লাল জামা

ফয়জুল ইসলাম

Lal jama

 

রাকিবুল হাসান যদি সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম মহলস্ন­vর ১১১ নম্বর বাসাটা ভাড়া না-নিত তবে তার দ্বিতীয় পুত্র শাহিন লাল রঙের ছোট্ট একটা জামা কিনে ফেলার সিদ্ধামত্মটা হয়তো কোনোদিনই নিত না এবং স্বর্গত কমলকুমার মজুমদারের লেখা ‘লাল জুতো’ নামের গল্পটার প্রসঙ্গও আসত না এখানে।

আজ থেকে ঊনত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের ফাল্গুন মাসের এক দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন আর রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঝের মাঠটায় বন্ধুদের সঙ্গে বসে চটপটি আর ফুচকা খাচ্ছিল শাহিনদের পড়শিবাড়ির মেয়ে ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী মহুয়া। প্রচ- রৌদ্রের দাপটে ঘাস পুড়ে গিয়ে মাঠটা তখন রম্নক্ষ হয়ে গিয়েছিল। কলাভবনের তিনতলায় অর্থনীতি বিভাগের অফিসরম্নমের পাশে তখন একটা ক্যান্টিন চালাত অর্থনীতি বিভাগের পিয়ন কানুদা। কানুদার ক্যান্টিন থেকে যথারীতি একটা আলুর চপ, চা আর স্টার সিগারেট খেয়েছিল সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শাহিন। তারপর সে তার বন্ধুদের বলেছিল : বাসায় যাইরে! সন্ধ্যাবেলায় টিএসসিতে দেখা হবে। শাহিনের বন্ধুরা যথারীতি আপত্তি করেছিল তখন। সূর্যসেন হলের রসুল তাকে বলেছিল : দুর ব্যাটা! এত তাড়াতাড়ি বাসায় যাবি কী করতে? দুপুর একটাই তো বাজেনি এখনো! তবু কানুদার দোকানের বেঞ্চ থেকে আড্ডা ভেঙে উঠে পড়েছিল শাহিন। সে আসলে বাসায় যেতে চায়নি। শাহিনের ইচ্ছে ছিল, ক্যাম্পাসে সে তাদের পড়শিবাড়ির মেয়ে মহুয়াকে খুঁজবে। মহুয়া যদি তার সঙ্গে নিউমার্কেটে যেতে রাজি হয়েই যায়, তবে তার আশপাশে থাকা হয় কিছুক্ষণ এবং সেইসঙ্গে তার নিজের একটা পাঠ্যবইও কেনা হয়ে যায় এমনটাই ভেবেছিল সে; কিন্তু তখন ইতিহাস বিভাগের সেমিনার রুমে মহুয়া ছিল না। মহুয়াকে খুঁজতে তাই কলাভবন আর  রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঝের মাঠে যেতে হয়েছিল তাকে।

ফাল্গুনের সেই দুপুরে শাহিনের সঙ্গে নিউমার্কেটে যেতে রাজি হয়েছিল মহুয়া, তবে একটা শর্তে, সে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চেপে বাসায় যাবে না; নিউমার্কেট থেকে রিকশায় করে সে তাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় ফিরবে এবং রিকশাভাড়াটা দিতে হবে শাহিনকেই। শাহিনের পকেটে তখন বই কেনার টাকাটা বাদে খুব একটা বেশি টাকা ছিল না। তবু সেই কঠিন প্রস্তাবে সে রাজি হয়েছিল মহুয়ার সঙ্গে সময় কাটানোর লোভে-লোভে। তারপর তারা হেঁটে-হেঁটে কলাভবন থেকে নিউমার্কেট গিয়েছিল। বলাকা সিনেমাহলের উল্টোদিকের গেট দিয়ে নিউমার্কেটে ঢোকার পর শাহিনকে মহুয়া বলেছিল, দাঁড়াও তো! আগে সালোয়ার-কামিজের একটা কাপড় খুঁজে আসি। তারপর বইয়ের দোকানে যাব। বাবলি যা সুন্দর একটা  ড্রেস বানিয়েছে না! খুব সুন্দর কাপড়টা! তাতেও সাগ্রহেই রাজি হয়েছিল শাহিন, কেননা বস্ত্ততপক্ষে তার বাসায় ফেরার কোনো তাড়াই ছিল না এবং পাঠ্যবই কেনাটা তার কাছে মোটেই জরম্নরি বলে মনে হচ্ছিল না তখন। সেই মুহূর্তে মহুয়ার সঙ্গই বরং আরাধ্য ছিল তার কাছে। সিদ্ধেশ্বরীতে তারা পাশাপাশি বাসায় থাকলেও মহলস্নায় তাদের দেখাসাক্ষাৎ তেমন একটা হতো না। মহুয়া যদি তার ছোট বোন তনুর সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাসায় যেত এবং পাকেচক্রে সে যদি বাসায় থাকত তখন, তবেই মহলস্ন­vয় মহুয়ার সঙ্গে দেখা হওয়াটা সম্ভব ছিল, নতুবা নয়।

কাপড়ের দোকানে মহুয়া ঢোকার পর নিউমার্কেটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল শাহিন এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে সে তাকাচ্ছিল এদিক-ওদিক। তখনই উল্টোদিকের এক দোকানে সে ঝুলতে দেখেছিল ছোট্ট লাল জামাটা। শিশুকন্যাদের জন্য তৈরি করা জামাটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তার মননে আন্দোলিত হয়েছিল অজানা এক শিহরণ। তার মনে ভেসে উঠেছিল মহুয়ার আদলের মতোই একজন শ্যামল রঙের শিশুকন্যার অস্পষ্ট ছবি – টানা ভুরম্ন, ভাসা-ভাসা  চোখ, টিকলো নাক, পাতলা ঠোঁট আর সামান্য খাঁজের থুতনি। ছোট্ট লাল জামাটা দেখার পর মহুয়ার চেহারা মনে আসাতে তখন খুবই অবাক হয়েছিল শাহিন। তারপর সে তড়িতে সালোয়ার-কামিজের কাপড় পছন্দরত মহুয়াকে হাত ধরে টেনে দোকানটার বাইরে নিয়ে এসেছিল; নিউমার্কেটের ভেতরের প্রশসত্ম রাস্তাটা জলদি পার হয়েছিল হতভম্ব মহুয়ার হাত ধরে; এবং শিশুদের পোশাক-পরিচ্ছদের দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছোট্ট লাল জামাটার দিকে আঙুল নির্দেশ করেছিল। মহুয়াকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল : জামাটা কেমন? বিস্ফারিত চোখে ছোট্ট লাল জামাটার দিকে মহুয়া তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ ধরে। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে শাহিনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় সে বলেছিল, আমি এই জামাটা কিনতে চাই। মহুয়া এই কথা বলেছিল যেহেতু তার মনেও তৎক্ষণাৎ ভেসে উঠেছিল শ্যামবর্ণের একজন শিশুকন্যার আবছা ছবি, যার লম্বাটে নাক পাতলা গড়নের মুখের ওপরে বসেছিল বেখাপ্পাভাবে। সেই শিশুকন্যার ছবিটা খুবই চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল তার। মহুয়া তখন কয়েক সেকেন্ড ধরে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখেছিল শাহিনের রোদে পুড়ে যাওয়া মুখটা। শিশুকন্যার আবছা ছবির সঙ্গে সে কেবল শাহিনের চেহারারই মিল খুঁজে পেয়েছিল এবং সে সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল ভয়ানক লজ্জায়।

দোকানদারকে প্রশ্ন করেছিল শাহিন : ঠিক কত বয়সের মেয়েদের জামা এটা? দোকানদার উত্তর করেছিল – পাঁচ-ছয় মাসের মেয়েদের জামাটা পরানো যাবে। তা

দাম কত হবে জামাটার? দোকানদার দাম হেঁকেছিল দেড়শো টাকা। দাম নিয়ে কোনো মুলামুলি চলবে না, তাও জানিয়েছিল দোকানদার। সঙ্গে-সঙ্গে শাহিন তার প্যান্টের পকেট থেকে দেড়শো টাকা বের করে দোকানদারকে দিতে গিয়েছিল। আর মহুয়া তখন চোখ গরম করে তার দিকে তাকিয়ে, তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দামদর করতে শুরম্ন করেছিল দোকানদারের সঙ্গে : একশ টাকার ওপরে এক পয়সাও বেশি দেওয়া হবে না! শেষ পর্যমত্ম দোকানদার একশ কুড়ি টাকা পর্যমত্ম নেমেছিল। তখন মহুয়া ছেড়ে দিয়েছিল দামদর করাটা। শাহিন জামাটার দাম পরিশোধ করলে জামাটা একটা হালকা খয়েরি রঙের কাগজের প্যাকেটে ভরে দিয়েছিল দোকানদার। কাগজের প্যাকেটে মোড়ানো ছোট্ট লাল জামাটা বুকের ভেতরে একবার জড়িয়ে ধরে জামাটায় ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে শাহিনকে মহুয়া বলেছিল, জামাটা আমার কাছেই থাক। তাতে আপত্তির কোনো কারণ ছিল না শাহিনের। শাহিনের মনে হয়েছিল, মূল্যবান এই জামাটা পরম যত্নে নিজের কাছে রেখে দিতে পারে এমন বিশেষ কোনো জায়গা তার  নেই। মহুয়ার নিজস্ব একটা ট্রাঙ্ক আছে বলে সে জানে, যেটা থাকে মহুয়ার খাটের নিচটায়। সেখানেই বরং নিরাপদে থাকবে জামাটা।

একথা স্মরণ করা যেতে পারে যে, ছোট্ট লাল জামাটা কেনার পর শাহিনের পকেটে সেদিন আর তেমন টাকা অবশিষ্ট ছিল না যা দিয়ে কোনো পাঠ্যবই কেনা যাবে। তাই আর শাহিনের পাঠ্যবই কেনা হয়নি সেদিন। তা নিয়ে শাহিনের বিন্দুমাত্র দুঃখ ছিল না।  দোকানটার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে-টানতে তখন মহুয়াকে স্বর্গত কমলকুমার মজুমদারের ‘লাল জুতো’ নামের গল্পটা বলেছিল শাহিন : কোনো একটা দোকানে এক জোড়া ছোট্ট লাল জুতো দেখে স্বপ্নাবিষ্ট হয়েছিল একজন কিশোর। নিজের জুতো কেনা বাদ দিয়ে ছোট্ট লাল জুতো জোড়া সে কিনে ফেলেছিল এবং জুতো জোড়া সে দেখিয়েছিল তার পছন্দের কিশোরীকে। বেদনামাখা গভীর নিশ্বাসে সেই কিশোরী তার নিজের বুকের ভেতরে জোরে  চেপে ধরেছিল লাল জুতো জোড়া এবং চুম্বন করেছিল। পরে স্বর্গত কমলকুমার মজুমদারের শ্রেষ্ঠ গল্প মহুয়াকে কিনেও দিয়েছিল শাহিন। কোনো একবার বাসা বদলের সময়, সম্ভবত কিশোরগঞ্জ থেকে সাতক্ষেরায়, শেষ পর্যমত্ম মহুয়া হারিয়ে ফেলে সে-বইটা। খুব মন দিয়ে মহুয়া পড়েছিল ‘লাল জুতো’ নামের গল্পটা এবং পড়ে অভিভূতও হয়েছিল ভীষণ। তবে শাহিনের আবেগঘন ভাষ্যটাই তার মনে দাগ কেটেছিল বেশি। এখনো তার মনে আছে শাহিনের স্বপ্নাবিষ্ট দুটো চোখের সেই উজ্জ্বলতার চিহ্নটুকু। স্বপ্নের তেমন উদ্গিরণ কোনোদিনই মহুয়া খুঁজে পায়নি এই পৃথিবীর আর কোনো পুরম্নষের চোখে, এমনকি তার অতিসজ্জন জামাই আবুল বাশারের চোখেও নয়, যখন তাদের একমাত্র কন্যা সোহা তার গর্ভে এলো, তখনো নয়।

ইনকাম ট্যাক্সের ছাপোষা উকিল রকিবুল হাসান যদি সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম মহলস্নার ১১১ নম্বর বাসাটা ভাড়া না-নিত তবে মহুয়া আর শাহিনের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। আসলে রাকিবুল হাসান শহীদবাগের বাসাটা ছাড়তে চায়নি। তার সব মক্কেলদেরই অফিস মতিঝিল এলাকায় হওয়ার কারণে শহীদবাগ থেকে সে খুব জলদি মতিঝিল পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তু গোলটা বাধায় তার মেয়ে তনু, যে কিনা তখন বাড়ির কাছের সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলে পড়ত। সেই তনু ১৯৮১ সালে ক্লাস সেভেন  থেকে ক্লাস এইটে উন্নীত হতে ব্যর্থ হয়। তখন তনুর জন্য নতুন একটা স্কুল খুঁজতে নামতেই হয় তার দুশ্চিমত্মাগ্রসত্ম পিতাকে। প্রথমেই রকিবুল হাসানের মনে আসে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক তার বাল্যবন্ধু আফতাবের কথা। আফতাবের দাক্ষেণ্যেই তনুকে সে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়ে দিতে পারে। তো নতুন স্কুলে যাওয়া শুরম্ন করে তনু। শহীদবাগ থেকে সিদ্ধেশ্বরী এলাকাটা কিছুটা দূরে বিধায় রিকশায় করে তনুর নতুন স্কুলে যাওয়া-আসাটা সাব্যসত্ম হয়। শহীদবাগ থেকে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে যাতায়াত বাবদ তনুর জন্য রিকশাভাড়া গোনাটা রকিবুল হাসানের কাছে তখন বাহুল্য বলেই মনে হতে থাকে। সে-কারণে তনুর নতুন স্কুলের কাছাকাছি সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় কম ভাড়ার একটা বাসা খুঁজে পাওয়াটাও জরম্নরি হয়ে দাঁড়ায়। সিদ্ধেশ্বরীতে বাসা খোঁজার পেছনে গৌণ একটা কারণও প্রণিধানযোগ্য। রকিবুল হাসানের বড়  ছেলে শাহিন তখন সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র। ছেলে বলেই তার জন্য রিকশাভাড়া বরাদ্দের প্রশ্নই ওঠেনি কোনোদিন। তবে রকিবুল হাসান হিসাব করে দেখে, সিদ্ধেশ্বরীতে বাসা ভাড়া নিতে পারলে শাহিনকে আর শহীদবাগ থেকে হেঁটে-হেঁটে স্কুল করতে হয় না। সেই মুহূর্তে সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় যে কটা বাসা ফাঁকা পাওয়া যায়  সেগুলোর ভেতরে একমাত্র ১১১ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের টিনের চাল-ইটের গাঁথুনির শ্রীহীন বাসাটার ভাড়া সহনীয় বলে মনে হয় রকিবুল হাসানের কাছে। কাজেই বিনা বাক্যব্যয়ে সে ভাড়া নিয়ে ফেলে সে-বাসাটা। শহীদবাগের চাইতে সিদ্ধেশ্বরী এলাকাটা ছিমছাম বিধায় নতুন বাসাটার ভাড়া শহীদবাগ এলাকার তুলনায় একটু বেশিই পড়ে যায়। রকিবুল হাসান নিজেকে প্রবোধ দেয় এই বলে যে সহসাই তার আইনি ব্যবসার উন্নতি হবেই হবে এবং তখন নতুন বাসাটার ভাড়া টানতে আর কোনো অসুবিধা হবে না তার।

সেগুনবাগিচার এজি অফিসের কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন তখন খরিদসূত্রে ১১০ নম্বর বাসাটার মালিক। তার ছোট মেয়ে মহুয়া সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রী। একদিন বিকেলে তাদের দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে দেখতে পায়, ১১১ নম্বর বাসায় তাদের ক্লাসের নতুন ছাত্রী তনুদের পরিবার ভাড়া এসেছে। সেই বাসাটার উঠানে একটা মোড়ায় বসে সুতো দিয়ে কাপড়ে ফুল তুলতে থাকা সহপাঠী তনুকে দেখে তখন মহুয়া খুব খুশি হয়ে ওঠে এবং সে তাদের দোতলার বারান্দা থেকে চিৎকার করে ডাকে – এই তনু! তুমি এইখানে? মহুয়াকে দেখে হাঁপ ছেড়েই বাঁচে শহীদবাগে  ফেলে আসা বন্ধুদের জন্য ভীষণ মন খারাপ করে বসে থাকা তনু। তার মনে হয় যাক! তাহলে নতুন মহল্লায় পরিচিত একজন মানুষ পাওয়া গেল!  সেই থেকে সখ্য তৈরি হয় মহুয়া আর তনুর ভেতরে। সকালবেলায় দুই বন্ধুতে একসঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে স্কুলে যায়। বিকেলে তারা একসঙ্গেই স্কুল থেকে বাসায় ফেরে। মহুয়া লক্ষ করে, তনুর একজন ভাই আছে যার বয়স তাদের বয়সেরই কাছাকাছি।  দোতলায় নিজের ঘরের জানালায় কখনো দাঁড়ালে অথবা কখনো তার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গেলে মহুয়া দেখতে পায় তনুর ভাই শাহিন। লম্বা গড়ন, শ্যামলকামিত্ম, টানা-টানা চোখ। স্কুল থেকে ফিরে বারান্দার চেয়ারে বসে-বসে বই পড়ছে সারাক্ষণ। তাছাড়া মহুয়া লক্ষ করে, ছেলেটা সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পেছনের মহলস্ন­vয় কখনোই আড্ডা দেয় না। তনুর কাছ থেকে মহুয়া পরে জানতে পারে, তনুর ভাই শাহিন মাসুদ রানা সিরিজের বইয়ের বেজায় ভক্ত। তবে শাহিন এমনিতেই বই পড়ে অনেক। গল্প-উপন্যাস থেকে শুরম্ন করে ইতিহাস-ভূগোল-পৌরনীতি পর্যমত্ম, কেবল মাসুদ রানাই নয়। আর সবসময় শাহিনের মন পড়ে থাকে শহীদবাগে।  সেখানে তার অনেক বন্ধুবান্ধব।

তো একদিন তনুদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে মহুয়া শাহিনকে জিজ্ঞাসা করে : আমি কি আপনার বই ধার নিতে পারি? গম্ভীর শাহিন সংক্ষেপে বলে, নিতে পারো। তবে বই হারিয়ে না-ফেললে­ই হয়! সেই  থেকে মহুয়ার পড়ার টেবিলে, বিছানায়, বারান্দার চেয়ারে আর স্কুলের ব্যাগে কেবল মাসুদ রানা আর মাসুদ রানা। শ্যামলকামিত্মর স্পর্শ জমাট বেঁধে থাকে সেসব বইয়ের পাতায়-পাতায় আর তাতে করে কিশোরীর মনে জাগে অচেনা অনুরণন। কী বলে সেই অনুভূতিকে? সহপাঠীদের বিভিন্ন কথোপকথন থেকে আর বড়দের জন্য লেখা গল্পের বই পড়ার সূত্রে সেই অনুভূতির নামটা তো তার অজানা নয়! তাই নিজের ভেতরে প্রকম্পিত হয়, খুব অসহজ হয় মহুয়া। সেসবের কিছুই অবশ্য জানতে পারে না শাহিন। শাহিন কেবল প্রতীক্ষা করে কখন মহুয়া তার ঘরের জানালায় অথবা বারান্দায় এসে দাঁড়াবে একটুখানি, কখন সেই মেয়েটা তার কাছ থেকে বই ধার নিতে আসবে, আর আলোকছটায় জ্বলে উঠবে তার হৃদয়। শাহিনের সেই প্রতীক্ষা অবশ্য দীর্ঘায়িত হয় না কখনো। কোনো একদিন শাহিন মহুয়াকে জিজ্ঞাসা করে – তুমি কখনো মহুয়াফুল দেখেছ নাকি? মহুয়া বলে, না। তার পরদিন, চৈত্রের কোনো এক ভোরে, রমনা পার্কে গিয়ে একগাদা মহুয়াফুল নিয়ে আসে শাহিন এবং প্যান্টের পকেট থেকে ফুলগুলো বের করে মহুয়ার হাতে দিয়ে বলে, কী সুন্দর গন্ধ, দেখ! যে-ফুলের নামে একদা তার নাম রেখেছিল তার মা, সেই ফুল তখন প্রথম চোখে দেখে মহুয়া এবং সে মুগ্ধ হয়।

একসময় সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রী মহুয়া শাহিনের কাছ থেকে হুমায়ূন আহমেদের তোমাদের জন্য ভালোবাসা নামের বইটা ধার নেয়। বইটার পাতায় মহুয়া পেয়ে যায় একটা চিরকুট যাতে লেখা – ‘সুচেতনা, তুমি এক দূরতম দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে; সেখানে দারম্নচিনি-বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে। এই পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়। কলকাতা একদিন কলেস্লিনী তিলোত্তমা হবে; তবু তোমার কাছে আমার হৃদয়।’ শাহিন তখন আর স্কুলবয় নয়। সে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। মাহমুদ, হারম্নন আর শমির সঙ্গে সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পশ্চিম মহলস্ন­vয় সে তখন দেদার আড্ডা দেয়। শহীদবাগে আর তেমন একটা যায় না শাহিন। পরদিন বিকেলে শাহিনকে মহল্লার পথে ধরে জিজ্ঞাসা করে মহুয়া বইয়ের ভেতরে আপনার হাতে লেখা একটা কাগজ পেলাম। কোন কবিতার লাইন ওগুলো? শাহিন তখন মহুয়াকে জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র পড়তে  দেয়, যে-বইটাতে মহুয়া খুঁজে পায় ‘সুচেতনা’ নামের কবিতাটা। কবিতাটা পড়ে আবারো প্রকম্পিত হয়, আবারো অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে  সে। তাই অনেক প্রতীক্ষার পরও মহুয়ার কাছ থেকে কোনো উত্তর আসে না। শাহিন ভাবে, ক্ষেপেছে মহুয়া! থাক! বইয়ের ভাঁজে  কোনোদিন আর কবিতা দেব না!

জীবনানন্দ দাশের ‘সুচেতনা’ নামের কবিতাটায় শাহিনের হৃদয়ের যে-সমর্পণ ছিল তার উত্তর আসে প্রায় একবছর পর। সেদিন বিকেলে শাহিনদের বাসার সবাই বেড়াতে যায় নারিন্দার মামার বাসায়। সামনে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের চূড়ামত্ম পরীক্ষা বলে বিরসবদনে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে পাঠ্যবই পড়ে শাহিন। তখন কোনো একটা বই ফেরত দিতে শাহিনের ঘরে ঢোকে মহুয়া। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মহুয়ার হাত থেকে শাহিন বইটা নিয়ে তার পড়ার টেবিলে রাখে। ঠিক তখনই মহুয়া হঠাৎ করে শাহিনকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে গভীর একটা চুমু খায়; চুমু খেয়ে মুচকি হাসিতে বলে, এটা আপনার চিরকুটের উত্তর। চরম বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় শাহিন এবং সে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। সেকেন্ডের ভেতরেই তার শারীরিক তৃষ্ণা জেগে উঠলে প্রবল উত্তেজনায়। সে মহুয়াকে টান দিয়ে এনে তার কোলে বসায় এবং সে মহুয়ার ঠোঁটে চুমু খেতে থাকে পাগলের মতো। মহুয়াও উত্তর দেয় সমান তালেই। তারপর মহুয়ার ব্রার হুক খুলে জামাটা গলার কাছে তুলে দিয়ে সে মহুয়ার অপরূপ সত্মনের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মহুয়ার সত্মনে সে হাত রাখে এবং দুই সত্মনাবৃমেত্ম সে চুমু খেতে থাকে অজস্র। উত্তেজনায় মহুয়া গলে-গলে পড়তে থাকে। শারীরিক মুক্তির পথে পা বাড়ানোর ঠিক আগমুহূর্তে থেমে যায় মহুয়া। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে – এভাবে না বাবু! তুমি বরং আমাকে সারা জীবনের জন্যেই নিও। তখন সম্বিত ফিরে আসে শাহিনের। বিপত্তি যেটা হয় যে, সে-ঘটনার পর থেকে শাহিন লজ্জায় আর মহুয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলে না; মহুয়াকে এড়িয়ে যায় সবসময়। তাতে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যায় মহুয়া এবং স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার জন্য মহুয়া আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। সুযোগ পেয়ে একদিন সে শাহিনকে বলে, পাগলামি করছ কেন? তুমি তো অন্যায় কিছু করোনি! মহুয়ার যুক্তি যেন বুঝতে পারে শাহিন! তারপরও সহজ আচরণ শুরম্ন করতে শাহিনের লেগে যায় ছয়-সাত মাসেরও অধিক সময়।

তার বছর দেড়েক পরে নিউমার্কেট থেকে শাহিন আর মহুয়া মিলে কিনে ফেলে ছোট্ট লাল জামাটা। জামাটার গলা আর হাতের অংশে থাকে সাদা পাইপিন আর বুকের অংশে সাদা সুতোয় বুনে  তোলা ছোট্ট একটা বেড়াল। কোনো একদিন কলাভবনের সামনের বিশাল বটগাছটার নিচে বসে গল্প করতে-করতে মহুয়াকে শাহিন জিজ্ঞাসা করে – ধরো, তোমার একটা মেয়ে হলো। তার নাম কী রাখবে তুমি? লাজুক হাসিতে তাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মহুয়া – তুমিই বলো। তখন উত্তর করে শাহিন – কুসুম নামটা কেমন লাগে তোমার? চলবে? মহুয়া বলে, খুবই সুন্দর এ-নামটা। কোথায়  পেলে? বিজয়ীর হাসিতে শাহিন বলে, পুতুল নাচের ইতিকথায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বইটা তোমাকে পড়তে দেব। তখন তাদের স্বপ্নের শিশুকন্যার একটা নাম হয়। মহুয়া ভাবে, লাল জামা গায়ে দিয়ে ছোট্ট কুসুম তার ঘরের বিছানায় বসে-বসে পস্ন­vস্টিকের হাতি, ঘোড়া আর ডাইনোসর দিয়ে খেলবে কোনো না কোনো দিন। আর জনামিত্মকে শাহিন বলে, ক্রিকেট খেলা শেখাতে হবে কুসুমকে। ভারতীয় ক্রিকেট টিমের মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের মতো ক্লাস ব্যাটসম্যান হবে কুসুম।

ছোট্ট লাল জামাটা নিয়ে কদিন খুব মেতে থাকে মহুয়া। তার খাটের নিচের রম্নপালি ট্রাঙ্কটায় সে লাল জামাটা রেখে দেয়। রম্নপালি ট্রাঙ্কটায় তার ব্যক্তিগত সব জিনিসপত্তর থাকে, যেমন শৈশব-কৈশোরের পুরনো স্ক্র্যাপবুক, স্ট্যাম্পবুক, চুল বাঁধার নানা রঙের ফিতা, কতগুলো রঙিন কাগজ, হিন্দি ফিল্মের নায়ক রাজেশ খান্না আর ইতালীয় ফুটবল দলের স্ট্রাইকার পাওলো রসির রঙিন  পোস্টকার্ড, বিভিন্ন আকারের কাপড়ের পুতুল ইত্যাদি। সেসব মহামূল্যবান জিনিসপত্তরের মাঝে সগর্বে স্থান করে নেয় ছোট্ট লাল জামাটা। দিনের ভেতর দশবার ট্রাঙ্ক খুলে লুকিয়ে-লুকিয়ে গভীর স্নেহে জামাটা স্পর্শ করে মহুয়া; জামাটায় সে কুসুম নামের তাদের স্বপ্নকন্যার শরীরের ঘ্রাণ আবিষ্কার করতে চায়; কখনো জামাটা বুকে  চেপে ধরে সে আবেশে চোখ বন্ধ করে রাখে অনেকক্ষণ ধরে, যেন জামা নয়, স্বয়ং কুসুমকেই সে নিজের বুকে জড়িয়ে আছে।

আর এদিকে শাহিনের ছোট বোন তনু তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বলে মহুয়া আর তনুর ভেতর যোগাযোগ কমে যায় সংগত কারণেই। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মহুয়া মাঝে-মাঝে তনুর সঙ্গে দেখা করতে ১১১ নম্বর বাসায় আসে বটে, তনুও মহুয়াদের বাসায় যায়। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে তখন মহুয়ার সঙ্গে বরং শাহিনেরই দেখা হয় বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে প্রতিদিন পরস্পরকে খুঁজে নেয় তারা। তারা আড্ডা মারে, ঘুরে বেড়ায়। বাসে ওঠার বদলে রিকশায় চেপে একসঙ্গে তারা বাসায় ফেরে কোনো-কোনো দিন। সে-দিনগুলোতে কখনো-কখনো শাহিন মহুয়াকে জিজ্ঞাসা করে – লাল জামাটা? মহুয়া উত্তর দেয় – আছে। আমার ট্রাঙ্কের ভেতরে জামাটা বহালতবিয়তেই আছে। ভেবো না তুমি। আর তাতে করে স্বস্তি পায় শাহিন।

বেকারত্ব যে বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করার পর শাহিন তা নিজের জীবন দিয়ে বিলক্ষণ বুঝতে পারে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করার পরপরই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সে চাকরির জন্য দরখাসত্ম পাঠালেও ইন্টারভিউ কার্ড আর সহজে আসে না। সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে ইন্টারভিউ কার্ড আসে কেবল। মহুয়া তাকে বলে, প্রশাসনিক কর্মকর্তার পোস্টটা তো ভালো। এটা যদি হয় তাহলে আমি বেঁচে যাই! লাল জামাটা ট্রাঙ্কের ভেতরে পচে যাচ্ছে! সায়েন্স ল্যাবরেটরির

লিখিত পরীক্ষা উতরে শাহিন মৌখিক পরীক্ষা পর্যমত্ম যায় বটে কিন্তু শেষতক চাকরিটা তার হয় না। ইতোমধ্যে সে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় বসে। সেখানেও সে চূড়ামত্মভাবে নির্বাচিত হতে ব্যর্থ হয়। হতোদ্যম হলেও সে চাকরির জন্য দরখাসত্ম করাটা অব্যাহত রাখে এবং সে একটা পত্রিকা-অফিসের বার্তা বিভাগে খ-কালীন চাকরি শুরম্ন করে দেয়। এদিকে মহুয়ার অনার্স পরীক্ষা শেষ হলে তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যসত্ম হয়ে ওঠে তার বাবা-মা। একদিন সুযোগ বুঝে মহুয়া তার মা আর বড় বোনের কাছে তার পছন্দ প্রকাশ করে। শাহিনকেই সে বিয়ে করতে চায়। এটা জানার পর খুব একটা খুশি হতে পারে না মহুয়ার মা আর তার বড় বোন। যুক্তিতে না-পেরে তারা বলে, এসব নরমসরম, মুখচোরা পোলাপানকে বিয়ে করলে নির্ঘাৎ তুই ডুববি! শাহিনকে কি আমরা আর চিনি না? তবু মহুয়ার চাপের মুখে নতি স্বীকার করে তারা এবং তারা জলদি শাহিনকে বাংলাদেশ সরকারের কেন্দ্রীয় চাকরির ব্যবস্থা করে নিতে বলে। মহুয়ার বাবা তখন এজি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মহুয়ার জামাই হিসেবে স্বভাবতই তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কোনো সদস্যকেই পছন্দ করবেন। বেতন কম হলেও সরকারি চাকরি স্থায়ী। সরকারি চাকরি ছিমছাম, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতাও অনেক। এটাই ছিল মহুয়ার মা আর তার বড় বোনের যুক্তি। অবশ্য সেসব যুক্তির কথা মহুয়া তেমন একটা বুঝতে পারে না।

মহুয়ার উৎসাহে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে ঢোকার জন্য দ্বিতীয় দফায় দরখাসত্ম করে শাহিন। মহুয়ার মাস্টার্স পরীক্ষা এগিয়ে আসে কিন্তু সিভিল সার্ভিসের মৌখিক পরীক্ষার তারিখ আর পড়ে না। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে শাহিন বসে থাকে দিনের পর দিন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওগুলো থেকেও সুসংবাদ আসে না  কোনো। এদিকে মহুয়ার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। বাবার উদ্যোগে পূর্ণোদ্যমে মহুয়ার জন্য জামাই দেখা চলতে থাকে। অস্থির হয়ে শাহিনকে মহুয়া বলে, চলো! পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি! শাহিন উত্তর দেয় – আমরা কি চোর নাকি? আরেকটু দেখি না! সিভিল সার্ভিসের ভাইভার তারিখ জলদি পড়বে বলে খবর পেলাম। তাছাড়া কয়েকটা এনজিওতেও দরখাসত্ম করেছি। কিন্তু শাহিনের কথায় সুস্থির হতে পারে না মহুয়া। তারপর যা হয় – জনৈক সরকারি ডাক্তারকে বিয়ে করার জন্য মহুয়ার ওপরে তীব্র মানসিক চাপ তৈরি করে ফেলে তার বাবা, যে-চাপ আটকাতে মহুয়া ব্যর্থ হয় শেষ পর্যমত্ম। মহুয়াকে তার মা আর বড় বোনও সহযোগিতা করে না। বাবা-মা আর বড় বোনের ওপরে তখন মহুয়ার প্রচন্ড অভিমান। কিন্তু মহুয়ার বিবাহযজ্ঞের আনন্দে সে-অভিমানকে পাত্তাই দেয় না কেউই।

অবশেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হাজিগঞ্জের ডাক্তার আবুল বাশারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় মহুয়ার। বাশারের সরকারি চাকরিসূত্রে এক জেলাশহর থেকে আরেক জেলাশহরে মহুয়া দৌড়ে বেড়ায়। মহুয়া তার ব্যক্তিগত রম্নপালি ট্রাঙ্কটা, যেখানে সে ছোট্ট লাল জামাটা রেখে দিয়েছিল, সেটা আর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে সরায় না। তার মনে হয়, লাল জামাটা থেকে তার দূরে  থাকাটাই শ্রেয়। হাতের কাছে ট্রাঙ্কটা থাকলে ট্রাঙ্ক খুলে সে লাল জামাটা স্পর্শ করবেই করবে আর লাল জামাটা হাতে নিয়ে নিঃসন্দেহে সে বিষণ্ণ হবে। নিশ্চয় সে জামাটা বুকে চেপে ধরবে প্রায়শই এবং তার জখমি আত্মার কান্না দুচোখ গলে পৃথিবীতে নামবেই নামবে! এ-জগতের কেউই হয়তো তার অমত্মর্গত কান্নার অর্থ বুঝতেই পারবে না! এমনটাই মনে হয় মহুয়ার।

এদিকে মহুয়ার বিয়ের পরপর বড় একটা এনজিওতে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি হয়ে যায় শাহিনের। তার কাজ পড়ে যশোরের অভয়নগরে। দ্বিতীয় দফাতেও তার কপালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের চাকরি জোটে না। পরে লোকমুখে মহুয়া খবর পায়  যে, ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাইভারসিফাইড ভিসার জন্য আবেদন করে বীতশ্রদ্ধ শাহিন। ভিসা সে পেয়েও যায় এবং তারপর  থেকে জর্জিয়া রাজ্যের আটলান্টা শহরের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বেকারি শপ, গ্যাস স্টেশন ইত্যাদি জায়গায় কাজ করে জীবনধারণ করতে থাকে সে। তনুর কাছ থেকে মহুয়া একদিন জানতে পারে যে, টরন্টো-প্রবাসী জনৈক তামিল মেয়েকে বিয়ে করেছে শাহিন। সে-খবর শুনে প্রথম-প্রথম ঈর্ষান্বিত হলেও শেষ পর্যমত্ম খুশিই হয় মহুয়া। শাহিনের একগাদা আদর লাগে, এটা তো মহুয়ার অজানা নয়! নিশ্চয় তামিল মেয়েটা অনেক আদর দিয়েছে জনাকীর্ণ মেলায় হারিয়ে যাওয়া একজন বালককে!

তখন মহুয়ার কেবল মনে হতে থাকে, এই পৃথিবীতে তার আর শাহিনের একটা স্বাভাবিক জীবন হতে পারত, যেটা অনেকেরই হয়। অর্থকষ্টে থাকলেও তাদের দুজনের মিলিত জীবন হতো। পেয়ারাবাগ বা নয়াটোলার মতো ঘিঞ্জি এলাকাতেই তারা কম টাকায় বাসা ভাড়া নিত না-হয়। একটা চাকরি খুঁজে নিত মহুয়া আর তাতে করে আয় বাড়ত তাদের সংসারের। কাজ থেকে বিকেলে বাসায় ফিরে একসঙ্গে চা খেত তারা দুজনে। কুসুম নামের একটা ফুটফুটে মেয়ে হতো তাদের, আর লাল জামাটা পরে ছোট্ট মেয়েটা হামা দিয়ে বেড়াত ঘরময়। বাসত্মবে সেসবের কিছুই আর ঘটবে না। স্বপ্নের ভেতরে  বেড়ে ওঠা সেই সুন্দর জীবনের ছবি ফের শূন্যেই মিলিয়ে যায়। সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় তার ঘরের খাটের নিচ থেকে তখন অনেকদিন পর রম্নপালি ট্রাঙ্কটা বের করে মহুয়া। ছোট্ট লাল জামাটা বুকে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে। সারা ঘরে দৌড়ে বেড়ায় দু্ই বছরের  সোহা – বাশার আর মহুয়ার কন্যা। সোহার পিছে-পিছে  ছোটে সোহার বড় বোন বছর দশেকের কুসুম। অশ্রম্নসজল চোখে  সেই দৃশ্যের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে মহুয়া। তবে ছোট্ট লাল জামাটার কথা সে বাশারকে আর বলতে পারে না। বাশার খুবই সহজ-সরল মানুষ। মানুষের স্বপ্নের মৃত্যুর মতো জটিল একটা গল্প  সে আদৌ ঠিকঠাক বুঝতে পারবে কিনা, তা নিয়ে মহুয়া সন্দিহান হয়। মহুয়া ভাবে, থাক! ঝামেলায় ঢুকে লাভ কী?

জেনারেল সার্জারিতে এফসিপিএস করার জন্য মাঝখানে সরকার থেকে দুবছরের ছুটি নিয়ে আইপিজিএমআরে ভর্তি হয় মহুয়ার জামাই বাশার। তখন সায়েন্স ল্যাবরেটরির পেছনের সেন্ট্রাল রোডের অংশে বাসা ভাড়া নেয় মহুয়ারা। লাল জামাটা থেকে দূরে থাকার জন্য এবারো সিদ্ধেশ্বরী থেকে সেন্ট্রাল রোডের বাসায় মহুয়া তার নিজের ট্রাঙ্কটা নিয়ে আসে না। লাল জামা থেকে দূরে থাকলেও স্বপ্নকন্যা কুসুম যথারীতি তাকে জড়িয়ে থাকে সর্বদাই। কিন্তু এ-জীবনের সচলতায় তো স্বপ্নের মৃত্যুর বিশেষ কোনো স্থান নেই; বিষণ্ণতা বা বিলাপেরও অবসর কম। তাই বাশারের মতো সজ্জনের জন্য একাগ্রতা আয়োজনের দরকার পড়ে। ছোট্ট সোহাকে ধানমণ্ডির একটা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়; রান্নাবান্না করতে হয় এবং সন্ধ্যাবেলায় সোহাকে পড়াতেও হয়। দীর্ঘদিন পরে ঢাকায় ফিরে আসার কারণে মাঝে-মাঝে আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধু-বান্ধবের খোঁজখবর নেওয়ার মতো পরিস্থিতিরও উদ্ভব ঘটে। সেই পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্বগুলো মহুয়া সুচারূরূপেই পালন করে যায়। বাশার তখন প্রায়শই মহুয়াকে বলে, সোহা তো বড়ই হয়ে গেল। আরেকটা বাচ্চা নিলে কেমন হয়? মহুয়া জবাব দেয় – নাহ্। আর না! এক বাচ্চা মানুষ করতেই চুল উঠে যাচ্ছে আমার! মহুয়া বাশারকে আর বলে না যে, তার তো দুটো মেয়ে। বড়টা কুসুম আর ছোটটা সোহা। তার আর সমত্মান নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

সেন্ট্রাল রোডের বাসার বিবিধ ব্যসত্মতার ভেতর প্রায় প্রায়ই সিদ্ধেশ্বরী যাওয়া পড়ে মহুয়ার। মা-বাবা-ভাইবোনদের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে-ফাঁকে মহুয়া তার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় একটু দাঁড়ায়। সে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে ১১১ নম্বর বাসাটার দিকে। সেখানে সংসার পেতেছে নতুন কোনো পরিবার। শাহিনরা সেখানে আর থাকে না। ইনকাম ট্যাক্সের ওকালতি জমাতে না-পেরে শাহিনের বাবা শেষ পর্যমত্ম চাঁদপুরে ফিরে গেছে। যতটুকু জানা যায়, জামাইয়ের সঙ্গে মিরপুর সাড়ে এগারোতে থাকে শাহিনের ছোট বোন তনু। আর শাহিন। কুসুম নামের একজন স্বপ্নকন্যার পিতা – হারিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা কানাডার কোথাও। তারপর বারান্দা থেকে নিজের ঘরে ঢুকে প্রতিবারই তার খাটের নিচে রাখা রম্নপালি ট্রাঙ্কটা থেকে ছোট্ট লাল জামাটা বের করে মহুয়া। সবার অলক্ষে সে জামাটা হাতে নিয়ে মেঝেতে বসে থাকে অনেকক্ষণ। জামার ভাঁজে-ভাঁজে সে খুঁজতে থাকে না-দেখা কুসুমের গায়ের গন্ধ; সে চুমু খায় জামাটায়; জামাটা সে বুকে চেপে ধরে রাখে; আর তার চোখে অশ্রম্ন হয়ে নামে একবুক হাহাকার। দূরে কোথাও বিরান কোনো প্রান্তরে পা ছড়িয়ে বসে সমত্মানহারা আলুথালু এক মা তখন বিলাপ করে চলে – কুসুম! মা আমার! তুই কোথায়?

মহুয়ার জামাই বাশারের এফসিপিএস ডিগ্রি হয়ে গেলে তার পোস্টিং হয় রংপুর মেডিক্যাল কলেজে। তিন বছর পরে সেখান  থেকে আবার সিলেট মেডিক্যাল কলেজ। সোহা তখন সিলেট শহরের মুরারিচাঁদ কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়। এইচএসসি পরীক্ষায় পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে অনার্স পড়ার সুযোগ পেয়ে যায় সোহা। মহুয়া তখন তার জামাইকে বলে, মেয়ে তো বড়ই হয়ে গেল। এবার থিতু হওয়া দরকার। ঢাকায় ফেরত যাই চল! বাশারও সেই প্রয়োজনীয়তা বোধ করে বটে। কিন্তু সহসা সে সিলেট থেকে ঢাকায় নিজের বদলির ব্যবস্থা করতে পারে না। অগত্যা বিসত্মর ঘোরাঘুরি করে নর্থ রোডে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার পরিকল্পনা করে বাশার। নর্থ রোডে বাসা ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলে মহুয়া। বাসা ভাড়া নেওয়ার দরকারটা কী? আমাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসার নিচতলার ভাড়াটে তুলে দিলেই তো হয়! মায়ের প্রস্তাব শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে সোহা – অসম্ভব! নানুদের বাসাটা ছোট, চেহারাও ভালো না। তোমাদের এসব পিচ্চি সাইজের জঘন্য চেহারার সরকারি কোয়ার্টারে থাকতে-থাকতে ঘেন্না ধরে গেছে আমার! আমার একটা সুন্দর বাসা লাগবে। আমি বাসা সাজাব এবার। বাশার তখন যুক্তি দেয় যে, নর্থ রোড থেকে সহজেই সোহা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে পারবে। কাজেই বাপ-বেটির ওজরের কারণে নর্থ রোডের দু-হাজার স্কয়ার ফিটের অ্যাপার্টমেন্টটাই ভাড়া নেওয়া হয় শেষ পর্যমত্ম।  বাসার দেয়ালের ক্রিম রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কাজিপাড়ার আসবাবের  দোকানগুলো থেকে নতুন খাট, টেবিল, চেয়ার – এসব কিনে আনে বাপ-বেটি। বাপ-বেটিতে মিলে বিপুল উদ্যমে নর্থ রোডের বাসা সাজায়। তাদের আনন্দে আনন্দিত হয় মহুয়া।

এমন একটা সময়ে ১১১ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের টিনশেডের বাসাটার জায়গায় অ্যাপার্টমেন্ট-বিল্ডিং উঠতে শুরম্ন করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, এ-বাসাটাতেই অনেক আগে শাহিনরা ভাড়া থাকত। তখন মহুয়ার ছোট ভাই রাসেল, বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তা, ঘ্যানর-ঘ্যানর লাগিয়ে দেয় পরিবারের মানুষজনদের সঙ্গে। ডানে-বাঁয়ে সবখানে অ্যাপার্টমেন্ট উঠে যাচ্ছে। এখন পিছের ১১১ নম্বরেও অ্যাপার্টমেন্ট উঠতে শুরম্ন করল। আমাদের বাড়িতে তো আলো-বাতাস ঢোকাটাই বন্ধ হয়ে যাবে এবার! ছোট ভাইয়ের কথায় সঙ্গে সঙ্গেই দুশ্চিমিত্মত হয়ে পড়ে মহুয়ার বড় বোন। রাসেল তখন তাদের ১১০ নম্বরেও অ্যাপার্টমেন্ট তোলার জন্য রিয়াল এস্টেট বিল্ডারদের দেওয়া প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনার ব্যাপারে গুরম্নত্ব তুলে ধরে। মহুয়া বলে, আমার অনেক স্মৃতির বাসা এটা! এই বাসা ভাঙা চলবে না। মহুয়ার মমত্মব্যের কারণে ভয়ানক বিরক্ত হয়ে রাসেল তার নিজের প্রতিক্রিয়া জানায় এভাবে – স্মৃতি ধুয়ে পানি খাও তুমি! তুমি তো আর এ-বাসায় থাকো না। এই পুরনো আমলের বাসায় থাকার সমস্যাগুলো বোঝার ক্ষমতা জিন্দেগিতেও হবে না তোমার! আর তখন ছোট ভাইয়ের রূঢ় কথায় আহত হয় মহুয়া। কিন্তু যেহেতু মহুয়ার মা এবং তার দুই ভাইবোন ১১০ নম্বরে অ্যাপার্টমেন্ট তোলার পক্ষপাতী কাজেই এক মহুয়ার আপত্তি তখন অসার হয়ে পড়ে। প্রথমে তাদের ১১০ নম্বর বাসাটা বড়-বড় সব হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়। বাসাটা গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার পর সেখানে নতুন একটা ভিত গাঁথা হবে। তারপর সেখানে উঠবে নতুন দালানকোঠা। এ-অবস্থায় মহুয়ার নিজের ঘরের সব আসবাবপত্তর, ট্রাঙ্ক, সুটকেস, জার্মানির জুবিলেট হারমোনিয়াম ইত্যাদি সব উন্মূল হয়ে পড়ার জোর সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই বাধ্য হয়ে ব্যক্তিগত সব জিনিসপত্তর তার নর্থ রোডের বাসায় নিয়ে আসে মহুয়া।

জার্মানিতে ১৯৪২ সালে তৈরি মহুয়ার জুবিলেট হারমোনিয়ামটার ওপরে তার মেয়ে সোহার মুগ্ধতা অনেকদিনের। কাজেই সেই হারমোনিয়ামটা অ্যান্টিক-সমাদরে স্থান পায় মহুয়াদের নর্থ রোডের অ্যাপার্টমেন্টের বসার ঘরে। তবে পুরনো সব আসবাবপত্তর দেখে নাক সিঁটকায় সোহা। সোহার উদ্যোগে মহুয়ার প্রাচীন খাটটা খুলেটুলে তুলে দেওয়া হয় বাথরম্নমের ওপরের বক্সে। গজর-গজর করতে-করতে মহুয়ার প্রাচীন টেবিলটা গেস্টরম্নমে ঢোকায় সোহা। ‘তুমি আসলেই একটা মহা ক্ষেত!’ – বলতে-বলতে মহুয়ার প্রিয় ওয়াড্রোবটা মহুয়ার বর্তমান ঘরের এক কোনায় বসিয়ে দিয়ে  সোহা হুমকি দেয় – এক মাস টাইম দেওয়া হলো তোমাকে! তোমার এই পচা ওয়াড্রোব তুমি বেচে দেবে নাকি ফেলে দেবে, সেটা তুমি ভেবে দেখো! বিষণ্ণ মহুয়া তার নাছোড়বান্দা মেয়েকে বলে, আচ্ছা। দেখি। পুরনো কাপড়চোপড়ে ঠাসা মহুয়ার বড়-বড় দুটো সুটকেস রান্নাঘরের ওপরের বক্সে চালান করা গেলেও রম্নপালি ট্রাঙ্কটা নিয়ে চূড়ামত্ম বিপত্তিটা ঘটে। তার বর্তমান ঘরেই ট্রাঙ্কটা রাখার ব্যাপারে মহুয়া গোঁ ধরলে মায়ের ওপরে ক্ষেপ্ত হয়ে ওঠে সোহা। সোহার কথার সারমর্ম এই – রং চটে যাওয়া এই ট্রাঙ্কটা মহুয়ার সাজানো-গোছানো ঘরের সৌন্দর্যহানি করবে। কাজেই ট্রাঙ্কটা এখানে রাখা যাবে না কিছুতেই। বিকল্প হলো, রম্নপালি ট্রাঙ্কের সব জিনিসপত্তর বের করতে হবে এবং সেগুলো গুছিয়ে-টুছিয়ে সোহা রেখে দেবে মহুয়ার প্রাচীন ওয়াড্রোবটার ভেতরে, যে-ওয়ার্ডরোবটা ইতোমধ্যেই মহুয়ার ঘরটায় সামঞ্জস্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সোহার এসব জোরাজুরির কাছে হার মানে মহুয়া।

রম্নপালি ট্রাঙ্কটার ডালা খুলে সোহা মেঝেতে নামায় মহুয়ার সব পুরনো জিনিসপত্তর। জিনিসপত্তরের ভেতরে ছোট্ট লাল জামাটা  দেখতে পেয়ে সেটা হাতে তুলে নিয়ে সোহা তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, আমার ছোটকালের জামা আবার এই ট্রাঙ্কের ভেতরে রেখে দিয়েছ তুমি! এটা কি আমি সাত-আট মাস বয়সে পরেছিলাম?

 

তখন আচমকাই মহুয়া উচ্চারণ করে বসে – না রে! এটা তোর জামা নয়।

তাহলে কার?

সোহার সে-প্রশ্নের উত্তর দিতে দ্বিধা হয় মহুয়ার। সে চুপ করে রম্নপালি ট্রাঙ্কটা থেকে একে-একে সব জিনিসপত্তর নামানো দেখতে থাকে। আর খুব সহজেই সোহার মনোযোগ পিছলে যায় তার মায়ের পুরনো সব বাহারি রেশমি চুড়ির সংগ্রহের দিকে – ওমা! কী সুন্দর রং তোমার চুড়িগুলোর! নিউমার্কেট থেকে কিনেছিলে, না? মহুয়া বলে, হ্যাঁ। মেয়েকে চুরিবিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার জন্য সহজই হয়। কিন্তু ছোট্ট লাল জামাটা কার – সে-প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা মহুয়ার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, মহুয়া নিজেই জানে না, কুসুমের কাল্পনিক উপস্থিতির প্রসঙ্গ উঠলে সোহা সেটা কীভাবে নেবে। তবে সুখের বিষয় এই যে, চুড়ি নিয়ে সোহা মেতে ওঠাতে সেই জটিল একটা প্রশ্নের উত্তর আর দিতে হয় না মহুয়াকে এবং তাই মহুয়া হাঁপ ছেড়ে বাঁচে তখন।

কিন্তু পরদিনই সোহার মুখোমুখি হতে হয় মহুয়াকে। বিকেলের দিকে প্রাচীন ওয়াড্রোব থেকে লাল জামাটা বের করে মহুয়া তার বুকে চেপে ধরে রাখে অনেকক্ষণ। কুসুমের জন্য তার মন খারাপ লাগে খুব আর তার চোখ দিয়ে নামতে থাকে বাঁধভাঙা অশ্রম্ন। কখন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরে কলিংবেল টিপেছে সোহা আর দরোজা খুলে দিয়েছে কাজের মেয়েটা তা তখন  খেয়ালই করতে পারে না মহুয়া। সোহা তার মায়ের ঘরে ঢুকে প্রাচীন ওয়াড্রোবের সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে ক্রন্দনরত তার মায়ের দিকে  যে পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে, সেটাও নজরে আসে না মহুয়ার।  সোহা আলতো করে তার পিঠে হাত রাখলে বাসত্মবে ফিরে আসে সে।

বিমূঢ় সোহা তার মাকে প্রশ্ন করে – কাঁদছ কেন মা? কী হয়েছে তোমার? সমত্মানের কাছে নিজের মানসিক দুর্বলতা আর ঢাকতে না-পেরে সে ভীষণ অপ্রস্ত্তত হয়ে যায়। তারপর সে অনির্দিষ্ট একটা উত্তর দিয়ে ফেলে – এমনি। তেমন কিছু নয়।

তবে মহুয়া বুঝতে পারে, এই অনির্দিষ্ট উত্তরে কাজ হবে না  কোনো। মেয়ের সঙ্গে তার সহজ সম্পর্ক বলে সোহা তাকে অমোঘ একটা প্রশ্ন করবেই এবং তা-ই হয়। গম্ভীর সোহা তার মাকে বলে, লাল জামাটা নিয়ে কান্নাকাটির কী হলো, তা তো বুঝতে পারছি না! এই ছোট জামাটা কার, ঠিক করে বলো তো মা! কালকে কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি!

দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর ধরে নিজের বুকে মহুয়া গোপন করে রেখেছে  ছোট্ট লাল জামাটার কথা। বাশার আর সোহা বাদে তার পরিবারের মানুষজন আর ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব সবাই জানে যে, একদা শাহিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তবে কারো সঙ্গেই সে ছোট্ট লাল জামাটা নিয়ে কখনোই কথা বলেনি। সবার চোখ আড়াল করে লাল জামা বুকে চেপে ধরে সে কেঁদেছে অনেকদিন। কিন্তু তাকে কাঁদতে দেখেনি কেউ, এমনকি তার সবচাইতে কাছের মানুষ বাশার আর  সোহাও নয়। তবে মনের ভেতরে সেই গোপনীয়তা জগদ্দল হয়ে বসে থাকে সর্বদাই! লাল জামা সংক্রামত্ম গোপনীয়তা টানতে-টানতে এই আটচলিস্ন­শ বছর বয়সে এসে নিজেকে আজকাল ভয়ানক ক্লামত্ম মনে হয় মহুয়ার। তাই সোহার কাছে আজ আর সত্য গোপন করতে মহুয়ার মন চায় না কিছুতেই। মহুয়া ভাবে, সোহা হয়তো কষ্টই পাবে কুসুমের কাল্পনিক অস্তিত্বের কথা জেনে। তা পাক! তবু আজ পৃথিবীর কাছে তার নিজের মনের ভার মুক্ত হোক। একদা নিউমার্কেট থেকে ছোট্ট লাল জামাটা কেনার ঊনত্রিশ বছর পরে তাই এ-জগতের কাউকে মহুয়া বলতে পারে, জামাটা তোর বড় বোনের।

বিস্ফারিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে  সোহা – মা! এসব কী বলছ তুমি? আমার আবার বড় বোন আসল  কোথা থেকে?

কেউ জানে না সে-কথা। তোর বড় বোনের নাম কুসুম। সে  তোর থেকে ছয় বছরের বড়।

আর তা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে মায়ের মুখের রহস্যময় রেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে সোহা। মায়ের দেওয়া তথ্যের কোনো পূর্বসূত্র না-থাকাতে সে তার মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না। তখন মহুয়াই উদ্ধার করে তার  মেয়েকে। মহুয়া সোহাকে জানায় – কুসুম আমার স্বপ্নের মেয়ে।

সে-কথা শোনার পরে একটু সুস্থির হয় সোহা। তবে তার বিমূঢ়তা কাটে না সহজে। তখন মহুয়া তাকে জিজ্ঞাসা করে – কমলকুমার মজুমদারের ‘লাল জুতো’ গল্পটা পড়েছিস তুই?

মাথা নিচু করে সোহা বলে – না।

মা বলে, পড়িস।

আর তারপর ছোট্ট লাল জামাটা ফের তার প্রাচীন ওয়াড্রোবে সাজিয়ে রাখে মহুয়া। সোহার মানসিক আন্দোলনের জন্য বস্ত্তত সে নিজেই দায়ী বলে তখন তার ভীষণ অপরাধবোধ ঘটতে থাকে, খুব অপ্রস্ত্তত লাগতে থাকে তার। তাই সোহার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায় পথহারা মহুয়া, হয়তোবা সে কাঁদতেও চায় পুনর্বার এবং সে দ্রম্নত ঢুকে যায় বাথরম্নমে।

চরম অস্বস্তির কারণে সেদিন সোহা আর মহুয়ার ঘরে ঢোকে না একবারের জন্যও। এমনকি রাতে খাবার টেবিলেও সোহা অনুপস্থিত। সোহার বাবা বাশার চিমিত্মত হয়ে মহুয়াকে জিজ্ঞাসা করে – কী হলো সোহার? তোমাকে বলেছে কিছু? একটু আগে আমি ওর ঘরে গিয়েছিলাম। আমার প্রশ্নের তো কোনো জবাবই দিলো না সে! বন্ধুদের সঙ্গে তার কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?

গম্ভীর মহুয়া তার জামাইকে বলে – যাই, দেখি। তুমি ভেবো না।

কিন্তু সোহার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভীষণ বাধো-বাধো লাগে মহুয়ার। নিজের অস্বস্তির সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করে, যুদ্ধে জিতে গিয়ে রাত দুটোর দিকে সোহার ঘরের দরোজায় সে টোকা দেয়। সোহা অনেক পরে তার ঘরের দরোজা খোলে। দরোজা খুলে দিয়ে বিছানায় গিয়ে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়েই থাকে ক্রন্দনরত সোহা।  সোহার বিছানার পাশে মহুয়া দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। সে ঠিকই বুঝতে পারে, অভিমানী সোহা সহজে তার সঙ্গে কথা বলবে না আজ। আর তা বুঝে নিয়ে মহুয়া সোহার পাশে বসে তার চুলে ধীরে- ধীরে আঙুল বুলিয়ে আদর দিতে থাকে। তখন সোহার কান্নার বেগ বেড়ে যায় আরো। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা গত হলে মায়ের দিকে সে পাশ ফিরে শোয়। মায়ের ডান হাতটা কাছে টেনে নিয়ে হাতের পিঠে সে একটা চুমু খায় এবং অশ্রম্নসজল চোখে সে তার মাকে বলে – ‘লাল জুতো’ গল্পটা একটু আগেই পড়লাম ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে। কুসুম আমার বড় বোন হয়েই থাকুক। আমার কোনো আপত্তি নেই তাতে। তুমি খুশি হয়েছ মা?

হ্যাঁ! খু্ব খুশি হয়েছিরে! বুকটা খুব হালকা লাগছে আমার! এই বলে সোহার পাশে শুয়ে তাকে বুকে টেনে নেয় মহুয়া। মা আর মেয়ে দুজনের চোখ থেকেই গড়ায় নীরব অশ্রম্ন। একটু ধাতস্থ হয়ে সোহা তার মাকে প্রশ্ন করে – তোমার সেই প্রেমিকের নাম কী? কোথায় থাকে সে?

উত্তর দেয় মহুয়া – তার নাম শাহিন। তোর নানুর বাসার  পেছনে যে ১১১ নম্বর বাসা আছে না, সেই বাসাটায় একসময়ে ভাড়া থাকত ওরা। তোর বাবার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে শাহিন আর আমার ভেতরে কোনো যোগাযোগ নেই। আমি যতটুকু জানি, শাহিন আমেরিকায় চলে গেছে বহু আগে। সে এখন কোথায় থাকে, তা আমি জানি না অবশ্য।

একটু চুপ থেকে সোহা তার মাকে বলে, লাল জামার গল্পটা আমাকে বলবে তুমি?

মহুয়া তখন তার আত্মজার নরম চুলে বিলি কাটতে-কাটতে প্রশামত্ম মুখে লাল জামার গল্প বলতে থাকে।