লাকডাউন

‘কি গো তোমার কাছে নারকেল হবে?’

ফলমূলের পসরা সাজিয়ে বসা মোটাসোটা দোকানি। তার দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সেই অধৈর্য ভদ্রমহিলা। ক্যারিব্যাগভর্তি বাগদা চিংড়ি। কেজিখানেক তো হবেই। মুখের গোমইটা আর একটু শক্ত করে ধরে আবার সেই একই প্রশ্ন –    ‘নারকেল হবে নারকেল?’

গোমই!

এখন সবার মুখে মুখে! বাবুরা অবশ্য মাস্কো না কী সব বলেন! কেলো একটুও ইংরেজি জানে না। অনেকবার চেষ্টা করেও সঠিক উচ্চারণটা করতে পারেনি। তাই গেঁয়ো ভাষায় গোমই শব্দটাই ব্যবহার করে। তবে মনে মনে। ছাগলের মুখে আটকে দেওয়া বাঁশকঞ্চির ঢাকনা, যাতে অন্যের বাগান, গাছগাছালিতে মুখ দিতে না পারে। কিন্তু মানুষ যে কেন এমন গোমই পরে, এখনো বুঝতে পারেনি। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত বুঝেছে, বাগদা বা গলদা চিংড়ি হাতে নিয়ে যদি কেউ নারকেলের খোঁজ করে, মালাইকারির ব্যাপারস্যাপার একেবারে নিশ্চিত। অতএব জিভটা কেমন ভিজে ভিজে ঠেকল! কিন্তু কেলো কীভাবে জানল চিংড়ির সঙ্গে নারকেল মিশলে মালাইকারি নামক একটা সুস্বাদু খাবারের জন্ম হয়? আলবাত জানে! ওর মা যে বাবুদের বাড়িতে কাজ করে! মানে করত! দু-একবার নিয়েও এসেছে। আহা, কী সোয়াদ! লকডাউন শুরু হতেই মায়ের কাজও বন্ধ। রাজমিস্ত্রির জোগানদার বাপটাও এখন দিনরাত ঘরের ভেতর। তবে লকডাউনটা ঠিক কী বস্তু, কেলো সেটাও জানে না। তবে অল্পস্বল্প যা বুদ্ধি তাতে বুঝেছে, লকডাউন হলো এমন এক অবস্থা যখন টিরেন-বাস চলে না, কিন্তু মোটরবাইক, চার চাকা চলে! বাজারহাটও খোলা থাকে। মাছ, শাকসবজি, এমনকি মাটন-চিকেনও পাওয়া যায়। তবে সবার জোটে না। যাদের পকেটে রেস্ত আছে, তারাই ওসব খাতি পায়। আরো অনেক নিয়মকানুন আছে। এই যেমন ফলের দোকান খোলা যাবে, ফুলের দোকান চলবে না! গণশার মুখটা আবার মনে পড়ল! কেলোর চেয়ে বছর তিনেকের বড়। পড়াশোনাতেও ভালো। ওর বাবার ফুলের ব্যবসা! কত ফুল যে নষ্ট হচ্ছে! প্রতিদিন। আর পাঁচজনে লকডাউন বললেও গণশা বলে লাকডাউন!

‘তুই বল কেলো, আমার বাপটা যদি ফুলের ব্যবসা না করে ফলের ব্যবসা করত, তবে কি এমন খারাপ দিন দেখতে হতো? ভাগ্য খারাপ হলে লাকডাউনই বলতে হয়।’

ঠিকই তো! তবু কেলো ঠিক বুঝতে পারে না! ফলের বাজার রমরমিয়ে চলছে, কিন্তু ফুলের বাজার নেই কেন? মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়েই গেল!

‘তুই যেমন মুখ্য! এই লাকডাউনের বাজারে ফুল কোন কম্মে লাগবে? ফল তো খাবার জিনিস!’

ঠিকই তো! নিজেকে মুখ্য ভাবতে কেলোর কোনো অসুবিধাই নেই! কিন্তু ওই যে ঠোঁট দুটো বড় বেয়াদব! কখন কী বলতে হয় –

‘কিন্তু মরে গেলে তো ফুল লাগে! দিদা যখন ওলা ওঠায় মারা গেল, তখন কত কত ফুল দিয়ে সাজানো হলো! ফুল তো তোরাই দিলি – এই তো সেদিনের কথা। এখন এত এত মানুষ করোনায় মরতাছে, তবে ফুল কেন লাগবে নি? এই গণশা, করোনা ব্যাপারটা কী রে?’ করোনা ব্যাপারটা ঠিক কী, গণশাও ঠিক জানে না। এমন একটা রোগ যাতে অনেক অনেক মনিষ্যি মারা যাচ্ছে, এইটুকু জানে! কিন্তু কেলোটার ঘটে কি একটুও ঘিলু নেই!

‘করোনায় তো সব সাহেব-মেম মারা যাচ্ছে। আমি সব খবর রাখি। আমেরিকা, ইতালি – তবে ওরা ফুল দিয়ে মরা সাজায় কি না জানি না! সাজালেই বা কি! আমার বাপের ফুল কি আমেরিকা যাবে? লাকডাউন হলে এমনই হয় বুঝলি! কাল কিছু পেটে পড়েনি। আজ হয়তো চাল-আলু পাব কিছু।’

কেলোর মগজটা কিলবিলিয়ে ওঠে। আমেরিকায় মরছে তো আমাদের কি? অনেক কষ্টে জিভটা সামলে নিল। কারণ উত্তরটা জানে। গণশা কী বলবে।

‘তোর আমার এখনো হয়নি! হতেও তো পারে! তাই এই লকডাউনের ব্যবস্থা বুঝলি গর্দভ!’

হয়নি কিন্তু হতি পারে! এই ভেবেই তো সব্বাই গোমই পরে ঘুরতাছে। কিন্তু খাওয়া-দাওয়া, বাজারহাট, গলদা-বাগদার মালাইকারি কিছুই তো বন্ধ হয়নি!

দু-দুটো নারকেল ব্যাগে পুরে ভদ্রমহিলা যখন বাড়ির পথ ধরল কেলোর কাজ তখনো বাকি। একটাও ওষুধের দোকান চোখে পড়ছে না।

কাল থেকেই বাবার শরীরটা খারাপ। চিন্তায় ভাবনায় কেমন হয়ে গেছে। কোটরবন্দি চোখে একটুও আলো নেই। রাতে আচমকাই বুক ব্যথা! সব ডাক্তারখানাই বন্ধ। অগত্যা হাসপাতাল। তাও পায়ে হেঁটে। সেখান থেকেই কী একটা লিখে দিয়েছে। পাড়ার সব দোকান বন্ধ। বাজারে যদি কোনো দোকান খোলা পায়, এই ভেবেই এতটা আসা – ওই তো একটা দোকান!

কেলোও এবার বাড়ির পথে। হাতে ওষুধের প্যাকেট। পথটা কেমন লম্বা মনে হচ্ছে। খিদেও পেয়েছে খুব। এতক্ষণে নিশ্চয় রান্না হয়ে গেছে। যদিও আলু-ভাতে। খিদের পেটে সবই অমৃত। যাক পরের বাঁকটা ঘুরলেই বাড়ি! কিন্তু এ কী! চারদিকে এত লোক কেন! গোমই পরা পুলিশ, বাতি লাগানো গাড়ি।

‘এই কেলো? কোথায় যাচ্ছিস? থেমে যা!’

গণশার গলা মনে হচ্ছে! ঠিক তাই। কিন্তু ও এখানে কী করছে!

যাক, মনে একটু বল পেল। এত এত লোক! ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক! কিন্তু এত লোক কেন?

কেলোর আর্তনাদটা ঠিক কার উদ্দেশে বোঝা গেল না!

‘তোর বাবা আর নেই কেলো! ওষুধ ফেলে দে! এ কী এত কাছে কেন? দূরে যা। অন্তত এক মিটার!’

‘এসব তুই কী বলছিস গণশা! আমার যে খুব কান্না পাচ্ছে। গতবার যখন দিদা মারা গেল তুই-ই তো ফুল আনলি। বাবা কি একটাও পাবে না? কত ফুলই তো নষ্ট হচ্ছে। বাবার জন্য দে না কয়েকটা -’

‘ওটা অন্য কেস! তোর বাবার কি কাশি হয়েছিল? সবাই বলাবলি করছে!’

‘হ্যাঁ বাবা তো হাঁপানির রোগী! বাড়াবাড়ি হলেই কাশে। তুই তো সবই জানিস গণশা! অমন করে তাকাচ্ছিস কেন? তোর চোখদুটো কেমন অন্যরকম!’

‘ন্যাকা ষষ্ঠী। এখন কাশি হওয়া মানে বুঝিস? ওই দ্যাখ। ওরা তোকে নিতে আসছে। আমি পালাই। ভালো থাকিস।’

কিছু বুঝে ওঠার আগেই গণশা কেমন হাওয়া হয়ে গেল। যতদূর চোখ যায়, শুধু গোমই আর গোমই! কেলোকে লক্ষ করেই ওরা ছুটে আসছে। ওষুধের প্যাকেটটাও আর হাতে নেই। বড়ির ঠোঙাটাতে বাতাস।

ধুলো মেখেও আকাশ খুঁজছে।

‘বাবা! বাবা গো!’

চাপা ঠোঁটের ভেতর থেকে যা বেরিয়ে এলো, তাকে কি আর্তনাদ বলা যায়। কে জানে!

কেলো কি এখনো দাঁড়িয়ে আছে? ঠিক বুঝতে পারছে না। শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া হাত-পায়ে একটুও শক্তি নেই। কান্নাটাই শুধু দলা পাকাচ্ছে। নিকটবর্তী হওয়া রাশি রাশি গোমই অতিক্রম করে তবু গণশার গলাটাই ভেসে এলো – ‘লাকডাউন!