কবিতাকে সাহিত্যের রাজপথ দাবি করা হয়, জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করেননি এমন মানুষও দুর্লভ এবং যাঁরা নোবেল পুরস্কারের প্রার্থী বাছাই ও পুরস্কার চূড়ান্ত করেন সেই সুইডিশ অ্যাকাডেমির সদস্যদের মধ্যে বরাবরই বেশ কজন কবি থাকার পরও নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের সিংহভাগ গদ্যকারগণ দখল করে নিয়েছেন। লুইস গ্লিক কতটা ভালো ও গুরুত্বপূর্ণ কবি – এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কবি ও কবিতার সমঝদারদের জন্য স্বস্তি যে, করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাধির আতঙ্ক-ছড়ানো দিনে কবিতার জয় হয়েছে। নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করার জন্য একজন কবিকে বেছে নেওয়া হয়েছে এবং একজন নারীকে।
লুইস গ্লিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ষোড়শ নারী, আর যদি পুরোদস্তুর কবি হিসেবে বিবেচনা করতে হয় তাহলে তৃতীয় কবি; অন্য দুজন হচ্ছেন উইসলাওয়া সিমব্রোস্কা (পোল্যান্ড, ১৯৯৬) এবং গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল (চিলি, ১৯৪৫)। আরো দুজন যাঁদের একজনের ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতি কবির চেয়ে বেশি, তিনি গ্রাজিয়া দেলেদ্দা (ইতালি, ১৯২৬) এবং অন্যজনের নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি কবিকে ঢেকে দেয়, তিনি নেলি স্যাকস (জার্মানি, ১৯৬৬)।
আবার লিঙ্গভেদ না করে যদি কবি পরিচিতি বিবেচনায় আনা হয় তাহলে দেখা যাবে, পঞ্চাশের দশকে কবিতার জন্য নোবেল পেয়েছেন দুজন – হুয়ান র্যামন হিমেনেথ (স্পেন, ১৯৫৬) এবং সালভাতর কোয়াসিমোদো (ইতালি, ১৯৫৯); ১৯৬০-এর দশকে সাঁ জাঁ পার্স (ফ্রান্স, ১৯৬০) ও
জর্জ সেফেরিস (গ্রিস, ১৯৬৩); তবে নেলি স্যাকস ও মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল অ্যাস্তুরিয়াসেরও কবি-পরিচিতি ছিল। সত্তরের দশকে চারজন কবি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন : পাবলো নেরুদা (চিলি, ১৯৭১), ইউজিনিও মন্তালে (ইতালি, ১৯৭৫), ভিসেন্তি আলেক্সেন্দ্রে (স্পেন, ১৯৭৭) এবং ওদেসিয়াস ইলাইতিস (গ্রিস, ১৯৭১); আশির দশকে পেয়েছেন তিনজন – চেশোয়াভ মিউশ (পোল্যান্ড-যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৮০), ইয়ারোসøাভ সাইফেট (চেক, ১৯৮৪) এবং জোসেফ ব্রডস্কি (রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৮৭)। ১৯৯০-এর দশকে চারজন : ওক্তাবিও পাজ (মেক্সিকো, ১৯৯০), ডেরেক ওয়ালকট (সেইন্ট লুসিয়া, ১৯৯২), সিমাস হিনি (আয়ারল্যান্ড, ১৯৯৫) এবং উইসলাওয়া সিমব্রোস্কা (পোল্যান্ড, ১৯৯৬)।
নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকে যে-দশজন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন তাঁদের একজনও কবি নন। দ্বিতীয় দশকে বব ডিলানের পুরস্কারটিকে সাহিত্যের মানদণ্ডে যদি অগ্রাহ্য করা যায় তাহলে ২০তম কবি পর্যন্ত পৌঁছতে দুজন কবি পুরস্কার পেলেন – একজন সুইডিশ কবি টমাস ট্রান্সট্রমার (২০১২), অন্যজন লুইস গ্লিক। প্রকৃত অর্থে ১৯৯৬-র পর এই প্রথম একজন কবি পুরস্কৃত হলেন। ২৪ বছর অর্থাৎ দুই যুগে দুজন মাত্র কবি। এ সময় সম্ভাব্য পুরস্কার প্রাপকের তালিকায় দুজনের নাম বারবার এসেছে – কোরিয়ার কবি কো উন এবং সিরিয়ার কবি আদোনিস। প্রয়াতদের মধ্যে ইভস বনফয় (১৯২৩-২০১৬), স্ট্যানলে কুনিজ (১৯০৫-২০০৬) এবং মায়া অ্যাঞ্জেলু (১৯২৮-২০১৪) – এ নামগুলো উচ্চারিত হয়েছে।
লুইস এলিজাবেথ গ্লিক
৮ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার অনুষ্ঠানটি প্রযুক্তির কল্যাণে সরাসরি অনেকেই দেখেছেন। এবার করোনা ভাইরাস সংক্রমণ-আতঙ্কের কারণে হাতেগোনা গণমাধ্যমকর্মী সুইডিশ অ্যাকাডেমির ঘোষণাকক্ষে উপস্থিত ছিলেন। করোনামুখোশ সরিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন কেউ করেননি, সে-সুযোগও দেওয়া হয়নি। ঘোষণা করা হয়, লুইস গ্লিকের ‘অভ্রান্তি কাব্যস্বর অনাড়ম্বর সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশে ব্যক্তির অস্তি¡কে বৈশ্বিক করে তোলে’ – তিনিই ২০২০ সালের নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হচ্ছেন।
সুইডিশ অ্যাকাডেমির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অ্যাডাম স্মিথ যখন ভোরবেলা খবরটি দেওয়ার জন্য লুইস গ্লিককে ফোন করলেন তিনি তখনো দিনের প্রথম কফি মুখে তোলেননি। পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ার বলেন, ‘আমার প্রতিক্রিয়া ছিল – আমার আর কোনো বন্ধু থাকবে না। কারণ আমার বন্ধুদের প্রায় সবাই লেখক। পরে আমি ভাবলাম, না, তা ঘটবে না।’
গদ্যলেখক হিসেবে আমি বুঝে নিয়েছি তাঁর কথার প্রথম অংশটিই সত্য, দ্বিতীয়টি বলেছেন প্রথম সত্যটিকে ঢাকতে। কোনো সন্দেহ নেই নোবেলের খ্যাতিতে তাঁর বন্ধুচ্যুতি ঘটবে। সহজাত ঈর্ষাই বন্ধুদের তাঁর কাজ থেকে সরিয়ে নেবে।
তাঁর কাছে নোবেল পুরস্কারের মানে কী? এবারো তিনি অনাড়ম্বর সত্যটাই বললেন – ‘নিশ্চয়ই অনেক সম্মান, যদিও সাম্প্রতিক কালের কিছু পুরস্কারপ্রাপকের প্রশংসা আমি করতে পারছি না। তবে যাঁদের পছন্দ করি তাঁদের কথাও মনে করছি।’
কেমন তাঁর স্বরধ্বনি
সুইডিশ অ্যাকাডেমি লুইস গ্লিকের নোবেল সাইটেশনে উল্লেখ করেছে, গ্রিক পুরাণের ডিডো, পার্সিফোন কিংবা ইউরিডিস হয়ে তিনি যে ব্যক্তিগত উচ্চারণ করেন তার মূল্য বৈশ্বিক। আত্মকথা ও গ্রিক পুরাণ মিলেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতা আত্মজীবনীমূলক মনে হলেও তা কনফেশনাল বা দোষ স্বীকারোক্তিমূলক মনে করা যাবে না।
তাঁর কবিতা নিরাভরণ কিন্তু নিরাবরণ নয়; বর্ণনার আধিক্য নেই, ইঙ্গিতের গল্প অনেক কবিতায়। কবি ক্রেইগ মর্গান টিচার মনে করেন, তাঁর কবিতায় শব্দ দুর্লভ, শব্দের কোনো অপচয় নেই, পুনরাবৃত্তি নেই।
তাঁর কবিতায় পাঠক কী পাবেন?
প্রকৃতি ও প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভাঙন, নিভৃতি, যাতনা, সম্পর্ক। মৃত্যু বিভিন্ন অবয়বে এসেছে। পাঠক পাবেন সংযত ভাষা, জীবনকাহিনি, মূল্যবোধ। পুরাণ ও মানুষের সম্পর্ক। তাঁর কবিতায় যাঁদের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়, যাঁদের শৈলী তিনি অনুসরণ করেছেন বলে মনে করা হয় তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এমিলি ডিকিনসন, এলিজাবেথ বিশপ, সিলভিয়া প্লাথ, জন বেরিম্যান, রবার্ট লাওয়েল এবং রাইনার মারিয়া বিলকে। তবে লিওনিদ অ্যাডামস এবং স্ট্যানলি কুনিৎজের কথা তিনি নিজেই বলেছেন, দুজনই তাঁর শিক্ষক।
তিনি কি ইংরেজি সাহিত্যের স্মরণীয় কবিদের মতো একজন? তরুণ কবিদের কেউ কেউ মনে করেন, তিনি যে কবিতায় স্বতন্ত্র স্বর প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন এটাই তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে। ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’, ‘ভিটা নোভা’ কিংবা ‘দ্য ট্রাম্প অফ অ্যাকিলিসে’র মতো কবিতা পৃথিবীতে হামেশাই লেখা হয় না।
যখন নকল কমলার গন্ধ
জানালাপথে প্রবাহিত হয়
আমি কেমন করে বিশ্রাম নিই?
আমি কেমন করে তৃপ্ত হই
যখন সেই দুর্গন্ধ
পৃথিবীতে বিরাজ করে?
(‘নকল কমলা’)
মহামানব দ্বীপের দিকে পিঠ ফেরায়
এখন সে আর স্বর্গে মৃত্যুবরণ করবে না
আর শুনবে না কখনো
সরলবর্গীয় গাছের নিচে স্বচ্ছ পুকুরের ধারে
জলপাইবনের ভেতর থেকে আসা স্বর্গের বংশীধ্বনি
(‘অডেসিয়াসের সিদ্ধান্ত’)
কবিতা রচনা – ধীরে, না দ্রুত
লুইস গ্লিক কবিতা লেখার দুটি ধারা রপ্ত করছেন – কটি কারিগরের মতো, বেশ শ্রমসাধ্য কাজ, শব্দ খুঁজে খুঁজে বের করে একটা শব্দ বসিয়ে কবিতাটি নির্মাণ করা। এতে কাজটা যে নিজের হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় এর সঙ্গে ‘সেন্স অব বিলঙ্গিংনেস’ বেশি। লিখতে লিখতে তখন নির্মাণ-প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। এভাবে এখন আর তেমন লেখা হয় না। কিন্তু যখন দ্রুত কবিতাটি লেখা হয়ে যায় – এটা যে তাঁর – সেই বোধটা তেমন কাজ করে না। যেসব কবিতা দ্রুত লেখা হয়ে যায়, সামান্যই পরিবর্তন করতে হয় – ‘আমি বুঝতে পারি না এগুলো কোত্থেকে এসেছে।’ কিছু কবিতা পরপর লেখা হয়, ভেঙে পাট পাট করা হয়, আবার শব্দগুলো জোড়া দেওয়া হয়। কোনো কোনো কবিতায় কিছু দুর্বিনীত শব্দ ও বাগধারা রয়েছে, এখন তাঁর মনে হয় সেগুলো বদলালে ভালো হতো।
‘যখন আমি একটি কবিতা বা একটি বই দাঁড় করাতে চেষ্টা করি, গন্ধ শুঁকে যারা বনের ভেতর একটার পর একটা পদক্ষেপ নেয়, নিজেকে তাদের মতো মনে হয় … আমার কোনো ধারণা থাকে না আমি কিসের পেছন পেছন যাচ্ছি, একমাত্র বিশ্বাস, যখন দেখব, তখনই জানব।’
লুইস গ্লিক শৈশবকে দেখছেন সত্যিকারের শিশুর মতো করে :
আমি সেই শিশুটির মতো
যে বালিশের ভেতর
মাথা খুঁজে রাখে
যেন তাকে দেখতে না হয়
যে শিশু নিজেকে শোনায় –
আলো দুঃখ নিয়ে আসে।
‘সেভেন এজেস’ কবিতায় তিনি লিখেছেন :
প্রভু বলেন, তুমি যা দেখ তোমাকে অবশ্য
তা লিখতে হবে
কিন্তু আমি যা দেখি তা তো আমাকে নাড়া দেয় না
প্রভু জবাব দিলেন, তাহলে তুমি যা দেখ
তা বদলে ফেল।
কেলেঙ্কারি থেকে উত্তরণের পথে
নন্দনতাত্ত্বিক ও সাহিত্য-সমালোচক সারা মারিয়া দানিউস ২০১৫ সালের জুনে সুইডিশ অ্যাকাডেমির পার্মানেট সেক্রেটারির পদ অধিকার করেই ঘোষণা দিলেন, নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০ বছরের একটি অনাকর্ষণীয় লৌকিকতায় পরিণত হয়েছে, সুতরাং এতে গতিময়তা আনতে সাহিত্যের সংজ্ঞা পুনর্নিরূপণ করা প্রয়োজন। সাহিত্যের ভিত্তিও সম্প্রসারিত হতে হবে। সে-বছর তাঁরই ‘ম্যানিপুলেশনে’ ইউক্রেনের সাংবাদিক স্ফেতলানা আলেক্সিয়েভ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে জাত গেল জাত গেল রব উঠল। কেউ কেউ বললেন, যদি সাংবাদিককেই দিতে হয় তার চেয়ে খ্যাতিমান সাংবাদিক-লেখকের তো অভাব ছিল না। পরের বছর পুরস্কার যাঁকে দেওয়া হলো তিনি বিশ্বখ্যাত সংগীতশিল্পী। সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার সেই বব ডিলানকেই এতটা বিব্রত করেছে যে তিনি নোবেল কমিটির সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ করে দেন। ২০১৮-তে এসে নোবেল কমিটির সদস্য জ্য ক্লদ আর্নল্ডের যৌন-কেলেঙ্কারি সারা দানিউসের স্বামী স্টেফেন এর তথ্য পাচারসহ দুর্নীতির অভিযোগ সুইডিশ অ্যাকাডেমিকে অকার্যকর করে তোলে; স্থায়ী সদস্যদের বেশ কজন পদত্যাগ করায় কোরাম সংকট দেখা দেয়। ফলে সুইডিশ অ্যাকাডেমির ইতিহাসে এই প্রথম নিজস্ব ব্যর্থতার কারণে ২০১৮ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা রহিত করতে হয়। কেলেঙ্কারি সারা দানিউসকেও পদত্যাগে বাধ্য করে। মাঝখানে ২০১৭ সালে কাজুও ইশিগুরোকে নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটির মর্যাদা খানিকটা রক্ষা করেছে। ২০১৯ সালে এসে সদস্যদের শূন্য আসন পূরণ করা হয় এবং অক্টোবরে যখন পুরস্কার ঘোষণা করা হয় নতুন বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমি। ২০১৮ সালের জন্য ওলগা তোকারচুককে নোবেল প্রদান মেনে নেওয়া হলেও ২০১৯-এর বিজয়ী পিটার হান্ডকে সার্বিয়ার কসাই মিলোসøাভিকের স্বঘোষিত সমর্থক। মুসলমান-অধ্যুষিত একটি অঞ্চলের আট হাজারের বেশি সংখ্যক মানুষের হত্যাকাণ্ডের বৈধতা প্রদানকারী হান্ডকেকে নোবেলের জন্য পছন্দ করার মতো অনৈতিক কাজ করে নোবেল কমিটি আবার বিতর্কিত হয়ে পড়ে। ২০২০-এর পুরস্কারটি ছিল তাদের জন্য কলঙ্ক থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা। এক বাক্যে অনেকেই বলবেন, লুইস গ্লিকের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী ছিলেন। অবশ্যই ছিলেন। লুইস গ্লিক বরং মন্দের ভালো।
সাহিত্যের নোবেল : বাজিকরদের তালিকা
সেপ্টেম্বর থেকেই সাড়া পড়ে যায়। সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার কে পাবেন – কাকে নিয়ে বাজি ধরা যায়। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে বাজির খাতা খোলে এবং নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে বন্ধ হয়। কোনো কোনো সময় শীর্ষ নামটি, কিংবা দ্বিতীয় বা তৃতীয় কিংবা লম্বা তালিকার একজন পুরস্কার পেয়ে যান। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মতো নোবেল কমিটির সদস্যের বিরুদ্ধেও বিজয়ীর নাম ফাঁস করার অভিযোগ আছে।
এ-বছরের ‘নাইস অডস’ যে চূড়ান্ত তালিকা দিয়েছে তার শীর্ষেও একজন নারী লেখক, তবে তিনি লুইস গ্লিক নন, তিনি ৮৩ বছর বয়স্ক ফরাসি ঔপন্যাসিক ম্যারিসে কোনডে। ‘নাইস অডস’ প্রকাশিত সেরা বত্রিশ জনের তালিকায় লুইস গ্লিক ২১ নম্বরে। আগ্রহী পাঠকের জন্য সর্বাধিক বাজি-সমর্থন থেকে ক্রমান্বয়ে নেমে আসা তালিকাটি উপস্থাপন করা হলো :
ম্যারিসে কোনডে
গুডমিলা উলিতস্কায়া
হারুমি মুরাকামি
মার্গারেট অ্যাটউড
নগুই ওয়া থিয়োঙ্গো
অ্যান কারসন
হাভিয়ের মারিয়াস
কো উন
ইয়ান লিয়াঙ্কে
এনি এনরো
ক্যান স্যু
কোরম্যাক ম্যাক্কার্থি
ভন ডি লিলো
ম্যারিলিন রবিনসন
জামায়িকা কিঙ্কেইড
ইউ হুয়া
এডনা ও ব্রিয়েন
ফ্রেডেরিকে মেরোকার
চার্লস সিমিক
জন ফসে
লুইস গ্লিক
স্কলাসটিক মুকাসোঙ্গা
বোথ স্ট্রস
হোমেরো আরিদজিস
উইলিয়াম ভোলম্যান
হিলারি ম্যানটেল
কার্ল ওভে নসগার্ড
লিস্টন জনসন
মিশেল নোলেবেক
মিলান কুন্ডেরা
স্টিফেন কিং
রিচার্ড ওসমান
আরো একটি তথ্য পাঠকের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে। ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চা করে যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন লুইস গ্লিক তাঁদের মধ্যে ৩০তম বিজয়ী।
এই ৩০ বিজয়ীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথও অন্তর্ভুক্ত; নোবেল কমিটির দলিলে তাঁর ভাষা বাংলা ও ইংরেজি লেখা হয়েছে; তেমনি স্যামুয়েল বেকেটের বেলায় ফরাসি ও ইংরেজি লেখা হয়েছে। এই ৩০ জন বিজয়ী হচ্ছেন :
রুডিয়ার্ড কিপলিং (১৯০৭), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৩), উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৯২৩), জজ বার্নার্ড শ (১৯২৫), সিঙ্কলেয়ার লিউইস (১৯৩০), জন ইলাসওয়ার্দি (১৯৪৮), উইলিয়াম ফকনার (১৯৪৯), বার্ট্রান্ড রাসেল (১৯৫০), উইনস্টন চার্চিল (১৯৫৩), আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৯৫৪), জন স্টেইনবেক (১৯৬২), স্যামুয়েল বেকেট (১৯৬৯), পেট্রিক জোয়াইট (১৯৭৩), সম বেলো (১৯৭৬), উইলিয়াম গোল্ডিং (১৯৮৩), নাদিন গর্ডিমার (১৯৯১), ডেরেক ওয়ালকট (১৯৯২), টনি মরিসন (১৯৯৩), সিমাস হিনি (১৯৯৫), ভিএস নাইপল (২০০১), জেএম কোয়েটজি (২০০৩), হ্যারল্ড পিন্টার (২০০৫), ডরিস লেসিং (২০০৭), এলিস মুনরো (২০১৩), বব ডিলান (২০১৬), কাজুও ইশিগুরো (২০১৭), লুইস গ্লিক (২০২০)।
লুইস গ্লিককে নোবেল পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করায় সুইডিশ অ্যাকাডেমি নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু পিটার মাস লিখেছেন, ‘কীসের ধন্যবাদ? এটি একটি অসৎ সংগঠন, আত্মসম্মানহীন। ১৯৬৪ সালে জ্যা পল সার্ত্রে পুরস্কার গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। এখন সুইডিশ অ্যাকাডেমিকে চ্যালেঞ্জ করার সময় এসেছে।’
লুইস গ্লিকের বই
পদ্যগ্রন্থ
১৯৬৮ : ফার্স্ট বোর্ন
১৯৭৫ : দ্য হাউস অফ মার্শল্যান্ড
১৯৮০ : ডিসেন্ডিং ফিগার
১৯৮৫ : দ্য ট্রাম্প অব অ্যাকিলিস
১৯৯০ : আরারাত
১৯৯২ : দ্য ওয়াইল্ড আইরিস
১৯৯৫ : দ্য ফার্স্ট ফোর বুকস অব পোয়েমস
১৯৯৭ : মিডোল্যান্ডস
১৯৯৯ : ভিটা নোভা
২০০১ : দ্য সেভেন এইজেস
২০০৬ : অ্যাভের্নো
২০০৯ : অ্যা ভিলেজ লাইফ
২০১২ : পোয়েম : ১৯৬২-২০১২
২০১৪ : ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট
গদ্যগ্রন্থ
১৯৯৪ : প্রুফস অ্যান্ড থিওরিস : এসেস অন পোয়েট্রি
২০১৭ : আমেরিকান অরিজিনালিটি : এসেস অন পোয়েট্রি
বুকলেট
১৯৭৬ : দ্য গার্ডেন
২০০৪ : অক্টোবর
আসন্ন কাব্যগ্রন্থ
২০২১ : উইন্টার রেসিপিস ফ্রম দ্য কালেক্টিভ
লুইস গ্লিক : টাইমলাইন
১৯৪৩ : নিউইয়র্কে হাঙ্গেরিয়ান অভিবাসী ইহুদি পরিবারে ২২ এপ্রিল জন্ম। বাবার কবিপ্রতিভা ছিল কিন্তু বিকশিত হয়নি।
১৯৬১ : জর্জ হিউনেট হাইস্কুল থেকে উত্তীর্ণ।
১৯৬৭ : কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ছেড়ে সাচিবিক চাকরি গ্রহণ, বিয়ে এবং একই বছর তালাক।
১৯৬৮ : প্রথম কাব্যগ্রন্থ ফার্স্ট বোর্ন প্রকাশ।
১৯৭১ : ভারমন্টের গোডার্ড কলেজে কবিতার শিক্ষক।
১৯৭৩ : পার্টনার জন ড্র্যানোর সঙ্গে বসবাস, পুত্রসন্তনের জন্ম।
১৯৭৫ : কাব্যগ্রন্থ দ্য হাউস অব মার্শল্যান্ড প্রকাশিত হয়। লুইস গ্লিক মনে করেন, এই প্রকাশনাটিতেই তিনি তাঁর স্বতন্ত্র স্বর খুঁজে পান।
১৯৭৭ : তাঁর পুত্রের জনক জন ড্র্যানোকে বিয়ে করেন, পরে তাঁর সঙ্গেও ১৯৯৪ সালে তালাক হয়ে যায়।
১৯৮০ : তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ডিসেন্ডিং ফিগার প্রকাশিত।
১৯৮৪ : ম্যাসাচুসেটসে অবস্থিত উইলিয়ামস কলেজের ইংরেজি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগদান।
১৯৮৫ : বাবার মৃত্যু।
১৯৯০ : কাব্যগ্রন্থ আরারাত প্রকাশিত।
১৯৯২ : কাব্যগ্রন্থ দ্য ওয়াইল্ড আইরিস প্রকাশিত।
১৯৯৩ : দ্য ওয়াইল্ড আইরিস পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত।
১৯৯৪ : প্রবন্ধগ্রন্থ প্রুফস অ্যান্ড থিওরিস : এসেস অন পোয়েট্রি প্রকাশিত।
১৯৯৯ : লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের স্পেশাল কনমালট্যান্ট নিযুক্ত।
২০০১ : ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইটার ইন রেসিডেন্স।
২০০৩ : পোয়েট লরিয়েট মনোনীত।
২০০৯ : কাব্যগ্রন্থ আ ভিলেজ লাইফ প্রকাশিত।
২০১৪ : কাব্যগ্রন্থ ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট প্রকাশিত।
২০২০ : নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ।
লুইস গ্লিকের একডজন কবিতা
প্রথম স্মৃতি
বহুদিন আগে, আমি বিক্ষত হয়েছিলাম। আমার
বাবার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে
আমি বেঁধেছিলাম – প্রতিশোধ
বাবার বিরুদ্ধে – তিনি যা ছিলেন
সে জন্য নয়, আমি যা ছিলাম সে জন্য
সময়ের পুরু থেকে, শৈশবে
আমি ভাবতাম
আমাকে ভাবতাম
আমাকে ভালোবাসা হচ্ছে না
তার মানে আমি তো
ভালোবাসতাম।
সকাল নটায় একা-কথন
এ তেমন ছোট কিছু নয়, এই সুরেলা
অধ্যায় পর্যন্ত চলে আসা। ষোলো বছর আগে
শুরু থেকেই তার সাথে জীবনযাপন গায়ে জ্বর
এনে দেয়। ষোলো বছর আমি বসে আছি
অপেক্ষা করেছি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
আমাকে হাসতে হয়েছে।
জানো আমি স্বপ্ন দেখতাম ভাটার টানে মৃত্যুর দিকে
চলেছি; অথবা সে আবার প্রেমে পড়ছে, তার জলনালার
দিক ঘুরেছে অন্যজনের দিকে। বেশ তো,
আমার ধারণা সে তাই করেছে।
আমি ভেবেছি, তার অনুপস্থিতি আঁচ করছি,
আজ তার রেখে যাওয়া ডিমপোচ মরণাপন্ন চোখ
হয়ে তাকিয়ে আছে, তার টোস্টে হাত পড়েনি।
কিরকির ক্ষমতা
(সূর্য-ঈশ্বর হেলিওস এবং সমুদ্রদেবী পার্সির কন্যা কিরকি। কিরকি জাদু জানতেন, মানুষকে অন্য কোনো প্রাণীতে পরিণত করতেন। সমুদ্রের নিঝুম দ্বীপে তার নিবাসে অডেসিউস যখন পৌঁছলেন, তার সঙ্গীরা শূকরছানায় পরিণত হলো। অলিম্পিয়ান দেবতাদের বার্তাবাহক হার্মেসের সাহায্য পেয়ে অডেসিউস এ-রূপান্তর থেকে বেঁচে গেলেন বরং তার প্রেমিক হিসেবে তিনটি পুত্রসন্তানের জনকও হলেন। তাদের একজন টেলিগোনাসের হাতে দুর্ভাগ্যবশত অডেসিউসের মৃত্যু ঘটে। – অনুবাদক)
আমি কখনো কাউকে শূকরছানায় পরিণত করিনি
কিছু মানুষ এমনিতেই শূকরছানা; আমি তাদের
শূকরছানার আকৃতিতে প্রকাশ করি।
আমি তোমার পৃথিবী নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছি
তাতে বাইরের বেশ ভেতরটা ছদ্মবেশে থাকে
তোমার মানুষগুলো খারাপ ছিল না
উচ্ছৃঙ্খল জীবন তাদের এমন করেছে
শূকরছানার মতো।
আমার ও আমার নারীদের
প্রযত্নে, তারা
সদাচারী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপর আমার জাদুভর করি, তোমাকে দেখাই
আমার ভালো গুণ এবং আমার ক্ষমতাও। দেখি
আমার সেখানে সুখী হতে পারি
যেমন গুণী নারী ও পুরুষ
যখন তাদের চাহিদা যৎসামান্য, একই নিশ্বাসে
আমি তোমার প্রত্যাগমন আগাম দেখতে পাই
আমার সহায়তা নিয়ে তোমার লোকজন সাহস করে
চিৎকারে ও দাবড়ে সাগর মাতায়। তুমি ভাবো,
কয়েক বিন্দু অশ্রু আমাকে বিচলিত করে? শোনো বন্ধু
সমস্ত নারী জাদুকর
অন্তরে প্রয়োগবাদী; যারা সীমাবদ্ধতা
মেনে নিতে পারে না, তার সারবত্তা খুঁজে পায় না।
আমি যদি তোমাকে ধরে রাখতে চাইতাম
তোমাকে বন্দি হিসেবে রেখে দিতাম।
সুখ
একজন পুরুষ এবং একজন নারী
সাদা বিছানায় শুয়ে থাকে
সকাল হয়েছে, আমি ভাবি শিগগির
তারা জেগে উঠবে।
বিছানার পাশ-টেবিলে ফুলদানিতে লিলি
সূর্যালোক তাদের নীলায় জমা হয় –
আমি দেখি পুরুষ নারীর দিকে ফেরে
যেন তার নাম ধরে ডাকবে
কিন্তু নিঃশব্দে, তার মুখের গভীরে
জানালার শার্সিতে
একবার দুবার
একটি পাখি ডাকে।
তারপর সে নড়ে ওঠে; তার শরীর ভরে ওঠে
পুরুষের নিশ্বাসে।
আমি চোখ মেলি : তুমি আমাকে পর্যবেক্ষণ করছ।
প্রায় সমস্ত ঘরেই সূর্য সাঁতরে নেমে এসেছে
তোমার মুখের দিকে তাকাই, তুমি নিজেকে
আমার কাছে টেনে চলো, আয়না বানাও।
কত শীতল তুমি। আর জ্বলন্ত চাকা
আমাদের ওপর দিয়ে শান্তভাবে চলে যায়।
রাত
মা গতরাতে মারা গেলেন
যে মা কখনো মরে না।
বাতাসে শীত নেমে আসে
যদিও শীতকাল অনেক দূরে
তবু নেমেছে বাতাসে
মে মাসের দশ তারিখ
কচুরিপানা ও আপেল ফুল ফুটেছে
বাড়ির পেছনের বাগানে
আমরা শুনতে পাচ্ছি
মারিয়া চেকোশ্লোভাকিয়া থেকে গান গাইছে :
কত নিঃসঙ্গ আমি –
এ-ধরনের গান।
কত নিঃসঙ্গ আমি
মা নেই, বাবা নেই –
তাদের ছাড়া আমার মস্তিষ্ক এত শূন্য
পৃথিবী থেকে সুঘ্রাণ বেরিয়ে যায়
খাবার-দাবার সব সিঙ্কে ডোবানো
ধোয়া হয়ে গেছে জল ঝরেনি
পূর্ণচাঁদের নিচে
মারিয়া ধোয়াধুয়ি শেষ করে আনছে
শক্ত চাদর শুকিয়ে হয়ে ওঠে
চন্দ্রালোকের চতুর্ভুজ।
কত নিঃসঙ্গ আমি, কিন্তু সংগীতে
আমার হতাশা আনন্দ হয়ে ওঠে
মে মাসের দশ তারিখ
যেমন ছিল নয় তারিখ কিংবা আট
মা ঘুমোচ্ছে তার বিছানায়
দু-হাত বাইরের দিকে ছড়ানো, এরই
মাঝে তার মাথা ভারসাম্য রক্ষা করেছে।
তুষারবিন্দু
তুমি কি জানো আমি কী ছিলাম
আমি কেমন করে বেঁচে ছিলাম
তুমি জানো হতাশা কী – তাহলে
তোমার কাছে শীতের একটা মানে থাকবে।
আমি টিকে থাকব এ-আশা করিনি
পৃথিবী আমাকে চেপে ধরে আছে। আবার
আমি জাগব এ-আশা করিনি, স্যাঁতসেঁতে
পৃথিবী আবার অনুভব, আমার দেহ
সাড়া দিতে সক্ষম পুনরায় – এতদিন পর
পুনরায় স্মরণ – কেমন করে গুনব
বসন্তের আগেভাগে শীতল আলো –
আকস্মিক, হ্যাঁ, কিন্তু তোমার ভেতর আবার
ক্রন্দন, হ্যাঁ ঝুঁকির আনন্দ
নতুন পৃথিবীর এলোমেলো ঝঞ্ঝা ও বাতাসে।
প্রেমের কবিতা
যন্ত্রণা দিয়ে তৈরি করার মতো কিছু না কিছু
বরাবরই আছে।
তোমার মা তা-ই বোনেন।
লালের সব ধরনের শেড দিতে তিনি স্কার্ফ বোনেন।
ওগুলো ক্রিসমাসের জন্য আর ওসব তোমাকে উষ্ণ রেখেছে
যখন তাকে বারবার বিয়ে করতে হয়েছে তোমাকে সাথে নিয়ে।
এতদিন কেমন করে কাজ করল
যখন এতগুলো বছর তিনি তার বৈধব্যগ্রস্ত হৃদয়
জমা করে রেখেছেন যেন মৃত মানুষ ফিরে আসবে
অবাক হবার কিছু নেই, তুমি যেমন আছ তেমনই।
রক্ত দেখে আঁতকে ওঠো, তোমার নারীর
পছন্দ একটি ইটের দেয়ালের পর
আরেকটি দেয়াল।
টেলিস্কোপ
যখন তুমি তোমার দৃষ্টি সরাও, তারপর একটি মুহূর্ত আছে
তখন তুমি ভুলে যাও তুমি কোথায়
কারণ মনে হবে তুমি অন্য কোথাও বাস করো
রাতের আকাশের নৈঃশব্দ্যে।
তুমি এই পৃথিবীতে থাকাটা বন্ধ করে দিয়েছ
তুমি এখন ভিন্ন জায়গায়
যেখানে মানুষের জীবনের কোনো অর্থ নেই।
তুমি দেহধারী কোনো প্রাণী নও
নক্ষত্রের যেমন অবস্থান, তোমারও তেমনই।
তাদের নীরবতায় তাদের বিশালতায় তোমার অংশগ্রহণ।
তারপর তুমি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসো
রাতের বেলা শীতল পাহাড়ের ওপর
তোমার টেলিস্কোপ আলাদা করে রাখো।
তারপর তুমি বুঝতে পারো
ইমেজটা কিন্তু ভুয়া নয়
সম্পর্কটা আসলে ভুয়া।
তুমি আবার দেখো, প্রত্যেকটি জিনিস
একটি আরেকটির কাছ থেকে অনেক দূরে।
অ্যাকিলিসের বিজয়
পেট্রোক্লাসের গল্প
কেউ বেঁচে থাকে না, এমনকি অ্যাকিলিসও না
যিনি ছিলেন প্রায় একজন ঈশ্বর।
পেট্রোক্লাস দেখতে তারই মতো, দুজন
একই ধরনের সমরসাজ পরেছিলেন।
এই বন্ধুত্বে
একজন অন্যজনের খাদেম, মান্যতার সিঁড়িতে
একজন অন্যজনের নিচে
এটা তো সবসময়ই স্পষ্ট, যদি পুরাণের কথা
বিশ্বাস করা যাবে না।
তাদের কাহিনির উৎস বেঁচে থাকা একজন
যাকে পরিত্যাগ করা হয়েছিল।
এই ক্ষতির তুলনায়
গ্রিক জাহাজের আগুন কত বেশি ছিল?
তার তাঁবুতে অ্যাকিলিস
সকল স্বজন নিয়ে শোকসন্তপ্ত
এবং ঈশ্বর দেখলেন
তিনি একজন মানুষ, আগেই মৃত, যে-অংশটা
ভালোবাসত তার প্রিয়া
সেই অংশটা ছিল মরণশীল।
সাদা লিলি
নক্ষত্রের বিছানা যেমন
একজন পরী ও একজন পুরুষ তাদের মাঝখানে
এমন একটি বাগান তৈরি করে, এখানে তারা
গ্রীষ্মসন্ধ্যায় দীর্ঘ সময় কাটায়, কিন্তু
সন্ধেটা আতঙ্কে শীতল হয়ে আসে।
সব শেষ হয়ে যেতে পারে, এটা ধ্বংস করতে সক্ষম।
সবকিছুই, সবই হারিয়ে যেতে পারে সুঘ্রাণ
বাতাসের সাথে অর্থহীন সরু খুঁটি বেড়ে উঠছে
ভেতরে ও বাইরে – পপির ঘূর্ণায়মান সমুদ্রে …
ধ্যাৎ প্রিয়, বেঁচে থেকে আমার ফিরতে কটা গ্রীষ্ম
কেটে যাবে তাতে পিছু এসে-যায় না
এক গ্রীষ্মে আমরা অনন্তে প্রবেশ করেছি।
আমি তোমার দু-হাত অনুভব করেছি
এর বৈভব মুক্ত করতে আমাকে তুমি
সমাহিত করো।
পোর্ট্রেট
একটি শিশু শরীরের কাঠামো আঁকে
সে যতটা পারে ততটা আঁকে, তবে পুরোটাই সাদা
সে যা জানে তাতে ভেতরটা পূর্ণ করতে পারে না
অপূর্ণ রেখার মধ্যে সে জানে
জীবনটা হারিয়ে যাচ্ছে : একটি প্রেক্ষাপট কেটে
সে অন্য প্রেক্ষাপটে যায়, শিশুর মতোই
সে তার মায়ের দিকে তাকায়।
সে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে
তার ভেতর তুমি হৃৎপিণ্ড আঁকো।
চৌরাস্তা
আমার শরীর, তোমাকে নিয়ে আর দীর্ঘ সময়
একসাথে সফর করব না
তোমার জন্য এক নতুন যাতনা অনুভব করতে শুরু করেছি
খুব অমসৃণ এবং অপরিচিত
আমার কম বয়সের ভালোবাসা যেমন ছিল
লক্ষ নির্ধারণে প্রায়ই বোকামি করে
ফেলতাম কিন্তু পছন্দে কিংবা ভালোবাসার তীব্রতায় নয়
আগাম চাহিদা বড্ড বেশি, এত বেশি যে প্রতিশ্রুতি
দেওয়া যেত না। আমার আত্মা
এত সন্ত্রস্ত, এত সহিংস :
এর নির্মমতা ক্ষমা করে দাও।
যেন এটা সেই আত্মা, আমার হাত সতর্কভাবে তোমার
ওপর চালাই – তোমাকে আঘাত দেবার ইচ্ছেতে নয়,
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সারাংশ হিসেবে এই অভিব্যক্তি
প্রকাশ করতে চাই আমি পৃথিবীকে মিস করব না আমি তোমাকে মিস করব।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.