আইয়ুব ভূঁইয়া
চারিদিকে গহিন অরণ্য। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। বহুদূরে অরণ্যের গভীরে বৌদ্ধমন্দিরের চূড়া দেখা যাচ্ছে। বসন্ত না হলেও কখনো কখনো কোকিলের কণ্ঠও ভেসে আসছে। এরই মধ্যে প্রকৃতি আর নিসর্গকে নিয়ে ছবি আঁকছেন শিল্পীরা। তুলির অাঁচড়ে ক্যানভাসে উঠে আসছে অরণ্যের দিনরাত। শিল্পীরাও যেন হারিয়ে গেলেন বনের আদিমতায়। প্রথমে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে শিল্পীরা কী আঁকবেন, কীভাবে আঁকবেন, বিষয় কী হবে ইত্যাদি নিয়ে ইতস্তত করলেও পরে তাঁরা নিজেরাই ডুবে গেলেন ক্যানভাসে। প্রকৃতি নিয়ে ক্যানভাসে রং-তুলির খেলা শুরু করলেন আর্ট ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারী দেশবরেণ্য ও খ্যাতিমান শিল্পীরা।
গত ৮ থেকে ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের শান্তিনিকেতনখ্যাত মিলনছড়ি এবং সেনাবাহিনীর নৈসর্গিক অবকাশযাপন কেন্দ্র নীলগিরিতে তিনদিনব্যাপী এ-আর্ট ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবী, তাহেরা খানম, ফরিদা জামান, শেখ আফজাল ও কনক চাঁপা চাকমা আর্ট ক্যাম্পে অংশ নেন। ঢাকার বেঙ্গল গ্যালারি অব্ ফাইন আর্টস এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশে যৌথভাবে এ-আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন করে। এর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক সুবীর চৌধুরী। শিল্পীদের আঁকা এসব ছবি দিয়ে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির ২০১৪ সালের ক্যালেন্ডার সাজানো হবে। এছাড়া এসব ছবির একটি প্রদর্শনীও হবে বলে জানিয়েছেন বেঙ্গল গ্যালারির পরিচালক সুবীর চৌধুরী।
আর্ট ক্যাম্পে অংশ নিতে শিল্পীরা ৭ অক্টোবর ঢাকা থেকে বিমানে চট্টগ্রামে নেমে সড়কপথে দুপুরের মধ্যে মিলনছড়ি পৌঁছে যান। ফরিদা জামান ও কনক চাঁপা চাকমা ছাড়া বাকি শিল্পীরা এখানে এর আগেও বেড়িয়েছেন এবং কেউ কেউ ছবি এঁকেছেন। তাই কনক ও ফরিদা জামান মিলনছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁদের ছবিতেও প্রতিফলিত হয়েছে এই বিমুগ্ধতা।
৮ অক্টোবর শিল্পীরা মিলনছড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আদিবাসী পণ্য কিনেছেন, ছবি তুলেছেন এবং খুঁজেছেন ছবি আঁকার বিষয়বস্ত্ত। সুবীর চৌধুরীর তোলা ছবিতে রফিকুন নবী তাঁর আঁকার বিষয়বস্ত্ত পেয়ে যান। তাঁর ক্যানভাসে অরণ্যের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের পাশাপাশি ক্যামেরায় তোলা সেই আদিবাসী মুখগুলোও ফুটে উঠেছে। শিল্পীরা বান্দরবানের শৈলপ্রপাত ভ্রমণ করেন, দূর থেকে সাঙ্গু নদীর ছবি তোলেন এবং আদিবাসী পল্লী ফারুকপাড়া পরিদর্শন করেন।
সন্ধ্যায় মিলনছড়ি রিসর্টের ক্যান্টিনে চাপানের পর বসে জমজমাট আড্ডা। আড্ডায় উঠে আসে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ। চারুকলার বাইরেও শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরী ও রফিকুন নবীর অবাধ বিচরণ। তাই আড্ডায় স্থান পায় বিভিন্ন নান্দনিক বিষয়ও। মাঝে মাঝে এই আড্ডায় যোগ দিতেন মিলনছড়ির স্বত্বাধিকারী হাসান মনসুর মানে সবার প্রিয় মিলনভাই। মিলনভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশে পর্যটন ব্যবসার পথিকৃৎ মিলনভাই ১৯৮০-র দশকে দ্য গাইড ট্যুরস লিমিটেডের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেন। সুন্দরবনে এমভি ছুটি নামে একটি দোতলা জাহাজ দিয়ে তাঁর ব্যবসার সূচনা। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তিনি এখন সুন্দরবন থেকে বান্দরবানের গভীর অরণ্যের কোলে থিতু হয়েছেন। সস্ত্রীক অবস্থান করে তিনি নিজেই এখানকার সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। এলাকাটি তাঁর নামে মিলনছড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কানন দেবী তাঁর প্রিয় নায়িকা। আড্ডায় যখন জানতে পারলেন কানন দেবী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রিয় নায়িকা তখন সুচিত্রা সেন ও কানন দেবী-অভিনীত পুরনো দিনের সিনেমার বেশ কিছু সিডি নিয়ে হাজির হলেন তিনি। আসার আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত ল্যাপটপ ও প্রজেক্টরের সাহায্যে বড় পর্দায় কাইয়ুম চৌধুরী ও রফিকুন নবী সস্ত্রীক এসব সিনেমা দেখেন। হারিয়ে যান অতীতের দিনগুলোতে, অর্থাৎ লায়ন সিনেমাহলে ছবি দেখার দিনগুলোতে।
প্রতিদিন সন্ধ্যার আড্ডায় এবং চলার পথে গাড়িতে সবার প্রিয় বক্তা ছিলেন রফিকুন নবী। তিনি সাধারণ বিষয়কে হাস্য-রসাত্মক করে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি কথা বলা শুরু করলে সবার মনোযোগ থাকত তাঁর প্রতি। উপস্থাপনার আকর্ষণীয় ভঙ্গি সবাইকে তাঁর প্রতি মনোযোগী করে তোলে। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতেন কাইয়ুম চৌধুরীর সহধর্মিণী শিল্পী তাহেরা খানম।
৯ অক্টোবর সকালে নাস্তার পরপরই শিল্পীদের মূল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। খন্ড খন্ডভাবে তাঁরা সামনে দৃশ্যমান বনের পুরো অবয়ব তুলে নিয়ে আসেন ক্যানভাসে। গত দুদিনে যে-দৃশ্য আমরা ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে বসে অবলোকন করছিলাম, তা যেন জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে শিল্পীদের ক্যানভাসে। এর মধ্যে বান্দরবান প্রেসক্লাব থেকে স্থানীয় সাংবাদিকরা আসেন শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলতে এবং আর্ট ক্যাম্প দেখতে। মধ্যাহ্নভোজের আগেই সবার ছবি আঁকা শেষ হয়ে যায়। বিকেলে শিল্পীরা বান্দরবান শহর দেখতে যান। সেখানে তাঁরা একটি স্থানীয় এনজিও অফিস পরিদর্শন এবং স্থানীয় আদিবাসী-জিনিসপত্র কেনেন। সন্ধ্যায় প্রতিদিনের মতো আড্ডা বসে ক্যান্টিন ও বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে।
পরদিন শিল্পীরা নাস্তার পর লাগেজ গুছিয়ে বান্দরবানের আরেক নৈসর্গিক রিসর্ট নীলগিরির পথে যাত্রা করেন। সেখানেও রাতযাপন ও ছবি আঁকার কর্মসূচি রয়েছে। পথে তাঁরা চিম্বুকের চূড়ায় ছবি তোলেন। পাশাপাশি পাহাড়ি কলা খেতে ও চা পান করতে ভোলেননি। তবে নীলগিরির দাপটে এখন চিমু^কের প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ অনেক কমে গেছে। তাই চিম্বুকের একমাত্র রেস্ট হাউসটি অনেকটা পরিত্যক্ত। তবে আমাদের নিসর্গপ্রিয় শিল্পীদের নীলগিরি তেমন আকর্ষণ করতে পারেনি। তাঁরা সেখানে পৌঁছেই আবার মিলনছড়িতে ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। যদিও তাদের জন্য সেখানে কটেজ বুকিং করা হয়ে গেছে। তাঁদের পীড়াপীড়িতে সুবীর চৌধুরী নীলগিরির কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করে আবার মিলনছড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যেও শিল্পী ফরিদা জামান ও শেখ আফজাল নীলগিরিকে তুলে আনেন দুটি ছোট ক্যানভাসে। দুপুরের খাবার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শিল্পীরা দুর্বার আকর্ষণে আবার মিলনছড়িতে ফিরে আসেন। আসার পথে হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে গাছ-গাছালির ওপর রোদ্র-ছায়ার খেলা সবাইকে মুগ্ধ করে। মিলনছড়িতে এসে শিল্পীরা প্রায় সবাই আগের নিজ নিজ কটেজে ওঠেন। তবে এক নবদম্পতির আগমনে আমাদের দলের দুজন সাময়িক বাস্ত্তচ্যুত হন। মিলনছড়িতে এসে শিল্পীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। আসলে মিলনছড়িতে যাঁরা থেকেছেন, তাঁদের কাছে নীলগিরি কখনো ভালো লাগবে না। তাছাড়া মিলনভাইয়ের কানন দেবীর দুর্লভ আকর্ষণও শিল্পীদের ফিরে আসার অন্যতম কারণ। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে শেষ দিন গভীর রাত পর্যন্ত কাইয়ুমভাই, তাহেরাভাবি এবং নবীভাই ও নাজমাভাবির দীর্ঘ সময় বসে পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা ও কানন দেবী অভিনীত সিনেমা ও গান দেখার মধ্য দিয়ে। শিল্পীর চোখে বান্দরবানের প্রকৃতি ও নিসর্গ দেখার পাশাপাশি তাঁরা উত্তম-সুচিত্রা ও কানন দেবীকেও নতুন পরিবেশে নতুন করে অনুভব করেছেন। ফেরার দিন বিকেলে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের অদূরে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বোট ক্লাবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাফেটেরিয়ায় বসে জাহাজের আনাগোনা আর ওপারে আনোয়ারায় নদীর তীরে সবুজের সমারোহ দেখে শিল্পীরা বাড়তি আনন্দ অনুভব করেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.