শিল্পভাষার ব্যাকরণ

শুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়

Atonko kali, Nasrin Begum

শিল্প কী জিনিস – এ-প্রশ্নের নানাবিধ উত্তর-অনুত্তর আছে; থাকবেও। কিন্তু শিল্পের যে-বৈশিষ্ট্যটি সবার কাছেই এক, তা হলো এর পরিবর্তনশীলতা। শিল্প কিংবা শিল্পচর্চা কখনই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দর্শন ও নন্দন চিন্তার মতোই বদলেছে তার জল, স্থল ও হাওয়া। চলেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর নতুনভাবে দেখার খেলা। বিশ্লেষণের ধারায় শিল্পের সে-খেলার অংশ হিসেবেই যেন, ঢাকার ‘এথেনা’ গ্যালারিতে আয়োজিত হয়েছে ‘Draw : Turning Thoughts into Lines’ শিরোনামের ভিন্নধর্মী এক চিত্রপ্রদর্শনী। চিত্রকর্মকে তার ভিত্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দেখার মধ্যেই এ-প্রদর্শনীর ভিন্নধর্মিতা প্রকাশ পেয়েছে। আর সে-ভিত্তিটা হলো ড্রইং। ড্রইংকেই বলা হয় শিল্পের ভাষার ব্যাকরণ, তা সে চারুশিল্পই হোক আর স্থাপত্য কিংবা গ্রাফিক্স ডিজাইনই হোক। শিল্প এবং তার স্রষ্টার সঙ্গে এ-ড্রইংয়ের গভীর এবং একান্ত সম্পর্কের দিকটি তুলে ধরাই মূলত এ-প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য।
দেশের প্রখ্যাত ২৬ চিত্রশিল্পীর দেড় শতাধিক চিত্রকর্ম নিয়ে আয়োজিত এ-প্রদর্শনীতে আমাদের সুপরিচিত শিল্পী এবং তাঁর কাজগুলোকে আরো একবার নতুন করে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন – কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবদুস শাকুর শাহ, মাহমুদুল হক, মনিরুল ইসলাম, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, নাইমা হক, শাহাবুদ্দিন আহমেদ,  নাসরিন বেগম, মোহাম্মদ ইউনুস, রোকেয়া সুলতানা, জামাল আহমেদ, চন্দ্রশেখর দে, ঢালী আল মামুন, ফরিদা জামান, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য, হামিদুজ্জামান খান, কালিদাস কর্মকার, শহিদ কবীর, কনক চাঁপা চাকমা, কুহু প্ল্যামনডন ও খালিদ মাহমুদ মিঠু।
এ শিল্পীরা শিল্পচর্চায় কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তাঁরা ছবি আঁকছেন বহু বছর ধরে এবং সকলেই তাঁদের নিজ নিজ কাজে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা স্টাইল তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। প্রচণ্ড বৈচিত্র্যময়তায় পূর্ণ এ-শিল্পীদের চিত্রকর্ম; তাঁদের শিল্পভাবনাগুলোও অনন্য। দর্শকদের সেই বিভিন্নরকম শিল্পসংগীত, দৃঢ় এবং অপেক্ষাকৃত মৌলিক এক শিল্পসুর দিয়ে শোনার সুযোগ করে দিয়েছে এথেনা গ্যালারি।
প্রদর্শনীর শুরুতেই চোখে পড়ে সৈয়দ জাহাঙ্গীরের কাজ। তাতে চিরাচরিত শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীরকেই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রদর্শনীর শিরোনাম ভাবনাটা মাথায় থাকার কারণে তাঁর সেই পরিচিত শিল্পভঙ্গিকেই আবিষ্কার করা গেল নতুন আঙ্গিকে। কাগজের ওপর অ্যাক্রিলিকের কালো রেখায় গ্রামবাংলা, ফসলের ক্ষেত, ঘাটে বাঁধা নৌকার সারি – এসব বিষয়ও যেন হুট করে শিল্পীর রৈখিক দক্ষতা আর বৈশিষ্ট্যের আলোকে ভিন্ন আরেক বিষয়ে রূপান্তরিত হয়ে যায় – যেখানে চিত্রকর্মকে শিল্পীর তুলির টানের কিংবা আঁচড়ের পথ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া যায়, আবার একই সঙ্গে চিত্রকর্মের সমগ্র শিল্পযাত্রাকে খুঁজে পাওয়া যায় বিস্ময়ে। কাইয়ুম চৌধুরীর বিখ্যাত তুলির আঁচড় প্রদর্শনীকে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। তাঁর চারটি ছবিতে সাদা কাগজে মোটা কালো রেখার ব্যবহার যেমন আছে, তেমনি প্যাস্টেলে রঙিন পাতলা রেখায়ও রয়েছে শিল্পদক্ষতার স্বাক্ষর। প্রদর্শনীতে নিসার হোসেনের দুটি কাজ যেন প্রদর্শনীটিতে বাজতে থাকা মূল সুরকে, একটু থামিয়ে দিয়ে আবার শুরু করতে বলে। কাজ দুটিতে শিল্পদক্ষতার বিচারকার্যের ঊর্ধ্বে শিল্পীর শিল্পভাবনার এবং অঙ্গীকারগত দিকটিই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে। তাঁর কাজে ক্যানভাসের কাপড় শুধু আঁকার মাধ্যম হিসেবেই থাকেনি, অনেকাংশেই চিত্রকর্মের স্বার্থে রূপান্তরিত হয়েছে আঙ্গিকে। আর তাঁর সে-চিত্রকর্ম দুটির নিচের অংশে যা লেখা আছে তাতে যে-কোনো মাপের দর্শকই নিজস্ব পরিমাণে থমকে যেতে পারেন। একটিতে লেখা আছে, ‘ইহা স্বপ্নলোক, কাল্পনিক অথবা বাস্তব দৃশ্য অনুসারে অঙ্কিত’। অন্যটিতে দেখা যায়, ‘ইহা দোজখ ও বেহেশত, ইহা সত্য এবং মিথ্যার লীলাখেলা’।
শিল্পী কামরুল হাসানের বেশকিছু ড্রইং প্রদর্শনীকে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার পরম্পরার সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াস পেয়েছে। আর স্পেস ব্যবহারে রৈখিক ক্ষমতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় মনিরুল ইসলামের চিত্রকর্মে। মিশ্রমাধ্যমের বিস্তীর্ণ জমিনে রেখা এবং স্পেসের যৌথ উপস্থাপনে তিনি এঁকেছেন ‘ওয়ে টু দ্য পিলগ্রিম’। শিশির ভট্টাচার্যের রৈখিক সাম্রাজ্য যেন এ-প্রদর্শনীর শিরোনামকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। জামাল আহমদের ‘পাগলা’ সিরিজের দুটি কাজ বাস্তবধর্মী চিত্রকর্মের বিস্ময়কর শিল্পশৈলীর উদাহরণ হিসেবে ঝুলে আছে প্রদর্শনীতে। তাঁর পেনসিলের জাদুতে, বিশ্রামরত রমণীর চিত্রকর্মটি তাৎক্ষণিকভাবেই দর্শকদের শিল্পকর্মের ভেতরে প্রাণের অস্তিত্ব টের পাইয়ে দেয়। রেখার কিংবা শিল্পভাষার ব্যাকরণগত দিকটি এখানে গৌণ হয়ে পড়ে থাকে।
শিল্পী রফিকুন নবীর প্যাস্টেল ড্রইং আমাদের দেখিয়ে দেয় রং, রেখা এবং স্পেস কীভাবে একান্ত হয়ে ছবি হয়ে ওঠে। মুর্তজা বশীরের কলমের চিকন রেখায় চিন্তারত নারীর মুখ এবং শিল্পকর্ম সৃষ্টির পথে রেখার সঙ্গে শিল্পীর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠার নমুনা পাওয়া যায়। জড় রেখা শিল্পীর মন ও কৌশলের মিশ্রণে জীবন্ত হয়ে ওঠে। কখনো সেই জীবন্ত রেখা-কঙ্কালের ওপর গড়ে ওঠে রঙের অস্তিত্ব। রেখাই যেন এসব শিল্পকর্মের ভিত্তিপ্রস্তর হয়ে রূপের অন্তরালে শিল্পের মেরুদণ্ড হয়ে বসে থাকে। এর এ-ভাবনাটাই এথেনা গ্যালারির এ-প্রদর্শনীটির কেন্দ্রবিন্দু।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের বহুল পরিচিত গতিশীলতা – সেটাও এখানে রেখার হাত ধরে দর্শকদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে। আর কনক চাঁপা চাকমার পাহাড়ি মানুষরাও চিত্রকলাচর্চার আদি এবং অকৃত্রিম রেখামালার অস্তিত্বকে জানান দেয় শিল্পীর আপন শৈলীতে।
ঢালী আল মামুনের মাছ সিরিজের কাজ, মাছের বহুমাত্রিক এক্সপ্রেশনের চমৎকারিত্ব অতিক্রম করে রেখার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে এ-প্রদর্শনীতে। ফরিদা জামানের চিত্রকর্মগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর ছবিতে বিভিন্ন মাত্রার রেখার সঙ্গে রং এবং স্পেসের ব্যবহার, রংকে রেখার প্রাচুর্যে যেন আয়ত্তে আনার চেষ্টা। আর সে-চেষ্টার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে পাখি ও প্রকৃতির গান। এদিক দিয়ে মাহমুদুল হকের উপস্থিতি সমস্ত প্রদর্শনীর মৌলিক চরিত্রের মধ্যে অনেকটা ব্যতিক্রমের আভাস দেয়। কালি ও কলমের মাধ্যমে রৈখিক এমন এক জগৎ তিনি তৈরি করেছেন – যেখানে রেখার আধিক্যে চিত্রকর্মের মৌলিক স্পেসের ভেতরে রৈখিক আরো এক স্পেস বের হয়ে আসছে।
আবদুস শাকুর শাহ তাঁর বাংলার লোক-ঐতিহ্যনির্ভর বর্ণিল ধারাকেও সাদাকালো রূপ প্রদান করেছেন, যাতে রেখাকেই আলাদাভাবে নির্ণয় করা যায় শিল্পের হাতিয়ার হিসেবে। প্রদর্শনীতে একমাত্র রোকেয়া সুলতানার কাজগুলোতে ধাতুর ব্যবহার দেখা যায়। রেখার সঙ্গে ধাতব ব্যবহারের মাধ্যমে মানবজীবনের কঠিন এবং কোমল, উভয় দিককে প্রতিবিম্ব আকারে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে জীবনের নানা বন্ধুরতাও রেখার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
সমস্ত প্রদর্শনীটাই যেন রেখাকে শিল্পের রূপান্তরের প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে উন্মোচিত করার, সকল শিল্পকর্ম ও শিল্পীর চর্চাকে একই ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে ভিন্নভাবে শিল্পানন্দ আহরণের প্রয়াস। এ-প্রদর্শনীটি এথেনা গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের দ্বিতীয় শিল্পায়োজন। কিন্তু শিল্প-ভাবনা এবং নতুনত্বের যাত্রায় নিজেকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় স্পষ্ট। প্রদর্শনীটি তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে গেল।