মার্ক টোয়েন
ভাষান্তর : রেজাউদ্দিন চৌধুরী
[বিদেশে এক ভবঘুরে-বই থেকে এ-লেখা বাদ দেওয়া হয়েছিল এই আশঙ্কায় যে, এর কিছু বর্ণনা সম্ভবত অতিরঞ্জিত
এবং অন্য অংশ সত্যি নয়। এই সন্দেহ ভিত্তিহীন প্রমাণ হওয়ার আগেই বইটি প্রেসে চলে গিয়েছিল। – এম. টি।]
এই কৌতূহলোদ্দীপক ইতিহাসটি আমার কাছে বয়ান করেছিলেন হঠাৎ পরিচিত হওয়া এক রেলওয়ে যাত্রী। তিনি ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব, আগাপাশতলা ভালো এবং ভদ্রমুখাবয়বধারী, আন্তরিক এবং অকৃত্রিম আচরণের এক ভদ্রজন, যার মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি বক্তব্য সত্যের অভ্রান্ত ছাপ ফেলে মনের মধ্যে। তিনি বলেছিলেন :
আপনি জানেন, কি শ্রদ্ধার চোখে শ্যামদেশের মানুষ রাজকীয় শাদা হাতিকে দেখে? আপনি জানেন, এটা রাজাদের কাছে পবিত্র। শুধু রাজাদের মালিকানায় এটি থাকতে পারে, এবং সত্যি বলতে কোনো-কোনো মাপকাঠিতে এটি রাজার চাইতেও শ্রেষ্ঠ, কারণ এটা শুধুমাত্র সম্মানই নয়, পূজাও পেয়ে থাকে। খুব ভালো কথা, এখন ব্যাপারটা হলো, বছর পাঁচেক আগে শ্যামদেশের সঙ্গে গ্রেট ব্রিটেনের সীমানা নিয়ে যখন ঝামেলার উদ্ভব হয়, তখন এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, ভুলটা হয়েছিল শ্যামদেশের পক্ষ থেকে। সুতরাং যত শিগগির সম্ভব ভ্রম সংশোধন করে নেওয়া হলো। ব্রিটিশ প্রতিনিধি বললেন, তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর অতীতের ঘটনা ভুলে যাওয়া উচিত। শ্যামদেশের রাজা স্বসিত্মর নিশ্বাস ফেললেন এবং অংশত কৃতজ্ঞতার নমুনা হিসেবে এবং অংশত ইংরেজদের মধ্যে তার প্রতি কোনো অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ থেকে থাকলে তার শেষ চিহ্ন মুছে ফেলার জন্যে প্রাচ্যদেশীয় ধারণায় শত্রম্ন সন্তুষ্ট করার একমাত্র উপায় হিসেবে গৃহীত প্রথা অনুসরণ করে তিনি রানীকে একটি উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। উপহারটা শুধু রাজকীয় হলেই হবে না, সর্বোত্তম রাজকীয় হতে হবে। অতএব, শাদা হাতি ছাড়া আর কোনো উপহার এ-প্রয়োজন মেটাতে পারে? ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে আমার অবস্থান এমন ছিল যে, একান্তভাবে আমাকেই এটা মহারানীর কাছে নিয়ে যাওয়ার সম্মানের অধিকারী বলে বিবেচনা করা হলো। তাই আমার, আমার ভৃত্যকুল এবং শাদা হাতির দেখভালকারী অফিসারবৃন্দের জন্যে একটা জাহাজ সাজানো হলো। যথা নির্দিষ্ট সময়ে আমি নিউইয়র্ক বন্দরে পৌঁছে আমার রাজকীয় আমানত জার্সি শহরের একটা প্রশংসনীয় আবাসে রাখলাম। পশুটার স্বাস্থ্য পুনরম্নদ্ধারের জন্যে পুনরায় যাত্রার পূর্বে সেখানে কয়েকদিন থাকা প্রয়োজন ছিল। এক পক্ষকাল সবকিছু ভালো চলল। তারপর শুরম্ন হলো আমার দুর্যোগ। শাদা হাতিটা চুরি গেল! আমাকে গভীর রাত্রিতে তারা ঘুম থেকে তুলল এবং এই ভয়ানক দুঃসংবাদটা দিলো। কিছুক্ষণের জন্য ভয় এবং দুশ্চিমত্মায় দিশাহারা হয়ে গেলাম অসহায় আমি। তারপর আসেত্ম-আসেত্ম আমি শান্ত হলাম, আমার বুদ্ধিবৃত্তি ফিরে পেলাম। শিগগির আমি আমার পথ খুঁজে পেলাম, আসলে একজন বুদ্ধিমান লোকের জন্যে তখন একটা পথই খোলা ছিল। যদিও অনেক রাত, তবু আমি নিউইয়র্ক শহরে ছুটে গেলাম এবং একজন পুলিশকে ধরে তার সাহায্যে গোয়েন্দা বাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছে গেলাম। সৌভাগ্যবশত আমি সময়মতো পৌঁছলাম, যদিও এ-সময় বাহিনীপ্রধান সুবিখ্যাত ইন্সপেক্টর বস্নান্ট সবেমাত্র বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তিনি একজন মাঝারি আকারের সুসংবদ্ধ কাঠামোর লোক। যখন তিনি গভীর চিমত্মায় মগ্ন থাকতেন, তাঁর অভ্যাস ছিল ভ্রম্ন আঁচড়ানো এবং আঙুল দিয়ে কপালে চিমত্মাগ্রসত্মভাবে টোকা দেওয়া, যেটা আপনাকে চমৎকৃত করবে এই বিশ্বাসে যে, আপনি কোনো সাধারণ লোকের সামনে দাঁড়িয়ে নেই। তাকে দেখামাত্র আমার বিশ্বাস বেড়ে গেল, আশা বৃদ্ধি পেল। আমি আমার আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। ঘটনা তাঁকে বিন্দুমাত্র উদ্বেলিত করল না; কেউ আমার কুকুর চুরি করেছে বললে তার লৌহদৃঢ় আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর যা ছাপ পড়ত, এটা তার চাইতে বেশি ছাপ ফেলল না। তিনি আমাকে একটা আসনের দিকে ইঙ্গিত করলেন, তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন : ‘আমাকে এক মুহূর্ত চিমত্মা করতে দিন, পিস্নজ।’ এই বলেই তিনি তাঁর অফিস টেবিলে হাতের ওপর মাথার ভর রেখে বসলেন। কক্ষের অন্যপ্রামেত্ম অনেক কেরানি কাজ করছিল; পরবর্তী ছয়-সাত মিনিট আমি শুধু তাদের কলম ঘষার শব্দ পেলাম।
ইতোমধ্যে চিমত্মায় মগ্ন হয়ে ইন্সপেক্টর সেখানে বসেই থাকলেন। অবশেষে তিনি মাথা তুললেন, তাঁর মুখের দৃঢ় রেখায় সেই ভাব প্রচ্ছন্ন যা দেখে আমি বুঝলাম তাঁর মসিত্মষ্কের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং তিনি পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেছেন। তিনি বললেন, নিচু এবং আকর্ষণীয় কণ্ঠে : ‘এটা কোনো সাধারণ মামলা নয়। প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানতার সঙ্গে নিতে হবে, প্রতিটি পা নিশ্চিত হয়ে ফেলতে হবে পরবর্তী পা ফেলার আগে। গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে – প্রগাঢ় এবং সম্পূর্ণ গোপনীয়তা। কারো সঙ্গে এ-ব্যাপারে কথা বলবেন না, এমনকি সাংবাদিকদের সঙ্গেও না। তাদের ব্যাপারটা আমি দেখব; আমি দেখব যাতে আমার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যে যতটুকু জানা প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তারা জানতে পারে।’ তিনি ঘণ্টা টিপলেন, এক তরম্নণের আবির্ভাব হলো।
‘এলারিক, সাংবাদিকদের অপেক্ষা করতে বলো।’ ছেলেটি ফিরে গেল।
‘এখন কাজ শুরম্ন করা যাক, সুবিন্যসত্মভাবে। আমার এই কাজে কঠোর এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদ্ধতি অনুসরণ ছাড়া কিছু অর্জন করা যাবে না।’
তিনি একটা কলম হাতে নিলেন। ‘এখন বলুন – হাতিটার নাম?’
‘হাসান বিন আলি বিন সেলিম আবদুলস্নাহ ময়েস্ট আলহাম্মাল জামশেদজেজিভাই ধুলিপ সুলতান ইবু ভুদপুর।’
‘খুব ভালো। ডাক নাম?’
‘জাম্বো।’
‘খুব ভালো। জন্মস্থান?’
‘শ্যামদেশের রাজধানী।’
‘বাবা-মা বেঁচে আছেন?’
‘না, মারা গেছেন।’
‘এ ছাড়া তাদের আর কোনো সমত্মান আছে?’
‘কেউ না। সে-ই একমাত্র সমত্মান।’
‘খুব ভালো। এই শিরোনামের নিচে এটুকুই যথেষ্ট। এখন দয়া করে হাতিটার বর্ণনা দিন, কোনো খুঁটিনাটি বাদ দেবেন না, যত তুচ্ছই সেটা হোক না কেন – মানে আপনার দৃষ্টিতে তুচ্ছ। আমার কাছে, আমার পেশায় তুচ্ছ খুঁটিনাটি বলে কিছু নেই, তাদের অসিত্মত্বই নেই।’
আমি বর্ণনা করে গেলাম, তিনি লিখে গেলেন। যখন আমি শেষ করলাম, তিনি বললেন, ‘এখন শুনুন। আমার কোনো ভুল হলে শুধরে দেবেন।’ নিচে যেমন লেখা আছে তেমনি তিনি পড়ে গেলেন :
‘উচ্চতা ১৯ ফিট; দৈর্ঘ্য কপালের চূড়া থেকে লেজের খাঁজ পর্যন্ত ২৬ ফিট; শুঁড়ের দৈর্ঘ্য ১৬ ফিট; লেজের দৈর্ঘ্য ৬ ফিট; শুঁড়, লেজসহ সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য ৪৮ ফিট; গজদন্তগুলির দৈর্ঘ্য ৯ ফিট; কান পরিধির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো; পায়ের ছাপ দেখতে বরফের ওপর কেউ একটা পিপাউলটে ফেললে যে-ছাপ পড়ে তার মতো। হাতির গায়ের রং বিবর্ণ শাদা; প্রত্যেক কানে অলংকার ঢোকানোর জন্যে থালার আকারের এক-একটা গর্ত আছে এবং তার একটা অভ্যাস আছে দর্শকদের দিকে লক্ষণীয় পরিমাণ পানি ছিটানো এবং শুঁড় দিয়ে শুধু তার জানাশোনা লোককেই নয়, সম্পূর্ণ অচেনা লোকদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করা; ডানদিকের পেছনের পায়ে সে একটু খোঁড়ায় এবং বাঁ-বগলে ফোঁড়া থেকে সৃষ্ট একটা ক্ষতচিহ্ন আছে; যখন চুরি যায় তখন তার পিঠে ছিল পনেরোজন বসার আসন-সংবলিত একটি হাওদা এবং একটি সাধারণ কার্পেট সাইজের সোনার কাপড়ে বোনা গদি-কম্বল।’
লেখায় কোনো ভুল ছিল না। ইন্সপেক্টর ঘণ্টা টিপলেন, বর্ণনাটা এলারিকের হাতে তুলে দিলেন এবং বললেন :
‘এটার পঞ্চাশ হাজার কপি এখনি ছাপিয়ে এই মহাদেশের সকল গোয়েন্দা অফিস এবং সকল বন্ধকি দোকানে ডাকে পাঠাও।’ এলারিক ফিরে গেলেন।
‘এ পর্যন্ত যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এরপর আমাকে সম্পত্তিটার একটা ফটো পেতে হবে।’
আমি তাকে একটা কপি দিলাম। তিনি তীক্ষন নজরে সেটি পরীক্ষা
করলেন এবং বললেন : ‘এটা দিয়েই চালাতে হবে, যেহেতু এরচেয়ে ভালো কিছু হাতে নেই; কিন্তু এখানে সে আবার শুঁড় বাঁকিয়ে মুখে পুরে রেখেছে। মন্দ কপাল। হিসাব করে ভুলপথে চালাবার জন্যেই এটা করা হয়েছে, নিশ্চয়ই সে সচরাচর এই অবস্থানে এটাকে রাখে না।’
তিনি ঘণ্টা টিপলেন। ‘এলারিক, কাল সকালে প্রথমেই এই ফটোগ্রাফের পঞ্চাশ হাজার কপি ছাপাবে এবং বর্ণনার প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে ডাকে পাঠিয়ে দেবে।’ আদেশ পালনের জন্যে এলারিক ফিরে গেল।
ইন্সপেক্টর বললেন : ‘একটা পুরস্কার ঘোষণার প্রয়োজন অবশ্য আছে। এখন পরিমাণ কত হতে পারে বলুন?’
‘আপনি কী পরিমাণ পরামর্শ দেন?’
‘শুরম্নতে, আমি বলব, পঁচিশ হাজার ডলার হতে পারে। এটা একটা জটিল এবং দুরূহ কাজ; এতে হাজারটা পালানোর এবং লোকানোর পথ রয়েছে। এই চোরদের বন্ধু এবং সুহৃদ রয়েছে সবখানে।’
‘হায় খোদা, তারা কারা আপনি চিনেন?’
চিমত্মা এবং অনুভূতি গোপনে অভ্যসত্ম তার সতর্ক মুখ কিংবা প্রত্যুত্তরে বলা তার কথা ইঙ্গিত বহন করে না, এমন শান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন : ‘এসব নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমি চিনতে পারি, আবার না-ও পারি। আমরা সাধারণত কাজের প্রকৃতি এবং যে-কাজ সে করছে তার আকার দেখে আমাদের প্রার্থিত লোক সম্বন্ধে মোটামুটি একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য ভালো ধারণা করে ফেলতে পারি। আমরা কোনো পকেটমার বা মামুলি চোর নিয়ে এখন নাড়াচাড়া করছি না, এটা বুঝে নেবেন। কোনো নবিশ চোর এই সম্পত্তি ‘তুলে’ নেয়নি। কিন্তু আমি যেমন বলেছিলাম, এই কাজে যে-পরিমাণ ভ্রমণ করতে হবে এবং চলার সঙ্গে-সঙ্গে চোরেরা যে ধৈর্য এবং একাগ্রতার সঙ্গে তাদের চলার পথের চিহ্ন ঢাকার চেষ্টা করবে তার জন্যে পঁচিশ হাজার ডলার পুরস্কার খুব কমই হয়, তবু আমার মনে হয় শুরম্নর জন্যে এটা যথাযথ।’
অতএব, শুরম্নর জন্যে আমরা এই সংখ্যাই স্থির করলাম। তখন এই লোকটা, যার দৃষ্টি থেকে সামান্যতম সূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে এমন কোনো কিছুই এড়িয়ে যায় না, বললেন : ‘গোয়েন্দা ইতিহাসে অনেক মামলায় দেখা যায় যে, অপরাধীদের তাদের খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য থেকে শনাক্ত করা হয়েছে। এখন বলুন দেখি, এই হাতিটা কী খায় এবং কতখানি খায়?’
‘ভালো কথা, কী খায় বললে বলা যায় – সে যে-কোনো কিছুই খাবে। সে একজন মানুষ খাবে, সে একটা বাইবেল খাবে এবং মানুষ ও বাইবেলের মাঝখানে যা পাবে তাই খাবে।’
‘ভালো, খুব ভালো, তবে কি-না এটা খুব সাধারণ বর্ণনা হয়ে গেল। খুঁটিনাটি দরকার – শুধু খুঁটিনাটিই আমাদের ধরনের কাজে একমাত্র মূল্যবান জিনিস। ভালো কথা, মানুষ প্রসঙ্গে আসুন। একবেলার খাবারে, অথবা আপনি যদি অন্যভাবে বলতে চান, একদিনে সে কয়জন মানুষ খাবে, যদি তাজা পাওয়া যায়?’
‘তাজা কি তাজা না তা নিয়ে সে থোড়াই পরোয়া করেছে বরাবর; একবেলার খাবারে সে পাঁচজন সাধারণ মানুষ খেত।’
‘খুব ভালো, পাঁচজন লোক, এটা আমরা লিখে রাখব। কোন জাতীয়তার লোক সে পছন্দ করত?’
‘জাতীয়তা বিষয়ে সে ছিল উদাসীন। চেনা লোক পছন্দ করত, তবে অচেনাদের প্রতি তার কোনো বিমুখতা ছিল না।’
‘খুব ভালো। এখন বাইবেলের ব্যাপারে। একবেলার খাবারে সে কয়টা বাইবেল খেত?’
‘সে একটা আসত্ম সংস্করণ খেত।’
‘এটা যথেষ্ট আঁটসাঁট বক্তব্য নয়। আপনি কি বলতে চান আটপাতার ভাঁজ করা সাধারণ প্রিন্ট, না পারিবারিক সচিত্র সংস্করণ?’
‘আমার মনে হয় চিত্র বিষয়েও সে উদাসীন ছিল, তার মানে, আমার মনে হয় না সাধারণ লেটার প্রেসের চাইতে সে চিত্রিতকরণকে অধিক মূল্য দিত।’
‘না, আমার কথাটা আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি পরিমাণের কথাটা বলতে চাচ্ছি। যেখানে আটপাতার ভাঁজ করা সাধারণ প্রিন্ট ওজনে প্রায় আড়াই পাউন্ড, সেখানে চারপাতার সচিত্র সংস্করণের ওজন দশ থেকে বারো পাউন্ড। একবেলায় কয়টা সচিত্র বাইবেল সে খাবে?’
‘আপনি যদি এই হাতিটাকে চিনতেন তাহলে এ-কথা বলতেন না। তাদের কাছে যা থাকত তাই সে খেতে পারত।’
‘ঠিক আছে, তাহলে ডলার, সেন্টে বলুন। আমাদের এটা যে-কোনোভাবে বের করতে হবে। একটা সচিত্রের দাম এক কপি একশ ডলার, রাশিয়ান চামড়া, ঢালু বহির্ভাগ।’
‘তার দরকার হবে পঞ্চাশ হাজার ডলার মূল্য পরিমাণ, ধরম্নন পাঁচশো কপির এক সংস্করণ।’
‘হ্যাঁ, এখন আরো যথাযথ হয়েছে। এটা আমি লিখে রাখব। খুব ভালো; সে মানুষ আর বাইবেল পছন্দ করে; এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। আর কী সে খাবে? আমি বিস্তারিত চাই।’
‘সে ইট খেতে পেলে বাইবেল ছেড়ে দেবে, বোতল খেতে পেলে ইট ছেড়ে দেবে, কাপড় খেতে পেলে বোতল ছেড়ে দেবে, বিড়াল খেতে পেলে কাপড় ছেড়ে দেবে, শামুক খেতে পেলে বিড়াল ছেড়ে দেবে, হ্যাম খেতে পেলে শামুক ছেড়ে দেবে, চিনি খেতে পেলে হ্যাম ছেড়ে দেবে, পিঠা খেতে পেলে চিনি ছেড়ে দেবে, আলু খেতে পেলে পিঠা ছেড়ে দেবে, ভুসি খেতে পেলে আলু ছেড়ে দেবে, খড় খেতে পেলে ভুসি ছেড়ে দেবে, জই খেতে পেলে খড় ছেড়ে দেবে, ভাত খেতে পেলে জই ছেড়ে দেবে, কারণ প্রধানত ভাত খেয়েই সে বড় হয়েছে। ইউরোপিয়ান মাখন ছাড়া এমন কিছু নেই, যা সে খাবে না এবং এটাও সে খেত যদি কোনোদিন তার স্বাদ নিতে পারত।’
‘খুব ভালো কথা। একবেলার খাবারে সাধারণত পরিমাণ – ধরম্নন প্রায়?’
‘হ্যাঁ, সিকি থেকে আধা টন, এর মাঝখানে যে-কোনো পরিমাণ।’
‘আর সে পান করে…’
‘তরল যে-কোনো কিছু। দুধ, পানি, হুইস্কি, ঝোলা গুড়, ক্যাস্টর অয়েল, ক্যাম্ফিন, কার্বলিক অ্যাসিড… বিস্তারিত বলে লাভ নেই, আপনার মনে যা আসে এমন যে-কোনো কিছু তার সামনে ফেলে দিন। ইউরোপিয়ান কফি ছাড়া তরল যা কিছু আছে সে পান করবে।’
‘খুব ভালো। পরিমাণের বিষয়টা?’
‘লিখে নিন, পাঁচ থেকে পনেরো পিপা – তার পিপাসার পরিবর্তন হয়, অন্যান্য খিদের হয় না।’
‘এগুলি অস্বাভাবিক। এ-তথ্যগুলি তাকে খুঁজে পাওয়ার পেছনের খুব ভালো সূত্র হিসেবে কাজ করার কথা।’
তিনি ঘণ্টা টিপলেন। ‘এলারিক, ক্যাপ্টেন বার্নসকে ডেকে পাঠাও।’
বার্নস হাজির হলেন। ইন্সপেক্টর বস্নান্ট তার কাছে পুরো ব্যাপারটা উন্মোচিত করলেন, খুঁটিনাটির পর খুঁটিনাটি।
তারপর তিনি মাথায় পরিকল্পনা পরিষ্কারভাবে ছক কেটে নেওয়া এবং আদেশদানে অভ্যসত্ম ব্যক্তির উপযোগী সুস্পষ্ট এবং স্থিরসিদ্ধ কণ্ঠে বললেন : ‘ক্যাপ্টেন বার্নস, গোয়েন্দা জোন্স, গোয়েন্দা হ্যালসি, গোয়েন্দা বেট্স এবং গোয়েন্দা হ্যাকেটকে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে হাতিটাকে অনুসরণ করতে বলুন।’
‘জি স্যার।’
‘গোয়েন্দা মোসেস, গোয়েন্দা ডাইকিন, গোয়েন্দা মার্ফি, গোয়েন্দা রোজার্স, গোয়েন্দা টাপার, গোয়েন্দা হিগিন্স এবং গোয়েন্দা বার্থেলেমিউকে চোরদের অনুসরণ করতে বলুন।
‘জি স্যার।’
‘যেখান থেকে হাতিটা চুরি গেছে, সেখানে দিন-রাত কঠোর নজর রাখার জন্যে ত্রিশজন বাছাই করা প্রহরীর সঙ্গে ত্রিশজনের রিলিফ টিম নিয়ে একটা শক্ত প্রহরা বসান এবং সাংবাদিক ছাড়া আর কাউকে আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া ধারে ঘেঁষতে দেবেন না।’
‘জি স্যার।’
‘সন্দেহভাজন সকল ব্যক্তিকে তলস্নাশি করার নির্দেশ দিয়ে শাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের রেলওয়ে, জাহাজ, ফেরিঘাট এবং জার্সি সিটির বহির্গামী সকল সড়কে নিযুক্ত করম্নন।’
‘জি স্যার।’
‘এসব লোককে ফটোগ্রাফ এবং সঙ্গে হাতির বর্ণনা সরবরাহ করম্নন এবং নির্দেশ দিয়ে রাখুন, ট্রেন, বহির্গামী ফেরি-নৌকা ও অন্যান্য জাহাজ অনুসন্ধান করতে।’
‘জি স্যার।’
‘যদি হাতিটা পাওয়া যায়, তাকে আটক করা হোক এবং সংবাদ টেলিগ্রাফ মাধ্যমে আমার কাছে পাঠানো হোক।’
‘জি স্যার।’
‘যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়, পশুটার পায়ের ছাপ বা এমন ধরনের কিছু তা অবিলম্বে আমাকে জানানো হোক।’
‘জি স্যার।’
‘বন্দর পুলিশকে আদেশ পাঠান, বন্দরমুখে সতর্কদৃষ্টিতে টহল দিতে।’
‘জি স্যার।’
‘শাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের সকল রেলওয়েতে পাঠিয়ে দিন, উত্তরে কানাডা পর্যন্ত দূরে, দক্ষেণে ওহাইও পর্যন্ত দূরে, পশ্চিমে ওয়াশিংটন পর্যন্ত দূরে।’
‘জি স্যার।’
‘বিশেষজ্ঞদের সকল টেলিগ্রাফ অফিসে বসিয়ে দিন সমসত্ম বার্তা শোনার জন্যে এবং তারা যেন অফিসের কাছে চায় তাদের সকল সাংকেতিক বার্তা বুঝিয়ে দেওয়া হোক।’
‘জি স্যার।’
‘এ সমসত্ম কিছু করা হোক অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে, মনে রাখবেন, অত্যন্ত দুর্ভেদ্য গোপনীয়তার সঙ্গে।’
‘জি স্যার।’
‘যথানির্দিষ্ট সময়ে আমার কাছে রিপোর্ট পাঠাবেন।’
‘জি স্যার।’
‘যান।’
‘জি স্যার।’
তিনি চলে গেলেন। ইন্সপেক্টর বস্নান্ট এক মুহূর্তের জন্যে চিমত্মান্বিত এবং নীরব হয়ে রইলেন, এর মধ্যে চোখের আগুন ঠান্ডা হয়ে মিলিয়ে গেল। তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে শান্ত কণ্ঠে বললেন :
‘গর্ব আমাকে গ্রাস করতে পারে না, এটা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই; কিন্তু হাতিটাকে আমরা খুঁজে পাবই।’
আমি তার সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন করলাম – অনুভবও করলাম আমার কৃতজ্ঞতা।
এই লোকটাকে আমি যত দেখেছি, তত বেশি তাকে পছন্দ করেছি এবং তত বেশি মুগ্ধ ও চমৎকৃত হয়েছি তার পেশার
রহস্যময় বিস্ময়করতায়। তারপর রাতের জন্যে আমরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম, এবং যে-হৃদয় নিয়ে আমি তার কাছে এসেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশি আনন্দচিত্তে বাড়ি ফিরে গেলাম।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.