আসমা সুলতানা
ফরাসি ভাস্কর কামিল ক্লদেলের নামের পাশে মহাকবি কালিদাসের শকুন্তলার নাম দেখে হয়তো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, শকুন্তলার সঙ্গে কামিলের যোগসূত্রটা কোথায়? আমরা জানি, ভারতীয় শিল্পী রাজা রবি বর্মার চিত্রকলায় শকুন্তলার কাহিনি বহুবার অনুরণনিত হয়েছে। কামিলের একটি ভাস্কর্যেরও প্রথম নামকরণ করা হয়েছিল ‘শকুন্তলা’। অদ্ভুতভাবে কামিলের জীবনের সমান্তরালে ভাস্কর্যটির নামও বিবর্তিত হয়েছিল। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদের পর দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার মিলিত হওয়ার মুহূর্ত ধারণ করেছে বলে দাবি করা বহু মাধ্যমে অনূদিত এই ভাস্কর্যটি ১৯০৫ সালে ওভিডের মেটামরফোসিসে অমর হয়ে থাকা রোমান পুরাণের দুই চরিত্রের নাম নিয়েছিল – ‘ভার্টুমনাস অ্যান্ড পোমোনা’। এই নামকরণটি অর্থহীন ছিল না, ফলের দেবী পোমোনার বাগানে চিরকুমারী থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অধরা পোমোনাকে জয় করতে বৃদ্ধার রূপ নিয়ে প্রবেশ করেছিল ঋতুর দেবতা ভার্টুমনাস। বৃদ্ধা পোমোনাকে সে বলেছিল, তার বাগানে আঙুরলতা আরো বেশি ফলবান হবে যদি এটি বয়স্ক কোনো বৃক্ষের নির্ভরতা পায়, এবং একজন নারী প্রস্ফুটিত হয় পুরুষের ভালোবাসায় – বৃদ্ধার প্রজ্ঞায় নির্ভর করে ভার্টুমনাসকে তার জীবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল পোমোনা। খানিকটা তীর্যকভাবে হলেও এখানে কি আমরা কামিলের জীবনের সঙ্গে কোনো সমান্তরালতা দেখতে পাই? যদিও ভার্টুমনাস আর পোমোনার এই ভালোবাসা বিয়োগান্তক নয়, যা কামিলের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ছিল। এর কিছুদিন পরেই কামিলের সবচেয়ে পরিচিত এবং বিখ্যাত সৃষ্টির নাম যথার্থভাবেই বিবর্তিত হয়েছিল লা’বানডোঁ (অ্যাবানডনমন্ট), যা আমরা অনুবাদ করতে পারি একাধিক শব্দ দিয়ে – পরিত্যাগ, বিসর্জন কিংবা উদ্বাসন। আর প্রতিটি শব্দ কামিলের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।
শকুন্তলার মতো দীর্ঘ বিচ্ছেদের শেষে কামিলের জীবনে মিলনের মুহূর্ত আসেনি, পোমোনার মতো ভার্টুমনাসকে ভালোবাসতে প্ররোচিত হয়েও পোমোনার মতো সুখী জীবন তিনি পাননি। প্রিয়জন ও পরিবারের সদস্যদের দ্বারা পরিত্যক্ত কামিলের জীবনের অধিকাংশ সময় মানসিক হাসপাতালের শীতল একটি কক্ষে নির্বাসনে কাটাতে হয়েছিল। জন্ম থেকেই পরিত্যক্ত প্রকৃতির মেয়ে শকুন্তলা ভালোবেসেছিল এক রাজাকে। বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় কাতর শকুন্তলাকে অভিশাপ দিয়েছিল এক ঋষি। দুষ্মন্তের ভালোবাসা আর স্মৃতি থেকে নির্বাসিত শকুন্তলা অবশেষে ফিরে পেয়েছিল তার ভালোবাসার মানুষটিকে; কিন্তু ভালোবাসা আর অপ্রতিরোধ্য সৃজনশীলতা থেকে নির্বাসিত কামিলের জীবনে শকুন্তলার সেই দুঃস্বপ্ন স্থায়ী একটি রূপ নিয়েছিল। সে-কারণে কামিলের জীবনকে যদি একটি শব্দে বর্ণনা করা হয় সেটি হবে ‘দুর্দৈব’ আর তাঁর শিল্পকর্মগুলো যদি একটি শব্দে বর্ণনা করতে হয়, সেটি হবে ‘সম্পর্ক’।
নিয়তি এবং সম্পর্ক – কামিলের জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। কামিল স্বতন্ত্র একজন শিল্পী হিসেবে পরিচিত হওয়ার পূর্বে সুপরিচিত ভাস্কর অগুস্ত রদ্যাঁর শিক্ষার্থী, সহকারী, প্রেমিকা অথবা কলালক্ষ্মী হিসেবে অধিকতর পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন আত্মাশ্রয়ী একজন নারী, আত্মপরিচয়ে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যে আজীবন কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করে গেছেন। একটা সময় সীমাবদ্ধ পরিমণ্ডলের মধ্যেই কামিলের প্রতিভা পরিচিত ছিল। তিনি ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী একজন নারী; যাঁর সৌন্দর্য ছিল ত্বকের বাইরে থেকে হৃদয়ের গভীর পর্যন্ত। জ্ঞানের প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা, শিল্পকলার প্রতি ছিল শুদ্ধ সততা। কামিল ছিলেন স্বাধীনচেতা, সংবেদনশীল, বুদ্ধিমতী এবং আত্মবিশ্বাসী, স্নেহময়ী বোন এবং বিশ্বস্ত প্রেমিকা।
কামিলের আয়ু অনেক শিল্পীদের মতো নাতিদীর্ঘ ছিল না। কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতার চর্চার মৃত্যু ঘটে খুব অল্প বয়সে। বলা যায়, তাঁর পেশাগত জীবনের অকালসমাপ্তি ঘটেছিল আকস্মিকভাবে, ধারাবাহিকভাবে ঘটা কিছু ঘটনার পরিণতিতে। তাঁর জীবন শেক্সপিয়ারের নাটকের থেকেও নাটকীয় এবং ফ্রান্সিসকো গয়ার শিল্পকর্মের থেকেও বিষাদময়, এদিথ পিয়াফের সংগীতের মতো অমসৃণ ও করুণ।
পেশাগত ও সামাজিক জীবনের অবসান ঘটলেও তাঁর জৈবিক শরীরটুকু নিয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন অনেক বছর। তাঁর জীবনের শেষ তিরিশটা বছর কাটাতে হয়েছিল তাঁকে মানসিক হাসপাতালের লম্বা করিডোরে হেঁটে বা বাগানে প্রকৃতির মধ্যে মুক্তজীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে বা হিম শীতল পাথরের দেয়ালের কোনো কক্ষে ডুকরে কেঁদে। তাঁকে অন্ধকূপে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল তাঁরই জন্মদাত্রী মা এবং অনুজ ভাই, যাকে তিনি নিজ সন্তানের মতো
করে মানুষ করেছিলেন। অন্যদিকে বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর শিল্পচর্চায় সব রকমের সহযোগিতা করেছিলেন। কন্যার স্বপ্নকে তিনি শ্রদ্ধা করেছেন এবং সর্বোত্তম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সে-কারণে তিনি সবধরনের ঝুঁকিও মোকাবিলা করেছেন, এমনকি করেছেন বাড়তি পরিশ্রমও। কিন্তু ১৯১৩ সালে পিতার মৃত্যুর পরপরই মা তাঁকে জোরপূর্বক মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করেন। কামিলের ছোট ভাই ও বোন মায়ের পক্ষেই থেকে যান আজীবন।
সবাই খুব প্রথাগত, রক্ষণশীল, ধার্মিক মানুষ ছিলেন এবং পারিবারিক সম্পত্তি দখলেরও বিষয় ছিল। ভিল ইভরার্ড হাসপাতালে তাঁকে সাময়িকভাবে রাখা হয় এবং পরে স্থায়ীভাবে রাখা হয় সেন্ট হসিপটালিয়ের মন্টফাভে, আভিনিয়ঁতে। কামিল একটি চিঠিতে সে-সময়কার কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছিলেন এভাবেই – ‘একাকী বিড়ালদের সঙ্গে আমার জীবন কাটানো আর লাঞ্ছিত অনুভব করার জন্য আমাকে তিরস্কার (কী ভয়াবহ যেন সেই অপরাধ) করা হয়েছে। আর সেই অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে যে স্বাধীনতাহীন এবং খাদ্য, উষ্ণতা আর এমনকি ন্যূনতম চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে সাড়ে পাঁচ বছর আমাকে একজন অপরাধীর মতো বন্দি করে রাখা হয়েছিল।’
১৮৬৪ সালে ৮ ডিসেম্বর কামিলের জন্ম হয়েছিল উত্তর ফ্রান্সে পরবর্তীকালে কামিলের পরিবার ভিলনোভ-সুর-ফের’তে স্থানান্তরিত হয়, কামিলের স্মৃতিতে যে-জায়গাটি সারাজীবন অমøান ছিল, যার মাটির সঙ্গে কামিলের ছিল হৃদয়ের বন্ধন। কামিলের শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছিল গ্রামে, সেখানে কাদামাটি-পাথরে-প্রকৃতিতে তিনি শিল্প খুঁজে পেতেন। মাত্র বারো বছর বয়সেই কামিলের সৃজনশীলতা উন্মেষিত হতে শুরু করে। উচ্চশিক্ষার জন্য ১৮৮১ সালে পরিবারের সঙ্গে তিনি প্যারিসে এসেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পকলা পাঠদানের প্রক্রিয়ায় নগ্নতার চর্চা ছিল অপরিহার্য। শিল্পীরা মানবশরীরের নগ্ন রেখাচিত্র সঠিকভাবে অংকন করতে না জানলে প্রকৃত শিল্পী বলে গণ্য হতেন না। অধিকন্তু, নারীদের নগ্নচিত্র চর্চায় ছিল নিষেধাজ্ঞা। প্যারিসের মতো আধুনিক একটি শহরে, অনেক সম্ভাবনার দরজা ছিল উন্মুক্ত, বেশ কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পকলা প্রশিক্ষণ স্কুল নারীদের শিল্পকলার চর্চার প্রায় সব ধরনের সুযোগ দিত, তেমন একটি স্কুল ‘আকাদেমি কোলারোসি’তে কামিল শিক্ষার সুযোগ পান। মেধার সঙ্গে শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত করেন। পরবর্তীকালে একটি স্টুডিওতে শিল্পচর্চা শুরু করেন, যেখানে অ্যালফ্রেড বুশের শিক্ষকতা করতেন। রদ্যাঁ আলফ্রেডকে সরিয়ে উপযাচকের মতো নিজে সে-দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং ১৮৮৫ সালে রদ্যাঁ কামিলকে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দেন।
রদ্যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের সময় কামিলের বয়স ছিল ১৯ বছর। তাঁদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল ২৪ বছরের। তা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে গভীর প্রণয় ঘটে এবং পরিণাম হয় ভয়াবহ। মাত্র দশ বছরের সেই সম্পর্ক থেকে সৃষ্টি হয় অসংখ্য অমর শিল্পকর্ম। তিনি রদ্যাঁর শিল্পকর্মের মডেলও হয়েছেন এবং ১৮৯২ সালে নিজেও রদ্যাঁর ভাস্কর্য গড়েছেন। তাঁদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও কামিলের সীমাহীন অদম্য মানসিক শক্তি কামিলকে রদ্যাঁর সমপর্যায়ে নিয়ে যায়। কামিলের প্রতিভা রদ্যাঁর সুনাম থেকেও ছড়িয়ে গিয়েছিল অনেকটা। রদ্যাঁ বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও নানা কারণে তিনি একজন সহজেই আক্রম্য, নিরাপত্তাহীনতায় আক্রান্ত অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর একজন মানুষ ছিলেন, সেজন্য কামিলকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন উত্তরণের সিঁড়ি হিসেবে।
১৮৮৮ সালের শেষ দিকে কামিল লন্ডন ভ্রমণশেষে রদ্যাঁর সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হন, রদ্যাঁ কোনো নারীশিক্ষার্থীকে নিয়োগ করতে পারবেন না এবং তাঁদের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেবেন, যদিও বাস্তবে সেরকম কিছু ঘটেনি। কামিল ‘শকুন্তলা’ সৃষ্টিতে মনোসংযোগ করেন এবং সফলভাবে ‘শকুন্তলা’ নির্মাণ করেন। এই ভাস্কর্যে দেখা যায়, নারীশরীরটি বসে ঝুঁকে আছে আর পুরুষশরীরটি নারীর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে, যেন নারীর সীমাহীন ভালোবাসার কাছে পুরুষটি আত্মসমর্পণ করছে। মানব-মানবীর এই দৈহিক ও মানসিক গভীর ভালোবাসার সম্পকের্র কথা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে কামিলের শিল্পকর্মে। একই বছর প্যারিসে সালোনে (ফরাসি শিল্পীদের শিল্পকলা প্রদর্শনী) সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন শিল্পী কামিল। তাঁর সফলতার দরজা খুলতে শুরু করেছে যে-সময়টিতে ঠিক সে-সময় আপনজনরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে সে-পথ রুদ্ধ করে দেয়।
কেন কামিলের ভাস্কর্যে মানব-মানবীর প্রেম এতো তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে? ‘শকুন্তলা’ (১৮৮১), ‘দ্য ওয়ালজ’ (১৮৮৯), ‘দ্য ম্যাচিউর এইজ’ (১৮৯৮-১৯১৩) প্রভৃতি শিল্পকর্মের মাধ্যমে কামিল অভিব্যক্ত করেছেন ভালোবাসার জন্য তাঁর তৃষ্ণা। কারণ শিল্পী রদ্যাঁকে তিনি সর্বস্ব উজার করে ভালোবেসেছিলেন। পরিণামে পেয়েছেন যন্ত্রণা এবং অবজ্ঞা। শকুন্তলার আরো বেশ কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে। মার্বেল প্রতিলিপিটির নামকরণ করা হয় ‘ভার্টুমনাস এ পোমোনা’ (১৯০৫) এবং ব্রোঞ্জ প্রতিলিপিটির নামকরণ করা হয় ‘অ্যাবান্ডনমেন্ট’ (লা’বানডোঁ)। কামিলের প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসার ফসল তাঁর সৃষ্টি শিল্পকর্মগুলো। মাটিকে তিনি বিশেষ ভালোবাসতেন, যে-কোনো কাদামাটির দলা থেকে সৃষ্টি করতে পারতেন অসম্ভব সুন্দর শিল্পকর্ম, গ্রিক-পৌরাণিক কাহিনির প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ (‘পার্সিয়াস অ্যান্ড দ্য গরগন’, ১৯০৫). যেমন ছিল ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিতে।
কিন্তু জীবনের অন্ধকার সময়ে, তিনি তাঁর শিল্পকর্মগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। মাত্র নব্বইটি শিল্পকর্ম আজো টিকে আছে, সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ভাস্কর্য, অল্পকিছু চিত্রকলা ও রেখাচিত্র। সেসব শিল্পকর্ম পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় কামিল কত বড়মাপের শিল্পী ছিলেন। তিনিই প্রথম নারী যিনি আধুনিক ভাস্করের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। তাঁর ভাবনা সেই সময় ছিল সময়ের বহু আগের, তিনি ছিলেন আভাঁ-গার্দ শিল্পী। বিষয় নির্বাচন, উপাদান নির্বাচন, শৈলী – সবকিছু বিবেচনায় আনলে বোঝা যায়, তিনি যদি জীবনের আরো তিরিশটা বছর শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখতে পারতেন, তবে আজ শিল্পকলার জগৎ কতটা ঋদ্ধ হতো!
কামিলের বিশেষত্ব ছিল, তিনি দুটো মাধ্যমকে মিশ্রিত করে ভাস্কর্য গড়তেন, যেমন মার্বেল বা অনিক্স পাথরের সঙ্গে ব্রোঞ্জকে জুড়ে দিতেন। শিল্পকলা নিয়ে
তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভীত ছিলেন না, বরং ছিলেন আধুনিক মানসিকতার। কামিলের শিল্পকলায় সমসাময়িক
পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্টদের প্রভাব লক্ষণীয়, আর্ট ন্যুভো বা জাপানি ছাপচিত্রের প্রভাবও সুস্পষ্ট। তবে এসব ভিন্নধর্মী শৈলীকে শিল্পকর্মে আশ্রয় দেওয়া প্রমাণ করে তাঁর মুক্তমনের কথা। ‘দ্য ওয়েভ’ (১৮৯৭)-এ অনিক্স পাথরের মাঝে ব্রোঞ্জে গড়া তিনটি নারীশরীর সুন্দরভাবে ভাসছে। তাঁর জীবনে সম্পর্কের মধুরতা দেখা না গেলেও কাজের মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, নারীমূর্তির অবয়বের মধ্যে দিয়ে, জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আটপৌরে কাজের মধ্যে দিয়ে, যেমন ফায়ারপ্লেসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা, বা স্নানঘরে বিভিন্ন বয়সের নারীদের কানাকানি (‘দ্য গসিপ’, ১৮৯৭)। ‘দ্য ওয়েভ’-এ শিল্পী কাটসুশিকা হকুসাইয়ের ‘দ্য গ্রেট ওয়েভ’-এর প্রভাব (১৮৩২) সুস্পষ্ট, তবে পাথরের মতো কঠিন একটি পদার্থ দিয়ে পানির মতো তরল একটি পদার্থ বা সমুদ্রের ঢেউকে প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ, যা তিনি করেছেন সফলতার সঙ্গে।
কামিল যে-শিল্পকর্মগুলোর জন্য বিখ্যাত তাদের মধ্যে ‘দ্য ম্যাচিউর এইজ’ অন্যতম, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন একজন পুরুষকে একজন বৃদ্ধ নারী টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পুরুষটি যেন সম্মোহিত এবং একজন তরুণী হাঁটু গেড়ে বসে পুরুষটির কাছে অনুনয়-বিনয় করছে। স্পষ্টতই এখানে তিনি রদ্যাঁর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বর্ণনা করেছেন। রদ্যাঁ রোজ নামে একজন রমণীর সঙ্গে সম্পর্কে যুক্ত ছিলেন আজীবন, কামিলের সব যন্ত্রণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যে, তাকেই কামিল অভিব্যক্ত করেছেন। রোজকে কামিল কুৎসিত ও বৃদ্ধ দেখিয়েছেন (বাস্তবেও এটিই সত্যি ছিল)। প্রতিশোধের তীব্রতা কিছুটা হলেও মিটিয়েছেন কামিল তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে।
এদিকে ‘শকুন্তলা’কে (১৮৮১ সালে) যখন কামিল সৃষ্টি করেছিলেন তখন তিনি ছিলেন আবেগময়ী এক তরুণী। তিনি তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে পেতে চেয়েছিলেন রদ্যাঁকে, সেই তীব্র প্রেমের প্রতিশ্রুতি তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘শকুন্তলা’র মাধ্যমে। ‘শকুন্তলা’ এবং ‘দ্য ম্যাচিউর এইজ’ কামিলের সঙ্গে রদ্যাঁর সম্পর্কের দুটি ভিন্ন মেরুর কথা, বলে শুরু ও শেষ বিন্দুর কথা।
কামিল মানসিক হাসপাতালে জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন এবং শেষ দিনটি পর্যন্ত একটি শিল্পকর্মও তিনি নির্মাণ করতে পারেননি। একজন শিল্পীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হলো সৃষ্টি থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা। সেটা মৃত্যুযন্ত্রণা থেকেও যন্ত্রণাময়। শিল্পীদের জীবন যদিও মুক্তোর মতো মসৃণ নয়, তবু কামিলের ক্ষেত্রে যেন মাত্রাতিরিক্ত ছিল, এমনকি মৃত্যুর পরেও কামিল সুবিচার পাননি। মৃত্যুর পূর্বেও যারা বন্ধুত্বের হাত এগিয়ে দিয়েছিলেন, ব্যর্থ হয়েছিলেন। মৃত্যুর পরেও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি তেমন কোনো শ্রদ্ধা। খুব ছোট একটা গ্রামে, মানসিক হাসপাতালের সাধারণ একটি সমাধিস্থলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। পরিবারের কোনো সদস্য তাঁর শবযাত্রায় বা শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিল না, এমনকি তাঁর মরদেহকে পরিবারের কোনো সদস্য দাবিও করতে আসেননি। কী নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ! শিল্পীদের প্রতি পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের এহেন আচরণ যেন খুব স্বাভাবিক। এটাই যেন শিল্পীদের অবধারিত নিয়তি। যাঁর জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর উন্নত সভ্য দেশ ফ্রান্সে। দীর্ঘ ৭৮ বছরের যন্ত্রণাময় জীবন যাপনের পর ১৯৪৩ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কামিলের পরিবারের সদস্যদের কথা আজ পৃথিবী জানতে পারছে তাঁর নামের মাধ্যমে, যারা একদিন অনেক চেষ্টা করেছে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে তাঁর অস্তিত্ব মুছে দিতে। আজ প্যারিসের বুকে রয়েছে কামিলের নামে একটি জাতীয় জাদুঘর – ‘দ্য মিউজে কামিল ক্লদেল’। তিনি অগণিত শিল্পপ্রেমিকের আরাধ্যের বিষয়। পৃথিবীর মানুষ কামিলকে মনে রাখবে আজীবন, যে-নামটি নির্বাসিত হওয়ার আর কোনো আশঙ্কা নেই।
– নিবন্ধের সব ছবি লেখকের পাঠানো
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.