শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং একটি নোলকের গল্প

সাহিত্যটা মোটামুটি বুঝতাম, শিল্পকলাটা মাত্রও না। তবু ভাগ্যক্রমে একজন খুব বড় শিল্পীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় হয়ে গেল। ডাকসুর ম্যাগাজিনের জন্য তিনি একটি ছবি এঁকে দিলেন। মুষ্টিবদ্ধ হাতে জনতার মিছিল। উপরে লাল-কমলা রঙে বিস্তীর্ণ আকাশ।

ফাইনাল প্রোডাকশনে দেওয়ার আগে ছবিটি আবার দেখলাম, মতিঝিল বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ প্রেস অফিসে বসে। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছবির নিচে শিল্পীর স্বাক্ষরটা নেই। লোকে জানবে কি করে যে এটা একজন নামকরা শিল্পীর আঁকা ছবি? খটকা লাগল! পাশের চেয়ারে বসা এক ভদ্রলোকের কথায় সজাগ হলাম।

বললেন, এটি নিশ্চয় জয়নুল স্যারের আঁকা?

ভদ্রলোক সম্ভবত নিবিড়ভাবে ছবিটি দেখছিলেন পাশে বসে।

বললাম, আপনি জানলেন কি করে? এতে তো তাঁর নাম নেই।

বললেন, নাম লাগবে কেন? এই আকাশের গায়ে তুলির শেষ স্পর্শের যে হালকা বিচ্ছিন্ন নিখুঁত লাইনগুলো, এটা শুধু জয়নুল স্যারের তুলিতেই সম্ভব।

ভালো করে দেখলাম – তাই তো, তুলির মাথা ছড়িয়ে যেন প্রতিটি চুলের সূক্ষ্ম টানা লাইন। ছবিটা প্রেসে দিয়ে দিলাম প্লেট করার জন্য, বিখ্যাত জয়নুল-স্বাক্ষর ছাড়াই। একজন অজ্ঞ সম্পাদককে শিল্পকর্ম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার জন্য তরুণ শিল্পীকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। ১৯৭২ সাল, আমি তখন ডাকসুর নির্বাচিত সম্পাদক।

একসময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাসায় প্রায়ই যেতাম, জোনাকি সিনেমা হলের পশ্চিম পাশের রাস্তাটায়, একটু এগোলেই। জয়নুল স্যারের বাসায় জমজমাট বৈঠক হতো। অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও গুণীজন আসতেন। মনসুর উদ্দিন, শওকত ওসমান, জুনাবুল ইসলাম, হাশেম খান, প্রাণেশ মণ্ডল, রফিকুন নবী, আরো কত কে – অনেকেই শিল্পাচার্যের ছাত্র। জয়নুল স্যার ছিলেন বৈঠকের মধ্যমণি, কখনো বলতেন তাঁর পুরোনো দিনের কথা, কখনো শিল্পকর্ম, আবার কখনো নতুন ভাবনা নিয়ে। তবে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। শীতের মৌসুমে প্রতিদিনই জয়নুল স্যারের বাসায় থাকত খেজুরের রসের পায়েস।

জয়নুল স্যার খুব স্বভাবিক গলায় সাধারণভাবে কথা বলতেন। কোনো অহংকার বা ইগো নেই। বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পসামগ্রী নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতেন। মসলিন, জামদানি, কাঁথা, চাদর, নাও-সাম্পান, হুঁক্কা, বাঁশি, পালকি, ঢেঁকি, পিঠা, কলসি, খড়ম – কিছুই বাদ যেত না। হঠাৎ নতুন নতুন আইডিয়ার কথা বলতেন। তাঁর উচ্ছ্বাস ও পাণ্ডিত্য আমরা প্রাণভরে উপভোগ করতাম। আমার মনে হতো, যদি কেউ তখন তাঁর হাতে রং, তুলি ও ক্যানভাস তুলে দিত, তিনি তখনই এঁকে ফেলতে পারতেন।

একদিনের কথা, সম্ভবত ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো একদিন। জয়নুল স্যারের বাসায় কথা বলতে বলতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। অন্যরা সবাই চলে গেছেন। জয়নুল স্যার বলছিলেন বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্পের কথা। ‘বাংলার অনেক ঐতিহ্য ও লোকশিল্প আজ হারিয়ে গেছে। এখন যা আছে তাও আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি একটা লোকশিল্প জাদুঘর গড়তে চাই, যেখানে হরেক রকম গ্রামীণ শিল্পকর্ম সংরক্ষিত হবে। গবেষণা হবে এসব শিল্পের নানা দিক নিয়ে, বিশেষজ্ঞরা চেষ্টা চালাবেন লুপ্ত এবং অর্ধলুপ্ত গ্রামীণ শিল্পকলাকে পুনরুজ্জীবিত করতে। এখনই এইসব কাজ শুরু করতে হবে, নতুবা সব হারিয়ে যাবে।’

আগেও অনেকবার এই প্রসঙ্গটা শিল্পাচার্যের মুখে শুনেছি। কিন্তু আজকের আবেগ ও তাগিদটা আরো গভীর মনে হলো। শিল্পাচার্য আরো বললেন, ‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এইসব কাজ সম্ভব নয়। কিন্তু আমার কথা শুনবে কে?’

আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে হঠাৎ একটা প্রস্তাব করে ফেললাম। বললাম, ‘আপনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন। তিনি বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রধান প্রবক্তা। নিশ্চয় আপনার কথা শুনবেন।’

জয়নুল স্যারকে খুব উৎসাহিত মনে হলো না। তিনি বললেন, ‘যা শুনেছি তাঁর ধারেকাছে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি দেশের কত জরুরি কাজে ব্যস্ত। এসব শোনার তাঁর সময় কোথায়?’

তবু আমি জোর করলাম। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কিছু রাজনৈতিক কর্মকর্তাকে আমি ভালোভাবেই জানি। তাছাড়া শিল্পাচার্য গণভবনে গেলে বঙ্গবন্ধু অবশ্যই দেখা করবেন, এই বিশ্বাস আমার ছিল। জয়নুল স্যার শেষে রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা তখনই গণভবনে যাবো। জয়নুল স্যার বললেন, ‘দেখা না হলেও বা কি, বাইরের থেকে অন্তত একটু ঘুরে আসা হবে।’

শীতের সন্ধ্যা। শিল্পাচার্যকে গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রি থেকে একটা ‘ভিভা’ গাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু গাড়িটা বিকল হয়ে পড়ে আছে। অগত্যা আমরা একটা রিকশায় করে (পুরনো) গণভবনে রওনা হলাম।

গণভবনে তখন ভিড় লেগেই থাকতো। তোফায়েল আহমেদ তখন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব। খুঁজে বের করলাম তাঁকে , ঘরের এক কোণে বাদশা ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন আলাপ করছিলেন। তাঁদের বললাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এসেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটু দেখা করতে। তোফায়েল ভাই গিয়ে বললেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে (ভূতপূর্ব স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা)।

সময়টা খুব সুবিধার মনে হলো না। দশ মিনিট পরেই পূর্ব ইউরোপের কোনো রাষ্ট্রদূত আসবেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সিদ্ধান্ত হলো, রফিকুল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে বলবেন, তিনি যদি শিল্পাচার্যকে সময় দেন, তাহলেই শুধু দেখা করা সম্ভব।

সচিব প্রধানমন্ত্রীর রুম থেকে বের হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধুর গলা শোনা গেল দরজায়, ‘কোথায় আমার শিল্পী? এক্ষুনি চলে আসুন।’

বাংলার দুই কৃতী সন্তান বঙ্গবন্ধু ও শিল্পাচার্য, একান্তেই আলাপ করলেন বাংলার লোকজ ঐতিহ্যকে ধরে রাখার এক মহান প্রয়াসে। সেদিন দুজনে পনেরো মিনিটের মতো কথা বললেন।

ফিরে আসার পথে জয়নুল স্যারকে খুব খুশি মনে হলো। বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু একশত ভাগ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি একজন আমলাকে ফোন করে নির্দেশ দিয়েছেন জাদুঘরের প্রাথমিক প্রস্তাবের কাজ শুরু করার জন্য। এবার একটা কিছু নিশ্চয়ই হবে। আমি প্রস্তাব করেছি, জাদুঘর ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁওতে হবে।’

মিশনের সফলতা শুনে আমারও খুব ভালো লাগল।

শিল্পাচার্যের সেই প্রয়াসেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজকের সোনারগাঁওয়ের লোকশিল্প জাদুঘর। জানি না লোকশিল্প সংরক্ষণ ও লুপ্ত শিল্পকে পুনর্জীবিত করতে সেখানে কতটুকু কাজ হচ্ছে! আমাদের দেশের অনেক সদিচ্ছা একসময় মাথাভারী অযোগ্য প্রশাসন ও সুরম্য অট্টালিকার নিচে চাপা পড়ে যায়। আমি আশা করি সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর সত্যিই শিল্পাচার্যের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে। শিল্পাচার্যের মনের ক্যানভাসে এর যে প্রতিচ্ছায়া আমি সেই সন্ধ্যায় দেখেছিলাম, সেই অনুভূতিটা আমি আজো অনুভব করি।

জয়নুল স্যারকে অনেকবার নোলক নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। একদিন বললেন, ‘বড্ড ইচ্ছে করে একটা নোলক আঁকতে। শিবচর গ্রামের এক গৃহবধূ নাকে নোলক ঝুলিয়ে ঘাটে যাচ্ছে। কিন্তু কেন জানি আঁকতে পারছি না।’

একদিন শওকত ওসমানকে ধরে বললেন, ‘শওকত, তুমি একটা গল্প লিখে ফেলো। গাঁয়ের একটা গৃহবধূ থাকবে সেই গল্পে। আমি ওর নাকে নোলক লাগিয়ে ছবি আঁকবো।’

শওকত ওসমান আমার শিক্ষক, ঢাকা কলেজে বাংলা পড়াতেন। আমি ওনাকে বললাম, ‘স্যার আপনি একটা গল্প লিখে দিন, জয়নুল ভাই ছবি আঁকবেন, আমি প্রকাশ করবো।’

শওকত স্যার না করে দিলেন। বললেন, ‘তোমাকে লেখা দিলে টাকা পাওয়া যাবে না।’

শওকত স্যারকে আমি ভালোভাবেই জানতাম। স্যার তখন লেখালেখি একদম কমিয়ে ফেলেছেন। জয়নুল ভাইয়ের আর নোলক আঁকা হলো না।

আমার বসার ঘরের দেয়ালে টানানো ছবিগুলো আমি মাঝে মাঝে দেখি – দুর্ভিক্ষে ভুখানাঙা মানুষের গ্রাম ছাড়ার মিছিল, নৌকায় গুণ টানা মানুষের ন্যুব্জ হওয়া দেহ, মেয়েরা দলবেঁধে ধান ভানছে ঢেঁকিতে …, এগুলোর পাশেই যেন আর একটা ছবি – শিবচরের সেই তরুণী বধূ, কলসি কাঁখে যাচ্ছে পুকুরে, নাকে তার একটা বড় নোলক। আমি চেয়েই থাকি, ‘ঘরেতে এলো না সে, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া’!