শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ

অমিতাভ সেনগুপ্ত

চিত্ররচনায় আর শৈল্পিক চিন্তায় সমাজকে আলোকিত করে, ক্লান্ত সফিউদ্দীন বিদায় নিলেন – যেন প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম মেনে। চল্লিশ দশকে যে কয়জন বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পী কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় শিল্পচর্চার নতুন কর্মকান্ড রচনা করলেন, সফিউদ্দীন তাঁদেরই একজন এবং বাংলাদেশ পর্বে তাঁরা যে-রেখাপথ রচনা করেছেন, তা এখন শিল্পধারায় বিস্তৃত। জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন বা কিবরিয়ার মতো শিল্পীরা যে-জীবনপরিক্রমা করেছেন, ইতিহাসের তিনটি সন্ধিক্ষণ, – তা লক্ষ করার; কারণ সেই অভিজ্ঞতা ও প্রচেষ্টার ফসল তৈরি করেছে পরবর্তী দিগদর্শন।

প্রথম পর্ব
সফিউদ্দীনের জন্ম ব্রিটিশরাজের শহর কলকাতায়। তাঁর শৈশব-যৌবন কেটেছে গঙ্গাপারে, আনাগোনায়। কখনো-বা বন্ধুদের সঙ্গে সাঁওতাল গ্রামে। সমসাময়িক সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ তাঁর জীবনের অঙ্গ।
কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে তাঁর শিক্ষাপর্বের শেষের দিকে, এক নতুন ধারায় তাঁর হাতেখড়ি – রমেন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে ছাপাই ছবির আরো পথনির্দেশ। ইতিমধ্যে মুকুল দে-র ‘ড্রাই পয়েন্ট’ তাঁকে মুগ্ধ করেছে। কলকাতায় তাঁর সময়কালে শিল্পের এক নতুন জোয়ার বইতে শুরু করেছে। বলা যায়, ওরিয়েন্টালিস্ট ও অবনীন্দ্রীয় চিন্তার বাইরে এবং কলোনিয়াল ‘অ্যাকাডেমিজমে’র পরবর্তী অধ্যায়। এর উৎস বলা যায় প্রথমে ‘প্যারিস স্কুল’ এবং জার্মানির ‘বঁ-হউস’ – এরপর আমেরিকান ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম’ (কিছুটা পরে)। কলকাতা ছাড়াও বম্বে তখন নতুন আরেক শহর, এই হাওয়ায় উদ্দীপিত। এই চিন্তাধারার ফসল যদি পরিতোষ সেন, নীরদ মজুমদার প্রমুখকে ধরা যায় – বোম্বেতে সুজা, রাজা – এঁরা। ইতোমধ্যেই আলোড়ন এনেছে কলকাতায় জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোরের রেখাচিত্র। এই ভাষারই প্রয়োগে জীবনের বাস্তবতা, মানুষের হাহাকার – যা ভারতীয় কোনো ভাষাতেই সম্ভব ছিলো না।
কিন্তু এই সন্ধিক্ষণেই ভারত বিচ্ছিন্ন হলো এবং সফিউদ্দীনের জীবন গঙ্গাপার থেকে পদ্মাপারে। নতুন পরিচয়ে। ইতোমধ্যে কলকাতায় সফিউদ্দীন তাঁরই শিক্ষাভূমি আর্ট স্কুলে ‘লিথোগ্রাফি’র শিক্ষক এবং বহুপুরস্কৃত, পরিচিত নব্যগোষ্ঠীর একজন শিল্পী। দিল্লিতে ‘অল ইন্ডিয়া ফাইন আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস সোসাইটি’র কমিটি সদস্য।

দ্বিতীয় পর্ব
ভারত বিচ্ছিন্ন হলো, ১৯৪৭ সালে। নতুন কর্মকান্ডের মাঝে ভাবতে ইচ্ছা করে, সফিউদ্দীনের মনে কী প্রশ্ন জেগেছিলো? হারানো, প্রাপ্তি, অথবা ধর্ম-রাজনীতির মাঝে কোথায় শিল্প? এসব হয়তো নীরব অধ্যায়, কিন্তু তাঁর মতো শিল্পীকে খুঁজছিলেন জয়নুল আবেদিন – যাঁর উদ্যোগে ঢাকায় তখন শিল্পশিক্ষার প্রস্ত্ততি ঘটছে ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টসে। সেখানে ইতোমধ্যেই আছেন সুলতান, কামরুল হাসান। যোগ দিলেন কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম আর সফিউদ্দীন। ঢাকার পরিবেশ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হতে থাকলো এঁদের উদ্যম ও প্রচেষ্টায়। সময়ের গন্ডি পেরিয়ে শিল্পী-লেখকদের আদান-প্রদান তৈরি করলো নতুন চিন্তার খোরাক।
কাইয়ুম চৌধুরী লিখছেন, ‘সেই পঞ্চাশের দশকে লেখক শিল্পীদের একত্রে ওঠানামা, আড্ডা নিয়মিত ছিল। ভাবের আদান-প্রদান আমাদের উভয়েরই জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে। ফজলে লোহানীর অগত্যা পত্রিকায় চিত্রপ্রদর্শনীর আলোচনায় উত্তেজিত আমরা। একগাদা ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীর নাম সে-সমালোচনায় দেখে আমরা শিহরিত’ (‘আলেখ্য, শামসুর রাহমানের অ্যালবাম’)।
সফিউদ্দীন ১৯৫৭ সালে লন্ডনে শিক্ষাকালীন পর্বে ইউরোপীয় ছাপাই কাজ এবং অন্যান্য শিল্পধারার সঙ্গে পরিচিত হন। ছাপাই কাজ তাঁর এক মূল মাধ্যম হয়ে উঠলো। উইলিয়াম হেটারের ‘ভিসকোসিটি’ ধারা, ছাপাই কাজের আরেক আকর্ষণ, তাঁকেও ছুঁয়েছিলো। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী এই লন্ডন পর্বে, কিন্তু তারপর দীর্ঘ পাঁচ দশক তাঁর একক প্রদর্শনী হয়নি। তাঁর কাজ অবশ্যই প্রদর্শিত হয়ে চলেছে দেশে ও বিদেশে – লন্ডনে, সিঙ্গাপুরে, সুইজারল্যান্ডে। এছাড়া ভারত-তেহরান-টোকিও বিয়েনালে।
পূর্ব পাকিস্তান – বস্ত্তত এই পর্বে ঢাকায় শিল্পশিক্ষার কর্মকান্ড রূপ নিলো এবং প্রসারিত হতে থাকলো। আরো লক্ষ করার এই যে, বাস্তববাদী শিল্পধারার সঙ্গে যুক্ত হলো বিমূর্ত শিল্পধারা। সময়ের ছাপ সফিউদ্দীনের কাজেও বিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং মুক্তচিন্তার সাহস জুগিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের।
কিন্তু আবার সময় হয়েছে। দুর্যোগের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ডাক এসেছে পৌঁছাবার।

তৃতীয় পর্ব
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতোবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতোবার দেখতে হবে খান্ডবদাহন?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।’
(শামসুর রাহমান)

আবার বিচ্ছিন্ন হওয়া, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা এক রাজনৈতিক তান্ডবের মধ্যে দিয়ে। স্বাধীনতা, দেশ – এসবের অর্থ যেন বারে বারে মোড় নেয়। এই পরিক্রমায় সফিউদ্দীন, কিন্তু নিঃশব্দে, কোনো কথা রেখে গেলেন না – শুধু ছবি। এই অসামান্য শিল্পী এক আলোকিত পরিক্রমায় মিশে রইলেন। 