লক্ষ্মীমনির ঠিকানাবদল

ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। অজগরের মতো হেলেদুলে স্টেশন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। পেটের মধ্যে পুরে নিয়েছে লক্ষ্মীমনিকে। নির্বিকার লক্ষ্মীমনির ভাবলেশহীন দৃষ্টি। তাকিয়ে আছে, বাগান নাকি খগেনমাঝি, কাকে দেখছে বোঝা গেল না।

খগেনমাঝি চা-বাগানে রোজের শ্রমিক। সিলেটের সবচেয়ে বড় বাগানে কাজ করে। ওর পূর্বপুরুষরা বিহার থেকে এ-বাগানে এসেছিল। সেই থেকে এখানেই ওদের স্থিতি আর এখানেই শেষ।

খগেনমাঝির বাবা নবীনমাঝি বড়মালিকের পছন্দের মানুষ ছিল। কারো কারো মতে, নবীনমাঝি ছিল বড় মালিকের ডান হাত আর সবধরনের মন্দ কাজের সহযোগী।

খগেনমাঝির বয়স যখন সাত বছর তখন এক ঝড়ের রাতে বড় মালিকের ডাক এলো। খগেনমাঝির মা দরজায় মাথা কুটে বলেছিল, ‘মাঝি, ই পাপ তু করিস নারে করিস না, ভগবান সইবেক লারে, ফির মাঝি ফির।’

ফিরেছিল তিনদিন পর। আবলুশ কাঠের মতো কালো শরীরে কাদামাটির মাখামাখি। সারাজীবন বাগান কাঁপিয়ে চলা মানুষটা ফিরেছিল চারজন মানুষের কাঁধে চেপে। ঝুপড়ির সামনে শুইয়ে দেওয়া মানুষটার হাতে তখনো শক্ত করে ধরা সবসময়ের সাথি চকচকে টেঁটা।

খগেন মাঝি মারা যাওয়ার পর বড় মালিককে আর দেখা গেল না। কেউ বলে তিনি বিদেশে চলে গেছেন, আবার কেউ বলে মারা গেছেন। বাগানের হাল ধরলো মালিকের শালা।

সবার জীবন একই তালে চলছে। শুধু খগেনমাঝির মা এখন আর দশজন চা-শ্রমিকের একজন। সর্দারের লাঠির আঘাত আর আদিম বখরা প্রদান ওর জন্যও নির্ধারিত হয়ে গেল।

খগেনমাঝির বয়স যখন আঠারো পেরুলো একদিন তারও হাতেখড়ি হলো বাগানে চা-শ্রমিক হিসেবে। সেদিন বোধহয় খগেনমাঝির মা সারারাত কেঁদেছিল। মাকে ঘরে পাওয়া যায়নি। খুঁজতে খুঁজতে বাগানের শেষে মাঠের কোণে তাড়ির দোকান থেকে মায়ের এলোমেলো কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।

কাছে যেতেই প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় মাকে যোগেন কুলির কোলের মধ্যে দেখলো। খগেনমাঝির নাকের পাটা ফুলে উঠেছিল। কুপির আলোতে ওকে আরো ভয়ংকর লাগছিল। যোগেন কুলি তাড়াতাড়ি পালিয়ে বাঁচলো। ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে শেষরাতে ঘরে ফিরলো খগেনের মা।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে খগেন মালিকের অনেক কাছে চলে এলো। মা কখনোই তা চায়নি। ছেলেকে কিছুই বলতো না। শুধু বিড়বিড় করে কাঁদতো। আর নিজেকে তাড়ির মধ্যে ডুবিয়ে রাখতো।

এক ঝড়জলের রাতে তাড়ির দোকান থেকে ফেরার সময় পাহাড়ের মাটিধসে মাও চলে গেল পরপারে। সেদিন একটুও কাঁদেনি খগেন। কেমন যেন শান্তি শান্তি হাওয়া বয়ে গেল বুকের উঠোনে।

আরো কিছুদিন পর বাগানের সবার ইচ্ছাতে ওর একটা সংসার হলো। অন্য বাগান থেকে লক্ষ্মীমনি এলো ওর বউ হয়ে। খগেনমাঝির নাদুসনুদুস বউটার গায়ের রং বেশ ফর্সা। দেখে দেখে যেন মন ভরে না। আরো দেখতে ইচ্ছা করে। আজকাল কাজেও যেতে ইচ্ছে করে না।

বাগানে কানাঘুষা আছে লক্ষ্মীমনির বাবা চা-শ্রমিক হলেও মা সবসময় মালিকের বাংলোতে কাজ করতো। সেখানেই থাকতো। কালেভদ্রে লক্ষ্মীমনির বাবার কাছে আসতো। লক্ষ্মীমনির বাবা যত আয় করতো তার চেয়ে বেশি খরচ করতো তাড়ির দোকানে। শোনা যায়, বিয়ের খরচটাও নাকি এসেছে বাংলো থেকে। তবে খগেনমাঝির তাতে কিছু যায়-আসে না। সে সুন্দরী বউ পেয়ে খুব খুশি। বউ ওকে খুব ভালোবাসে। বাগানের অন্য বউদের মতো ওর সঙ্গে ঝগড়া করে না। যা বলে চুপচাপ শোনে। ওকে খুব যত্ন করে। বাগান থেকে না ফেরা পর্যন্ত নিজে খায় না। খগেনমাঝি ফিরে এলে একসঙ্গে খায়।

বিয়ের পর থেকে মালিকের কাছে ওর কদর বেড়েছে। ডেকে ডেকে অনেক কথা বলে। বউয়ের কথাও জানতে চায়। হঠাৎ করে ওর রোজের টাকাও বেড়ে গেছে। টাকা বাড়ানোর সময় সর্দারকাকা কেমন করে যেন হেসেছিল। সর্দারকাকা ওর বাবার সময় থেকে বাগানের সর্দার, তাই তাকে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করা হয়নি। তাছাড়া বাড়তি টাকা পেয়েই খুশি ছিল, অন্য কোনো প্রশ্নই মনে আসেনি। বেশি টাকা পেয়ে লক্ষ্মীমনির জন্য একটা লাল জরিপাড়ের শাড়ি কিনে এনেছিল। বউ খুব খুশি। তারপরও বারবার জানতে চাইছিল এত টাকা কোথায় পেল। মেঘের মতো দু-চোখে যেন ঝড়ো হাওয়ার পূর্বক্ষণ দেখা দিয়েছিল।

দিনগুলো ভালোই কাটছিল। আজকাল তাড়ির দোকানে গেলে অন্যরা বেশ সমীহ করে বেঞ্চ ছেড়ে দেয়। তাড়ির চাঁট এগিয়ে দেয়। নিজেকে বেশ ভদ্দরনোক ভদ্দরনোক মনে হয়। ওদের সঙ্গে গলা তুলে কথা বলে। কিন্তু ঘরে ফিরে গেলে চুপসে যায়। লক্ষ্মীমনির চোখে আর আগের মতো বিদ্যুৎ চমকায় না। আগের মতো হেসে গড়ায় না অন্যবাগানের সেরা ফুলটি। তাড়ির ঘোরে খগেনমাঝি ভাবে, কীভাবে এই ভাঙা কুটির চাঁদের আলোয় ভরিয়ে তোলা যায়। নেশা কেটে গেলে আবার ফিরে যায় ছোট মালিকের কাছে। স্বপ্ন দেখে একদিন এই বাগানের সর্দার হওয়ার।

এক সকালে বাংলো থেকে ডাক এলো। ছোট মালিকের শাশুড়ি বেড়াতে এসেছে, এসেই অসুস্থ হয়ে গেছেন। দেখাশোনা করার জন্য লক্ষ্মীমনিকে যেতে হবে। দিন সাতেক পর ফিরে আসতে পারবে। শুনেই খগেনমাঝির বুকের ভেতর একটা যেন গাছ উপড়ে পড়লো। উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আছে সর্দারকাকার দিকে।

খবরটা দেওয়ার সময় কী সর্দারকাকার চোখে বিদ্রূপের ঝিলিক ছিল?

ছোট মালিকের কথা মানতে হবে। উপায় নেই। এদিকে সর্দার হওয়ার গোপন ইচ্ছা, অন্যদিকে ছোট মালিকের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক, কোনোটাই কম লোভনীয় নয়। কথাটা শোনার পর থেকে বউ একটা কথাও বলেনি। দু-চোখে ছিল পরিত্যক্ত বাগানের শূন্যতা। শ্লথ হাতে একটা পুঁটলিতে দুটো শাড়ি গুছিয়ে নিল, খগেনমাঝির কেনা জরিপাড় লালশাড়িটাও।

পরদিন সকালে খগেনমাঝির পেছনে পেছনে লক্ষ্মীমনি ছোট মালিকের বাংলোতে পৌঁছে গেল। হাতে কাপড়ের পুঁটলি আর পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা খগেনমাঝির আদুরে বউয়ের ঠাঁই হলো ছোট মালিকের বাংলোতে। বাংলোর গেট থেকে বউকে বিদায় দিয়ে ফিরে এলো। বারবার তাকাচ্ছিল। লক্ষ্মীমনি একবারও ফিরে দেখেনি। নতমুখে মোজাইক মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা বউয়ের নথ কী সামান্য দুলে উঠেছিল তীব্র অভিমানে?

খগেনমাঝির ঠিকানা এখন তাড়ির দোকান। শূন্যঘরে ফিরতে মন চায় না। ছোট্ট ঘরটা লক্ষ্মীমনির ভালোবাসায় সাজানো। ঘরটা এখন খগেনমাঝিকে গিলে খেতে আসে। যেদিকে তাকায় বউয়ের হাসিমাখা হাতছানি ওকে ব্যাকুল করে তোলে। দিন গুনছে কখন লক্ষ্মীমনি ফিরে আসবে।

একসকালে তাড়ির নেশায় আচ্ছন্ন খগেনমাঝির কাছে খবর এলো, ছোট মালিক ঢাকা ফিরে যাচ্ছে। সঙ্গে শাশুড়ি এবং পরিবারের অন্য সবাই। ছুটতে ছুটতে বাংলোতে পৌঁছে দেখে ওরা আগেই স্টেশনে চলে গেছে। বাংলোতে সব কাজের লোক আছে, শুধু খগেনমাঝির সুন্দরী বউটা নেই। আবার ছুটলো স্টেশনের দিকে। সে যখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকলো ট্রেন তখন স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার জন্য দুলে উঠেছে। একটা রিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে ছোট মালিকের শাশুড়ির সঙ্গে লক্ষ্মীমনি উঠেছে। খগেনমাঝি জানালা দিয়ে বারবার বউয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। লক্ষ্মীমনি শূন্যদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। খগেনমাঝির হাত নাড়া আর ডাকাডাকি ওর বোধের ওপর কোনো রকম আঁচড় কাটছে না।

বিশাল অজগর সাপের মতো ট্রেনটা লক্ষ্মীমনিকে উদরে নিয়ে চলে যাচ্ছে, খগেনমাঝি এখন নবীনমাঝি হয়ে কাটা ছাগলের মতো প্ল্যাটফর্মে পড়ে গোঙাতে লাগল। খগেনমাঝির মায়ের মতো কেউ তো এসে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছে না, কেউ তো বলছে না – 

‘মাঝি, তুক হামি বহুত পেয়ার করি, হামাক ছাড়ি যাসনি মাঝি, হামি ভি যাবেক নাহি।’