রৌদ্রের আহবান

Rodrer Ahban

মোবাশ্বির আলম মজুমদার

শিল্প সহজে ব্যবধান ঘোচায়। বৈষম্যের চাবিকাঠি স্থবির করে দেয়। প্রত্নগুহা থেকে সৃষ্ট শিল্পকলার উত্তরণ ঘটে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। বাংলাদেশের শিল্পকলায় নারীশিল্পীদের আলাদা করে নাম উল্লেখ করলে বলতে হয় ভাস্কর নভেরা আহমেদের কথা। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে নভেরা আহমেদ ইউরোপীয় ধাঁচের জ্যামিতিক নির্মাণ পদ্ধতি অনুসরণ করে সাহসিকতার প্রমাণ রেখেছেন। পরবর্তীকালে নাইমা হক, নাসরিন বেগম, রোকেয়া সুলতানা, দিলারা বেগম জলি, ফরিদা জামান, নাজলী লায়লা মনসুর, আইভী জামান প্রমুখ শিল্পী ধীরে ধীরে বাংলাদেশের শিল্পকলায় অবদান রেখেছেন। ষাট বছর ধরে বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনে নারীরা কেমন অবদান রেখেছেন, এ-প্রদর্শনী তার সাক্ষ্য দেয়। চল্লিশজন শিল্পীর কাজে দেখা যায় মাধ্যমের নিরীক্ষা, চিত্রতলের বিন্যাস ও প্রকরণে চিন্তার প্রকাশ ঘটানো। নানা মাত্রায় চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ছাপচিত্র, মিশ্রমাধ্যমসহ সকল শাখায় নারীশিল্পীদের অগ্রগতির সূচক ঊর্ধ্বগামী। তবু বলতে হয়, সমাজ যেভাবে নারীর প্রতি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে, সেটি সকল অগ্রগতির জন্যে নেতিবাচক।
এ-প্রদর্শনীর চল্লিশজন শিল্পীর কাজকে দশক বিভাজনের মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাক। আশির দশকের শুরুতে কাজ করেছেন নাইমা হক। তাঁর কাজে আবহমান বাংলার প্রতীক নকশিকাঁথার নকশা কোলাজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সাদা-কালো জমিনে কালো রেখার গতি ছবিতে প্রাণ সঞ্চার করেছে। নাইমা হকের এবারের কাজে প্রতীক প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। আশির দশকের শিল্পী নাসরিন বেগম বাস্তবধর্মী চিত্রকর্মে লোকজ অনুষঙ্গ প্রকাশ করেছেন। ফরিদা জামানের কাজে কালো রঙে গড়া নারী-অবয়ব ঘিরে আছে লাল রেখা আর ধূসর রঙের আকৃতি। অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে যাত্রা নারীর চিরন্তন চাওয়া। গত শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের নারীশিল্পীদের ভাবনায় সমাজ-ভাবনা, স্বদেশপ্রেম, প্রকৃতি, রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছে। নারী সমাজের প্রতিটি স্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছে, কাজে অংশগ্রহণ করছে। দেশের উন্নয়নে নারী-পুরুষ এক হয়ে কাজ করছে। নারীশিল্পীদের কাজে শুধু নারীবাদী চেতনা প্রকাশ পায়নি, সমাজ-ভাবনা রাজনৈতিক দর্শন, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক চেতনাবোধের রূপায়ণ দেখা যায়। শিল্পী রোকেয়া সুলতানার অাঁকা ‘ম্যাডোনা’ ছবিতে আমরা দেখি মায়ের যত্নে আছে শিশু। তার পেছনে লাল রঙের অর্ধবৃত্ত। ছবিটির বিষয়ের কেন্দ্রে মা ও শিশু অবাক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। রোকেয়া সুলতানার ছবির চরিত্রে বঞ্চনার দৃষ্টি ফুটে উঠেছে। যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী ও শিশু। গাজা উপত্যকার হানাহানি, রক্তক্ষয় নিয়ে আতিয়া ইসলাম এ্যানি এঁকেছেন ‘গাজা উপত্যকা কাঁদছে’। কালো চিত্রতলে হলুদ পোশাক-পরিহিত নারীর দুপাশে তাক করে আছে বন্দুক। নারীর মুখে আতঙ্ক আর মারণাস্ত্রের সজ্জায় ছবিটি বিশ্ব-রাজনীতির অসুস্থতার কথা জানান দেয়। তৈয়বা বেগম লিপি সুতার বান্ডিল আর বোতামের আকৃতি পেনসিলে এঁকে উপস্থাপন করেছেন। প্রতীকের সাহায্যে লিপি বোঝাতে চান বস্ত্রবালিকাদের জীবনগাথা। আইভী জামান প্রতিকৃতি চিত্রে রেখাবহুল মানুষের মুখ এচিং মাধ্যমে এঁকেছেন। ফারেহা জেবা এচিং মাধ্যমে নারীদেহের ছন্দ এঁকে চিত্রতল সাজিয়েছেন বড়-ছোট বৃত্তের সাহায্যে। চিত্রকলার বিষয় বর্ণনের বাইরে এসে ভাস্কর্যের আলোচনায় যাই। তিনটি ভাস্কর্যের ধরন তিন রকম। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তাঁরনিজস্ব রীতির গাছের গুঁড়ি আর শেকড়ের ডালপালা হাজির করেছেন। ফারজানা ইসলাম মিল্কী ব্রোঞ্জ মাধ্যমে তৈরি করেছেন ‘খোলা জানালা’। ভাস্কর্যে সামিনা এম করিম যুগল মানুষের আলিঙ্গন দেখিয়েছেন বিমূর্ত ভঙ্গিতে। কোনো কোনো শিল্পীর কাজের মধ্যে সৌখিন আচরণ লক্ষণীয়। চল্লিশজন শিল্পীর কাজের প্রদর্শনীর পাশাপাশি দুজন বরেণ্য শিল্পীকে সম্মাননা দিয়েছে আয়োজক প্রতিষ্ঠান। শিল্পী হাশেম খান ও শিল্পী রফিকুন নবীর দুটি কাজ এ-আয়োজনকে দ্যুতি দিয়েছে। এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘যাত্রা’। নারীর অগ্রযাত্রা, আমাদের দেখায় কতটা পথ পাড়ি দিয়েছে নারী। সমাজের সকল ক্ষেত্রে আজ নারীর পদচারণা আমাদের এগিয়ে দেয়। জোন্টা ক্লাব অব ঢাকার ব্যস্থাপনায় এ-প্রদর্শনী শুরু হয় ২৮ মার্চ, শেষ হয় ১২ এপ্রিল।