন্দর একটা ডিজাইন করা চাদর দিয়ে ঢাকা। একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার পাশে। টেবিলেও একটা প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথ। একটা ছোট ফুলের ভাঁজে একগাছা রক্তকরবী ফুল। কিন্তু দেয়ালগুলো একটু যেন নোংরা – সিলিংয়ের কাছে ঝুল, শুধু একটা ইলেকট্রিক বাল্ব ছাদ থেকে ঝুলছে ঘরের মধ্যিখানে। আলো যথেষ্ট না। একটা সিলিং ফ্যান আস্তে-আস্তে ঘুরছে।

ভ্যাপসা গন্ধ একটু যেন। কেন? ঘরে কোনো জানালা নেই। দরজা একটাই – বাইরের সঙ্গে এই দরজা দিয়েই সম্পর্ক।

আমার মনে একটা ধাক্কা লাগলো। ও আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলেছিলো – জায়গাটা নিরিবিলি। উলটো প্রতিক্রিয়া হলো আমার মনে। একটা দোটানায় পড়ে গেলাম। বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু যাবো কোথায়? দেখি কী হয়! নিরিবিলি না হলেই ভালো হতো।

সে দুই প্লেট পাকোড়ার মতো কিছু নিয়ে এলো। দুই গ্লাস জল। বরফ একটা পাত্রে।

আমাকে বললো, ‘এগুলো খাও। আরো মুরগির কাটলেট আছে। আমি সঙ্গে একটু হুইস্কি খাবো। তুমি খাও?’

আমি মাথা নাড়লাম।

‘একেবারে গ্লেনমোরানজি। সিংগল মল্ট। একবার খেলে স্বাদ জিভে লেগে থাকবে সারাদিন। অন্তত একটু চেখে দেখতে পারো।’

বোতল এলো। স্পেশাল দুটো গ্লাস। আমার গ্লাসে একটু জল ঢেলে দিলো কিছুটা। নিজের গ্লাসটা তুলে নিয়ে বললো, ‘খেয়ে দেখো। চিয়ার্স।’

এক চুমুক খেলাম – কেন জানি না। আগেই বলেছি একটা দোটানায় ছিলাম। দেখি না কী হয় শেষ পর্যন্ত। স্বাদটা খুব খারাপ লাগলো না কিন্তু ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে আমাকে, ‘আর না। আর খেও না এ জিনিস।’ আমি বললাম, ‘তেতো লাগছে। বমি হয়ে যাবে।’ গ্লাসটা নামিয়ে রাখলাম।

একটু হেসে ও আমার গ্লাসের বাকিটুকু নিজের গ্লাসে ঢেলে দিলো। তারপর বললো, ‘আচ্ছা এটা যদি না পারো, তবে একটু রেড ওয়াইন খাও। এটা অনেকটা মিষ্টি। মুরগির মাংসের সঙ্গে ভালো যাবে।’

আমার গ্লাসে রেড ওয়াইন ঢেলে দিলো।

‘এটা ফ্রান্সের রেড ওয়াইন। এর স্বাদই আলাদা।’ চুমুক দিলাম। সত্যিই এই ওয়াইনের স্বাদ মিষ্টি। খিদে একটু পেয়েছিলো। কাটলেট খেলাম। শুকনো গলা একটু ভিজলো মিষ্টি ওয়াইনের কল্যাণে। কমিনিট কাটলো এভাবে জানি না। একটু পরেই লক্ষ করলাম আমার গ্লাস অর্ধেক খালি। এতখানি ওয়াইন খেয়ে ফেলেছি এরই মধ্যে। মাথাটা একটু হালকা লাগছে। গলার ভেতরে পেছন দিকে একটু গরম গরম লাগছে।

ও বললো, ‘একটু আস্তে আস্তে খাও। হঠাৎ বেশি খেলে ভালো লাগার সময়টা বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। তোমার চোখ দুটো অলরেডি ঢুলুঢুলু হয়ে আসছে কিন্তু। মনে হয় জীবনে আগে কখনো             এ-রকম ওয়াইন খাওনি। তাই একটু রয়েসয়ে খাও।’

আরো কিছুক্ষণ গেল।

আমি আরো দুই ঢোক খেলাম। আমারও তখন একটু জেদ চেপে গেছে। আমি শুনেছি, ও অন্য মেয়েদেরও নাকি এরকম ভাবে এখানে এনে হুইস্কি খাওয়াতো। আমি শুধু জানতাম না বোলপুর স্টেশনের এই অন্ধকূপ ঘরটার কথা।

ও আবারো বললো, ‘তোমরা নেপালের লোকেরা, বিশেষ করে মেয়েরা, তোমাদের পেটে নাকি মদ সয় না। চট করে মগজে চলে যায়। কথাটা বোধহয় সত্যি – তোমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে।’

ও উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘এরপর যা হবে সেটা উপভোগ করা দরকার। এ-রকম ঢুলতে থাকলে সব মাটি।’

ওর হাতদুটো আমার কাঁধে নেমে এলো। আমার শাড়ির অাঁচলটা মনে হলো ইচ্ছে করে ঠেলে নিচে নামিয়ে দিলো। আমার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বললো, ‘আমাদের বাঙালি মেয়েরা কিন্তু এদিক দিয়ে অনেক ভালো। কথা শোনে। তোমার মতো এতো তাড়াতাড়ি সম্বিৎ হারিয়ে ফেলে না। দাও তোমার গ্লাসটা। এখন আর খেও না।’

ওর মুখের হুইস্কির গন্ধ আমার ওয়াইনের গন্ধ ছাপিয়ে আমার           মস্তিষ্কটাকে চাবুক মারলো যেন। আমার গা ঘিনঘিন করে উঠলো।

তারপরই আমি বুঝলাম ও আমার শরীরটাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি আর বেশি বিস্তারিতভাবে কিছু বলতে চাইছি না। শুধু আমার সেই মুহূর্তে মনে হলো ইংরেজিতে যাকে ‘গ্রোপিং’ বলে সে তাই করছে। এবার আমি বুঝতে পারলাম আসলে ওর মতলবটা কী। এখানে এই অন্ধকূপের মতো ঘরে আমায় কেন নিয়ে এসেছে।

ওর হাত দুটোকে আমি ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলাম। ও একটু হকচকিয়ে গেল। বোধহয় ও এটা আশা করেনি। পিছিয়ে গেল দুই পা।

আমি বললাম, ‘আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি একটু বাইরে খোলা হাওয়ায় যেতে চাই। আমি চিৎকার করবো তা না হলে।’

‘বেশ তো চলো না আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে বাইরে।’

‘না, তোমাকে যেতে হবে না। আমি নিজেই যাবো।’

আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু আমার পা দুটিতে যেন কোনো জোর নেই। মাথাটাও টলছে।

ও ডাক দিলো, ‘বাংকু, এ-ধারে আয়। ওঁকে একটু প্লাটফরমের খোলা হাওয়ায় নিয়ে যা।’

লোকটা দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। ও চোখের ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিলো আমাকে কিছুক্ষণের জন্য বাইরে নিয়ে যেতে। বললো, ‘ওর মুখে আর মাথায় একটু ঠান্ডা জলও দিয়ে দিস্। এই গরমে ওর মাথা ঘুরছে। সাবধানে নিয়ে যাস।’

লোকটা আমার হাত ধরতে যাচ্ছিল। আমি ওকে বুঝিয়ে দিলাম আমি নিজেই যেতে পারবো।

বাইরে এসে অনেক ভালো লাগলো। প্লাটফরমে একটা বেঞ্চে বসলাম আমি। নির্জন জায়গা।

লোকটা আমাকে বললো, ‘আপনার খুব খারাপ লাগছে দিদি? আপনি আর ওসব খাবেন না। ও যেসব মেয়েকে এখানে নিয়ে আসে আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছি আপনি তাদের মতো নন।’

দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল একটা ইঞ্জিনের হেডলাইট। ওটা ক্রমাগত কাছে আসছে।

‘ওই যে কলকাতা থেকে রাতের ট্রেনটা আসছে। তা আপনি কোথায় থাকেন?’

আমি বললাম, ‘প্রান্তিকে উঠেছি। এখান থেকে তো অনেকদূর।’

‘আমি আপনাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে পারি। পরের স্টেশনটাই তো প্রান্তিক। আপনি সেখানে নেমে রিকশায় বাড়ি যেতে পারবেন না?’

‘হয়তো পারবো।’

‘আমি গার্ডকে বলে দেবো আপনার দেখাশোনা করতে। তাহলে আর আপনার টিকিটও লাগবে না।’

‘অনেক ধন্যবাদ। আপনার কথা শুনে আমি খুব আশ্বস্ত হলাম। আপনি যে এত ভালো মানুষ প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি।’

ট্রেন এলো প্লাটফরমে। বেশ হইচই। অনেক লোক নামলো স্টেশনে।

ভাগ্যিস আমাকে আর ট্রেনে উঠতে হলো না। প্রায় সবাই চলে গেছে। তারপর আমি দূর থেকে দেখতে পেলাম আমার মাস্টার মশাই ড. গুপ্ত ট্রেন থেকে নেমে এদিকেই আসছেন।

আমাকে দেখে তিনি চমকে গেলেন যেন।

‘এত রাত্রে তুমি এখানে কী করছো? কোথাও যাচ্ছো নাকি?’

আমি বুদ্ধি করে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি এই ট্রেনে প্রান্তিকে যাওয়ার জন্য বসে আছি। ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে ঠিক করলাম এখান থেকে রিকশা না নিয়ে, ট্রেনে গিয়ে ওখান থেকে রিকশা নেবো। আপনার দিদিকে আর যাতে বেশি চিন্তা করতে না হয়।’

‘তাহলে ভালোই হলো। এখানে আমার জন্য গাড়ি আছে। চলো আমরা একসঙ্গে যাই। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে আসবো।’

মিত্রা এবার থামলো। সুফীর দিকে তাকালো। অন্ধকারে ওর মুখটা দেখতে পেলো না। কিন্তু এতক্ষণ যে ও কথা বলছিলো, সুফী ওর একটা হাত ধরেই রয়েছিলো। সুফী এর আগেও তো অনেকবার মিত্রার হাত ধরেছে। কিন্তু এবারের হাত ধরাটা অন্যরকম যেন। ‘আমি আছি তোমার পাশে। ভয় নেই।’ এই রকম একটা সান্ত্বনার আশ্বাস ছিলো সেই ছোঁয়ায়।

‘মানুষের মন যে এতো নোংরা হতে পারে সেটা আমি নিজে ঠেকে শিখলাম। অনেক কানাঘুষা শুনেছিলাম এর আগে ছেলেটা সম্বন্ধে – সে বদ, মাতাল। অন্য মেয়েদের কতো ঠকিয়েছে কিন্তু তখন আমার বয়সটাই ছিলো এমন যে কারোর কথা, চেহারা আর বাইরের চটকদার ব্যবহার দেখে শুধু আমি কেন, অন্য অনেক মেয়ে ওর ফাঁদে পড়েছে।’

দুজনেই চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ।

পার্কে লোকজনের সংখ্যাও কমছে। সেই সুযোগে ওরা আরো সরে এলো। তবে ওদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।

মিত্রা এবার বললো, ‘আমি তোমাকে প্রথমদিন বলেছিলাম যে, মনের ভেতরের ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে আরো কষ্ট পেতে চাই না কিন্তু এসব কথা তোমাকে বলে এখন আমার অনেক হালকা লাগছে। যতো কষ্ট হবে বলে ভেবেছিলাম, সে-রকম মোটেই হচ্ছে না। এখন যদি তোমার নিজের জীবনে এ-রকম কোনো ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সেটা অকপটে বললে আমার  মনে হয় তোমারও ভালো লাগবে।’

 

আঠারো

সুফী বললো, ‘হ্যাঁ, আমার জীবনেও একটা ঘটনা ঘটেছিলো, যেটা ভোলা সম্ভব নয় কোনোদিন। যদিও কষ্টের কিন্তু তোমার মতো কষ্ট নয়। হ্যাঁ, ওর নাম বলতে আমার দ্বিধা নেই। ও আর বেঁচে নেই। তাই অনায়াসে বলা যায়। ওর নাম ছিলো মাহেলী। ইকোনমিক্সে পড়তো ইউনিভার্সিটিতে, আমাদের বছরতিনেক জুনিয়র। আমি চিনতাম না। আমার ছোটবোন মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। সে একটু-আধটু রাজনীতি করতো। আমি রাজনীতির দিকে মোটামুটি মুখ ফিরিয়ে থাকতাম। সাহিত্য নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম আর তখন সবে খবরের কাগজে ঢুকেছি। আমার ছোটবোন শিখা একদিন আলাপ করিয়ে দিলো আমাদের বাড়িতেই। বললো, ‘ভাইয়া একে চেনো? ও মাহেলী। আমরা যখন গেন্ডারিয়ায় থাকতাম ও আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো।’ হ্যাঁ, মনে পড়লো সেরকম কেউ থাকতো বটে, তোর সঙ্গে খেলা করতে আসতো। অস্পষ্ট মনে আছে। তারপর শিখা আমাকে চুপি চুপি বললো, ‘ওকে তুমি চামচিকে বলে ডাকতে। রোগা হাত-পা ছিলো। চুলে তেল দিত না। আর সমবয়সী সব ছেলেমেয়েকে নিয়ে দল করে সরদারি করতো। টমবয় যাকে বলে। এখন দেখ কী রকম সুন্দরী হয়েছে। পল্লবিনী সঞ্চারিণী বলবে, নাকি তন্বী ফর্সা শিখরদশনা বলবে?’ মাহেলী শিখাকে ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু শিখা আরো বলে চললো, ‘আজকে তুমি আমাদের সঙ্গে চলো একটা মিটিংয়ে, যাবে তো?’

‘কিসের মিটিং বলো?’

‘স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মিটিং। মাহেলী সেখানে বক্তৃতা দেবে। ও তো জেনারেল সেক্রেটারি। তুমি এসব কিছু খোঁজ রাখো না। কিসের সাংবাদিক তুমি?’

মাহেলী কিছু বললো না। শুধু কৌতুক মেশানো একটা চাহনি দিলো।

মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী। একটা মামুলি অসুন্দর টমবয় যখন বয়ঃসন্ধিতে একজন দৃষ্টিকাড়া যুবতী হয়ে যায় তখন শুধু একটা বিশ্রী শুঁয়োপোকা থেকে রঙিন প্রজাপতির বিবর্তনের কথাটাই মনে পড়ে যায়।

মিটিংয়ে গেলাম। মাহেলীর বক্তৃতা শুনলাম। রাজনীতিতে ভরা তার ভাষণ। আমি নিজেও অতো খুঁটিনাটি জানতাম না কেন দেশের অবস্থা এরকম। আইয়ুব খানের রাজত্ব দেশকে কীভাবে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে – তাই ছিলো তার প্রতিপাদ্য বিষয়। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি। ওর গলার স্বর ওর চেহারার চাইতে বেশি মিষ্টি।

শিখা আমাকে বললো, ‘মাহেলীর একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারো ভাইয়া। ওর যা ব্যাকগ্রাউন্ড, সাংবাদিকতাই ওর জন্য সবচেয়ে ভালো হবে। তোমার কাগজে চেষ্টা করে দেখবে?’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও গান করে নাকি? এতো সুন্দর ওর গলা। শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতা আর ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিতে থাকলে গলাটা নষ্ট হয়ে যাবে।’

শিখা বললো, ‘তুমি জানো না ভাইয়া, ও সারাদিন স্লোগান, বক্তৃতা, চেঁচামেচি সবই করবে কিন্তু কেউ কোনোদিন ওর গলা ভেঙেছে বলে শোনেনি।’

মিটিং ভাঙার পর আবার মাহেলীর সঙ্গে দেখা হলো একটুখানিকের জন্য।

ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি গান করো নাকি?’

মাহেলী জবাব দিলো, ‘না, গান করে সময় নষ্ট করতে চাই নে। অন্য কতো দরকারি কাজ আছে।’

তারপর একটু চুপ করে বললো, ‘আমি যদ্দূর জানি চে গুয়েভারা গান করতেন না।’ এমন একটা ভাব নিয়ে বললো, যদি চে গুয়েভারা গান না করেন, তাহলে সে কোন দুঃখে গান করবে?

এরপর মাহেলী আমার অস্তিত্ব জুড়ে থাকলো অনেকখানি। যদিও কাউকে জানতে দিলাম না। বিশেষ করে শিখাকে। তবে শিখা মাঝে মাঝে ওর কথা বলতো, আর আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনতাম।

তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি তথা গোটা দেশটাকে গভর্নর মোনায়েম খাঁ এমন দাপটের সঙ্গে শাসন করতে লাগলেন যে, কবিতা লিখি বা সাহিত্য করি, একটা খবরের কাগজের অফিসে বসে তখনকার দিনের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব নয়।

অফিসে প্রায়ই মাহেলীর নাম শোনা যেত। আর আমি ভাবতাম, চে গুয়েভারা গান না করলে, এতো মিষ্টি যার গলা, সেও গান করবে না। এর পেছনে লজিকটা কোথায়?

তারপর মাহেলী ইউনিভার্সিটির পালা চুকালো। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। আবার শিখা আমাকে মাহেলীর একটা চাকরির ব্যবস্থার জন্য মনে করিয়ে দিলো।

আমাদের সম্পাদকের সামনেই কথাটা পাড়লাম একদিন। তিনিও মাহেলীর নাম শুনেছেন। বললেন, ‘দেখি ভেবে।’ তার মানে ওর চাকরি হয়ে যাবে।

সম্পাদক সাহেব আমাকে ভার দিলেন ওকে হাতেনাতে কিছু কাজ শেখানোর জন্য। আমার মেনটর ওয়াহাব চাচাও ওকে কিছু কিছু তালিম দিতে থাকলেন।

প্রথম থেকেই লক্ষ করলাম ওর সব ঘটনার একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা আছে। একটা কালবৈশাখী ঝড় হলো। অনেক কিছু লন্ডভন্ড হলো। কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি ধনুষ্টংকার কিংবা সাপের কামড়ে মারা গেলেন। এসব কি শুধুই নিছক দুর্ঘটনা, না অন্যরকম সমাজব্যবস্থা থাকলে এগুলো হয়তো ঘটতো না। রেলের দুর্ঘটনায় শুধু গরিব লোকেরা মরলো কেন? এসব ঘটনার পেছনে সাম্রাজ্যবাদ বা তাদের দোসর দেশি পুঁজিবাদীরা দায়ী। এগুলো খুঁজে বের করা যে কোনো সৎ জার্নালিস্টের কর্তব্য। এ-সম্বন্ধে সে খুবই সচেতন।

ওকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতাম যে, আমাদের কাগজ মোটামুটি মধ্যপন্থী। ডানে-বাঁয়ে না ঝুঁকে একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কপি লিখতে হবে। তা না হলে স্টাফ মিটিংয়ে এগুলো নিয়ে যখন আলোচনা হবে, তখন এডিটরের কাজ হবে – অনেক কাটাকুটি করে একটা মাঝামাঝি ভারসাম্য বজায় রাখার পর তবে কাগজে ছাপা হবে। ও এসব ধৈর্য ধরে শুনতো। কিন্তু প্রথম-প্রথম খুব যে ওকে বোঝাতে পারতাম মনে হতো না।

ও পড়াশোনা যে অনেক করতো সে-সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। সম্পাদক সাহেবও এটা বুঝতেন। আমাকে বলতেন, মেয়েটা ভালো। কিন্তু ওকে একটু রিয়ালিস্ট হতে হবে। হয়তো কিছুদিন সময় লাগবে। এতো অল্প বয়সে এ-রকম আদর্শবাদী হওয়া সততার লক্ষণ। এটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তার সঙ্গে কিছুটা রিয়ালিস্টিক না হলে এ-দেশে টিকে থাকা বুঝতেই পারছো বেশ কঠিন। আমি ওকে তোমার হাতেই ছেড়ে দিলাম।

কিছুদিন পর মনে হলো, মাহেলী আস্তে-আস্তে পথে আসছে। বেশ খাটতে পারতো ও। সকালেই চলে আসতো অফিসে। অন্যদের আসার আগেই সে আসতো। হাতে কাজ না থাকলে অন্যদের মতো বিশেষ আড্ডা দিত না। বসে বসে নিজের ব্যাগে করে আনা কোনো বই পড়তো। আমরা পত্রিকার অফিসে কিছু ইংরেজি ম্যাগাজিন নিয়মিত রাখতাম – টাইম, নিউজউইক আর কিছু ভারতীয় কাগজ। সেগুলো সে গোগ্রাসে গিলতো। আমি মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলতাম, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অগ্রদূত এই ম্যাগাজিনগুলো এতো আগ্রহের সঙ্গে পড়ো কেন? এরা তো শত্রুপক্ষের প্রপাগান্ডায় ভর্তি।

ও বলতো, ‘শত্রুপক্ষের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর জানা দরকার। তা নইলে ওদের দুর্বলতার জায়গাগুলো খুঁজে বের করবো কী করে?’

একদিন সকালবেলায় অফিসে এসেই একটু হকচকিয়ে গেলাম। অন্যদিনের মতো তখনো আর কেউ আসেনি। শুধু মাহেলী ছাড়া।

ওর কিউবিক্লের পাশ দিয়ে যেতেই কানে ভেসে এলো একটা মিষ্টি কণ্ঠস্বর। মাহেলী গুনগুন করে গান করছে – ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।’

আমি বললাম, ‘একি শুনি, তুমি গান করছো? তাহলে আমার উপদেশটা মানলে?’

‘হ্যাঁ মানলাম সুফী ভাই। আমি যে বলেছিলাম চে গুয়েভারা গান করতেন না, তা নিশ্চয়ই ঠিক নয়। এই কিছুদিন আগে একটা কিউবার গান শুনলাম। সেটা কিউবার সকলেই গায়। শুধু কিউবা নয়, সমস্ত ল্যাটিন আমেরিকায় স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের কাছে এটা প্রিয় গান – ‘গুয়ানতানামেরা গুয়াহিরা গুয়ানতানামেরা’। চে গুয়েভারা নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে অন্তত এ-গানটা করতেন।’

‘এ-গান করতে গেলে বোধহয় স্প্যানিশ ভাষা শিখতে হবে, তাই না?’

‘আমি স্প্যানিশ ভাষা শিখতে শুরু করেছি। কারণ কিউবায় একদিন তো যেতেই হবে।’

‘এ-গানের বৃত্তান্তটা কী? কেন এতো পপুলার হয়ে গেল?’

‘গানটা লিখেছিলেন, আসলে গান নয়, এটা একটা কবিতা, কিউবার যোদ্ধা কবি হোসে মারতি। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। এটাকেই সুর দিয়ে গান করা হয়েছে। আমি ভাষাটা আর একটু রপ্ত করে নিই, তারপর তোমাকে শোনাবো। বাংলায় তর্জমা করে মানেটা বুঝিয়ে দেবো।’

‘বেশ আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। কিন্তু তুমি এর সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতও শিখছো নাকি?’

‘হ্যাঁ, আমার প্রিয় গান হলো – তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই। শিখাকে বলো। শুনলে ও খুশি হবে। এখনো সুর ঠিক হচ্ছে কিনা জানি না। বাফায় যাবো ভাবছি। কিন্তু সময় কোথায়? ততোদিন ভুল সুরেই গাইবো।’

‘তুমি ভুল সুরে গাইলেও মিষ্টি শোনাবে। তোমার গলাটাই যে মিষ্টি।’

মিষ্টি মেয়েটা এবার একটু মিষ্টি হেসে বললো, ‘সুফী ভাই, তুমি যখন এ-রকম মিষ্টি কথা বললে তখন তোমাকে বেলা বিস্কুট খাওয়াবো আজ। আমার মামা চিটাগাং থেকে এনেছেন। ঢাকার নকল বিস্বাদ বেলা বিস্কুট নয়। একটু পরে যখন চা খাবো তখন চায়ের সঙ্গে খাঁটি বেলা বিস্কুট বেশ লাগবে।’

ভালো লাগলো ওর স্বাভাবিক কথাগুলো শুনে। প্রথম-প্রথম ওর কথা ও লেখার মধ্যে একটা আড়ষ্টতা ছিলো। রাজনৈতিক ইশতাহার বা মিটিংয়ের জ্বালাময়ী বক্তৃতার ঢঙে লেখা সে আস্তে-আস্তে বাদ দিয়ে খবরের কাগজের ঠান্ডা মাথার ভাষা রপ্ত করতে চেষ্টা করছে। গত হপ্তায় সম্পাদক সাহেব নিজেই বললেন যে, মাহেলীর লেখায় সম্পাদকের লাল কালির দাগ আর আগের মতো বেশি দরকার হচ্ছে না। এর জন্য প্রশংসার সিংহভাগ নাকি আমারই প্রাপ্য।

এ-রকম সুন্দরী মেয়ের জন্য পক্ষপাতিত্ব অফিসের আরো অনেকের ক্ষেত্রে বেশ প্রকট হচ্ছে দিনে-দিনে। কিন্তু মাহেলী সবাইকে দেখিয়ে-দেখিয়ে যেন আমার সঙ্গেই বেশি কথা বলে। দুপুরে ক্যান্টিনে খাওয়ার সময় অন্য সবাইকে অবজ্ঞা করে প্রায়ই আমার সঙ্গে এক টেবিলে বসে। আজ বেলা বিস্কুট এনেছে। আর একদিন বললো, ‘এই চালতার চাটনি মা বানিয়েছেন। যা মজার – আজ দুপুরে ভাতের সঙ্গে খেয়ে দেখো।’

মাহেলীরা থাকতো রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের কাছে। আর আমি শান্তিনগরে। অনেকদিন বেশ রাত করে ছুটি হতো। আমি অতো রাতে ওকে একলা ছাড়তাম না। রিকশায় করে আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে ওকে নামিয়ে দিয়ে আবার উলটোপথে রিকশায় বাড়ি ফিরতাম।

প্রথম-প্রথম মাহেলী আপত্তি করতো। বলতো, ‘তোমাকে বিব্রত করছি। রিকশার ভাড়াও বেশি লাগছে। আমি কিন্তু রাত্রে একলা-একলা চলাফেরায় অভ্যস্ত। আমার ভয় করে না।’ একটু চুপ করে সে আবার বললো, ‘রাস্তাঘাটে এই রাত্রের অন্ধকারে আমার যতো না ভয় লাগে, তার চাইতে বেশি ভয় লাগে আমাদের অফিসে দিনে-দুপুরে। কেউ-কেউ এমন করে তাকায় যে, ভয় করে, ঘেন্নাও লাগে। অনেকেই তো আমার বাবার বয়সী।’

আমি বলতাম, ‘আমার চিন্তা হয় তোমার জন্য। তবে সত্যি কথা তোমার সঙ্গে নির্জন রাস্তায় এতো রাত্রে রিকশায় যেতে ভালোই লাগে।’ আমি আশা করিনি যে সে বলবে, ‘আমারও ভালো লাগে।’

কিন্তু যখন সে তাই বললো, তখন আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, আমি মাহেলীকে ভালোবেসে ফেলেছি। এবং সেটা বোধহয় একতরফা নয়।

পরের হপ্তায় মাহেলী এসে বললো, ‘আগামীকাল ছুটি চাই। আমাদের পার্টি ভিয়েতনাম দিবস ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই একই দিন ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে আমেরিকাবিরোধী আন্দোলন হবে আগামীকাল। আমার অনেক কাজ। একটা খুব বড় প্রতিবাদ মিছিল করতে হবে। ইউএসআইএসের সামনে দিয়ে যাবো। ভয় হয় একটা গোলমালও হতে পারে। আর আমাকে একেবারে সামনের সারিতে থাকতে হবে। বক্তৃতা দিতে হবে। কী করে ছুটি নেওয়া যায়?’

‘ভিয়েতনামের নাম করে তো ছুটি পাওয়া যাবে না। আমাদের সম্পাদক সাহেব খুব স্ট্রিক্ট এসব ব্যাপারে। আর তুমি তো বেশিদিন হলো জয়েন করোনি। এরই মধ্যে এ-রকমভাবে ছুটি নিতে চাইলে মোটেই ভালো দেখাবে না।’

‘যদি বলি রাস্তায় পড়ে গিয়ে আমার পা ভেঙে গেছে, কি মাথা ফেটে গেছে, তবুও কি ছুটি দেবে না।’

‘ওগুলো হওয়ার পর ছুটি হয়তো দিতে পারে কিন্তু হওয়ার আগে ডাক্তারের আগাম সার্টিফিকেট নিয়ে দরখাস্ত করলেও চলবে না।’

মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে মাহেলী বললো, ‘তাহলে কী করা যায় বলো তো সুফী ভাই। তুমি তো অনেকদিন হলো এই কাগজে কাজ করছো। তুমি একটা উপায় বের করো না।’

‘আচ্ছা এক কাজ করা যায়। তুমি কাল সকালে আর কেউ আসার আগে চলে এসো। এসে হাজিরাটা দাও। তারপর আমি তোমাকে পাঠিয়ে দেবো তোমাদের এই ভিয়েতনাম দিবস কভার করার জন্য। আমি বলবো আর কেউ সিনিয়র অফিসে ছিলো না বলে তাদের অনুমতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। এরপর আমার চাকরিটা থাকলেই হলো। অবশ্য তোমাকে তোমাদের সভা আর ডেমোর বিবরণ দিয়ে একটা কপি তৈরি করতে হবে। পরের দিনের কাগজের জন্য। আমাদের স্টাফ ফটোগ্রাফারকেও খবর দিতে হবে যাতে দু-একটা অ্যাকশন শট নিতে পারেন।’

‘আগামীকালের ভিয়েতনাম দিবসের কপিটা কাগজের জন্য আমি তো আজকেই লিখে দিতে পারি। দেখো না, আমেরিকানরা কী রকম বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। এতোদিন দক্ষিণ ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছিলো, এখন ওরা উত্তর ভিয়েতনামকেও জড়াতে চায় এই যুদ্ধে। যে কোনোদিন হ্যানয়ে বোমা ফেলতে পারে। আর আমরা এখানে হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? একদিনের ছুটির জন্য দরখাস্তে কী লেখা থাকবে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবো?’

পরদিন দুপুর নাগাদ আমি চলে এলাম প্রেসক্লাবে। মাহেলী গেল ওদের মিছিলের আয়োজন করতে। পল্টন থেকে তোপখানা রোড দিয়ে মিছিল যাবে ইউএসআইএসের দিকে। আমাদের প্রেসক্লাব তার কাছেই উলটোদিকে। প্রেসক্লাবের দোতলা থেকে ভালোই দেখা যাবে সব ঘটনাটা। স্বভাবতই প্রচুর পুলিশ মোতায়েন থাকবে সামনের রাস্তায়, যাতে মিছিলটা ইউএসআইএসের সামনে পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে।

বেলা ১১টার দিকে দূর থেকে শোনা গেল মিছিলের স্লোগানের আওয়াজ। দেখলাম মিছিলে প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ হবে। খুব বেশি নয়। বেশিরভাগই অল্পবয়সী ছাত্র, কিছু মজদুর টাইপের লোক। মাহেলী ঠিক সামনের লাইনে রয়েছে। পরেছে একটা নীল রঙের কুর্তা পাজামা। টাইট করে ওড়নাটা গায়ের সঙ্গে জড়ানো। সকালে মাহেলী অফিসে এসেছিলো শাড়ি পরে। তার মানে অফিস থেকে বাড়ি গিয়ে কাপড় বদলে এসেছে। ভালোই করেছে সে। শাড়ি নিয়ে মিছিলে দৌড়াদৌড়ি করতে একটু অসুবিধা হওয়ার কথা। এসব ব্যাপারে মেয়েটার অভিজ্ঞতা আছে বোঝা যায়।

তোপখানা রোডে যতো না বিক্ষোভকারী, তার চেয়ে সংখ্যায় বেশি পুলিশ। লরি, সাঁজোয়া যান সব প্রস্ত্তত।

ওখানকার রকমসকম দেখে মনে হলো আজকে ভালোই বোঝাপড়া হবে। মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে – ‘আমার নাম, তোমার নাম, ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম।’ একবার ছেলেরা বলছে ‘ভিয়েতনাম’, তারপর গলা মিলিয়ে মেয়েরা বলছে ‘ভিয়েতনাম’।

পুলিশ প্রেসক্লাবের ঠিক উলটোদিকে রাস্তায় আড়াআড়ি লাইন করে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথম সারিতে লাঠিধারী, পরের লাইনে টিয়ার গ্যাস ছোড়ার সরঞ্জাম। তার পরে কিন্তু রাইফেলধারী পুলিশ। মিছিলের লোকেরা যতোই স্লোগান দিক ওদের কিছুতেই আর এগোতে দেবে না।

মিছিল বসে পড়লো রাস্তায়। আমি দেখতে পেলাম মাহেলী চেষ্টা করছে তাদের ছেলেমেয়েদের লাইনগুলো যেন একসঙ্গে সারিবদ্ধ থাকে। প্রায় আধঘণ্টা মুখোমুখি অবস্থানের পর এরকম ক্ষেত্রে যা হয়, মিছিলের পেছন দিকের কিছু লোক হঠাৎ ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করলো পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশের এমন কিছু ক্ষতি হলো না তাতে। কারণ তাদের হাতে ছিলো বড় বড় ঢাল। ঢিল বৃষ্টির কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো টিয়ার গ্যাসের শেল বর্ষণ। মিছিল ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলো। তারপর লাঠিচার্জ। ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া। সামনের দিকের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে কিছুতেই সরে যাবে না। বেশ হইচই, ধোঁয়া, চেঁচামেচি – এসবের ভেতরেও দেখতে পেলাম মাহেলীকে। নীল কাপড় পরা মেয়েটা তো আর কেউ নয়। বসে আছে সে রাস্তায়। ওর মতো আরো আট-দশটা ছেলেমেয়ে আছে দলে। ওরা দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা দিয়ে নিজেদের বাঁচাতে চাচ্ছে। হাত দুটো দিয়েও লাঠির আঘাত থেকে মাথাটাকে ঢাকার চেষ্টা করছে। আর পুলিশ এলোপাতাড়ি তাদের লাঠি চালাচ্ছে ওদের শরীরের ওপর।

ঘন-ঘন স্লোগান, চেঁচামেচি, হট্টগোল আর কাঁদুনে গ্যাস – সব মিলিয়ে একটা বিশ্রী ব্যাপার।

মাহেলী মাঝে মাঝে মাথাটা তুলে চেঁচিয়ে অন্যদের বলছে, ‘বসে থাকো। সরো না। মাথা বাঁচিয়ে রাখো। সরো না একদম।’

বেশ খারাপ লাগছিলো আমার। একেবারে নিরস্ত্র এই ছেলেমেয়েগুলো। আট-দশজন জড়াজড়ি করে রাস্তার ওপর বসে আছে। আর পুলিশ গায়ের জোরে ওদের ওপর লাঠি চালাচ্ছে। কেউ একটু প্রতিবাদও করছে না। একটু পরেই দু-একজন আর বসে থাকতে পারলো না। রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়লো। রক্তাক্ত মাথা, হাত-পা নিয়ে কেউ কেউ পালাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না।

অনেকক্ষণ ধরে চললো এই একতরফা নির্দয় আক্রমণ। তারপর একসময় দেখলাম নীল রঙের কুর্তা পাজামা পরা একটা মেয়ে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে আছে। জমাট রক্ত রাস্তায়।

টিয়ার গ্যাসের গন্ধ প্রেসক্লাবের ভেতরেও আসতে লাগলো। কিছু ছাত্র প্রেসক্লাবে ঢুকে গেছে। প্রেসক্লাবের নিরাপত্তায় থেকে তারা কিছুক্ষণ ইটপাটকেল মারলো। এরপর তারাও রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হলো।

ততোক্ষণে অ্যাম্বুলেন্স আসতে শুরু করেছে। রক্তাক্ত শরীরগুলো স্ট্রেচারে করে তারা অ্যাম্বুলেন্সে তুললো। তারপর মেডিক্যাল কলেজের দিকে চলে গেল। আমার চোখের সামনে ঘটে গেল পুরো ব্যাপারটা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সব শান্ত। সবকিছু দেখলাম প্রেসক্লাবের দোতলা থেকে। বেশ অসহায় মনে হলো নিজেকে। মাহেলী আর অন্য ছেলেমেয়েদের মাথায় এলোপাতাড়ি পুলিশের লাঠির আঘাত পড়ছে আর ওরা দুই হাঁটুর মাঝে মাথা ঢুকিয়ে এক হাত দিয়ে মাথাটাকে বাঁচানোর বৃথা চেষ্টা করছে। অন্য হাত দিয়ে পাশের মানুষটাকে ধরে রেখেছে। কিন্তু ওরা কিছুতেই সরবে না। বসেই থাকবে রাস্তায় ওরা – কতো মারবে মারো। একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করবে যতোক্ষণ সম্ভব হয়। কী সাহস এদের! দেখে মনে হয় ওরা তৈরি হয়েই এসেছে। চোখ বন্ধ করলে এখনো আমি এই দৃশ্যটা দেখতে পাই। তবু বিশ্বাস করো এখনো গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে।

অফিসে ফিরে আমি আগামীকালের কাগজের জন্য একটা কপি লিখে দিলাম। বেশ কষ্ট হলো লিখতে। কারণ কাগজের জন্য লিখতে হবে একেবারে নিস্পৃহভাবে। আমার নিজস্ব মতামত বাদ দিতে হবে। বেশ কষ্ট হলো। তবে এতোদিনে সাংবাদিকতার কায়দা শিখে ফেলেছি।

প্রথম দিন মাহেলীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে জেনারেল ওয়ার্ডে রেখেছিলো। সেদিন সে পুরো অজ্ঞান ছিলো। মাথায় বেশ চোট পেয়েছে। একটা পা ভেঙে গেছে। আর মিছিল থেকে আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সবই পুলিশ কেস। বাইরের কাউকে তাদের সঙ্গে দেখা করতে দেবে না। পুলিশ প্রহরী ওয়ার্ডের দরজায় মোতায়েন।

আমি সম্পাদক সাহেবকে বললাম, ‘মাহেলী আমাদের স্টাফ। আমি ওকে পাঠিয়েছিলাম কাগজের জন্য। আর স্টাফ ফটোগ্রাফার সুন্দর কয়েকটা অ্যাকশন ফটো তুলেছে। তাতে মাহেলীকে দেখা গেছে। পুলিশ শুধু-শুধু ওকে পেটাচ্ছে। দায়িত্বটা আমাদেরই।’

সম্পাদক সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘তুমি মাহেলীর জন্য এতো সুপারিশ করছো। হ্যাঁ, মেয়েটার সাহস আছে বটে! দেখি কী করতে পারি।’ তার মানে তিনি কিছু একটা করবেন।

পরদিন কাগজের খরচেই মাহেলীকে হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে কেবিনে নেওয়া হলো। আমি মাহেলীকে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। সেখানেও কড়া পাহারা কিন্তু একটু শিথিল। একশ টাকার একটা নোট পুলিশের হাতে দেওয়ার পর ঢুকতে পারলাম কেবিনে। মাহেলীকে দেখে আমার বেশ খারাপ লাগলো। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ। একটা পা প্লাস্টার করা। পুরো মুখটা ফুলে রয়েছে। চোখ দুটো প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। দুই চোখের চারপাশে কালচে রক্তের ছোপ। নিচের ঠোঁটটা কাটা। হাসপাতালের গাউন পরা তার বাম কাঁধটা দেখা যাচ্ছে। রক্তের কালশিটে দাগ পড়েছে সেখানে।

আমার চোখের সামনেই একটা সুন্দরী মেয়েকে পিটিয়ে-পিটিয়ে চেষ্টা করেছে একেবারে কুৎসিত করে দিতে। বাইরের চেহারা দেখে মনে হবে তারা হয়তো সফল হয়েছে।

আমাকে দেখে একটা সুন্দর হাসি দিলো মাহেলী। বললো, ‘দেখছো ছুটির জন্য বলেছিলাম না আমার মাথা ফেটে যাবে, পা ভেঙে যাবে – ঠিক তা-ই হয়েছে।’

মাহেলীর শরীরে প্রচন্ড জখম সত্ত্বেও আগের মতোই ওর গলার স্বর। পিটিয়ে-পিটিয়ে মুখটাকে ওরা কুৎসিত করেছে ঠিকই কিন্তু গলার স্বর এখনো আগের মতো মিষ্টি। আবারো সে কি আগের মতো গাইতে পারবে – ‘আমার সোনার হরিণ চাই।’

আমি বললাম, ‘করাচি থেকে নিউরো সার্জন ডা. জুমা ঢাকায় এসেছেন। আমাদের কাগজ থেকে তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছে তোমার চিকিৎসার ভার নিতে। তোমার ব্রেনে নাকি আঘাত লেগেছে। আশা করি এবার ভালো হয়ে যাবে। ডা. জুমা নামকরা নিউরো সার্জন।’

‘হাঁ, ভালো আমাকে হতে হবেই। কারণ পৃথিবীজুড়ে কোটি মানুষ একটা ছুরিতে শান দিচ্ছে। ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদ একদিন মরবেই।’

এবার ওর মিষ্টি গলার স্বর একটু রুক্ষ হয়ে এলো। বললো, ‘এই দানবকে জবাই করার সময় সেই শাণিত ছুরির হাতলে থাকবে কোটি মানুষের হাত। তখন সেই হাতলে আমার হাতটাও তো থাকতে হবে।’

এগুলো কী বলছে মাহেলী? এগুলো কি ওর মস্তিষ্কে আঘাত লাগার ফল, না এসব ওর মনের কথা?

কিন্তু একেবারে ঠান্ডা মাথায় কথাগুলো বললো মাহেলী। আমার ভেতরটা একটুখানিকের জন্য শিউরে উঠলো ওর কথা শুনে।

তারপর আমার দিকে চেয়ে বললো, ‘তোমাকে যে আমি ভালোবাসি সেটা তো তুমি জানো। তবে আরো একজনকে আমি তোমার চেয়ে একটু বেশি ভালোবাসি। সেটা বললে রাগ করবে না তো?’

তারপর ও ডান হাতটা তুললো। ওর ব্যান্ডেজ করা তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দুটোর মাঝে সামান্য একটু ফাঁক রেখে বললো, ‘তোমার চেয়ে এই একটুখানি বেশি ভালোবাসি আরেকজনকে।’ বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো মাহেলী। তারপর বললো, ‘জানতে ইচ্ছে করে কাকে ভালোবাসি বেশি? খুব বেশি নয়, এই একটুখানি মাত্র। আমি যদি মরেও যাই, তাহলে হয়তো তোমার কষ্ট হবে। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই হবে। কারণ আমিও তো জানি যে তুমি আমাকে ভালোবেসেছো। আমি চলে যাওয়ার পর তোমার কষ্টের মাত্রাটা যাতে একটু কম হয় সেজন্যই তোমাকে বলছি এ-কথাটা। আমি আরেকজনকে তোমার চাইতে সামান্য একটু বেশি ভালোবাসি।’

আমি যন্ত্রচালিতের মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকে?’

‘জানতে চাও বলেই বলছি। তার নাম চে গুয়েভারা।’

মাহেলীর সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা এবং এটাই তার শেষ কথা। পরদিন অপারেশন টেবিলেই সে মারা যায়।’

অনেকক্ষণ ওরা চুপ করে থাকলো। এ-রকম কথার পর কী বলা উচিত দুজনের কেউ বুঝতে পারছিলো না।

একসময় মিত্রা বললো, ‘তোমার জীবনের এই দুঃখের ব্যাপারটা এখন থেকে কতোদিন আগে ঘটলো মনে পড়ে?’

সুফী বললো, ‘এই প্রায় আট মাস আগে।’

‘জানো, আমারটাও মাস আটেক হতে চললো।’

‘আমরা দুজনেই প্রায় একই সময়ে আঘাত পেয়েছি। ভাবতেও আমার কেমন অদ্ভুত লাগছে। তোমারটা একটু বেশি কষ্টের। কারণ তোমরা দুজনে দুজনকে ভালোবেসেছিলে। আর আমারটা একতরফা। কিন্তু কষ্টের পরিমাণ কি সত্যিই মাপা যায় কখনো? আমার ক্ষেত্রে কষ্টের সঙ্গে একটা অপমান মিশেছিলো, যেটার জন্য আমার নিজের ওপর একটা অশ্রদ্ধার ভাব চেপে ছিলো অনেকদিন। সময় যাওয়ার সঙ্গে এই ভাবটা একটু কমেছে। তোমার সঙ্গে মাত্র এক হপ্তার মতো দেখা হলো। এখন মনে হচ্ছে আমি এ-রকম আত্মগ্লানির হাত থেকে পুরো উদ্ধার পেয়ে গেছি তোমাকে সব কথা বলে।’

সুফী বললো, ‘আমিও এতোদিন মনে মনে ভাবছিলাম মাহেলীকে কিছুতেই ভোলা যাবে না। ভুলে থাকা যাবে না ঠিক কিন্তু গত হপ্তার মধ্যে আমারও ভেতরে একটা অন্যরকম পরিবর্তন এসেছে মনে হয়। মাহেলী তার নিজের জায়গায় থাকবেই। কিন্তু ওই যে যাওয়ার আগে মাহেলী আমাকে ঠাট্টা করে বলেছিলো চে গুয়েভারাকে সে আমার চেয়ে একটু বেশি ভালোবাসে। এ-কথাটা ভাবলে মাহেলীর ওপর দুঃখের সঙ্গে-সঙ্গে একটু শ্রদ্ধার ভাবও আসে।’

মিত্রা বললো, ‘যদিও আমাদের দুজনের অভিজ্ঞতা দুরকম কিন্তু ইংরেজিতে এরকম ঘটনাকে বলা হয় – আমরা দুজনেই ‘অন দি রিবাউন্ড’। আমরা দুজনেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম একটা ভরসার স্থল। আমার মনে হয়, আমরা ভাগ্যবান যে আমরা দুজনে নিজেদের খুঁজে পেয়েছি। অনেকটা আবিষ্কার করেছি। আমার মন বলছে, আমরা ঠকবো না।’

‘ঠিকই বলেছো। তা নইলে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের দুজনের মাঝে হৃদয়ের যে বোঝাপড়া হয়ে গেল, সেটা মোটেই সম্ভব হতো না।’

ততোক্ষণে একটু অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সমুদ্রের দিক থেকে একটু ঠান্ডা বাতাস ওদের জানিয়ে দিলো, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। এতোক্ষণে নিশ্চয় ড্রাইভার জগদীশ গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে। তাদের জন্য নিচে অপেক্ষা করছে।

সুফী বললো, ‘চলো এবার যাই। আমার একটু খিদেও পাচ্ছে।’

 

উনিশ

গাড়িতে উঠে মিত্রা বললো, ‘কী জগদীশ, তুমি কি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছো?’

‘বেশিক্ষণ না, এই আধঘণ্টার মতো হবে।’

‘তাহলে তো বেশিক্ষণ নয়। এখান থেকে বোম্বে শহরটা রাত্রে যা সুন্দর লাগে। তুমি খুব সুন্দর জায়গায় আমাদের রেখে গিয়েছিলে। এখন তো বেশ খিদে পেয়ে গেছে। তুমি যে কৈলাস পর্বত রেস্টুরেন্টের কথা বলেছিলে সেটা কি এখান থেকে বেশিদূর?’

‘না, আধঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবো মনে হয়।’

সুফীর হাতে একটা স্লিপ দিলো জগদীশ।

‘আপনার ফিল্মের রসিদ এটা। কাল বিকেল ৪টার পর ফিল্মটা পাওয়া যাবে। আপনি যদি পারেন দোকান থেকে ওই সময়ে নিজে নিয়ে যেতে পারেন। দোকানটা ফোর্ট এরিয়ায়। আপনার হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। না পারলে আমাকে দেবেন। আমি সময়মতো আনিয়ে রাখবো।… আচ্ছা বামদিকে দেখেন একটা খুব বড় বাড়ি। বাড়িটা খুব উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে আলোও বেশি নেই। রাস্তায় লোকজন অনেক কম দেখবেন। এদিকে রাত্রে ভয়ে কেউ আসতে চায় না।’

‘কেন? কী এমন জায়গা এটা?’ সুফী জিজ্ঞেস করলো।

‘এটা হলো পারশিদের টাওয়ার অব সাইলেন্স। পারশিরা মারা গেলে লাশ এখানে রেখে দেয়। শকুন আর পাখিরা লাশ খেয়ে শেষ করে দেয়।’

‘হ্যাঁ, এটা আমি শুনেছি।’ মিত্রা বললো, ‘কিন্তু এই বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে এর ভেতরে কী হয়, সেটা বোঝার উপায় নেই।’

‘এর ভেতরে শুনেছি একটা বড় হলঘরের মতো আছে। সেখানে লাশ রাখার জায়গা আছে। ওপরে ছাদ নেই পুরোটা, যাতে শকুনেরা ঢুকতে পারে। কিন্তু হাড়গোড় যেগুলো শকুন খেতে পারে না, শেষ পর্যন্ত ওগুলো কী হয় বলতে পারি না। বাইরের কারোর এখানে ঢোকা নিষেধ। শুধু পারশি পুরোহিতরা ছাড়া। তবে এখন শোনা যাচ্ছে শকুনের সংখ্যা আজকাল অনেক কমে গেছে। তাই অনেক লাশ শেষ হতে বেশি সময় লেগে যাচ্ছে।’

‘শকুনের সংখ্যা কমে গেল কেন?’

‘অনেকে অনেক কথা বলে। তবে আমি এখানকার খবরের কাগজে পড়েছি – কীটনাশক হিসেবে বেশি বেশি ডিডিটি ব্যবহার করার জন্য নাকি এরকম হচ্ছে। পোকামাকড়ের শরীরে ডিডিটির পরিমাণ বেড়ে গেছে। আর শকুনেরা এসব কীটপতঙ্গ খায়। তার মানে শেষ পর্যন্ত শকুনদের শরীরে এই রাসায়নিক বিষ বেশি পরিমাণে জমা হচ্ছে। যার ফলে শকুনেরাও মারা পড়ছে। আর তাদের ডিমও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশবাদীরা এখন ডিডিটি ব্যবহারের ঘোর বিরোধী হয়ে যাচ্ছেন।’

সুফী বললো, ‘পারশিদের মৃতদেহ সৎকারের এই প্রথা আমি কিন্তু মনে মনে পছন্দ করি। আমাদের কবর দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু আমাদের দেশে আমি দেখেছি জায়গার অভাবে কবর দেওয়ার সমস্যা হচ্ছে। আর কবরের খরচ এখন অনেক বেশি। তাই গরিব লোকদের জন্য কষ্টকর হচ্ছে দিন দিন। এখন মরাটাও সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে গরিবের জন্য।’

মিত্রা বললো, ‘লাশ পোড়ানোও তো পরিবেশবাদীদের আপত্তির কারণ হতে পারে। কী পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড আর মিথেন এতে তৈরি হবে কে জানে। তবে পারশিদের এই প্রথার কথা ভাবলে আর একদিক দিয়ে এটাকে গ্রহণ করা যেতে পারে মৃত্যুর পর। প্রাণ যখন চলে গেল, শুধু একটা নিশ্চল দেহ পড়ে থাকলো। তখন সেই মৃতদেহ খেয়ে যদি ঈশ্বরের তৈরি অন্য কোনো জীব বেঁচে থাকতে পারে যেমন শকুন – তাহলে এটা প্রশংসার যোগ্য। আমি জানি, দার্শনিক দিক থেকে একে সমর্থন দেওয়া যায়। কিন্তু পারশিরা ছাড়া অন্য কেউ এই ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’কে পারলে এখান থেকে বিদায় করে দেবে।’

সুফী বললো, ‘আমার খিদে পেয়েছে বলেছিলাম কিছু আগে। এখন এসব আলোচনার পর খিদেটা মনে হয় আর নেই। তবে কতক্ষণ এ-রকম থাকবে জানি না। জগদীশ তুমি কৈলাস পর্বতে আমাদের ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে চলো। তাড়াতাড়ি।’

‘আমাদের এবার বাইকালার দিকে যেতে হবে। খুব বেশি দূর নয়। আপনারা থালি খেতে চেয়েছিলেন। তা ওখানে সব রকম থালি পাওয়া যায়। আমি মারাঠি মানুষ। আমি বলবো মারাঠি থালি টেস্ট করুন।’

‘বেশ তো, তাহলে তুমিও এসো আমাদের সঙ্গে খাবে।’

‘উঁহু, অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের পৌঁছে দিয়ে গাড়িটা রেখে আমি বাড়িতে খেতে যাবো। আমার স্ত্রী খুব ভালো রান্না করে।… আর দেখুন আমরা এখন ‘মনি ভবনে’র কাছ দিয়ে যাচ্ছি। গান্ধীজি বোম্বেতে এলে এই মনি ভবনে থাকতেন। এটা একজন ধনী লোকের বাড়ি। এখন এখানে একটা মিউজিয়ামের মতো করা হয়েছে। গান্ধীজির ব্যবহার করা অনেক জিনিস আর অনেক ছবি এখানে রয়েছে। সময় হলে এখানে পরে আসতে পারেন।’

কৈলাস পর্বত রেস্টুরেন্টের সামনে বেশ ভিড়। অনেক লোক বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল গাপ্পা, ফুচকা, পানি পুরি আর কতো রকম চটপটি জাতীয় জিনিস খাচ্ছে। ওদের চোখের সামনেই খাবার জিনিসগুলো রান্না করা হচ্ছে। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, তরুণ, ছোট বাচ্চা সকলেই মনে হয় খোশমেজাজে খেয়ে যাচ্ছে। পয়সার আদান-প্রদান হচ্ছে এরই ভেতর। বোঝাই যাচ্ছে রেস্টুরেন্টটা খুব জনপ্রিয়।

জগদীশ বললো, ‘আপনারা বাইরে দাঁড়িয়ে খাবেন না। ভেতরে চলুন। দোতলায় এতো ভিড় নেই। নিশ্চিন্তে খেতে পারবেন।’

মিত্রা বললো, ‘এখন তো মাত্র ৭টা বাজে। আমরা হয়তো ঘণ্টাখানেক থাকবো। তুমি কি এর মধ্যে বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসতে চাও?’

‘তা-ই করবো। আমার বাড়ি কাছেই। আমি ঘণ্টাখানেক পরে আসবো। রাস্তার উলটোদিকে ওই জায়গায় আমাকে খুঁজে পাবেন।’

ওদের বারান্দার দিকের একটা টেবিলে বসিয়ে জগদীশ একজন ওয়েটারকে ডেকে কী সব বললো। ওয়েটারকে ওর চেনা বলেই মনে হলো। ফিরে এসে বললো, ‘আপনারা প্রথমে ওদের স্পেশাল ফুচকা দিয়ে শুরু করবেন। খেতে যদিও খুব ভালো লাগবে, তবুও চারটির বেশি খাবেন না। কারণ প্রথমেই পেট ভরিয়ে ফেললে, পরে মারাঠি থালির মজাটা মিস করবেন। আপনারা লাস্সি পছন্দ করেন তো – মিষ্টি, না নোনতা। যা পছন্দ হয় বলবেন। আর শেষে পেস্তা কুলফি। দাম দেওয়ার দরকার নেই। ওটা দেওয়া হয়ে গেছে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব ওটার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে দিয়েছেন। আর আমি যখন গাড়ি নিয়ে আসবো, আপনারা এখান থেকেই রাস্তার দিকে তাকালে আমাকে দেখতে পাবেন।’ জগদীশ চলে গেল।

ফুচকা খেতে খেতে সুফী বললো, ‘আঙ্কেল আর আন্টি আমাদের এমন হৃদ্যতার সঙ্গে খাতির করছেন কেন বলো তো? আঃ এখানকার ফুচকা সত্যিই খুব মজার।’

মিত্রা বললো, ‘বোধহয় আমাদের দেখে ওদের বহুদিন আগের স্মৃতিগুলো মনে আসছে। ঢাকার কথা – যেখানে তিনি প্রথমে ব্যাচেলরের জীবন, পরে প্রথম সংসারের অভিজ্ঞতা, সেগুলো বোধহয় মনে পড়ছে। আর নেপালের সঙ্গে তো বহুদিনের পরিচয়। আর তিনিই যে আমাকে সেই অন্ধকার কুয়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন, সে-কথা ভাবলেও আমার গায়ে কাঁটা দেয়।’

ওরা এবার ফুচকার দিকে মনোযোগ দিলো।

চারটি ফুচকা শেষ করে মিত্রা বললো, ‘আমার আরো ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে। কী করি বলো তো?’

সুফী বললো, ‘না, আর খেতে পারবে না। জগদীশ বুঝেছিলো বলেই নিষেধ করেছিলো আর না খেতে।’ বলে সুফী মিত্রার নাকের ডগায় নিজের তর্জনী দিয়ে ছুঁয়ে বললো, ‘এবার মারাঠি থালি আসছে কিন্তু।’

মিত্রা বললো, ‘এই তুমি আমার চাপা নাক আরো চাপা করে দিতে চাও নাকি? এমনিতেই চাপা নাক নিয়ে আমার মনের ভেতরে একটা চাপা দুঃখ আছে। তুমি বোঝো না সেটা?’

‘কেন তোমার নাকটা বেশ সুন্দর। আর গন্ধ-টন্ধ সব ভালোই তো বুঝতে পারো। নাকের কাজই তো সেটা।’

‘হ্যাঁ, আমার নাক আর পাহাড়ি চেহারা নিয়ে আমার সোকলড্ বন্ধুরা আমাকে শুনিয়ে-শুনিয়েই মাঝে মাঝে কথা বলে। আমি জানি আমার মুখের চেহারা কোনো শ্রাবস্তীর কারুকার্য নয়। কিন্তু আমি যেখান থেকে এসেছি তাদের অনেকেই আমাকে একটু-একটু সুন্দরী বলে মনে করে। তোমরা হয়তো সে-রকম মনে করো না জানি।’

সুফী আবার ওর নাকে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে বললো, ‘আমার কাছে তুমি সুন্দরী।’

সুফীর কথায় এমন একটা খাঁটি ভাব ছিলো যে মিত্রা ওকে খ্যাপানোর জন্য বললো, ‘হ্যাঁ জানি। আচ্ছা যদি আমার চিবুকে ওই তিলটা না থাকতো, তবু তুমি আমাকে পছন্দ করতে?’

সুফী এবার মিত্রার চিবুকের তিলটা নিজের তর্জনী দিয়ে ঢেকে ওর মুখটাকে এদিক-ওদিক ঘোরালো। তারপর বললো, ‘হ্যাঁ, তবুও সুন্দর লাগছে। তবে আগের মতো নয়। কিন্তু চলবে। বোখারা সমরখন্দের বদলে কিন্তু তোমার মুখের তিলটা আমি দিতে রাজি নই। ভাগ্যিস তুমি আমার নাম রুমি দিয়েছো, হাফিজ নয়।’

মিত্রা বেশ কিছুক্ষণ স্মিতহাসি মুখে সুফীর দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর ওর থুঁতনিতে হাত দিয়ে বাম দিকে ঘুরিয়ে বললো, ‘তোমার ডান কানের লতির নিচে তোমারও যে একটা তিল আছে সেটা তুমি জানতে? আয়নাতে ওটা বোধহয় দেখা যায় না। কিন্তু অন্যরা কেউ তোমাকে বলেনি তোমার এই তিলটার কথা?’

‘না তো। তোমার কি মনে হয় আমার এই তিলের জন্য ঢাকা কিংবা বোম্বে দেওয়া যায়? কারণ বোখারা আর সমরখন্দ তো আগেই হাতছাড়া হয়ে গেছে।’

আর কথা এগোলো না এই ব্যাপার নিয়ে। কারণ ওয়েটার দুটো বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের প্লেটে মারাঠি থালি নিয়ে এসেছে। ধোঁয়া উঠছে প্লেট থেকে। বেশ কতকগুলো ছোট ছোট বাটি সাজানো আছে থালায়। মাঝে একটু ভাত, রুটি, নানা রকম সবজি, টক দই আর আচার। একেবারে নিরামিষ। সঙ্গে এলো দুই গ্লাস লাস্সি।

মিত্রা বললো, ‘স্বাদে কী রকম জানি না এখনো। তবে নিঃসন্দেহে ওজনে বেশ ভারী এই থালি।’

সুফী বললো, ‘এতো রকম আইটেম আছে – কোনটা কী, কোনটা আগে, কোনটা পরে, কী দিয়ে খেতে হয় কিছুই জানি না। তবে আমি খাবো আমার স্টাইলে। সব একসঙ্গে মিশিয়ে। আমাকে সবাই বলে খাবার ব্যাপারে আমি অসভ্য বর্বর। আমি যেভাবে খাই তাতে নাকি এক-একটা বিশেষ রান্নার যে আলাদা স্বাদ আছে সেটা বোঝা যায় না। আমি ঠিকই স্বাদ পাই। তাই এসব দুর্নাম আমার গায়ে লাগে না।’

‘খাবার ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একমত। কার কী ভালো লাগে, কে কীভাবে খায়, কী খায় – সেসব নিজের ইচ্ছা আর নিজের অভ্যাস। এসব নিয়ে অন্য লোকের বিশেষ মাথা ঘামানো উচিত নয়।’

খাওয়া শেষে ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনারা পান খেতে চান?’

‘একটা পান পেলে মন্দ হয় না। কি বলো মিত্রা?’

পানও এলো।

মিত্রা কিছু ভাবছিলো। সুফীর কথায় বোধহয় কান দিলো না। বললো, ‘তুমি রুমির কবিতার যে-বই দিয়েছিলে রাত্রে আমি সেটা পড়ছিলাম। অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। জীবন-মৃত্যু, প্রেম-ভালোবাসা, আর তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম – সবগুলোর সম্বন্ধে তিনি কথা বলছেন। এতো সহজে সাবলীলভাবে তিনি একটা বিষয় থেকে আরেকটা বিষয়ে যাতায়াত করছেন যে, প্রায়ই তাঁর সঙ্গে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।’

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। আমিও যখন রুমি বা এইরকম অন্য             সুফী-কবিদের লেখা পড়ি তখন অনেক সময় প্রথমে দুর্বোধ্য মনে হয়। কারণ আমার মনে হয় তাঁরা যখন এরকম চিন্তা করেন আর লেখেন তখন তাঁরা অন্য এক জগতে চলে যান। তাছাড়া এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদে কতোটা ভাবার্থ হারিয়ে যায় তা বোঝা দুরূহ। যে কোনো কবির নিজের ভাষায় তাঁর কবিতাগুলো না পড়লে অনেকখানি হারানোর জন্য তৈরি থাকতে হবে। তার ওপরে সব ভাষারই প্রচলিত শব্দগুলোর একটা সীমাবদ্ধতা থাকে। শব্দসংখ্যা সীমিত কিন্তু মনের ভাবটা তো অসীম। আমাদের মনের মধ্যে যতোরকম অনুভূতি আমরা বোধ করি সবগুলো প্রকাশ করতে গেলে যতো শব্দসংখ্যা দরকার হতে পারে, কোনো ভাষাতেই অতগুলো শব্দ নেই। থাকতেই পারে না। জেমস জয়েসের ইউলিসিসে কতো সম্পূর্ণ নতুন-নতুন শব্দ তৈরি করতে হয়েছে সেজন্য। মুশকিল হচ্ছে পাঠকের পক্ষে সে নতুন শব্দের মানে বুঝতে হলে, লেখক-কবির চিন্তাতরঙ্গের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে।’

মিত্রা একটু ভেবে বললো, ‘আমি আরেকটা কথা মাঝে-মাঝে ভাবি। শুনলে অনেকে হয়তো হাসবে। আমরা এখন আছি স্পেস টাইম এই চার ডাইমেনশনের মধ্যে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনটা এই চার ডাইমেনশনের দেয়ালের মধ্যে বন্দি। মৃত্যুর পরও বোধহয় এই চার চৌহদ্দির ভেতর থেকে বেরোনো সম্ভব নয়। কিন্তু সবসময়েই কি এরকম ছিলো? আমি শুনেছি, আবদুস সালাম নাকি বলেছেন – বিগ ব্যাংয়ের সময় যখন বিশ্বব্রহ্মা তৈরি হলো, তখন বোধহয় দশটা ডাইমেনশন ছিলো। অন্যগুলো শেষ হয়ে এখন চারে এসে ঠেকেছে। রুমির মতো মনীষীরা কি এই চার ডাইমেনশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য বিশ্বে অন্য ডাইমেনশনে বিচরণ করতে পারেন? জানি না এর উত্তর আমরা আমাদের জীবদ্দশায় কোনোদিন পাবো কিনা?’

একটু থেমে আবার মিত্রা বললো, ‘আজ যখন আমরা পার্শিদের টাওয়ার অব সাইলেন্সের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমি মনে মনে চিন্তা করছিলাম, আমি মরার পর আমার দেহাবশেষ শকুনেরা টানাটানি করে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে। তখন গত রাত্রে পড়া রুমির একটা ছোট অদ্ভুত কবিতা আমার মনে পড়লো। রুমি বলছেন – আমি যখন মরে যাবো তখন আমার লাশটা বাড়ির বাইরে ফেলে দিও/ তারপর বহুদিন পরে তুমি যখন আসবে/ আমার শুকনো ঠোঁটে চুমু দেবে/ তখন আমি যদি চোখ মেলে তাকাই/ তাহলে তুমি ভয় পাবে না তো?

রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয়নি এরপর। কী এর অর্থ? এই যে দিনের পর দিন আমাদের রোজকার কাজ করছি। তারপর যখন আমার সময় আসবে, তখন মরেই তো যাবো। তারপর কী হবে সে বিষয়ে কতো বর্ণনা আছে কতো কতো ধর্মে, দর্শনে বা বিজ্ঞানে। কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়, সেটা ভেবে আমার কী লাভ-লোকসান হবে। অতএব শকুনের খাদ্য হতে দোষ কী?’

সুফী তন্ময় হয়ে শুনছিলো মিত্রার কথাগুলো। মিত্রা অনেকক্ষণ ধরে কথা বললো। সে এমন করে বলছিলো যে, সুফী ভাবছিলো – বলুক, আরো বলুক। শুনতে ভালো লাগছিলো। রুমির কবিতা সেও কম পড়েনি। কিন্তু যে-বইগুলো সে পড়েছে তাতে এই ছোট্ট কবিতাটা এর আগে সে পড়েনি। ওকেও একটা চিন্তায় আচ্ছন্ন করে ফেললো মিত্রার এই লম্বা স্বগতোক্তির মতো কথাগুলো। দুজনেই চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। ওরা ভুলে গেল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে জগদীশ ড্রাইভার এসেছে কিনা দেখতে।

সুফী বললো, ‘তাই তো আমাদের জীবনেও হয়েছে। যখন গদ্যে মনের ভাব প্রকাশ আর করা যাচ্ছে না, তখন কবিতার আশ্রয় নিতে হয়। কারণ কবিতায় অতোটা বাধ্যবাধকতা নেই, যেমন আছে দৈনন্দিন গদ্যের কথাবার্তায়। আর যখন পদ্যেও কুলোচ্ছে না, তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আশ্রয় নিয়েছিলেন চিত্রকর্মের। প্রথম প্রথম নিজের লেখা কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে বুঝলেন এগুলোতে কিছু পরিবর্তন দরকার তখন তার ভেতরেই কতো নকশা আর ছবি অাঁকলেন। শেষ পর্যন্ত তুলি আর কলম দিয়ে ছবি অাঁকলেন অজস্র। আর এই বলে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন যে, এতোদিন আমার সমালোচকেরা যখন আমার শব্দচয়ন বা ছন্দ নিয়ে বিতর্কে নেমেছেন, এবার ছবির ব্যাপারে একেবারে প্রায় বেপরোয়া হয়ে অাঁচড় টানতে পেরেছি। কোনো সমালোচকের মুরোদ নেই আমার ছবির ব্যাপারে বেশি কিছু বলতে পারবে।’

‘আর আমাদের মতো মানুষেরা, বৈজ্ঞানিকেরা যারা লিখতে পারে না, ছবিও অাঁকতে পারে না, তারা তাদের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য আশ্রয় নেয় অঙ্কের – অ্যালজেবরা, ক্যালকুলাস, জ্যামিতি ইত্যাদির।’

‘তবে একটা কথা ভেবে দেখেছো, আইনস্টাইন তাঁর গবেষণার কথা বলার জন্য একটা ফর্মুলা লিখলেন ই ইকোয়ালস এম সি স্কয়ারড। তিনি যদি ওই সময়ে এই সমীকরণ করে না দেখাতেন তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কোনো বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যতে কোনো সময়ে ওটা ঠিকই আবিষ্কার করতেন। কিন্তু ভেবে দেখো, রুমি যে-কবিতা লিখে গেছেন                    সে-কবিতাটা হাজার বছর পরও কেউ ওইরকমভাবে লিখতেন না। হয়তো কোনোদিনও নয়। অদ্ভুত লাগে ভাবতে।’

‘আর একটা কথা চিন্তা করেছো – বিজ্ঞানচর্চার জগতে যে নোবেল প্রাইজগুলো দেওয়া হয় যেমন ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও মেডিসিনে, এসব বিষয়ে সবসময় কয়েকজন বৈজ্ঞানিককে দেওয়া হয় একসঙ্গে। দুই-তিনজন মিলে প্রাইজটাকে ভাগ করে নেন। কিন্তু সাহিত্যের নোবেল প্রাইজ সবসময়ে একজনকেই দেওয়া হয়। তাঁকে অন্য কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয় না।’

‘ঠিক তাই। শেষ একা নোবেল প্রাইজ পেলেন লাইনাস পলিং। কেমিস্ট্রিতে ১৯৫৪ সালে। তাঁর আর একটা পরিচয় – তিনি আণবিক বোমার বিরুদ্ধে জগৎজোড়া আন্দোলন করেছিলেন, যার জন্য ১৯৬২ সালে তাঁকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হলো আবার। দুবার নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী। কিন্তু তাঁরা সেই প্রাইজগুলো সব সময়ে অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। লাইনাস পলিংই একমাত্র মানুষ যিনি দুটো নোবেল প্রাইজ একলাই পেয়েছেন। অন্য কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়নি। এটা নিঃসন্দেহে একটা বিরল কৃতিত্ব।’

‘এর থেকে কী প্রমাণ হয় যে, কবি-সাহিত্যিকরা নির্জনে একা-একা সৃষ্টি করেন তাঁদের কাব্য আর উপন্যাস। কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের সৃজনশীল কাজগুলো যৌথ উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়।’

এবার একটু হেসে মিত্রা বললো, ‘কী রকম কবি তুমি? একজন বৈজ্ঞানিকের হাত ধরে আছো কতোক্ষণ ধরে। এ-রকম করলে তুমি একা-একা মহাকাব্য রচনা করবে কেমন করে?’

এইসব কথা বলতে-বলতে কখন যে টেবিলের নিচে দুজনে দুজনের হাত ধরে ফেলেছে সেটা তারা খেয়ালই করেনি।

সুফী বললো, ‘আচ্ছা আমি তোমার হাত ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু তুমি ছাড়ছো না কেন আমার হাত?’

‘বা রে! আমি তো বৈজ্ঞানিক। আমি একা তো কিছু করি না। বৈজ্ঞানিকেরা অতো স্বার্থপর নয়। কবিদের মতো নিরালায় নির্জনে সৃষ্টি করতে তাদের মন চায় না। তারা অন্যদের হাত ধরে থাকতে পছন্দ করে।’

সুফী এবার সিঁড়ির দিকে চেয়ে বললো, ‘দেখো জগদীশ যে কতোক্ষণ আগে গাড়ি নিয়ে নিচে অপেক্ষা করছে আমাদের খেয়ালই ছিলো না। তাই ও নিজেই ওপরে উঠে এসেছে আমাদের খোঁজ নিতে। এবার আমার হাত ছেড়ে দিতেই হবে।’

জগদীশ এসে বললো, ‘আমি মিনিট পনেরো নিচে বসে থেকে আপনাদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। তাই নিজেই খোঁজ নিতে এলাম। আপনাদের খাওয়া হয়েছে তো? নিশ্চয়ই হয়েছে। তা নাহলে পান চিবোচ্ছেন কেন? কেমন লাগলো মারাঠি থালি?’

গাড়িতে ওঠার পর জগদীশ বললো, ‘আপনাদের জন্য একটা মেসেজ আছে। বাড়ি গিয়ে দেখি ব্রিগেডিয়ার সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। আপনাদের দুজনকে আগামীকাল সন্ধ্যায় ডিনারে ওঁদের ওখানে যেতে বলেছেন। ওঁদের মেয়ে আর জামাইও থাকবেন। একেবারে ঘরোয়া ব্যাপার। আমাকে বলে দিয়েছেন – দরকার হলে আপনাদের আমি সন্ধ্যায় গাড়িতে তুলে নিতে পারবো।’

মিত্রা বললো, ‘এটা তো বেশ খুশির কথা। তবে গাড়িতে তুলে নেওয়ার দরকার হবে না। আমি নিজেই তাঁর ওখানে যেতে পারবো।’

‘তোমার মনে আছে কি?’ সুফী বললো, ‘আগামীকাল সায়েন্স কংগ্রেসের শেষ দিন। বিকালে একটা সেশন হবে। তারপরই সমাপ্তি ঘোষণা। আমি ভাবছি আমার যাওয়া উচিত। আমার কাগজের জন্য একটা কপি পাঠানো উচিত।’

মিত্রা বললো, ‘না, আমার যাওয়ার খুব ইচ্ছে নেই। শেষ সেশনটা আমার সাবজেক্টের নয়। কী একটা মেডিসিনের ব্যাপারে কতকগুলো পেপার। মোটেই ইন্টারেস্টিং নয়। আমি বোধহয় যাবো না। আর আমার ডাক্তার মামার সঙ্গে বিশেষ দেখাও হয়নি এই কদিন। সায়েন্স কংগ্রেস নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। আগামীকাল দুপুরে আমাকে তাঁদের সঙ্গে খেতে হবে।’

‘আর আমাকেও একবার একটা খবরের কাগজের অফিসে যেতে হবে। ওয়াহাব চাচা – যাঁর হাতে আমার জার্নালিজমে প্রায় হাতেখড়ি, তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন, একবার সুযোগ পেলে দি ব্লিৎস পত্রিকার সম্পাদক মি. কারানজিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসতে। আগামীকাল দুপুরে ওঁর ওখানে যেতে হবে আমাকে। আর সন্ধ্যার আগে ফটোগুলো দোকান থেকে আনতে হবে। জগদীশ আজ ফিল্মটা দিয়ে এসেছে। জায়গাটা আমি চিনি না। তাই হয়তো সময় লাগতে পারে। তাই আমিও ভাবছি ব্রিগেডিয়ার সাহেবের ফ্ল্যাটে আমি নিজেই চলে যাবো।’

জগদীশ বললো, ‘তাহলে এক কাজ করা যেতে পারে – সায়েন্স কংগ্রেস শেষ হওয়ার পর আমি আপনাকে বিকালের দিকে তুলে নিয়ে ফিল্মের দোকানে আনতে পারি। তারপর ফেরার পথে হাসপাতালের কোয়ার্টার থেকে তাঁকে তুলে সোজা চলে আসবো এই কাফ প্যারেডে। এটা করলে আর আপনাদের যাতায়াতের ঝামেলা অনেক কমে যাবে। আর ঠিক সময়ে ডিনারের জন্য আসতে পারবেন।’

ওরা দুজনেই রাজি হলো এই ব্যবস্থায়।

জগদীশ বললো, ‘ব্রিগেডিয়ার সাহেব সময়ের ব্যাপারে বেশ সচেতন। অযথা দেরি করা তিনি পছন্দ করেন না।’

 

বিশ

পরদিন মিত্রা তৈরি হয়েই ছিলো। ওকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হলো। গাড়িতে উঠেই প্রথম কথা মিত্রা জিজ্ঞাসা করলো, ‘ফটোগুলো পেয়েছো? দেখি।’

তখন সন্ধ্যার অন্ধকার একটু-একটু করে নামছে। মিত্রা ছবিগুলো বের করে একের পর এক দেখতে লাগলো। সেই সূর্য ডোবার স্বল্প আলোর মধ্যেই সে ছবিগুলো দেখতে-দেখতে বলতে লাগলো – ‘বাহ, এটা সুন্দর হয়েছে। এটাতে তোমাকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছে। আর এটাতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল কেমন করে? ’

তারপর একটা ছবিতে এসে আটকে গেল সে। বারবার সেটাকে এদিক-ওদিক থেকে দেখলো। কাছে এনে, একটু দূরে সরিয়ে দেখলো। তারপর বললো, ‘এ-ছবিটা আমার। শুধু আমার। আর কাউকে দেখাতে পারবে না।’

সুফী বললো, ‘দেখি কোন ছবিটা? ওহ, ওই যে তুমি অর্ধেক গ্লাসভর্তি লিম্বু পানি লনে ঢেলে ফেলে দিচ্ছো সেই ছবিটা। তা এটা তো ভালোই এসেছে। তোমার এতো রাগ কেন এই ছবিটার ওপর?’

‘রাগ হবে কেন?’ ছবিটা সুফীর হাত থেকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে আবার বললো, ‘রাগের কিছু নেই। তবে আমি চাই না এই ছবিটা আর কেউ দেখুক। শুধু তুমি আর আমি।’

‘কেন বলো তো?’

‘বলবো না।’

‘মানে?’

‘কী রকম মানুষ তুমি? সব কথা কেন বুঝিয়ে বলতে হবে? তুমি নিজে বোঝো না কেন?’

‘হ্যাঁ, অবশ্য এই ছবিটা দেখলে স্বভাবতই লোকে জানতে চাইবে কেন তুমি অমন করে গ্লাসের পানি ফেলে দিচ্ছো? এটা তো স্বাভাবিক আচরণ নয়। অবশ্য বলা যায় যে, গ্লাসের ভেতরে একটা মাছি বা অন্য কিছু পড়েছিলো। তাই তুমি সব ফেলে দিচ্ছো। তবে তোমার মুখের ভাবটা তা বলছে না। কী রকম রাগ তোমার চেহারায়। হিংসে-হিংসে ভাব তোমার চোখেমুখে। সত্যিই তো। আমি ওটা খেয়াল করিনি আগে।’

মিত্রা বললো, ‘এই ছবিটা যে দেখবে সেই জিজ্ঞেস করবে এর পেছনের বৃত্তান্তগুলো। তখন তুমি কি করে বোঝাবে সবকিছু? না, এ-ছবিটা তুমি কাউকে দেখাতে পারবে না।’

‘হ্যাঁ, এ-ছবিটা যে দেখবে সে-ই বুঝতে পারবে যে, মেয়েটা একজনকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু কোনো কারণে ছেলেটার ওপরে ওর অভিমান হয়েছে। তা নইলে ওর চোখেমুখে এরকম হিংসে-হিংসে ভাব কেন? মনে হয় ওর মনের দরজা একেবারে খোলা। মনের গভীরে আর কিছু লুকোনো নেই। …মিত্রা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে আমি ভালো ছবি তুলি।’

মিত্রা একটু লজ্জা পেয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, স্বীকার করছি তুমি ভালো ছবি তোলো। কিন্তু সব কথা একটু আস্তে-আস্তে বলো। সামনে যে গাড়ি চালাচ্ছে সে-ও বুঝতে পারবে।’

মিত্রা এবার ছবিটা তার ব্যাগের ভেতর রেখে দিলো। বললো, ‘অন্য সব ছবি দেখাবে। কিন্তু এটা নয়। শুধু আমার কাছে থাকবে এটা। তুমি কিন্তু ভালো ছবি তোলো এটা আবারো বলছি। দেখো না পল ডিরাকের সঙ্গে ছবিটা কী সুন্দর এসেছে। এটাকে আমি এনলার্জ করে আমার ঘরে বাঁধিয়ে রাখবো। হ্যাঁ, একটা নয়, দুটো। একটা থাকবে আমার শোবার ঘরে, আরেকটা আমার কলেজের ল্যাবে। তোমার হিংসা হবে না তো? দেখো দেখো পল ডিরাকও হাসছেন আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। এ-রকম ছবি কেন জানি না বিকালবেলাতেই ভালো ওঠে।’

সুফী বললো, ‘একটু যে হিংসা হচ্ছে না, তা বলতে পারবো না। অবশ্য পল ডিরাকের চেয়ে তোমাকেই বেশি সুন্দর লাগছে।’

কাফ প্যারেড এসে গেল।

মিত্রা আর সুফী যখন কাফ প্যারেডে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়-হয়। অরুণা আন্টি হাসিমুখে ওদের অভ্যর্থনা জানালেন।

‘তোমাদের এতো দেরি হলো? আমি তো প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।’

তারা সবাই ঘরে ঢুকে সোফায় বসলো। মিত্রা বললো, ‘আমার দোষ না আন্টি। ওর দোষ। দেখছেন না কেমন স্মার্ট লাগছে ওকে আজ। ছেলেরা আজকাল সাজগোজ করতে এতো সময় নেয় কেন বুঝি না।’

সুফী বললো, ‘ওর কথায় কান দেবেন না আন্টি। আমি সারাদিন আজ চরকির মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। এতো কাজ ছিলো যে আজ আর কী বলবো।’

ব্রিগেডিয়ার সাহেবও এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘এসো এসো। এতো কী কাজ ছিলো আজ তোমার?’

‘আজ সকালে সায়েন্স কংগ্রেসের শেষ দিন ছিলো। মিত্রা গেল না। ওর নিজের সাবজেক্টের কোনো পেপার ছিলো না। তাই ও বিশ্রাম নিলো। কিন্তু আমাকে তো যেতেই হবে। আনুষ্ঠানিক ব্যাপার – আমার খবরের কাগজের জন্য একটা রিপোর্ট লিখতেই হবে। বিকেলে যেতে হলো ব্লিৎস সাপ্তাহিক কাগজের অফিসে। ঢাকা থেকে আমার জার্নালিস্ট মেন্টর আবদুল ওয়াহাব চাচার হুকুম। তারপর টুকিটাকি কতো কাজ। তার মধ্যে আবার ফিল্মের দোকান থেকে ছবিগুলো নেওয়া। আপনার গাড়ি না পেলে এতোগুলো কাজ করা সম্ভব হতো না।’

‘তোমরা আর কদিন আছো বোম্বেতে?’

‘আমি তো আগামীকালই ফিরে যাচ্ছি। কাজে এসেছিলাম। কাজ শেষ। আর কোনো উপায় নেই। যদিও আরো কদিন এখানে থাকলে মজাই হতো।’

‘আর তুমি মিত্রা?’

‘আমি আরো দুদিন আছি। ড. ভাভার সঙ্গে কাজ আছে। এতোদিন তিনি সায়েন্স কংগ্রেসের কাজে এতো ব্যস্ত ছিলেন যে আমাকে সময় দিতে পারেননি।’

মিত্রা বললো, ‘আপনাদের মেয়ে আর জামাই আজ এখানে থাকবে শুনেছিলাম। ওরা কোথায়?’

‘হ্যাঁ, ওরা এক্ষুনি আসছে। ওরা তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আনতে গেছে।’

দরজায় ঘণ্টা বাজলো। অরুণা আন্টি বললেন, ‘এই তো এসে গেছে ওরা।’

মাঝবয়েসি ভদ্রমহিলা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। গেরুয়া রঙের সালোয়ার কুর্তা পরনে।

‘আমার নাম সীমা। আর ও আমার স্বামী লুইস ডিমেলো। আপনারা নিশ্চয়ই মিত্রা আর সুফী।’ ওরা হাত মেলালো। বললেন, ‘এ কদিন ধরে বাবা-মায়ের কাছে আপনাদের দুজনের নাম এতোবার শুনেছি যে, মনে হচ্ছে আপনাদের অনেক দিন ধরে চিনি।’

সুফী বললো, ‘আমাদের আপনারা তুমি বলেই ডাকবেন।’

‘তা ঠিকই। তোমরা এখানে সবার চেয়ে ছোট। তোমরা না থাকলে আমার বাবা-মা রানীর অসুখ নিয়ে যে কী করে সামাল দিতেন,                সে-কথাই বারবার বলছেন। আর মিত্রার মামা প্রথমদিন থেকেই আমাদের মেয়ের বেশ যত্ন নিয়েছেন হাসপাতালে। সবাই বলেছিলো আমাদের – মেনিনজাইটিস নাকি ভীষণ মারাত্মক অসুখ। চটপট চিকিৎসা না করলে অনেক সময় নাকি রোগীকে বাঁচানো যায় না। তাই আমাদের দুজনে তোমাদের ধন্যবাদ জানানোই এখন কর্তব্য।’

রানীর বাবা বললো, ‘আজ বিকেলে হাসপাতালে গিয়েছিলাম মেয়েকে দেখতে। ও দিন-দিন ভালো হচ্ছে। আমরা তো ওকে বাড়ি আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার মামা আরো কয়েকদিন হাসপাতালে রাখতে বললেন। তা নাহলে আবার নাকি অন্য কমপ্লিকেশন দেখা দিতে পারে। আর রানীকে ওরা সবাই হাসপাতালে এতো যত্ন করে দেখেছে যে, সেও খুব যে বাড়ি আসার জন্য আগ্রহী তা মনে হয় না।’

‘হ্যাঁ, আমি মামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম রানীকে আর কতোদিন হাসপাতালে রাখতে চান। মামা বলেছেন, সব ঠিক থাকলে আগামী হপ্তায় ছেড়ে দিতে পারেন।’

ব্রিগেডিয়ার মেহতা বললেন, ‘মিত্রার জন্য কী সারপ্রাইজ এনেছো সেটা ওকে দাও।’

সীমা ওর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ক্যাডবেরি চকোলেট বের করে মিত্রার হাতে দিলো। বললো, ‘আর কাঁদবে না এরপর, কেমন?’

মিত্রা স্বাভাবিকভাবে বললো, ‘ধন্যবাদ।’ কিন্তু একটু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলো এই চকোলেটের সঙ্গে কান্নার কী সম্পর্ক?

সীমা বললো, ‘আজই বাবা বলছিলেন, তিনি যখন ইটাহারিতে তোমাকে কুয়ো থেকে উদ্ধার করে নিয়ে ওপরে উঠছিলেন তখন তোমার হাত থেকে চকোলেট পড়ে গিয়েছিলো। আর তুমি সেজন্যে অনেক কান্নাকাটি করছিলে। কিন্তু বাবা ঝুঁকি নিয়ে আবার কুয়োর নিচ থেকে সে চকোলেট উদ্ধার করে তোমার হাতে দিতে পারেননি। মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার পরও তুমি চকোলেটের শোকে কাঁদছিলে। তাই এতোদিন পর এই চকোলেট তোমাকে ফেরত দেওয়া হলো।’

মিত্রা কিছুক্ষণ ওর মুখটা নিচে নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। হাতে তার চকোলেট মুঠো করে ধরা। তারপর যখন ওদের দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে তাকালো, তার দুই চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে। বললো, ‘আপনারা সবাই এতো ভালো কেন?’ দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো গালে।

সীমা একটু ধমক দিয়ে বললো, ‘এতে কান্নার কী হলো? বললাম তো আর কেঁদো না।’ মিত্রার হাত দুটো ধরে ওকে কাছে টেনে নিলো। বললো, ‘চকোলেট পড়ে গেলে কাঁদে, আবার চকোলেট হাতে পেলেও কাঁদে। মহাঝামেলায় পড়া গেল মেয়েটাকে নিয়ে।’

মিত্রার পাশে বসলো সীমা। সুফী বসলো লুইসের পাশে।

এবার মিত্রা সকলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, ‘জানেন আমি কাল রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে ভাবছিলাম, এক হপ্তা আগে আমি বোম্বে আসার জন্য ট্রেনে উঠেছিলাম কলকাতা থেকে। সেখানেই সুফীর সঙ্গে আলাপ। তারপর এই পুরো সাতদিনে আরো কতো লোকের সঙ্গে আলাপ হলো, কতো কিছু ঘটলো। কেউ একটা কটু কথাও বলেনি। কেউ আমার মনে আঘাত দিয়ে কথা বলেনি। উলটো সবাই আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলো। আমার জীবনে এরকম আগে কখনো ঘটেনি। এখানকার এই এক হপ্তাকে আমি চিরকাল মনে রাখবো।’

মিত্রার এরকম কথা শুনে কেউ প্রথমে কথা বলতে পারলো না। সুফী ভাবলো আবহাওয়া হঠাৎ বেশি গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। তাই সে এবার একটু হেসে টিপ্পনী কেটে বললো, ‘শুধু একজন বাদ সেধেছিলো। লাল শাড়ি, বেণি দুলুনি একজন মেয়ে। মুখটা গীতাবলির মতো। হবু ডাক্তার।’

‘থাক তোমাকে আর বেশি-বেশি বলতে হবে না।’ সুফীর দিকে তাকিয়ে এবার বললো মিত্রা।

সুফী বলেই চললো, ‘শুধু তাই নয়, এতো খাটো আর টাইট চোলি পরেছিলো মেয়েটা যে তার কিডনিতে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা।’

মিত্রা বললো, ‘চুপ। আমি ভেবেছিলাম এই চকোলেট আমি সকলের সঙ্গে ভাগ করে খাবো। তোমাকে দেবো না একটুও।’

লুইস এতক্ষণ চুপ করে ওদের সকলের কথাবার্তা শুনছিলো। কিছু বলছিলো না। এবার বললো, ‘আমরা বোধহয় কেউ জানি না মিত্রা হঠাৎ সুফীর ওপর কেন এতো ক্ষেপে গেলো যে, চকোলেট পর্যন্ত ওর সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছে না। বোধহয় এতো সেনসেটিভ ব্যাপারে কোনো কিছু না জেনে আমাদের কোনোরকম অনধিকার চর্চা করা উচিত হবে না। তাই আমি বলি, আমার বেশ খিদে পেয়েছে। মা, এবার ডিনারের ব্যবস্থা করলে কিন্তু সবদিক রক্ষা হবে।’

খাবার টেবিলে লুইসের পাশে বসলো সুফী। মিত্রার পাশে সীমা। টেবিলের দুই প্রান্তে অরুণা আন্টি আর ব্রিগেডিয়ার।

সুফী জিজ্ঞাসা করলো লুইসকে, ‘আপনার দেশ কোথায়? আপনাকে দেখে তো ভারতীয় বলে মনে হয় না।’

‘হ্যাঁ, আমি পর্তুগালের লোক কিন্তু এখন এখানেই থাকি। আমি প্রথমে এসেছিলাম গোয়াতে। বছর দশেক আগে গোয়া তখনো পর্তুগিজদের অধীনে। তখন পর্তুগাল সরকার বলতো, গোয়ার সব অধিবাসী পর্তুগিজ। চাইলেই তারা পর্তুগালের পাসপোর্ট পেতে পারে। এই কয়েক বছর আগে যখন ইন্ডিয়া সামরিক অভিযান চালিয়ে গোয়া দখল করে নিলো তখন যদিও আমার পর্তুগিজ পাসপোর্ট ছিলো, তবুও আমি সেটা বাদ দিয়ে ইন্ডিয়ার পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করলাম।’

‘কেন, কেন?’ জিজ্ঞেস করলো মিত্রা আর সুফী দুজনেই।

‘কেন? ওটা সীমাকেই জিজ্ঞেস করা উচিত।’

সীমা বললো, ‘উত্তর খুব সোজা। কারণ ততোদিনে আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। লুইস ছিলো আর্কিটেক্ট। কিন্তু সে ওই পেশা ছেড়ে দিয়ে হলো থিয়েটারের স্টেজ ডিজাইনার। ওদিকে তার বেশি ঝোঁক। আর আমিও প্রায় ওই লাইনেই। আমি স্ক্রিপ্ট রাইটার। আমরা দুজনেই এখন পুনাতে ফিল্ম অ্যাকাডেমিতে কাজ করি। এখানে কাজ করতে গেলে ভারতীয় নাগরিক হলে সুবিধা।’

সুফী আবার জিজ্ঞেস করলো লুইসকে, ‘আপনাদের জানাশোনার কতোদিন পর আপনারা বিয়ে করলেন?’

মিত্রা ধমক দিলো সুফীকে। বললো, ‘এই তুমি এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছো কেন? মাত্র একঘণ্টারও কম আলাপ হয়েছে ওদের সঙ্গে।’

লুইস হেসে বললো, ‘কোনো চিন্তা নেই। একঘণ্টার কম আলাপ হয়েছে তোমাদের সঙ্গে বটে কিন্তু গত কয়েকদিনে তোমাদের কথা এতো শুনেছি যে, মনে হচ্ছে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় বহুদিনের। আর তাছাড়া এর পেছনে বোধহয় সুফীর মনে একটা প্রচ্ছন্ন চিন্তাও থাকতে পারে, তাই না? তোমাদের জানানোর জন্য বলতে পারি, আমরা বিয়ে করেছি আমাদের দুজনের মধ্যে পরিচয়ের প্রায় দুবছর পরে।’

‘এতোদিন পর?’

‘হ্যাঁ, কয়েকটা চিন্তার ব্যাপার ছিলো। বিয়ের মতো একটা সিরিয়াস পদক্ষেপ নেওয়ার আগে চিন্তা করা কি উচিত নয়? ধরো, আমাদের দুজনের দেশ ও ভাষা তখনো ছিলো আলাদা। আমাদের ধর্মও ছিলো আলাদা। আমি তখনো ছিলাম আর্কিটেক্ট। তাই আমার পেশাও আলাদা। আমাদের অবস্থা সম্পর্কে একটু চিন্তা করো, একটা কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হলে হুট করে কিছু কি করা উচিত?’

এবার মিত্রা অরুণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কিন্তু আন্টি আপনারা তো…?’

অরুণা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা ওরাও জানে যে আমরা শিলংয়ের পথে মাত্র দুদিনের পরিচয়ের পরেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অবশ্য আমাদের সারকামস্টেনস ছিলো অন্যরকম। আমরা দুজনে একই দেশের অধিবাসী, একই ধর্মের। এক ভাষাভাষী। অমিলের চাইতে মিলই ছিলো বেশি। অবশ্য তখন আমরা এতো কথা চিন্তা করেছিলাম বলে মনে হয় না। আমি তো আমার বাবা-মায়ের ঘাড়ে সব চিন্তাভাবনার ভার ছেড়ে দিয়ে হালকা হয়ে গেছি। কী আরাম! অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের এই একটা সুবিধে। তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা আমাদের পুরনো প্রথা বাদ দিয়ে কেন যে নিজের কাঁধে সব দায়িত্ব নিতে চাও বুঝি না?’

ব্রিগেডিয়ার সাহেব এতোক্ষণ এদের সব কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে ফিক-ফিক করে হাসছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন। বললেন, ‘এসব ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিয়ের ব্যাপারে প্রত্যেকের অবস্থান আলাদা বুঝতেই পারছো। একজনের জন্য যেটা কাজ দিয়েছে, অন্য আরেকজনের জন্য সেটা নাও খাটতে পারে।’

তিনি এবার মিত্রা আর সুফীর দিকে চেয়ে আস্তে-আস্তে বললেন, ‘আমি কি একটু সাহস করে বলতে পারি যে, তোমাদের দুজনের আলাপ হয়েছে মাত্র এক হপ্তা, কিন্তু তোমাদের দিকে যখন তাকাই তখন তোমাদের দৃষ্টিতে আলাদা অন্যরকম একটা ভাব দেখতে পাই। একরকম আপন-আপন টান বুঝতে পারি। এটা তোমাদের অজান্তেই ঘটে যাচ্ছে। যতোই তোমরা এটা লুকোতে চেষ্টা করো না কেন, পারছো না।’

মিত্রা এক সেকেন্ডের মতো একবার সুফীর দিকে চাইলো। তারপরই চোখ নত করলো।

‘তোমরাও কি ভাবছো মাত্র এক হপ্তার জানাশোনার পরই কি এতোবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় বা উচিত?… এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করার আগে তোমাদের কতকগুলো অন্য প্রশ্ন করতে চাই।’

একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব হয়তো আমার নয়। তোমাদের নিজেদের যারা অত্যন্ত কাছের মানুষ – স্বাভাবিকভাবেই তাঁরাই তোমাদের অন্যান্য পারিপার্শ্বিক অবস্থান সম্বন্ধে বেশি ওয়াকিবহাল। তাঁদের উপদেশ বা সিদ্ধান্ত অনেক বেশি কাজের হবে। তবে তোমরা যদি চাও, আমি আমার নিজের দিক থেকে কিছু কথা বলতে পারি। ওগুলোকে তোমরা কোনো দাম দেবে কিনা সেটা তোমাদের ব্যাপার। বলতে দ্বিধা নেই, তোমাদের দুজনকে মনে-মনে আমি প্রায় নিজের ছেলেমেয়ের মতো করে ফেলেছি। আমি অরুণার সঙ্গে এ নিয়ে একটু আলাপ করেছি। করাটা উচিত হয়েছে কিনা জানি না। তোমরা শুনতে চাও আমাদের দুজনের কথা?’

মিত্রা আর সুফী দুজনই মাথা নাড়লো।

‘তাহলে সুফী, তোমাকে নিয়েই শুরু করি। দেশে তোমার ফ্যামিলি সম্পর্কে কিছু বলো। তোমার বাবা-মা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন এদের সম্বন্ধে কিছু কথা।’

সুফী বললো, ‘আমার বাবা-মা দুজনেই বেঁচে আছেন। দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত। কিন্তু ব্যস্ত থাকেন নানান কাজে। বাবা ছিলেন উকিল। মা স্কুলের টিচার। দুজনেই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যেতে পারে। আমরা চার ভাইবোন। বড় বোন ডাক্তার। আমি দ্বিতীয়। আমার ছোটটা ইঞ্জিনিয়ার। আর সবার ছোট সে এখনো মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। শিগগির ডাক্তার হবে যদি পরীক্ষায় পাশ করতে পারে। ছোট বোন শিখার সঙ্গেই আমার বেশি ভাব। ওর কাছে আমার সব মনের কথা বলা যায়। আমি সাংবাদিক। লেখালেখি করি। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ আশাবাদী নয়, শুধু আমার ছোট বোনটা ছাড়া। আমার কিন্তু নিজের ওপর বেশ আস্থা আছে। টাকা-পয়সার দিক থেকে বোধহয় বেশি সাফল্য আসবে না কিন্তু একেবারে না খেয়েও থাকবো বলে মনে হয় না। আর বুঝতেই পারছেন আমি মুসলিম।’

‘কিন্তু তোমার কাজের জায়গা কোথায় হবে বলে মনে হয়?’ জিজ্ঞাসা করলেন অরুণা আন্টি।

‘মনে হয় ঢাকায়ই আমাকে থাকতে হবে। তবে এখানে সেখানে যেতে হতে পারে। কিন্তু ঢাকাতেই থাকতে হবে।’

এবার ব্রিগেডিয়ার মেহতা ফিরলেন মিত্রার দিকে। বললেন, ‘মনে হবে যেন আমি আদালতে জেরা করছি। শুনতে সে-রকম লাগতে পারে কিন্তু কিছু মনে করো না। তোমার বৃত্তান্ত আমাদের জানতে হবে এবার।’

মিত্রা শুরু করলো, ‘হ্যাঁ, আমি বিশ্বভারতীতে অনেক বছর কাটিয়েছি – প্রায় বারো বছর। আমার প্রায় সব শিক্ষাই ওখানে। এখন কলকাতায়। কিন্তু আমি নেপালের অধিবাসী। আমার পাসপোর্ট নেপালের। আমি বৌদ্ধ যদিও আমার মনে হয় আমি সব ধর্মেই বিশ্বাস করি কিংবা একটা বিশেষ ধর্মের অনুসারী আমি নই। বিজ্ঞানই আমার ধর্ম বলতে পারেন। আমার কর্মস্থল যে কোথায় হবে আমি নিজেই ভালো করে জানি না। এই সায়েন্স কংগ্রেসে আসার পর হোমি ভাভা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি আমাকে মোটামুটি তাঁর ওখানে এসে আরো কাজ করতে বলেছেন। তিনি আমাকে আমেরিকায় স্ট্যানফোর্ডে পাঠাতে চান। এসব ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য হয়তো আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে তাঁর কাছে যেতে হবে।’

‘এবার তোমার বাড়ির অবস্থা বলো যতোটা পারো।’

‘আমার বাবা-মা দুজনেই এই বছর দশেক আগে বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন নেপালে। আমার এক বড় বোন আছে। এই বোন আর আমার ভগ্নিপতি আমার গার্জেন। আমরা ধূলিখেলে থাকতাম, বাবা যখন ওখানে ইউনিভার্সিটিতে কাজ করতেন। আমার বোন আর ভগ্নিপতি এখন থাকেন কাঠমান্ডুর কাছে থামেলে। ওদের দুই মেয়ে। আমার খুব প্রিয় ওরা। যদিও অনেকদিন পরপর ওদের সঙ্গে দেখা হয়। আমার ভগ্নিপতির আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালোই। ট্যুর অপারেটর হিসেবে তাঁরা এখন মন্দ করছেন না। দিনে দিনে ব্যবসা বেড়েই চলেছে। আর ধূলিখেলের বাড়িটা আমরা ছাড়িনি। ওটা ভাড়া দেওয়া আছে। আঙ্কেল আপনি নিজেও মাঝে মাঝে তো যান নেপালে। আন্টিকে সঙ্গে নিয়ে আসেন নিশ্চয়ই। এবার গেলে অবশ্যই আমাদের বাড়িতে যাবেন। আর শুধু আপনি কেন? রানী ভালো হলে ওকে নিয়ে ওর বাবা-মা নিশ্চয়ই নেপালে আসবেন। যে রেটে ট্যুরিস্টরা নেপালে আসতে শুরু করেছে, আসল নেপাল ওদের চাপে তলিয়ে যাওয়ার আগেই আপনারা সবাই আসবেন।’

অরুণা আন্টি এবার বললেন, ‘হ্যাঁ, মিত্রার নিমন্ত্রণ নিলাম। যখন আমরা সবাই মিলে হঠাৎ ওর ওখানে এসে উপস্থিত হবো, তখন বুঝবে মজা। এখন যাও, তোমরা হাতমুখ ধুয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসো। কফি বা চা যা খেতে চাও ওখানেই হবে।’

ওরা সবাই এসে জড়ো হলো ছোট্ট বসার ঘরে।

লুইস বললো, ‘আমি এতোক্ষণ ধরে মিত্রা আর সুফীর কথাগুলো শুনলাম। একসময় আমিও এরকম নিজের মনে-মনে জেরা করেছি আমাদের বিষয়ে। তারপর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তাতে কখনো পস্তাতে হয়নি। তবে তোমাদের ভবিষ্যৎ অতো সহজ হবে না বুঝতে পারছি। তোমাদের দুজনের মধ্যে এতো রকম অমিল রয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত তোমাদের কী পরিণতি হবে আমার মনে হয় সেটা কেউ ঠিক করে বলতে পারবে না।’

তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলো, ‘আমার দেশে মানে পর্তুগালে একরকম লোকজ গান আছে, যার নাম হচ্ছে ফাদো। পর্তুগিজদের অতিপ্রিয় গান। এই গানগুলোর কথা সবসময়ে গায়কের দুঃখের বিচ্ছেদের কথা বলে – কবে আমি একজনের প্রেমে পড়েছিলাম। তারপর আমি তাকে হারিয়ে ফেললাম। কিন্তু যখনই তার কথা আমার মনে পড়ে – একটা সূর্যাস্ত দেখে কিংবা আকাশে একদল হাঁস উড়ে যাচ্ছে, এইসব দেখে তখন আমার মনটা ভিজে যায়। এইরকম সব সেন্টিমেন্টাল ভাবনা মনটাকে আচ্ছন্ন করে। বোধহয় পৃথিবীর সব দেশেই এরকম গান গাওয়া হয়। তবে আমরা পর্তুগিজরা এই ফাদো গানকে নিজেদের মজ্জার ভেতরে একেবারে মিশিয়ে ফেলেছি।’

‘হ্যাঁ, আমাদের দেশেও আছে ভাটিয়ালি আর ভাওয়াইয়া।’ বললো সুফী, ‘একেবারে মাটির গান। দুঃখের ভারে ভারাক্রান্ত সব গান। তবে শহুরে গানের চাপে ওরা অনেকটা চাপা পড়ে যাচ্ছে আজকাল।’

‘পর্তুগালে ফাদো গানের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গায়িকা হচ্ছেন আমালিয়া রোদ্রিগেজ। তাঁর নাম আপনারা হয়তো শোনেননি। কিন্তু তিনি অনেক দেশেই ধীরে-ধীরে প্রসিদ্ধি লাভ করছেন। তিনি নিজেই একটু লাজুক আর প্রচারবিমুখ। তবে আমার সৌভাগ্য যে, তাঁর সঙ্গে একটু আলাপ আছে। তিনি যখন গান করেন তখন ছোট ঘরেই হোক বা বড় হলঘরে হোক, শ্রোতা দর্শকেরা সকলে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েন। কারণ গানের বিষয়বস্ত্ত যে দুঃখে ভারাক্রান্ত। সেই ভাবটা, সেই দুঃখ কষ্ট বেদনা সব তিনি নিজের মুখে ফুটিয়ে তুলতে পারেন।’

সীমা বললো, ‘হ্যাঁ, আমি তাঁর গান রেকর্ডে শুনেছি। লুইসের কাছে আছে। কিন্তু লুইস বলে, মুখোমুখি তাঁর গান না শুনলে ফাদোর আসল মর্ম বোঝা যায় না।’

লুইস বললো, ‘আমালিয়া রোদ্রিগেজের সঙ্গে আমার যখন আলাপ হয় তখন আমি তরুণ। তাঁকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তখনো তিনি অতোটা বিখ্যাত হননি। সেই সূত্র ধরে পরে তাঁর সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ফাদো গান কেন আমাদের এতো জনপ্রিয়। তিনি খুব সহজভাবে বললেন, দেখো, সব প্রেমের সার্থক পরিণতি কি মিলনে? না, তা নয়। বরং বলা যায়, মিলনে প্রেম ঘুমিয়ে পড়ে, মিলিয়ে যায়। মানুষের চোখের সামনে দিয়ে সুখ চলে যায়। তার ঘুম ভাঙে না। কিন্তু প্রেম জেগে থাকে বিরহে। ঘুমুতে দেয় না। বরং মনটাকে খুঁচিয়ে ঝেঁটিয়ে এমন একটা অপার্থিব স্তরে পৌঁছে দেয়, সেখানে সুখ আর বেদনার প্রভেদ বোঝা যায় না। মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মানুষ তখন কবিতা লেখে, গান গায়। ফাদো সেই গান। সাধারণ মানুষ তখন অসাধারণ হয়ে ওঠে।’

মিত্রা আর সুফীর দিকে তাকিয়ে লুইস আবার বললো, ‘তোমরা মনে রেখো এ-কথাটা।’

অরুণা আন্টি এবার বললেন, ‘এই লোপচু চায়ের গন্ধটা কেমন লাগছে সুফী। রং ফিকে কিন্তু ফ্লেভার বেশি – এইজন্য আমার বেশ ভালো লাগে।… তা মিত্রা পার্টিকল ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করে। এটাই তার প্রফেশন হবে। এটা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু তুমি একজন সাংবাদিক। এটা তোমার প্রফেশন। তবে মিত্রার কাছে শুনেছি যে, তুমি কবিতা লেখো আর রুমি তোমার বেশ পছন্দ। এ দুটো আলাদা কাজ তুমি কী করে তোমার জীবনে মানিয়ে নাও।’

একটু হেসে সুফী বললো, ‘হ্যাঁ, এ নিয়ে আমার বাবা-মা, বন্ধুবান্ধবও প্রশ্ন করেন। অনেকের মনে এ-প্রশ্নটা ওঠে। আমি নিজেও ভাবি এ নিয়ে। যদিও খুব সদুত্তর পাইনি এখনো। খেয়ে-পরে বাঁচতে হলে একটা প্রফেশন নিয়ে থাকতে হবে, অন্তত আমাদের দেশে। কিন্তু যদি একজনের কবি মন থাকে, নিজের ভেতর থেকে এমন একটা তাগিদ আসে, যখন সাধারণ ভাষা দিয়ে মনের ভাবটা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না, তখন আমাকে কতকগুলো অস্বাভাবিক কথা আর শব্দ             জুড়ে-জুড়ে ভাব প্রকাশ করতে হয়। তখন আমি নিজস্ব জগতে বিচরণ করি, যারা সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। তারা বোধহয় আমার কথাগুলো বুঝতে পারবে না। যুগ-যুগ ধরে সাধারণ মানুষ আর কবিদের ভেতরে এই বিভেদ থেকে যায়। কিন্তু যখন আমি রুমির লেখা পড়ি তখন আমার মনে হয় যেন আমি এই কবিমনের মধ্যে আমাকে কিছুটা খুঁজে পাই। এ-রকম কথা বলা আমার পক্ষে অনেকটা ধৃষ্টতা বলেও অনেকে মনে করতে পারেন। হাজার বছরের বেশি সময় পেরিয়ে রুমি এখনো আমাদের মধ্যে কৌতূহল জাগান। মাত্র কবছর হলো আমার জ্ঞান হয়েছে। কতোটুকুই বা পড়েছি। তাও আবার অনুবাদে – ইংরেজি আর বাংলায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, রুমি একটা অগাধ সমুদ্র, অসীম তাঁর ব্যাপ্তি। তাঁর গভীরতার কোনো অন্ত নেই। কিন্তু মুক্তোগুলো রয়েছে সেই গভীরে লুকিয়ে। এসব বড়-বড় কথা বলে আমি কাউকে চমকে দিতে চাই না। তবে যদি কোনোদিন পারি ফার্সি ভাষাটা শিখতে হবে, যাতে রুমির লেখা কথাগুলো তাঁর নিজের ভাষায় পড়তে পারি। যখন গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ পড়ি তখন মনে হয় এটা পড়েই ওরা তাঁকে নোবেল প্রাইজ দিলো। যদি বাংলায় কবির নিজের ভাষায় লেখা কবিতাগুলো পড়তো এবং বুঝতে পারতো, তাহলে নোবেল কমিটির পন্ডিতদের কী অবস্থা হতো!’

সকলেই সুফীর কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলো। কেউ কথা বলে তাকে বাধা দিতে চায়নি।

সুফী শেষে বললো, ‘অবশ্য বলতে পারেন, রুমি আমাদের জন্য একটা লাক্সারি বা অপ্রয়োজনীয় একটা প্রসাধন সামগ্রী। কিন্তু এসব অপ্রয়োজনীয় জিনিস না থাকলে আমাদের জীবন সমৃদ্ধ হবে কী করে?’

এবার সে একটু হেসে মিত্রার দিকে চেয়ে বললো, ‘অনেকটা পার্টিকল ফিজিক্সের মতো – আমাদের দৈনন্দিন আটপৌরে জীবনের জন্য যার কোনো দরকার নেই।’

এবার ব্রিগেডিয়ার মেহতা সবাইকে টেনে মাটিতে নামালেন। ‘খেয়াল আছে কটা বাজলো – রাত্রি ১১টা পেরিয়ে গেছে। সুফী, শুনলাম তুমি কালকেই বোম্বে ছেড়ে যাচ্ছো। কিন্তু মিত্রা আরো কয়েকদিন থাকবে। অনেকদিন এতো আনন্দের সন্ধ্যা আমাদের কাটেনি। তুমি যদি কালই না যেতে তাহলে আবার হয়তো আরেকটা আড্ডা বসাতে পারতাম। তবে ভবিষ্যতে আমরা সকলেই নিশ্চয় আবার কোথাও জড়ো হয়ে এ-রকম আড্ডা বসাবো। তোমাদের দুজনের সঙ্গে আলাপ করতে পেরে সত্যিই আমরা খুব খুশি হয়েছি।… আর সুফী, তোমার ট্রেন ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস থেকে কখন ছাড়বে? গাড়ির দরকার হলে কোনো সংকোচ না করে আমাদের বলবে।’ ওরা যাওয়ার জন্য এবার উঠলো।

গাড়িতে উঠে মিত্রা বললো, ‘তোমার ট্রেন তো বিকাল ৪টায় ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস থেকে। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবো স্টেশনের ভেজিটারিয়ান রেস্টুরেন্টের সামনে। সকালে যাবো আমার মাস্টারমশাই ড. গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে। বেশ কয়েকদিন তাঁর কোনো খবর নিইনি।’

‘আর আমিও একবার যাবো চোর বাজারে। দেখি ওখানে কিছু ভালো জিনিস কিনতে পাই কিনা। তোমার জন্য কী আনবো বুঝতে পারছি না। তোমার যে কী পছন্দ সেটা জানি না।’

‘খবরদার, আমার জন্য কিছু তোমাকে কিনতে হবে না।’ তারপর একটু থেমে বললো, ‘অবশ্য জাভেরি বাজার থেকে যদি একটা হীরের নেকলেস কিনতে পারো তাহলে আপত্তি করবো না।’

‘হ্যাঁ, কিনতে তো পারি। তবে তোমার আবার যে অভ্যাস – ওটা আবার অন্য কাউকে দিয়ে দেবে, তাহলে কী লাভ?’

‘এটা ঠিক বলেছো। ওসব জিনিস আমার মোটেই পছন্দ নয়। না, হীরের নেকলেসের দরকার নেই তাহলে।’

‘আমাকে দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ফ্র্যাংক মোরেজের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ঢাকা থেকে আমার ওয়াহাব চাচা খবর পাঠিয়েছেন। তাঁরা দুজনেই প্রবীণ সাংবাদিক, জানাশোনা আছে। আমারও এ জগতের সব রথী-মহারথীর সঙ্গে আলাপ থাকা উচিত।’

‘আর আমারও একবার দেখা করতে হবে হোমি ভাভার সঙ্গে। দেখি ড. গুপ্ত কালকে সকালের দিকে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে পারেন কিনা।’

ঠিক সময়মতো স্টেশনে পৌঁছে সুফী উঁকি মারলো রেস্টুরেন্টের ভেতরে। মিত্রা সেখানে এক কোণে একলা বসে আছে একটা টেবিলে। দুপুরের খাবারের সময় পেরিয়ে গেছে বলে লোকজন বেশি নেই সেখানে।

সুফী চুপ করে মিত্রার উলটোদিকের চেয়ারে বসলো। তার স্যুটকেস আর হোল্ডঅলটা পাশে রাখলো। জিজ্ঞাসা করলো, ‘খিদে পেয়েছে?’

‘না, দুপুরে খেয়েছি। এখন কফির খিদে পেয়েছে।’

ওয়েটারকে ডেকে সুফী এক কাপ গরম কফি আর নিজের জন্য এক কাপ ঠান্ডা কফি অর্ডার দিলো। ফুচকা আর পাকোড়া দুটো তার সঙ্গে। তারপর চেয়ে রইলো মিত্রার দিকে কিছুক্ষণ। আজ মিত্রা সালোয়ার-কামিজ পরেছে। সাদাকালো ডটওয়ালা একটা কামিজ। তেমনই একটা ওড়না গায়ে।

মিত্রা মুখ খুললো কিছুক্ষণ পর। বললো, ‘তুমি আমাকে লজ্জা দিচ্ছো কেন?’

‘কেন আমি তো তেমন কিছুই বলিনি, তুমি লজ্জা পাচ্ছো কেন?’

‘তুমি ভাবছো আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না? আমি ঠিকই শুনতে পারছি কিন্তু।’

‘কেমন করে?’

‘এই এক হপ্তা ধরে তোমার সঙ্গে কতো ঘণ্টা কাটালাম। তুমি মনে-মনে যা বলছো তা আমি ঠিকই শুনতে পাচ্ছি।’

‘কী ভাবছি আমি?’

‘তুমি ভাবছো এই মেয়েটাকে এখন একটা চুমু দিলে ভালোই হয়। একটু পরেই তো চলে যাবে। এতোদিন কোনো সুযোগ পাওয়া গেল না। এবার কী করি?’

‘তুমি ঠিকই ধরেছো। মেয়েটার দিক থেকে খুব যে আপত্তি হবে তা আমার মনে হয় না।’

‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু এখানে এই রেল ইস্টিশানে এতো লোকের মাঝে ওসব কান্ড করলে আমাদের দুজনকেই পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে।’

‘হ্যাঁ, এ-রকম একটা আশঙ্কা আছে ঠিকই। কিন্তু যখন তুমি তোমার চুল টানটান করে মাথার পেছনে বাঁধো, তোমার কান দুটো চুলে ঢেকে থাকে না, তখন তোমাকে দেখতে যা সেক্সি লাগে।’

‘তাই বুঝি?’ মিত্রা মুখটা নিচে নামালো। এবার সত্যিই একটু লজ্জা পেলো বোধহয়। বললো, ‘তবু তো আজ খোঁপায় ফুল পরিনি।’

‘কেন?’

‘সাদাকালো ফুটকিওয়ালা কোনো ফুল আজ আর হাসপাতালের বাগানে পেলাম না।’

ওদের কফি এসে গেল।

মিত্রা বললো, ‘কফিটা ভালো বানিয়েছে। বেশ গরম।’

‘আমারটা বেশ ঠান্ডা, ভালোই লাগছে। জানো, গতকাল রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি। বোধহয় তোমাকে ছেড়ে যাবো আজকে সেই চিন্তায়। কিন্তু শুধু মনের মধ্যে ঘুরতে লাগলো রুমির সেই ছোট্ট কবিতাটা, যেটা তোমাকেও ভাবিয়ে তুলেছিলো। কোনটা বলছি বুঝেছো তো – ‘আমি মরে গেলে/ আমার লাশটা বাড়ির বাইরে ফেলে দিও/ তারপর বহুদিন পরে তুমি আসবে/ আমার শুকনো ঠোঁটে চুমু দেবে।/ তখন আমি যদি চোখ মেলে তাকাই/ তাহলে তুমি ভয় পাবে না তো?’… এ কেমন কবিতা। রুমি কি এখানে পুনর্জন্মের কথা বলছেন? কিন্তু ইসলামে তো পুনর্জন্মের ঘটনা বিশ্বাস করে না। নাকি সম্পূর্ণ অন্য কোনো কথা বলতে চেয়েছেন তিনি? খামোখা এই চিন্তা মনের মধ্যে ঘুরতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে ছেড়ে দিলাম – তোমার ভাষা বোঝার আশা দিলাম জলাঞ্জলি বলে ঘুমিয়ে পড়লাম।’

মিত্রা বললো, ‘সকালে গিয়েছিলাম ড. গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তোমার কথাও জিজ্ঞাসা করছিলেন। জ্বর, গলার ব্যথা ভালো হয়েছে। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। আরো একটু ভালো না হয়ে কলকাতা ফিরবেন না। তাই দুঃখ করে তিনি বলছিলেন, আমরা তিনজন একসঙ্গে ট্রেনে এলাম। কিন্তু ফিরে যাচ্ছি আলাদা-আলাদা। তোমার সঙ্গে তিনি ঢাকা সম্বন্ধে আরো কথাবার্তা বলতে চেয়েছিলেন।’

সুফী জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোমার হাতে ওটা কী বই?’

‘এই জার্নালটা মাস্টারমশাই আমাকে দিলেন পড়ার জন্য। এটা একটা উঁচু মানের ফিজিক্সের জার্নাল। অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিক এতে প্রায়ই লেখেন। এটার নাম ফিজিক্স রিভিউ লেটারস – এই বছরের মানে ১৯৬৪ সালের ৩১ আগস্ট সংখ্যা। আমাকে একটা লেখা পড়তে বললেন। এটা লিখেছেন পিটার হিগস নামে এডিনবরা ইউনিভার্সিটির একজন ফিজিসিস্ট। আমি একবার পড়লাম কিন্তু সবকিছু বোধগম্য হলো না। তিনি বলতে চান যখন বিগ ব্যাংয়ের মুহূর্তে বিশ্ব সৃষ্টি হলো তখন কোন কোন সাব-অ্যাটমিক পার্টিকলগুলোতে ভর বা ম্যাস ছিলো না। অথচ ইলেকট্রনে যদি ম্যাস না থাকে তাহলে সেগুলো চতুর্দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে বেড়াবে। অন্য কোনো অ্যাটমের সঙ্গে মিলেমিশে নতুন নতুন পদার্থ তৈরি করতে পারবে না। অথচ সৃষ্টির মূল লক্ষ্য তো তাই। বিশ্বে যতোকিছু আছে সেগুলো তৈরি করার জন্য ইলেকট্রন এবং অন্য অনুকণাগুলোতে ম্যাস তৈরি করতে হবে। এটা করার জন্য বিশ্ব সৃষ্টির ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে সর্বত্র এমন একটা কণা থাকতে হবে যার কাজ হচ্ছে অন্য এই কণাগুলোতে ভর তৈরি করে দেওয়া। তিনি এই লেখাতে অনেক অঙ্ক করে আর ইকোয়েশন দিয়ে দেখিয়েছেন – এই অনুকণার অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক এবং তিনি হিসেব করে বলছেন, এটা হবে একটা বোসন। তিনি আরো বলছেন, এই বোসন ছিলো সেই সৃষ্টির মুহূর্তে এবং তার কাজ ফুরিয়ে গেছে বলে এখন আর নেই। এটা ব্যবহারিক দিক থেকে প্রমাণ করে দেখাতে হবে অন্য বৈজ্ঞানিকদের – এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে। আমাদের কাজটাও ওই লাইনের।’

সুফী লক্ষ করলো এই রকম একটা দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বোঝানোর সময় মিত্রা নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলে। অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে। যেন এক অবোধ শিশুকে বোঝাচ্ছে অনেক ধৈর্য ধরে। সুফীর বেশ মজাই লাগে মিত্রার এ-রকম লম্বা বক্তৃতা শুনতে। যদিও বোঝে না অনেক কিছুই।

তাই একটু খোঁচা দিয়ে বললো, ‘যা বললে সবই তো বোঝা সহজ। শুধু ওই অঙ্কগুলোই দুর্বোধ্য। আমার এই মোটা মাথায় ওগুলো কোনো কালেই ঢুকবে না। তবে রুমির কবিতাগুলো পড়ে দেখো। বারবার পড়তে হবে। বিশেষ করে মনটা যখন দৈনন্দিন জীবনের অন্য সমস্যা নিয়ে জর্জরিত না থাকে সেই সময়। যখন বারবার পড়বে তখন প্রত্যেকবারই একটু বেশি করে নতুনভাবে ঝুঝবে – অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।’

‘না। এবার আর হলো না। এরপরে আবার যখন দেখা হবে তখন আমরা দুজন মিলে পড়বো। তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিও। আমি যখন আমার ফিজিক্সের সমস্যা নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলি তখন বোধহয় অনেকটা বেশি-বেশি মাস্টারিপনা করি। তুমি কিছু মনে করো না তো?’

‘একটু-একটু যে করি না তা তো নয়! তবে তোমার এসব দুরূহ ম্যাথস আমার মাথায় ঢুকবে না। যতোই চেষ্টা করো না কেন।’

মিত্রা বললো, ‘তুমি আজ সকালে চোর বাজারে গিয়েছিলে না? কিছু কিনলে নাকি?’

‘গিয়েছিলাম তো। আমার ইচ্ছে ছিলো তোমার জন্য কিছু কিনতে। বিরাট বাজার – নতুন-পুরনো কতোরকম জিনিসে দোকানগুলো ভর্তি। আর ভিড়ও তেমনি। কিন্তু আমার অবস্থা হলো সক্রেটিসের মতো।’

‘তার মানে?’

‘গল্পে বলে সক্রেটিস রোজ এথেন্সের বাজারে যেতেন।            দোকান-দোকান ঘুরে অনেক জিনিস দেখতেন। দরদস্ত্তর করতেন। ব্যস, এই পর্যন্ত। তাঁর সাগরেদ একদিন জিজ্ঞাসা করলো, মহাশয় আপনি বাজারে এসে অন্যসব ক্রেতার মতো সব জিনিসপত্র পরীক্ষা করেন, দাম করেন, ওজন করান কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু কেনেন না। ব্যাপার কী? সক্রেটিস জবাবে বললেন, বৎস, আমি বাজারে আসি দেখতে কী-কী জিনিস আমার দরকার নেই। না কিনলেও জীবনটা বেশ চলে যায়। নির্ঝঞ্ঝাটেই চলে যায়। খামোখা এসব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে জীবনটাকে শুধু শুধু জটিল করার কোনো মানে হয় না। আমিও ঘণ্টা দুই এভাবে কাটানোর পর শেষ পর্যন্ত একটা পুরনো বইয়ের দোকান পেলাম। সেখান থেকে এই দুটো বই কিনলাম।’

বই দুটো বের করলো সুফী।

‘এটা আমার জন্য। তোমাকে দিচ্ছি না। গালিবের কবিতার ইংরেজি অনুবাদের সংকলন। এটা আমি ট্রেনে পড়বো। লম্বা জার্নি – সহজেই সময় কেটে যাবে। অবশ্য তুমি সঙ্গে থাকলে পড়ার হয়তো সুযোগ পেতাম না। আর এই বইটা তোমার জন্য। অজন্তা ইলোরার একটা ছবির বই। অনেক রঙিন ছবি আছে।’

মিত্রা বইটি হাতে নিলো। উলটেপালটে দেখলো।

সুফী বললো, ‘কোন গুহাটায় হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল বুঝতে পারছো। আর তুমি ‘আই মাম্মি’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলে, খেয়াল আছে।’

মিত্রা কোনো জবাব দিলো না। মুখ নিচু করে পাতা ওলটাতে লাগলো।

‘তুমি অন্ধকারে সত্যিই ভয় পেয়েছিলে না আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য ওটা একটা অজুহাত?’

‘তুমি না?… আবার যদি তুমি আমাকে শুধু-শুধু খ্যাপাও তাহলে আমি পুলিশ ডাকবো কিন্তু।’ তারপর বিষয় বদলানোর জন্য বললো, ‘তোমার ক্যামেরায় তোলা সব ছবির কপি আমাকে দিতে হবে। আমি একটা অ্যালবাম করবো। আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার সময় থেকে।’

‘হ্যাঁ, সেই গ্লাসের লিম্বু পানি লনে ফেলে দিচ্ছো ওটা কিন্তু এনলার্জ করে আলাদা একটা পাতায় লাগাতে ভুলো না।’

মিত্রা বললো, ‘ওহ, আমি তো ভুলেই যাচ্ছিলাম। তোমার জন্য কয়েকটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছিলাম। ট্রেনে কোনো একসময় খিদে পেলে খাবে। জানি না তুমি কী রকম স্যান্ডউইচ খেতে পছন্দ করো। ভেজিটেবল আছে, শসা আর টমেটো আছে। আর আছে সেদ্ধ ডিম, বেশ ঝাল চাটনির সঙ্গে।’

‘নিশ্চয়ই খাবো। এবার কিন্তু যাচ্ছি এয়ারকন্ডিশনড কোচে একটু আয়েশ করে। আমার খবরের কাগজ যখন টাকাটা দিচ্ছে তখন চিন্তার কী? আর এই ট্রেনে ভালো খাবার ব্যবস্থাও আছে। অতএব একেবারে অনশনে মরবো না।’

‘তোমার ট্রেনের সময় প্রায় হয়ে এলো। আমি কিন্তু প্লাটফরম পর্যন্ত যাবো না। এসব বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে আমার খুব অকওয়ার্ড লাগে। কেঁদেও ফেলতে পারি। খুবই লজ্জার কথা – এতো লোকের সামনে।’

সুফী অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিত্রার দিকে। ওর চোখের ভাষা বুঝে মিত্রা একটু লজ্জা পেল।

বললো, ‘ও-রকমভাবে তাকিয়ে দেখছো কী?’

‘আমি ভাবছিলাম তোমার গালের ওই তিলের ওপর একটা চুমু দেবো। কিন্তু মনে হয় তুমি আবার পুলিশের ভয় দেখাবে।’

স্টেশনের এতো লোকের দিকে তাকিয়ে মিত্রা বললো, ‘এই সদিচ্ছাটা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখো। মনে রেখো তোমার গালেও একটা তিল আছে। যদিও আয়নায় তুমি ওটা দেখতে পাও না।’

‘হ্যাঁ, পরেরবার যখন দেখা হবে তখনকার জন্য তোলা থাকবে। আর মনে রেখো আমরা দুজনে একসঙ্গে রুমির কবিতা পড়বো। আর তুমি আমাকে সব বুঝিয়ে দেবে।’

মিত্রা এবার সুফীর ডান হাতটা ধরে ওকে স্যান্ডউইচের প্যাকেটটা দিলো। কিন্তু হাত ছাড়লো না সহজে। বললো, ‘তাহলে দেখা হবে শিগগির – তবে কবে সেটা জানি না।’

সুফী বললো, ‘আর যদি কোনোদিন দেখা না হয়, তাহলে?’ ওর ঠোঁটের ওপর অন্য হাত দিয়ে চেপে মিত্রা বলে, ‘ওরকম করে বোলো না। দেখা যে হতেই হবে। তা নইলে দুনিয়াটা চলবে কেমন করে?’

তারপর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘চলি।’

ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসের হাজার লোকের কোলাহলে সুফীর কানে লেগে রইলো শুধু ওই একটা কথা – ‘চলি’।

কয়েক পা এগিয়ে মিত্রা আরেকবার ফিরে চাইলো। সুফী ওর যাওয়ার পথে তাকিয়েই ছিলো। আবার শুনলো। সব কোলাহলের মধ্যেও আবার একটা মিষ্টি কথা – ‘চলি।’ r

 

 

 

অন্ধ নিশানা

তিলোত্তমা মজুমদার

 

সুহাসের সঙ্গে সুমালার দেখা হয়েছিল রজতদার কোচিংয়ের ফরম তুলতে গিয়ে।

শুনলে মনে হয় ‘রজতদার কোচিং’ মানে একফালি ঘর, একটি লম্বাটে টেবিল নিয়ে চারখানি বেঞ্চ, তাতে ঠাসাঠাসি বসে আছে ছাত্রছাত্রীরা। লিখতে লিখতে এর কাঁধ ঘষে যাচ্ছে ওর কাঁধে, এর কনুই তাকে গুঁতিয়ে দিচ্ছে, এর হাঁটু লেগে যাচ্ছে তার জানুসন্ধিতে। উঠতি বয়সের পক্ষে ভারি মজাদার, পরস্পরকে ঘনিষ্ঠ করে তোলে, আরো গভীর বন্ধুত্ব, গাঢ়তর টান।১

কিন্তু রজতদার কোচিং একফালি ঘর নয়। তাহলে কি গৃহাংশ? আধুনিক বাংলায় বলে অ্যাপার্টমেন্ট। আগেকার কালে ছিল শরিকি বাড়ি। বৃহৎ বংশ ক্রমে শাখায়-প্রশাখায় বিস্তার লাভ করত আর বেচারা অট্টালিকা, যা একদা কোনো ধনী ব্যক্তির গর্বিত কীর্তি হিসেবে শোভিত ছিল, বংশবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর্ভাগ গৃহের স্বাভাবিক রূপ হারিয়ে ভাগাভাগির চাপে যেনবা মধুমাছির পরিত্যক্ত মৌচাক। কার বা গোয়াল, কে বা দেয় ধোঁয়া। অট্টালিকার প্রলেপ খসে পড়ে, অঙ্গে রং ওঠে না, পরিবার যত বাড়ে শৌচালয় তত সংখ্যায় নির্মিত হয় না বলে এজমালি শৌচাগারে শ্যাওলা ও হলদে ছোপ, পূতিগন্ধ, মাকড়সার জালে লম্বা মালার মতো ঝুলে থাকে সাদাটে ডিম। অধিবাসীরা পরস্পর রক্তসম্বন্ধে সম্পর্কিত কিন্তু ঈর্ষাকাতর ও বিবাদপরায়ণ। অপরিষ্কার শৌচালয়ে শুদ্ধ হতে যায় এবং মনের মধ্যে ময়লা জমিয়ে তোলে। হায় সেইসব প্রাসাদোপম অট্টালিকা! হায় সেইসব শরিকি বাসস্থান! হায় সেই অট্টালিকার আদি পিতা যাঁর একখানি গম্ভীর ছবি, স্যাঁতা-পড়া, ঘুণ-লাগা, হয়তো দেয়ালের কোনো কোণে অবহেলায় লটকে থাকত। হয়তো বেঁকে থাকা প্রতিকৃতি, কেউ সোজা করে দেওয়ার কথা ভাবে না। মানুষ গত হলে তার প্রতাপ অন্তর্হিত হয়।

এমনসব শরিকি বাড়ি অদ্যাবধি বর্তমান। অযত্নে ক্ষয়াটে, পারিপাট্যহীন, ময়লা। তাদের জায়গায় শরিকি অ্যাপার্টমেন্ট ভাগাভাগি সংক্রান্ত প্রগতিশীল নির্মাণ বটে। দশ ভূতেই এই ইমারতগুলি ব্যবহার করে, কিন্তু প্রতি ইঞ্চি মেঝের দাম দিতে হয় বলে, খাজনা প্রদেয় বলে, দায় এড়াতে পারে না।

বহু কোচিং অ্যাপার্টমেন্টে গড়ে উঠছে আজকাল। প্রায় তপোবনে গুরুগৃহের মতো। শিষ্যকুল এত বেশি যে চেয়ারে, বেঞ্চে কুলোয় না। সাবেক বৈঠকখানার আধুনিক নাম হলো গিয়ে ড্রয়িংরুম। সেখানে সস্তার কার্পেট পাতা। না হোক, পলিয়েস্টারের অাঁশ দিয়ে তৈরি মাদুর, তার ওপর গায়ে গা লাগিয়ে ছাত্রছাত্রীরা। গুরুমহাশয়, অমুকদা কিংবা তমুকস্যার বসেন বেতের মোড়ায়। হাতের কাছে সাদা জাদুবোর্ড। প্রয়োজনে লিখে বোঝান।

রজতদার কোচিং তেমনই হতে পারত। এক-এক দল দুঘণ্টা। সেরকমই প্রত্যাশা ছিল সুহাস ও সুমালার। কিন্তু নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। একে বলে কোচিং!

সুমালার চেয়ে সুহাসের চমক লাগল বেশি। অজ্ঞাত আতঙ্কে তার বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠল। এই শিরশিরানি তার অতিপরিচিত। উদ্বেগ, আতঙ্ক তাকে এই অনুভূতিতে জড়িয়ে ফেলে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার আতঙ্কের কারণ কী? অপেক্ষার দীর্ঘ সারির একজন হয়ে, আপাত উদাসী মুখে সে কারণ অনুসন্ধানে আত্মমগ্ন হলো।

 

ভারি সুন্দর এই অট্টালিকা। ত্রিতল বটে। কিন্তু পরিসর বিশাল। বিশাল কাচের দরজা। তার হালকা বাদামি স্বচ্ছতার মধ্যে দিয়ে ভেতরের আয়োজন দেখতে পাওয়া যায়। একেবারে ঝকঝকে, অত্যাধুনিক কেতায় সুসজ্জিত দপ্তরখানা। সেখানেই ভর্তির কাজ চলছে। সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। একজন আবেদনপত্র এবং বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের নথি যাচাই করে নিচ্ছে। একজন টাকা জমা নিচ্ছে। অপর একজন নির্দিষ্ট বিভাগের পরিচয়পত্র দিচ্ছে। দোতলা ও তিনতলা জুড়ে পাঠকক্ষ। কোচিং সংক্রান্ত যে-পুস্তিকাটি একটু আগেই হতে পেয়েছে সুহাস, তাতে পাঠকক্ষের ছবি আছে। সেখানে দামি পর্দা ঝোলানো, মনোরম অন্দরসজ্জা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ। বিলাসবহুল। ছোটখাটো সভা করার পক্ষেও অনুপযুক্ত নয়। এত বৈভব! হবে না-ই বা কেন! সুহাস তার প্লাস্টিক ফোল্ডারে রাখা ড্রাফটি একবার দেখে নিল। পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। তিন মাসের জন্য। এরা যে পরীক্ষা নেবে, তাতে ভালো ফল করলে আরো একমাসের বিশেষ প্রশিক্ষণ। বিনামূল্যে। মুফ্ত মুফ্ত মুফ্ত। একটি বহুল প্রচারিত অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন সুহাসের মনে পড়ে গেল। ‘নবাব কিনলে আরাম ফ্রি!’

সে জানে, ওই এক মাসের ফাউ কোচিং সে পেয়ে যাবে। কিন্তু যার জন্য আজ এই দীর্ঘ সারিতে সে অপেক্ষমাণ, যার জন্য তার জেদ হয়ে ওঠে অদম্য আর বুকের মধ্যে শিরশিরিয়ে ওঠে… কেন? কেন? আত্মমগ্ন সুহাস এই সন্ধানই করে চলেছিল প্রতীক্ষার সারিতে দন্ডায়মান।

প্রতীক্ষা প্রতীক্ষা! প্রত্যাশা প্রত্যাশা!

তার লক্ষ্য সে ভারতের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কৃত্যক হয়ে উঠবে। আইএএস। সে মেধাবী। বুদ্ধিদীপ্ত। পরিশ্রমী। এবং সে বড় সুদর্শন। ভালো করে খেতে-পরতে পায়নি, তবু তার শরীর সযত্ন লালিত পুঁইডাঁটার মতো। বই কেনার পয়সা জোটেনি, শিক্ষকদের দান, বন্ধুদের সহৃদয়তা এবং পাঠাগারের সহায়তায় স্নাতক স্তর পর্যন্ত সে অতিউত্তম ফল করেছে। এবার সে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসতে চায়। করণিক নয়, মধ্যমমানের আধিকারিক নয়, সে হতে চায় উচ্চতম শিখরজয়ী, কিন্তু একটি বছর আপন মেধাবৃত্তির প্রতি আস্থা রেখে আইএএস প্রাথমিক পর্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তী পর্যায়ে সে অকৃতকার্য হয়। জীবনে এই প্রথম সে কোনো পরীক্ষায় ব্যর্থ হলো। কেন হলো? নিজেকে তার অচেনা লাগছিল। আপন পরাজিত অবয়ব থেকে সে পালাতে চাইছিল। ভেঙে তুবড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস তার – তাকে কোঁকড়ানো, দলা পাকানো ভীত জন্তুর মতো করে ফেলেছিল। সারাক্ষণ তার বুকের মধ্যে শিরশির করত। মনে হতো, লোকে তাকে দেখে হাসছে হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ!…২

সেই সময় ‘রজতদার কোচিং’য়ের বিজ্ঞাপনসমেত একটি খবরের কাগজ হাতে করে তার বাবা শ্রী সুভাষচন্দ্র বারিক তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছেলের গ্লানিময় অন্তরের কান্না, পরাজয়ের অপমান তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি চিরসংগ্রামী, দরিদ্র মানুষ। ইস্কুলের শেষ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই জীবন বোঝা হয়ে নেমেছিল। সেই ভার বইতে বইতে অবশেষে শহরে তিনি একজন ভাড়াটে মালি। চার চাকাওয়ালা মালবাহক রিকশায় কয়েকটি ফুলের টব চাপিয়ে ফিরি করেন। রেললাইনের ধার বরাবর জবরদখলি জমি এক চিলতে। গায়ে গায়ে লাগানো ছিন্নমূল মানুষের কুঁড়ে। তারই একটিতে শ্রী সুভাষচন্দ্র বারিকের মাথা গোঁজার ঠাঁই একখানি ঘর আর চার হাত আঙিনায় ফুলের টব। সুভাষচন্দ্রের হাতে গাছ হয় ভালো। ওই ফুল কি লঙ্কার গাছ বিক্রি ছাড়াও ফ্ল্যাটবাড়ির চিলতে ঝুলবারান্দায় শখের বাগানে মালিগিরি করেও তিনি কিছু উপার্জন করেন। চলে যায় কষ্টে-সৃষ্টে। চলে যাচ্ছে। দুঃখ এই যে, ঈশ্বর মেধাবী সন্তান দিয়েছেন, কিন্তু তার উপযুক্ত পালনপোষণের অধিকার দেননি! এত কষ্ট, এত বঞ্চনার মধ্যেও যে ছেলে নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করে চলেছে, সে যদি আর পাঁচজন সম্পন্ন বাড়ির         সন্তানের মতো সহায়তা পেত, সারা দেশের মধ্যে সেরা হতে পারত, এ নিয়ে সুভাষচন্দ্রের এতটুকু সন্দেহ নেই। তাই পুত্রের সেই ব্যর্থতার বেদনালিপ্ত, আশাভঙ্গের কালিমাবিজড়িত মুখ দেখে তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছিল। ভারি দুঃখের সঙ্গে তিনি সুহাসের মা লীনাদেবীকে বলেছিলেন, ‘কেন এমন হলো বলো তো? ও তো ফাঁকি দেয়নি! প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। তা হলে? ভগবান কেন আমাদের কৃপা করলেন না?’ লীনাদেবী ভক্তিমতী। তদুপরি, সংসারে সাহায্য হবে বলে তিনি বস্তির অদূরে হেনা অগ্রবাল নামে এক মহিলার শাড়ি কারখানায় জরি ও চুমকির নকশা বসানোর কাজ করেন। পাঁচ রকম মানুষের সঙ্গে কথা হয়। চোখ-কান খোলা। ছেলের হতাশায়  ভেঙে-পড়া ভাব আর বাপের হতবুদ্ধি দশা তাঁর পছন্দ হয়নি। তবে আগ বাড়িয়ে বেশি কথা বলার মানুষও তিনি নন। তাঁর জীবনের শিক্ষাই হলো, মেয়েমানুষ – তায় আবার নিতান্ত দরিদ্র, কেউ জানতে না চাইলে মতামত দেওয়ার অধিকার তাঁর নেই। ঘরে না। বাইরে না।

কিন্তু সেদিন শ্রী সুভাষচন্দ্রের জিজ্ঞাসায় লীনাদেবীর কথা বলার সুযোগ ঘটেছিল। তিনি শান্তভাবে বলেছিলেন, ‘দেখো, মানুষ কোনো বিদ্যার খানিকটা নিজে নিজেই শিখে নিতে পারে। দেখে দেখেই শেখা হয়ে যায়। কিন্তু সেই বিদ্যার বিশেষ দিক জানতে বুঝতে আলাদা সমঝদারি লাগে। দক্ষ লোকের সাহায্য লাগে, নইলে এগোনো যায় না।’

‘যেমন?’

‘আমার যখন সাত-আট বছর বয়স, তখন মা আয়ার কাজ করতে মনিববাড়ি যেত। আমি ভাত-রুটি করতাম। বাবাকে চা করে দিতাম। ওমনিই শিখে গিয়েছিলাম। কিন্তু একবার পৌষপার্বণে পিঠে বানাতে বসে কিচ্ছু পারলাম না। সব কেমন দলা পাকিয়ে গেল। মা তখন যত্ন করে শেখালো আমাকে। এই যে জরির কাজ, এ কি শুরুতেই পারতাম? হেম করা, বখেয়া, চেন ফোঁড়, কাঁথা সেলাই – এই বিদ্যে ছিল। সে তো মেয়েরা এমনিই শিখে নেয়। কিন্তু জরি-চুমকির কাজ, ফসফসে ফিনফিনে জর্জেটে শিফনে কেমন নিখুঁত করতে হয়, শিখতে হলো না কারিগরের কাছে? এই তোমার কথাই ধরো। একটা গাছের চারা কি বীজ পুঁতে দিলাম, গাছ হলো, ফল-ফুল ধরল, এতে তো মুন্শিয়ানা নেই। বিদ্যে হলো, ছোট ছোট টবে অমন ঝাপড়া গাছ করা। চার ইঞ্চি টবে বড় ডালিয়া, আট ইঞ্চি টবে গন্ধরাজ লেবু… পারবে যে কেউ? এই বিদ্যে তোমায় আয়ত্ত করতে হয়নি?’

‘তা হয়েছে। সে ছিল ওস্তাদ ইদ্রিসচাচা। একমুঠো মাটি পেলেই সোনা ফলিয়ে দিত। ছ-ইঞ্চি টবে লাউয়ের মাপে বেগুন ফলিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। মজিলপুরের কৃষিমেলায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার বাঁধা ছিল তার কাছে। ইদ্রিসচাচার বিদ্যে দিয়েই তো করে খাচ্ছি আজ।’

‘সেই কথাই তো বলছিলাম। দেখো, সুহাস আমাদের ভালো ছেলে। বুদ্ধি আছে। কোথাও ঠেকেনি। কিন্তু এইসব পরীক্ষা ভারি কঠিন। সারা দেশের সেরা ছেলেমেয়েরা সব পরীক্ষায় বসে। তার জন্য কিছু বিশেষ শিক্ষা লাগে না? তুমি জানো, গাছে সার দিতে হয়। কোন গাছে, কী সার, কতখানি লাগে তোমায় বুঝতে হয়নি? মালকিন ম্যাডাম বলছিল, আজকাল সবকিছুর জন্যই কোচিং লাগে। সরকারি চাকরি, ইস্কুলের চাকরি, ডাক্তারির ভর্তি – সবকিছু। তুমি দেখেশুনে সুহাসকে ভালো আইএএস পরীক্ষার কোচিংয়ে ভর্তি করে দাও।’

 

লীনাদেবীর বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন শ্রী সুভাষচন্দ্র বারিক! তিনি খোঁজখবর শুরু করেছিলেন। দেখেশুনে ‘রজতদার কোচিং’ তাঁর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছিল। বহুল প্রচারিত খবরের কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন নিয়ে তিনি সুহাসের কাছে এসেছিলেন।

একফালি ঘরে বাবা-মা-ছেলের বাস। প্রয়োজনীয় আড়াল-আবডাল রক্ষা করা দায়। টাইমকলে গা ভিজিয়ে স্নান সেরে ভিজে শাড়ি পরে মা ঘরে ফিরলে ছেলে বেরিয়ে একফালি আঙিনায় বাপের সৃজিত ফুলগাছগুলির কাছে দাঁড়ায়। এইসব তাকে আকর্ষণ করে না তেমন। সে ধরে নিয়েছিল জেলাশাসক হয়ে উঠবে অচিরেই। সুবিশাল সুসজ্জিত বাংলোয় ফুটে থাকবে অজস্র রঙিন ফুল। মালি ফোটাবে। ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আরামকেদারায় গা এলিয়ে মালিকে নির্দেশ দেবেন সুভাষচন্দ্র। ঠাকুরঘরে শ্বেতপাথরের সিংহাসনে মায়ের ঠাকুর। লাল পাড় মটকা শাড়ি পরে লীনাদেবী পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে সন্ধ্যা-সকাল পূজার্চনা করবেন, খানসামা নমস্কার করে জিজ্ঞেস করবে – মা, আজ কী রান্না হবে?… মূল ফটকের পাশে খুপরি ঘরে বন্দুকধারী আরক্ষাকর্মী সদাসতর্ক প্রহরায়।

হায়! ওই ফটক পর্যন্ত পৌঁছানো হলো না। হায় তার ব্যর্থ স্বপ্নরা! এই বস্তির ঘরে তারা তার গলা টিপে ধরে। টব ফিরি করা মালির ছেলে, শাড়িতে চুমকি বসানো মায়ের ছেলে, বখে যাওয়ার কত হাতছানি ছিল তার এই বস্তিতে, রেললাইনের পারে, অন্ধকারে। নেশা ছিল। মেয়ে ছিল। ডাকাতি, গুন্ডামি, চোরাকারবার ছিল। সে কোনো ফাঁদে পা দেয়নি।৩ সে উত্তম নিশ্চিন্তে থেকেছে অধমের দলে, উচ্চশ্রেণির কেরানি বা ইস্কুলমাস্টার হওয়ার জন্য নয়, নয়। আইএএস হওয়ার মহিমান্বিত স্বপ্ন তাকে সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে শিখিয়েছে। কিন্তু এ কী হলো! কেন সে পারল না!               এক-একবার তাঁর মনে হতে লাগল, সে যদি মেধাবী না হতো, স্বপ্নময় না হতো, বস্তির ছেলে, গরিবের সন্তান – বড়জোর স্থানীয় কোনো নেতার অনুচর হয়ে একটি পান-বিড়ির গুমটি দোকান বাগাত কিংবা বিদ্যুতের মিস্ত্রি হয়ে জীবনযাপন করত – সেই হতো তার পক্ষে মানানসই!

কিন্তু সুভাষচন্দ্র ও লীনাদেবী তাঁদের একমাত্র সন্তান, যে কিনা বিদ্বান, বুদ্ধিমান, তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ভবিষ্যতের অবলম্বন, তাকে ব্যর্থতার গ্লানি ও হতাশায় নিমজ্জমান দশা থেকে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। শুভবুদ্ধি বাবা-মায়ের এমনই দস্ত্তর।

শ্রীসুভাষচন্দ্র বললেন, ‘সুহাস, এটা দ্যাখ তো বাবা।’

‘কী?’

‘অনেক খোঁজ নিলাম। এটাই সবচেয়ে ভালো, বুঝলি।’

‘আমি জানি।’

‘তুই ভর্তি হয়ে যা।’

‘কোনো ধারণা আছে তোমার?’

‘কীসের?’

‘কত টাকা লাগে এখানে?’

‘কত লাগে?’

‘ওসব ছাড়ো বাবা। কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারলে তো আমি ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চেষ্টা করতাম। ওসব আমাদের জন্য নয়।’

‘কত টাকা লাগে, বল না।’

‘আমিও জানি না ঠিক। আমার এক বন্ধু মাসে সাত হাজার টাকা দিয়ে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সির কোচিং নিচ্ছে। ওদের অনেক টাকা।’

‘মাসে সা-ত হা-জা-র!’

বাবা-ছেলের কথালাপ এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু লীনাদেবী কেরোসিন স্টোভে ডাল রাঁধতে রাঁধতে নিচু স্বরে বললেন – ‘একবার ফোন করে খোঁজ নিতে ক্ষতি কী!’

 

সেদিনও বুকের মধ্যে শিরশির করে উঠেছিল সুহাসের। কেন, সে বোঝেনি। সেই মুহূর্তে কোনো আতঙ্ক ছিল না। স্কুলে যখন পড়ত, পরীক্ষার ফল বেরুনোর আগে, ভালো ফল সম্পর্কে নিশ্চয়তা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাসের অভাবজনিত অনিশ্চয়তার বিপুল উদ্বেগে ওই শিরশিরানির পীড়ন তাকে পেয়ে বসত। সে ভাবে, সম্ভবত এ তার অসুখ, তার অনুকম্পা-লালিত জীবনের, তার দারিদ্র্য ও অসহায়তা সম্বল জীবনের প্রদত্ত অসুখ। তার সহপাঠী বন্ধুরা কেউ তার দশায় ছিল না। কিন্তু সেজন্য কেউ তাকে অপমান অবহেলা করেনি সম্ভবত তার মেধার কারণে। কিন্তু আশেপাশে মানুষ যে স্বাচ্ছন্দ্য পায়, তার সিকিভাগও আপন জীবনে না থাকলে করুণ অপমান আপনি এসে লাগে। তার অভিঘাত অস্বীকার করার শক্তি সব মানুষের থাকে না। সেই বঞ্চনাকাতরতার বহিঃপ্রকাশ একেকজনের একেকরকম। যেমন সুহাসের শিরশিরানি।

সেদিন, লীনাদেবীর কথার ভেতর যে আশা জাগানোর লেশমাত্র ছিল, সুহাসের সাফল্যকাঙাল হৃদয় তাকেই অবলম্বন করতে চেয়েছিল বলেই সে উদ্বেজিত হয়েছিল। সেই শিরশিরানি-সমেত সে খোঁজখবর নিতে শুরু করে এবং তিন মাসের প্রশিক্ষামূল্য পঁয়ষট্টি হাজার টাকা শুনেও, বিস্ময়করভাবে সে হতোদ্যম হয়নি। তাদের একফালি ঘরে কোনো কথাই কারো কাছে গোপন থাকে না, একজন ক্ষুধার্ত হলে অপর দুজনের কানে তার উদরের আর্তরব পৌঁছোয়, এমতাবস্থায় বাপ-মায়ের রোজগার সম্পর্কে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ধারণা থাকা সত্ত্বেও সুহাস, এই বিশ্বাস অাঁকড়াতে চাইছিল যে, লীনাদেবী যখন খোঁজ নিতে বলছেন তখন কোনো ব্যবস্থা করা সম্ভব বলেই বলেছেন। মায়ের টাকা না থাক, তাঁর মালকিন হেনা অগ্রবালের অনেক টাকা। সেখান থেকে কি কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না? চাহিদা মানুষকে সমস্ত রকম জোগানের সম্ভাব্যতার প্রতি প্রলুব্ধ করে।

 

‘এইখানে পড়লে চাকরি হবেই, না?’ সরলভাবে প্রশ্ন করলেন সুভাষচন্দ্র।

সুহাস বলেছিল, ‘আইএএস পাব বলো। এটা আইএএসের পড়ানো। কেরানির চাকরি তো আমি পরীক্ষা দিলেই পাব।’

‘অতই সোজা না-ও হতে পারে রে বাবা।’ লীনাদেবী অল্প হেসে বলেছিলেন, ‘বিএ-এমএ পাশ, সব ফার্স্ট ক্লাস, অথচ চাকরির পরীক্ষায় বসে বসে হদ্দ হয়ে গেল। আকছাড় হচ্ছে।’

‘সে যাদের হয় তাদের। এত তো ডাক্তার প্রতি বছর পাশ করে বেরোয়, সবার কি সমান পসার জমে? মা, আমি কিন্তু নিজে পড়েই এতকাল পাশ করেছি। নিজে পড়েই এবারের আইএএসে প্রাথমিক বিভাগ পাশ করেছিলাম, তুমিই বললে, বিশেষ পরীক্ষার জন্য বিশেষ তরবেতর দক্ষতা আয়ত্ত করতে হয়।’

‘তা তো বটেই। বলেছিই তো। তবে আরো একটা কথা            বলি বাবা, সবচেয়ে ভালো চাকরিটা পাওয়ার আগে ছোট-বড়            যে-কাজই পাস, নিয়ে নিলে সংসারের সুরাহা হয়। তোরও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। তোর বয়স তো কিছুই হয়নি। একটা জোর থাকলে মন শান্তি করে আইএএসের তোড়জোড় করতে পারবি। যদি পেয়ে যাস, পুরনো চাকরি ছেড়ে দিলি, আর না পেলেও অমন জলে ডোবা দশা হবে না।’

সুহাসের মুখে হতমান দশার কালিমা ছেয়ে গিয়েছিল। সে জানে, তার মা প্রয়োজনাতিরিক্ত কথা বলার মানুষ নন। তবু যে আজ পঁয়ষট্টি হাজার টাকার সংস্থান কীভাবে হয় তার আলোচনায় বসে, এক বস্তিবাসী পরিবারের নগণ্যতম ব্যক্তিটি পর্যন্ত সরব, এই           বাস্তবতা সুহাসের প্রতি চরম অনাস্থা বলেই তার মনে হয়েছিল। একটু পরপর তাদের ঘর কাঁপিয়ে চলে যাচ্ছিল ট্রেন। সেই কাঁপন সুহাসের নিজের মনেও লাগছিল। সে কি এত কষ্ট করেছে কেবল মধ্যমমানের সরকারি কর্মী হবে বলে? কোনোক্রমে মাথা গুঁজে থাকবে, বাসে-ট্রামের ভিড়ে ঘেমো গায়ে গা সেঁকতে সেঁকতে আপিস যাবে, ব্রিটিশ আমলে তৈরি প্রাচীন চেয়ার-টেবিলে বসে, ধুলো          আস্তরণ পড়া বিবর্ণ কাগজপত্র ঘাঁটবে আর যৌবনেই আধবুড়ো খিটখিটে ঘুষখোর হয়ে গিয়ে লুকনো রুটি আর ঢেঁড়সভাজা দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করতে করতে ভাববে, মালির ছেলের পক্ষে এই ঢের?

না। অসম্ভব। তাহলে এই মেধার প্রয়োজন ছিল না। তিন চাকার ভ্যান-রিকশায় ফুলের টব বিক্রি করাই তার উপযুক্ত পেশা হতে পারত। শৈশব থেকে এ-পর্যন্ত, এই পরিবেশে, এই দারিদ্রে্য, এই স্বল্পশিক্ষিত পিতামাতার তত্ত্বাবধানে, নিজের ব্যতিক্রমী মেধা এবং পারঙ্গমতা সম্পর্কে যে আত্মগরিমা তার মনে বিপুলাকার এবং অক্ষত ছিল, সরকারি সর্বোচ্চ কৃত্যক পরীক্ষার ব্যর্থতায় তাতে আঘাত লেগেছিল বড়রকম, যেন বা প্রাচীন পাথরের গায়ে আকস্মিক ফাটল এবং মা লীনাদেবী, সেই ফাটল ধরা যে অসম্ভব নয়, শক্তিমানের পক্ষেও ভেঙে শতখান হওয়া যে স্বাভাবিকতা, এই কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে সুহাসের অহঙ্কারকে অবমানিত করলেন। সুহাসের তা সহ্য হয়নি, সে চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল, এমনকি তার ক্ষমতাদৃপ্ত পৌরুষে আঘাত লেগেছিল প্রাচীন কুসংস্কারাচ্ছন্নতায়, যা গোপন থাকে মানবের মনের তলাকার অন্ধকারে, এই বলে যে, লীনাদেবী একজন মেয়েমানুষ, মা তো কী, একজন মেয়েমানুষ, সংসারে যার মত দেওয়ার সর্বনিম্ন অধিকার, তিনি পর্যন্ত সুহাসের জীবনের প্রথম ব্যর্থতাকে লাঞ্ছনা করার সাহস পেয়ে যাচ্ছেন।

সে চোখ লাল করে বলেছিল, ‘আমি কী করব, সেটা আমাকেই ভাবতে দেওয়া উচিত ছিল মা। আমি তো কোনো দিন কিছু চাইনি। কোচিংয়ের খরচ খোঁজ নিতে তোমরাই আমাকে বলেছ! সংসারে টাকা চাই তো? সেটা সরাসরি বললেই হয়।’

‘তুই শুধু শুধু রাগ করছিস। সংসারে টাকার জন্য বলিনি। বলেছি তোরই জন্য। হাতের পাঁচ বলে একটা কথা আছে সুহাস। আমাদের জীবন তো কেটেই গেল, এবার যা চিন্তা, সবই তোর জন্য।’

‘তুমি থামো তো।’ ধমকে উঠেছিলেন শ্রী সুভাষচন্দ্র। বলেছিলেন, ‘যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলো না। এসব বড় পরীক্ষার পড়া হলো সারাদিনের কাজ। চাকরিতে একবার ঢুকে গেলে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে ও? এতদিন ও যা করেছে একলা করেছে। এখন আমাদের উচিত ওর স্বপ্ন সফল করার জন্য ওর পাশে আমাদের সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়ানো। ওই যে শরাফজি, কোটিপতি লোক, বিরাট ছাতে ফুটবল খেলা যায়। আমি গাছ করি বলে, শরাফজির ছেলে নির্মল আমাকে ডাকে গার্ডনার আঙ্কেল।           ও-ও এইরকম পরীক্ষা দিয়েছিল। বিদেশে কাজ পাবে। হয়ে গেছে। ও-ই তো আমাকে এই কোচিংয়ের কথা জোর দিয়ে বলল। বলল, গার্ডনার আঙ্কেল, আপনার ছেলে আইএএস দেবে! তাজ্জব কি বাত! কেউ বিশ্বাস করে না। করবে কেন? অনেক বড় ঘরেও সুহাসের মতো ছেলে জন্মায় না। তবু তো নির্মল বিশ্বাস করেছে।’

সুভাষচন্দ্র আরো কিছু বলতেন। শরাফদের বৈভবের গল্প করতে তিনি পছন্দ করেন, সুহাস জানে। তবে নির্মল শরাফ ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক কৃত্যক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েছে, তা জানত না। তার গর্ব আরো স্ফীত হলো। আইএএস হয়ে গেলে তার বস্তিজন্ম নিয়ে উপকথা রচিত হবে। সে অসহিষ্ণুভাবে বলেছিল, ‘ঠিক কী বলতে চাইছ তুমি বাবা!’

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘তোর মাকে বোঝাতে চাইছি। নির্মল বলেছিল, আইএএস, আইপিএস হওয়া সবচেয়ে কঠিন। সে সারাদিন পড়ত। তিন জায়গায় কোচিং নিয়েছিল। তবু তৃতীয়বারের চেষ্টায় সফল হয়। ওকে এখনই চাকরির কথা বলো না।’

লীনাদেবী তাঁর নিত্যব্যবহার্য বিবর্ণ ঝুলি থেকে একটি চাবির গোছা নিয়েছিলেন। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন চৌকির তলায়। টেনে-হিঁচড়ে বার করে এনেছিলেন একটি টিনের তোরঙ্গ। ফুল অাঁকা। মাঝে মাঝে জং পড়ে রং খসে গেছে। তোরঙ্গের তালাটিও মরচে পড়ে কমলরঙা হয়ে উঠেছে। কী আছে ওই তোরঙ্গে? গরিবের ঘরের কোনো সম্পদ?

সুহাস যখন ছোট ছিল, তোরঙ্গ খুলে দেখার জন্য বায়না করত। লীনাদেবী বলতেন, ‘দেখবি, বড় হলে দেখবি। সবই তো তোর।’

তারই বস্ত্ত যখন, কেন তাকে বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে একটুখানি অবলোকন করার জন্য, শিশু সুহাস তা বুঝতে পারত না। কিন্তু বায়না নিয়ে পড়ে থাকতে শৈশবাবস্থাতেও সে পছন্দ করেনি। একসময় টিনের তোরঙ্গ সম্পর্কে তার সব আকর্ষণ চলে যায়। বস্ত্তত সে ভুলেই গিয়েছিল এইরকম একটা কিছু তাদের আছে। সেইদিন, বহু বর্ষ পর, মাকে তোরঙ্গখানি বার করতে দেখে সে কৌতূহল বোধ করতে লাগল।

সুভাষচন্দ্র বললেন, ‘ওটা আবার খুলছ কেন?’ তাঁর স্বর সামান্য কম্পিত, প্রশ্রয়ে গদগদ বটে। তিনি জানেন, ওই তোরঙ্গ স্বপ্ন সম্ভব করলেও করতে পারে।

লীনাদেবী স্বামীর কথার জবাব দিলেন না। চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে, কিছু কাপড়-চোপড়, কাঁসার কটি বাসন হাতড়ে, কোন কোনা থেকে বার করে আনলেন ছ-ইঞ্চি আন্দাজ লম্বা, ইঞ্চি চারেক প্রস্থ ও গভীরতার পেতলের বাক্স। একসময় হয়তো বা এটি ছিল পানের বাটা। এখন কী আছে এতে?

একটি শালু কাপাড়ের পুঁটলি। লালশালু। কালের মলিনতায় টকটকে ঔজ্জ্বল্য কালচে আবরণে প্রলিপ্ত। লীনাদেবী তার ভাঁজ খুলছেন। অতি সাবধানে। পরম মমতায় এক ভাঁজ, দু-ভাঁজ…! সুভাষচন্দ্র বলছেন, ‘এসব আবার বার করছ কেন? ওইটুকুই তো সম্বল।’ বলছেন, কিন্তু দৃষ্টি ফেরাচ্ছেন না। সুহাসও দেখছিল           শান্তভাবে। সহসা, সকল মলিনতা, সমস্ত গরিবি নস্যাৎ করে, চুরি করা বিদ্যুতের আলোয় জ্বলা একটিমাত্র টিউববাতির বিকিরণে ঝিকমিক করে উঠেছিল একজোড়া সোনার বাউটি। হিরের কুচি বসানো। আসল হিরের কুচি বসানো, আসল সোনার বাউটি।

মেয়েদের কোন অলঙ্কারের কী নাম, জানত না সুহাস। আজো জানে না। জানে কেবল গলার হার, হাতের চুড়ি, বালা, কানের দুল। আর জানে বাউটি। যা দেখে সেদিন তার মনে হয়েছিল, খুব ছোটবেলায় পড়া, ‘রাজার ঘরে যে-ধন আছে, টুনির ঘরেও সে-ধন আছে।’

কত ঝড়-ঝাপটা, কত কষ্ট ও দারিদ্রে্যও মা ওই অলঙ্কার হাতছাড়া করেননি। আজ, পঁয়ষট্টি হাজার টাকার ড্রাফট নিয়ে, নিশ্চিত স্বপ্নপূরণের আশায় মেধাবী উচ্চাকাঙ্ক্ষী সুহাস ‘রজতদার কোচিং’য়ে ভর্তি হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণের সারিতে যে দাঁড়িয়ে আছে, তা ওই একজোড়া বাউটির আশীর্বাদে। তার মায়ের আশীর্বাদে।

সুহাস, প্লাস্টিক আবরণের ওপর দিয়ে ড্রাফটে হাত বুলিয়ে দিলো। আত্মপ্রতিষ্ঠার পর তার প্রথম কাজ ওই বাউটি উদ্ধার করা।

সেদিন, সুভাষচন্দ্রের প্রশ্নের উত্তরে লীনাদেবী বলেছিলেন, ‘আমাদের সম্বল আমাদের ছেলে। এ তো ওরই জিনিস। ওর বউকে দিয়ে মুখ দেখতাম।’

সুভাষচন্দ্র কম্পিত স্বরে বলেছিলেন, ‘ক-কত হ-হবে এর            বা-বাজারদর?’

‘এ অমূল্য। অ্যান্টিক যে! আমাদের বাড়িতে নাকি সাত পুরুষ ধরে আছে। বেচলে লাখখানেক তো হবেই।’

হেনা অগ্রবালের কারখানায় ‘অ্যান্টিক’ বস্ত্তর সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন লীনা। ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বস্ত্তগুলি অমূল্য। কিন্তু মানুষ অমূল্যের মূল্যও বাণিজ্যিক পরিমাপে বাঁধে। সেই অঙ্ক সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান লীনাদেবীর ছিল না। তাঁর কাছে এক লাখ টাকা স্পর্শাতীত সম্পদ।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ‘একেবারে বেচে দেবে?’

সুহাসের বুকের মধ্যে প্রবল শিরশির করছিল। আনন্দে উত্তেজনায় বিহবল হয়ে গিয়েছিল সে। এমন দামি জিনিস তাদের ঘরে আছে! এমন চটজলদি সমাধান! কতকাল ধরে কত যত্নে আগলে রেখেছেন মা! তার ইচ্ছে করছিল মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। কিন্তু সে বড় আবেগ-প্রকাশী নয়।

লীনাদেবী বাউটিজোড়া হেনা অগ্রবালের কাছে বাঁধা রেখে সত্তর হাজার টাকা নিয়েছেন। এ-গহনা যে লীনারই সে নিয়ে হেনার কোনো সন্দেহ ছিল না। এত সংগ্রামের মধ্যেও লীনার সৌন্দর্য এবং সদাচার তাঁদের উচ্চবংশমর্যাদা সম্পর্কে ধারণা দেয়। সুহাস পেয়েছে মায়ের ধারা। তার উচ্চতা, গড়ন, মুখশ্রী, মেধা ও সৌভদ্র আচরণ তাকে যে-বৈশিষ্ট্য দিয়েছে, যে লালিত্য ও সৌষ্ঠব, যে আকর্ষণী ক্ষমতা – তার সবটাই মাতুলবংশসূত্রে। আজ যে সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার দুটি মাত্র ভালো পরিধেয়র একখানি, এই নীল শার্ট, হালকা নীল জিন্স, হাতে হালফ্যাশানের প্লাস্টিক খাম, যাকে বলে ফোল্ডার, সব মিলিয়ে, আরো যারা অপেক্ষারত, সে বাজি ধরতে পারে, তাদের মধ্যে একজনও তার মতো পরিস্থিতির নয়, তবু, এই উচ্চ বা মধ্যবিত্তের দঙ্গলে, শরাফজির মতো ধনী মানুষের ছেলেমেয়ের দঙ্গলে, সে, সুহাস বারিক, সে জানে, তাকে এতটুকু বেমানান লাগছে না।

তার মাতুলবংশ ছিন্নমূল উদ্ধাস্ত্ত ছিল। সর্বহারা ছিল। রাতারাতি ঐতিহ্য ও মর্যাদার শিখর থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল ধূলিধূসর মানহীনতায়।

কিন্তু সর্বহারারও রক্ষা করার মতো কিছু থাকতে পারে। জিনের মধ্যে প্রোটিন তন্তুর ভাঁজে ভাঁজে পরতে পরতে ধরা থাকে আহরিত রূপ, রুচি, সততা, মেধা ও আত্মমর্যাদাবোধ।

লীনাদেবী কখনো আত্মমর্যাদাবোধ থেকে ভ্রষ্ট হননি। প্রয়োজনে হেনা অগ্রবালের কাছ থেকে টাকা ধার করেছেন, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে পরিশোধও করেছেন। হেনা দেবী বন্ধকি কারবার করেন না। বাউটিজোড়া হাতে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এ-জিনিস বিক্রি কোরো না। টাকা যা লাগে নাও। পরে সুবিধে মতো ছাড়িয়ে নিও।’

দেওয়া-নেওয়া সংক্রান্ত কোনো নথি নেই। সাক্ষী, সই-সাবুদ কিছুই নেই। শুধু বিশ্বাস। দুই নারী পরস্পরকে চেনেন। একজন ব্যবসায়ী, খাটিয়ে নেন, ন্যূনতম মজুরিতে সমধিক কাজ আদায় করে লাভের কারবার করেন। কিন্তু ঠগবাজ তাঁকে বলা চলে না। কর্মচারীদের বিপদে-আপদে তিনি পাশে থাকেন। অপরজন সেই কর্মচারীদের একজন। মালকিনের বিরুদ্ধে অন্য সবার মতো তাঁরও অভিযোগ কম নয়। বেতন, বোনাস, বাড়তি শ্রমের মজুরি নিয়ে সদা অসন্তোষ। তবু তাঁকেই অবলম্বন করে বাঁচতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন লীনাদেবী। বাউটিজোড়া রেখে, বিনিময়ে ন্যায্যমূল্য পাবার আশায়, গহনার দোকানে না গিয়ে ওই হেনা অগ্রবালের কাছেই গিয়েছিলেন।

মায়ের মালকিন, ওই হেনা অগ্রবালের কাছে কি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তার? সুহাস ভাবছিল। বাউটিজোড়া কোথাও বাঁধা দিলে প্রদত্ত ঋণের জন্য চড়া সুদ হাঁকত, আর বেচলে, অমন সাতপুরুষের অ্যান্টিক চিরকালের জন্য হাতছাড়া হয়ে যেত! তার মনে পড়ল, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক থেকে একেবারে মাস্টার পর্যন্ত প্রতিটি পরীক্ষায় সে যখন ভালো ভালো ফল করত, হেনা অগ্রবাল সেই খবর শুনে এক বাক্স মিষ্টি পাঠাতেন, সঙ্গে কিছু টাকা। সুহাস কখনো তাঁকে দেখেনি। অথচ তার জীবনের সঙ্গে ওই দূরবর্তিনী কীরকম জড়িয়ে আছেন! তার মনে হতে লাগল, কবেকার কোন পূর্বনারীরা, যাঁরা ওই বাউটিজোড়া ব্যবহার করতেন, যাদের বিবিধ বিচিত্র বৈশিষ্ট্য বংশধারা অনুযায়ী সঞ্চারিত হয়ে গেছে তার মধ্যে, তাঁদের সঙ্গে, হেনা অগ্রবালের সঙ্গে, এই ঝাঁ-চকচকে কলেজের মতো সুসংগঠিত ‘রজতদার কোচিং’য়ের সঙ্গে অদৃশ্য গ্রন্থিতে যুক্ত তার জীবন, এখানে তার কিছু করার নেই!

ভাবতে ভাবতেই পিছনপানে তাকাল সে। দেখল মেয়েটিকে। কখন থেকে আছে, খেয়াল করেনি। ধীরে ধীরে সারির সামনের দিকে এসে দাঁড়িয়েছে সে এখন। মেয়েটির চোখে তার চোখ পড়ল। মেয়েটি হাসল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘হাই, আমি সুমালা।’ তার হাতে মুঠোভাস যন্ত্রখানি। সুহাস কীভাবে করমর্দন করে? সে নিজের ফোল্ডার সামলে সুমালার মুঠোফোনসহ হাতখানিতে অল্প চাপ দিয়ে বলল, ‘আমি সুহাস। কোন কোর্স?’ সুমালা বলল, ‘আই অ্যাস।’

‘আই অ্যাস!’ আধ সেকেন্ড সময় লাগল বুঝতে। তারপর         হো-হো করে হেসে উঠল সে। শেষ কবে এমন হেসেছে, মনে করতে পারল না। হাসি, মজা, ক্ষ্যাপামির মধ্যে দিয়ে জীবনকে দেখার অবকাশই মেলেনি তার। রেললাইনের ধারে ওই বস্তির, ঘরখানি সে সারাক্ষণ বয়ে বেড়ায়। এই মুহূর্তের হেসে ওঠার মধ্যে তার প্রাণ যে নিরাময় পেল, তার স্বাদ বুঝি আগে সে আর পায়নি। সে, না জেনে, না বুঝে, মেয়েটি সুন্দর না অসুন্দর, অমল না অহঙ্কারী, একাকিনী না প্রেমিকা – কিছুই ভাবার অবকাশ পর্যন্ত না নিয়ে তাকে আপন হৃদয়ে চিরকালের মতো স্থাপন করে বসল। সুহাস জীবনে প্রথম প্রেমে পড়ল।

মেয়েটি জানল না। জানল না কিছুই। সুহাসের খোলা হাসির দিকে মুগ্ধ চেয়ে থেকে হাসতে হাসতেই বলল, ‘নয়? বলো? গাধা না হলে, বিশ্বে এত কিছু থাকতে কেউ আইএএস হতে চায়?’

 

দুই

তিন মাসের পাঠক্রমের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে শিক্ষকদের নজর কেড়ে নিয়েছিল সুহাস। প্রতিটি পরীক্ষায় সে সেরা ফল করল। কিন্তু সে ভারি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিল। কারণ বিজ্ঞাপনে সব কথা বলা থাকে না। তথ্য সরবরাহ করার জন্য যে মেয়েটি সুমধুর ভঙ্গিমায় বিবিধ পাঠক্রমের ব্যাখ্যা করে, তার পরিবেশনায়ও আপাত সম্পূর্ণতার কৃত্রিম আশ্বাস থাকে। হ্যাঁ, এই কোর্স করলেই আপনি যে উদ্দেশ্যে এসেছেন, তা সফল হবে। আমরা আপনাকে পঞ্চাশ শতাংশ তৈরি করে দেব। বাকি আপনার পরিশ্রম ও ভাগ্য। তবে এই একটা পাঠক্রমের মধ্যে দিয়ে আপনি যে-কোনো প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরি হয়ে যাবেন।

আসলে, বিজ্ঞাপনে যা বলা হয় না, এমনকি সহজে প্রচারও করা হয় না যা, সে হলো, আইএএসের বিশেষ কোচিং। পঁয়ষট্টি হাজার টাকায় যা খরিদ করা হলো তা একরকম সার্বিক প্রস্ত্ততি। যথেষ্ট কঠিন, আয়াসসাধ্য এবং মেধানির্ভর। একে তো স্নাতক স্তরে যথেষ্ট ভালো ফল না হলে এই কোচিংয়ে ভর্তি হওয়াই যায় না, তদুপরি, এখানকার কড়া ব্যবস্থা এবং কঠিন প্রশিক্ষণ শেষে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নানাবিধ চাকরি পেয়ে যায় বহুজন। আইএএস হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আসে, মধ্যম মানের আধিকারিক পদ লাভ করে। সেই বা কী কম! এই চূড়ান্ত বেকারত্বের দেশে, কর্মসংস্থান অপ্রতুল, সেখানে মান্যগণ্য সরকারি চাকরি পাওয়া রীতিমতো সাফল্যগর্বী করে তোলে কোচিংয়ের প্রশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের। খবরের কাগজে ফলাও করে তাদের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কোনো অজ্ঞাত কারণে সফল আইএএস পরীক্ষার্থী বা তৎসমতুল্যদের ছবিসহ নাম ছাপা হয় না। সুহাস সেই অজ্ঞাত কারণসম্পন্ন দলভুক্ত হতে চায়। কিন্তু তার জন্য পাঁচ লাখ টাকা দরকার। এর মাধ্যমেই নিশ্চিতভাবে খরিদ করা যাবে ভারতীয় প্রশাসনিক কৃত্যকের নিশ্চিত প্রশিক্ষণ! লিখিত পরীক্ষায় একশ শতাংশ সাফল্য। কিন্তু এই দক্ষিণার কোনো রসিদ মিলবে না। ছ-মাস ক্লাস চলবে। এর মধ্যে কেউ যদি ছেড়ে যেতে চায়, তাকে দশ শতাংশ অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। অবশ্য, সেক্ষেত্রে তিন মাস পার হয়ে গেলে সে প্রশ্ন উঠবে না।

তাহলে সুহাসের কী লাভ হলো?

কোচিং কেন্দ্রের সমীপবর্তী একটি কফিবিপণিতে বসে ছিল সুহাস ও সুমালা। সুহাস গম্ভীর ম্লান, স্পষ্টতই হতাশ। সুমালা বিব্রত। সে বলল, ‘এত ভেঙে পড়ছ কেন? তোমার তো আত্মবিশ্বাস আছে সুহাস। এতদিন নিজের জোরেই তুমি যা কিছু করেছ। আমাদের মধ্যে সেরা ফল করেছ তুমি। এবার তুমি পাবেই।’

সুহাস ও সুমালার প্রথম দিনের আলাপ বন্ধুত্বের যে নিবিড় স্তরে পৌঁছেছে, তাকে প্রেম বলা চলে অনায়াসে। তারা এই প্রেম গোপন করেনি, অস্বীকারও করেনি। এ এক আশ্চর্য সম্পর্ক। চার মাস আগেও কেউ কাউকে দেখেনি পর্যন্ত। আজ, কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। একজনের বিষাদ আরেকজনের চোখে জল ঘনিয়ে তোলে। বাকি জীবনে, বিচ্ছেদের তিলমাত্র সম্ভাবনা এলে মনে হয় এ-জীবনের আর কোনো মানে রইল না।

কদিন আগে সুমালার জন্য বিবাহের প্রস্তাব এসেছিল। প্রতিষ্ঠিত উদার পাত্র, প্রগতিশীল পরিবার। সুমালা যে আত্মপ্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, তাতে তাঁদের কিছুমাত্র আপত্তি ছিল না। তাঁরা শুধু ‘বধূ’ খুঁজছিলেন না, পুত্রের পক্ষে উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী সন্ধান করছিলেন। এমন সম্বন্ধ সচরাচর জোটে না। সুমালার বাবা-মা এই বিবাহে অত্যুৎসাহী হয়ে উঠলেন। তার ছোটবোন শর্মিলা পর্যন্ত চোখেমুখে খুশি মেখে বলল, ‘দিদি, রাজি হয়ে যা। শুভব্রতদার সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা মেরেছি। আমার দারুণ ভালো লেগেছে। জানিস, ও নিজে গান লেখে, সুর দেয়। খুব ভালো গলা।’

শুভব্রত নামে সেই প্রস্তাবিত পাত্র একটি হীরকখন্ড, সে-বিষয়ে সুমালার দ্বিমত ছিল না। সেই পাত্র যদি অসুন্দর হতো, নির্গুণ হতো, তার ভদ্রতাবোধ সম্পর্কে একটু সন্দিহান হওয়া যেত যদি, সুমালার পক্ষে প্রত্যাখ্যানের যুক্তি সাজানো সহজ হতো। শর্মিলা তার ছোটবোন, বয়স মাত্র এগারো, বোনকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সে; কিন্তু বোনের উচ্ছ্বাসে, আগ্রহে সে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়েছিল। সে জানে, এই ক্রোধ আসলে তার অসহায়তা। সে সুহাসকে ভালোবেসে ফেলেছে। সুহাস তার প্রথম প্রেম, প্রথম মুগ্ধতা, প্রথম পুরুষ – যাকে দেখলে তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে, সে স্বেদাপ্লুত হয়, যার হাত ধরলে তার শরীর-মন অপূর্ব পুলকে শিহরিত হতে থাকে। এই কথা সে কাউকে বলেনি। দশ বছরের ছোট, প্রাণপ্রিয় বোনটিকেও বলেনি। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হয় না যে নিজেকে প্রকাশ করবে। সবচেয়ে বড় কথা, সে আর সুহাস, পরস্পরকে অতলপরশ প্রেমে জড়িয়েছে, কিন্তু সে নিয়ে একটিও কথা বিনিময় তারা করেনি। মন মানুষের সর্বস্ব। কিন্তু মনের অনুভবকে কথার উচ্চারণের আনুষ্ঠানিকতায় না বাঁধা পর্যন্ত সামাজিক মানুষের স্বস্তি হয় না। বিশ্বাস পূর্ণ হয় না। সুমালার সেই দশা তখন। সেই অসহায়তা। সে কী করে! কী বলে! সুহাসকে তখনো পুরো জানেনি।৪ সে দারুণ রাগে বোনকে বলেছিল, ‘এক চড় মারব!’

বিস্ময়ে চেয়েছিল শর্মিলা। কী ভুল করল সে! দিদিকে এতখানি অসহিষ্ণু হতে সে কখনো দেখেনি। সুমালাও এই রুক্ষতায় আপনাতে আপনি আহত হয়েছিল। এ কী নিষ্ঠুরতা তার! বোন অন্যায় কিছু বলেনি। অসহায়তাবোধ ও অনিশ্চয়তায় ছিন্নভিন্ন হতে হতে সে হঠাৎ কেঁদে ফেলেছিল।

যে-মেয়ে আইএএস হওয়ার কঠিন আরোহণ পর্ব সম্পূর্ণ অভিনিবেশে আয়ত্ত করার প্রয়াসী, সে নির্বুদ্ধি নয়, কান্ডজ্ঞানহীন নয়, ছিঁচকাঁদুনিও নয়। বরং তার সরসতা ও ব্যক্তিত্বের মাধুর্য এই পরিবারের দীপশিখার মতো। আর এগারো বছরের শর্মিলাও যথেষ্ট পরিণত এবং মেধাবিনী। দিদির এই অসহিষ্ণুতা, এই কাঁদনবিজড়িত বিস্ফোরণ যে তার বিচলিতচিত্তের বহিঃপ্রকাশ, তা অনুভব করে সে বলেছিল, ‘দিদি, তুই কি প্রেম করছিস?’

সুমালা ধমকে ছিল, ‘পাকামি করিস না।’

‘সেদিনই তুই আমাকে বলেছিলি আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। পাকামিতে আমার অধিকার জন্মায়। দিদি, বাবা-মাকে সব বলে দিচ্ছিস না কেন? লুকোচ্ছিস কেন? তুই তো বলিস, মনে অপরাধবোধ থাকলে তবেই মানুষ সবচেয়ে কাছের লোককে মিথ্যে বলে।’

‘আমি কোনো মিথ্যে বলেছি কি?’

‘লুকোচ্ছিস।’

‘লুকোনো আর মিথ্যে বলা সম্পূর্ণ আলাদা মিলা। খুব কাছের জনের মনে যাতে আঘাত না লাগে, তার জন্যও অনেক সময় অনেক কিছু গোপন করতে হয়, মিথ্যে বলতে হয়। আসলে পৃথিবীতে কোনো কাজেরই সরল ব্যাখ্যা হয় না। এটার জন্য ওটা বা ওটার জন্য এটা নয়।’

‘আমি অতশত বুঝি না। আমার কথা হলো, যেটা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছে না, আমাকে কষ্টে রাখছে, সেটা আগে সমাধান করো। যে অঙ্কগুলো আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না সেগুলোই আগে হরেনস্যারকে দেখাই। আর আমি তোকে বলছি দিদি, হরেনস্যার ইংলিশে ভালো, ফিজিক্সে ভালো, ভূগোল ইতিহাস – সবকিছুতে ঝক্কাস, কিন্তু অঙ্কে? এই আমি তোকে বলে রাখলাম দিদি, ওই বুড়োর কাছে আর এক বছর অঙ্ক করলে আমি চিরকালের মতো অঙ্কান্ধ হয়ে যাব।’

‘অঙ্কান্ধ?’

‘জন্মান্ধর অনুপ্রাস।’

সুমালা হেসে ফেলেছিল। নরম চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘একজনের কাছে অঙ্ক করবি? একদম তৈরি করে দেবে।’

‘কে রে?’

‘আছে একজন।’

‘যার জন্য শুভদা একশয় একশ পেয়েও ফক্কা?’

‘আবার ওস্তাদি করছিস?’

‘হরেনকে হটানো যাবে না। তোকে কীরকম চৌকস বানিয়েছেন উনি বল। অঙ্কে পঁয়তাল্লিশ পেয়ে পেয়েই আমাকে সারাজীবন কাটাতে হবে।’

মুখখানা ছদ্মকরুণ করে কান্নার ভান করছিল শর্মিলা। সুমালা বলেছিল, ‘সুহাসের ব্যাপারে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলব।’

‘তো তার নাম সুহাস?’

‘হু।’

‘ঠিক আছে। আমি রাজি। দেখতে ভালো?’

‘হুঁ।’

‘স্মার্ট?’

‘হু।’

‘তোর জন্য জান দিতে পারে?’

‘জানি না।’

‘কথা হয়নি?

‘ফাজিল কোথাকার! কী বলব আমি? তুমি আমাকে ভালোবাসো? আমার জন্য প্রাণ দিতে পারো?… ওসব ফিল্মে হয়।’

‘মানে এখনো কোনো কথাই হয়নি তোদের?’

‘মিলা…।’

‘কী হলো? পাকামি করছি, এটাই বলবি তো?’

‘তুই এত পরিণত হয়ে গেলি কবে?’

‘দুনিয়া দ্রুত এগোচ্ছে দিদি। আমি তোর পরের প্রজন্ম। আমাদের ক্লাসে অনেক বন্ধু রীতিমতো প্রেম করে। দিদি, যার জন্য শুভদার মতো ছেলেকে তুই ফিরিয়ে দিচ্ছিস, তার সঙ্গে আগে কথা বলে নেওয়া দরকার ছিল না?’

‘হুঁ! দেহি!… শুভব্রত ছেলেটিকে তোর এত ভালো লেগেছে?’

‘হ্যাঁ। খুব। অনেক বড়, না হলে প্রেম করতাম। কিন্তু শুভদা আমাকে বাচ্চা মেয়ের মতো দেখে। তাতে বয়েই গেল। আমরা বন্ধু হয়ে গেছি।’

‘এরই মধ্যে।’

‘ফেসবুক ফ্রেন্ড। সেটা কথা নয়, কথা হলো সুহাস কি শুধু আমার অঙ্কশিক্ষক হয়েই আসবেন, নাকি বাবা-মা আরো কিছু জানতে পারবেন?’

 

সেই রাতে সুমালার ঘুম হয়নি। জীবনে প্রথমবার, নিজের পড়া, চাকরি, উন্নতি, প্রতিষ্ঠা – ইত্যাদির বাইরে সে জীবনের কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছিল। সেসবের উত্তর তার জানা ছিল না। কাকে বলে প্রেম? এই যে অনুভবসমূহ, এই যে একজন প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল যুবকের প্রতি তীব্র টান, যাকে ছাড়া তার আগামী দিনগুলি সে কল্পনাও করতে পারে না, এই অভিনব এবং অত্যাশ্চর্য বোধ তাকে কোথায়, কতদূরে নিয়ে যাবে? সে কি তার বাবা-মাকে অসুখী করে তুলবে? সে তা চায় না। কী এসে যায় যদি সে এমন বিয়ে না করে, আদৌ বিয়ে না করে? এমনকি সুহাস – তার সঙ্গেও যদি শেষ পর্যন্ত জীবন যুক্ত না হয়? তবু এই মুহূর্তে এ-ই সত্য, সে সুহাসকে ভালোবেসেছে। ভালোবাসে। এর বাইরে অন্য কেউ তার সহনাতীত।

ভোরের বেলা, যখন শহরের পাখিরা আড় ভেঙে ঘুমবিজড়িত কণ্ঠে ডাকাডাকি শুরু করে, সুমালা তাদের সুবিশাল বৈঠকখানার পুবমুখী জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। তখনো সূর্য দেখা দেয়নি। ঊষার লালিমা রাঙা কিরণরঞ্জিত করছে শেষরজনীর কালচে নীল দিগন্ত। সুমালা চুপচাপ চেয়েছিল সেইদিকে। যেদিকে তাকায়, সুহাসের চোখ দুটি, তার হাসি, কথা, বিভঙ্গ, অভ্যাস – সমস্তই আকাশের প্রেক্ষাপটে অাঁকা হতে থাকে। মুছে যায়। ফের অাঁকা হয়। সেই মুহূর্তে, জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবহমানতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছিল সুমালা।

সেদিন সে সুহাসকে বলেছিল, ‘বাবা পাত্র দেখছেন। তিনি চান আমি বিয়ে করি।’

সুহাস বলল, ‘তোমার পড়া? তোমার আই অ্যাসের প্রস্ত্ততি?’

‘সব থাকবে।’

‘তুমি কী চাও?’

‘এই মুহূর্তে তোমার মুখ থেকে কিছু শুনতে চাই।’

‘তুমি কি আমাকে বোঝোনি?’

‘বুঝি। তবুও।’

‘তুমি অন্য কারো হয়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব সুমালা। কিন্তু এখন বিয়ে করার কথা আমি ভাবতেও পারি না।’

‘এখন বিয়ে করতে বলিনি তো। সুহাস, আমি বাড়িতে তোমার কথা জানাতে চাই। আমি কখনো বাবা-মায়ের কাছে কিছু লুকোইনি। তোমার কথা বলতে না পেরে আমার নিজেকে অপরাধী লাগছে।’

‘কিন্তু আমি তো তোমাকে এই মুহূর্তে বাড়িতে… মানে, সুমালা, তুমি আমার সম্পর্কে তো কিছুই জানো না।’

‘আমাকে জানাও।’

‘আমাদের অবস্থা, মানে… ইয়ে… আমার বাবা ফুলগাছের ব্যবসা করেন। দারিদ্রে্যর মধ্যে বড় হয়েছি। আমার মা একটি পোশাকের কারখানায় উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। ছোট বাসা। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার মতো… সুমালা, তোমাকে প্রথম দিন থেকে ভালোবেসেছি, কিন্তু আমার জীবন যে সহজ নয়। এই পরীক্ষার ওপর আমার অনেক কিছু নির্ভর করছে। বলা ভালো, গোটা জীবন।’

‘আমার বোন মিলার একজন ভালো অঙ্কশিক্ষক দরকার। তুমি ওকে পড়াবে? আমাদের বাড়ির সঙ্গে একটা যোগাযোগ হয়ে যাবে তোমার। তারপর জীবন যেদিকে নিয়ে যায়! দেখাই যাক না।’

 

সুহাস গিয়েছিল সুমালার বাড়িতে। আজো যায়। শর্মিলাকে অঙ্ক পড়ায় নিয়মিত। সুমালার পরিবার তাকে পছন্দ করেছে। আর সুহাস, নিত্য যাওয়া-আসার মধ্যে, সুমালাদের বৈভব-বিত্ত ও সম্পন্নতার আন্দাজ পেয়ে গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে প্রতিদিন। হায়! এর সিকিভাগও কি তার জীবনে থাকতে পারত না। তার বাবার? তার একদাসম্পন্ন বাড়ির অধুনা প্রজন্ম, অ্যান্টিক বাউটিবাহিনী তার মায়ের?

 

তিন

ইদানীং সুহাস বড় গম্ভীর। উদাসী। পাঁচ লাখ টাকা নগদ, যার কোনো প্রমাণপত্র থাকবে না, রসিদ থাকবে না, সুমালা সেই অর্থের বিনিময়ে ‘রজতদার বিশেষ কোচিং’ খরিদ করবে।

সুহাস জানে, পৃথিবীতে, এই মুহূর্তে তাদের সর্বস্ব উজাড় করেও এই অর্থ সংগ্রহ অসম্ভব। এমনকি চিন্তা পর্যন্ত অবাস্তব। এর কথা বাবা-মাকে জানানো বাতুলতা মনে করেছে সে। সম্পূর্ণ হতাশার বহিঃপ্রকাশের মধ্যেও মনের অতলান্ত তমিস্রায় একটি ভাবনা সুগোপনে লালন করতে তার ভালো লাগছে যে, পৃথিবীতে,            আত্যন্তিক চেষ্টা, অসম্ভবকে সম্ভবপর করে তুলতে পারে।

কোন সে প্রয়াস? তার মেধামন্ডপে বিবিধ উপায় উঁকি দিয়ে যায়।

সুমালার বাবার কাছে ঋণ চাইবে?

সুমালাকে বলবে, টাকাটা আমায় দাও। আমি তো পাবই তা হলে! আমার জন্য তুমি সব করতে পারো। সব দিতে পারো। বলোনি?

নিজের একটি অঙ্গ বিক্রি করে দেবে? শুনেছে একটি সুস্থ বৃক্কের জন্য সাত লাখ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তাদের বস্তিতে সবরকমের লোক আছে। মেয়েপাচার চক্রের পান্ডা, কিডনি বেচার দালাল, মড়া বিক্রির কারবারি, চোর, পকেটমার, ডাকাত…

সে কি ডাকাতি করবে?

একবার? জীবনে একবার? একবার আইএএস হয়ে যেতে পারলেই আর কখনো, কোনো দিন, কোনো অন্যায় করবে না, লোভ করবে না, পাপ করবে না…

নাকি, ব্যাংক ডাকাতি নয়? অন্য কিছু! আর কোথায় কোথায়?

দুই তরুণ-তরুণী, পরস্পর ভালোবাসে। কফি টেবিলের স্বল্প পরিসরে বসে আছে মুখোমুখি। চোখে রাখা চোখ। হাতে রাখা হাত। একজনের হাতে উদ্বেগ ও হতাশার স্বেদ, অপরজনের করতলে আশ্বাসের উষ্ণতা। সে বলছে, ‘তুমি পারবে। তুমি এমনিই পারবে। যা যা পড়াবে এখানে, যেমন যেমন পঠনীয় বিষয় দেবে, শেখাবে যা কিছু, সব আমি তোমাকে দেব। এভাবে ভেঙে পড়ো না সোনা আমার। রজতদার কোচিং সাফল্যের শেষ কথা নয়। দেশের সমস্ত আইএএস, আইপিএস, আইআরএস, আইএফএস কোনো না কোনো কোচিংয়ের সাহায্য নেয় – এমন কোনো কথা নেই।’

সুহাস মৃদু হাসল। অল্প চাপ দিলো সুমালার হাতে। তার চোখে শান্ত চোখ রেখে বলল, ‘ঠিক। ঠিকই বলেছ তুমি সুমালা। শুধু শুধু এত ভাবছি। চলো, লড়ে যাব।’

সে কফিতে চুমুক দিলো। কফি বা খাবারের দাম সুমালাই মেটায়। সুহাসকে তার দরিদ্র বাপ-মা রোজগার করতে দেয়নি। এমনকি হাতখরচের জন্য ছাত্র পড়াতেও দেয়নি। শর্মিলাকে পড়ানোর জন্য যে পরিমাণ দক্ষিণা সুহাসকে দিতে চাওয়া হয়েছিল, তা কম আকর্ষণীয় ছিল না। কিন্তু সুহাস তা প্রত্যাখ্যান করে। সে দরিদ্র হলেও লোভী বা আত্মসম্মানবোধহীন নয়।

এই মুহূর্তে সুমালার পাত্র হিসেবে শুভব্রত অতুলনীয় ছিল। কিন্তু সুহাসকে সুমালা ভালোবাসে। তাই তার মা-বাবাও সুহাসকে সসম্মানে গ্রহণ করেছেন। ভালোবাসার চেষ্টা করছেন। সুমালার মা বলেন, ‘ছেলেটা ভালো। শান্ত ভদ্র। দেখতেও কী সুন্দর। চোখ দুটি বড় উদাসী। সন্ন্যাসীর মতো। মিলাকে খুব যত্ন নিয়ে পড়ায়।’

সুমালার বাবা বলেন, ‘হ্যাঁ। নিষ্ঠাবান ছেলে। মেধাবী। আগাগোড়া খুবই ভালো ফল। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। শুধু আইএএস নিয়ে পড়ে না থাকলেও ওর চলবে।’

‘হ্যাঁ। বাপের টাকা থাকল কি না থাকল, তা দিয়ে কী এসে যায়। ছেলে সদাচারী, উদ্যমী, প্রতিষ্ঠিত হলেই আর সব তুচ্ছ হয়ে যাবে। তখন একবার ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।’

‘সেসব পরে হবে। আগে আমাদের সুমালার স্বপ্ন পূরণ হোক। ওদের সম্পর্ক পাকা হোক। আজকাল ছেলেমেয়েরা অন্যরকম।’

শর্মিলা ততখানি বন্ধু হয়নি সুহাসের। শুভব্রতের সঙ্গে তার উচ্ছলতার তরঙ্গ সহজে মিলতে পেরেছিল। কিন্তু শান্ত, মিতবাক সুহাসের মধ্যে উষ্ণতার বড় অভাব মনে হয় শর্মিলার। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝতে চায়, দিদি সুহাসকে এত ভালোবাসে! কেন?

সেদিন পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ‘রজতদার বিশেষ কোচিং’য়ে ভর্তি হবে সুমালা, তার আগের সন্ধ্যায় দুবোন গিয়েছিল মাসির বাড়ি, মাসতুতো বোনের জন্মদিন উপলক্ষে। সঙ্গে তাদের মা। বিশেষ কাজে বাবা শহরের বাইরে আছেন দুদিন হলো। আগামী কাল তাঁর ফেরার কথা।

রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। মা নিজেই গাড়ির চালিয়ে ফিরছেন। চালককে ১০টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয় কারণ সে শহর ছাড়িয়ে দূরের দিকে থাকে। বাড়ি পৌঁছে গাড়িশালে গাড়ি রাখলেন তিনি। ঝাঁপ বন্ধ করে তালা দিলেন। দুই মেয়েকে নিয়ে মূল দরজার তালা খুলে প্রবেশ করছেন –

হঠাৎ মনে হলো, বাগানের গাছের আড়ালে কাউকে দেখলেন।

‘কে?’ ডাকলেন একবার বাগানে হালকা আলো জ্বলে সারারাত।

সুমালা বলল, ‘কী মা?’

‘মন হলো লোক।’

‘কোথায় লোক?’

শর্মিলা বলল, ‘বাবা না থাকলেই মা প্রচন্ড ভয় পায়। সেবার মনে আছে, একটা বেড়াল নিয়ে কী কান্ড হলো?’

দুই বোন হাসতে লাগল। মা হাসতে পারছেন না। তিনি স্পষ্ট কাউকে সরে যেতে দেখেছেন। হয়তো ছিঁচকে চোর। এবারে রাতের পাহারা না রাখলেই নয়। তিনি তাড়াতাড়ি মেয়েদের নিয়ে ভেতরে চলে এলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব বোনের বাড়িতে সমাধা হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে কথা সেরে, শয়নের প্রস্ত্ততি নিয়ে, নিজের ঘরে চলে গেলেন মা। দুই বোনও যার যার কক্ষে ঢুকে পড়ল। অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করবে সুমালা এখন। সে তার কম্পিউটার চালু করল। পর্দায় সুহাসের মুখ। মৃদু হাসছে। নিজের মুঠোভাস যন্ত্রের ক্যামেরায় তুলেছিল সুমালা। কী গভীর চাউনি! সুমালা অনিমেষে চেয়ে রইল সেদিকে। তারপর পড়ায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কী রকম অপরাধবোধ হচ্ছিল তার। সে যেন সুহাসের প্রাপ্য কেড়ে নিচ্ছে। যেন সুহাসের আর্থিক অপারঙ্গমতার জন্য সে-ই দায়ী। সে দুহাতে মুখ ঢাকল। সে বুঝতে পারছিল প্রেম তাকে দুর্বল করছে। সুহাসকে তার নিজের পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে হবে। আইএএস না হয়েও জীবনে উচ্চপ্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। সুহাসের ওপর সুমালার পূর্ণ আস্থা। দাক্ষিণ্য বা করুণা দিয়ে সে সুহাসকে কেন ছোট করবে?

রাত্রি দুটো নাগাদ তার ভারি ঘুম পেল। তিনতলায় দক্ষিণখোলা ঝুলবারান্দা সংলগ্ন তার ঘরখানি। তার অতিপ্রিয় বাসস্থান। দেয়াল জোড়া কাচের পাল্লা। বাইরে অতিরিক্ত সুরক্ষার জন্য সংকোচনশীল লৌহ ফটক। সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেলে এই ফটকে তালা পড়ে।

শীত গিয়ে বসন্ত আসছে। বহুদূরে কোকিল ডাকছে। মৃদুমন্দ বায়ু এসে দোল দিয়ে যাচ্ছে সুমালার কালো চুলের গুচ্ছে। বিছানায় শুয়ে, খোলা দক্ষিণে দৃশ্যমান রাতের আকাশে ঝিকিমিকি তারা দেখতে দেখতে, সুহাসের কথা ভাবতে ভাবতে সুমালা ঘুমিয়ে পড়ল। জানল না, তার ঘুমের প্রগাঢ়তা স্বাভাবিক নয়। জানল না, তার প্রিয় দক্ষিণের খোলা ঝুলবারান্দা দিয়ে কেবল কোকিলের কূজন নয়, মলয় বায়ু নয়, বসন্তের আভাস মাত্র নয়, প্রবেশ করল লুটেরা। জানল না, তারা এগারো বছরের বোনকে ধর্ষণ করেছে, চুয়াল্লিশ বছরের মাকে ধর্ষণ করেছে, আলমারি থেকে লুট করে নিয়ে গিয়েছে টাকা, গয়না যা ছিল সব। তারা ধ্বংস করে গেছে একটি পরিবার।

এই নিয়ে সাতবার জেরা করা হলো সুমালাকে। তদন্তের ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। শর্মিলা হাসপাতালে। তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। কিন্তু অপমান ও মানসিক যন্ত্রণায় সে মূক হয়ে গেছে।

তদন্তভারে একনিষ্ঠ তমাল দত্ত বলছেন, বাড়ির কেউ, কিংবা অত্যন্ত পরিচিত কারো সাহায্য ছাড়া এত নিখুঁত কাজ সম্ভব নয়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সুমালাকে তিনি একই প্রশ্ন করছেন। একদিন দুদিন তিনদিন। একবার চারবার সাতবার।

পুলিশ : তো, আপনার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনি রাতে               খোলা ছিল।

সুমালা : হ্যাঁ।

পুলিশ : কেন?

সুমালা : শীতকাল ছাড়া খোলাই রাখি।

পুলিশ : কেন?

সুমালা : ভালো লাগে।

পুলিশ : ভয় করে না?

সুমালা : না। এতকাল করেনি।

[সে কেঁদে উঠছিল]

পুলিশ : বাড়িতে ডাকাত পড়ল, আপনার বারান্দা দিয়ে, আপনার ঘর দিয়ে ভেতরে এলো, এতকিছু করল, কোনো শব্দ, কোনো ডাক, কোনো চিৎকার আপনি শুনলেন না।

সুমালা : না। শুনিনি।

পুলিশ : আপনার ছোটবোনকে আপনি ভালোবাসেন।

সুমালা : প্রাণের চেয়েও বেশি। কেন এসব বলছেন। আমি কী করেছি! আমি কিছুই জানি না। কিচ্ছু জানি না।

পুলিশ : ওরা আপনাকে ছুঁলো না পর্যন্ত। অথচ আপনার              মা-বোনকে… খুব আশ্চর্য নয়?

সুমালা : কী বলছেন? এসব আপনারা কী বলছেন?

[সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল]

পুলিশ : আপনার কোচিংয়ে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। অথচ আপনার প্রেমিক তা দিতে পারছিল না।

সুমালা : হ্যাঁ। ওর সে অবস্থা নয়।

পুলিশ : সে কী এরকম কিছু করতে পারে?

সুমালা : অসম্ভব!

পুলিশ : কী করে বুঝলেন!

সুমালা : সুহাস ওরকম নয়। কখনো নয়। তা ছাড়া… তা ছাড়া… মিলাকে ও নিজের বোনের মতো দেখে।

পুলিশ : বোনের মতো। বোন তো নয়।

সুমালা : আমি জানি না। আমি কিছু জানি না।

পুলিশ : আপনি সুহাসকে সাহায্য করতে চাননি?

সুমালা : না।

পুলিশ : কেন?

সুমালা : এ তো অনেক টাকার ব্যাপার!

পুলিশ : অনেক টাকাই তো গেল আপনাদের। পনেরো লাখ ছিল। চলে গেল। গয়না গেল। মানসম্মান। মা বোনের ইজ্জত… সত্যি করে বলুন তো আপনি ব্যালকনির দরজা খোলা রেখেছিলেন কেন? বিশেষত, আপনার মা যখন বাগানে কোনো লোকের উপস্থিতি টের পেয়েছিলেন – তার পরেও!

সুমালা : আপনারা কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। আমিই আমার বোনকে… আমার মাকে… ওঃ ভগবান! আমি কিছু জানি না। কিচ্ছু জানি না। মা, আমাকে তুমি সন্দেহ করো? মা গো? বাবা? তুমিও? তোমরা কিছু বলছ না কেন? কেন বলছ না আমি এসব কিছুই করতে পারি না। সুহাস গরিব। কিন্তু ও তো কত ভালো বাবা! ও বাবা!

পুলিশ : আপনার বন্ধু সুহাস সে-রাতে নিজের বাড়িতেই ছিলেন। তবু প্রশ্ন থেকেই যায় সুমালা… সত্য নির্মম। অসত্য নিষ্ঠুর। সন্দেহ ক্রূরতম। সহনাতীত। সন্দেহ স্নেহ মানে না, প্রেম মানে না, আজন্মলালিত বিশ্বাস ভুলিয়ে দেয়।

 

ঘটনার পর, দশম দিনে, ডাকাতির বখরা মেটাতে শহর থেকে দূরে, এক নির্জন পল্লির নির্জন মাঠে দেখা করল তিনজন। দীনেশ, হারুন আর ভবিষ্যতের আইএএস হওয়ার স্বপ্ন দেখা এক তরুণ।

কথা ছিল পাঁচ লাখ তার। বাকি যা পাবে, দীনেশ আর           হারুনের ভাগ।

হাজার টাকার নোটে পাঁচ লাখ খুব বড় খাম নয়। এ লাইনে চৌকষ হারুন, লুটের টাকাগুলি নানা জায়গা থেকে বদলে এনেছে যাতে নোটের নম্বর ধরে পুলিশ সহজে অনুসরণ করতে না পারে।

সুহাস এসব কিছুই ভাবছে না। টাকাভর্তি খাম নিয়ে সে চুপ করে বসে আছে। এ তার কোন কাজে লাগবে! সে তো এমন চায়নি। তার মনে শান্তি নেই। বিবেক তাকে তাড়িয়ে মারছে। অবশেষে রাগত স্বরে সে বলল, ‘কেন তোরা নোংরা কাজ করতে গেলি! একটা বাচ্চা মেয়ে… একজন মায়ের মতো…!’

‘দ্যাখ সুহাস,’ দীনেশ ধমকে উঠল, ‘তুই তো বে ধোয়া তুলসীপাতা থেকে গেলি! শালার ভালো ছেলে! তোর মালটাকে তো কিছু করিনি।’

হারুন বলল, ‘মায়ের মতো! থুঃ! নরম গদিতে স্বচ্ছ নাইটি পরে শুয়ে ছিল মাগিটা। এরা মালদার লোক! ফাউ মেরে হেভ্ভি আরাম!’

‘কচিটার নথ তো কেউ ভাঙতই। আমিই দিলাম! বা রে! ভালো ছেলে! ভালো হয়ে থাক। বেশি কথা বলতে আসিস না। আমরা লোক ভালো না।’

সুহাস উঠে পড়ল। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল স্টেশনের দিকে। তার সস্তার মুঠোভাস যন্ত্রে সুমালাকে পাওয়ার চেষ্টা করল। পেল না। মাত্র একদিন দেখা হয়েছিল তাদের। সুমালাকে প্রেতিনীর মতো লাগছিল। সুমালার বাবা তাকে এখন ও-বাড়ি থেকে নিষেধ করেছেন। সুমালা বোবা চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। তার দৃষ্টিতে অভিযোগ ছিল না। প্রশ্ন ছিল না। ভয় ছিল না। সে যেন এই জগৎ থেকে বহুদূর চলে গিয়েছিল। কতদূর? সুহাস ওই দৃষ্টি সহ্য করতে পারছিল না। সে চাইছিল, সুমালাকে সর্বশক্তিতে বুকে চেপে ধরতে। সে চাইছিল, গলা ফাটিয়ে ক্ষমা চাইতে। সে চাইছিল, কোনো মন্ত্রে আবার সবকিছু আগের মতো করে দিতে!

শর্মিলার হাসপাতালে গিয়ে সে দু-ঘণ্টা বসেছিল চুপচাপ। একেবারে বাইরের দিকে। যেখানে অপেক্ষমাণের জন্য পেতে রাখা সারি সারি স্টিলের চেয়ার। শর্মিলার সামনে যেতে চাওয়ার সাহসও তার হয়নি।

সুহাস বুঝতে পারছে, সে মরে যাচ্ছে। মরণের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ক্রমশ। একদিন তার সব ছিল। রূপ, গুণ, বুদ্ধি, মেধা, প্রেম, স্নেহ, সম্মান। আজ তার কিছুই নেই। সে ফাঁপা। সে শূন্য। সে মলিন।

তখন, সুমালা এসে দাঁড়াল শর্মিলার শয্যার পাশে। গতকাল থেকে কথা বলছে শর্মিলা। মা, বাবা, ডাক্তার, পুলিশ – সবার সঙ্গে বলেছে। আজ সুমালাকে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে নিল। সুমালার শেষ আশ্রয় ছিল ছোট বোন। সে শুধু বলতে পারল, ‘মিলা, তুইও…!’ লোভ অন্ধ। লোভ বধির। লোভ হৃদয়হীন। লোভ জটিল। পঙ্কিল। পূতিগন্ধময়। নির্মম। সত্য নির্মম। অসত্য নিষ্ঠুর। সন্দেহ ক্রূরতম। সহনাতীত। সন্দেহ ও লোভ স্নেহ মানে না, প্রেম মানে না, আজন্মলালিত বিশ্বাস ভুলিয়ে দেয়।

সুমালা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো। ফিরল তার প্রিয় কক্ষটিতে। সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিলো। একটি কাগজ টেনে লিখল – বিশ্বাস করো। আমি কিছুই জানি না। তোমরা আমাকে বিশ্বাস করো।… সুহাস এর মধ্যে থাকতে পারে না। ও পবিত্র। ও সুন্দর।

আমার বুক ভেঙে গেছে। আমি চলে যাচ্ছি।

 

সুমালা আত্মহত্যা করল।

রেললাইনের ধারে পড়ে ছিল যুবকের মৃতদেহ। পেটের ওপর দিয়ে চলে গেছে ট্রেন। আধখানা লাইনের এধারে, আধখানা ওধারে। মুখখানা অটুট। পাশে একটি ব্যাগ। তাতে পাঁচ লাখ টাকা। বাদামি কাগজের খামে মোড়া এক হাজার টাকার নোট। খামের গায়ে লেখা – সুমালা। ক্ষমা করো।

বসন্তের উথাল হাওয়ায় লাল টকটকে দুটি শিমুল ফুল, সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ল মাটিতে। কেউ ফিরেও তাকাল না।

১. ছাত্র বয়সে বন্ধুত্বের বহুরকম বৃত্ত থাকে। কখনো এক বৃত্ত অপরটির সঙ্গে আংশিকভাবে মিশে যায়, কখনো একে অপরকে ছেদ করে, কখনো সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি বৃত্তে হয়তো একটিই সাধারণ মুখ। স্কুলে নিচু ক্লাসে একরকম বন্ধুদল, উঁচু ক্লাসে আবার অন্য বৃত্ত, কোচিংয়ের বান্ধববলয় – সে-ও হতে পারে একেকটি বিষয়ের জন্য একেকরকম! সুমালার এমন পৃথক বলয় বেশ কয়েকটি। আজকাল সময়াভাবে দেখাসাক্ষাৎ আড্ডা গল্প কমে গেছে, তাই বলে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। নিজস্ব সত্তার পূর্ণ সামাজিকীকরণের জন্য ‘ফেসবুক’ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক বৈঠকে ব্যবস্থা মজুত। যদিও সুহাস এসবের মধ্যে নেই। তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুবৃত্ত নেই। কখনো ছিল না। ঘনিষ্ঠতা তার আসে না। তার           শান্ত, মিতবাক, মিষ্টি ব্যববহারের জন্য সহপাঠীরা তাকে পছন্দ করত। তাকেই বন্ধুত্বের ক্ষেত্র বলা যেতে পারে। একত্রে পড়া, বই কিংবা কোনো বিশেষ প্রশ্নোত্তর দেওয়া-নেওয়া করার মধ্যেই তা সীমিত ছিল। তাই, রজতদার কোচিংয়ে ভর্তির জন্য সুহাস একা অপেক্ষমাণ ছিল। অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ সদলে এসেছিল, কেউ একা, কিন্তু তারা পরস্পর আলাপ-পরিচয় করে দলবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুহাসের মুখচ্ছবিতে, পরিচয়ে অনাগ্রহী বিজ্ঞপ্তি এত স্পষ্ট ছিল যে, কেউ তার প্রতি অগ্রসর হয়নি। যারা এসেছে, অধিকাংশই সুবেশ, কেতাদুরস্ত, বেশির ভাগ ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলছে। নানারকম পরীক্ষার প্রস্ত্ততি হয় যেহেতু, ভর্তির সরঞ্জাম হাতে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠাপ্রত্যাশীদের সংখ্যা কম নয়। কোনো একফালি কোচিং কেন্দ্রে এত ছাত্র ধরে কি?

 

২. সে যে তার মেধার কারণে, সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করতে পারছিল, জয়ী হয়ে উঠছিল বছরের পর বছর – তাতে, নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ধরে নিয়েছিল সে। তার বিশ্বাস ছিল, সে অমিত শক্তিমান। এর দ্বারা নিজের স্বপ্ন এবং জীবনকে সে একাকার করে ফেলবে!

আইএএস মূল পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ওঠা তাকে হিংস্রভাবে অভিমানী করে তুলল কার বিরুদ্ধে, সে নিজেও সম্যক বুঝতে পারছিল না। যে-ভাগ্য তাকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেও এমন অনেক দিয়েছিল, যার দ্বারা তার অহং মেরুদাঁড়া সোজা রেখে চলতে পারে, সম্ভবত তারই কাছে ছিল তার অভিমান।

কিন্তু হায়! ভাগ্য এক বিশ্বাস মাত্র। স্বীকার এবং অস্বীকারের মধ্যে সে বিরাজ করে অথবা করে না। আমার কর্মই আমার ভাগ্য, আমার নিজস্ব জীবনের নিয়ন্তা – এমনটি যারা ভাবে, তাদের ব্যর্থতার গ্লানি বোঝা বাড়ায় না। ব্যর্থতার কারণগুলি অনুধাবন করে নতুনতর উদ্যম তাদের পাথেয়। যারা মনে করে, অহো, আমি কী দুর্ভাগা, জীবন এই রেখেছিল, ভাগ্য এই দিলো আমায়! এই ব্যর্থতা, এই গ্লানি, এই পরাজয়। অহো! বিনা দোষে নষ্ট জীবন!… সুহাস সেই দলভুক্ত কিনা স্পষ্ট নয়, তবে অসাফল্য তাকে এতখানি বিচলিত করে দিলো যে সে হয়ে উঠল বিমূঢ়, শোকগ্রস্ত, হতোদ্যম। সে অসফল হতে পারে না। সে প্রভূত পরিশ্রম করেছিল। ভালো পরীক্ষা দিয়েছিল। আইএএস ঘিরে নানাবিধ চক্র চলে বলে সে শুনেছিল।

তার মধ্যে এই ধারণা দৃঢ়মূল হচ্ছিল যে, সে হয় চক্রান্তের শিকার, নয় দুর্ভাগ্যতাড়িত। স্কুল-কলেজের পরীক্ষা এক জিনিস, আর রাষ্ট্রীয় পদাধিকারী হওয়া অন্য। সেখানে ‘ব্যাকিং’ লাগে।

‘ব্যাকিং’। ঠেলে দেওয়ার মতো আত্মীয়, পরিচিত কিংবা আর্থিক পারিতোষিক। ব্যাকিং। যা থাকলে মানুষ যা চায়, তাই পায়। জগৎসংসার এই নিয়মে চলছে – এই বিবৃতি কখনো সত্য কখনো মিথ্যা। এমনকি তা যুগপৎ সত্য ও মিথ্যা হলেও হতে পারে। প্রয়াস, প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধি, একনিষ্ঠ অনুশীলন মানুষকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে দেয় আজো। কিন্তু ব্যর্থতার বেদনা যার দুঃসহ, সে তা ভুলে যায়। এমনকি বিশ্বাস পর্যন্ত করতে চায় না। সুহাসের হলো গিয়ে সেই দশা। সে ভালো করে খায় না, স্বস্তিতে ঘুমোয় না, পড়ার বইগুলি স্পর্শ করে না, কেবল শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সিলিংয়ের দিকে। সস্তা টিনের চালের তলায় হোগলার চাটাই-টাঙানো সিলিং। গরমে তাপ বিকিরণ প্রতিহত করে, শীতে ঠান্ডা। সুহাস, চূড়ান্ত  ক্ষয়-লাগা মনে হোগলার চাটাইয়ের মতো অর্থহীন হতাশার নকশা বুনছিল কেবল।

৩. তার বাল্যে, বস্তিতে তার সমবয়সীর দল, ওই হারুন, দীনেশ, রবি, সন্তোষ, রফিক স্কুলে যেত এবং স্কুল পালাত। স্টেশনে বাজারে ভিক্ষে করত নিখুঁত ক্ষুধার্তের ভূমিকায়। বস্ত্তত, তারা কেউ অভুক্ত ছিল না। কিন্তু তারা পয়সা চিনেছিল। চকচকে রুপোলি ধাতুখন্ড। হাতে পেলে মন যা চায় তাই পাওয়া যায়। ভিক্ষের পয়সায় তারা খেত আইসক্রিম, ঘটিগরম, কিনত রকমারি রঙিন প্লাস্টিকের খেলনা। সিনেমা দেখা, ভিডিও দর্শন, আর দেখতে দেখতে, চাইতে চাইতে, বালকবেলার মেলার ছলে অভ্যাস করা ভিক্ষাবৃত্তি পালটে গেল ধান্ধায়। তার মধ্যে চুরি, ডাকাতি, মাদক পাচার, জাল নোট ছাপা – বিবিধ অপরাধমূলক কাজ। যা যখন জোটে। আইন পরোয়া নেই, ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই, শিক্ষা-সংস্কার নেই, কেবল চায় টাকা, কেবল চায় ভোগ, কেবল চায় যৌনতা। জীবন পেয়েও জীবন বোঝে না হায়!

এ-সুহাস, চল ভিক্ষা মাঙবি, হেভ্ভি পয়সা মিলবে।

আমি যাব না। তোরা যা রে।

এ-সুহাস, চল বে, সাট্টা খেলবি? মাল কামাবি। আরে চল না বে। আচ্ছা আচ্ছা বাবুরা আসে খেলতে।

না রে। আমার ক্লাস আছে, পড়া আছে।

চল বে সুহাস, খালি পড়লে হবে? শালা মেয়েছেলে মাল ঘাঁটবি না তো লাইফ বেলাইন হয়ে যাবে রে বুদ্ধু।

না রে…!

আ বে সুহাস, তুই শালা পাঁকে পদ্ম মাইরি। তুই কি আমাদের গর্ব, নাকি ঈর্ষা? শালা, তোকে দেখলে মনে হয় আমরা সব পোকামাকড় হয়ে বেঁচে আছি। ফোট বে শালা! তোর মুখ দেখতে চাই না! জীবনে হতাশা এসে যায় মাইরি!

সুহাস, সে আপনাতে আপনি সুরভিত। তার পিতা সৎ ও পরিশ্রমী, খবরের কাগজ পড়েন। তার মা সৎ, নির্লোভ, কর্মনিষ্ঠ, স্নেহপরায়ণ, সদাচারী। অল্প মূল্যে পুরনো বইপত্র কিনে পড়া তাঁর অভ্যাস। সুহাস স্বগৃহে শান্তি ও শৃঙ্খলায় সুরক্ষিত জীবন পেয়েছিল।

 

৪. পৃথিবীতে আবহমানকাল ধরে ঘটে চলা প্রেমের এক প্রকৃতি, তারও জীবনে ঘটে গেছে অজ্ঞাতসারে। সুহাসকে ভালোবেসেছে কোন লগ্নে! প্রথম দিন ওই হাসি দেখে? ভালোবেসেছে, কিন্তু মুখে বলা হয়নি ভালোবাসি। সুহাসের দৃষ্টিতে দেখেছে টলটলে প্রেম, কিন্তু শোনা হয়নি সেই চিরনূতন চিরপুরাতন অমোঘ শব্দ – ভালোবাসি, ভালোবাসি। হাতে হাত রেখে গভীরতম চাহনিতে ডুবে ছিল কত পল, কিন্তু উচ্চারণ করা হয়নি – ছেড়ো না, ছাড়ব না। তুমি আমার, আমি তোমার!

হঠাৎ সে অনুভব করেছিল এক নির্মম সত্য। সুহাসকে ভালোবাসা হয়েছে, জানা হয়নি। সুহাসকে বিশ্বাস করা হয়েছে, বোঝা হয়নি। আপন বিমূঢ়তা ও কান্ডজ্ঞানহীনতায় সে ক্রুব্ধ হলো, অসহায় বোধ করল।