লিভিংস্টন : মুক্তির প্রতীক

সুকল্যাণী সেনগুপ্ত

রিচার্ড ডেভিড বাখ (জন্ম : ২৩ জুন, ১৯৩৬) একজন আমেরিকান লেখক। তিনি সত্তরের দশকের দুটি বেস্টসেলারের জন্য বিখ্যাত – Jonathan Livingston Seagull (১৯৭০) এবং Illusions : The Adventures of a Reluctant Messiah (১৯৭৭)। Jonathan Livingston Seagulla story একটি শঙ্খচিলের গল্প, যেটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকেই দশ লাখের বেশি বইয়ের কপি বিক্রি হয়।

শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এ-বইটি অনুবাদ করেন, যেটি জোনাথন লিভিংস্টন সীগাল : একটি গল্প নামে প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে কলকাতা বইমেলায়, ঋতাক্ষর প্রকাশন থেকে।

জোনাথন লিভিংস্টন একটি গাঙচিল, যে বাকিদের থেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাই সে শুধু খাদ্য সংগ্রহের জন্য নয়, ওড়ার আনন্দ উপভোগ করার জন্যই উড়তে চায়, নানা কায়দা রপ্ত করতে চায়। তার মা-বাবা এতে আশাহত হন, সন্তানকে বোঝানোর চেষ্টা করে গতানুগতিকতার পথে ফিরিয়ে আনতে চান, কিন্তু ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত সমাজচ্যুত করা হয় জোনাথনকে – কিন্তু সে হার না মেনে নিজ লক্ষ্যে অবিচল থেকে জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে থাকে। উত্তরণ ঘটে তার। সে নিজের উত্তরসূরিদের শিক্ষাপ্রদান করতে থাকে, যারা তারই মতো মুক্তমনা হওয়ার কারণে সমাজচ্যুত। সেই তরুণ প্রজন্মকে নিজের অবর্তমানেও আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে বাকিদের পথ দেখানোর কাজে লিপ্ত করে  জোনাথন – ভালোবাসাই মূলমন্ত্র বলে শিখিয়ে দিয়ে যায় তাদের।

‘জোনাথন লিভিংস্টন সীগাল’ এমন একটি গল্প, যা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। এমন অনেক কথা, যা স্বীকার করতে আমরা ভয় পাই, জোনাথনের মধ্য দিয়ে সেই কঠিন সত্যগুলো সোচ্চারে বলিয়ে নিয়েছেন লেখক। তিনি দেখাতে চেয়েছেন জীবনে কত সুন্দরভাবে বাঁচা যায়। সাধারণ মানুষরা সত্যিই নিজস্ব বক্তব্য জোরদারভাবে রাখতে পারে না, আর আমাদের তৈরি করা অনুশাসন আসেত্ম আসেত্ম আপামর জনগণের ভাবনাচিন্তার বিকাশের পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় জগদ্দল পাথরের মতো, স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে। মানুষ চলে আসে শাসকের অধীনে – নিজস্ব চিন্তা, নিজের জীবন নিজের মতো করে বাঁচাই মানুষ আসেত্ম আসেত্ম ভুলছে। হয়তো রোবটের ব্যবহার যথেচ্ছহারে এখনো পৃথিবীতে প্রচলিত হয়নি, কিন্তু মানুষ সত্যিই শাসকের হাতের রোবটে পরিণত হয়েছে।

তবু সেই সাধারণ মানুষের মধ্যেই জন্ম নেয় জোনাথন লিভিংস্টন সিগালের মতো কেউ, যে মুক্তির পথ সন্ধান করে, নিজের জীবনকে নিজের খেয়ালখুশিমতো নিয়ন্ত্রণ করে; প্রসঙ্গ টানাই যায় জাভেদ আখতারের লেখায় – ‘হাওয়া কে ঝোঁকে কে জ্যায়সে আজাদ রহেনা শিখো’ (বাতাসের মতো স্বাধীন বিচরণ করতে শেখো) – এখানেও একই কথা বলা হয়েছে, জীবনটা খুব সহজ, তাকে অযথা জটিল না করাই ভালো; একজন মানুষ হিসেবে উপলব্ধি করা দরকার ‘আমি’ কে। কিন্তু তার পথে বাধা অনেক, সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, শাসক পথ প্রতিরোধ করে, এমনকি নিজের পরিবারও গতানুগতিকতার পথেই হাঁটার পরামর্শ দেয় – সত্যি! এ তো গাঙচিলের কথাই নয়, রূপকের আড়ালে আমাদের গোটা সমাজকেই ভয়ংকরভাবে প্রেক্ষাপট হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন লেখক, তুলে এনেছেন রূঢ় বাস্তবকে। ‘গাঙচিলেরা কখনো হোঁচট খায় না, কখনো হারায় না শৃঙ্খলা’ – ‘শৃঙ্খলা’র আড়ালে শিকলবদ্ধ মনুষ্যজীবনের প্রতিচ্ছবিই পাঠকমনে ফুটে ওঠে। কিন্তু সাধারণের ভিড়েও অসাধারণ কারো জন্ম হয়, যার জীবনের প্রথম ভালোবাসা হয়ে ওঠে জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করা, আর পাঁচজনের মতো জন্ম-খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-প্রজনন-কর্তব্য-মৃত্যুর মতো ছোট গ–তে জীবনটা আটকে না রেখে। পুনর্জন্ম হয় কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ – কিন্তু আমাদের সবাইকে জোনাথন শিখিয়ে যায় যে, জীবন একটাই, তার সদ্ব্যবহার করতে হবে; না হলে জীবনের পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে আফসোস যেন না হয় যে, জীবনটা বৃথাই নষ্ট হলো।

আমাদের সমাজই শিখিয়ে দেয় যে, বেঁচে থাকার জন্য যে প্রয়োজনীয় রসদগুলো আমাদেরই জোগাড় করতে হবে, তাই সেই গড্ডলিকা প্রবাহে বেশিরভাগ মানুষ গা ভাসালেও কিছু মানুষ এর ঊর্ধ্বে উঠে বাঁচতে চায়, জীবনটা দেখতে চায় – বেঁচে থাকার প্রধান কারণ খাওয়া-পরা নয়, বরং জীবনটা জানতে চাওয়া, আরো ভালো করে বললে জানতে চাওয়ার সদিচ্ছা – ‘দিলোঁ মে তুম আপ্নি বেতাবিয়াঁ লেকে চল্ রহে হো তো জিন্দা হো তুম! (হৃদয়ের ব্যাকুলতাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে)’ (জাভেদ আখতার)

জোনাথন যেমন নিজের উত্তরণ ঘটায়, বিনিময়ে সমাজচ্যুত হতে হয় তাকে। কিন্তু তার জন্য সে লজ্জিত, দুঃখিত, শঙ্কিত নয়, সে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ওড়ার আনন্দে মনোনিবেশ করেছিল; ফলত পেয়েছিল এক অনন্য জীবন, যা তার প্রগতির পথ প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর করেছিল। যেমনটা হয়েছিল বাস্তবে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেইয়ের সঙ্গে। ধর্মীয় শাসকরা তাঁর কাজের স্বীকৃতি না দিয়ে তাঁকে গৃহবন্দি করেছিল। আবার বিদ্যাসাগরকে বিধবা বিবাহের সপক্ষে আন্দোলনের জন্য বাঙালি সমাজের অনেকাংশ ধিক্কার জানিয়েছিল। কিন্তু, এই ধিক্কার, অবজ্ঞা সত্ত্বেও তাঁরা নিজস্ব মূল্যবোধ থেকে সরে আসেননি। পরবর্তীকালে তাঁদের কর্ম স্বীকৃতি পেয়েছে, যা প্রমাণ করে, প্রতিভাকে আটকানো যায় না।

শিক্ষার আলো মানুষকে উজ্জ্বল করে তোলে, বাঁচার অন্য অর্থ শেখায়। ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’ – অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাওয়ার জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষা যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে মানুষকে ভাবতে শেখায়, বুঝতে শেখায়, জানতে শেখায়, আবিষ্কার করতে শেখায়। জোনাথনও শিখতে শিখতে উপলব্ধি করে সেই অমোঘ সত্য – ‘স্বর্গ কোনো স্থান নয়, কোনো সময়ও নয়। উৎকর্ষের মধ্যেই আছে স্বর্গ’। উৎকর্ষের স্তর থেকে স্তরে উন্নীত হয় সে।

জোনাথন অগ্রজ শঙ্খচিল চিয়াংয়ের থেকে শিক্ষালাভ করে জানতে পারে তার প্রকৃত সত্তাটি এক নিখুঁত অলিখিত সংখ্যার মতোই সব জায়গায় ও সবসময়ে বিরাজমান। সে হাড়, পল, পালকের সমষ্টি নয়, সীমাহীন ধাবমান মুক্তির প্রতীক। ভালোবাসাই জীবনের প্রকৃত সত্য, ভালোবাসা নিয়েই কাজ করে যাওয়া উচিত – এ-কথাও জোনাথন উপলব্ধি করে, ঠিক যেমনিভাবে নানান সময়ে নানান মনীষী বিশ্বের নানান প্রান্তে একইভাবে প্রেমের বাণী বিতরণ করে গেছেন – স্বামী বিবেকানন্দ, যিশুখ্রিষ্ট কিংবা চৈতন্যদেবের মতো ব্যক্তিত্বরা।

‘যে শঙ্খচিল সব চেয়ে ওপরে ওড়ে, সে-ই সব থেকে দূর পর্যন্ত দেখে’ – অর্থাৎ উৎকর্ষের শীর্ষে উঠলে জীবনের, পৃথিবীর স্বরূপ উদ্ঘাটন সম্ভব হয়, এই শিক্ষাও আমাদের দেয় জোনাথন।

জোনাথন কখনো যেন আবার ডিরোজিওর প্রতীকী হিসেবে দেখা দেয়, যখন সে কুসংস্কার থেকে মুক্ত, সমাজচ্যুত, মুক্তচিন্তক অনুজ শঙ্খচিলদের নিজস্ব পদ্ধতিতে উড়ান শেখায়, মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে। এর জন্য সমাজের নানান কটাক্ষির মুখোমুখি হলেও পলায়নী মনোবৃত্তি না এনে সাহসের সঙ্গে সেই মুক্তমনাদের সাহায্য করতে থাকে জোনাথন – কারণ ভালোবাসাই ছিল তার জীবনের প্রধান ব্রত।

জোনাথন যখন বলে – ‘একজন শঙ্খচিলের ওড়াটাই স্বাভাবিক, মুক্তিই বেঁচে থাকার প্রকৃত সত্তা, সেই মুক্তির পথে যে-বাধাই আসুক, তা সে ধর্মগত, কুসংস্কার বা আরো কোনো সীমাবদ্ধতাজনিত হোক না কেন, তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে দূরে’ – তখন স্বামী বিবেকানন্দের অমোঘ বাণী স্মরণে আসে। তিনিও জাতিগত, ধর্মগত ভেদাভেদ অগ্রাহ্য করে মুক্তির পথই দেখাতে চেয়েছিলেন আপামর ভারতবাসীকে।

রিচার্ড বাখ জোনাথনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন। প্রশাসন আইন বানালেই তা আইন হয়ে যায় না, তা লেখক সোচ্চারে বলেছেন। তাঁর মতে,
যে-আইন মানুষকে সত্যিকারের স্বাধীনতা এনে দেয়, সেই আইনই বাস্তবসম্মত ও শ্রেষ্ঠ। সমাজ, প্রশাসন আইন দিয়ে অনেক সময় জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলেও তারা পুরোপুরি সফল হয় না সবসময়। কারণ, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ‘জোনাথন’ বাস করে। তফাৎ একটাই, সবাই উপলব্ধি করতে পারে না, আবার কখনো সচেতনভাবেই উপলব্ধি করতে চায় না।

একজন, যে স্বাধীন, সে যে সমাজের বানানো কিছু আইনের অনুশাসনে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে অনুশীলন ও জ্ঞানের মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করতে পারে, সেটা সমাজ কখনো মেনে নেয় না। একজনকে নির্দিষ্ট এখতিয়ারে বেঁধে রাখাই সমাজের কাজ; আর সেই প্রাচীর ভেঙে বেরোনো যতটা কঠিন, তার থেকেও বেশি কঠিন কাউকে বোঝানো যে-প্রাচীর দৃঢ় কিন্তু ভাঙা অসম্ভব নয়।

জোনাথনরা সময়ের থেকে এগিয়ে নয়, বরং চলতি ধারার থেকে এগিয়ে – এ-বার্তা দিয়েছেন লেখক। চলতি ধারার থেকে অগ্রসর তারাই হয়, যাদের মধ্যে জীবনটাকে অন্যভাবে দেখার, অন্যভাবে জানার অদম্য ইচ্ছা থাকে। নদীপ্রবাহকে যেমন পাথর দিয়ে আটকানো যায় না, সে তার নিজের পথ খুঁজে নেয়, তেমনি জোনাথনকেও আটকানো সম্ভব নয়।

জোনাথন স্বীকার করে, সে একজন সাধারণ শঙ্খচিল। জোনাথনের মতো মানুষরাও নিজেদের ঐশ্বরিক প্রতিভাসংবলিত মানব হিসেবে দেখাতে চায় না, তারা চায় মানুষ জানুক তারাও বাকিদের মতোই সাধারণ। শুধু পার্থক্য, তারা নিজেদের অন্তর্নিহিত প্রকৃত সত্তাকে, ভালোকে খুঁজে পেয়েছে; আর বাকিরাও যাতে সেটা পেরে উত্তরণ ঘটাতে পারে, তার জন্য চেষ্টা করে যায় আজীবন। কিন্তু সমাজ, ধর্ম সেই নশ্বর মানুষদের অবর্তমানে তাদের ওপর দেবত্ব আরোপ করে নিজেরা মুনাফা লুটতে চায়।

জোনাথন শেষ পর্যন্ত প্রেমের জয়গানই গেয়ে যায়। জোনাথন প্রেমের প্রতীক, মুক্তির প্রতীক, উন্নয়নের প্রতীক, প্রকৃত শিক্ষার প্রতীক, যে অনুজদের মধ্য দিয়ে নিজের ধারাকে আবহমান রাখে নিজের অবর্তমানেও।

জোনাথন আমাদের শিক্ষা দেয় জীবনের প্রকৃত মানে খুঁজে পাওয়ার। তাই গল্পটি পড়ার পর মুগ্ধতা গ্রাস করে, গল্পটি আমাদের ভাবায়, জীবনদর্শন উপলব্ধি করায়।

জোনাথন লিভিংস্টন সীগাল : একটি গল্প – শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু আক্ষরিক অনুবাদ না করে ভাবানুবাদ করায় বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না পাঠকের জোনাথনের সঙ্গে একাত্মবোধ করতে। মুন্শিয়ানার সঙ্গে করা তাঁর এই অনূদিত গ্রন্থকে সাধুবাদ জানাই। গল্পটি পাঠকদের আপস্নুত করেছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক পাঠককে মুগ্ধ করবে – এই আশা রাখি। r