বিশ্ব ভারতীর ভাবনা ও আদর্শের কথা বলতে গেলে গোড়াতেই শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ের দিকে চোখ মেলতে হয়। বিদ্যালয় সম্পর্কে কি ভেবেছিলেন সেদিনের তরুণ রবীন্দ্রনাথ? দেখতে পাই, সেদিনের কবি প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তাঁর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের ভিত্তি। যদিও স্পষ্ট জানতেন, তপোবন আশ্রমের হবহু নির্মাণ এ-কালে কখনোই সম্ভব নয়, তবে তার ‘বিলাসমোহমুক্ত বলবান আনন্দের মূর্তি’ প্রতিষ্ঠা করা যে অসম্ভব নয় – তা বিশ্বাস করতেন নিশ্চিতভাবে। এর সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ভারতের গভীর অন্তরে প্রবহমান কল্যাণ আর স্নিগ্ধ-সুন্দরের মানসপ্রতিমা। শিশুকালে স্কুলজীবনের তিক্ত ব্যক্তিঅভিজ্ঞতা তাঁকে দীর্ঘকাল তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে – এ আমাদের অজানা নয়। পরবর্তীকালে ‘বিশ্বভারতী’ সিরিজের ৪-সংখ্যক প্রবন্ধে স্বয়ং জানিয়েছেন, … ‘আমি বাল্যকালের শিক্ষা ব্যবস্থায় মনে বড়ো পীড়া অনুভব করেছি। সেই ব্যবস্থায় আমাকে এত ক্লেশ দিত আঘাত করত যে বড়ো হয়েও সে অন্যায় ভুলতে পারি নি। কারণ
প্রকৃতির বক্ষ থেকে, মানবজীবনের সংস্পর্শ থেকে স্বতন্ত্র করে নিয়ে শিশুকে বিদ্যালয়ের মধ্যে ফেলা হয়। তার অস্বাভাবিক পরিবেষ্টনের নিষ্পেষণে শিশুচিত্ত প্রতিদিন পীড়িত হতে থাকে।’ তাঁর মনে হয়েছে, ঔপনিবেশিক শিক্ষার আলোকে ছোটদের মানুষ করে তোলার জন্য স্কুল যেন একপ্রকার যন্ত্রবিশেষ – যা কখনোই শিশুর শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের পক্ষে সহায়ক হতে পারে না। পাশাপাশি এও ভেবেছেন, ‘এই শিক্ষার জন্য আশ্রমের দরকার, যেখানে আছে সমগ্রজীবনের সজীব ভূমিকা।’ মনে হয়েছে, এইপ্রকার ঔপনিবেশিকতায় গঠিত যান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নামক কারখানার বিপরীতে কোনো আশ্রমের কথা। সেই আশ্রমের কেন্দ্রে যে গুরু বাস করেন, তিনি যন্ত্র নন, তিনি মনুষ্যত্বের লক্ষ্য-সাধনে প্রবৃত্ত একজন অনুভূতিশীল মানুষ। ছাত্রের সঙ্গে এই গুরু তথা শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্কে প্রাণের নিবিড় স্পর্শ থাকবে, তবেই শিক্ষক এবং ছাত্রের সকল কাজ আনন্দময় হয়ে উঠতে পারবে। গুরু বা শিক্ষকের তপস্যা অর্থাৎ অধ্যাপনা এবং সান্নিধ্যের গতিমান ধারায় শিষ্য বা ছাত্রের হৃদয় তিনি সর্বদা গতিশীল করে তুলবেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষক প্রসঙ্গে তাঁর মত এই যে, … ‘গুরুর অন্তরে ছেলেমানুষটি যদি একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় তা হলে তিনি ছেলেদের ভার নেবার অযোগ্য হন। শুধু সামীপ্য নয়, উভয়ের মধ্যে প্রকৃতিগত সাযুজ্য ও সাদৃশ্য থাকা চাই। নইলে দেনা-পাওনার নাড়ীর যোগ থাকে না।’ অর্থাৎ মূল কথা হলো, শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কের মধ্যে দেওয়া-নেওয়ায় অন্তরের গভীর যোগ থাকা চাই। এই কারণে তিনি এমনসব শিক্ষককে আশ্রমে আহ্বান জানিয়েছেন যাঁরা কেবল তকমাধারী ‘পণ্ডিতমশাই’ নন, নিজেদের সাধনা ও সৃজনের কাজে নিমগ্ন হয়ে থাকতে ভালোবাসেন।
‘বিশ্বভারতী’ প্রবন্ধমালার প্রথম লেখাতেই রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন – ‘বিদ্যার ক্ষেত্রে সেই-সকল মনীষীদের আহ্বান করিতে হইবে যাঁহারা নিজের শক্তি ও সাধনা দ্বারা অনুসন্ধান আবিষ্কার ও সৃষ্টির কাজে নিবিষ্ট আছেন। তাঁহারা যেখানেই নিজের কাজে একত্র মিলিত হইবেন সেইখানে স্বভাবতই জ্ঞানের উৎস উৎসারিত হইবে, সেই উৎসধারার নির্ঝরিণীতটেই দেশের সত্য বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হইবে। বিদেশী বিদ্যালয়ের নকল করিয়া হইবে না।’ পুত্র রথীন্দ্রনাথকেও জানিয়েছেন, ‘বিদেশের বাঁধা বুলি মুখস্থ করিয়ে ছেলেদের তোতাপাখী করে’ তুলতে কখনোই তিনি চান না। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের স্কুলে শিক্ষকের আদর্শ ও সেই অনুসারে তাঁদের ভূমিকা প্রসঙ্গে একটা খসড়া ধারণা পাওয়া গেল।
এবারে দেখা যাক, বিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিষয়ে তিনি কী ভাবছেন বা তাদের কীভাবে তিনি গড়ে তুলতে চান?
নানান চিঠিপত্রে ছড়িয়ে আছে কবির এই ভাবনার অজস্র নিদর্শন। চকিতে মনে পড়বে ত্রিপুরার রাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মাকে লেখা একটা চিঠির টুকরো। সেখানে তিনি লিখেছেন – ‘আমি ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মচর্যের প্রাচীন আদর্শে আমার ছাত্রদিগকে নির্জনে নিরুদ্বেগে পবিত্র নির্মলভাবে মানুষ করিয়া তুলিতে চাই। তাহাদিগকে সর্বপ্রকার বিলাতী বিলাস ও বিলাতের অন্ধমোহ হইতে দূরে রাখিয়া ভারতবর্ষের গ্লানিহীন পবিত্র দারিদ্র্যে দীক্ষিত করিতে চাই।’ শুধু তাই নয়, তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন – ‘মনে দৃঢ়রূপে জান যে দারিদ্র্যে অপমান নাই, কৌপীনেও লজ্জা নাই। চৌকি টেবিল প্রভৃতি আসবাবের অভাবে লেশমাত্র অসভ্যতা নাই। শান্তিতে সন্তোষে মঙ্গলে ক্ষমায় জ্ঞানে ধ্যানেই সভ্যতা।’ বিদ্যালয় স্থাপনের সূচনা পর্বে কবির এই শেষ বাক্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, শান্তি সন্তোষ মঙ্গল ক্ষমা জ্ঞান আর ধ্যানই হলো সভ্যতার প্রকৃত মাপকাঠি। এছাড়াও এখানে ‘বিলাতী বিলাস’ এবং ‘পবিত্র দারিদ্র্য’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ আমাদের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। তবে কি শুরুতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিদ্যালয়ের আদর্শকে একেবারে কঠিন হাতে স্বদেশি ভাবনার শৃঙ্খলে বাঁধতে চেয়েছিলেন? ‘বিলাতী বিলাস’ অর্থে নিশ্চয়ই তথাকথিত ইংরেজের বহিরঙ্গে ফুটে-ওঠা আপাত জৌলুসের বিরুদ্ধে সহজ দেশীয় অনাড়ম্বর জীবনযাপনের প্রতি চোখ ফেরানোর কথা বোঝানো হচ্ছে, অঙ্গুলি নির্দেশ করা হচ্ছে স্বদেশের নিজস্ব সরলতার দিকে। বিদ্যালয় ভাবনার এই শুরুর অধ্যায়ে তাঁর পরবর্তী কালের পূর্বপশ্চিমের দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে দিয়ে গড়ে তোলা বিদ্যানিকেতনের আইডিয়া তেমন প্রাধান্য পেয়েছে বলে মনে হয় না। ‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার’ – এ বিশ্বাস হয়তো তখনো কবির মনে সেভাবে আঘাত করেনি। ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে …’ এই চিন্তা দেখা দিয়েছে আরো কিছুকাল পরে। সেইজন্যেই কি কেবল স্বদেশি ভাবনার আধারে সাজিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের আদর্শ? নিঃসন্দেহে তাই, খেয়াল করলে দেখবো, স্বদেশি আন্দোলনের দরজায় কড়া নাড়ছে সময়ের সেই প্রেক্ষাপট। আরো কিছুকাল পরে, এমন কি ১৯১৮-১৯ নাগাদ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে, যেখানে ‘কলাবিদ্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে ‘বিশ্বভারতী’র প্রধান দুটি অঙ্গ হিসেবে সংগীত ও চিত্রকলার কথা ঘোষণা করছেন, সেখানেও তাঁর চিন্তার প্রধান ভর দেশের লুপ্ত গৌরবের দিকেই নিবদ্ধ। সেই প্রবন্ধের শেষ বাক্যে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন, … ‘বিশ্বভারতী যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে ভারতীয় সঙ্গীত ও চিত্রকলা শিক্ষা তাহার প্রধান অঙ্গ হইবে এই আমাদের সঙ্কল্প হউক।’ অর্থাৎ ভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতির অন্যতম বিষয়, সংগীত আর চিত্রকলাকে তিনি নির্মীয়মাণ বিশ্বভারতীর প্রধান দুটি স্তম্ভ করে গড়ে তুলতে চান। উল্লেখ্য, এর ঠিক আগের অনুচ্ছেদে লিখেছেন – ‘… যেখানে দেশের আপন সম্পদ নিহিত সেইখানেই দেশের আপন গৌরব প্রসুপ্ত আছে। সেই সম্পদ যতই উদ্ঘাটিত হইবে আমাদের গৌরবের ততই উদ্বোধন হইবে। আমাদের নব উদ্বোধনের উৎসব বিলাতী গোরার বাদ্যে অথবা দেশী সঙ্গীতের হাড়গোড়-ভাঙা একটা বিরূপ ব্যাপারের দ্বারা সম্পন্ন হইবে না।’ আরো কঠিন স্বরে বলেছেন, ‘… আমাদের দেশের নির্বাসিত লক্ষ্মীকে নূতন আবাহনকালে মন্দিরের দ্বারে যে আলপনা আঁকিতে হইবে তার ডিজাইন কি জর্মানি হইতে সংগ্রহ করিয়া আনিব?’ আমাদের মনে হয়, বিশ্বভারতী তৈরির শুরুতে চিত্রকলা ও সংগীত – এই দুটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে কিছু দোলাচল রয়ে গেছে, বিষয়ের নির্বাচন স্থির হলেও পাঠচর্চার ভুবন তখনো পরিষ্কার নয়। চিত্রের ক্ষেত্রে পশ্চিমের ছবির নকলের পরিবর্তে নব্যবঙ্গীয় চিত্রধারায় গড়ে ওঠা ভারতীয় চিত্রশৈলীর তারিফ করছেন – যা কি না বিদেশি রসজ্ঞদেরও প্রশংসা আদায় করে নিচ্ছে বলে দাবি করছেন। অথচ এই বিদেশি রসজ্ঞের অধিকাংশই বিলেতের ‘রসজ্ঞ’। ছবির সংগ্রাহকের দলে তাঁরাই অধিক। আর এই ছবি যে অবনীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত বাংলা কলমের চিত্রধারার দিকে তাকিয়ে বলেছেন – তা আমরা জানি। একটু আগে যে-কথা প্রসঙ্গে বারবার বিলেতের বিরুদ্ধতা এলেও চিত্রকলায় যেন তাদেরই প্রশংসার ওপর অনেকটাই রবীন্দ্রনাথ নির্ভর করছেন। এখানে কি একটা দ্বিচারিতার ভাব এসে গেল না? আবার দেশি সংগীতের হাড়গোড়-ভাঙা একটা বিরূপ ব্যাপার বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তিনি? ভারতীয় সংগীতের কালোয়াতি গানের কথা বলছেন কি? এই লেখায় কিছু আগেই অবশ্য বিবাহসভা অথবা শোভাযাত্রায় ব্যান্ড (সেটাকেই কি বিলাতি গোরার বাদ্য বলে অভিহিত করেছেন?) আর সানাইয়ের ধাক্কা লাগিয়ে সংগীতের মহামারির কথা শুনিয়েছেন। আরো বলেছেন, সংগীতের প্রতি দরদ থাকলে এমনটা কিছুতেই করা সম্ভব নয়। তাহলে সংগীতের কোন অংশটির ভাবনা তাঁর মনে কাজ করছে? তিনি কি বিশ্বভারতীতে গানের ক্ষেত্রে আরো নতুন কোনো কিছু ভাবছিলেন?
আমাদের মনে হয়, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সূচনায় যে আইডিয়ার দ্বারা তিনি পরিচালিত হচ্ছিলেন, তার পরিষ্কার ছবি তখনো তাঁর মাথায় সম্পূর্ণভাবে গড়ে ওঠেনি। আর সেটাই স্বাভাবিক, নতুন কিছু একটা গড়ে তোলার সময় তা নানা ভাঙচুরের মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যায়, চলতে চলতে সেই কাঠামো ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসেবে বিশ্বভারতীর সূচনালগ্নে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে দেখি গ্রহণ-বর্জনের সুর স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন – ‘বিশ্বভারতীর বিদ্যায়তনের শিক্ষা প্রভৃতির যে আদর্শ খাড়া করা হয়েছে সে সম্বন্ধে অনেক তর্কের বিষয় আছে। আর একবার সকলে বসে না আলোচনা করলে চলবে না। যে কথা বলে আমি ভারতবর্ষের লোককে বিশেষভাবে আপীল করেছি সে হচ্চে বিশ্বভারতীতে ভারতীয় বিদ্যার সমবায়। এখানে বৈদিক বৌদ্ধ জৈন মুসলমান শিখ পারসি প্রভৃতি সকল বিদ্যার একটা সমন্বয়ক্ষেত্র হবের আদর্শের মধ্যে তার কোনো পরিচয় নেই।’ অর্থাৎ এই প্রথম দিকের খসড়া রবীন্দ্রনাথের যথাযথ বলে মনে হয়নি। বিশ্বভারতীতে ‘ভারতীয় বিদ্যার সমবায়’ গড়ে তোলাই রবীন্দ্রনাথের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই আয়োজনে সারাবিশ্ব থেকে যোগ্য গুণীর সন্ধান চলেছে। আমরা জানি, অদূরভবিষ্যতে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী পূর্ব আর পশ্চিমের দেওয়া-নেওয়ায় হয়ে উঠবে শিল্প-সংস্কৃতির এক মহামিলনকেন্দ্র। সেদিক থেকে দেখলে তার বীজ রোপিত হয়েছে কিছুকাল আগে, ১৯১৩ সালের নোবেল পুরস্কার রবীন্দ্রজীবনের সেই জরুরি টার্নিং পয়েন্ট। যেখানে ‘বাংলার কবি’র তকমা সরিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্বজনীন। তাঁর স্বদেশিয়ানার মার্কা দেওয়া গণ্ডি যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে উঠতে দেখবো আর দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে আন্তর্জাতিকতার উন্মুক্ত অঙ্গনে।
এবারে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠার একেবারে সূচনালগ্নের দিকে তাকাই। বিশ্বভারতীর মূল মন্ত্র হলো ‘যত্র বিশ্বে ভবতেকনীড়ম’, সমগ্র বিশ্ব যেখানে একটি নীড়ে এসে মিলিত হবে। তিনি বলছেন যে – ‘বিশ্বভারতী ভারতবর্ষের জিনিস হলেও একে সমস্ত তপস্যার ক্ষেত্র করতে হবে।’ তবে কি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের আদর্শ আর ‘বিশ্বভারতী’র ভাবনার মধ্যে গোড়াতেই একটা ভিন্নতা ফুটে উঠতে চাইছে? শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় বিশ্বভারতীর বাঁকে এসে ঘরের দুয়ার খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতে চায়? দেশীয় ভাবনার সঙ্গে বিশ্বজনীনতা পরতে পরতে যুক্ত হয়ে এগিয়ে চলেছে? ‘বিশ্বভারতী’ প্রবন্ধমালার ৪-সংখ্যক লেখায় স্পষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথ জানিয়ে দিলেন – ‘বিশ্বের হাটে যদি আমাদের বিদ্যার যাচাই না হয় তবে আমাদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হল না। ঘরের কোণে বসে আত্মীয়স্বজনে বৈঠকে যে অহংকার নিবিড় হতে থাকে সেটা সত্য পদার্থ নয়। মানুষের জ্ঞানচর্চার বৃহৎ ক্ষেত্রের সঙ্গে যোগ হলেই তবে বিদ্যার সার্থকতা হবে। বিশ্বভারতীর এই লক্ষ সার্থক হোক।’ পরের প্রবন্ধে আরো স্পষ্ট ঘোষণা করলেন – ‘দেশবিদেশের তাপস এই বিশ্বভারতীতে আসন গ্রহণ করুন। আয়ন্তু সর্বতহ স্বাহা, এই কথা আমরা আশ্রমে বসে বলব। ভারতবর্ষ আধ্যাত্মিক ঐক্যসাধনার যে তপস্যা করেছেন সেই তপস্যাকে এই আধুনিক যুগের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে তবেই আমাদের সমস্ত অগৌরব দূর হবে – বাণিজ্য করে নয়, লড়াই করে নয়, সত্যকে স্বীকার করার দ্বারাই তা হবে।’
পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে দেশবিদেশের অতিথিরা সানন্দে এসে এখানে যোগ দিয়েছেন। দেশের পণ্ডিতগণ কবির আহবানে যেমন সাড়া দিয়েছেন, তেমনি সুদূর বিদেশ থেকে বিম্বভারতী প্রতিষ্ঠার একেবারে গোড়াতেই এসেছেন ফরাসি প্রাচ্যতত্ত্ববিদ পণ্ডিত সিলভা লেভি, এসেছেন স্তেলা ক্রামরিশের মতো শিল্পবেত্তা, আন্দ্রে কারপেলেসের মতো চিত্রশিল্পী, এলমর্হাস্টের মতো কর্মী এবং পরে আরো অজস্র গুণীজন। বিশ্বভারতীর প্রধান দুটি স্তম্ভের একটি যে শিল্পকলা তা আগেই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই শিল্পকলার ভার প্রধানত নন্দলালের ওপরেই ন্যস্ত হয়েছিল। অনেক টানাপড়েনের পর গুরু অবনীন্দ্রনাথের অনুমতি পেয়ে নন্দলাল বিশ্বভারতীর কলাভবনে যুক্ত হয়েছিলেন, সে-খবর আমাদের অজানা নয়। তবু প্রশ্ন জাগে মনে, ব্রহ্মবিদ্যালয় থেকে বিশ্বভারতী হয়ে ওঠার এই বিবর্তিত আদর্শের সঙ্গে নন্দলাল প্রথম থেকেই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলেন কি? কথাটা এই জন্যেই উঠে আসে, নন্দলাল বরাবর স্বদেশিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন পূর্ব-পশ্চিমের সম্মিলন, এমনকি শিল্পকলার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। তাই ক্রামরিশ যখন কলাভবনে পশ্চিমের শিল্পকলার ইতিহাস, বিভিন্ন শিল্প-আন্দোলনের বিষয় পড়াচ্ছেন, তখন রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে নন্দলালকেও সেই ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। কলাভবনে তেলরঙের মাধ্যমে আঁকা ছবির চর্চা আবশ্যিক না হলেও আন্দ্রে তৈলচিত্রের ক্লাস নিয়েছেন। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও আদর্শ, কখনো শিক্ষকদের ভাবনায় কোথাও বৈপরীত্যের দোলাচল গোড়াতেই কাজ করেছে? বিভিন্ন আদর্শকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের দুই দলে ভাগ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি – এমনটা নয়। যেমন বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার আগেই ১৯১৪ নাগাদ মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আশ্রমের ধর্ম ভাবনা সম্পর্কে মতবিনিময় পর্বে কয়েকটি ব্যাপারে উভয়ের মতানৈক্য দেখা দেয়। যেমন, গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন, আত্মনির্ভরতার জন্য বেতনভোগী পাচকের পরিবর্তে বিদ্যার্থী ও শিক্ষকদের নিজেদেরই রান্না বা অন্যান্য কাজ করা উচিত। এই বিষয়ে শিক্ষকেরা সকলে একমত হতে পারেননি। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি জোর করে চাপিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে, শিক্ষকেরা রাজি থাকলে এই পরীক্ষা অবশ্যই করা যেতে রে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেই দুটি ভাগ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে এই নিয়ম একবার বহাল হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তখনকার ছাত্র প্রমথনাথ বিশী জানিয়েছেন, ‘এই ব্যবস্থার ফলে আশ্রমে ছাত্রজীবনের সত্যযুগ আরম্ভ হইয়া গেল। সব কাজই ছেলেরা আরম্ভ করিল এবং এইসব অত্যাবশ্যক কাজের চাপে পড়াশুনার অবান্তর উপলক্ষটা যে কোথায় চাপা পড়িয়া গেল তাহা আর নজরে পড়িল না।’ যদিও মাস দুয়েকের মধ্যে এই ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনাটি অবশ্য বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পূর্বে আশ্রম বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ঘটেছে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত ‘বিশ্বভারতী’র আদর্শ দেশের সকলেই কি সাদরে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন? একটু খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের কথাই ধরা যাক। প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই যদুনাথকে ‘বিশ^ভারতী’র ‘গভর্নিং বডি’র সদস্য হতে আমন্ত্রণ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি দেন, তবে যদুনাথ সেই পদ গ্রহণ করেননি। গ্রহণ না-করার নানা কারণসহ তিনি তাঁর চিঠিতে বিশ্বভারতীর বেশ কড়া সমালোচনা করেছিলেন। যদিও তাঁর সমালোচনার সবটুকু গ্রহণযোগ্য বলে আমাদের মনে হয় না। বিশেষত কলাভবনের শিল্পচর্চার প্রতি তাঁর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতটিকে একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। অবাক লাগে, যখন অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিশ্বভারতীর ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন – ‘আমি এখন মানিতে প্রস্তুত নই যে বর্তমান ভারত জগতকে দিতে পারে শুধু সেই খৃস্টপূর্ব যুগে রচিত বেদান্তের নূতন ভাষ্যের তস্য ভাষ্য, নব্যন্যায়ের কচকচি, কাঁথা সেলাইয়ের প্যাটার্ন, এবং আলিপনার নকসা, অথবা মুঘল চিত্রের সাত নকলের খাস্ত নকল।’ ছবির ব্যাপারে আরো তীব্রভাবে বলেছেন, ‘আমরা বলি যে রবি বর্মার ছবিতে ভাব নাই, তাহা নেচার-এর দানোপযোগী নকল। এই মত প্রচারের ফলে, অবনীবাবু ও নন্দলাল ভিন্ন আর সব নব্য ইন্ডিয়ান আর্টের সাধকগণ প্রথমে হাত ঠিক করার কাজটা ঘৃণার সহিত ত্যাগ করিয়াছেন; প্রকৃতিকে লক্ষ করা নাই, শরীর বিজ্ঞান পড়া নাই, ছবি আঁকিবার পূর্বে নানা পরীক্ষা (স্টাডিস বা স্কেচেস) করিয়া চিত্রের উপযোগী, অঙ্গভঙ্গিটি আবিষ্কার করা নাই; এক লাফে ভাবের ছবি আঁকিয়া জগতের সম্মুখে উপস্থিত করেন।’ শান্তিনিকেতন তথা নব্যবঙ্গীয় চিত্রচর্চা বিষয়ে যদুনাথের তিরস্কার এখানেই থেমে থাকেনি। বলেছেন, ‘এসব ছবির মধ্যে যাহা ভাল তাহাকে অজন্তার বা মুঘল চিত্রের নকল ভিন্ন আর বেশী কিছু বলা যায় না। অপরগুলি সব কাঁচা ও খারাপ, ঠিক শিশুর আঁকা বা কেভম্যান-এর আঁকা ছবির মত, শুধু রঙগুলি তার চেয়ে ভাল।’ এই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, যদুনাথ সেই সময়ের বিশ্বব্যাপী আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের দিকে একেবারেই চোখ মেলে তাকাননি। বিলেতের আকাদেমিক আর্টের প্রতিই নিবদ্ধ ছিল তাঁর দৃষ্টি। আধুনিক শিল্পকলা সেই মুহূর্তে যেভাবে প্রিমিটিভ আর্ট তথা চাইল্ড-আর্টের অন্দরে শিল্পের অভিব্যক্তির প্রধান উপাদান অন্বেষণ করে বেড়ে উঠছিল – তার এক চিলতে বার্তাও যদুনাথের কর্ণগোচর হয়নি। এছাড়াও বলতে হয়, বাংলার লোকশিল্পকে কেন্দ্র করে আধুনিক চিত্র ও ভাস্কর্যের যে নতুন দিগন্তের উন্মোচন দেখা দিয়েছে, তা যদুনাথের ভাবনায় প্রবেশ করেনি। এই চিঠি রবীন্দ্রনাথকে এতটাই ব্যথিত করেছিল যে, তাঁকেও বলতে হয়েছে – ‘কাঁথা সেলাইয়ের প্যাটার্ন ও আলিপনার নকসা সম্বন্ধে য়ুরোপের বৈজ্ঞানিক ইতিহাসবিৎ ও আর্ট সমালোচকদের সঙ্গে আমার আলাপ হইয়াছে – দেখিয়াছি সকল প্রকার জ্ঞান ও ভাবপ্রকাশের প্রতি তাঁহাদের মানসিক বায়ু পরিশুদ্ধ বলিয়াই এগুলিকে তাঁহারা বহুমূল্য গণ্য করেন।’ এছাড়াও বলেছেন, ‘একথা স্বীকার করা কর্তব্য বোধ করি যে, বাংলার আর্টিস্টদের সম্বন্ধে ও আর্টসাধনা সম্বন্ধে আপনি যে মত যেভাবে প্রকাশ করিয়াছেন তাহার সঙ্গে আমি মিলি না।’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমালোচনায় বেশিরভাগই নীরব থেকেছেন, কিন্তু এখানে যদুনাথের দীর্ঘ চিঠির উত্তরে তাঁকেও বিস্তৃতভাবে কিছুটা কঠিন স্বরেই উত্তর দিতে দেখা যায়। জোড়াসাঁকোর ‘বিচিত্রা স্কুল’-এর ধারা ক্ষীণ হয়ে আসায় বিশ্বভারতীর কলাভবনে নতুন করে শিল্পচর্চার এক সজীব কেন্দ্র গড়তে চেয়েছিলেন, যা ভবিষ্যতে দেশের শিল্পকলাকে দিশা দেখাতে সক্ষম। তার বীজ পুরোপুরি অঙ্কুরিত হয়ে ওঠার পূর্বেই যদুনাথের এই বিদ্রূপ তাঁর পক্ষে অসহনীয় লাগাই স্বাভাবিক। তবে পরবর্তীকালে যদুনাথ নিশ্চয়ই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, এই পত্রবিনিময়ের বহুদিন পরে উভয়ের পত্র প্রবাসীতে (চৈত্র ১৩৫২) প্রকাশের সময় যদুনাথ তাঁর চিঠির কিছু অংশে পরিবর্তন করেছিলেন। বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে কেবল যদুনাথ সরকার নন, দেশের সকলেই যে কবির আদর্শের প্রতি গভীর আস্থা রেখেছিলেন – এমনটা নয়। তাই দেখা যাবে, শুরু থেকে রবীন্দ্রনাথের বিশ^ভারতী কেবল অর্থসংকটের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়নি, অধিকাংশ সময়েই তাকে নানান বিরুদ্ধতার মধ্যে দিয়ে পথ চলতে হয়েছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মনে এই আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে যে, তাঁর অবর্তমানে কবির শিল্পীসত্তার ওপরেও আঘাত আসতে পারে। এই দুর্ভাবনা থেকেই জীবনের একেবারে প্রান্তে (১৯৩৮) পৌঁছে বিচিত্র সমস্যা জর্জরিত বিশ্বভারতীর সমস্ত স্বত্ব পুত্র ও পুত্রবধূর ওপর দেওয়ার কথা ভেবেছেন। একটি ছোট কাগজে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লিখে রেখেছেন, ‘…ইনস্টিটুশনের রাস্তা বেয়ে এমন সকল লোক এখানকার কর্তৃত্ব অধিকার করতে পারে যাতে করে গোলমাল পাকানো অসম্ভব নয় – এই জন্যে বিনা দায়ে সমস্ত স্বত্ব রথীদের হাতেই দিতে চাই।’
শান্তিনিকেতনের সেই ছোট্ট একটি বিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক মানের বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র বিশ্বভারতী গড়ে ওঠার এই দীর্ঘ পথের দিকে তাকালে দেখা যাবে, কত না দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সংকট-সমাধান, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। এর একদিকে যেমন আদর্শ আর বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে দোলাচলের অন্ত ছিল না, তেমনি তার পাশাপাশি প্রিয়জনের আন্তরিক সহানুভূতি, সহযোগিতা, সহমর্মিতার বিপরীত মেরুতে অবস্থিত বিরুদ্ধতার আঘাতও বেজেছিল বড় নির্মম, বড় কঠিন সুরে।
তথ্যপঞ্জি
১) আশ্রমের রূপ ও বিকাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, কলকাতা।
২) রবিজীবনী (৫,৬ ও ৭ খণ্ড), প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ, কলকাতা।
৩) ‘চিঠিপত্র ২’ এবং ‘চিঠিপত্র ১৫’ – বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা।
৪) রবীন্দ্র রচনাবলী ১৪ খণ্ড (সুলভ সংস্করণ), বিশ^ভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.